কাজেই হ্যারিকেন তেজ করে রাখলেও খালেদা শেষ পর্যন্ত স্বামীকে কোন প্রশ্ন করে না, তার পরিবর্তনের কারণও জানতে পারে না। তাতে অতি প্রত্যুষে উঠে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে স্বামীটি যখন আঙ্গিনায় বসে চুপচাপ হয়ে তাকে, তখন তার মনে একটা ভয়ের সঞ্চার হয়। তার স্বামীটির হলো কি?
জাগ্রত সময়ের প্রতি মুহূর্তে মানুষ কিছুনা-কিছু ভেবেই চলে। তবে প্রত্যেকের চিন্তাধারার স্বরূপটা নিজস্ব। খালেদার মনে চিন্তাধারাটি দুই বন্ধুর আলাপ-আলোচনার রূপ গ্রহণ করে।
খালেদা তার মনের বন্ধুকে বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্ধু উত্তর দেয়, বোঝা মুশকিল।
তারপর খালেদা এবং তার মনের বন্ধু দু’জনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকে।
নির্বাক হয়ে থাকলেও একটা কথা দু’জনের মধ্যেই উকিঝুঁকি মারে। কেবল সেটা তুলতে কারো সাহস হয় না। অবশেষে তার বন্ধুই বলে, আমার কি মনে হয় জানো?
কি? সে উত্তর দেয়।
মনে হয় কোন মেয়েলোকের ওপর তোমার স্বামীর দিল পড়েছে।
সে টক করে উত্তর দেয় না। কথাটা সে যেন বোঝে না। দিল পড়ার অর্থ কি? কেনই বা একটি পুরুষের দিল একটি মেয়েমানুষের ওপর পড়ে? তাছাড়া, সে-ও কি মেয়েমানুষ নয়?
তার মনের বন্ধু উত্তর দেয়, হয়তো মেয়েলোকটি সুন্দরী।
খালেদা কিন্তু তার মনের বন্ধুর কথা মানতে চায় না। মাথায় একটু ঝামটা দিয়ে বলে, আমি জানি তার কি হয়েছে।
কি হয়েছে?
কোন ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে। মনের বন্ধু হাসে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে না কচু হয়েছে। দেখ না কেমন যত্ন করে সিঁথি কাটে আজকাল, মুখে-চোখে কেমন আবেশ?
খালেদা জবাব দেয় না। সে নিজেই বোঝে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়লে খোদারসুলকেও মনে পড়ে। কিন্ত মতিনউদ্দিনের মধ্যে বিচিত্র পরিবর্তনটা আসার পর সে একদিনও কলমা পর্যন্ত মুখে নেয় নাই। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। সে মনের বন্ধুকে বলল। একটু থেমে আবার বলে, তবে চিন্তার কারণ নাই। ভেবেছিলাম, তার অসুখ-বিসুখ হয়েছে বুঝি।
মনের বন্ধু মুখ টিপে হাসে।
সুন্দরী মেয়েমানুষের ওপর তোমার স্বামীর মন পড়লে চিন্তার কারণ নাই?
চিন্তার কি কারণ? গোয়ার্তুমির ভাব করে খালেদা উত্তর দেয়।
যদি তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে বিয়ে করে?
আবার কিছুক্ষণ খালেদা নীরবে ভাবে। তারপর আরেকবার মাথায় ঝামটা দিয়ে বলে, আমি চলে যাব।
সে ভাবে, অন্য একটি বউ ঘরে নিয়ে এসে তাকে তাড়িয়ে দিলে সে বাপের বাড়িতে না-হয় ভাই-এর বাড়িতে চলে যাবে। এখানে ভাত কাপড়টা পায়, বাপ-ভাই এর বাড়িতেও ভাত কাপড়টাও পাবে। দেশের বাড়িতে ক্ষেতখামার আছে, কুমড়ো শাকবজি আম-কাঁঠাল আছে, গাই-ছাগল আছে, এখানে উঠান ছাড়া আছে কি?
কিন্তু তুমি একটি মানুষের বউ। তাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না?
আবার একটু ভেবে খালেদা জবাব দেয়, কষ্ট কিসের? যেতে হলে যাবো।
মতিনউদ্দিনের চিন্তাধারাটা ভিন্ন ধরনের। তার মনের প্রাসাদের থামের আড়ালে দেয়ালের আনাচে-কানাচে অসংখ্য শ্রোতা। তবে তারা নীরবেই তার কথা শোনে। কেবল তারই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি জাগে মনের সেপ্রাসাদের কক্ষে কক্ষে।
তবে তার মধ্যে ঘোর পরিবর্তনটি আসার পর তার চিন্তাধারার রূপটাও বদলেছে। আজ তার মনের প্রাসাদ নির্জন, সেখানে শ্রোতারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে নিঃসঙ্গ প্রাসাদের অসীম ভার সে একাই বহন করে বেড়ায়—আপিসে দীর্ঘ ঘরে হোক, মিষ্টমধুর কলতানমুখর নদীতীরে থোক, আপন ঘরেই হোক। তার এই নিঃশব্দ জগতে একটি কাক পর্যন্ত নাই যে-একটু শব্দের লহরি তুলবে।
আসলে একটা নিদারুণ ভয় পাথরের মতো ভারি হয়ে চেপে আছে তার মনে। সে ভয়েই নিজের মনে কোন কথা তুলতে সাহস পায় না। কি হয়েছে তার?
সে বোঝে, ভয়ের তলে আসলে আছে একটি বিচিত্র মিগ্ধভাব—এমন-এক ভাব যার স্পর্শে এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে ফুটে ওঠে, ধানের ক্ষেতের মধুর হাওয়ার ঢেউ জাগে। সত্য কথা বলতে কি, সে প্রেমেই পড়েছে কেবল কথাটা স্বীকার করার সাহস তার নাই। না হলে পাথর ঠেলে যে-মিগ্ধ মনোরম ভাবটি বারেবারে তার মনে ছেয়ে ফেলতে চায়, তাকে সে বাধা দিতো না।
সে যে তার পারিবারিক জীবনের বা খালেদার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আপন মনে এই সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তা নয়। বস্তুত, এ-পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও সেসব কথা তার মনে পড়ে নাই। সে-যে দায়িত্বহীন তাও নয় পারিবারিক শাসন-সংযমের খাতিরে কঠোর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সে বিশ্বাসী বলে তার মনোভারে বাহ্যিক কোন পরিচয় সে দেয় না। কিন্তু খালেদার প্রতি তার স্নেহ-মমতা-দায়িত্ববোধের অন্ত নেই।
যে কারণে পরিবারের কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনের আকাশে উদয় হয় না তা এই যে, তার হৃদয়ে যে প্রেমের ভাবটি জেগেছে তা অতি বিচিত্র। আসলে তার কোন বাস্তবরূপ নাই; সে-প্রেমের উৎপত্তি স্বপ্নের মধ্যেই। তবু আজ কদিন ধরে তা-তাকে গম্ভীরভাবে আবিষ্ট করে রেখেছে তার মানসিক সংগ্রামের এবং ভয়ের কারণ তাই। সেজন্যেই তার মনের প্রাসাদ কেচ্ছা কাহিনীর অভিশপ্ত কোন প্রাসাদের মতো নিস্তব্ধ নির্জন।
স্বপ্নের কথাটি সে ভাবতে চায় না। ও বারবার তারই অজ্ঞাতে তার মনে তা ভেসে ওঠে এবং প্রতিবারই তাকে কেমন অবশ করে ফেলে।
তার স্বপ্নটি এই। সে পুরুকে গোসল করতে যাচ্ছে, হাতে লাল গামছা। সেদিন কোন কারণে তার বড় তাড়াতাড়ি। হয়তো আপিসে যাওয়ার সময় উতরে গেছে। ঘরের বউটিও রান্না করতে দেরি করেছে। গোসল করতে গিয়েও তার আবার দেরি হয়, কারণ সে দেখতে পায় পুকুরের ধারে মস্ত একটা বাজার বসেছে। মানুষের হৈ হট্টগোল, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি, গরু-ছাগলের পায়ের ধুলায় স্থানটি ভরপুর। ভিড়ের মধ্যে অসংখ্য মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি। করে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় দুর্ধর্ষগোত্রে একটি পুলিশ এসে তার হাত ধরে। তারপর মুহূর্তে কোথাও সব গোলমাল হয়ে যায় যেন। সে যেমন জানে তেমনি পুলিশও জানে, সে নির্দোষ। লু সে দৌড়তে শুরু করে প্রাণপণে। শীঘ্র সে ভোলা মাঠে এসে পৌঁছয়, উন্মুক্ত হাওয়ায় তার বুক ভরে ওঠে। পুলিশ তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। লু তার ভয়টা সম্পূর্ণভাবে যায় না। ক্ষেত্রে আল ধরে পুর্ণোদ্যমে আবার সে ছুটতে শুরু করেছে। এমন সময় সারা আকাশ খণ্ডবিখণ্ড করে একটি নারীর আর্তনাদ জেগে ওঠে। সে নারীর আর্তনাদে কি ছিলো কে জানে, কিন্তু পুলিশের ভয় ভুলে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে সে দাঁড়িয়ে। পড়ে। শীঘ্র সে বুঝতে পারে, নারীকণ্ঠ আর্তনাদ করে তাকেই ডাকছে। উদভ্রান্তের মতো সে এদিক-ওদিক তাকায় প্রথমে কোথাও কাউকে দেখতে পায় না। তারপর বিস্ময়ে সে দেখে, সামান্যদুরে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে একটি সুতন্বী নারী। তার পরনে উগ্র লাল বর্ণের শাড়ি, মুখে কেমন বেদনাভরা নমনীয়তা। তাদের চোখাচোখি হতেই নারীটি তাকে হৃদয়বিদারক কন্ঠে অনুরোধ করে, সে যেন তাকে ফেলে না যায়। পরক্ষণেই উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সে যেন বুঝতে পারে, মতিনউদ্দিন তাকে ফেলে চলে যাবেই। এসময় মউিদ্দিনের ঘুম ভেঙে যায়, স্বপ্নেরও অবসান ঘটে।