তবে বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র সেমানুষেরই চেহারা-হাবভাবে একটি বিষম পরিবর্তন ঘটে। বাইরে মতিনউদ্দিন এবং ঘরের মতিনউদ্দিনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ইট-তর্জা, টিনযোগে কোন মনে দাঁড়া করিয়ে রাখা তার ক্ষুদ্র বাসস্থানটি তার নতুন চরিত্রে স্পর্শে প্রাসাদে পরিণত হয়, এবং ঘরে তার স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় কোন লোক
থাকলেও মনে হয় যেন তার হুকুম তামিল করবার জন্য মোসাহেব-গোমস্তা বাবুর্চি-খানসামা পেয়াদা-কাবরদারের অন্ত নাই। তখন তার ত্রিশ-ইঞ্চি বুক থেকে অহরহ বাঘের মতো আওয়াজ বের হয়। তবে বন-জঙ্গলের শক্তিশালী পশুটির মতো তার সিনাটা গভীর নয় বলে মনে হয়, নিনাদ প্রচেষ্টায় যে-কোন সময়ে তার রগ ফেটে যাবে। মতিনউদ্দিনের খড়মেও কম আওয়াজ হয় না। বরাবর দেখে-শুনে শক্ত মজবুত খড়ম কেনে সে। বস্তুত, তার ঘরের জাদরেল সত্তাটির একধারে তার গলা অন্যধারে। খড়ম।
তিন বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তার বউ খালেদা এখনো জানে না। কখন তার স্বামী হুঙ্কার দিয়ে উঠবে, কখন হুড়ুম করে লাফিয়ে যাবে উঠান থেকে কাক কুত্তা তাড়াতে। সেজন্যে সত্যিই পান থেকে চুন খসার প্রয়োজন নাই, উঠানে কাক কুত্তার উপস্থিতির দরকার নাই। দিনের মধ্যে কতবার যে খালেদার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে, তার ঠিক নাই।
খালেদাও ছোটখাটো মানুষ। গোপনে শরীরে একটু-যে মেদমাংস হয়েছে সে ধরটা ঢাকতে চেষ্টা করে নিঃশব্দে আলগোছে হেঁটে, দেহটা কাপড়ে জড়িয়ে রেখে। অবশ্য এ-বিষয়ে তার লজ্জার কোন অর্থ নাই, সাবধানতাও নিষ্প্রয়োজন। মউিদ্দিন কখনো তার বউ এর দিকে চোখ খুলে তাকায় না। তাকালেও বুঝবে না যে তার স্ত্রী কেমন একটু মোটাসোটা হয়ে উঠেছে। দোষভাবটা খালেদার মনেই। মোটা-হওয়া মানে খেয়েদেয়ে সে আরামেই আছে। সে কথা প্রকাশ করতে তার লজ্জা হয়। বিশেষ করে স্বামীটি যখন তেমন রোগাপটকাই থাকে।
তারপর একদিন অকস্মাৎ মতিনউদ্দিনের মধ্যে একটি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটে। এমন আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটে বিনা খবরে, তার অব্যবহিত পূর্বে ক্ষীণতম ইঙ্গিত ছাড়া। পরিবর্তনটি শুরু হয় সকালেই, কিন্তু খালেদা তা লক্ষ করে সন্ধ্যাবেলায়। সেদিন আপিস থেকে ফিরে বেড়াঘেরা ক্ষুদ্র উঠানে বসে মতিনউদ্দিন কেমন নীরব হয়ে থাকে। বসার ভঙ্গিটা শিথিল, দৃষ্টি মাটির দিকে। নিত্যকার মতো চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে আসে খালেদা। মতিনউদ্দিন চা পান করে বটে কিন্তু অন্যদিনের মতো থেকে থেকে তৃপ্তিসূচক উচ্চ আওয়াজ করে না। তারপর খালেদা কাটা নিয়ে এলে সে ধূমপানও করে, কিন্তু আজ ইঞ্জিনের ধুয়ারমতো রাশি রাশি ধুয়া নির্গত হয় না, কার পানিতে দুর্দান্ত গড়গড় আওয়াজও হয় না। ধূমপান শেষ করেও মতিনউদ্দিন কেমন নিস্তেজ ভাবে বসে থাকে, বেড়ার ওপর বসে একটা কাক তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করলেও সে টু শব্দটা করে না। এদিকে সূর্য ডুবে যায়, আকাশে চাঁদ ওঠে, পাশের বাড়িতে ছেলেটি উচ্চকণ্ঠে ইতিহাস পাঠ খতম করে ঘুমোতে যায়। খালেদা চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু উঠান থেকে কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে না, খাবার তৈরি হয়েছে কিনা।
তিনদিন কাটলেও মতিনউদ্দিনের এ-অত্যাশ্চর্য ব্যবহার শুধু-যে অব্যাখ্যাত থাকে তা নয়, তার সেব্যবহারে কোন তারতম্যও হয় না। সেদিন রাতে খাবার সময়ে হ্যারিকেনটা একটু তেজ করে রাখে খালেদা। স্বামীকে সে ভালো করে দেখতে চায়, যদি বুঝতে পারে তার পরিবর্তনের কারণ। সে দেখে, মতিনউদ্দিনের মুখে ব্যথা বেদনার কোন স্পর্শ নাই, থমথমে ভাব নেই, কিন্তু গভীর ঘুম থেকে থেকে জেগে ওঠার-পর বেদনার কোন স্পর্শ নাই, থমথমে ভাব নেই, কিন্তু গভীর ঘুম থেকে জেগে-ওঠার-পর মানুষের মুখে যেমন একটা আবেশ দেখা যায়, তেমনি একটা আবেশে তার সারা মুখ আচ্ছন্ন। হাত-মুখ নড়ে, কিন্তু তার মনটা যেন ঘুমিয়ে। কিংবা দেহ-পরিত্যাগ করে তার মনটি কোথাও নিরিবিলি স্থানে গাছের ডগায় একাকি বসে আছে।
খালেদার চোখ স্বামীর ওপর থাকে বলে গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে যায়। মেঝেটা মাটির বলে সেটি না ভাঙলেও পানি ছড়িয়ে পড়ে। সভয়ে খালেদা স্বামীর দিকে তাকায়। কিন্তু স্বামীর চোখ বর্তন থেকে ওঠে না। তারপর খাদ্যের গন্ধ পেয়ে একটি নোমছাড়া কুকুর চোরের মতো অনিশ্চিতভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে তাকালে একটু অপেক্ষা করে খালেদাই আজ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেয়।
এবার হঠাৎ খালেদার মনে হয় মউিদ্দিনের ব্যবহার আর সহ্য করা যায় না। স্বামীর হুঙ্কার গর্জন লাফাঝাপি সহ্য হয়, কিন্তু তার এই পরিবর্তন সহ্য করা হয় না। কিন্তু সে কি করবে? স্বামীকে কোন প্রশ্ন করা যায় না। তিন বছরের পারিবারিক জীবনে তাদের মধ্যে এমন একটি আদত গড়ে উঠেছে যে, কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সহজ নয়। কাক কুত্তা ত্যক্ত করলে তা নিয়ে কথা হতে পারে, কিন্তু স্বামী একমাস কথা না বললেও তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না তার মৌনতার হেতু। অনেক হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে, গুরুর কথারও উত্থাপন করে মতিনউদ্দিনের ঘরে তা সম্ভব হয়। বিয়ের প্রথম মাসেই তার স্বামী পরিষ্কারভাবে তাকে বলে দিয়েছিলো যে, হাসি-ঠাট্টার মানুষ সে নয়। একদিন রাতের বেলায় মতিনউদ্দিন যখন তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছিলো, তখন মস্করা করে হাল্কাভাবে সে তার পিঠে একটু খোঁচা দেয়। তৎক্ষণাৎ মতিনউদ্দিন বিপুলবেগে লাফিয়ে উঠে রেগে লাল হয়ে তাকে প্রশ্ন করে, গুতা দেও কেন? সেদিন থেকে খালেদার মস্করায় কোন সাধ নেই। অবশ্য তাতে খালেদার কোন আফসোস নাই। তার মতে, স্বামীর আইনকানুন আচার ব্যবস্থা স্ত্রীকে মানতেই হয়।