যুধিষ্ঠির কথাটি বলেই ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। ফের বলল, পুলিশ ধরুত না ড্যানিসায়েবকে। সাধ্যি আছে? বড়লোকের সব দোষ টাকার জোরে মাস।
খামোকা গরিবের ওপর অত্যাচার ভগবান এ কি সইবেন?
বলে সে করজোড়ে ঠাকুরের উদ্দেশে নমো করল।
টিনির মা চলে গেলেন কেন?
যুধিষ্ঠির বলল, ড্যানিসায়েব এসে নিয়ে গেছে। ভাল ফ্ল্যাট দিয়েছে। টিনির মা বলল, যুধোদা, তুমি বাড়িতে থেকে পাহারা দেবে। বাড়ি বেচে দেব। তোমাকে টাকা দেব, ভেবো না। স্যার, আর একটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল ড্যানিসায়েব। টেম্পোগাড়ি স্যার! জিনিসপত্র নিয়ে গেল টিনির মা।
কর্নেল উঠে পড়লেন। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে একবার মনে হলো, সত্যি কথা বলছে, আমার মনে হলো, মিথ্যা বলছে। লোকটি নিরীহ এবং সরল, নাকি গভীর জলের মাছ? দামী পাথর নিয়ে দরাদরি করছিলেন গোমেশ! গোমেশকে তা হলে ড্যানি মারবে কেন?
সেদিন রাতে কর্নেল আবার চার্লস গ্রিয়ার্সনের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী খুঁটিয়ে পড়ছেন, রাত দশটা পনের বাজে। টেলিফোন বাজল। অভ্যাসমতো ফোন তুলে সাড়া দিলেন।
মহিলাকণ্ঠে কথা ভেসে এল, টু নাইন সিক্স থ্রি নাইন ফাঁইভ?
ইয়া, ম্যাডাম।
প্লিজ হোল্ড অন! আ ট্রাঙ্ক কল ফ্রম ডালটনগঞ্জ।
কর্নেল জোরে সাড়া দিলেন। জয়ন্ত নাকি? হ্যালো ডার্লিং! হঠাৎ অমৃতসর ছেড়ে…
আমি সুব্রত চৌধুরি।
হোয়াট?
সুব্রত, কর্নেল! ডালটনগঞ্জ থেকে বলছি। একটা কথা…।
সুব্রত, তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন?
আমার কিছু কথা আছে। ফোনে বলা যাবে না। আপনি বেতলা ফরেস্টের ওখানে কোয়েল নদীর ধারে আসুন। একা আসবেন। জঙ্গল জায়গা। পুলিশ আনলে আমি গা ঢাকা দেব। মদনরাজার কেল্লার পুবে জঙ্গলের ঢালে। একা। পরশু বিকেল পাঁচটা থেকে ছটা অব্দি অপেক্ষা করব।
এত ভয় কেন, সুব্রত?
কারণ আছে। আসুন। বলব। আপনাকে জানি বলেই……
হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
লাইন কেটে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও আর রিং হলো না। কর্নেল উত্তজনায় দাড়িতে আঙুলে চিরুনি টানতে শুরু করলেন। আশ্চর্য ছেলে তো সুব্রত! অত দূরে তাঁকে ডাকল কেন?
কিন্তু ডেকেছে যখন, তখন যেতেই হবে। কর্নেল আপন মনে একটু হাসলেন। যাবার আগে অবশ্য একটু মার্কেটিং করতে হবে। কিছু কেনাকাটা করে কিছু উপহার নিয়ে যাবেন। রাঁচি হয়ে যাওয়াই ভাল। রাঁচিতে তাঁর বন্ধু আছেন মেজর তারাপদ ভৌমিক। তার জিপ পাওয়া যাবে। হাওড়া-হাতিয়া এক্সপ্রেস রাত সাড়ে আটটায়। রাঁচি পৌঁছুবে সকাল নটা নাগাদ। মেজর ভৌমিক না থাকলে ওখানে বেতলা যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।
বেতলা রিজার্ভ ফরেস্টের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হলেন কর্নেল। ক্রমশ উত্তেজনা থিতিয়ে স্মৃতির মাধুর্য ফিরে এল। ডিসেম্বরের কুয়াশা-ঢাকা ভোরে মেজর ভৌমিকের সঙ্গে ভ্রমণ। জলাশয়ে বাষ্পের মতো কুয়াশার উত্থান, বড় মায়াময়। ওখানে একটা সিঙ্কোনা-ফার্ম আছে। বাঁ দিকের জঙ্গলে একটা হায়েনা দেখেছিলেন। হায়েনার চোখের বিস্ময় মনে পড়ে যায়। সে-ও কি কর্নেলকে দেখে ক্রিসমাসের সান্তা ক্লস ভেবেছিল? মদনরাজার কেল্লার ভেতর মসজিদ। সেখানে দাঁড়িয়ে হাতিদের ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
এই অক্টোবরে জঙ্গল ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে।……
সকালে শূন্যোদ্যান থেকে নেমে আসার পর ডেভিড প্যাটার্সনের আবির্ভাব ঘটল। খুব উত্তেজিত চেহারা। হাঁফাচ্ছেন। কর্নেল বললেন, কী হয়েছে মিঃ ডেভিড? এনিথিং রং?
সার্টেনলি রং, কর্নেল!
হোয়াটস দ্যাট?
ডেভিড কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, ওই কবরখানায় দিনদুপুরেই শয়তানের চেলার উপদ্রব। গির্জার ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ। পণ্টারজিস্ট! পল্টারজিস্ট!
জার্মান শব্দ পল্টারজিস্টের অর্থ, শব্দকারী ভূত–যে সবকিছু ফেলে দেয়। ভাঙচুর করে। কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, কখন?
এইমাত্র। আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। বারবারাকে যেন বলবেন না। শুনলে আমাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপে অস্থির করবে। কর্নেল!
ওক্কে। কিন্তু মিঃ ডেভিড, আপনি উঁকি মেরে দেখলেন না কেন?
দেখেছি। কিছু নেই।
ভেতরে ঢুকেছিলেন গির্জার?
ঢুকতে যাচ্ছি, কী একটা পড়ল গালে। অদৃশ্য হাতের থাপ্পড়।
চামচিকে বা পাখি নয় তো?
গালটা দেখুন! ডেভিড বাঁ গাল এগিয়ে দিলেন। এখনও জ্বালা করছে।
কর্নেল পরীক্ষা করে দেখে কিছু পেলেন না। তবে গালটা লাল হয়ে আছে বটে। বললেন, সাহস, মিঃ ডেভিড, সাহস! সাহস এবং বাইবেলের আবৃত্তি। আপনি এখনই ফিরে যান। বাইবেল হাতে জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢুকুন।
আপনি আমার সঙ্গে চলুন, প্লিজ! আমি একজন আন্ডারটেকার ছিলাম। কত মৃতদেহ গাড়িতে বয়ে নিয়ে গেছি। সৎকারের ব্যবস্থা করেছি। কখনও কোন আত্মা আমাকে জ্বালাতন করেনি। এ হচ্ছে শয়তানের চেলাদের কাজ। আপনি চলুন।
আমি গিয়ে কী করব?
আমি কেয়ারটেকার। গির্জার ভেতর চার্চ সোসাইটির কিছু জিনিসপত্র আছে। সেগুলোর জন্য আমি দায়ী। ভেতরে ঢুকে দেখা দরকার কী অবস্থা হয়েছে। প্লি-জ!
অগত্যা কর্নেল উঠলেন।
ট্যাক্সি কবরখানায় দাঁড় করিয়ে রেখে কর্নেল বললেন, আমিই ভাড়া দের, মিঃ ডেভিড। সামান্য ব্যাপার। এই ট্যাক্সিতেই ফিরতে চাই।
.
গির্জার পুবের সেই জানলাটা ভেতর থেকে যথারীতি আটকানো। খড়খডি ফাঁক করে ছিটকিনি তুলে দিলেন কর্নেল। ডেভিড অবাক হয়ে বললেন, স্ট্রেইঞ্জ! আমি জানালা খোলা দেখেছিলাম।