হুঁ, তারপর?
তারপর চলে গেল। বলে ষষ্ঠীর হাত থেকে কফি গ্রহণ করলেন হালদারমশাই। কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ভোররাত্তিরে বাড়ি ফিরলুম। স্নান করে হেভি ব্রেক ফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছি। এবার বলুন, আর দরকার আছে নাকি কবরখানায় নজর রাখার?
না। এই যথেষ্ট। কর্নেল নিভন্ত চুরুট ধরালেন।
হালদারমশাই বললেন, কিন্তু ওরা কী খুঁজছিল?
একটা দামী ফলক। পাথরটাও দামী।
হ। বুঝছি।
বুঝে থাকলে আর একটা দায়িত্ব দেব হালদারমশাই!
স্বচ্ছন্দে। হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, প্রাণ দিয়া দিমু কর্নেলস্যার কইলে। সেই সঙ্গে ফাঁচ করে হাসি।
কর্নেল একটা কাগজ নিয়ে নকশা এঁকে বললেন, চন্দননগরের বাইরে এই এলাকা। ইভনিং লজ নামে এই পুরানো বাড়ি। এই হলো গঙ্গার ধারে বটতলা। এখানে বসে বাড়িটার দিকে নজর রাখতে হবে। কে কেমন চেহারার লোক যাতায়াত করছে, তার ডিটেল জানতে চাই। শুধু সাবধান, ওই বাড়িতে কাল্লু নামে একটা লোক আছে। সে খুনে প্রকৃতির। পরনে হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। পালক দিয়ে কান চুলকোনো অভ্যাস। আবার বলছি, সে সাংঘাতিক লোক।
তাচ্ছিল্য করে হালদারমশাই বললেন, পুলিশলাইফে কত সাংঘাতিক লোকেরে দেখছি, কর্নেলস্যার! ভাববেন না।
ছদ্মবেশের দরকার হবে এবারও।
ঠিক করেই ফেলেছি। সাধু সেজে গঙ্গার ধারে বটতলায় ধুনি জ্বেলে বসব। ব্যস!
দারুণ!
হালদারমশাই সোৎসাহে চলে গেলেন।…
.
সুব্রত টিনিকে কবরখানায় রাতে যেতে বলেছিল। গোমেশের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল।
নাকি গোমেশের কাছে চিঠিটা রেখে এসেছিল?
খুব চিন্তাযোগ্য পয়েন্ট এটা। গোমেশ টিনিদের বাড়ি গিয়েছিল। চিঠিটা দিতেই কি গিয়েছিল?
তা হলে গোমেশ চিঠি ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলবে কেন?
গোমেশ চিঠি দিতে টিনির কাছে নাকি অন্য কারণে গিয়েছিল? সুব্রত এবং টিনি প্রায়ই কবরখানায় যেত প্রেম করতে, এটা বোঝা যায়।
নাকি ছেঁড়া চিঠি জোড়তাপ্পি দিতে ভুল হয়েছে কর্নেলের? রাতে যেতে বলেছিল, না নিষেধ করেছিল? গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের বাকি টুকরোগুলি পেলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতো। গোমেশ সেগুলি পুড়িয়ে ফেলে।…
কর্নেল গাড়ির ব্রেক কষলেন বস্তির ভেতর। দুটো বাজে। উজ্জ্বল রোদ। গাড়ির কাছে উৎসুক একদল ছেলেমেয়ে ভিড় করল। কর্নেল তাদের মধ্যে লজেন্স চকলেট হরির লুঠ দিয়ে বলেন, তোমরা এই গাড়ি পাহারা দেবে। কেমন? ফিরে এসে আবার লজেন্স-চকোলেট!
ছেলেমেয়েরা খুব খুশিতে হাসতে লাগল। বয়স্ক লোকেরাও আমোদ পাচ্ছিল। সে রাতে এসে টিনিদের বাড়ি চিনে গেছেন কর্নেল। পোড়ো জমি, খোলা ড্রেন, আর এই পানের দোকান।
বেলা দুটোয় কারও সাহস হবে না তার ওপর হামলা করতে। তবু সাবধানে চারদিক দেখে নিলেন কর্নেল। বয়স্কদের উদ্দেশে বললেন, হম্ সি এম ডি এ
সে আতা হ্যাঁয় ভাই! ইয়ে মহল্লাকা ডেভালাপমেন্ট কাম হোনে লগে।
এতে কাজ হলো। যুবকেরাও এসে ভিড় করল। নানা অভিযোগ তাদের। কর্নেল সব নোট করার ভঙ্গি করলেন নোটবইতে। তারপর পা বাড়ালেন পোডড়া জমিটার দিকে। দলটি তাকে অনুসরণ করছিল। বললেন, ঠিক হ্যাঁয়। হম্ উও ড্রেন দেখনে যাতা ভাই! আপলোগোনে গাড়িকি পাশ ওয়েট কিজিয়ে!
তবু জনাকয়েক উৎসাহী যুবক তার সঙ্গ ছাড়ল না। তাদের মধ্যে বাঙালি অর্ধশিক্ষিত যুবকরাও আছে। তারা বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে থাকল। কর্নেল একতলা বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ও বাড়িটা কার?
একজন বলল, একটা খারাপ মেয়েছেলের স্যার! মার্ডার হয়ে গেছে।
কে থাকে বাড়িতে?
ওর মা থাকত, স্যার। আর থাকত যুধো নামে একটা লোক। সে হাজতে।
অপর একজন বলল, যুধোটাকে জামিনে ছেড়ে দিয়েছে। ভোরবেলা দেখলুম, রিকশো করে আসছে। পুলিশ হাড় ভেঙে দিয়েছে। খোঁড়াচ্ছে।
সবাই হাসতে লাগল। কর্নেল বুঝলেন, বস্তিবাসীদেরও কড়া নীতিবোধ আছে। এবং টিনি ছিল চক্ষুশূল। কর্নেল বললেন, ড্রেনটা বাড়িটার ধারে। একটা। প্রবলেম। যাই হোক, দেখি বাড়ির লোকেরা কী বলে।
একজন বলল, টিনির মা তো দুপুরে পাড়-ছেড়ে কোথায় চলে গেল স্যার! কোন মুখে আর এখানে থাকবে? যুবধা আছে।
টিনির মা চলে গেছেন? কর্নেল একটু চিন্তিত হলেন। বললেন, তা হলে আপনাদের ওই যুদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
আপনি যান স্যার! ও বাড়িতে আমরা কেউ যাই না। আর যুধোর কথা বলছেন? ও শালা এক ঢ্যামনা স্যার। টিনিকে তো খারাপ রাস্তা সে-ই দেখিয়েছিল।
আরেকজন বলল, হমলোগ জানতা স্যার। যুদ্ধে বহত খারাপ আদমি। টিনিকো রোজ এক বারমে লেকে যাতা শালালোগ। টিনি নাচতি উঁহাপর! খারাব ছোঁকরি থি।
কর্নেল ড্রেন পরীক্ষার ছলে চোখে বাইনোকুলার রেখে এগিয়ে পিছিয়ে একটা ভঙ্গি করলেন। ক্যামেরায় শাটার টিপেও ছবি তোলার ভান করলেন। সবাই ভোলা ড্রেনের যাচ্ছেতাই নিন্দা শুরু করল। তাদের এবার বড় আশা, ড্রেনটার সংস্কার হবে।
এবার কর্নেল টিনিদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেন। পাশের ঘর খুলে একটা ভীত মুখ উঁকি দিল। রোগা, তোবড়ানো গাল, ঢ্যাঙা একটা লোক। ভিড়টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে ঘৃণার ছাপ।
কর্নেল বললেন, আপনি এ বাড়িতে থাকেন?
যুধিষ্ঠির তাঁর অমায়িক কণ্ঠস্বরে একটু আশ্বস্ত হলো। বলল, আপনি কে, স্যার?
আমি সি এম ডি এ থেকে আসছি। এই ড্রেনটা…..