কর্নেল একটু হাসলেন। সত্যসেবক পত্রিকায় নতুন জয়েন করেছেন বুঝি?
হ্যাঁ। আপনার কিছু খবরটবর ছাপার থাকলে প্লিজ চিফ রিপোর্টারকে দিন। আমার কিছু সরাসরি করার ক্ষমতা নেই।
খবর আছে। তবে সেটা আপনার জন্য।
সুব্রত চমকে উঠল। আমার জন্য? কী খবর?
আমি একটা ম্যাগাজিন বের করছি। শুনলুম, আপনি কবিতা লেখেন…
সুব্রত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, গাঙ্গুলিদা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেন। আমি কবিতা লিখি না।
গল্প লেখেন?
চেষ্টা করি।
বেশ একটা গল্পই দিন না প্লিজ! যৎকিঞ্চিৎ সম্মান দক্ষিণা আমি দেব, যদি কিছু মনে না করেন। শুধু একটা অনুরোধ…..
বলুন!
প্রেমের গল্প হলে ভাল হয়। একটু ট্রাজিক ধরনের……বোঝেন তো, বাঙালি পাঠক বড্ড রোমান্টিক। একটু সঁতসেঁতে প্রেম ট্রেম চায় আর কী! কর্নেল হাসতে লাগলেন। আর একটা ব্যাপার থাকলে ভাল হয়। সেক্স নয়, অন্তত, খানিকটা ভায়োলেন্স, রহস্য-টহস্য…….ধরুন, পরিবেশ রোমাঞ্চকর করার জন্য কবরখানায় নায়ক-নায়িকা……
সুব্রত চুপচাপ শুনছিল। এবার শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে রুষ্টস্বরে বলল, ফরমায়েসি গল্প আমি লিখি না।
না, না! জাস্ট পত্রিকার ক্যারেক্টার অনুসারে বলছি।
ওইসব ট্র্যাশ পত্রিকায় আমি লিখি না! আমি লিখি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। সুব্রত চাপা স্বরে বলল, আমি যা লিখব, তা ছাপতে পারেন আসবেন, নয় তো আসবেন না!
কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, তবে তাই। বাই দা বাই, স্পেশাল রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরির সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে?
না। আমি যেচে কারুর সঙ্গে আলাপ করি না। তা ছাড়া আমি জয়েন করেছি সদ্য দিন দশেক আগে। উনি এখন পাঞ্জাবে আছেন লং অ্যাসাইমেন্টে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বাও করে পা বাড়িয়েছেন, সুব্রত ডাকল, শুনুন!
কর্নেল ঘুরে বললেন, বলুন!
সুব্রতকে এবার একটু নরম দেখাচ্ছিল বলল, একটা কথা। কিছু অ্যাডভান্স করলে ভাল হতো। আমার টাকার দরকার।
কর্নেল দ্রুত পকেট থেকে পার্স বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট খুঁজে দিলেন ওর হাতে। সুব্রতও দ্রুত তা পকেটস্থ করল। তারপর কর্নেল লম্বা নিউজ রুমের শেষ প্রান্তে এসেছেন, পেছনে হল্লা শুনে ঘুরলেন। রিপোর্টাররা সুব্রতকে ঘিরে ধরেছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
শুধু একটা জিনিস চোখে পড়ার মতো। সুব্রত তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটা এবার অসম্ভব সাদা–পাণ্ডুর। কর্নেল হনহন করে বেরিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলেন। লিফটের দিকে গেলেন না।
একেবারে অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার নয়। দৈবাৎ প্রাপ্তি নয়। নিউজপ্রিন্ট, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার যোগসূত্র, মুনলাইট বারের কাছে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিস, এই কয়েকটি পয়েন্ট ধরে তাহলে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে হাঁটছিলেন। সন্ধ্যা ছটা বাজে। রাস্তা জ্যাম। খানাখন্দের ওপর আলো পড়ে মনে হচ্ছে, কলকাতা সত্যি মুমূর্ষ এবং ক্ষতবিক্ষত। অথচ এত জেল্লা চারদিকে ওপরে ওপরে।
হুঁ, সুব্রতর পায়ে নতুন চপ্পল, তাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু সুব্রত…
হঠাৎ ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। কর্নেল মুনলাইট বারে ঢুকলেন। বারের মালিকই ম্যানেজার। নাম যশোবন্ত সিনহা। কর্নেলকে দেখেই হাত তুললেন। গুড ইভনিং স্যার! আফটার হাউ লং ডেজ……আইয়ে, আইয়ে!
কর্নেল কাউন্টারের সামনে গেলেন। বৃষ্টির জন্যই বোধ করি ছোট্ট বারে ভিড় বেড়ে গেল দেখতে দেখতে। পাশের ছোট্ট ডায়াসে এক পপ সিঙ্গার প্রাচ্য-প্রতীচ্য খিচুড়ি পরিবেশন করছে। জগঝম্পে কানে তালা ধরে যায়। সিনহা কর্নেলকে কাউন্টারের ভেতরে একটা চেয়ারে বসতে দিলেন। ইংরেজিতে বললেন, আপনি তো বিয়ার ছাড়া কিছু ছোঁবেন না। এক মিনিট। সিঙ্গাপুর থেকে একডজন বিয়ারক্যান পাওয়া গেছে। আপনাকে দিয়েই উদ্বোধন হোক।
বিয়্যারক্যানে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন, মেয়েদের দিয়ে গান করালে যথার্থ বারের আবহাওয়া গড়ে ওঠে মিঃ সিনহা! পুরুষেরা বড় রাফ!
সিনহা হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক! কিন্তু আমার বরাত মন্দ। একটা সুন্দর মেয়ে যোগাড় করলুম। তো তার চরিত্র ভাল নয়। খুন হয়ে গেল। কাগজে পড়েননি? পুলিশের হাঙ্গামা সামলাতে জেরবার।
বলেন কী!
সিনহা আগাগোড়া তার যেটুকু জানা, সব বর্ণনা করে চোখ নাচিয়ে বললেন, পাড়ার মস্তানদের নিয়ে খেলত। তাদেরই কেউ খতম করেছে। বোকা মেয়ে! আপনি স্যার এই কেসটা…….
আচ্ছা মিঃ সিনহা! এই বারে তো দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিকরা অনেকে আসেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওঁদের অনেকে আমার নিয়মিত খদ্দের। সিনহা চাপা স্বরে বললেন, টিনির মার্ডার কেস হাতে নিয়েছেন বুঝি?
কর্নেল জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি ওসব লাইন কবে ছেড়েছি, মিঃ সিনহা! এখন স্রেফ নেচারিস্ট। এই যে দেখছেন, সব সময় বাইনোকুলার ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। পাখি টাখি দেখি। ছবি তুলি।
জানি, জানি। সিনহা সকৌতুকে বললেন। আপনার বাইনোকুলারে কত কিছু দেখেন। তো আমি বলি কী, এই কেসটাও দেখুন। মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়, কর্নেল!
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, বয়স হয়েছে। আর ছোটাছুটি করতে পারি না!
বলে কর্নেল বারের ভিতরটা দেখতে থাকলেন। বাইরে বৃষ্টির জন্য তাগড়াই চেহারার প্রহরী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময় দরজা খুলে কাউকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করল। কর্নেল ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে মুখ নামালেন। চন্দননগরের সেই ড্যানি ঘোষ ঢুকছে। সঙ্গে দুজন লোক।