ঠোঁটের সিগারেট হাতে নিয়ে অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল ডরোথিও। দু-হাতে অরুণের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, পড়া শেষ হলে ফের এসো। বোলো কেমন লাগল। পারলে একটা গল্প লিখো টোনিকে নিয়ে। ইট মাস্ট হ্যাভ আ বিউটিফুল এণ্ডিং। খুব সুন্দর শেষ হতে হবে সে-গল্পের। তা সে যতই কষ্টের হোক।
কী মনে করে অরুণ বলল, গল্পই তো নিজে ঠিক করে শেষে কী হবে, তা কি আগে থেকে বলা যায়?
ডরোথি খুব বিষণ্ণ একটা হাসি মাখিয়ে রাখল মুখে, দরজা অবধি এগিয়ে দিল অরুণকে। দরজার ওপারে গিয়ে অরুণ কিছুটা যখন ঘুরে দাঁড়াল ‘বাই! বাই!’ বলবে বলে তখন কিছুটা আপনমনে ডরোথি বলল, গল্পের নায়িকাও জানবে না শেষ কোথায়?
উত্তরে অরুণ শুধু বলল ‘না’, তারপর বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
২.
সাত সাতটা দিন পড়ার টেবিলের সামনের বুক-র্যাকে দিব্যি শোভা পাচ্ছে আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিগুলো। অরুণ বোজ একবার মনে করে প্রথম খন্ডটা নামিয়ে পড়া শুরু করে। আর তা মনে হলেই কতকগুলো অদ্ভুত স্মৃতি ধেয়ে এসে অচিরে মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। ওর মনে পড়ে টকটকে লাল রঙের ডায়েরিগুলো কীরকম উন্মনা হয়ে বাড়ির গেটের ধাপিতে বসে বিড়বিড় করে পড়ত সুক। এক-আধবার অরুণকে দুটো-একটা শব্দের বানানও জিজ্ঞেস করেছে। শুনে কান থেকে কলম নামিয়ে বানানটা শুধরেও নিয়েছে। তারপর ফের ডুবে গেছে। নিজের লেখা ডায়েরি পড়ায়।
একবার চটে তিরিক্ষি অরুণের ওপর, কারণ ও বলেছে মেয়েদের শাড়িতে লাগানো হয় যে ব্রোচ তার বানান broach নয়, brooch। বলতে লাগল, কী পাগলের মতো বকবক করছ? তুমি বলতে চাও তোমাদের পারসি টিউটোরেস ডিনা মিস শাড়িতে যেটা লাগায় তার বানান brooch? নট broach? অরুণ হাতের মার্বেল গুনছিল, চোখ না তুলেই বলেছিল, এগজ্যাক্টলি! তখন ‘ধুত্তোর!’ বলে খাতাপত্তর গুটিয়ে বাড়ির ভেতরে হাঁটা লাগিয়েছিল সুক।
আরেক বার কীসব লিখছিল সুক একটা বেতের চেয়ারে বসে। চেয়ারটা গেটের ওই ধাপিটার পাশে রাখা। বিশেষ কোনো কৌতূহল থেকে নয়, এমনি এমনিই অরুণের চোখ চলে গিয়েছিল ওর ডায়েরির পাতায়, যেখানে আপনমনে কীসব লিখে চলেছিল সুক। অরুণের দৃষ্টি যে সেখানে লেপটে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য তার কারণ একটা শব্দ—Prostitute. নিতান্ত বালক, কিন্তু এই শব্দটা ওকে চিন্তায় ফেলার পক্ষে মোক্ষমই। অরুণ চোখে একটু কম দেখে। যদিও চশমা নিতে হয়নি। ও দূর থেকে কিছু পড়ার চেষ্টা করলে ভুরু কুঁচকে যায়। আড়চোখে সেটাই হয়তো দেখেছিল সুক, তাই ধমকে বলেছিল, চোখ ঘোরাও, দিস ইজ অ্যাডাল্ট স্টাফ।
কিন্তু ততক্ষণে যা পড়ার পড়া হয়ে গেছে অরুণের। আর ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া শুরু হয়েছে। সুক লিখেছে :
একদিন এক বেশ্যাকে সঙ্গে করে বাড়ি আনল বাবা, আর মার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছেন আমার স্ত্রী। সুন্দরী বেশ্যা বেশ অবাকই হয়ে প্রশ্ন করল, ওহ, তাই বুঝি! তোমার বউও আছে! তখন সাত বছরের আমার দিকে দেখিয়ে বাবা বলল, সঙ্গে একটি পুত্র। আমার প্রিয়তম আঁতোয়ান।
সুকের ধমকে একটু চমকেছিল অরুণ। তবে ঘাবড়ে যায়নি, কারণ ডায়েরির ওই শব্দটা ওকে এত ভাবিয়েছিল যে, তার একটা নিষ্পত্তির প্রয়োজন বোধ করছিল। ও হাতের গুলিগুলো পকেটে পুরে ফেলে বেশ স্পষ্ট করে জানতে চাইল, টোনি, তুমি সাত বছর বয়সেই জানতে পারছিলে যে বাবা যে-মেয়েটিকে তুলে এনেছে সে বেশ্যা? Prostitute শব্দটা তো আমি এই ক-দিন আগে জেনেছি। আর কে যে প্রস্টিটিউট তা কী করে জানব? জানা যায় কি?
সুক প্রথমে একটা গম্ভীর শব্দ করেছিল ‘হুম’! কিছুক্ষণ নীরব থেকে পরে বলেছিল, না, জানতাম না। প্রস্টিটিউট শব্দটার মানে জানতাম না। রাতে আমায় ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা-ই বলেছিল। বিছানায় ভারী কম্বলের তলায় শীতে নয়, রাগে কাঁপছিল মা। কাঁদছিলও। বলেছিল, অনেক সহ্য করেছি আঁতোয়ান, তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। আর পারছি না রে। যে-ছুঁড়িটাকে তোর বাপ তুলে এনেছে আজ, তুই জানিস ওটা কী? আ প্রস্টিটিউট! আ ব্লাডি হোর! যার মানে…
মাকে আর কষ্ট করে মানে বোঝাতে হয়নি। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে তুলে আনা মেয়েটার হইহই, চিৎকার, গান আর কত সব অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে। এরকম মেয়ে আসা আর এরকম শব্দটব্দ আমার কাছে নতুন নয়, কিন্তু সেই প্রথম আমি এদের মেলাতে শুরু করলাম মার কান্না আর প্রস্টিটিউট শব্দটার সঙ্গে। আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় মা নিজেই একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।
সুকের এই স্মৃতিটা মন থেকে মিলিয়ে যেতেই অরুণের মনে পড়ল ডরোথির মুখে শোনা একটা কথাও। সেই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে শোনা কথাটা আজও ভুলতে পারেনি অরুণ। পিজবোর্ড কেটে কেটে গঁদের আঠা দিয়ে এঁটে এঁটে বেশ একটা খেলনা এরোপ্লেন বানিয়ে ফেলেছিল সুক। তারপর তাতে রঙিন রঙিন কাগজ সেঁটে দিব্যি বাহারি করা হল সেটাকে। ছোট্ট ছোট্ট টিনের পাত দিয়ে প্লেনের নাকের ডগায় প্রপেলার বসানো হল। মোটা কলমে গা জুড়ে লেখা হল ‘টাইগার মথ। শেষে খেলার মার্বেল দিয়ে বানানো হলো তিন পিস চাকা। তখন খুব চেষ্টা চলল প্লেনটাকে মেঝেতে দৌড় করানোর।