কলকাতায় স্যার, কলকাতায়।
ঠিকানা বল্!
ঘোষসায়েবের মামার কাছে স্যার! ফিরি ইস্কুল স্টিট স্যার! রায় কোম্পানিতে স্যার? কাল্লু ভাঙা গলায় বলল। তবে এই শালা ঘোষসায়েবের চিঠি ছাড়া দেবে না।
গোমেশ কোথায়?
কথাটা বলেই কর্নেল কাল্লুর নাভির ওপরটা খামচে ধরলেন। যন্ত্রণায় গোঙিয়ে উঠে কালু বলে ফেলল, এসেছিল। ছোট মেমসায়েবের ভয়ে লুকিয়ে, ছিল কোনার ঘরে। আপনি আসার পরই পালিয়ে গেল। স্যার, এবার গোমসায়েব খুব দামী পাথর বেচেছে কোম্পানিকে। ফিরি ইস্কুল স্টিটে গেলেই পেয়ে যাকেন।
কর্নেল তাকে ছেড়ে দিতেই সে দিশেহারা হয়ে গা ঢাকা দিল। দেখার মতো দৃশ্য।
কিন্তু হাসতে গিয়ে হাসতে পারলেন না কর্নেল। আবছায়া ঘনিয়ে এসেছে। বড় বিপজ্জনক জায়গায় এসে পড়েছেন। হনহন করে হাঁটতে থাকলেন।
বসতি এলাকায় পৌঁছে একটা সাইকেল রিকশো পেয়ে গেলেন। বললেন, স্টেশন!
স্টেশনে পৌঁছুতে প্রায় আধঘণ্টা লাগল। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখলেন, হাওড়াগামী ট্রেন সবে হুই দিচ্ছে। সামনের কামরায় উঠে পড়লেন। বড্ড ভিড়। এবার চুরুট টানতে পারলে মাথার ঘিলু চাঙ্গা হতো। কিন্তু এই ভিড়ে সেটা সম্ভব নয়।
ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুনোর পর কর্নেল নেমে চুরুট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে সেই ধোঁয়ার ভেতর আচমকা আবিষ্কার করলেন, ভিড়ে গোমেশ চলেছেন।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে ডাকলেন, হ্যাল্লো ব্রাদার গোমেশ!
গোমেশ ঘুরে তাঁকে দেখামাত্র প্রায় দৌড়ে ভিড় ঠেলে নিপাত্তা হলে গেলেন। এতক্ষণে কর্নেল হাসতে পারলেন।…
.
ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে খুঁটিয়ে কর্নেলকে দেখছিল। কর্নেল বললেন, কী রে? ষষ্ঠী একটু হেসে বলল, বাবামশাইকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।
কেমন?
কেমন যেন…ঝড়জল খাওয়া কেমন শুটকো…ষষ্ঠী জুতসই উপমা খুঁজে পাচ্ছিল না।
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললেন, খুব হয়েছে! অরিজিৎ কটায় আসবে বলেছে বললি যেন?
ষষ্ঠী যেতে যেতে বলে গেল, ঠিক ধরেছি। কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বললুম নালবাজারের নাহিড়ীসায়েব ফোং করবে বলেছেন, আর বলেন, কী, কটায় আসবে?
হুঁ। কটায় ফোন করবে?
রাত্তির নটা বাজুক! ঘড়ির কাটা জায়গামতো যাক্। বলে ষষ্ঠী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
সত্যিই বড় ধকল গেছে দিনটায়। তার ওপর নিজের সেই ষষ্ঠেন্দ্রিয়জাত বোধের ব্যর্থতা! ভাবতে বুক ধড়াস করে ওঠে, কালু যদি সত্যি তাকে মড়া করে গঙ্গায় ফেলে দিত? রহস্যটার অন্য একটা দিক এটা, নাকি ওটা আলাদা একটা ব্যাপার–টিনির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যোগসূত্রহীন?
যোগসূত্র শুধু গোমেশের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছেঁড়া চিঠিটা। তার মানে, রহস্য যদি দুটি পৃথক ঘটনাকেন্দ্রিক হয়, তাহলেও গোমেশ একটা যোগসূত্র হয়েই থাকছেন। গোমেশের অদ্ভুত আচরণের কারণ কী? এইসব কথা ভাবতে ভাবতে রাত নটা দুমিনিটে ফোন এল অরিজিৎ লাহিড়ীর। হাই ওল্ড বস! সারাদিন কোথাও কি পাখি-প্রজাপতি-অর্কিডের খোঁজে নিপাত্তা হয়েছিলেন? নাকি।…
ডার্লিং। নাকি অংশটাই ঠিক। এনিওয়ে, কোনও খবর আছে বুঝতে পারছি। বলো!
চার্লস গ্রিয়ার্সনের নাম চেনা মনে হচ্ছে?
ইয়া। যদি তিনি হন এইটিন্থ সেঞ্চুরির ব্রিটিশ অ্যাডভেঞ্চারার!
কারেক্ট। ইস্টার্ন প্রোটেস্ট্যান্ট সিমেট্রিতে তার কবর আছে।
তার কবরের ফলক চুরি গেছে কি?
ইউ আর ড্যাম রাইট, বস! তবে সাধারণ মার্বেল নয়। উনি নিজের কবরের ফলকের জন্য দুর্মূল্য পাথর এনেছিলেন পার্সিয়া থেকে। কালো একরকম দুর্লভ পাথর। সরি! দেখতে পাথর, কিন্তু আসলে রত্ন। ছ ইঞ্চি বাই ন ইঞ্চি মাপ। দাম আজকাল কম করেও লাখ টাকা।
কী করে চুরি যাওয়ার খবর পেলে?
দুপুরে আবার গোমেশের ঘর এবং গির্জায় পুলিশ গিয়েছিল তদন্তে। সঙ্গে চার্চের যাজক এবং কমিটির মেম্বাররা ছিলেন। যে-কবরে টিনি খুন হয়েছে, তার কয়েক হাত তফাতে চার্লস গ্রিয়ার্সনের কবর। যাজক ফাদার হুবার্টই আবিষ্কার করলেন, ফলকটা নেই। পরে এক্সপার্ট টিম গিয়ে তদন্ত করলেন। ফলকটা ওপড়ানো হয়েছে, এটাই আশ্চর্য, টিনির মৃত্যুর পরের রাতে। ডঃ মহাপাত্রকে আপনি তো জানেন–ইওর বুজম ফ্রেন্ড! উপড়ে ফেলা ঘাসগুলোর অবস্থা পরীক্ষা করে ওঁর এই সিদ্ধান্ত। টিনি খুন হওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা পরে ঘটনাটি ঘটেছে।
অরিজিৎ! কুইক! এখনই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে রয় অ্যান্ড কোমর নিলামঘর, অফিস, গোডাউন সার্চ করো!
হো-য়া-ট?
রয় অ্যান্ড কোম্পানি। ইউ নো দেম।
মাই গুডনেস! কিন্তু…
কোনও কিন্তু নয়। মেক্ হেস্ট!
একটু পরে অরিজিতের গলা শোনা গেল ফের, ওল্ড বস! আর য়ু দেয়ার?
বলো!
তা হলে আপনি কোনও সূত্রের সন্ধানে আজ সারাটা দিন…
নো মোর টক। ডু দ্যাট অ্যাট ওয়ান্স। অবশ্য জানি না, ওরা কতটা বোকা বা বুদ্ধিমান। তবু দেখা যাক।
ওক্কে। গুড নাইট!
ফোন বন্ধ হলো। কর্নেল ফোন রেখে রিসিভারে হাত চেপে রাখলেন কিছুক্ষণ। তারপর ফের ফোন তুলে ডায়াল করলেন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায়। সাড়া এলে বললেন, প্লিজ পুট মি টু দা চিফ অব দা নিউজ ব্যুরো প্লিজ!
মহিলা অপারেটর বললেন, প্লিজ, হোল্ড অন!
একটু পরে চিফ অফ দা নিউজ ব্যুরো তারক গাঙ্গুলির সাড়া এল, হ্যাঁ! গাঙ্গুলি।
আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, মিঃ গাঙ্গুলি!
হ্যাল্লো সান্তা ক্লজ! ক্রিসমাসের তো ঢের দেরি! হাঃ হাঃ হাঃ।