আজ মতিনউদ্দিনের নিদ্রাহীনতার কারণটি কিন্তু একদিনের মোহ নয়। বস্তুত, আজ সন্ধ্যায় বেড়ার নিকট হতে ফিরে আসার পর হঠাৎ সে বুঝতে পারে, স্বপ্নের সুতন্বী নারীটি তার হৃদয়বিদারক আবেদন ক্রন্দনসহ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন সজ্ঞানভাবে সে নারীর কথা স্মরণ করলেও হৃদয়ে ভাববেগের ঢেউ ওঠে না, দেহে মধুর ঝংকার জাগে না। প্রথমে সে একটু ক্ষোভ বোধ করে, তারপর মনে স্বস্তিই পায়। এখন যে কথা তার ঘুমের ব্যাঘাত করে তা হচ্ছে এই। স্বপ্নের মায়াময়ী নারীর হাত থেকে সে নিস্তার পেয়েছে বটে কিন্তু সে যেন এখনো ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করে নাই : সূতম্বী নারীটি তাকে নিরবল অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। যে পাখায় ভর করে একদিন সে উড়ে বেড়িয়েছিলো সে-পাখা আর নাই বটে কিন্তু সে তার পায়ের তলে শক্ত জমি এখনো ফিরে পায় নাই। তাছাড়া তার কণ্ঠেও এখনো ভাষা ফিরে আসে নাই। শুধু তাই নয়, হঠাৎ খালেদা সম্বন্ধে এমন একটি তীক্ষ্ণ সচেনা সে বোধ করে যে একটু নড়বারও সাহস সে পায় না যেন। তবে তার সন্দেহ। নাই, একবার সে ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারলে তার নিরাবলম্বভাব, তার বাকশূন্যতা এবং খালেদার বিষয়ে তীক্ষ্ণ বেদনাদায়ক সচেতনাটি দূর হয়ে যাবে, কিন্তু কি করে সে মৃত্তিকাময় স্থূল পৃথিবীতে প্রত্যবর্তন করে, কি করেই বা তার সাধারণ স্বাভাবিক জীবন পুনঃগ্রহণ করে?
সাহায্য আসে অপ্রত্যাশিত অঞ্চল থেকে।
বেহেস্ত-প্রেরিত একটি ফেরেশতা অতি দক্ষতার সঙ্গে তাদের মশারির মধ্যে অদৃশ্য একটি ছিদ্র আবিষ্কার করে। সে-ছিদ্র দিয়ে সে মশারিতে প্রবেশ করে কয়েক মহুর্ত বিজয় উল্লাসে নৃত্য করে। অবশ্য তার আবির্ভাব অলক্ষিতই থাকে। গব্যস্থলে পৌর প্রশংসনীয় দক্ষতা সত্ত্বেও মনস্কামনা চরিতার্থ করার ব্যাপারে অশেষ ধৈর্য অধ্যবসায় থাকা সত্ত্বেও ফেরেশতাটি একটি অতিক্ষুদ্রকায় জীবন, দিনের বেলায় তার ছায়া পড়ে না কোথাও, রাত্রে অন্ধকারে সে অদৃশ্যই থাকে।
গ্যস্থলে পৌঁছানোর আনন্দোচ্ছাসটি কাটলে বেহেস্তপ্রেরিত ফেরেশতাটি এবার আপনকার্যে মনোনিবেশ করে। কাপড়ের বান্ডিলটি উপেক্ষা করে সরাসরি মতিনউদ্দিনের ঘর্মাক্ত ডান গালে সে অবতীর্ণ হয়। তার স্বীয় পাখাদুটিতে আলগোছে বার কয়েক ঝাঁপটা দিয়ে সে হঠাৎ নিশ্চল হয়ে পড়ে।
একটু পরে আকস্মাৎ চাপড়ের মতো উচ্চ আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রে গভীর নীরবতা মতিনউদ্দিনের নিকট আর্তনাদের ভঙ্গুর কাঁচের মতোই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিজের গালে চাপড় দিয়ে এবং আর্তনাদ করেই মতিনউদ্দিন ক্ষান্ত হয় না। দুর্ধর্ষ গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলে, মশারিতে হাজারো মশা। কি করে মানুষ চোখ বোজে?
তারপর মশারিতে যে মশার অন্ত নাই সেকথাই প্রমাণ করার জন্যে সে ঠাসঠাস করে নিজের দেহের নানা স্থানে চড়-চাপড় মারে। মশা মারতে সে কামান দাগে।
অন্যদিন হলে খালেদা উঠে মশারিটা ঝেড়ে আবার সযত্নে গুঁজে দিতো। আজ সে নড়ে না।
মতিনউদ্দিন অবশেষে শান্ত হয়। শবিজয়ী সেনাপতির মতো আত্ম সচেতভাবে কিছুক্ষণ নড়েচড়ে সে যখন ঘুমের আয়োজন করে, তখন তার পিঠটা খালেদার পিঠের সঙ্গে একটু লেগে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে সে সংস্পর্শ মধুর না হলেও মতিনউদ্দিন সরে না।
খালেদার চোখে যখন নীরব অশ্রুর আবির্ভাব হয় তখন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে এমন রব তুলে মউিদ্দিন নাক ডাকতে শুরু করেছে।