কর্নেলকে থামতে দেখে ডি সি ডি ডি ভুরু কুঁচকে বললেন, শুট! কর্নেল জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম একটি কেসে আমি উল্টোমুখে হেঁটে যাচ্ছিলুম। ডার্লিং! তোমাকে তো বরাবর বলে এসেছি, খুনীকে ধরতে হলে তার ছায়ার পেছনে দৌড়ো না, যে খুন হয়েছে তাকেই খুঁজে দেখ। খুনীকে তার মধ্যেই পেয়ে যাবে। সব হত্যাকারী লুকিয়ে থাকে তার ভিকটিমের মধ্যে। এবার আমি……বয়স অরিজিৎ, বয়স! আমাকে বাহাত্তুরে ধরেছে!
অরিজিৎ একটু হাসলেন। টিনিদের বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে? ওকে! কী সূত্র আশা করছেন আপনি?
কিছু না। তবে যেখানে দেখিবে ছাই/উড়াইয়া দেখ তাই/পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন! বলে কর্নেল আবার এক অট্টহাসি ছাড়লেন।
ওঃ! আপনি বড্ড বেশি পৈশাচিক হাসি হাসছেন আজ! অরিজিৎ মন্তব্য করলেন।
কর্নেল হাসি থামিয়ে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দুলতে শুরু করেছেন।
অরিজিৎ উঠে বললেন, চলি। আমিও বড় টায়ার্ড!
ডার্লিং, সুব্রত……
অরিজিৎ চমকে উঠলেন। সুব্রত? হু জি দ্যাট ফেলো?
সুব্রত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবকের সাংবাদিক এবং গল্প লিখিয়ে।
বিরক্ত ডি সি ডি ডি বললেন, হেঁয়ালির স্বভাব আপনার গেল না!
অরিজিৎ! সুব্রত হয়তো বিপন্ন। তার পুলিশ প্রোটেকশন দরকার। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। সেজন্যই এখনই তাকে গ্রেফতার করে হাজতে রাখার ব্যবস্থা করো। সেটাই হবে তার প্রকৃত প্রোটেকশন। না, তার ওপর জুলুম কোরো না। তাকে হাজতে সাচ্ছন্দ্যে রাখবে। গল্প লেখার সুযোগ দেবে। খাওয়া-দাওয়া যেন কয়েদিদের মতো না হয়। সুব্রত এই কেসে খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘুটি। এক মিনিট, সে এখন কাগজের অফিসে আছে কি না জেনে নিই।
বলে কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করলেন। তারক গাঙ্গুলিকে চাইলেন।
তারক গাঙ্গুলি নটায় চলে গেছেন। চিফ রিপোর্টার অমল গুপ্ত লাইনের ও প্রান্তে। কর্নেল বললেন, সুব্রত চৌধুরি। আপনাদের নতুন রিপোর্টার……। নেই?…….। অসুস্থতা…….ওক্কে! ওর বাড়ির ঠিকানাটা……হ্যাঁ, ধরে আছি।
ডান হাতে টেবিল থেকে প্যাড-কলম টেনে বললেন, ১২/২ গোবিন্দ মিস্ত্রি লেন, কলকাতা ১৭……। ওকে! পার্ক সার্কাস……ও! বেকবাগান এরিয়া? থ্যাংকস্ ডার্লিং! না, না! আমি সত্যিই একটা পত্রিকা করছি। অপরাধ তদন্ত বিষয়ক পত্রিকা। তার ভেতর দুটো গল্প, খান চারেক পদ্য না ঢোকালে পাবলিক খাবে না! হাঃ হাঃ হাঃ!
ফোন রেখে কর্নেল অরিজিতের দিকে তাকালেন। কুইক! ঠিকানা লিখে নাও। সুব্রত বিপন্ন। আর একটা কথা, সুব্রতের হাতের লেখার নমুনা আমি দেখেছি। তবু টিনির পার্সের ভেতর পাওয়া লেখাটির সঙ্গে ভালভাবে মিলিয়ে দেখা দরকার। আর তার আঙুলের ছাপের সঙ্গে ওই লেখাটির কাগজে পাওয়া ছাপ…
এনাফ! বলে ডি সি ডি ডি কর্নেলের টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন।…..
৪. রেনবো অর্কিড
মার্চে রূপগঞ্জ থেকে আনা রেনবো অর্কিডের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কর্নেল। এপ্রিলে চমৎকার রামধনুরঙা ফুল ফুটিয়েছিল। এখন বেমরশুমে ঝিমোচ্ছে। তবে বর্ষার পর এখন জাঁকালো চেহারা। যেন ধাড়ি মুরগি ডিমে তা দিচ্ছে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুতে সেই বসন্তকাল।
কিন্তু প্রকৃতির কেন এত সব আয়োজন? একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে নিষ্ঠুর হত্যা। সুন্দর অসুন্দরকে নিয়ে ডানহাত বামহাতে লোফালুফি। অদ্ভুত বৈপরীত্যের ছন্দের বাঁধা এই বিশ্বের সব কিছু। ডান হাতে দান, বাম হাতে কেড়ে নেওয়া– রবীন্দ্রনাথ চরম প্রশ্নটি ভুলে গেছেন, কিন্তু কেন?
সব চেয়ে অদ্ভুত লাগে, প্রকৃতি নির্বিকার। তার কাছে রক্ত এবং অশ্রুর কোনও পৃথক মূল্য নেই। প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু দার্শনিকরা যথার্থ সত্যটিকে জেনেছিলেন। যিনি অন্নপূর্ণা, জীব পালন করেন স্নেহে, তিনিই কালী, ধ্বংস করে ফেলেন সব কিছু, সঙ্গে হিংস্র সহচরীরা। পায়ের তলায় জড়বৎ শিব। আবার সেই দার্শনিকরাই অন্যদিক থেকে সত্যকে জেনে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর স্রষ্টা পালক সংহারকর্তা এই তিন প্রতীক এঁকে রেখে গেছেন।
নিরীশ্বরবাদী মার্ক্স এঙ্গেলসও প্রকৃতিতে একই দ্বন্দ্ব দেখেছিলেন। থিসিস, অ্যান্টিথিসিস, সিন্থেসিস-তত্ত্বকে বাজিয়ে দেখলে একই ব্যাপার! জড়ে যেমন দ্বন্দ্বের ধারা, চৈতন্যেও তাই। দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্বহীন অবস্থা অকল্পনীয়। প্রকৃতি দ্বদ্বাকীর্ণ।
বাবামশাই!
কর্নেল ক্রুদ্ধ হয়ে ঘুরেই হেসে ফেললেন। মূর্তিমান রসভঙ্গ ষষ্ঠীচরণ!
আজ্ঞে, আর কেউ হলে ডিসটাব করি? নালবাজারের নাহিড়িসায়েবের ফোং!
অগত্যা নিচে ড্রয়িং রুমে যেতে হলো কর্নেলকে। মোটে সাতটা বাজে। আকাশ আজও নির্মেঘ। দেবদারুশীর্ষে শকুনগুলি দেখার ইচ্ছে ছিল। হঠাৎ তত্ত্বচিন্তার উপদ্রব।
বলো, ডার্লিং! সুব্রত……
রাতারাতি উধাও। বাড়িতে বলে গেছে, পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্টে বাইরে যাচ্ছে-দার্জিলিঙ গোখা মুভমেন্ট কভারজে। কিন্তু……
পত্রিকার কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তাকে কোথাও পাঠানো হয়নি!
কী আশ্চর্য! জানেনই যদি, তাহলে কেন……
ওকে ডার্লিং! মুখ বন্ধ করলুম। গো অন, প্লিজ!
গা ঢাকা দিয়েছে। আপনি কাল গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেই এই কাণ্ডটি বাধিয়েছেন?
অরিজিৎ, আমার ভয় হচ্ছে……
না! কোথাও কোন বডি পড়ার খবর নেই। পুলিশ নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভ। সব রাজ্যের পুলিশ কর্তৃপক্ষকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। জাল ঘেঁকে মাছটি ভোলা হবে। ভাববেন না। কিন্তু আমি শুধু ভাবছি, ছেলেটা যদি চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত না থাকবে এবং নির্দোষ হবে, তা হলে সে গা ঢাকা দিল কেন? কেন সে সব কথা বলল না আমাদের, যখন তারই প্রেমিকা খুন হয়েছে? সুব্রত সব জানে। জেনেও এমন আচরণ কেন? নিশ্চয় সে…….