এগারোটার মধ্যে দুই বন্ধুতে খেয়েদেয়ে রওনা হলেন। প্রায় দেড়শো মাইল। রাস্তা। অপূর্ব দৃশ্য মাঝে মাঝে। জঙ্গল, পাহাড়, ছোট্ট বাজার। পালামৌ জেলায় পালামৌ রেঞ্জের পাহাড় পেরুনোর সময় দার্জিলিং এলাকার কথা মনে পড়ে যায়। নীচে বিস্তীর্ণ জঙ্গল। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা চলেছে চড়াই থেকে উত্রাই।
ডাল্টনগঞ্জগামী রাস্তার মোড়ে বাঁ দিকে ঘুরল গাড়ি। বেতলা আর মাত্র। কয়েক মাইল। কোয়েল ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে বেতলা এলাকা। দুধারে টিলা পাহাড়, ঘন জঙ্গল।
বেতলায় একটা বেসরকারি লজে ঘর পাওয়া গেল। প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। ফরেস্ট বাংলোর কাছে পিচ রাস্তার ধারে একটা দোকানে অখাদ্য কফি খেয়ে কর্নেল এবং মেজর রুমে ফিরলেন। তারপর মদনরাজার কেল্লার দিকে রওনা হলেন গাড়ি নিয়ে।
ঘন জঙ্গলের ভেতর কেল্লার সামনের চত্বর ফঁকা। বাঁ দিকে ধ্বংসাবশেষের আড়ালে গাড়ি লক করে রেখে দুজনে বোঁচকাটি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন।
কোয়েল নদীর তীরে জঙ্গলে পাথরের প্রকাণ্ড চাই ইতস্তত। তার আড়ালে বসে কর্নেল ঝটঝট ডামিটি জোড়া দিলেন। গুঁড়ি মেরে দুজনে ডামিটিকে ঠেলতে ঠেলতে (যেন…হেঁটে চলেছেন কর্নেল) নিয়ে গেলেন নদীর ধারে বালির চড়া থেকে উঁচিয়ে ওঠা একটা পাথরের কাছে। সেই পাথরে ডামিটি বসানো হলো। তখন সাড়ে চারটে বাজে। বাতাস বইছিল। তাই ডামিটির দুধারে পাথর সেঁটে দিলেন কর্নেল। গুঁড়ি মেরে পিছিয়ে এসে ঝোপে বসলেন।
নদীর ওধার থেকে বা দুপাশ থেকে দেখলে, এমন কি পেছন থেকে দেখলেও, কর্নেল বসে আছেন। মাঝে মাঝে সুতো টানলে ডামি কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে রাখছে দুহাতে। ঢিলে করলে হাত এবং বাইনোকুলার নামাচ্ছে। হালকা ওজনের পলকা ফোপরা মূর্তি।
পাঁচটা বেজে গেল দেখতে দেখতে। শরঙ্কালের বনভূমিতে এখনই অন্ধকার ছমছম করছে। কোয়েল নদী এখন ভরা। বুকে বড় বড় পাথর। চারদিকে পাখপাখালি তুমুল চাঁচামেচি করছে। মাঝে মাঝে হনুমান বাঁদর হুপহাপ, কিচমিচ করে ডাকছে। তারপর নদীর ওপার থেকে সম্বর হরিণের ডাক ভেসে এল, তাঁ ক! টাক!
ডামি কর্নেলের চোখে বাইনোকুলার উঠল। মিনিট তিনেক পরে বাঁ দিকে জঙ্গল ভেঙে দুটি লোক বেরুল। তাদের একজনের হাতে বন্দুক। সে একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যজন যুবক। চোখে সানগ্লাস। ডামির কাছে গিয়ে বলল, এসে গেছেন তা হলে?
মেজর অবাক হয়ে শুনলেন, ডামি বাইনোকুলার নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল, এস ডার্লিং, বলো তোমার কী কথা?
মেজর কর্নেলের দিকে তাকালেন। কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলেন।
আপনার গলার স্বর অমন কেন, কর্নেল?
তোমার গলার স্বর অমন কেন, সুব্রত?
সানগ্লাস-পরা যুবকটি পেছনে ঘুরে বন্দুকবাজকে ইশারা করল। সে বন্দুক তুলল। তারপর গুলির শব্দ। কর্নেলের ডামি ডিগবাজি খেয়ে জলে পড়ে গেল। তীব্র স্রোতে ভেসে চলল ওলট-পালট হতে হতে। যুবক হাসল। চলো কুন্দন সিং! কাম ফতে! আভি ডালটনগঞ্জ যানা পড়ে। উহা বাস পাকাড়কর কলকাতা যায়েগা। সাবকা পাশ বাকি রুপৈয়া আদা করনে হোগা!
চলিয়ে।
মেজর ফিসফিস করে বললেন, ওদের ধরে ফেলা উচিত। শিগগির।
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন, রিস্ক নেওয়ার দরকার নেই। ওরা সশস্ত্র। যেতে দিন। ভাড়াটে গুণ্ডা।
কিন্তু ডামি কথা বলল, এই রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে না।
কর্নেল মুচকি হাসলেন। স্রেফ ভেন্ট্রিলোকুইজম! স্বরজাদু। আমি এ বিদ্যাটা জানি। আপনি নিশ্চয় ম্যাজিকে কথা বলা পুতুল দেখেছেন?
মেজর শ্বাস ছেড়ে বললেন, তা-ই! আমি ভেবেছিলুম কোনও যন্ত্রট নাকি!
দুজনে সাবধানে মদনরাজার, কেল্লায় ফিরলেন। তখন অন্ধকার ঘন হয়েছে জঙ্গলে। গাড়িটা আড়ালে রাখা ছিল। স্টার্ট দিয়ে মেজর বললেন, কী সর্বনেশে লোক। এ তল্লাটে বিস্তর ভাড়াটে খুনী পাওয়া যায় জানতুম। এই প্রথম স্বচক্ষে দেখলুম। কিন্তু ওরা গেল কোন পথে?
বেতলা গ্রামের দিকেই গেল মনে হচ্ছে। ফরেস্ট বাংলোর দক্ষিণে বেতলা গ্রাম।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
আমাদের এখনই রাঁচি ফিরতে হবে কিন্তু। আপনার কষ্ট হবে। আমি ড্রাইভ করব বরং।
মেজর হাসলেন। দুজনেই বুড়োমানুষ। তবে আমি ডাক্তার, ডোন্ট ফরগেট দ্যাট।
ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে সন্দিগ্ধ দৃষ্টে বাবামশাইকে দেখে তারপর ফিক করে। হাসল। কর্নেল রাঁচি থেকে বাসে এসেছেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ থাকা স্বাভাবিক। রুষ্ট হয়ে বললেন, হাসির কী আছে! কফি।
ষষ্ঠী তবু ফিকফিক করে হাসতে লাগল।
হাসি কেন রে হতভাগা? কর্নেল আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে দাড়ি ঝেড়ে বললেন, আবার হাসি? তবে রে?
ষষ্ঠী কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে বলল, বাবামশাই কি সত্যি রাঁচি গিছলেন?
হুম। আগে কফি।
আপনাকে ছেইড়ে দিলে?
ছেইড়ে দিলে মানে?
আজ্ঞে, ওই যে গো, কিসের যেন গারদ আছে রাঁচিতে।
কর্নেল অট্টহাসি হেসে বললেন, ব্র্যাভো ডার্লিং! এতদিনে গাঁইয়া ভাব গিয়ে স্মার্ট হয়েছ। হুঁ, রসবোধও জন্মেছে। ভাল, ভাল। তবে আগে কফি।
ষষ্ঠীর কফি করতে সময় লাগে না। কর্নেল পোশাক বদলে বাথরুম সেরে ফিটফাট হয়ে আরামকেদারায় বসলেন। কফিও পেলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, কিছু খবর আছে এ দুদিনের? বল, শুনি।
এবার ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, খালি ফোং ফোং আর ফোং! আবার কে? ওই…….