কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, আজ ঘুম থেকে ওঠার পরই কেন যেন মনে হয়েছিল, গোমেশ বিপন্ন।
ওটা কোনও ব্যাখ্যা হলো না!
ডার্লিং! আমাদের সব অনুভূতির কার্য-কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না।
প্লিজ! মনস্তত্ত্ব নয়। তাড়া আছে। বেরুব। একটু কংক্রিট ব্যাখ্যা পেলে ভাল হয়।
নিজেই এখনও অন্ধকারে ঘুরছি অরিজিৎ! যা কিছু ঘটতে দেখছি, মেলাতে পারছি না একটার সঙ্গে আরেকটাকে।
অন্তত একটা ঝাড়ুন। নইলে মনে কাঁটা খচখচ করবে।
রয়সায়েবের এক ভাগ্নে ঘোষসায়েবকে নজরে রাখো। সে থাকে চন্দননগরের আউটকার্স্টে ইভনিং ভিলায়। ড্যানি ঘোষ। কিন্তু সাবধান! সে যেন টের না পায় তাকে নজরে রাখা হয়েছে।
অরিজিৎ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, হাই ওল্ড ডাভ! তাহলে গতকাল কি…ওকে! নো মোর টক। বাই।
বলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডি সি ডি ডি ধাঁই করেই বেরিয়ে গেলেন।
কর্ণেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে! আমি ওপরে যাচ্ছি।
শূন্যোদ্যানের সকালবেলার পরিচর্যা বাকি আছে। ক্যাকটাস-অর্কিডের ক্ষতে লোশন লাগাতে হবে। কর্নেল হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সেই দূরের দেবদারুশীর্ষে শকুনের বাসাগুলির দিকে বাইনোকুলারের নল রাখলেন। ওই শকুনগুলো…কোনও মানে হয়? শহরটা কি ভাগাড় ভেবেছে ওরা? পুরসভা করছেটা কী? অত সুন্দর দেবদারুর মাথায় শকুন!
অ্যারিজোনার কচ্ছপ-ক্যাকটাসটার কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসলেন কর্নেল। মাথার ভেতরটা শূন্য লাগছে। গোমেশ জেভিয়ার মারা পড়লেন? আত্মহত্যা…হু, কাল রাতে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কর্নেলকে ডাকতে দেখেই উধাও হয়ে গেলেন। চন্দননগরে ইভনিং ভিলায় লুকিয়ে ছিলেন। কাল্লু তাকে লুকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত গোমেশ আড়াল থেকে কর্নেলকে দেখে থাকবেন। তাই বিপদ আঁচ করেই কি আত্মহত্যা করে ফেললেন?
নাকি কেউ বা কারা তার মুখ বন্ধ করতেই মেরে ফেলল?
গোমেশ একটু বোকা আর ভিতু লোক ছিলেন তো বটেই।…
.
দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার চিফ অব দা নিউজব্যুরো তারক গাঙ্গুলি টেবিলে ঝুঁকে খুব মনোযোগে দা গার্ডিয়ান পত্রিকা পড়ছিলেন। সামনে থেকে কেউ চাপা স্বরে বললেন, ব্রিটেন বরাবর বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি।
তারক গাঙ্গুলি মুখ না তুলেই বললেন, ধূর্ত! চিরধূর্ত! পাঞ্জাবের টেররিস্টদের দমন করবে বলছে, আবার তলায়-তলায় সাহায্যও করছে। বাজি রেখে বলতে পারি।
আসলে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের দেশ। সব তাতে রক্ষণশীল। আইরিশ টেররিস্টদের ওপর রাগটা…
রাইট, রাইট! আমরা মরছি ঘা খেয়ে তো তোরা ইন্ডিয়ানরাও ঘা খেয়ে মর! হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ!
অবশ্য থ্যাচার খুব জাঁদরেল মহিলা।
মহিলা বলেই তো বন্দী বিনিময় চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করছে। আমাদের সম্পর্কে গাদাগাদা বিধিব্যবস্থা বরাদ্দ করে যাননি! রামায়ণ মহাভারত আঠারো পুরাণ সবখানে মহিলা নিয়ে গণ্ডগোল। ট্রয়ের যুদ্ধ!
এবং ইস্টার্ন সাবআর্বান সিমেট্রিতে খুন।
অ্যাঁ? বলে এতক্ষণে তারক গাঙ্গুলি কাগজ নামিয়ে মুখ তুললেন। তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত বাড়ালেন করমর্দনে। হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো ওল্ড বস! কী আশ্চর্য কী অদ্ভুত!
কর্নেল তাকে চুরুট অফার করে বললেন, আমার চেয়ে আশ্চর্য-অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে বিস্তর আছেন মিঃ গাঙ্গুলি!।
তারক গাঙ্গুলি হেসে,কুটি কুটি হয়ে বললেন, আছে, আছে! আমি কারণ এতক্ষণ দিব্যি কথা চালিয়ে যাচ্ছি, অথচ মুখ তুলে দেখছি না হুম আই অ্যাম টকিং টু! সাংবাদিক মহালের প্রবাদ, তেত্রিশটে বেড়াল মরে একটা সাংবাদিক জন্মায়। আমি হোপলেস! সেজন্যই কোম্পানি আমাকে এখানে নিষ্কর্মা করে বসিয়ে রেখেছে। নামেই চিফ অব দা নিউজব্যুরো। কাজের মধ্যে শুধু কাগজ পড়া। বরং ওই সুব্রতর মতো পদ্য লিখতে পারলেও…..ওই দেখুন! ও কি খবর লিখছে ভাবছেন? পদ্য লিখছে!
তারক গাঙ্গুলি আঙুল তুলে অদূরে এক যুবককে দেখালেন। মুখে দাড়ি। পরনে সাদাসিধে প্যান্ট-শার্ট। কিন্তু শিল্পীসুলভ চেহারা। ঈষৎ লাজুক হাবভাব। কর্নেলের দিকে সে তাকিয়ে ছিল। তারক গাঙ্গুলিকে বলল, কিছু বলছেন তারকদা?
বলছি। তুমি নিশ্চয় পদ্য লিখছ! তারক গাঙ্গুলি সহাস্যে বললেন। এঁকে চেনো কি? নতুন এসেছ। চিনবে না। জয়ন্তের ফ্রেন্ড-ফিলসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুব্রত মুখ নামিয়ে কাজে মন দিল। তারক গাঙ্গুলি বললেন, তুমি ওয়ার্থলেস! যোগ্য সাংবাদিক হতে হলে প্রথম গুণ অবজার্ভেশন–পর্যবেক্ষণ! কাম হিয়্যার মাই বয়! কাম, কাম! আলাপ করিয়ে দিই। আ ম্যান অব হাই কানেকশনস। আখেরে লাভ হবে।
সুব্রত মুখ তুলে একটু হাসল। কিন্তু উঠল না। তারক গাঙ্গুলি চটে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, আমাকে আর কেউ গ্রাহ্য করে না কর্নেল! এক্সটেনসনে আছি তো! যত্তোসব আজকালকার কিম্ভুত ছেলেছোঁকরা ঢোকাচ্ছে কোম্পানি। খবরে সাহিত্য ফলায়। খবর হবে অবজেক্টিভ। তা নয়, খালি মেয়েলি ভাষায় কাব্যি।
কর্নেল উঠে গেলেন সুব্রতর কাছে। সুব্রত তাকাল। কর্নেলের মনে হলো, চাউনিটা মাছের। আজকাল ছেলেছোঁকরাদের হাবভাব এরকমই। আর-সব রিপোর্টাররা হইহই করে উঠল। হ্যাল্লো ওল্ড বস! একটা স্কুপ ঝাড়ুন প্লিজ!
আজ একেবারে খবরে ভাটা।
কর্নেল সবাইকে হাত তুলে সম্বাধনের ভঙ্গি করে সুব্রতর সামনে বসলেন। চেয়ারটা খালি ছিল। সুব্রত আস্তে বলল, বলুন কর্নেল সরকার!