কর্নেল বললেন, হুঁ, কিন্তু গোমেশকে কে খুন করল, যুধিষ্ঠির?
যুধিষ্ঠির এবং সুরঞ্জনা এক গলায় বললেন, ড্যানিসায়েব।
কর্নেল সুরঞ্জনা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন?
যুধিষ্ঠির কী বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে সুরঞ্জনা বললেন, আমি ভাবতুম, আমার মেয়েকে গোমেশ খুন করেছে, তারই গোধ নিয়েছে। কিন্তু আপনি কবরের দামী পাথরের ফলকের কথা বলেন। তাই এখন মনে হচ্ছে, আমার আমার বোকা মেয়ে ফাঁদে পা দিয়েছিল।
উত্তেজিত যুধিষ্ঠির বলল, রোজ খ্রীস্টান কবরখানায় যেত টিনি! সুব্রতও যেত। আজ সুব্রত বিপদে পড়ে ভাল মানুষ সেজেছে বটে, কিন্তু স্যার, সে-ও দলে ছিল মনে হয়। ঠেলায় না পড়লে তো বেড়াল গাছে চড়ে না!
কর্নেল হা হা করে হাসলেন। ঠিক, ঠিক বলেছ যুধিষ্ঠির! সুব্রত…….তবে আমার সন্দেহ…….না, খুলেই বলি, সুব্রত জানে, দামী পাথরের ফলক কোথায় আছে। আমিও হয়তো আঁচ করেছি, কোথায় সে ওটা রেখেছে। টিনি ওকে। রাখতে দিয়েছিল হয়ত।
যুধিষ্ঠির অবাক হলো। দামী পাথরের ফলক? কী রকম দাম হতে পারে স্যার?
তা বিদেশে বেচলে কোটি টাকা!
যুধিষ্ঠির কপালে চোখ তুলে বলল, ওরে বাবা! একশো হাজারে এক লাখ। একশো লাখে এক কোটি! মাথা খারাপ হয়ে যায় শুনলে। গোমেশ আর ড্যানিসায়েবের মাথা খারাপ হবারই কথা।
এবং সুব্রতরও।
আজ্ঞে। যুধিষ্ঠির সায় দিল। সুব্রত ডুবে ডুবে জল খায়। নইলে টিনির সঙ্গে রোজ সে কবরখানায় যেত কেন?
সুব্রত জানে, টিনি পাথরের ফলক কবরখানায় লুকিয়ে রেখেছে।
সুরঞ্জনা শ্বাস ছেড়ে বললেন, কাকে আর বিশ্বাস করব? অথচ সুব্রত আপনার কাছে আসতে বলল। ওর পেটে-পেটে বদমাইশি!
যুধিষ্ঠির বলল, আহা, আগে যদি জানতুম, ওই ফেরারি আসামীকে আজই ধরিয়ে দিতুম পুলিশের হাতে।
সুরঞ্জনা কাতর স্বরে বললেন, আমি বড় অভাগিনী, দাদা! আমার বড় ভয় করছে। আপনি এর একটা বিহিত করুন। আমার মেয়েকে আর ফিরে পাব না। কিন্তু পালের গোদারা শাস্তি পাক।
কর্নেল আস্তে বললেন, পাবে। সুব্রতকে আগে ধরা দরকার।
যুধিষ্ঠির বলল, বমালসুদ্ধ স্যার! হাতেনাতে ধরা উচিত।
নিশ্চয়। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ঠিক আছে। আমি একটু বেরুব। লালবাজারে পুলিশকে সব বলা দরকার। আগে ড্যানিসায়েবকে অ্যারেস্ট করতে হবে। সুরঞ্জনা দেবী! আপনি নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে থাকুন। আপনার আর ভয়ের কারণ নেই। চোরাই মাল তো, আপনার বাড়িতে নেই। কাজেই আর আপনার বিপদের আশঙ্কা নেই। চোরাই মাল কবরখানাতেই লুকোনো আছে।–সম্ভবত সুব্রত আজ রাতেই তা হাতাতে যাবে। তখন তাকে ধরে ফেলব।
সুরঞ্জনা এবং যুধিষ্ঠির চলে যাওয়া মাত্র কর্নেল ফোন তুললেন। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীকে চাইলেন। একটু পরে তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হাই ওল্ড বস! এনি নিউ ডেভালাপমেন্ট?
ইয়া। ডার্লিং! এখনই পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে কবরখানা পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ করে দাও। কুইক! এরিয়ার বাইরেও পুলশ মোতায়েন রাখতে হবে।
ব্যাপারটা কী?
তুমিও বেরিয়ে পড়ো। চলে এস আমার ডেরায়। এখনই দুজনে বেরুব।
ওক্কে। কিন্তু যাব কোথায়? কবরে নাকি?
ইয়া।
সর্বনাশ! এ বয়সে কবরে নিয়ে যাবেন আমাকে?
কুইক, অরিজিৎ, কুইক! আগে পুলিশ ফোর্স, ডোন্ট ফরগেট। এখনই পুলিশ না গেলে কেলেংকারি হবে। তুমি সোজা আমার কাছে এস। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।
ফোন রেখে কর্নেল দ্রুত পোশাক বদলাতে ঘরে গেলেন। তারপর ষষ্ঠীকে বললেন, যদি কেউ আসে, বলবি একটু অপেক্ষা করতে। আমি বেরুব। ফিরব আধঘণ্টার মধ্যে। যে-ই আসুক, অপেক্ষা করতে বলবি।
কর্নেল ড্রংইরুমে পায়চারি শুরু করলেন। উত্তেজিত, অস্থির। মঞ্চের উইংসের আড়ালে অভিনেতা যেমন অপেক্ষা করে, নাটকীয় ক্লাইমেক্সের দৃশ্যে ঢোকার মুহূর্তটির জন্য, তেমনি তীব্র প্রতীক্ষার ছাপ কর্নেলের মধ্যে। মিনিটগুলো অসম্ভব দীর্ঘ। সেকেন্ডগুলো যেন খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। মহাকাশযানের চরম উৎক্ষেপণ মুহূর্তের কাউন্টডাউন শুরু, এক…দুই…..তিন…
ডোরবেল বাজল। কর্নেল গিয়ে দরজা খুললেন। নাঃ, অরিজিৎ নন। কথাকলি এবং সুব্রত। কর্নেল ভেতরে নিয়ে এসে বসালেন। বললেন, অপেক্ষা করো। এখন কোনও কথা নেই। আধঘণ্টার জন্য বেরুচ্ছি। ফিরে কথা হবে। না, না, উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। জরুরি একটা কাজ পড়েছে। এখনই ফিরে আসছি, ডার্লিং! ষষ্ঠী! এঁদের কফি-টফি খাইয়ে দে! ইচ্ছে করলে ইউরোপিয়ান বা ভারতীয় ক্লাসিক্যাল কিংবা পপ মিউজিক শোনো! ওই রেকর্ডপ্লেয়ার! বলে দুজনকেই ভীষণ অবাক করে বেরিয়ে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে নিচের লনে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন।
.
অরিজিৎ এলেন দশ মিনিট পরে। মাই গড! আপনাকে সাংঘাতিক দেখাচ্ছে। জাস্ট লাইক আ টাইগার অ্যাট দা মোমেন্ট অফ আ স্প্রিং ডাউন! যেন ঝম্পপ্রদান করে ঘাড় মটকাবেন।
কর্নেল তার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বললেন, কুইক! টু দা গ্রেভইয়ার্ড!
যেতে যেতে অরিজিৎ বললেন, একটু আভাস না পেলে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব। মন চঞ্চল।
ঐতিহাসিক ফলক উদ্ধার করা হবে।
অ্যাঁ!
অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ। কর্নেল একটু হাসলেন। একটু অসুবিধা আছে। তবে তোমার পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ট্রেইন্ড। কেউ না কেউ কাজটা পারবে।
কী কাজ?
আসল কাজ।
কী বিপদ!
হ্যাঁ, একটু বিপদ আছে। ঠ্যাং ভাঙার।