সবাই চলে গেলেন। কিন্তু ইভনিং ভিলার কাল্লু বসে রইল। সাধুবাবা চোখ কটমটিয়ে বললেন, কৌন বে শালে?
কাল্লু গাঁজা প্রসাদ পাওয়ার লোভে এসেছিল। কিন্তু সাধুবাবা কিছুতেই প্রথা অনুসারে ছিলিম বের করছেন না। কাল্লু করজোড়ে বলল, বাবা, আমি কাল্লু।
তু ম্লেচ্ছ খ্রীস্টানবাড়িকি নোকর আছিস? ভাগ, ভাগ।
না বাবা! ও বাড়িতে থাকি এইমাত্র। আমি হিন্দুর ছেলে বাবা! কাল্লু ভক্তিতে করুণ হয়ে বলল। পোড়া পেটের দায়ে নোকরি করি। গঙ্গাজলে না চান করে কি এসেছি আপনার চরণদর্শনে? মাইরি! আপনার দিব্যি।
সাধুবাবা একটু নরম হয়ে বললেন, কিন্তু হুঙ্কারটা জমল না।
তেরা নাম কী আছে বেটা?
আজ্ঞে, হারাধন পাত্র। ডাকনাম কালু। সবাই আমাকে কাক্কু বলে।
সাধুবাবা ব্যোম কালী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, বেটা কাল্লু! হা দেখতা, তেরা বহত দুর্ভাগ্য হ্যাঁয়! উও কোঠি খ্রীস্টান ম্লেচ্ছ লোকের কোঠি আছে। হ ইয়ে ভি দেখতা পাতা কি উও কোঠিমে বহত পাপ হ্যাঁয়।
কাল্লু একটু ভড়কে গিয়ে বলল, কী পাপ দেখতা হ্যাঁয়, বাবা?
সাধুবাবা জটা দুলিয়ে হাসলেন। তুভি পাপী হ্যাঁয়। আবে, ম্যায় ত্রিকালজ্ঞ হুঁ।
কাল্লু আরও ভড়কাল। বাবা, মাইরি বলছি, আমি হুকুমের নোকর। ড্যাং সায়েব যা বলে, তা না মানলে নোকরি তো যাবেই, জেলও খাটতে হবে।
কৌন উও ড্যাংসায়েব?
হিন্দু ছিল, বাবা! মেমসায়েব বে করে খেরেস্তান হয়েছে। তাই ওঁর মামা রায়সাহেব খুব চটে আছে। কিন্তু চটলে কী হবে? সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি।
কাল্লু ফিসফিস করে বলল, চোরাই মাল বেচে, বাবা!
সাধুবাবা আবার হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী!
কাল্লু একটু উসখুস করে বলল, একটু প্রসাদ পাই বাবা। আজ্ঞা হোক!
আবে যা যা! ভাগ! ম্যয় রাতমে কারণবারি পিউঙ্গা! ইয়ে মড়াকা খুলিমে। রাতমে আ যা! বলে সাধুবাবা মড়ার খুলিটি দেখালেন!
কাল্লু একগাল হেসে বলল, হুকুম হলে আমি এনে দেব বাবা। খাঁটি বিলিতি কারণবারি। ইস্কচের বোতল ড্যাংসায়েবের ঘরে আছে।
আবে শালে! ম্যয় ম্লেচ্ছ কারণবারি নেহি পিউঙ্গি! সাধুবাবা বাঁকা মুখে বললেন।
কাল্লু দাঁত বের করে বলল, বাবা, শিবের জটা চলে না?
ক্যা?
কাল্লু হাতের তালুতে গাঁজা ডলার ভঙ্গি করে হাসতে লাগল।
যত সাধুবাবা দেখেছি, সব্বাই শিবের জটা আনেন। খাঁটি পাহাড়ি মুল্লুকের মাল। আপনি আনেননি বাবা?
সাধুবাবা অট্টহাসি হাসলেন। জরুর আনা! লেকিন তুঝকো নেহি দেউঙ্গি!
কেন বাবা?
তু পাপী আছে। উও পাপপুরী আছে। ম্যয় ত্রিকালজ্ঞ হুঁ! উও কোঠিমে বহত চোট্রালোক আনাযানা করত।
কাল্লু চাপা গলায় ব্যস্তভাবে বলল, এখন আর আসে না। কদিন আগে দুদুটো মাডার হলো। পুলিশ……
মার্ডার!
আপনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ। আপনি সবই জানেন। তবে পুলিশ ধানি দিয়েছে সায়েবকে। এদিকে মেমসায়েবও ধাতাচ্ছেন। ওঁর দিদি এলে বিহিত করবেন বলে শাসাচ্ছেন। খুব ঝগড়া, বাবা, খু-উ-ব! কাল্লু খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল।
সাধুবাবা ভুরু কুঁচকে বলেন, কোন মার্ডার কিয়া? তা জানি না। তবে ড্যাবসায়েব পেছনে আছে। কিসকো মার্ডার কিয়া? কাঁহাপর?
কলকাতায়। দুদুটো… কাল্লু থেমে গেল। ইভনিং ভিলার জানালায় ড্যানি ঘোষের মুখ। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ফের, রাত্তিরে এসে কারণবারি প্রসাদ পাই যেন বাবা! আমি খানিক শিবের জটাও আনব। পাহাড়ি মুল্লুকের চেয়ে সরেস জিনিস। দুটোকে মেশালে জম্পেশ হবে, বাবা!
সাধুবাবা হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যোম কালী। ব্যোম! ব্যোম ভোলা! ব্যোম!
কাল্লু চলে গেল। তখন সাধুবাবা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডটপেন আর নোটবই বের করলেন আসনের তলা থেকে। খচখচ করে লিখলেন, টু মার্ডারস ইন ক্যালকাট্টা! ড্যানি ঘোষ।…….
চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে নকল বাগছাল, হরিণের চামড়ার আসন, মড়ার খুলি এবং ত্রিশূল কিনেছিলেন গোয়েন্দা কে কে হালদার। সারাটা দিন বৃথা গেল। তেমন সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলেন না ড্যানি ঘোষের বাড়ি ঢুকতে। এই কাল্লু সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন কর্নেল। কিন্তু নেহাত গোবেচারা মনে হচ্ছে।
তবে সমস্যা হলো, রাতে ব্যাটাচ্ছেলে গাঁজার প্রসাদ চাইলেই বিপদ। একপাত্তর স্কচ হুইস্কিতে আপত্তিতে নেই হালদারমশাইয়ের। কিন্তু গাঁজা বড় বাজে জিনিস।
দুপুরে এক ভক্ত একগাদা আপেল আর এক ঘটি দুধ দিয়ে গেছেন। খিদেয় পেট চনচন করছে। রাত্তিরটা কাটিয়ে চলে যাবেন। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখছেন না।
সন্ধ্যার মুখে একদঙ্গল ভক্ত এসে প্রণাম করে গেল কলোনি থেকে। আড়চোখে দেখলেন, সব মিলিয়ে যা প্রণামী পড়েছে, তাতে চিৎপুরের যাত্রার সাজের দোকানে কেনা জিনিসগুলোর দাম প্রায় উসুল হয়ে যাবে। এটাই আনন্দের কথা।
ভিড় হটিয়ে হুঙ্কার দিলেন, ম্যয় ধেয়ান করুঙ্গা। আভি মুঝকো একেলা রহনে দে। যাঃ! যা সব! ভাগ, ভাগ!
ভক্তরা কেটে পড়ল। অদূরে একটা শ্মশান। সেখানে হরিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। কেমন গা ছমছম করে।
একটু পরে ইভনিং ভিলার সামনে মোটরগাড়ির আলোর ছটা। সাধুবাবা ঝটপট নোটবই পেন বের করলেন। বাড়িটার গেটের মাথায় আলো আছে। এক দিশি সাহেব নামলেন। চেহারার বর্ণনা নোট করে নিলেন।
ধুনির আগুন উসকে দিলেন। শুকনো কাঠকুটোর অভাব নেই এখানে। কিছুক্ষণ পরে কাঙ্গু এল। মুখে একগাল হাসি। সাষ্টাঙ্গে নমো করে বসল। হাফপ্যান্টের পকেট থেকে গাঁজার পুরিয়া বের করল এবং কাঁধের ঝোলা থেকে সত্যিই একটা স্কচের বোতল।