কর্নেল হাত নেড়ে বললেন, অ রিভোয়া! আবার দেখা হবে।
.
ড্রইংরুমে পপ মিউজিক বাজছে। সুব্রত চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু কথাকলিকে দেখে কর্নেলের মনে হলো, নাচছিল। ষষ্ঠীও মুচকি হেসে চাপাস্বরে বলে গেল, ঘরের মধ্যে সিনেমা, বাবামশাই! কথাকলি রেকর্ডপ্লেয়ার বন্ধ করল।
কর্নেলকে দেখে সুব্রত কঁচুমাচু হাসল। আমি অনেক অন্যায় করেছি, কর্নেল! আমাকে রক্ষা করুন।
কথাকলি বলল, নিশ্চয় করেছ। প্রথমেই সব বলা উচিত ছিল তোমার। তুমি বোকার বোকা!
আহা, বকে না! কর্নেল সস্নেহে বললেন, আসলে সুব্রত ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কারণ সে একটা হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। তাকে পুলিশ জড়াবে ভেবে তার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
সুব্রত কথাকলির উদ্দেশে বলল, কিন্তু আমি যথেষ্ট ক্লু দিয়েছিলুম। টিনির বুকের মধ্যে পার্স গুঁজে…
শাট আপ। অসভ্য।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, তুমি নিজের পার্সের ভেতর একটা লেখা ভরে মৃতা টিনির ব্লাউসের ভেতর গুঁজে দিয়েছিলে। তুমি বড্ড বেশি রোমান্টিক, সুব্রত। টিনির চমৎকার আর্টিস্টি জীবনচরিত লিখেছিলে। প্রচুর ক্লু ছিল ওতে। তোমাকে সেজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু টিনির পার্স কী হলো?
সুব্রত মুখ নামিয়ে বলল, ওর পার্সে দুশো টাকা ছিল। আমার টাকার খুব দরকার। লোভ সামলাতে পারিনি। কিন্তু ভয় পেয়ে প্রথমে…….
প্রথমে পাশেই একটা ফাটলে ছুঁচোর গর্তে লুকিয়ে রেখেছিলে।
সুব্রত চমকে উঠল। আপনি জানেন!
পরে আমি গর্তটার খোঁজ পাই। যাই হোক, ওটা পরে নিয়ে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। শেষ অব্দি মনে হয়েছিল খামোকা দুশো টাকা নষ্ট হবে কিংবা পুলিশ খুঁজে পাবে। তার চেয়ে আমিই নিই।
তুমি টিনিকে গোমেশের মারফত চিঠি পাঠিয়েছিলে। টিনিকে রাতে কবরখানায় ডেকেছিলে কেন?
টিনি বলেছিল, ড্যানি ঘোষ কবরের পাথরের ফলক কেনে। অ্যান্টিক ভ্যালু আছে ওগুলোর। আমি যদি ওকে সাহায্য করি, একটা দামী পাথরের ফলক সে বেচবে। আমাকে ভাগ দেবে টাকার। আমি ওকে নিষেধ করেছিলুম প্রথমে। পরে আমারও লোভ হলো। ঠিক করলুম, সেরাতে ফলকটা উপড়ে তুলতে ওকে সাহায্য করব। তাই গোমেশকে চিঠি দিয়ে এলুম, টিনিকে যেন পৌঁছে দেয়। গোমেশের মারফত আমরা পরস্পরকে চিঠি লিখতুম। গোমেশকে বখশিস দিত টিনি। আমরা কবরখানায় গিয়ে আড্ডা দিতুম।
কথাকলি ফুঁসে উঠল, প্রেম করতে!
সুব্রত একটু হাসল। না কলি! ঠিক প্রেম নয়, আই জাস্ট… লাইকড় হার। . আই ট্রায়েড টু আন্ডারস্ট্যান্ড হার। ওর মধ্যে গানের প্রতিভা ছিল।
কর্নেল বললেন, হুঁ। আগে বলো, গোমেশ চিঠিটা ছিড়লেন কেন?
আমার পরামর্শে। চিঠিটা গেমেশ দিতে গিয়েছিল টিনিকে। ওকে বাড়িতে না পেয়ে ফিরে আসে। তারপর রাত দশটা নাগাদ কথামতো আমি রেলইয়ার্ড ঘুরে কবরখানায় ঢুকলুম। জ্যোৎস্না ছিল। ক্রিস্টিনার কবরের কাছে টিনি আর একটা লোককে দেখলুন, চাপা স্বরে কথা বলছে। আমার ভীষণ রাগ আর দুঃখ হলো। ভারি ট্রেচারাস মেয়ে তো! তক্ষুণি চুপিচুপি ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে চলে গেলুম গোমেশের কাছে। আমার কথা শুনে গোমেশ টর্চ নিয়ে বেরুলেন। আমি ওঁর সঙ্গে। টর্চের আলো দেখেই হয়তো ওরা পালিয়েছে ভাবলুম। তারপর ক্রিস্টিনার কবরের কাছে এসে দেখি, ওঃ! বীভৎস দৃশ্য! টিনি খুন হয়ে পড়ে আছে। অমনি গোমেশকে বললুম, আমরা এতে জড়িয়ে পড়ব। চিঠিটা যেন ছিঁড়ে ফেলে। পুলিশে খবর দিতে বললুম। গোমেশ বললেন, এত রাতে খবর দিতে গেলে পুলিশের সন্দেহ হবে, ঘর থেকে এত রাতে অতদূরে ক্রিস্টিনার কবরে কেন গেল সে? তার চেয়ে সকালে খবর দেওয়াই ভাল। পুলিশের জেরার চোটে কী বলতে কী বলে ফেলবে।
টিনির পার্সে টাকা আছে কেমন করে জানলে?
আমারও লোভের কথা অস্বীকার করছি না, কর্নেল। আমি এখনও পার্মানেন্ট স্টাফ হইনি। ভাউচারে টাকা পাই। ট্রেনি জার্নালিস্ট মাত্র। ড্যানি ঘোষকে আমিও কবরের ফলক বেচতে চেয়েছিলাম। তখন ড্যানি বলেছিল, আজই সে টিনিকে দুশো টাকার কড়কড়ে নোট দিয়েছে। অ্যাডভান্স। আমি বরং টিনিকে
হেল্প করলে টাকার ভাগ পাব।
তাই তুমি চিঠি লিখে টিনিকে বলেছিলেন রাত দশটায় কবরখানায় যেতে?
হ্যাঁ।
বেশ। তারপর তুমি মৃতা টিনির পার্স বের করে নিজের পার্স ঢোকালে? কিন্তু নেলপালিশ, লিপিস্টিক…
কর্নেল, ওটা টিনির পিকিউলার অভ্যাস! সে হ্যান্ডব্যাগ ব্যবহার করত না। একবার ছিনতাই হয়েছিল ওদেরই বস্তিতে।
কর্নেল হাসলেন। তা হলে আমি ভুল বুঝেছিলুম। এনিওয়ে, এবার বলো। টিনির ডেডবডি দেখার পর কী করলে তোমরা?
বললুম ত! গোমেশকে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়তে আর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে বললুম।
গোমেশ পাশের কোনও কবরের ওপর আলো ফেলে কিছু দেখেছিলেন?
আলো ফেলেছিল চারপাশে। কী দেখেছিল, জানি না। বলেনি কিছু।
টিনি তোমাকে বলেনি কোন কবরে ফলক চুরি করবে?
না। শুধু বলেছিল, একটা দামী পাথরের ফলক আছে, সে দেখেছে।
এবং তুমি ওকে প্রথমে নিষেধ করায় সে অন্য কারও সাহায্য নিয়েছিল। তাই তো?
ঠিক তা-ই।
ঘটনাস্থলে গিয়ে কোনও কারণে তার সঙ্গে টিনির বচসা হয়। ধস্তাধস্তিও হয়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ধস্তাধস্তির প্রমাণ চুড়ি ভাঙা! তুমি পদ্যে লিখেছিলে! তোমার টেবিলের ড্রয়ারে সেই পদ্য পাওয়া গেছে।
সুব্রত বিষণ্ণভাবে বলল, পার্স বদলাতে গিয়ে জ্যোৎস্নায় ভাঙা চুড়ি দেখতে পেয়েছিলুম, ঝিকমিক করছিল কবরে আর ঘাসে।