কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, কবরখানায় ওয়াগনব্রেকারদের খুব দৌরাত্ম্য মনে হয়?
সাংঘাতিক। তারা এই গেট দিয়ে মাল পাচার করে। গেটের সামনে ট্রাক অপেক্ষা করে। ভয়ে পুলিশকে জানাতে পারি না, মহাশয়!
কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি কিছু বখশিস দাবি করতেই পারেন।
গোমেশ জোরে মাথা নেড়ে বললেন, কখনই না। সেটা পাপ। আমাকে একবার দশটা টাকা দিতে এসেছিল। নিইনি। বলেছিলাম, তোমাদের কাজ তোমরা করো। আমি তো বাধা দিচ্ছি না। মুখ বুজে আছি। থাকব।
কেয়ারটেকার টেবিলের বাইবেল স্পর্শ করলেন। তারপর কিচেনে গেলেন।
টেবিলের তলায় কর্নেলের জুতোয় কিছু ঠেকল। কাত হয়ে দেখলেন একটা ওয়েস্টপেপার বাস্কেট। ছোট টর্চটা জ্বেলে দেখলেন ছেঁড়া কাগজে ঠাসা। কর্নেল উঠে গেলেন জানালার কাছে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, এই! এই! কী হচ্ছে?
গোমেশ সাড়া দিলেন বাইরে থেকে। কী হয়েছে? কী হয়েছে?
ভাই গোমেশ! দেখুন তো গাড়ির কাছে কে কী করছে!
গোমেশ দ্রুত ঘরে ঢুকে দেয়ালের হুক থেকে ছাতি আর টেবিলের ড্রয়ার থেকে টর্চ বের করে হন্তদন্ত হয়ে বেরুলেন। আবছা অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। গেটের মাথায় আলো নেই কেন? কর্নেল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটটা টেনে নিলেন। ছেঁড়া ঠোঙা, খ্রিস্টান সোসাইটির ইস্তাহার, এইসব কাগজ।
একটা কুচিতে বাংলা হরফ চোখে পড়েছিল কর্নেলের। ডটপেনে লেখা। সেজন্যই গোমেশকে বাইরে পাঠানো।
ঝটপট অনেকগুলো কুচি কাগজ কুড়িয়ে পকেটে ঢোকালেন। তারপর জিনিসটা টেবিলের তলায় চালান করে বারান্দায় গেলেন। গেটের বাক্টা জ্বলে উঠল।
গোমেশ ফিরলেন। মুখে হাসি। পালিয়েছে। গেটের আলোটা জ্বালতে ভুল হয়েছিল, তাই এত সাহস।
একটু পরে চা খেয়ে ব্রাদার গোমেশকে কুড়িটা টাকা বখশিস দিয়ে কর্নেল বেরুলেন। গোমেশ ছাতা ধরে তাকে গাড়িতে পৌঁছে দিলেন। বললেন, ইউ আর ভেরি গুড জেন্টলম্যান, স্যার! ইউ আর আ বার্ড-ওয়াচার। ওয়েল, কাম স্যার ইন দা মর্নিং, অর হোয়েন ইউ লাইক! মেনি মেনি বার্ডস ইন দা সিমেট্রি! গুড বাই স্যার! মে আওয়ার লর্ড দা সেভিয়ার ব্লেস ইউ! বাই বাই!
কবরখানার কেয়ারটেকার হাত নাড়তে থাকলেন।……
.
রাত দশটায় ষষ্ঠীচরণ হাই তুলতে তুলতে পর্দার ফাঁকে মুখ বের করল। বাবামশাই টেবিলে একপাটি ছেঁড়া জুতো নিয়ে কী যেন করছেন। দ্য ছ ছ্যা! নাক কুঁচকে গেল ষষ্ঠীর। সব থাকতে ঘেঁড়া জুতো ঘাঁটা। সে খুক করে কাশল।
কর্নেল মুখ না তুলেই বললেন, তোকে না বলেছি খাবার ঢাকা দিয়ে শুয়ে। পড়গে?
ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, ভাল করে হাত দুটো যেন ধুয়ে লেবেন।
কর্নেল স্যান্ডেল তুলে কপট প্রহারের ভঙ্গি করলে ষষ্ঠীচরণ অদৃশ্য হলো।
কর্নেলের সামনে কাগজের কুচিগুলো মোটামুটি সাজানো। কতক্ষণ ধরে তাস মেলানোর মতো পরিশ্রম চলেছে। বুঝতে পারছেন না সাজানো ঠিক হয়েছে কি না। গোমেশ যেন খুব খাপ্পা হয়েই কাগজটা ছিঁড়েছিলেন। দলা-পাকানো কাগজের কুচি। ওর চিহ্নটুকু কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটিও পুরো শব্দ নেই। এটাই সমস্যা।
কিন্তু দুটো জিনিস বিস্ময়কর। এ কাগজটাও নিউজপ্রিন্ট এবং সেই একই হস্তাক্ষর। অন্তত কর্নেলের যতটা স্মরণ হচ্ছে। জেরক্স কপিটা পেলে মেলানো যাবে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, গোমেশ এটা পেলেন কোথায়? ছিঁড়ে ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে ফেললেন কেন? এখনও বেশ কিছু কুচি গোমেশের ওয়েস্ট-পেপার বাস্কেটে পড়ে আছে। পুলিশকে বললে এখনই ওটা নিয়ে আসবে। ওটা আনা– দরকার। কাগজের এই কুচিগুলো মিলিয়ে মোটামুটি একটা ছোট্ট চিঠি দাঁড়িয়েছে। এটাই ভাবিয়ে তুলেছে কর্নেলকে। টিনিকে লেখা চিঠিই বটে! সেটার মোটামুটি এবং আনুমানিক চেহারা এইরকম :
টিনি, আজ তুমি ক্রিস্টিনার কবরের ওখানে যাবে। ওখানে তোমার জন্য ফুলগুলি ফুটে আছে। সুন্দর বিষাক্ত লাল ফুল। আজ রাতে বৃষ্টি না হলে জ্যোৎস্নায় তোমাকে পরী দেখাবে। তুমি আকাশকন্যা। মৃতদের মধ্যে জীবন জাগাবে। তুমি ক্রিস্টিনা হয়ে উঠবে। কবির আত্মা। কিন্তু সাবধান। বেশিক্ষণ নয়। গোমেশ তোমাকে সব কথা বলবে।……।
ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠল কর্নেলের ঠোঁটের কোনায়। টাকে হাত বোলালেন। যা লিখেছেন, তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বলতে গেলে শব্দ ও বাক্যের অনেকটাই তারই আরোপিত। কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রে আনুমানও যুক্তিসিদ্ধ।
হ্যাঁ, চিঠিটা এরকমই ছিল। কাব্যিক, আবেগময়।
হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন কর্নেল। অরিজিৎ লাহিড়ীর ফ্ল্যাটের ফোন, সাড়া এল, লাহিড়ী!
ডার্লিং! আশা করি গোদারের চিত্রনাট্য পড়ছ?
হেরে গেলেন, অন্তর্যামী!
ভূতের গল্প নয় তো?
হুঁ। প্রায় কাছাকাছি। বইটার নাম কবরখানার সাহিত্য।
রোজার গারোদি!
ধন্যবাদ! আপনি সর্বঘটের কঁঠালী কলা। তবে কমিউনিস্ট গাররাদি–সার্ত্র, পাউন্ড কাউকে রেয়াৎ করেননি। কবরে পাঠিয়ে ছেড়েছেন!
ডার্লিং! গাবোদিকেই পরে কমিউনিস্টরা কবরে পাঠিয়েছিল।
আপনাকেও আজ কবরে দেখা গেছে!
খুশি হলাম শুনে। তবে ডার্লিং, ওই কবরখানায় এখনই কাউকে পাঠানো দরকার।
মাই গুডনেস! কী ব্যাপার? আবার কি……..
না। কেয়ারটেকার মিঃ গোমেশের ঘরে টেবিলের তলায় একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট আছে। সেটা খুবই জরুরি। আর…মিঃ গোমেশকে আটক করে জেরা করো–তিনি কিছু জানেন। একটু পরে অরিজিতের সাড়া এল, আর ইউ দেয়ার, ওল্ড বস?