প্রহরী দুই মাতালকে ঠেলে বের করে দিল বৃষ্টির মধ্যে। তারা নাচতে শুরু করেছিল। আসলে ড্যানি ঘঘাষকে আসন করে দিল সে। বাকি দুই মাতাল ভয়ে ভয়ে কেটে পড়ল আসন ছেড়ে। ড্যানি ঘোষের চোখে চোখ পড়ল কর্নেলের। সে ক্রুর চোখে তাকিয়ে আছে।
কর্নেল বললেন, আপনার প্রহরীটি বেশ। বারেরও একটা নীতিবোধ নিয়মকানুন থাকা উচিত। সে তা বজায় রাখে।
সিনহা বললেন, যোসেফ? ওঃ খুব হুঁশিয়ার এসব ব্যাপারে।
ওর নাম যোসেফ নাকি?
হ্যাঁ। একসময় ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকার সব মস্তান ওর পায়ের তলায় থাকত। ওকে পুলিশ সোর্স থেকে বলে কয়ে নিয়ে এসেছিলুম। ও ছিল পুলিশের ইনফরমার। কাজেই ওর-ও নিজের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল।
যোশেফকে ড্যানি কিছু ইশারা করছে কর্নেলকে দেখিয়ে। যোসেফ হেসে কী বোঝাচ্ছে। কর্নেল আস্তে বললেন, ওই ভদ্রলোককে চেনেন? যোসেফ যার সঙ্গে কথা বলছে।
কে চেনে না ড্যানি ঘোষকে? ওর মামা নিলামের কারবারী। রয় অ৬ কোং আছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। সব এক ঘাটের মড়া। ড্যানি অবশ্য চন্দননগরে মেমসায়েব বউয়ের কাছে থাকে।
এবার ঢুকল সুব্রত। ঢুকেই টেবিল খালি পেল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ কর্নেলের চোখে পড়তেই বেরিয়ে গেল।
কর্নেল বললেন, ওই যুবকটিকে চেনেন?
খুব চিনি। সুব্রত চৌধুরি। আমিই সত্যসেবকের মালিককে ধরে ওকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছি।
বাঃ! ভাল কাজ করেছেন!
সিনহা মিটিমিটি হাসলেন। ছেলেটা ভালই। প্রথম প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে আসত। তাদের পয়সায় খেত। আলাপ হয়ে গেল। একদিন দেখি টিনিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। বলে, মেয়েটি ভাল গায়। নাচতেও পারে। যদি ওকে চান্স দিই……
বুঝতে পেরেছি। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি মিঃ সিনহা। আবার দেখা হবে।
কর্নেল দরজার বাইরে গিয়ে দেখলেন, বৃষ্টিটা কমেছে।……
.
ইস্টার্ন সাব-আরবান সিমেট্রির পুবে রেল ইয়ার্ড, দক্ষিণে একটা বস্তি এলাকা। বস্তিটা ক্রমশ তার সত্তা হারাচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ নাকি অশুভ, কর্নেল ভাবছিলেন। ইতস্তত তিন থেকে পাঁচ তলা বাড়ি উঠেছে বস্তি খুঁড়ে। কবি কিপলিঙের পভার্টি অ্যান্ড প্রাইড/সাইড বাই সাইড এখানে মর্মান্তিক সত্য। নতুন উঁচু বাড়িগুলোতে নিশ্চয় বস্তির লোকেরা থাকে না। তার মানে, তাদের রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়নি। তাদের উচ্ছেদ করেই বস্তি মালিকেরা ফ্ল্যাটবাড়ি বানিয়েছেন। তারা হয়তো ফুটপাতে কি অন্যত্র আবার আশ্রয় নিয়েছে। ঝোপড়ি বেঁধেছে। দশ-বিশ বছর পরে কোন বড়কর্তার খেয়াল হবে, তখন পুলিশ গিয়ে ঝোপড়ি ভাঙবে। তারা আবার ছড়িয়ে পড়বে মহানগরের অন্যত্র। সভ্যতার দেহে মারীবীজাণুর মতো জন্ম নেবে আঁকে ঝাঁকে রাস্তার ছেলেমেয়েরা। মহানগরের রক্ত দূষিত করবে। সভ্যতাকে পচিয়ে দেবে তীক্ষ্ণ আণবিক দাঁতের কামড়ে।
দিক। কর্নেল রিকশো থেকে নেমে মনে মনে বললেন, একচোখা সভ্যতার পতন ঘটুক। কার্ল মার্ক্সের বর্ণিত সত্যিকার সর্বহারারা মারীজীবাণু হয়ে উঠুক।
তবেই নতুন সভ্যতার জন্ম হবে। আসলে এখনও মানুষ বর্বরতার যুগ অতিক্রম করতে পারেনি।
সাব! ভাড়া……
কর্নেল বললেন, সরি! এই নাও ভাই!
রিকশোওয়ালা ভাড়া নিয়ে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বস্তির ভেতরটা কেমন থমথম করছে। বাতিগুলি নিষ্প্রভ। ইতস্তত কিছু জটলা। শ্রমজীবীরা আড্ডা দিচ্ছে। তাস খেলছে। একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করলে টিনির মা সুরঞ্জনা দেবীর বাড়ি দেখিয়ে দিল।
একটুকরো পোড়া জমি এবং ভোলা ড্রেন পেরিয়ে একতলা জরাজীর্ণ বাড়ি। ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছিল খোলা জানালা দিয়ে। কর্নেল দেখলেন, কলিং বেল আছে। টিনির আশা-আকাঙক্ষার একটা সামান্য চিহ্ন। টিপলে পিয়ানোর শব্দ হলো। বুকের ভেতর ঝংকৃত হলো ধ্বনি। যেন টিনির আত্মা সাড়া দিল।
কে রে? মহিলাকণ্ঠে ভেতর থেকে সাড়া এল।
কর্নেল বললেন, আমি একটু দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।
কে আপনি? বলে এক প্রৌঢ়া দরজা খুললেন। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, রোগা, বিধ্বস্ত চেহারা। কর্নেলকে দেখে এক পা পিছিয়ে বললেন, আপনি কোত্থেকে আসছেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন। আমাকে স্যার বলবেন না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুরঞ্জনা দেবী একটু ইতস্তত করে বললেন, কী ব্যাপার…পুলিশকে তো…….
আমার নামটা আপনার জানা মনে হচ্ছে সুরঞ্জনা দেবী? কর্নেল শুকনো হাসলেন।
সুরঞ্জনাকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, কর্নেলসায়েব। আমি মেয়ে। বয়স হয়েছে। তাতে বুকে এই পাথরচাপা শোক। পুলিশকে যা বলার সব বলেছি। আর নতুন কথা তো নেই।
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে কেউ নিষেধ। করেছে, বুঝতে পারছি।
সুরঞ্জনা কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, আপনি চলে যান কর্নেলসায়েব! আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার আরও বিপদ হবে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না! পুলিশ কত দিন আমার বাড়ি পাহারা দেবে?
যে শাসিয়ে গেছে, সেই বলেছে বুঝি?
দরজা মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল। কর্নেল মুহূর্তে শক্ত হয়ে গেলেন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরে দ্রুত রিভলবারটি বের করে প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন এবং সেই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালেন।
একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। ঝোঁকের মাথায় রাত আটটায় এখানে আসা ঠিক হয়নি। আলো-আঁধারি পরিবেশ। আততায়ীর পক্ষে দারুণ সুযোগ।