আতঙ্ক, ডার্লিং! কবিসাহিত্যিকদের মন কোমল। স্পর্শকাতর। তাই তারা কলমে যতই খুনখারাবি করুক, বাস্তবে খুনখারাবি দেখলে দিশেহারা হয়ে পড়ে!
বোগাস! সুব্রত টিনির রক্তাক্ত বডি ঘেঁটেছিল। ভুলে যাচ্ছেন, তার ছেঁড়া জুতোয় রক্তের ছাপ। কাগজে রক্তের ছাপ।
মরিয়া হয়ে পড়েছিল সে। আমার ধারণা টিনির পার্সে পাওয়া এই লেখাটির মধ্যে আসলে কোনো সূত্র লুকোনো আছে। সুব্রত চেয়েছিল খুনী ধরা পড়ুক। কিন্তু খুনীকে তার প্রচণ্ড ভয়। এর দুটো কারণ থাকা সম্ভব। খুনী খুব শক্তিমান প্রভাবশালী লোক এবং সুব্রত তাকে চেনে।
লেখার জেরক্স কপি তো দিয়েছি। আপনি কিছু সূত্র পেলেন না এখনও?
না!
অথচ আপনার বিশ্বাস ওতেই খুনীকে চেনার সূত্র আছে!
ইউ আর ড্যাম রাইট! ওকে, ছাড়ি। পরে যোগাযোগ করব।
কর্নেল ফোন রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে টাকে হাত বুলিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বইয়ের র্যাক থেকে দা গ্রেট ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার্স বইটি বের করলেন। প্রকাণ্ড বই।
কর্নেল চার্লস গ্রিয়ার্সনের সংক্ষিপ্ত একটি জীবনী এবং কর্মকাণ্ড আছে ওতে। তিনি প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী রিচার্ড বার্টনের সঙ্গে করাচি সেনানিবাসে ছিলেন। পরে বার্টন মুসলিম ছদ্মবেশে মক্কায় যান। বই লেখেন দা পিলগ্রিমেজ টু মেক্কা। পরে আরব্য উপন্যাস অনুবাদ করেন। আরও পরে যান আফ্রিকায় নীলনদের উৎস সন্ধানে। আর গ্রিয়ার্সন সিপাহি বিদ্রোহের সময় পালিয়ে যান পারস্যে। সেজন্য তার শাস্তি হয়েছিল ছমাস জেল। পারস্য থেকে তাকে ধরে আনা হয়েছিল। জেলে আত্মজীবনী লেখেন। সেটির খোঁজ মেলেনি। তবে একটি নোটবই পাওয়া গিয়েছিল। তাতে এই কয়েকটি লাইন উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে আছে এবং তার ওপরে আছে মধ্যযুগের পহলভি ফার্সিতে লেখা কিছু কথা! এই বইয়ে পুরো পাতাটির ব্লক করে ছাপানো হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদের বাংলা করলে দাঁড়ায় :
আমি, দিব্যজ্ঞানী, আর্দশের। অহু মাজদা আমাকে রক্ষা করতে এসেছিলেন।
পারস্যে পহলভি আমল খ্রীঃ পূর্ব ২৫০ থেকে খ্রীস্টাব্দ ১৯১ পর্যন্ত। তখনকার অগ্নিপূজক জোরাস্তার ধর্মাবলম্বী সম্রাট হ.-এর। তার লেখা আবিষ্কার করেছিলেন প্রিয়ার্সন?
নিশ্চয় তাহ। যে কালো দামী পাথরের ফল গ্রিয়ার্সনের কবরের মাথায় ছিল, সেটি কি সেই ফলক? তার উল্টো পিঠেই কি পহলভি লেখাটি ছিল?
তা হলে তো……
কর্নেল নড়ে উঠলেন। কেউ কি জানতে পেরেছিল এই গোপন সত্যটি? পাথরের নিজস্ব দামের চেয়ে সেটির ঐতিহাসিক দাম বহু লক্ষ টাকা বেশি। লক্ষ টাকা কেন, আজকাল কোনও ধনকুবের বিদেশী সেটি কোটি ডলার দামেও সংগ্রহ করতে চাইবেন। সম্রাট আর্দশেরের ফলকের দাম কম নয়।
কর্নেল বইটি র্যাকে রেখে হাঁকলেন, যষ্ঠী! আজ আটটায় ব্রেকফাস্ট খাব। বেরুব।…….
.
ইস্টার্ন সাব-আর্বান সিমেট্রির পুলিশরক্ষীরা কর্নেলের কার্ড দেখেই সেলাম ঠুকে বসল। এস. আই. সঙ্গে আসতে চাইলেন বিনীতভাবে, যদি কোনও সাহায্য দরকার হয় কর্নেল সায়েবের! কর্নেল সহাস্যে বললেন, না, না। আমি জাস্ট পাখি দেখতে আর দুষ্টু প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
পুলিশমহলে কিংবদন্তির নায়ক বৃদ্ধ ঘুঘুর সঙ্গলাভে বঞ্চিত পুলিশ অফিসার একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন বৈকি।
কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি দেখতে দেখতে পুবের পাঁচিলের কাছে ক্রিস্টিনার কবরে এলেন। এখানেই টিনি খুন হয়েছিল। তার ডাইনে হাত সাত-আট দূরে গ্রিয়ার্সনের কবর। শূন্য ফলকের চৌকো স্থানটি চোখে খচখচ করে বিধছে। ক্রসটিও উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। তবে অনেক আগে। তার চিহ্ন স্পষ্ট।
শূন্য ফলকের নিচের ঘাসের দিকে ঝুঁকে বসলেন কর্নেল। আতস কাচ বের করে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে ঘাসের পাতা বেরুনো ঊটার খাঁজ, তলার মাটি পরীক্ষা করতে থাকলেন। বৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিক চিহ্ন থাকলে ধুয়ে যাওয়ার কথা। তবে লাইম কংক্রিটের গুঁড়ো প্রচুর। গুড়োগুলো ডাইনে এগিয়ে গেছে। হাত দশেক তফাতে আবার একই গুড়ো ঘাসের তলায়।
যে উপড়েছিল, সে গুঁড়ো ঝেড়ে সাফ করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল ফলকটা।
গতিপথ লক্ষ্য করে বুঝলেন ভাঙা গির্জাঘর। কিন্তু এর পর গুডোর ছড়াছড়ি সর্বত্র। আর পার্থক্য করা অসম্ভব। গির্জা ঘরের পেছনে একটা দরজা আছে। কপাট উপড়ে নিয়ে গেছে কারা। সংকীর্ণ করিডর দিয়ে পুবের জানালার কাছে গেলেন কর্নেল। সেকেলে লম্বা খড়খড়ি দেওয়া জানালা। ভাঙাচোরা অবস্থা। হাত গলিয়ে মরচেধরা ছিটকিনি খুলে আস্তে টানলেন। একটা পাট খুলে গেল অদ্ভুত শব্দে। অশরীরী আত্মার ক্রুব্ধ কণ্ঠস্বর মনে হলো। প্রার্থনা গৃহের প্রায়শ্চিত্ত প্রার্থনায় রত কোনও আত্মা কি বিরক্ত হলো? কিন্তু তিনটে গরাদ নেই!
কর্নেল নিঃশব্দে উঠে ভেতরে ঢুকলেন। টর্চের আলো জ্বালার দরকার নেই। খোলা জানালা দিয়ে ছোট্ট গির্জার ভেতর সবটাই দেখা যাচ্ছে। একটা চেয়ারও অবশিষ্ট নেই। একপাশে আবর্জনার গাদার মতো চেয়ারগুলোর টুকরো। কতকাল এই গির্জায় কেউ প্রার্থনা করতে ঢোকেনি। মেঝেয় ধুলো। দেয়ালে ঝুলকালি। ফাটা ছাদ দিয়ে আলো ঢুকছে। লম্বা রোদের ফালি তলোয়ারের মতো বিঁধছে গির্জার বুকে।
কর্নেল হাঁটু মুড়ে বসে মেঝেয় টর্চের আলো ফেললেন। জুতোর ছাপ ইতস্তত পরিষ্কার। পুলিশের জুতোর চাপও থাকা স্বাভাবিক। পুলিশ গির্জার ভেতরও সূত্র খুঁজেছে। কিন্তু একটা ছাপ অন্যরকম। জুতোটার হিল পুলিশের নয়।