যুধিষ্ঠির বেরিয়ে নমস্কার করে বলল, ড্রেনটা খুব নোংরা স্যার! ওটা ঢাকা। দিলে ভাল হয়।
তাকে পুলিশ পীড়ন করেছে বোঝা যাচ্ছিল। কর্নেলের আফসোস হচ্ছিল, অরিজিৎকে একটু বলে দিলে ভাল হতো। যুধিষ্ঠিরের মুখ দেখে মনে হয়, সে তত কিছু খারাপ লোক নয়। কর্নেল বললেন, আপনি কি অসুস্থ?
যুধিষ্ঠির করুণ হাসল। না, স্যার। গরিবের কপাল। অসুস্থ করে দিল। ভগবান আছেন, এর বিচার করবেন। খামোকা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। তারপর…….
পুলিশ? সে কী! কেন?
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি টের পেয়ে যুধিষ্ঠির চোখ মুছে বলল, দয়া করে যদি ভেতরে আসেন স্যার, সব বলছি। আপনি আমাকে কাইন্ডলি একটু হেল্প করুন স্যার। আমি গরিব লোক টুকিটাকি কাজকর্ম করি। মেদিনীপুরে আমার ফ্যামিলি। তাদের আনলে বুড়ো বাবা-মাকে কে দেখবে? অতগুলো লোকের তো জায়গা হবে না এই ছোট্ট ঘরে। আসুন স্যার দয়া করে।
ঘরটা ছোট্ট। নেহাতই ঘর। পলেস্তারাখসা দেয়াল। কালিঝুলিতে ভর্তি। একটা খাঁটিয়ায় বিছানা। ঘরেই কুকার জ্বেলে রাঁধা হয়। সামান্য তৈজস। দেয়ালে কয়েকটা দেবদেবীর ক্যালেন্ডার। একটা তাকে সবই বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানের মিস্ত্রির নানারকম হাতিয়ার। একটা চটের থলেয় ভর্তি।
কর্নেলকে সে খাঁটিয়ার পাশে একটা ফোল্ডিং চেয়ার পেতে দিল বসতে। কর্নেল বললেন, পুলিশে ধরল কেন আপনাকে?
যুধিষ্ঠির যা বলল, তার সারমর্ম হলো…..
টিনির বাবা মধুবাবু ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল। যুধিষ্ঠিরের। হঠাৎ স্ট্রোকে মধুবাবু মারা যান। ব্যবসা কে দেখবে? দোকানে উঠে যায়। যুধিষ্ঠির এসে টিনিদের মাথার ওপর দাঁড়ায়। এই যে বাড়িটা টিকে আছে। তা যুধিষ্ঠিরের জোরে। টিনির মা ন্যালাভোলা মেয়ে। কত মারোয়াড়ি এসে টাকার লোভ দেখাত। টিনির মা বাড়ি বেচে দিতে এক পা ছিলেন। এ পাড়ায় থাকার ইচ্ছে ছিল না তার। না থাকারই কথা। যুধিষ্ঠিরও কি থাকতে চায়? যত মস্তান-চোর-ডাকাতের মহল্লা। তো, বাড়ি বেচলে সেই টাকায় ভাল এরিয়ায় মাটিটুকু মাত্র কেনা যাবে। বাড়ি আর উঠবে না। যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়িবেচা ঠেকিয়েছিল।
এবার টিনির কথা।
টিনি স্কুল ফাঁইনালে পরপর দুবার ফেল করল। তবে গানের গলাটা ছিল। ভাল। এ পাড়ার ক্লাবে ফাংশন হলে নাচ-গাইত। সেউ সূত্রে পাশের পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হলো। ছেলেটাকে যুধিষ্ঠিরের ভাল মনে হতো। এখন বুঝতে পেরেছে, ভাল ছেলে ছিল না। সেই টিনিকে বারে গাইতে নিয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরকে টিনির মা অনুরোধ করেন, রোজ যেন কাজের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে। যুধিষ্ঠির সামান্য টাকা পেত এজন্য। তারপর যুধিষ্ঠিরের খটকা লাগে। মাঝে মাঝে টিনির কাছে এক সায়েব লোক আসে কেন?
কর্নেল জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির বলল, শক্ত চেহারার গুফো লোক। টিনিকে জিগ্যেস করলে বলত, অন্য একটা বারের মালিক। সেখান গাইলে বেশি টাকা পাবে। তা টিনি যাচ্ছে না কেন? টিনি বলেছিল, তা হলে হারামজাদা যোশেফ তাকে খুন করবে।
কে যোশেফ?
যে বারে টিনি গাইতে যায়, তার মালিকের লোক। দত্যিদানোর মতো চেহারা। অ্যাংলো সায়েব। এদিকে দিশি সেই সায়েব লোক সম্পর্কে টিনির কাছে যুধিষ্ঠির বেশি কথা জানতে চাইলে টিনি খেপে যেত। বলত, তোমার ও নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার? তবে টিনির মুখে তার নাম শুনেছিল একদিন যুধিষ্ঠির। ড্যা……ড্যা……ড্যাং সায়েব না কী নাম।
ড্যানি?
আজ্ঞে স্যার! ড্যানি।
বেশ। তারপর?
সেই ছেলেটা স্যার রোজ রাত্তিরে টিনিকে নিয়ে আসার সময় একটা কবরখানার গেটে অপেক্ষা করত। টিনি বলত, তুমি একটু অপেক্ষা করো। আসছি। বলে দুজনে কবরখানায় ঢুকত। যুধিষ্ঠিরের নাকের ডগা কুঁচকে গেল ঘেন্নায়।
ছেলেটার নাম কী?
সুব্রত, স্যার। লম্পট! লম্পটের ধাড়ি হারামজাদা!
কবরখানায় তো কেয়ারটেকার আছে। সে নিষেধ করত না?
গোমেশসায়েব? সে-ও তো টিনির কাছে আসত মাঝে মাঝে। যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলল ফের, কী একটা গণ্ডগোলে জড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। খামোকা পুলিশ আমাকে……
এসব কথা কি পুলিশকে বলেছেন?
সব বলেছি। বলব না কেন? যা জানি, সব বলে দিয়েছি।
কর্নেল গুম হয়ে গেলেন। অরিজিৎ তাকে এসব তথ্য গোপন করল কেন? তার সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা কষতে চায়? একটু ক্ষুব্ধ হলেন কর্নেল। এমনটি আরও একটা কেসে করেছিল। শেষে বলেছিল, দুষ্টুমি। বৃদ্ধ ঘুঘুমশাইয়ের সঙ্গে মগজের লড়াই করতে একটু সাধ জাগে। কর্নেল হেসে ফেললেন।
হাসলেন কেন স্যার?
পুলিশের কাণ্ড ভেবে।
পুলিশ স্যার মাথামোটা। খালি ডাণ্ডা চেনে। খামোকা আমাকে… যুধিষ্ঠির আবার চোখ মুছল।
টিনি খুন হয়েছে শুনলুম?
হয়েছে। হতোই। যুধিষ্ঠির ক্ষুব্ধভাবে বলল। আসল কথাটা বলে দিই স্যার! পুলিশকে বলিনি! বললে আরও ঠ্যাঙানি দিত আমাকে। ভাবত আমিও এর সঙ্গে আছি। বলে ফিসফিস করল, গোমেশসায়েব, ড্যানিসায়েব, সুব্রত আর টিনি কবরখানায় পাথর চুরির কারবার করত স্যার। ড্যানিসায়েবের বারটার নেই। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ড্যানিসায়েব কবরখানায় গোমেশসায়েবের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল এক রাত্রে। সুব্রত গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। টিনি তার সঙ্গে কবরখানায় ঢুকল। আমি কী আর করি, গেলুম গোমেশ সায়েবের সঙ্গে গল্প করতে। গিয়ে দেখি ঘরের ভেতর ড্যানি আর গোমেশ। চুপিচপি ২৯ পাথরের দরাদরি হচ্ছে। দামী পাথর স্যার!