শেষে ক্লাস নাইনে উঠে হোস্টেলে ভরতি হয়ে পড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে যেদিন, ডরোথি এল এক বাক্স চকোলেট নিয়ে। মা-র সামনে অরুণের হাতে চকোলেট তুলে দিয়ে বলল, তাহলে, অরু, তুমি সত্যিই বড়ো হয়ে গেলে?
অরুণ মিষ্টি করে বলেছিল, বলছ?
বড়ো বড়ো চোখ করে ডরোথি বলল, ইয়েস! অফ কোর্স!
তারপর ডরোথিকে বাড়ির গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, তাহলে টোনির চলে যাওয়া নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি?
একটু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ডরোথি, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো অরুণকে দেখেনি। সামনে, ওপারে নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে চোখ রেখে বলেছিল, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভালো করতে, অরু। আই রিয়েলি মিন ইট।
অরুণ আর কথা বাড়ায়নি। কিছুটা অভিমানে, কিছুটা হতাশায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বাড়ির গেটে। ডরোথি টরটর করে হিলতোলা জুতোর আওয়াজ তুলে ওপারের বাড়িতে চলে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে দেখল অরুকে, কিন্তু বাই! বাই!’ বলার মতো করে অরুর ডান হাতটা উঠল না।
ওর মনের চোখে ততক্ষণে ভাসছে আঁতোয়ান সুকের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভরদুপুরের দৃশ্যটা।
অরুণ বলল, আমি তো আজ সত্যিই বড়ো হয়ে গেছি, ডরোথি। আজ আমি সত্যিই তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি, টোনি চলে গেল কেন?
ডরোথি রেডিয়োগ্রামের পাশে রাখা একটা পুরোনো রুপোর কেস থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ধরল, আর কেসটা এগিয়ে দিল অরুণের দিকে। অরুণ একটা স্টিক বার করে ঠোঁটে তোলার আগে সিগারেটের ব্র্যাণ্ডটা দেখল। ও নামটা পড়ছে দেখে ডরোথির বেশ হাসি পেল, বলল—নিশ্চয়ই ভাবছ এই ভিখিরির দশায় আমি ‘সিনিয়র সার্ভিস অ্যাফোর্ড করছি কী করে? সত্যিই পারি না, তা ছাড়া ওই ব্র্যাণ্ডটা এখানে আসে না।
সিগারেটটা ধরিয়ে বসতে বসতে অরু বলল, কিন্তু এসেছে তো দেখছি। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল একটা বিশ্রী রকম কঠিন কথা বলা হয়ে গিয়েছে। কথাটা ঘোরাবার কথা ভাবছে যখন অন্য কিছু বলে ডরোথি এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হল ল্যাম্পের পাশের মোড়াটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, আমার শরীরের আর তেমন কিছু পড়ে নেই ঠিকই, কিন্তু কিছু অ্যাডমায়ারার্স তবু পড়ে আছে দেখি। ওদেরই একজন ডিকি। তুমি তো চিনতে ডিকিকে, তাই না?
অরুণ মাথা নাড়ল।-মিন্টো লেনের ডিকি? জাহাজের পার্সার?
ডরোথি বলল, এগজ্যাক্টলি! টোনি চলে যাওয়ার পর এতদিন ওরাই তো আমাকে সামলেছে। ও ট্রিপ করে ফিরলে আমার কিছুদিনের জন্য চারমিনারের হাত থেকে নিস্তার। তারপর কয়েক হপ্তা গেলে ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
হঠাৎ কীরকম চিনচিন করে উঠল বুকটা অরুণের। বলল, তোমায় সামলেছে মানে? ওদের কী স্বার্থ?
যেটা সব পুরুষের! একটু খিলখিল করে হেসে নির্লজ্জের মতো বলল ডরোথি।
তার মানে…? প্রশ্নটা আটকে রইল গলার মধ্যে অরুণের।
ঠিক। ঠিকই। গত চব্বিশটা বছর তো আমি শুধু টোনির জন্য বৃথা অপেক্ষাই করিনি। কিছু বৃথা বেশ্যাবৃত্তিও করেছি। করিনি কি?
‘বৃথা বেশ্যাবৃত্তি’! টং করে কথাটা বাজল মগজে অরুণের। সামান্য নাক সিটকে বলল, বেশ্যাবৃত্তি…তাও বৃথা…?
ডরোথি ফের একটা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল।–বৃথা তো বটেই। আশপাশের অবস্থা দেখছ না? পয়সার জন্য পুরুষ ধরলে এই হাল হয়? টাইপিস্টের চাকরিটাও ছাড়লাম মাত্র দু-বছর আগে।
তাহলে পুরুষ নিতে কেন?কেমন এক অভিমানের সুরে জানতে চাইল অরুণ।
এবার একটা রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে ডরোথি বলল, কে জানে, হয়তো টোনিরই একটা কথাকে সত্যি করতে।
কী কথা? —অরুণ জিজ্ঞেস না করে পারল না। হা হা হি হি করে হেসে কুটোপুটি যাচ্ছে তখন ডরোথি। স্কুলের বালিকার মতো প্রায় ওর এই অদ্ভুত হাসি থামানোর জন্যই অরুণকে ফের জিজ্ঞেস করতে হল—এত হাসির কী হল? বলোই না কথাটা।
এত হাসির পর ধোঁয়া টানা ঠিক হবে না ভেবে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে দিল ডরোথি। কিছুটা মেজাজ তৈরির জন্যই দামি বিলিতি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল অরুণ। আমেজে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল ওর, শুনল ডরোথি বলছে—তুমি খুব ছোটো ছিলে ঠিকই, তবু তোমায় একবার বলেছিলাম না? অরুণ জানতে চাইল কী কথা?
—যে, টোনি বেহদ্দ পাগল আমার এই শরীরটার জন্যে।
–হু। মনে আছে।
—ভালোবাসা দেখানোর সময় মাঝে মাঝেই বলত টোনি, তোমার এই অপূর্ব শরীর শুধু একটা লোকের ভোগে থাকা ঠিক নয়। তোমার বেশ্যা হওয়া উচিত!
ডরোথি কথাটা শেষ করতেই ও আর অরুণ হো হো হি হি করে দমফাটা হাসিতে ভেঙে পড়ল। হাসির তোড় সামলাতে সামলাতে অরুণ কোনোমতে জিজ্ঞাসা করল, তা তুমি কী বলতে? ডরোথি ফের একটা সিগারেট ধরাবার উদ্যোগ করল; বলল—বলতাম ওহ, দ্যাটস ওয়াণ্ডারফুল! কাল থেকেই শুরু করি? তাতে টোনি বলত, কাল কেন? আজ থেকেই হতে পারে। যখন বলতাম আজ বললে একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। হঠাৎ করে কাকে ধরব এখন? তখন টোনির জবাব আসত, কেন, এই আমাকে দিয়ে! তোমার ফাস্ট কাস্টমার।
এতগুলো কথা বলে চুপ করে গিয়েছিল ডরোথি। হল ল্যাম্পের নিবু নিবু আলোয় এত রোমান্টিক একটা সংলাপ এমনভাবে থমকে যেতে অরুণের কৌতূহল যেন আরও তীব্র হল। ও জানতে চাইল, তাতে তুমি কী উত্তর দিতে ডর?
ডরোথি ওর সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলেছিল। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ওর ওই ফাস্ট কাস্টমার কথাটা আমার ভালো লাগত। তাই প্রতিবার আমি শেষ করতাম আর আমার শেষ খদ্দের! বলে।