একটু গাছের আড়ালে গিয়ে কর্নেল ডাইনে ঘুরলেন। তারপর গঙ্গার ধারে একটা বটগাছের তলায় গেলেন। চোখে বাইনোকুলার রেখে বাড়িটা দেখতে থাকলেন।
লোকটা ঘরে ঢুকে গেল সদ্য। মিনিট দুতিন লক্ষ্য রাখলেন কর্নেল। কিন্তু তাকে বেরুতে দেখলেন না। দোতলা বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ।
এবার গাছতলায় বসে গঙ্গার শোভা দেখতে থাকলেন। এক ঝাঁক হাঁস গঙ্গার ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে বাঁকা রেখার মতো। ভরা গঙ্গায় পালতোলা নৌকো। খেয়া নৌকো। একটা লঞ্চ। চিরাচরিত দৃশ্য।
হ্যাঁ, গোমেশ নিজেও লুকিয়ে কবরের ফলক বেচতেন। ওই লোকটার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল। পেছনে একটা চক্রও আছে। কিন্তু তার সঙ্গে টিনি হত্যারহস্যের সম্পর্ক কী?
ছেঁড়া চিঠিটা এবং গোমেশের হঠাৎ অন্তর্ধান…
খুব জট পাকিয়ে গেল ব্যাপারটা। টিনি সম্পর্কে যে ওই নিউজপ্রিন্টে অনবদ্য আখ্যায়িকা লিখেছে, সে-ই টিনিকে লেখা একটা চিঠি গোমশকে দিয়েছিল, টিনিকে দেবার জন্য। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে লিখেছিল। কী কথা?
গোমেশকে সবার আগে খুঁজে বের করা দরকার। সে আর কোথায় যেতে পারে, সে-খোঁজ এমা সম্ভবত দিতে পারবেন। অতএব এমার সঙ্গে দেখা না করে কলকাতা ফেরা উচিত নয়।
তিনটে পনের বাজে, একটা রিকশো দেখতে পেলেন কর্নেল। রিকশোয় এক মেমসায়েব এবং এক দিশী সায়েব। রিকশোটা ইভনিং ভিলার দিকে ঘুরলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।
রিকশো থেকে দুটিতে নেমেছে, কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে বললেন, গুড আফটারনুন!
দুজনেই তাকালেন। পুরুষটির চেহারায় রুক্ষ ভাব। চোখের তলায় কালচে ছোপ। চল্লিশের মধ্যে বয়স।
কর্নেল বললেন, আশা করি মিসেস এমা এবং মিঃ ঘোষকেই আমি দেখছি!
ঘোষসায়েব কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, তার আগে এমা বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলুম না!
আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইলিয়ট রোডের আন্ডারটেকার মিঃ ডেভিড প্যাটার্সনের স্ত্রী মিসেস বারবারা আমার পরিচিত। তিনি আপনার দিদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। বলে কর্নেল চিঠিটা দিলেন এমাকে।
এমা চিঠিটা পড়ে বললেন, কিন্তু দিদি তো নেই।
দিদি নেই, কিন্তু তার বোন আছেন! কর্নেল একটু হেসে বললেন। আশা করি, তাঁর সহযোগিতা পাব।
এমা একটু পরে বললেন, ওকে। ভেতরে আসুন।
সেই লোকটা দৌড়ে এসে গেট খুলেছিল। দম্পতি আগে ঢুকলেন। পেছনে কর্নেল। তার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা কর্নেলকে চোখ টিপল। এর একটাই অর্থ হয়। পাথর সম্পর্কে কোনও কথা যেন কর্নেল না তোলেন। লোকটা হাত দুটো জোড়ও করল।
হুঁ, লোকটাকে যতই গুণ্ডা দেখাক, নেহাত ভিতু ছিচকে। হয়তো বাঘের পেছনকার ফেউয়ের মতো কিছু বখরাকড়ি পায়-টায়। কর্নেল মুচকি হেসে চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলেন।
মেমসায়েব বারান্দায় ওঠার সময় বললেন, কাল্লু! দরওয়াজা-জানলা বন্ধ কাহে? তুমকো বোলা, কভি বন্ধ নেহি রাখনা। হওয়া পাস নেহি করে গা। খুল দো জলদি!
কাল্লু কঁচুমাচু মুখে বলল, আভি খুল দেতা মেমসাব! একেলা থা। হম্! চোট্টাউট্টাকা ডর লাগতা থা। ইস্ লিয়ে…।
শাট আপ! এমা ধমক দিলেন। কভি এইসা না কিও।
কাল্লু দৌড়ে ঢুকে প্রথমে বসার ঘরের জানালা খুলে দিল। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল। এমা কর্নেলকে বসতে বললেন। ততক্ষণে পাশের ঘরে জানালা খোলার শব্দ এবং তার একটু পরে ওপরেও। একটু হেসে বললেন, পুরনো বাড়ি। এই আবহাওয়ায় স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ওঠে। অথচ কাল্লু বড় ভিতু। আমরা না থাকলেই জানালাগুলো বন্ধ করে ফেলবে। যাই হোক, গোমেশদাকে টাকা ধার দেওয়া নিয়ে এর আগে অনেক ঝামেলা দিদিকে পোয়াতে হয়েছে। বারবারাদির কথা আলাদা। কিন্তু অন্য যারা টাকা ধার দিয়েছে, সবাই কিন্তু পাথর কেনার জন্যই দিয়েছে। না, না–আমি বলছি না, আপনিও একই উদ্দেশ্যে দিয়েছেন। আপনাকে সেরকম লোক মনে হচ্ছে না।
কর্নেল দ্রুত বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, ম্যাডাম! আমি একজন নেচারিস্ট-প্রকৃতিপ্রেমিক। ওই কবরখানায় প্রচুর গাছ আর পাখি। এই দেখছেন বাইনোকুলার। পাখি দেখতে গিয়ে মিঃ গোমেশের সঙ্গে পরিচয়। তো, উনি কি এখানে এসেছেন?
…এলে কাল্লু আমাকে এখনই জানাত। কাজেই আসেনি। তা ছাড়া এ বাড়িতে ওকে দিদি ঢুকতে বারণ করেছেন। আমি তো দিদির চেয়ে আরও কড়া। ওকে বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখলে ভাগিয়ে দিই। কারণ, কবে না আমাদের চোরাপাথরের কারবারে ফাঁসিয়ে দেয়! এমা শক্তমুখে কথাগুলি বললেন।
কর্নেল বললেন, গোমেশের কবরখানার ঘরের দরজা বন্ধ। খবর নিয়েছি, উনি কোথায় চলে গেছেন। দয়া করে যদি জানান, আর কোথায় ওঁর যাওয়ার চান্স আছে?
এমা মাথা নেড়ে একটা ভঙ্গি করে বললেন, যাবে কোন চুলোয়! অবশ্য ওর সঙ্গে চোরচোট্টাদের ভাব আছে। কলকাতায় কোথাও থাকতে পারে। আপনি বরং পুলিশে খবর দিন। ওর এবার শাস্তি হওয়া দরকার!
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনাদের বাড়িটা একবারে প্রকৃতির রাজ্য। বড় সুন্দর পরিবেশ।
এমা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আর পরিবেশ! সব জঙ্গল হয়ে গেল। কী ছিল এই বাড়ি ব্রিটিশ স্বর্ণযুগে! এখন নরকের মাঝখানে আছি। চারদিকে চোর ডাকাত। আইন-শৃঙ্খলা নেই। ভাবছি, শিগগির বাড়ি বেচে দিয়ে আমরা বাইরে চলে যাব।
বলে কর্নেলকে এতক্ষণে ভাল করে লক্ষ্য করে হাসলেন। ইউ লুক আ ফরেনার! জাস্ট লাইক আ ক্যাথলিক ফাদার! হাউ ফানি! ইউ আর আ কর্নেল! ডিড ইউ সার্ভ আন্ডার দা গোল্ডেন ব্রিটিশ এম্পায়ার?