কিছুক্ষণের মধ্যেই ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইয়ের জন্য বিশেষ কফি আনল। উনি চুমুক দিয়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস! এবার বলল ভাইটি, কর্নেলস্যারের খবর কী?
ষষ্ঠী বলল, বাবুমশাই কি কখনও বলে যান? তবে এবার যেন মনে হলো রাঁচি যাচ্ছেন। আচ্ছা হালদারমশাই, রাঁচিতে পাগলাগারদ আছে না?
আছে। তবে কর্নেলস্যার পাগলাগারদে যদি যান, তা হলে জানবে কোনও ক্লু পেয়েছেন। কবরখানায় যে মাইয়াডা খুন হইছে, সেই খুনী পাগলাগারদে পাগল সেজে আছে। সিওর!
হালদারমশাই! আজ ডেভিডসায়েব এসেছিলেন কবরখানায় থাকেন বললেন, ডেভিডসায়েব। সেখানে আবার কী ভুতুড়ে ব্যাপার হয়েছে। তো……
হালদারমশাই বললেন, এক্ষুণি যাচ্ছি। ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ করিয়া দিমু, দেখবা!
ষষ্ঠী মনে করিয়ে দিল, আপনার গোঁফ?
কইলাম না গোঁফে গোঁফ আটকাইয়া যায়! গোঁফ গেছে, গোঁফ গজাবে। ভেবো না।
বলে কফি শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন হালদারমশাই। এবার লক্ষ্য ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রি, যেখানে পাগল সেজে ঘুরেছেন। সব চেনা হয়ে গেছে। একদিনেই।
পৌঁছুতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কিন্তু মেঘও আছে। রেলইয়ার্ড ঘুরে সেই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে কবরখানায় ঢুকলেন।
চুপিচুপি কবর ও ঝোপজঙ্গলের আড়ালে এগিয়ে গির্জার কাছে গেলেন। কারা ওপাশে চাপাস্বরে কথা বলছে। গেটের কাছে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে। তাদের এদিকে দৃষ্টি নেই। খৈনি ডলছে।
কিন্তু কথা বলছে কারা? রহস্যময় ব্যাপার। রিভলবার বের করে পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। কেয়ারটেকারের ঘরের বারান্দায় আলো জ্বলছে। লোক নেই।
লোক নেই, অথচ কথা শোনা যাচ্ছে। আরও রহস্যময় ব্যাপার।
দেবদারু গাছের পেছনে যেতেই তার ওপর টর্চের আলো পড়ল। আচম্বিতে। তারপরই পেছন থেকে কেউ তাকে ধরে ফেলল। মুচড়ে রিভলবার কেড়ে নিল। হালদারমশাই চেঁচালেন, পুলিশ! পুলিশ!
ততক্ষণে তাকে ঠেলতে ঠেলতে কেয়ারটেকারের ঘরের সামনে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। হালদারমশাই অবাক। পুলিশরক্ষীরা ঘুরেও তাকাল না! হাল ছেড়ে দিলেন হালদারমশাই।
কেয়ারটেকার ডেভিড বেরিয়ে বললেন, সোয়াইন! ব্লাডি! রাস্কেল! হালদারমশাই চটে গিয়ে বললেন, ইউ সোয়াইন! ইউ ব্লাডি! ইউ রাস্কেল?
সাদা পোশাকের পুলিশ তার ঘাড়ে থাবা হাঁকড়ে বলল, চো-ও-প বে শালে! চোট্টা!
হালদারমশাই বললেন, শাট আপ! তুম জানতা হম্ কৌন হ্যাঁয়? প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার!
আবে কৌন হালদার? তেরা বাপকো আভি ডিটেকটিভ দেখা দুঙ্গা! বৈঠ! হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। ভুল হয়ে গেছে! সেমসাইড!
সাদা-পোশাকের দ্বিতীয় পুলিশ তার চুল খামচে ধরে বলল, চো-ও-প্! বৈঠ শালে লোক।…
৭. রাঁচির গণেশলাল লেনে
রাঁচির গণেশলাল লেনে মেজর তারাপদ ভৌমিকের বাড়ি। দোতলার বারান্দার পাশেই একটি পাইনগাছ। সকালের ট্রেনে স্টেশনে পৌঁছুনোর পর মেজর ভৌমিক তার গাড়িতে কর্নেলকে নিয়ে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কফি। কফির পর চুরুট। দুই বন্ধুর অনেক দিন পরে দেখা। প্রথমে খোশগল্প, তারপর পাইনগাছটির কথা উঠেছিল। কর্নেল বলেছিলেন, আশ্চর্য আপনার দক্ষতা মেজর ভৌমিক! পাইনগাছ! ভাবা যায় না। বিশেষ করে এত বড় পাইনগাছ!
মেজর সগর্বে বলেছিলেন, শিলংও উঁচু জায়গায়, রাঁচিও তাই। আমি জেদ ধরেছিলুম, এখানকার মাটিতেও এই সিকুইয়া পাইন কেন হবে না? হলো।
এসব আলোচনার পর বেতলা জঙ্গলের প্রসঙ্গ উঠল। কোয়েল নদী, মদনরাজার কেল্লা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। তারপর কর্নেল বললেন, ট্রাঙ্ক করে সুব্রত কথা বলল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সুব্রতই কথা বলল কি না আমি নিশ্চিত নই। একবার শোনা গলা। সেই গলার স্বর মনে থাকলেও ট্রাঙ্ক কলে সুদূর ডালটনগঞ্জ থেকে সেই গলা সনাক্ত করা কঠিন। কাজেই……. বলে তিনি অট্টহাসি হাসলেন।
মেজর উৎসুক হয়ে বললেন, কাজেই?
আমার লগেজে একটা আশ্চর্য জিনিস এনেছি। দেখাচ্ছি। কুমোরটুলির প্রখ্যাত এক মৃৎশিল্পীর তৈরি। আপনি অবাক হয়ে যাবেন দেখলে।
বলে তিনি লগেজ আনলেন ঘর থেকে। খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ভাঁজকরা কিছু খোলজাতীয় জিনিস। একটা মুণ্ড। কর্নেল সবগুলো জোড়া দিয়ে বললেন, কাকে দেখছেন?
অবাক মেজর বললেন, মাই গুডনেস! ইট ইজ ইউ! হ্যাঁ, আমি। সরি, মাই ডামি। কেমন চমৎকার নকল কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, বলুন?
অসাধারণ! কিন্তু……
কিন্তু কী?
ভেঙে যাবে না হ্যাঁ করতে?
ভাঙেনি। ভাঙবে না। কারণ প্লাস্টার অফ প্যারিস আর শোলার তৈরি। এবার দেখুন শোলার তৈরি বাইনোকুলার দুহাতে চোখে ঠেকিয়ে দিচ্ছি। পেছনে সুতো দেখছেন। ষাট গজ লম্বা নাইনলের সুতো। পুতুলনাচ তো দেখেছেন। এই সুতো ধরে দূর থেকে টানলে ডামি মূর্তির দুহাতে ধরা শোলার বাইনোকুলার চোখে উঠে আটকে যাবে। সুতো ঢিলে করলে গলা থেকে খুলে পড়বে।
আপনার বুদ্ধির প্রশংসা নতুন করে করার নয়। তবু বলব, আপনি টেক্কা দিয়েছেন। মেজর হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু যদি ওটা সত্যি শত্রুপক্ষের ফাঁদ হয়, তারা আপনার সঙ্গে কথা বলবে আগে। ডামি কথা না বললে সন্দেহ হবে।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ডামিও কথা বলবে! দেখবেন!
আপনার রহস্য বোঝা কঠিন।
রহস্য নয় মেজর ভৌমিক! খুব সোজা পরিকল্পনা। ওখানে পাথর আর ঘন জঙ্গল আছে দেখেছি। অসুবিধে হবে না।