ষষ্ঠী খামখানি দুহাতে দিয়ে দ্রুত কেটে পড়ল। খামের মুখ ছিঁড়ে কর্নেল দুটো ভঁজ করা কাগজ বের করলেন। একটা অরিজিতের চিঠি। লেখা আছে : সুব্রতর অফিসের টেবিলে ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। সন্দেহজনক মনে হলো। বৃদ্ধ ঘুঘুমহাশয়ের প্রতি উপহার। ইতি–অল।
দ্বিতীয় কাগজটি নিউজপ্রিন্ট। ডটপেনে লেখা সুব্রতর একটি কবিতা। কবিতাও লিখত তা হলে! কিন্তু এ কী অদ্ভুত কবিতা!
॥ পতন ॥
চুপিসাড়ে এসেছে সে আলতো পা
বেড়াল ভূত কি পরী জানতো না।
অবশেষে আততায়ী হাতে ছুরি
কণ্ঠার হাড় কাটে ভাঙা চুড়ি
রেলগাড়ি ঝমাঝম বাঃ রে বাঃ
কড়কড়ে নোটগুলি মূল্য তা
নিয়ে ঘোরে দিব্যি তো ফালতো না।
হায় রে সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা
সে ছাড়া কেউ না আর কেউ তো না।
বারকতক পড়ার পর কবিতা থেকে একটি ছবি ফুটে উঠল। চুপিসাড়ে আসা একজন আততায়ী, একটা হত্যা, হাতের চুড়ি ভেঙে পড়া, রেলগাড়ির শব্দ, কিছু টাকা……। রেলগাড়ির শব্দ হয়েছিল হত্যার সময়, তাই টিনির আর্তনাদ শোনা যায়নি কি? সাক্ষী শুধু ক্রিস্টিনা…। কিন্তু ক্রিস্টিনা তো মৃত। তার কবরের ওপর একটি হত্যা ঘটল। তবু সাক্ষী কেন সে? মৃতেরা চিরমূক। তা হলে সাক্ষী শব্দটা কেন? নিছক আলঙ্কারিক প্রয়োগ?
কর্নেল কাগজ খামে ঢুকিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন। তারপর পোশাক বদলে বেরুলেন। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার, ক্যামেরা, হাতে প্রজাপতিধরা নেটের স্টিকছড়ির মতো। তার চেনা মূর্তিটি।
গাড়ি নিয়েই বেরুলেন।
ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির গেটের সামনে এক নোংরা পোশাকপরা কালিঝুলি-মাখা পাগল দাঁড়িয়ে কাকে শাসাচ্ছে। বিড়বিড় করছে। কর্নেলের গাড়ি দেখেই সে ঘুরে ফাঁচ করে হাসল।
হালদারমশাই।
কর্নেল আস্তে বললেন, খুব মানিয়েছে।
গোয়েন্দা হালদারমশাই ফের অনবদ্য ফাঁচ করে বললেন, সন্দেহজনৰ তেমন কিছু দেখলুম না কর্নেলস্যার। তবে নতুন কেয়ারটেকার অ্যাপয়েন্ট করেছে। হালায় ঢুকতে দিচ্ছে না।
গাড়িটার দিকে লক্ষ্য রাখুন আপাতত।
বলে কর্নেল গেটে গেলেন। চার্চ সোসাইটি নতুন কেয়ারটেকার পাঠিয়েছেন। তাকে দেখেই কর্নেল, চেঁচিয়ে উঠলেন, হাই ডেভিড! আ সারপ্রাইজ ইনডিড! আ কেয়ারটেকার ফ্রম অ্যান আন্ডারটেকার!
ডেভিড প্যাটাসন খুব হেসে বললেন, আ টেকার ওনলি টেকস সামথিং গুড অর ব্যাড। বাট আ টেকার লাইক মি ওনলি টেক দা ডেডস!
ভালো। তবে এটা পদোন্নতি, না পদাবনতি সেটাই প্রশ্ন।
ডেভিড বললেন, আমার ক্ষেত্রে পদাবনতি। তবে পুষিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী বারবারার পদোন্নতি হয়েছে। এখন সে আন্ডারটেকার।
আশা করি, বারবারা বেচারিকে ছেড়ে এই ভুতুড়ে কবরখানায় রাত কাটাবেন না?
ডেভিড হতাশার ভঙ্গিতে বললেন, সোসাইটি পীড়াপীড়ি করছে, নিয়ম হচ্ছে নিয়ম। তবে আমি এই শয়তানের দরবার পাহারা দেব রাতবিরেতে? কখনও না। রাত নটাতেই কেটে পড়ব। আসব ফের সকাল সাতটায়।
কথা বলতে বলতে দুজনে কবরখানার ভেতর হাঁটছিলেন। কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখছিলেন। হঠাৎ পথ ছেড়ে কবরের জঙ্গুলে জায়গায় ঢুকে গেলেন। ডেভিড হুঁশিয়ারি দিলেন, সাবধান কর্নেল! সাপ থাকতে পারে। কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না।
উত্তর দিকে ঘুরে ঝোপঝাড় ঠেলে পুবে ক্রিস্টিনার কবরের কাছে গেলেন। দাঁড়িয়ে চারপাশে বাইনোকুলোরে খুঁটিয়ে দৃষ্টিপাত করলেন। দূরে ডেভিড দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে বিরক্তির ছাপ। ভুরু কুঁচকে গেছে। গেটের ফাঁক গলিয়ে পাগল উঁকি দিচ্ছিল। কর্নেলস্যারের গোয়েন্দাগিরি লক্ষ্য করার জন্য পাগলের বড় কৌতূহল বরাবর। কিন্তু ডেভিড তেড়ে গেলেন তার দিকে।
ক্রিস্টিনার কবরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। সুব্রতর কবিতাটি সত্যিই কোনও সংকেতবহ কি না দেখা দরকার। আগের বার আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। এবার আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান শুরু করলেন।
একটু পরে কবরের ফাটলে ভাঙাচুড়ির কয়েকটি টুকরো আবিষ্কার করলেন কর্নেল।
কবরের দক্ষিণের অংশে নিচে ঘাসের ভেতরও দুটো টুকরো। মড মেয়ে হয়ে উঠেছিল টিনি। তারা আজকাল রঙবেরঙের চুড়ি পরে হাতে। প্লাস্টিকের চুড়িই।
চুড়ির টুকরো এগিয়ে গেছে গ্রিয়ার্সনের কবরের দিকে। গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছেও তিনটি টুকরো। কেন?
ক্রিস্টিনা এবং গ্রিয়ার্সনের কবরের মধ্যে একটা ঝোঁপের আড়াল। টিনি গ্রিয়ার্সনের কবরের কাছে গিয়েছিল এবং সেখানেই কেউ তার হাত ধরে টেনে এনেছিল। এত জোরে চেপে ধরেছিল যে মুটমুট করে চুড়ি ভেঙে গিয়েছিল?
সেটাই কি টিনির ভুল পথে পা বাড়ানো। ক্রিস্টিনার কবরের কাছে ফিরলেন কর্নেল। কবরটা আবার খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। উত্তর-পূর্ব কোণে ফাটলটা প্রায় সিকি ইঞ্চি। নিচের মাটিও ফেটে গেছে। ঘাস সরাতেই একটা টাটকা খোঁড়া গর্ত আবিষ্কৃত হলো।
গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা ছুঁচো। ছুঁচোর গর্ত। প্রজাপতি ধরা স্টিক দিয়ে গর্তের ভেতর খোঁচা দিলে আরও ছুঁচো বেরুল। কিচকিচ শব্দে গাল দিতে দিতে পালাল। কিন্তু ছুঁচোর গর্ত খুঁড়ল কে? কী ছিল ওর ভেতর? কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কিছু লুকোনো ছিল। কেউ তুলে নিয়ে। গেছে……
৫. লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ
কর্নেল শূন্যোদ্যানে দাঁড়িয়ে লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজের ওদিকে দেবদারু গাছের শীর্ষে শকুনের বাসা দেখছিলেন। বিরক্তিকর দৃশ্য। অথচ ক্ষত খোঁচানোর মধ্যে মানুষের যেমন কী একটা প্রবণতা আছে, এক্ষেত্রেও তা-ই। বিষদৃষ্টে একটি শকুনকে দেখতে দেখতে পেছনে শুনলেন, মর্নিং ওল্ড বস!