বলেন কী!
কর্নেল হাসলেন! তোমার কথার সুরে মনে হচ্ছে আমি এই বুড়ো বয়সে আবার ড্রিংক ধরেছি। অরিজিৎ, তুমি গোয়েন্দা অফিসার। তোমার মাথায় আসা উচিত ছিল মুনলাইটের কাছেই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস। এবং……..
অরিজিৎ দ্রুত বললেন, আই নো, আই নো। দা রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি! আপনার প্রতেজে!
জয়ন্ত পাঞ্জাবে আছে। ও এখানে থাকলে ভাল হতো।
অরিজিৎ লাহিড়ী ঘড়ি দেখে দ্রুত কফি শেষ করলেন। চলি! সি পির ঘরে কনফারেন্স। চারটে বেজে গেল।
.
কবরখানার জরাজীর্ণ ফটকের সামনে লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটি দেখে আংলো-ইন্ডিয়ান খ্রিস্টান কেয়ারটেকার গোমেশ একটু ভড়কে গিয়েছিলেন। সকাল থেকে পুলিশের জেরায় জেরবার তিনি। গাড়ি থেকে কর্নেল নামলে তিনি স্মার্ট হয়ে সেলাম ঠুকলেন। ফরেনার ভেবেই।
।কর্নেল এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন, হ্যাল্লো মিঃ গোমেশ!
অন্তরঙ্গ করমর্দনে খুশি কেয়ারটেকার বললেন, মহাশয় কি বিদেশী?
কখনই না মিঃ গোমেশ! খাঁটি স্বদেশী।
আপনাকে বিদেশী দেখায়। গোমেশ একটু অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমার নাম জানেন! দুঃখিত মহাশয়। আমার এটা আগেই ভাবা উচিত ছিল, গোমেশ জেভিয়ার এই কবরখানার ভূত বলে পরিচিত। হাঃ হাঃ হাঃ! তবে কি জানেন, আর আমার মাথার ঠিক নেই। এই কবরখানা ক্রমশ শয়তানের আড্ডা হয়ে গেছে। বছরে গড়ে তিনটে করে খুনখারাপি। মহাশয়, এই কবরখানা ছিল নন্দনকানন। আপনি লক্ষ্য করুন! কত গাছ! কত ফুল! অথচ হয়ে গেছে একটা জঙ্গল! সব দামী মার্বেল পাথরের ফলক উপড়ে নিয়ে গেছে। সমস্ত দামী কাঠের ক্রস পর্যন্ত! পুলিশ কিছু করে না।
কর্নেল ভেতরে ঢুকে বললেন, আপনি কি এখানেই থাকেন?
হ্যাঁ, স্যার। গির্জার পাশে এই ঘরটাতে। ভাবতে পারেন? একা একজন লোক এই কবরখনায় বাস করে। আমার স্ত্রীর কবর ওইটে। আমার দুই ছেলে তিন মেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমি যেতে পারলাম না। গোমেশ করুণ মুখে একটু হাসলেন। ওরা আমাকে ডাকে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ডাকে মৃতেরা! ব্যাপারটা কল্পনা করুন মহাশয়! মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি……
কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভাই গোমেশ! বলছিলে, আজ মাথার ঠিক নেই। কিছু কি ঘটেছে? তারপর একটি দামী চুরুটও উপহার দিলেন।
ভাই সম্বোধনে এবং চুরুটটি পেয়ে বিগলিত কেয়ারটেকার বললেন, খুন মহাশয়! সাংঘাতিক খুন!
নিজে চুরুট ধরিয়ে এবং গোমেশেরটি ধরিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, বলেন কী! কোথায়? কে খুন হলো?
উত্তেজিত কেয়ারটেকার তার হাত ধরে টানলেন। আসুন, আসুন! দেখাচ্ছি। হতভাগিনী মেয়েটা! আমি জানতাম, ওকে এই কবরখানার মৃতেরা ডেকেছে। রোজ বিকেলে কবরে ফুল দেবার ছলে ওখানে এসে বসে থাকত। আমার চোখ, মহাশয়! বুঝতে পেরেছিলাম, ও কখনই খ্রিস্টান নয়।
এবড়ে-খেবড়ো সংকীর্ণ পথ। দুধারে গাছ, ঝোপঝাড় আর কবর। শুধু কবর। পাখি ডাকছে। ফুলের ঝোপে বসে আছে প্রজাপতি। বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে এসেছে। অক্টোবরের দিনশেষে আকাশে ঘন মেঘ। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি এসে যাবে। কর্নেল প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললেন, রোজ বিকেলে এখানে আসত মেয়েটি–মানে, যে খুন হয়েছে?
আবার কে? গোমেশ উৎসাহে হাঁটতে হাঁটতে বললেন। ওদিকটায় ব্রিটিশ আমলের অনেক বিখ্যাত মানুষের কবর আছে। মেয়েটা যে কবরে বসত, সেটা কার জানেন? ক্রিস্টিনা ম্যাকবেরির। লর্ড কার্জনের আত্মীয়া। তখনকার এক মেয়েকবি। ব্রিটেনের পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতো। কল্পনা করুন, মহাশয়!
মেয়েটি কি একা বসে থাকত?
গোমেশ চাপাস্বরে বললেন, আপনাকে বলা চলে। আপনি ভদ্রলোক। পুলিশকে বলিনি। আপনি তো জানেন মহাশয়, পুলিশকে কিছু বলা মানেই ফাঁদে পা দেওয়া। আপনাকেই ওরা খুনী সাজাবে। কেন? তার উত্তরে বলব, যেভাবে হোক, পুলিশ কাউকে খুনী সাব্যস্ত করতে পারলেই ওপরওলার কাছে প্রশংসিত হবে।
কর্নেলও চাপা স্বরে বললেন, ঠিক ঠিক। পুলিশকে বলেননি, ভাল করেছেন।
কেয়ারটেকার ফিস ফিস করে বলেন, ওই ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে ওর প্রেমিক আসত।
ওদিকটায় তো রেলইয়ার্ড?
হ্যাঁ, কেয়ারটেকার হঠাৎ থেমে বললেন, এই কবর। মার্বেল ফলকটা নেই। ওই দেখুন, ঘাসের ভেতর রক্তের ছাপ। গত রাতে মেঘ সরে জ্যোৎস্না উঠল। আপনাকে আগেই বলেছি, মৃতেরা আমাকে ডাকে। আমি ঘুমোতে পারি না। অস্থির হয়ে কবরখানার ভেতর ঘুরে বেড়াই। মৃত আত্মাদের সঙ্গে কথা বলি। বিশ্বাস করুন।
কর্নেল বুঝতে পারছিলেন, লোকটি ছিটগ্রস্ত। সেটা স্বাভাবিক। বহু বছর ধরে কবরখানায় থাকলে এ বয়সে মাথার ঠিক না থাকারই কথা। কর্নেল সায় দিলেন। না, না। বিশ্বাস করছি। আমি জানি মৃতেরা জীবিতদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। দরকার শুধু দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠতার।
সুন্দর বলেছেন মহাশয়! আপনি জ্ঞানী।
কাল রাতে জ্যোৎস্নায় এখানে দুজনকে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ!
আপনি কী করলেন?
কী করব? কেয়ারটেকার ম্লান হাসলেন। আমার হাতে অবশ্য টর্চ ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে কি প্রভু যীশুর অনভিপ্রেত পাপ কাজ দেখা উচিত হবে? তা ছাড়া এ অবস্থায় পুরুষটির মস্তান হওয়াই স্বাভাবিক। সাধারণ যুবকদের এ সাহস হবে না। কাজেই আমাকে সে ভোজালির কোপ মারতই, যেভাবে মেয়েটিকে মেরেছিল।
তারপর আপনি কী করলেন?