বারবারা স্বামীর কথায় সায় দিলেন। হ্যাঁ, ইভলিনের ঘাড়ে গিয়ে চাপতেও পারে। ইভলিনটা যে বড্ড বেশি দয়ালু মেয়ে।…
.
কর্নেল চন্দননগরে ট্রেন থেকে যখন নামলেন, তখন প্রায় বারোটা বাজে। ইভলিনকে এখন কলেজে পাওয়া যাবে। তাই রিকশো করে মিশনারি কলেজে গেছেন।
গিয়েই নিরাশ হলেন। ইভলিন তিন দিন আগে ছুটিতে গেছেন। সম্ভবত মুসৌরিতে বেড়াতে গেছেন।
কিন্তু তার বোন এমা ঘোষ আছেন। অন্তত থাকার সম্ভাবনা আছে। কারণ, দিদির সঙ্গে তিনিও মুসৌরি চলে যেতে পারেন। তবু শেষ চেষ্টা। গোমেশের খোঁজ যদি মেলে!
গোমেশ এই হত্যারহস্যের একটা প্রধান সূত্র।
রিকশোওলা গাঁইগুই করছিল। ওই এলাকায় রাস্তাঘাট নাকি ভাল নয়। বখশিসের লোভে সে শেষে রাজি হলো। গঙ্গার ধারে রাস্তা ধরে শহর এলাকা ছাড়িয়ে তারপর আমবাগান, বাঁশবন, জঙ্গল পোড়ো বাড়ির ভেতর দিয়ে কাঁচা পথ। বৃষ্টিবাদলায় কাদা আর খানাখন্দে ভরা। রিকশোওলা তেতো মুখে মাঝে মাঝে নেমে সাইকেল রিকশো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
কর্নেল তৈরি হয়েই বেরিয়েছেন। কিটব্যাগে লাঞ্চের প্যাকেট, হ্যাঁভারস্যাকে জল আছে। ফ্লাস্কভর্তি কফিও মজুত। বাইনোকুলার ক্যামেরা যথারীতি ঝুলছে গলা থেকে। হাতে প্রজাপতি ধরা নেটস্টিক। রথদেখা কলাবেচা দুই-ই হবে। বরাবরকার অভ্যাস।
বাঁ দিকে দূরে সুদৃশ্য হাউসিং কলোনি। একখানে রিকশোওলা গোঁ ধরে দাঁড়াল। আর যেতে পারব না স্যার! ওই দেখুন কত্তো জল। আপনি দয়া করে চলে যান।
সত্যি আর রিকশা যাবে না। অগত্য নেমে পড়লেন। বখশিস অবশ্য কথামতো দিলেন। রিকশোওলা একটু বিশ্রাম নিতে বসল একটা গাছের তলায়।
কর্নেলের পায়ে গামবুট। জলকাদা ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন, ইভলিন কলেজে যান কোন রাস্তায়? নিশ্চয় ভুল রাস্তায় এসে পড়েছেন। সম্ভবত ওই হাউসিং কলোনির ভেতর দিয়ে ভাল রাস্তা আছে।
হ্যাঁ, ভুলটা নিজেরই। দূরত্বটা বেশি হতো ওদিকে গেলে। কিন্তু নিজেই গঙ্গার শোভা এবং পাখি-প্রজাপতির ধান্দায় এদিকে নিয়ে এসেছিলেন রিকশোলাকে।
তবে লাভ হলো। পাখির রাজত্ব এদিকটায়। কত রকমের প্রজাপতিও। সাধারণ প্রজাতির প্রজাপতি বলে নেটে ধরার চেষ্টা করলেন না। জঙ্গুলে এলাকা। মুসলিম গোরস্তান। ভাঙা মসজিদ। কোথাও ধ্বংসাবশেষ।
একটা বাজে। গঙ্গার ধারে বসে লাঞ্চ সেরে নিলেন কর্নেল।
চুরুট ধরিয়ে আবার হাঁটতে থাকলেন। এবার গাছপালার ফাঁকে জরাজীর্ণ কিছু বাড়ি চোখে পড়ল। বনেদী বড়লোকের বাড়ি ছিল একদা। কিন্তু মানুষজন চোখে পড়ল না। এগুলো বাগানবাড়ি বলেই মনে হচ্ছিল। খানিকটা এগিয়ে বা দিকে সুরকি-বিছানো ক্ষয়টে এক ফালি সংকীর্ণ রাস্তার ধারে একটা গেট। গেটের মাথায় বোগনভেলিয়ার ঝুঁপি। নিচু পাঁচিলঘেরা একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। গেটের ফলকটা টুটাফাটা। লেখা আছে; ইভনিং ভিলা। এই সেই বাড়ি!
গেট বন্ধ। গরাদ দেওয়া গেট। ভেতরে ফুলবাগিচা অযত্নে জঙ্গল হয়ে আছে। বাড়ির সিঁড়ির মাথায় খোলা পার্লারে একটা হাফপ্যান্ট গেঞ্জিপরা লোক বসে পালক দিয়ে কান চুলকোচ্ছে। আরামে চোখ বন্ধ। কর্নেল খুক করে কাশতেই সে তাকাল। তারপর হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে সেলাম দিল।
কর্নেল, মিসেস ইভলিনের ভাই গোমেশকে একটু ডেকে দাও না ভাই!
লোকটি হকচকিয়ে গেল। তারপর জোরে হাত নেড়ে বলল, গোমসায়েব নেই স্যার! তাকে এখানে পাবেন কে বলল? সে তো কলকাতায় থাকে।
কর্নেল ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করেছিলেন। কিন্তু লোকটির প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত। এর দুটো অর্থই হয়। গোমেশ এখানে আছেন এবং নিষেধ করা আছে, কিংবা এ বাড়িতে তিনি অবাঞ্ছিত লোক।
কর্নেল অমায়িক হেসে বললেন, মিসেস ইভলিনের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল।
লোকটি গেটের গরাদে বুক ঠেকিয়ে চাপা গলায় বলল, স্যার কি মাল কিনবেন? তা হলে এখানে নয়। মেমসায়েবের বকুনিতে গোমসায়েব আর এখানে মাল এনে রাখতে সাহস পায় না। অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে রাখে। দামী পাথর স্যার! আদ্ধেক দামে পাবেন। কিছু বখশিস ছাড়ুন। পাথর কেনার ব্যবস্থা করে দেব।
একটা চক্রের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কর্নেল বললেন, পাথর? পাথর নয়। গোমেশ আমার কাছে টাকা ধার করেছেন। দিদির কাছে টাকা নিয়ে…
লোকটা হাসতে লাগল। সে-গুড়ে বালি। বড় মেমসায়েব গোমসায়েবকে টাকা দেবেন? তার এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসা বারণ।
বড় মেমসায়েব তো এখন মুসৌরিতে। তাই…
গোমসায়েব আপনাকে আমোক কষ্ট দিয়েছে স্যার! লোকটা আরও হাসতে লাগল।
কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন, ছোট মেমসায়েব তো আছেন। তাঁকে একটু ডেকে দাও তা হলে।
ছোট মেমসায়েব আর সায়েব কলকাতা গেছেন।
কখন ফিরবেন?
কিছু বলে যাননি। বিকেলে ফিরতে পারেন; রাত্তিরেও ফিরতে পারেন। লোকটা হাই তুলে বলল। তবে ছোট মেমসায়েব আরও তেজী। গোমসায়েবের নাম শুনলেই খেপে যান।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, এদিকে রাস্তাটা খারাপ। ভাল রাস্তা কোনদিকে?
লোকটা বাঁ দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই দিকে। স্টেশনে যাবেন তো? দূর হবে। তবে রিকশা পেয়ে যাবেন কলোনির মোড়ে।
সে চলে গেল। পার্লারে গিয়ে বসে আবার পালক দিয়ে কান চুলকোতে থাকল। কর্নেল বাঁ দিকে এগিয়ে একটা মোটামুটি ভাল রাস্তা দেখতে পেলেন। তারপর ঘুরে লক্ষ্য করলেন, লোকটা এবার চোখ বুজে নেই। তাকে দেখছে। দাঁত দেখা যাচ্ছে। তাঁকে বোকা ভেবে হাসছে নাকি।