ভেতরে গেলেন কর্নেল। ডেভিডও সাহস করে ঢুকলেন।
কর্নেলের প্রথমেই চোখ গেল বেদির পাশের সেই তাকে। বাইবেলগুলি নিচে পড়ে আছ। পুরনো বই। পাতা ছিঁড়ে মলাট ভেঙে পড়ে আছে। ডেভিড মাই গড বলে আর্তনাদ করে পবিত্র গ্রন্থগুলি গোছাতে ব্যস্ত হলেন।
সেই সময় কর্নেল দেখলেন ইংরেজি বাইবেলের কিং জেমস ভার্সনের ১৯১০ সালের সংস্করণটি দুভাগ হয়ে পড়ে আছে। তলায় একটুকরো কাগজ উঁকি দিচ্ছে। কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে বাইবেলটি তুলে রাখলেন।
ডেভিড বললেন, কী? কী? স্যাটানিক ভার্সেস অথবা সদুপদেশ! কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। কিংবা ধাঁধা।
দেখি, দেখি!
বাইরে গিয়ে দেখাচ্ছি। কেতাবগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে রাখুন। গির্জাঘরের ভেতর ধুলোয় একই লোকের জুতোর অনেকগুলো ছাপ। আগের ছাপে ধুলো পড়ে মিলিয়ে গেছে। তার ওপর নতুন ছাপ।
বাইরে গিয়ে দেবদারুতলায় দাঁড়িয়ে কর্নেল কাগজটা বের করলেন। ডেভিড সাগ্রহে র কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিলেন।
Vulgarity is a very common thing today.
Ultimatium to then who commit nuisances!
Learn what is good and what is bad.
Turn your face towards the Heaven.
Understand what I say to thee.
Remember what I said to thee.
Even the foolish person will know the Truth.
Satan is always following you, oh man!
Never submit your self to him.
Eden Garden from where you had fallen;
Say, I must go back to that place!
Turn your face towards the Heaven.
ডেভিড একটু হেসে বললেন, কোনও ভক্ত খ্রীস্টানের উপদেশ। স্যাটানিক ভার্সেস নয়।
ঠিক তাই। বলে কর্নেল কাগজটা পকেটে ঢোকালেন। তারপর বাইনোকুলারে পুবের দিকটা লক্ষ্য করতে থাকলেন।
এইমাত্র কে ভাঙা পাঁচিল গলিয়ে রেলইয়ার্ডের দিকে নামল। শুধু মাথার পেছনটা এক পলকের জন্য দেখা গেল।
কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে, সেখানে পৌঁছুলেন। সঙ্গে ডেভিড। তিনি ভীষণ উত্তেজিত। বারবার জিজ্ঞেস করছে, হোয়াটস দ্যাট? হোয়াটস দ্যাট? কর্নেল জবাব দিচ্ছেন না। আজ রেলইয়ার্ডে অসংখ্য মালগাড়ি। তেমন কাউকে দেখা গেল না।
বাড়ি ফিরে কর্নেল কাগজটা নিয়ে বসলেন। হুঁ, ডেভিড ঠিকই বলেছেন, কোনো ভক্ত খ্রীস্টানের সদুপদেশ। কোনও পাদ্রিসায়েবেরই হয়তো।
কিন্তু কাগজটা পুরনো হলেও লেখাটা খুব পুরনো মনে হচ্ছে না। হস্তাক্ষর আঁকাবাঁকা দ্রুত লেখা। ডটপেনে লেখা। বাংলা করলে মোটামুটি এই মানে দাঁড়ায় :
অশ্লীলতা আজকাল খুব সাধারণ ব্যাপার।
যারা অপকর্ম করে, তাদের প্রতি চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি,
মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।
বুঝে নাও কী তোমায় বলছি।
স্মরণ করো কী তোমায় বলেছি।
এমন কি, বোকারাও সত্যকে জানতে পারবে।
হে মানুষ, শয়তান সবসময় তোমার পিছনে।
তার কাছে কদাপি বশ মেনো না।
নন্দনকানন থেকে তুমি পড়েছিলে।
বলো, আমি আবার ফিরে যাবোই সেখানে।
মুখ ফেরাও স্বর্গলোকের দিকে।
হুঁ, ধর্মভীরু কোনও মানুষের উপদেশ। গোমেশের কি? তা হলে বলতে হবে, এটা তার নিজের প্রতি হুশিয়ারি। খ্রীস্টানদের মধ্যে পাপ বিষয়ে স্বীকারোক্তি বা কনফেসন-প্রথা চালু। এটা কনফেসন হওয়াই সম্ভব।
কর্নেল কাগজটা ড্রয়ারে রেখে রেলের টাইম-টেবিলের পাতা ওল্টাতে থাকলেন। আজ রাতেই রাঁচি রওনা হওয়া দরকার। নির্জন অরণ্যে কোয়েল নদীর তীরে কী কথা বলবে ফেরারি আসামী সুব্রত চৌধুরি, জানার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
আবার ভাবলেন, কোনও ফাঁদ নয় তো? শরীর একটু শিউরে উঠল। উত্তেজনাটা থিতু হয়ে এলে ঠিক করলেন, আগে ট্রাংক কলে রাঁচিতে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে সব কথা খোলাখুলি আলোচনা করে নেওয়া দরকার।…….
৬. গঙ্গার পাড়ে বটতলায় এক সাধুবাবা
গঙ্গার পাড়ে বটতলায় এক সাধুবাবা ধুনি জ্বেলে বসে আছেন, এটা নতুন কোনও দৃশ্য নয়। হাজার-হাজার বছর ধরে পবিত্র নদী গঙ্গার সঙ্গে সাধুসন্ন্যাসীদের অস্তিত্ব ঐতিহ্যাঁনুগত। তাকে পুরনো বাঙালি শাস্ত্রকারের উক্তি, গঙ্গার পশ্চিম কুল/বারাণসী সমতুল।
সাধুবাবার পাশে একটা ত্রিশূল পোঁতা এবং ডগায় একফালি লাল কাপড় এলোমেলো উড়ছে। বাবার পরনে বাঘছাল। আসন হরিণের চামড়ার। চেহারাটি দেখলে গা ছমছম করে ভয়ে ও ভক্তিতে। তবে এদিকটায় বসতি কম। শুধু জঙ্গল, ধ্বংসস্তূপ। ঐতিহাসিক কিংবদন্তি, এখানেই ছিল মোগল ফৌজদার গুরগন খায়ের সামরিক ঘাঁটি। পরে একটা গঞ্জ হয়ে ওঠে। ফরাসিরা মোগল বাদশাহের কাছে জায়গির পেয়েছিল। আঠারোশতকে ফরাসি সায়েব কুঠিয়ালদের ডেরা ছিল এখানটাতেই। ইংরেজরা ছিল ফরাসিদের শত্রু। মুর্শিদাবাদের নবাব ফরাসিদের সহায়। ইংরেজরা এঁটে উঠতে পারত না। পরে নাকি গঙ্গার ভাঙনে ফরাসিদের গঞ্জ খানিকটা ভাটিতে সরে যায়।
সাধুবাবা ইতিহাস পড়েই এসেছেন। চোখ বুজে আসন করে বসেছেন। মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছেন, ব্যোম কালী! বাবা শৈবও বটেন, শাক্তও বটেন। যিনি শিব, তিনিই কালী। কয়েকজন স্নানার্থী-সানার্থিনীর চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। তারা হাউসিং কলোনির বাসিন্দা এবং বয়স্ক মানুষ। করজোড়ে এবং সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে গেলেন। সাধুবাবা উদাত্ত স্বরে আওড়াচ্ছিলেন :
কস্তুরিকাঁচনলেপনায়ৈঃ শ্মশান
ভস্মাঙ্গ বিলেপনায় চ
সকুণ্ডলায়ৈঃ মণিকুণ্ডলনায় নমঃ
শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায় ॥