আমি দূরে সরে এলাম।
তখন সময় কত?
প্রায় রাত বারোটা। ঘড়ি দেখিনি।
কোনও আর্তনাদ শুনেছিলেন?
নাঃ! আমি ওই জীর্ণ গির্জার সামনে প্রার্থনা করছিলাম। প্রভু! পাপীদের হাত থেকে এই পবিত্র স্থানকে রক্ষা করুন!
আলো কমে এসেছে আরও। পুবের আকাশে মেঘ আরও গাঢ় হয়েছে। কর্নেল কবরটির দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
ছিটগ্রস্ত কেয়ারটেকার এতক্ষণে একটু চমকে উঠে বললেন, কী দেখছেন আপনি?
মানুষের রক্ত, গোমেশভাই!
আপনি কি খ্রিস্টান?
কেন?
আমি তাই ভেবেছিলাম। আপনাকে…ঈশ্বর! ঈশ্বর! আপনি পুলিশের গোয়ন্দা নন তো?
না ভাই গোমশ!
বৃদ্ধ কেয়ারটেকার সন্দিগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। চুরুট থেকে একদলা ছাই ঝরে পড়ল।
কর্নেল কবরটার চারপাশে ঘুরে ভাঙা দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গেলেন। গোমেশ এবার তার পেছনে গিয়ে প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বললেন, ঈশ্বরের দোহাই! আপনি কে?
আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
আপনি কী দেখে বেড়াচ্ছেন?
রেলইয়ার্ডটা দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনার ভাবনার কারণ নেই। ভাঙা অংশটা কোমরসমান উঁচু। সেখানে দাঁড়িয়ে কর্নেল জ্যাকেটের পকেট থেকে বাইনোকুলার বের করলেন। রেলইয়ার্ড দেখতে থাকলেন।
গোমেশ আরও অবাক হয়ে কাছে গিয়ে বললেন, বাইনোকুলারে কী দেখছেন মহাশয়?
পাখি! পাখি দেখা আমার নেশা, গোমেশভাই!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেয়ারটেকার খিকখিক করে হেসে উঠলেন। ওদিকে পাখি নেই! শকুন আছে। মহাশয়, পাখি দেখতে হলে এদিকে ঘুরুন। দেখুন, দেখুন! গাছে-গাছে কত পাখি! চিড়িয়াখানা মহাশয়!
গোমেশভাই! এক মিনিট! সিগন্যাল-পোস্টের মাথায় একটা অদ্ভুত জাতের শকুন দেখতে পাচ্ছি! আপনি দয়া করে আমার গাড়িটার কাছে যান। আপনাকে পুরস্কৃত করা হবে। আজকাল বড্ড গাড়িচোরের উপদ্রব?
পুরস্কারের লোভেই কেয়ারটেকার হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।
কর্নেল ভাঙা পাঁচিল ডিঙিয়ে ওধারে নামলেন। ঝোপঝাড়, খানাখন্দ, ঘন ঘাস। তারপর রেলইয়ার্ডের কাঁটাতারের ঘেঁড়াখোঁড়া বেড়া। এখানে ওখানে ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে একটা ওয়াগন লাইনছাড়া হয়ে মাটিতে আটকে গেছে। প্রকৃতি তাকে যথেচ্ছ শাস্তি দিচ্ছে। তবে ওয়াগানব্রেকারদের উপযুক্ত ঘাঁটি বলা চলে।
একটু দূরে একটি শান্টিং ইঞ্জিন হুই দিতে দিতে চলাফেরা করছে। তার ওদিকে দুজন সশস্ত্র সেন্ট্রি সিগারেট ফুকুতে ফুঁকতে সারিবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে অদৃশ্য হলো। তখন কর্নেল বেড়া গলিয়ে রেলইয়ার্ডে ঢুকলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে একটা লাইনের ওপর একপাটি জুতো দেখতে পেয়েছিলেন। সাধারণ স্যান্ডেল মাত্র।
রেলইয়ার্ডে এমন অনেক কিছুই পড়ে থাকে। তবু দেখা দরকার। কাছে গিয়ে দেখলেন, ফিতে ছেঁড়া পুরনো স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা বাঁ হাতে আলতোভাবে কুড়িয়ে নিলেন।
আর তখনই দড়দড় করে তার আশেপাশে পাথরকুচি এসে পড়তে থাকল। একটা পাথরকুচি তাঁর জুতোয় এসে পড়ল। মুহূর্তে গতি আঁচ করে টের পেলেন কেউ ওই ভাঙা ওয়াগনটার দিক থেকে এই কাজটি করছে। তার চেয়ে বড় কথা, কর্নেলের কাজটিও তার মনঃপুত নয়। দ্রুত পকেট থেকে রিভলবার বের করে তেড়ে গেলেন ওয়াগানটার দিকে। এই সময় ঝিরঝিরে বৃষ্টি এসে গেল।
ছেঁড়া চটিটা জ্যাকেটের পাশ-পকেটে ঢুকিয়ে ছোট্ট টর্চ বের করে ভাঙা ওয়াগনের ভেতরটা দেখলেন কর্ণেল।
চাপচাপ পাথরকুচি, মাটির চাবড়া, গুল্ম। কোনার দিকটা পরিষ্কার। সেখানে প্রকাণ্ড ফোকর। ফোকরে উঁকি দিতেই ধূসর বৃষ্টির ভেতর খানিকটা দূরে এইমাত্র কেউ সারবদ্ধ ওয়াগনের আড়ালে চলে গেল। পরনে প্যান্ট-শার্ট। রোগা চেহারা। কয়েক সেকেন্ডের দেখা একটা মানুষ এবং দিনশেষের বৃষ্টির ধূসরতায় দেখা একটা আবছা মূর্তি মাত্র।
সে এই স্যান্ডেলটাই নিতে এসেছিল, এতে কোনও ভুল নেই। এও ঠিক, সে ভেবেছিল, ভূতের ঢিল পড়া দেখে এই দাড়িওলা বুড়ো সায়েব লোকটি ভয় পেয়ে পালাবে!
ঝকঝকে জায়গাটিতে সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। একটা ছেঁড়া তাসের জোকারও। কারা এখানে তাস খেলত। সিগারেট ফুঁকত। সম্ভবত তারা ওয়াগনব্রেকার অথবা নেহাত নেশাখোর ভবঘুরের দল।
বৃষ্টির মধ্যে কর্নেল সাবধানে পায়ের কাছে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কবরখানায় ফিরে এলেন। সেন্ট্রিদের চোখে পড়লেই গুলি ছুড়ত। খুব ঝুঁকি নিয়েছিলেন কর্নেল।
গেটের ছাউনির তলায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেয়ারটেকার। বাও করে বললেন, ওই আপনার গাড়ি, মহাশয়! দেখুন, যেমন ছিল তেমনই আছে। আসলে এই শয়তানের আখড়ার দিকে সচরাচর কেউ আসে না। আমার জ্ঞান মতে, যারা গাড়িচোর, তারা ছিচকে মস্তান নয়। যাই হোক, আশা করি সেই অদ্ভুত শকুনটি কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে?
না গোমেশভাই! বৃষ্টি সব গণ্ডগোল করে দিল।
গোমেশ তার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বললেন, ভিজে গেছেন দেখছি। যদি এ গরিবের ডেরায় ঢোকেন, কড়া চা খাওয়াতে পারি। আসুন, আসুন! আমার ঘরের জানালা থেকে আপনার গাড়ির ওপর নজর রাখা চলে।
গির্জার কাছ ঘেঁষে একতলা জীর্ণ কয়েকটি ঘর। দুটি ঘর যেকোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। বাকি ঘরটি মোটমুটি মেরামত করা হয়েছে। বারান্দার একপাশে কিচেন। ছোট্ট একটা ডাইনিং টেবিল। সবই ব্রিটিশ যুগের। ঘরের ভেতর চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব। লোহার খাটে সাদাসিধে একটা বিছানা পাতা। নড়বড়ে তিনটে চেয়ার। দেয়ালের আয়নাটা ডিমালো এবং সুদৃশ্য! গোমেশ কিচেনে কেরোসিন কুকার জ্বেলে কেটলি চাপিয়ে এসে দেখলেন, কর্নেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গোমেশ উৎফুল্ল মুখে বললেন, খাঁটি বেলজিয়ামী আয়না মহাশয়! আজকাল দুষ্প্রাপ্য। দুঃখের কথা কী বলব টাকার অভাবে এমন কত দামী জিনিস বেচে দিতে হয়েছে। মাত্র দুশো টাকা মাইনে আর কফিনে নতুন লাশ এলে কিছু বখশিস। এ বাজারে একজন মানুষের পক্ষে কোনও রকমে বেঁচে থাকা। তবে এই কবরখানায় খুব কম লাশ আসে। শহরতলি এলাকা। কাছাকাছি খ্রিস্টানবসতি নেই।