কর্নেল না ঘুরেই বললেন, মর্নিং ডার্লিং!।
টিনির হত্যাকারীকে দেখতে পাচ্ছেন বাইনোকুলারে? অরিজিৎ কৌতুকে বললেন, অসম্ভব নয়। বাইনোকুলার যে কত জরুরি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে বোঝাতে পারা গেল না ওঁদের মতে, ফাঁইন্যান্স দফতর আটকে দেবে। তা ছাড়া পুলিশ বাইনোকুলার নিয়ে দেখবেটা কী? পুলিশ কি মিলিটারি?
অরিজিৎ! কলকাতার মাথায় বিপদ সংকেত?
কী রকম?
শকুন, ডার্লিং, শকুন! কর্নেল ঘুরলেন। কলকাতা ভাগাড় হবে, এ তার লক্ষণ।
ওঃ! আপনার সেই শকুনতত্ত্ব? ষষ্ঠী বহুবার বলেছে? অরিজিৎ কাগজে মোড়া একটা জিনিস দিয়ে বললেন, রাতে আপনার ফোন পেয়ে তখনই ফোরেন্সিক এক্সপার্ট আপনার বন্ধু ডঃ মহাপাত্রের ল্যাবে গেলুম। ওঁর পরীক্ষা শেষ।
টিনির পার্স?
ইয়া।
ডঃ মহাপাত্র কী বললেন?
আশ্চর্য ব্যাপার, টিনির পার্স! টিনির ব্লাউসের ভেতর ছিল। অথচ টিনির আঙুলের ছাপ নেই। অন্য কারও আঙুলের ছাপ।
সুব্রতর আঙুলের ছাপ তো নিয়েছ!
টিনির পাসে সুব্রতর আঙুলের ছাপ পাওয়া নতুন কথা নয়। সে তার লেখাটি টিনির পার্সে ভরেছিল। কিন্তু টিনির পার্সে টিনির আঙুলের ছাপ না থাকাটা আশ্চর্য! এটা নতুন সূত্র। কর্নেল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।
অরিজিৎ তাকে অনুসরণ করে বললেন, গোমেশের আঙুলের ছাপও নয়। মিলিয়ে দেখা হয়েছে। গোমেশের আঙুলের ছাপ আমরা নিয়েছিলুম।
ড্রইংরুমে নেমে কর্নেল গার্ডেনিং পোশাক খুলে বাথরুমে হাত ধুয়ে এলেন। অরিজিৎ সোফায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। মোড়ক থেকে পার্সটা খুলে কর্নেল বললেন, হুঁ, আশ্চর্য!
উঁ?
ডার্লিং, এই পার্স টিনির না হওয়াই সম্ভব।
কিন্তু ওর ভেতরকার জিনিসগুলো দেখুন। সেফটিপিন, নেলপালিশ, লিপস্টিক, চুলের ক্লিপ…..
কর্নেল পার্স থেকে জিনিসগুলো বের করে অট্টহাসি হাসলেন।
আমি তোমাকে বলেছিলুম অরিজিৎ। এটা নিছক পার্স। মানিব্যাগ মাত্র! কোনও অতিচালাক একে নারীচরিত্র দেবার জন্য……হাঃ হাঃ হাঃ! বলে হঠাৎ গম্ভীর হলেন। সেফটিপিন, ক্লিপ যদি বা পার্সে থাকে, লিপস্টিক নেলপালিশ কেন? তা ছাড়া এগুলো সবই নতুন। সবই প্ল্যান্টেড, ডার্লিং!
তা হলে সুব্রতরই কাজ।
সম্ভবত তাই। সে জানত টিনি খুন হবে। লেখাটি ঠাণ্ডা মাথায় লিখেছিল। পাসটিও নতুন, জিনিসগুলো নতুন। তার মানে, টিনির হত্যাকাণ্ডের পরই সে টিনির ব্লাউসের ভেতর এটা গুঁজে দিয়ে পালিয়ে যায়। রেললাইনে চপ্পল ছিঁড়ে যায়। এনিওয়ে, এ সুব্রতরই কাজ।
তা হলে সে-ই খুনী।
জানি না ডার্লিং! বড় জটিল এই কেস। কর্নেল হাত বাড়ালেন এবং কফির পেয়ালা হাতে পৌঁছে গেল। ষষ্ঠী নালবাজারের নাহিড়ীসায়েবকে অর্ঘ্যদানের মতো কফির পেয়ালা দিয়ে ভয়ে-ভক্তিতে চলে গেল।
একটু পরে কর্নেল বললেন, এবার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, টিনির পার্স কোথায় গেল? তার বাড়িতে কোনও পার্স পাওনি। কাজেই টিনি খুন হওয়ার আগেই তার পার্স চুরি যায় বা কেড়ে নেওয়া হয়।
কেন?
কড়কড়ে নোট ছিল হয়তো! পদ্যটা তুমিও পড়েছ।
অরিজিৎ সোজা হয়ে বসে বললেন, সুব্রত! সুব্রত! তাকে খুঁজে বের করবই। সে-ই খুনী। তা অভাব ছিল। প্রেম-ট্রেম বোগাস! কর্নেল, নিরীহ বোকাসোকা চেহারার মধ্যেও খুনী লুকিয়ে থাকে। কবিদেরও খুনী হওয়া সম্ভব। কবি র্যাঁবোকে খুন করতে কবি ভেরলেন গুলি ছুঁড়েছিলেন। নিজেকে খুন করেন হেমিংওয়ে। তারপর…..
কবি-সাহিত্যিকরাও মানুষ। তাদের কেউ অপরাধী হতেও পারেন। মহাকবি বাল্মীকি প্রথম জীবনে দস্যু ছিলেন। সোক্রাতেস বলেছিলেন, আমি সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল হতে পারতুম। কিন্তু ইচ্ছাশক্তির জোরে নিজেকে দার্শনিক করে ফেললুম। তো কথা হচ্ছে, সুব্রত কেন পার্সটা ঢোকাল টিনির ব্লাউসে?
আমাদের ভুল পথে চালাতে।
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, দ্যাট মে বি আ পয়েন্ট। কিন্তু…..মাই গুডনেস! হঠাৎ নড়ে উঠলেন কর্নেল। অরিজিৎ! গির্জার পেছনের দেবদারু গাছের মাথাতেও শকুনের বাসা আবিষ্কার করেছি আজ!
আবার শকুনতত্ত্ব! চলি।
আন্ডারটেকার ডেভিড প্যাটার্সনকে ওই কবরখানার কেয়ারটেকার করা হয়েছে। কর্নেল হাসলেন। অদ্ভুত ব্যাপার, উনি আনন্দের সঙ্গে চাকরিটা নিয়েছেন।
শুনেছি। কিন্তু অদ্ভুত বলছেন কেন?
ডেভিড বলতেন শয়তানের ডেরা। সেই ডেরাতেই এবার উনি প্রহরী!
উপরি রোজগার। ওঁর বউ নাকি আন্ডারটেকার সোসাইটির হেড হয়েছেন!
অরিজিৎ লাহিড়ী উঠলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, কোট একজিবিট আপনার জিম্মায় রইল–ওই পার্সটা পরে ফেরত চাইব।
অরিজিৎ বেরুনোর একটু পরে হালদারমশাইয়ের আবির্ভাব ঘটল। বসেই বললেন, বাস্! ভূত, ভূত, ভূত! কী সর্বনেশে জায়গা কর্নেলস্যার! ষষ্ঠীকে বলুন, বেশি দুধ দিয়ে কড়া কফি। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
ষষ্ঠী হালদারমশাইকে দেখলেই অস্থির হয়। সে কফি আনতে দৌডুল। কর্নেল বললেন, রাত্রে ছিলেন নাকি কবরখানায়?
সারা রাত! হালদারমশাই করুণমুখে বললেন। হালার মশায়…….সরি কর্নেলস্যার, মসকুইটো! একেকখানা রকেট। এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায়। এই দেখুন, শরীরের অবস্থা!
আপনার কষ্টের জন্য দুঃখিত, হালদারমশাই!
কিছু কষ্ট না। পুলিশের চাকরিতে কত মশা দেখেছি। এ কী মশা! বলে তিনি নস্যি নিলেন। ফাঁচ করে হেসে ফের বললেন, সায়েব তো সন্ধ্যাবেলা কেটে পড়ল। তখন ঢুকলুম। গির্জার পাশের ঘরের বারান্দায় পাগল শুয়ে আছে। নাকি। অনেক রাতে গির্জার ভেতর রহস্যজনক শব্দ। টর্চের আলো। গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের আড়ালে বসলুম। তিনজন লোক স্যার, আঙুল দেখালেন হালদারমশাই। একজন তাগড়াই, একজন বেঁটে, একজন মাঝারি। অন্ধকারে কিছু বোঝা গেল না। তার ওপর হঠাৎ টিপটিপ করে বৃষ্টি। ওদের একজন গেটের কাছে, একজন গির্জার জানালার ধারে, আরেকজন জানালা গলিয়ে গির্জার ভেতরে। কতক্ষণ পরে বেরিয়ে বলল, নাথিং। নেহি মিলা!