একটু পরে অরিজিৎ লাহিড়ীর নৈরাশ্যমিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল ফোনে, ওকে। ঠিক আছে।……
কর্নেল আবার বেরুলেন।
.
গণেশ অ্যাভিনিউতে রাস্তা থেকে একটা তেতলা বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে সাইনবোর্ডটি দেখা যায় : হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি। কৃতান্তকুমার হালদার পুলিশের সার্কেল অফিসার ছিলেন গ্রামাঞ্চলে। রিটায়ার করে এই লাইন ধরেছেন। ঢ্যাঙা মানুষ। প্রচণ্ড নস্যির নেশা। কর্নেলকে খুব খাতির করেন। ইতিপূর্বে কর্নেলের সঙ্গে বেশ কিছু কেসে সহযোগিতা করেছেন, যেচে পড়েও করেছেন। বিভ্রাটও বাধিয়েছেন। তবে লোকটি ঝুঁকি নিতে পারেন। ছদ্মবেশ ধরতে যেমন উৎসাহী, তেমনি দক্ষ।
ইদানীং কেস পাচ্ছেন না বলে মনমরা হয়েই ছিলেন। ছাদে অ্যাসবেস্টস চাপানো ছোট্ট ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলে ঠ্যাং তুলে বলে ছিলেন। নাকে নস্যির ছোপ। কর্নেলের সাড়া পেয়েই চোখ খুললেন এবং প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, স্বপ্ন! স্বপ্ন!
স্বপ্ন নয় হালদারমশাই! রহস্য! টাটকা রহস্য! কবরখানায় দুদুটো খুন। দামী কবরের ফলক চুরি।
হালদারমশাই রহস্যের গন্ধ পেলেই শক্ত হয়ে যান। চোখ দুটো গোল করে। বললেন, হঃ!
হঃ কী? কাগজে পড়েননি?
পড়ছি! পড়ছি! হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। তারপর ঝটপট নস্যি নিয়ে ফাঁচ শব্দে স্বকীয়তাসম্পন্ন হাসিটি হাসলেন। কর্নেলস্যার! কী আশ্চর্য! আমি কি সত্যি স্বপ্ন দেখছি, না কর্নেলস্যারকে দেখছি গরিবালয়ে!কাইন্ডলি টেক ইওর সিট কর্নেলস্যার!
কর্নেল বুঝলেন, এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছেন প্রাইভেট গোয়েন্দা {ক কে হালদার। ড্রয়ার থেকে খাম বের করে ফেললেন। খামে লেখা সিমেট্রি মিস্ট্রি। ভেতরে খবরের কাগজের কাটিং। কর্নেল এ-ও বুঝলেন, এই কেসটিতে তাঁর নাক গলানোর খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও কোনও পক্ষ থেকে এঁকে ডাকা হয়নি। তবু প্রতীক্ষায় ছিলেন।
কর্নেল তাকে কাগজের খবরের বাড়তি কিছু বললেন না। বলে পরে অত্যুৎসাহী গোয়েন্দা ভদ্রলোক স্বভাবমতো কী বিভ্রাট বাধিয়ে বসবেন, বলা যায় না। তারপর বললেন, হালদারমশাই! আপনাকে পাগল সেজে ওই কবরখানার। আনাচে-কানাচে থাকতে হবে। অন্তত দুটো দিন। আমার ধারণা, গ্রিয়াসনের কবরের ফলক এখনও কবরখানায় কোথাও লুকানো আছে। কারণ গোমেশ জেভিয়ারের মৃত্যুর পরই পুলিশ পাহারা বসেছে। আজ থেকে পুলিশ সরে যাচ্ছে। এখন আপনিই প্রহরী। বুঝলেন কি কিছু?
হ। বুঝছি! বলে উত্তেজিত হালদারমশাই আরেক টিপ নস্যি নিলেন। উত্তেজনার ব্যাপার ঘটলেই তিনি পূর্ববঙ্গীয় মাতৃভাষায় কথা বলেন। বরাবর এই অভ্যাস।
কী বুঝলেন?
আমারে পাগল সাজতে হইব।
নজর রাখতে হবে…….
হাত তুলে হালদারমশাই বললেন, এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!
সশস্ত্র থাকতে হবে। আপনার রিভলবার…..
এনাফ, কর্নেলস্যার, এনাফ!
হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে বেরিয়ে কর্নেল তার লাল রঙের ল্যান্ডরোভার গাড়িটির গতি সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউমুখী করলেন। জ্যাম ছিল পাতালরেলের কারণে। ম্যাডান স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছুতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল।
রয় অ্যান্ড কোম্পানির দোকান তাঁর চেনা। বিশাল হলঘরের ভেতর সেকেলে আসবাবপত্রের স্তূপ। একদা এগুলি সায়েসুবো রাজা-মহারাজা রইস লোকেদের গৃহশোভা ছিল, বোঝা যায়। চোখ জ্বলে যায় সৌন্দর্যের দীপ্তিতে, যদিও কালের ধূসর পাঞ্জার ছাপ পড়েছে গায়ে। কর্নেল ঘুরে ঘুরে জিনিসগুলি দেখছিলেন, ক্রেতার ভঙ্গি। কোন জিনিস কবে নিলাম হবে, তা স্লিপে লিখে আটকানো আছে।
শেষপ্রান্তে কোনার দিকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন কর্নেল। একটি ডিমালো আয়না। বেলজিয়াম কাঁচে তৈরি। অবিকল গোমেশের ঘরে দেখা সেই আয়নাটার মতো।
একই গড়নের আয়না অনেক থাকতে পারে। নিঃসংশয় হওয়ার জন্য ঝুঁকে গেলেন একটু। কোম্পানির লোক ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, উসকি নিলাম পরশু রোজ হোগি, সাব! খাস বিলয়তকি চিজ।
জেরা দেখনা চাহিয়ে ভাই!
দেখিয়ে। লোকটি দাঁত বের করল।
পেছনে কিছু লেখা ছিল সুন্দর হস্তাক্ষরে। ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে। দুটি ডবলিউ হরফের অস্পষ্ট চাপ। উইথ বেস্ট উইশেস? এর পর অস্পষ্ট একটা হরফের মাথা। জি। গোমেশে জি আছে। গোমেশ শব্দটি বিকৃত উচ্চারণ। শব্দটি পর্তুগিজ গোম্জ্। সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে গোম। কাল্লু গোমসায়েব গোমসায়েব বলেছিল। সে মেমসায়েবদের মুখে সঠিক উচ্চারণ শুনে থাকবে। হিব্রু জামে থেকে গ্রিক লাতিনে জেমস। পর্তুগিজ ভাষায় তাই বিকৃত গোমেজ।
হুঁ, সেই আয়নাটাই বটে। গোমেশ জেভিয়ারকে কেউ উপহার দিয়েছিল, সম্ভবত তার বিয়েতে। সেটা এত দিনে তিনি বেচে দিয়েছিলেন কেন? অস্ট্রেলিয়ায় ছেলেমেয়েদের কাছে চলে যেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু এই আয়না বেচে কি তত টাকা পাওয়া যায়?
তা হলে কি গোমেশই গ্রিয়ার্সনের কবরের ফলকটা……
কর্নেল কয়েক মুহূর্তের জন্য শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ঘুরে আস্তে পা বাড়ালেন। রয়সায়েবের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছায় এখানে আসা। তার অফিস দোতলায়। হলঘরের ভেতর থেকে কাঠের সিঁড়ি ঘুরে ঘুরে দোতলায় উঠেছে। আসবাবপত্রের ভেতর দিয়ে এগিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মুনলাইট বারের সিনহার সঙ্গে। সিনহা বলে উঠলেন, হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!