Site icon BnBoi.Com

কর্নেলের গল্প – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কর্নেলের গল্প - সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

কালো পাথর

০১.

প্রেতাত্মা নিয়ে আসর বসানো অরুণেন্দুর হবি। এই আসরে মৃত মানুষের আত্মার আবির্ভাব হয় কোনো জীবিত মানুষের মাধ্যমে, যাকে বলা হয় মিডিয়াম। অরুণেন্দু নিজে কিন্তু মিডিয়াম নয়, নিছক উদ্যোক্তা। মিডিয়াম সবাই হতে পারে না। অরুণেন্দুর মতে সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের অধিকারী এবং খুব অনুভূতিপ্রবণ মানুষই মিডিয়াম হবার যোগ্য। পুরুষের তুলনায় এ ক্ষমতাটি মেয়েদের বেশি। তাই মেয়েদের মধ্যেই সে মিডিয়াম খোঁজে। পেয়েও যায়। অশরীরী আত্মা আনতে দেরি করে না। অরুণেন্দু দাবি করে, শতকরা নব্বইটি আসরে তার সাফল্যের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই আসরকে ইংরেজীতে বলা হয় Seance-এর আসর। ..

আসর যখন তখন যেখানে বসানো যায় না। পরিবেশ নির্জন এবং স্তব্ধ হওয়া চাই। আসরের লোকগুলোরও বিশ্বাস থাকা চাই দেহাতীত সত্তায়। তবে আত্মার আবির্ভাবের গ্যারান্টি দিতে অরুণেন্দু রাজি, যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে কোনো নিরিবিলি বাড়িতে আসর বসানো যায়।

সেদিন এই রকম একটা অবস্থা দেখা দিয়েছিল চব্বিশে অক্টোবর রাত দশটায়, বঙ্গ-বিহার সীমান্তে খনি এলাকায় বারাহিয়া টাউনশিপে, ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের বাড়িতে। ডঃ রায় খনি ও ধাতুবিশেষজ্ঞ সরকারি অফিসার। অরুণেন্দু সম্পর্কে তার ভাগ্নে। যখনই বেড়াতে আসে, প্রেততত্ব নিয়ে বকবক করে সারাক্ষণ।

রাতের খাওয়ার পর বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন ডঃ রায়, তার স্ত্রী মীনাক্ষী, একমাত্র সন্তান মঞ্জুশ্রী, তার হবু বর সুমন আর অরুণেন্দু। সেই সময় হঠাৎ বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তার মধ্যে লনের ওধারে গেট খুলে দৌড়ে এল দুটি মেয়ে, অনুরাধা আর ভাবনা দুই বন্ধু। মঞ্জুশ্রীরও বন্ধু। বেড়াতে বেরিয়ে আচমকা প্রকৃতির তাড়া খেয়ে আশ্রয় নিতে এল।

ভাবনা গুজরাটি মেয়ে। তার বাবা কেশবলাল শান্তপ্রসাদ স্থানীয় ব্যবসায়ী। ভাবনার জন্ম বারাহিয়ায়। তাই সে বাংলাও বলে মাতৃভাষার মতো।

বৃষ্টির ছাঁট এসে সবাইকে বিব্রত করছিল। তাই ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমে যাওয়া হল। অনুরাধা ও ভাবনা যে-যার বাড়িতে ফোনে জানিয়ে দিল মঞ্জুশ্রীদের বাড়িতে আটকে পড়েছে। চিন্তার কারণ নেই। ডঃ রায় গাড়ি করে পৌঁছে দেবেন তাদের।

কফির আসর বসল এবার। অরুণেন্দু কিছুক্ষণ আগে সিয়াস (Seance) নিয়ে আলোচনা করছিল। ডঃ রায় ওসব বিশ্বাস করেন না। কিন্তু মা ও মেয়ে করে। তারা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। সুমন হা বা না কিছুই বলছিল না। সে বরাবর মধ্যপন্থী সব ব্যাপারে। কফির আসরে আরও দুজনকে পেয়ে অরুণেন্দু আগের কথাটার জের টেনে আনল। অনুরাধা ও ভাবনার চোখে ফুটে উঠল চাপা ভয় ও বিস্ময়। বাইরে ঝড় বৃষ্টি, মেঘের গর্জন যেন অশরীরী আত্মারা আত্মপ্রকাশের জন্য অস্থির হয়ে, জীবিত মানুষের আনাচেকানাচে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মঞ্জুশ্রী বলল, তাহলে অরুদা, এই তো তোমার মতে উপযুক্ত সময়।

তার মা মীনাক্ষী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে, আত্মাটাত্মা ডেকে, এখন কাজ নেই। মুখেই বলল অরু, শুনতে বেশ লাগছে।

ভাবনা একটু হাসল হঠাৎ। না মাসিমা। আমরা পরীক্ষা করে দেখি না, যদি সত্যি আত্মা আসে।

ডঃ রায় হাই তুলে বললেন, ও কে! তোমরা আজ্ঞা দাও। আমি একটু পড়াশোনায় বসি এবার। অনু, ভাবনা-চিন্তা কোরো না। পৌঁছে দেবখন, যত রাতই হোক।

তার পেছন-পেছন মীনাক্ষীও চলে গেলেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর আড্ডা দেওয়া শোভন নয়। ওরা হয়তো মন খুলে কথা বলতে পারছে না। বিশেষ করে। সুমন ও মঞ্জুশ্রীর কথা ভেবেই উঠে গেলেন মীনাক্ষী।

সুমন চোখ নাচিয়ে বলল, কী অরুদা, হবে নাকি?

অরুণেন্দু পা বাড়িয়েই ছিল। অনুরাধার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার আপত্তি নেই তো?

অনুরাধা আস্তে মাথাটা দোলাল।

অরুণেন্দু তার দিকে তাকিয়েই রইল মিনিট-খানেক। তারপর রহস্যময় হেসে বলল, আমার বিশ্বাস, মিডিয়াম, হবার যোগ্যতা এখানে একমাত্র আপনারই আছে।

ভাবনা বলল, কি করে বুঝলেন বলুন তো?

অরুণেন্দু বলল, ওটা আমার ইনটুইশান বলতে পারেন। দশবছর ধরে এসব নিয়ে আছি। দেখামাত্র বুঝতে পারি কে ভাল মিডিয়াম হতে পারে। অনুরাধা প্লিজ আপত্তি করবেন না কিন্তু।

অনুরাধা মৃদুস্বরে বলল, আমাকে কী করতে হবে?

অরুণেন্দু উঠে দাঁড়িয়ে বল্ল, ডাইনিং টেবিলে চলুন সবাই বলছি। আর মঞ্জু একটা হাল্কা পেন্সিল আর একটা কাগজ চাই। ঝটপট! সময় চলে যাচ্ছে। আর একটা মোম চাই।

সঙ্গে সঙ্গে জোগাড় হয়ে গেল। কিচেন বন্ধ করে ফেলু ঠাকুর আর পরিচারিকা সুশীলাকে নিজেদের ঘরে পাঠানো হল। দরজা ও জানালাগুলো বন্ধ করে, অরুণেন্দু মোমবাতি জ্বেলে টেবিলে রাখল। বাইরের প্রাকৃতিক আলোড়ন খুব চাপা শোনাচ্ছিল এবার। ফ্যান বন্ধ করলে ঘরের ভেতরটা গুমোট হয়ে উঠল। কিন্তু উপায় নেই।

সে অনুরাধাকে টেবিলের একদিকে একা বসাল। অন্যদিকে পাশাপাশি বসল সুমন, ভাবনা, মঞ্জুশ্রী আর সে। অনুরাধার হাতে পেন্সিল ও কাগজটা দিয়ে সে বলল, পেন্সিলটা কাগজের ওপর আলতো ভাবে রাখুন। তারপর কী করতে হবে বলছি।

অরুণেন্দু খুব চাপা গলায় বলতে থাকল, এবার আমরা সবাই মিলে এমন একজন মৃত মানুষের কথা, চিন্তা করব, যাকে আমরা প্রত্যেকে চিনি। চিনি মানে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও পরোক্ষ ভাবে চিনি। অর্থাৎ জানি। যেমন রবীন্দ্রনাথ। আমি টেবিলে সংকেত করব। সঙ্গে সঙ্গে গভীর মনোযোগে রবীন্দ্রনাথের কথা চিন্তা করতে হবে। অনুরাধা আমাদের আসরের মিডিয়াম। রবীন্দ্রনাথের আত্মা তার মধ্যে আসবেন। অনুরাধা, প্লিজ বি ভেরি কেয়ারফুল। তিনি এলে আপনার পেন্সিল কেঁপে উঠবে কিংবা অন্য কোনো ভবে টের প্রানে সেটা। আপনার আঙুল যদি লিখতে চায় জোর করে বাধা দেবেন না কিন্তু। এটা একটা সিরিয়াস এবং কঠিন ব্যাপার-মানে, আপনার সচেতন মন অন্যের অনুভূতি-চিন্তা কাজকে বাধা দিতে চাইবে। আপনি নিষ্ক্রিয় থাকার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন, আপনার এই মানসিক অবস্থার ওপর আসরের সাফল্য নির্ভর করছে। কেমন?

অনুরাধা তাকিয়ে রইল নিষ্পলক চোখে। মোমের আলোয় তাকে যেন দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল অন্যদের। সুমনের ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসি ছিল এতক্ষণ। সেটা মিলিয়ে গেল। ভাবনাও গম্ভীর হয়ে পড়ল। মঞ্জুশ্রীর মুখে ভয় ও বিস্ময় ছিল। তাকেও এবার শান্ত দেখাল।

— অরুণেন্দু বলল, রেডি। আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতীক্ষা করছি। বলে সে টেবিলে আঙুলের শব্দ করল।

বাইরে মেঘ ডাকল সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা কেঁপে উঠল। মোমের শিখা স্থির জ্বলছে। ঘরে স্তব্ধতা ও ভ্যাপসা গরম। আবছা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ক্রমশ শোনা যেতে থাকল। দুমিনিট পরে দেখা গেল অনুরাধার হাতের পেন্সিল কঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে কাগজের ওপর কিছু লেখা হল।

পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু আস্তে কাগজ আর পেন্সিলটা অনুরাধাকে না ছুঁয়ে তুলে নিল। কিছু লেখা নেই। আঁকাবাঁকা একটা রেখা মাত্র।

অরুণেন্দু লিখল : আপনি কে? তারপর কাগজটা আস্তে এগিয়ে পেন্সিলটা অনুরাধার হাতে গুঁজে দিল। অনুরাধার হাত তেমনি পেন্সিল ধরার ভঙ্গিতে টেবিলে রাখা আছে।

আবার পেন্সিলটা কাঁপল। তারপর লেখা হতে থাকল। পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু কাগজ ও পেন্সিলটা তেমনি আস্তে তুলে নিল। লেখা হয়েছে : আমি সুদীপ্ত।

অরুণেন্দু লেখাটা নিঃশব্দে দেখাল অন্যদের। অনুরাধা ছাড়া সবারই মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের কথা ভেবেছিল সবাই। সুদীপ্ত এসে গেল!

এর পর অরুণেন্দুর প্রশ্ন এবং অনুরাধার জবাব লেখা হতে থাকল পালাক্রমে।

তা হল এই :

আপনাকে আমরা ডাকিনি।

আমার কথা আছে।

বলুন।

থাক। আমি যাই।

কেন?

পিট নং ৩৪৭ ..

তার মানে?

কালো পাথর।

কিছু বুঝলাম না।

মোহান্তজী।

এসব কী বলছেন?

যাচ্ছি।

অনুরাধার আঙুল থেকে কাগজ-কলম টেনে নিতে হাত বাড়াল অরুণেন্দু, সেই সময় হঠাৎ টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনুরাধা। ভাবনা আতঙ্কে অস্ফুট চীৎকার করে উঠল। অরুণেন্দু ডাকল, অনুরাধা! অনুরাধা!

অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেছে। সবাই উঠে দাঁড়াল। সুমন ঝটপট সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। মঞ্জুশ্রী কিচেন থেকে জল নিয়ে এল গ্লাসে। অরুণেন্দু অনুরাধার মুখে জল ছিটিয়ে দিল। ভাবনা তাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে।

তারপর অনুরাধা চোখ খুলল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

গণ্ডগোল শুনে ডঃ রায় এবং মীনাক্ষীদেবী পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন। অরুণেন্দুকে একটু বকাবকি করলেন। ভাবনা বলল, অনু, তোমরা কি হয়েছিল?

অনুরাধা আস্তে বলল, জানি না। হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল।

সুমন জানালাগুলো খুলে দিলে ঘরের ভেতরকার গুমোটভাবটা চলে গেল। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ লেগেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সমানে। অরুণেন্দু কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে অদ্ভুত হাসি। সে বলল, সিয়াসের আসরে অনেক সময় এমন হয়েই থাকে অবশ্য। মিডিয়াম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। তার একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আমি দিতে পারি। তবে

ডঃ রায় কপট ধমক দিয়ে বললেন, থাক। তারপর হো হো করে হাসলেন। কবে অশরীরী এসে তোমারই ঘাড় মটকাবে দেখবে।

মীনাক্ষী বললেন, মনু, সুস্থবোধ করছ তো?

অনুরাধা একটু হাসল। আমি ঠিক আছি, মাসিমা।

বাইরের বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখে এসে ডঃ রায় বললেন, এখন বেরুনো যায়। অনু ভাবনা, এস–গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করি।

ভাবনা বলল, এক মিনিট। মেসোমশাই, সিয়াসের আসরে কে এসেছিল জানেন? সুদীপ্ত।

ডঃ রায় চমকে উঠলেন। সুদীপ্ত!

ধাতু গবেষণা কেন্দ্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অফিসার ছিল সুদীপ্ত। কিছুদিন আগে সে খুন হয়ে গেছে। তাই সকলের অবাক হবারই কথা।

ডঃ রায় অরুণেন্দুর হাত থেকে কাগজটা নিলেন। অরুণেন্দু কাগজটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কাগজটা নিয়ে চোখ বুলোতে ডঃ রায়ের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। পড়া শেষ হলে গম্ভীর মুখে বললেন, এটা আমার কাছে থাক, অরু! ভাবনা এস। অনু তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।

সুমন বলল, আমি ওদের পৌঁছে দিতে পারতাম। বৃষ্টির মধ্যে আপনি কষ্ট করে–

ডঃ রায় বললেন, তুমি তো উল্টোদিকে যাবে। তাছাড়া রাত হয়ে গেছে। অতখানি পথ তোমাকে ফিরতে হবে।

ডঃ রায় বেরিয়ে গেলেন। তাদের বিদায় দিতে গেল মঞ্জুশ্রী আর তার মা। মা ও মেয়ের মুখে আতঙ্ক ও উদ্বেগের ছাপ লেগে রয়েছে।

অরুণেন্দু গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন একটু হেসে বলল, কী অরুদা? কী ভাবছ?

অরুণেন্দু হাসল। চাপা গলায় বলল, ব্যাপারটা আমার নিজেরই খটকা লাগছে।

কেন বলো তো?

আমার অভিজ্ঞতায় কখনও সিয়াসের আসরে সদ্যমৃত কেউ আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা অপঘাতে মৃত কোনো মানুষের আত্মা আসে বলেও জানি না। প্রেততত্ত্বের বহু বই পড়েছি। কোথাও পড়িনি, অপঘাতে মৃতরা আসে। কারণ কী জানো? অরুণেন্দু চাপা গলায় বলতে লাগল। তার মুখে উত্তেজনা থমথম করছে।..কারণ যারা অপঘাতে মারা পড়ে, তারা ভীষণ যন্ত্রণায় ভোগে অনন্ত কাল। মৃতদের জগতে কয়েকটা স্তর আছে। অপঘাতে মৃতরা সেই সব স্তরের বাইরে কোথাও স্থান পায়। সেখান থেকে যদি বা কেউ বস্তুজগতে এসে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তাই ভগবান বা প্রকৃতি, যিনিই হোন, তাদের স্বাভাবিক পারলৌকিক স্তরগুলোতে রাখার ব্যবস্থা করেননি। ..

সুমন বলল, বাপস্। মাথাটা আর বিগড়ে দিও না অরুদা! তাছাড়া এসব শুনলে এ রাতে আর বাড়ি ফেরা কঠিন হবে। মাইণ্ড দ্যাট, পাঁচ কিলোমিটার দূরে থাকি।

অরুণেন্দু বলল, সুদীপ্তকে তুমি চিনতে, সুমন?

সুমন উঠে দাঁড়াল। অল্পস্বল্প। তবে ওর কথা আর নয়। দেখি বৃষ্টি কমল নাকি।…

.

০২.

বারাহিয়া টাউনশিপে জল সরবরাহ করা হয় ফুলঝরিয়া লেক থেকে। লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। চারিদিকে টিলাপাহাড় আর জঙ্গল। এক দিকটায় সুন্দর পার্ক করা হয়েছে সমতল জমির ওপর। পার্কে বিকালের দিকে অনেকে বেড়াতে আসে। ছাব্বিশে অক্টোবর বিকেলে পার্কের দক্ষিণপূর্ব কোণে বিশাল ম্যাকটামের মেঝের পাশে একটা বেঞ্চে বসে কথা বলছিল সুমন আর মঞ্জুশ্রী। সুমনের গাড়ি পার্কের উত্তরে ওয়াটার পাম্পিং সেন্টারের পেছনে রাখা ছিল। পার্কটা লেকের দক্ষিণে। ওরা সেখানে বসে ছিল, সেখান থেকে বাঁদিকে একটা ন্যাড়া টিলা লেকের কিনারা থেকে উঠে গেছে। টিলাটার গায়ে বড় বড় পাথর। কথা বলতে বলতে মঞ্জুশ্রী হঠাৎ সেদিকে তাকাল। তারপর বলল, আরে! অনু ওখানে কী করছে?

সুমন ঘুরে দেখে বলল, বেড়াতে এসেছে কারুর সঙ্গে! ছেড়ে দাও।

না, না একা।

সুমন হাসল। একা নয়। বাজি রাখছি, ওর প্রেমিক আড়ালে বসে আছে।

অনু ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?

প্রেমিকের কাছে।

মঞ্জুশ্রী বলল, ভ্যাট! খালি প্রেমিক আর প্রেমিক!

তাছাড়া আর কে থাকবে মঞ্জু, এই সুন্দর দিন শেষে নিরিবিলি ফুলঝরিয়া লেকের ধারে- সুমন খুব আবেগে হবু স্ত্রীকে চুম খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।

মঞ্জুশ্রী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি বড়বেশি সাহসী হয়ে উঠেছ অশকারা পেয়ে।

সুমন মুখ এগিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ মঞ্জু! ফুলঝরিয়া একটা চুমুর প্রত্যাশা করে! তার খাতিরে।

মঞ্জুশ্রী হেসে ফেলল তার কথাবলার ভঙ্গি দেখে। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে সুমন অথবা এই সুন্দর লেকের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে গিয়ে হঠাৎ চমক খাওয়া গলায় সে বলল, এই, এই, অনু দৌড়ে যাচ্ছে কে-দেখ, দেখ!

আঃ! বলে সুমন ঘুরল ওদিকে। তারপর সেও অবাক হল।

অনুরাধাকে খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। টিলাটার ওপর শেষ বেলার রোদ ঝকমক করছে। সে টিলার ওদিকে নেমে গেল। মিনিট দুয়ের মধ্যে তার দৌড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে অস্বাভারিকতা ছিল।

সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু বসবে তুমি? আমি দেখে আসি কী ব্যাপার।

চলো আমিও যাই।

পারবে না। দেখছ না ভীষণ চড়াই, আর পাথরে ভর্তি?

শীগগির ফিরে আসবে কিন্তু। আমার একা থাকতে ভয় করবে।

তুমি বরং গাড়িতে গিয়ে বসো, এই নাও চাবি।

গাড়ির চাবি দিয়ে সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। মঞ্জুশ্রী পার্কের গেটের দিকে হাঁটতে থাকল। পার্কে আজ তত লোক নেই তাদের মতো জোড়ায়-জোড়ায় কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রবীণ দম্পতি, আর কিছু নিঃসঙ্গ লোক চুপচাপ বসে আছে। ছড়িয়ে-ছাটিয়ে।

সুমন টিলার পাথর বেয়ে সোজা উঠে যাচ্ছিল। তার মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়া আছে। আগের অক্টোবরে সে কামেট শৃঙ্গ অভিযানে গিয়েছিল। দুর্যোগের জন্য দলটাকে ফিরে আসতে হয়। এবার আবার গেছে। কিন্তু সুমনকে যেতে দেননি ওর মা। মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু প্রচুর পয়সা রেখে গেছেন ছেলের জন্য। গোটা তিনেক অভ্র খনির মালিক ছিলেন সুমনের বাবা। এখন খনিগুলো পরিত্যক্ত। তবে সুমন নিষ্কর্মা নয়। সে চাটার্ড অ্যাকাউন্টাষ্ট। বারাহিয়ার্স ইস্পাত কারখানার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের অ্যাকাউন্টস অফিসার।

সুমন অনুরাধাকে ডেকে সাড়া পাচ্ছিল না। টিলার দক্ষিণপূর্বে দিকে নেমে যেতে দেখেছে তাকে। নিচে ওদিকেও প্রকাণ্ড সব পাথর পড়ে রয়েছে। তার ফাঁকে ঝোপ ঝাড় সাজিয়েছে। একটা জলের ধারা মোটামুটি সমতল উপত্যকার মতো মাঠ ঘিরে ঝর্ণার আকারে লেকের পূর্ব দিকে মিশেছে। তার বুক জুড়ে পাথর। সড় সড় শব্দে জল ঝরে পড়ছে নিচের ডোবামতো একটা জায়গায় এবং ডোবাটা লেকেরই একটা অংশ হয়েছে।

একজন অচেনা লোক ডোবাটায় ছিপ ফেলে বসে আছে। মাথায় টুপি। পরনে। ধূসর জ্যাকেট, আর প্যান্ট। সুমন আবার অনুরাধা বলে ডাকতেই সে মুখ ফেরাল। মাথার টুপিটা পড়ে গিয়ে টাক চকচক করে উঠল। টুপিটা কুড়িয়ে নিল সে।

এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মুখে সাদা ঋষিসুলভ দাড়ি। টকটকে ফর্সা রঙ। যেন আশু সান্তাক্লজ। গলায় একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। পাশে পাথরের ওপর পড়ে আছে। একটা ক্যামেরা কিটব্যাগ, আর ছড়ির মতো দেখতে একটা সবুজ রঙের মাথায় পরানো ছোট্ট জাল।

সুমন বলল, এদিকে একটা মেয়েকে আসতে দেখেছে।

শান্তা ক্লজ বললেন, কৈ, না তো!

সুমন এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনুরাধাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ গেল খানিকটা দূরে পাথরের আড়ালে কী একটা রঙীন জিনিস যেন। সে সেদিকে দৌড়ে গেল।

ঝর্ণার ডোবা থেকে আন্দাজ একশো মিটার দুরে কয়েকটা পাথর আর ঝোপের ভিত্র একটা বড় গর্ত। গর্তে জল জমে আছে। আগের রাতের বৃষ্টিটাই এই জল জমার কারণ। সুমন যে রঙিন জিনিসটা দেখতে পেয়েছিল, সেটা অনুরাধার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ। গর্তে জলের ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে আছে অনুরাধা। তার পিঠের ডানদিকে চাপচাপ টাটকা রক্ত। রক্তে গর্তের জল লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।

সুমন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বোধ বুদ্ধি ফিরে আসতে লাগল। তারপর সে পিছিয়ে এল কয়েক পা। তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল–সে আর ওদিকে তাকাতে পারছিল না।

মৎস্যশিকারী বৃদ্ধ এদিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। তার পা ফেলার ভঙ্গিতে সুমন বুঝতে পারছিল ভদ্রলোককে যতটা বৃদ্ধ মনে করেছিল, ততটা হয়তো নন। যুবকের মতো শক্তসমর্থ যেন। কাছে এসে বললেন, সামথিং হ্যাড ইয়ং ম্যান?

সুমন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অনুরাধাকে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক চমকে উঠে দ্রুত এগিয়ে গেলেন গর্তটার দিকে। তারপরে অস্ফুটস্বরে বললেন, মাই গুডনেস! আমার মাত্র একশো মিটার পেছনে।

তারপর ঘুরে সুমনকে বললেন, এরই খোঁজেই আসছিলেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। সুমন আড়ষ্টভাবে জবাব দিল। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।

আপনার কি নাম! কোথায় থাকেন? এই মেয়েটি কে?

সুমন ব্যানার্জি। থাকি বারাহিয়ার নিউ কলোনিতে। সুমন ঢোক গিলে বলল, এ অনুরাধা।

কুইক। এখনই বারাহিয়া থানায় গিয়ে খবর দিন। আমি থাকছি এখানে। ইন্সপেক্টর মিঃ মোহন শর্মা থাকলে তাকে বলবেন, কর্নেল আছে ডেডবডির কাছে।

সুমন একটু অবাক হল। কর্নেল? কর্নেল কী…মানে আপনার পুরো নামটা…

বৃদ্ধ একটু হাসলেন। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। এবার টিলার দিকে নয়, উত্তরদিকটা ঘুরে সহজ পথে।…

.

০৩.

এই শরৎকালে বারাহিয়া এলাকায় বেড়াতে এসে হত্যারহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের এতটুকু ছিল না। কিন্তু চেঁকি স্বর্গে গেলেও তাকে ধান ভানতে হয় এটাই চেঁকির নিয়তি। ফুলঝরিয়া লেকের আশেপাশে সকালে একজাতের প্রজাপতি দেখেছিলেন। তাছাড়া লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার মোহানায় ছোট্ট জলাশয়ে ছিপ ফেলে বিকেলটা কাটানো লোভনীয় মনে হয়েছিল। কল্পনাও করেননি, তাঁর মাত্র একশো মিটার পেছনে এইভাবে একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে–নিয়তি যেন তার সঙ্গে একটা কদর্য পরিহাস করে বসল।

নিহত মেয়েটির নাম অনুরাধা সান্যাল। তার বাবা পরিতোষ সান্যাল স্থানীয় সরকারি শিল্পসংস্থার কর্মিদফতরের অফিস সুপারিন্টেন্টে। আর এক বছর পরে রিটায়ার করবেন। তার কাছে পুলিশ এমন কোনও সূত্র পায়নি, যাতে অনুরাধার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রণয়-প্রতিহিংসা বা এধরনের কোনও ব্যাপার আছে বলে মনে হবে। অনুরাধা নাকি সাদাসিধে আর মুখচোরা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের মেয়ে মঞ্জুশ্রী আর শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনা। তারাও পুলিশকে কোনও সূত্র দিতে পারেনি। মঞ্জুশ্রী যা বলেছে, তাতে সুমন ব্যানার্জীর অ্যালিবাই সঠিক সাব্যস্ত হয়েছে। তারা দুজনেই দেখেছিল, অনুরাধা দৌড়ে টিলা বেয়ে ওপাশে নেমে যাচ্ছে। শুধু এটুকু বোঝা যায়, কেউ তাকে তাড়া করে গিয়ে ছুরি মেরেছে। সুমনের বক্তব্য হল অনুরাধার ওভাবে দৌড়ানোটা তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাই সে খোঁজ নিতে গিয়েছিল হন্তদন্ত হয়ে।

যে গর্তে অনুরাধার বডি পড়ে ছিল, তার চারপাশে মাটিতে ঘন ঘাস। তাই তাদের ছাপ পাওয়া অসম্ভব। টিলাটার ঢালু অংশে মাটি পাথুরে। আগের রাতে বৃষ্টি হলেও পায়ের বা জুতোর ছাপ পড়ার মতো নরম হয়নি মাটিটা। অন্তত পুলিসের চোখে পড়েনি কোনো ছাপ।

ইন্সপেক্টর শর্মাজী সকালে সেচ দপ্তরের বাংলোয় এসে কর্নেলকে এইসব কথা জানিয়ে গেছেন। তার সিদ্ধান্ত হল ফুলঝরিয়া লেকের ওদিকে খুনোখুনি না হলেও মেয়েদের প্রতি মস্তানদের দৌরাত্মের অভিযোগ ইতিপূর্বে পাওয়া গেছে। অনুরাধাকে সম্ভবত কোনো মস্তানই রেপ করার জন্য তাড়া করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে রাগের চোটে ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার দুবৃত্তরা খুব সহজেই ছুরি চালাতে ওস্তাদ।

সিদ্ধান্তটা তত টেকসই অবশ্য নয়। তবু পুলিশের নিজস্ব কিছু প্রবণতা ও পদ্ধতি আছে এসব কেসে। তাছাড়া আজকাল যথেষ্ট খুনোখুনির দরুন পুলিশ আগের মতো মাথা ঘামাতে চায় না। রুটিন ডিউটি সেরে নেয় মাত্র।

কর্নেলেরও মাথা ঘামাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার মাত্র একশো মিটার দূরত্বে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে, ওটাই তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সারারাত ভাল ঘুমোত পারেননি। বারবার মনে হয়েছে, এ যেন একটা সাংঘাতিক ধৃষ্টতার সামিল। সামরিক জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে তার অভিজ্ঞতাটি বিরাট। ইদানিং তিনি হত্যারহস্য ছেড়ে প্রকৃতি রহস্যে মন দিয়েছিলেন। অথচ নিয়তি প্রতি পদক্ষেপে তার সামনে একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে তার সঙ্গে কুৎসিৎ রসিকতা করে চলেছে।

কর্নেল বাংলোর বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলেন, কোন পথ ধরে এগিয়ে যাবেন, অনুরাধার জীবনের ব্যাকগ্রাউণ্ড জানার জন্য কি তাদের বাড়িতে যাবেন, নাকি সেই টিলার কাছে গিয়ে আততায়ীর কোনও চিহ্ন খুঁজে বের করবেন। আজ সকালে ছুরিটা অবশ্য গর্তের জলের খুঁজে পেয়েছে পুলিস। কিন্তু জলে ধুয়ে গৈছে ছুরির বাঁটে আততায়ীর হাতের ছাপ এবং গন্ধ। তবে অন্য কোনও চিহ্ন কি মিলবে না যা আততায়ী সম্পর্কে একটু অন্তত আভাস দেয়!

বাংলোর গেট দিয়ে এক যুবতীকে আসতে দেখে কর্নেল তাকিয়ে রইলেন। যুবতীর মুখে অবাঙালী আদল। কোথায় দেখেছেন যেন। খুব সম্প্রতি দেখেছেন যুবতীটি বারান্দায় উঠে নমস্কার করে চমৎকার বাংলায় বলে উঠল, আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?

কর্নেলের মনে পড়ল। কাল রাতে হাসপাতালের মর্গে অনুরাধার বাবা-মায়ের সঙ্গে ওকে দেখেছিলেন। ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অনুরাধর মা ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ওই মেয়েটিই তাহলে অনুরাধার বন্ধু ভাবনা।

কর্নেল বললেন, বসুন। আশা করি, আপনি অনুরাধার বন্ধু ভাবনা। আমাকে আপনি বলবেন না প্লিজ। মুখোমুখি বসে বলল। কাল রাতে অফিসারদের সঙ্গে আপনাকে দেখেছিলুম। একটু আগে ইন্সপেক্টর মিঃ শর্মার কাছে গিয়েছিলুম কিছু কথা বলতে। কিন্তু উনি আমার কথার গুরুত্ব দিলেন না। হাসতে হাসতে বললেন, সিয়াসেটিয়াসে আমি বুঝি না। এ কেসের সঙ্গে ওসবের কী সম্পর্ক? বরং আপনি সেচবাংলোয় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে দেখা করুন। উনি ওইসব ব্যাপার বুঝবেন।

কর্নেল হাসছিলেন। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, সিয়াসে?

ভাবনা বলল, তার আগে প্লিজ বলুন, আপনি কি সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেলসায়েব? কমাস আগে টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় আপনার একটা হিস্ট্রি পড়েছিলুম। শৰ্মাজী আপনার নাম বলার পর তা মনে পড়েছে। সেজন্য ছুটে আসছি।

ভাবনা, সিয়াসের ব্যাপারটা কি?

আমার গুড লাক, কর্নেল! ভাবনা একটু হাসবার চেষ্টা করল। আপনাকে মুখোমুখি দেখব এবং কথা বলব, স্বপ্নেও ভাবিনি! এখন আমার মনে হচ্ছে, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী শীগগির ধরা পড়বেই পড়বে। সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।

কিন্তু…..কর্নেল হাসলেন। তুমি রহস্যের জট আরও পাকিয়ে তুলছ, ভাবনা!

ভাবনা চারপাশ দেখে নিল। বাংলো নির্জন। কিচেনের দিকে চৌকিদারের বউ কাজে ব্যস্ত। তার এদিকে চোখ নেই। ভাবনা চাপা গলায় বলল, আজ সাতাশে অক্টোবর, চব্বিশে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমি আর অনুরাধা সুদীপ্তের দিদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। সুদীপ্তের ওই বিধবা দিদি ছাড়া এক কেউ নেই। মাঝে মাঝে ওঁকে সাহায্য করতে যাই। সুদীপ্ত ওমাসে হঠাৎ মার্ডার হওয়ার

কে সুদীপ্ত?

ধাতু গবেষণা কেন্দ্রে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। একুশে সেপ্টেম্বর সকালে ওর ডেডবডি পাওয়া যায় পোডড়া খনি এলাকয়। পুলিশ এ পর্যন্ত কোনও কিনারা করতে পারেনি সে-কেসের।

তোমাদের সঙ্গে আলাপ ছিল তাঁর।

হ্যাঁ, অনুরাধার সঙ্গে সুদীপ্তের গোপন সম্পর্ক ছিল। সেটা শুধু আমিই জানতুম। অনুরাধার সঙ্গে ওর বিয়েও হয়ে যেত এতদিনে।

হুঁ, তারপর?

সুদীপ্তের দিদি বিশাখাদির সঙ্গে দেখা করে সাইকেলরিকশোয় ফিরে এসেছিলুম। পার্বতীতলার মোড়ে রিকশো ছেড়ে ভাবলুম, বাকি রাস্তা হেঁটে যাব। হাঁটতে, আমার ভাল লাগে। তখন অবশ্য রাত দশটা বেজে গেছে। অনুরাধা আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। পার্বতীতলা থেকে একটুখানি পথ মাত্র। কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তখন দৌড়ে মঞ্জুশ্রীদের বাড়ি ঢুকলাম। মঞ্জুশ্রী মানে–

বুঝতে পেরেছি। বলো।

মঞ্জুশ্রীর পিসতুতো দাদা অরুণেন্দুর সঙ্গে আলাপ হল ওদের বাড়িতে। সে সিয়াসের আসর করতে চাইল। ব্যাপারটা আমার জানার আগ্রহ ছিল। ওদের ডাইনিং টেবিলে আসর বসানো হল। অরুণেন্দু কেন জানি অনুরাধাকেই মিডিয়াম হতে রাজি করাল। আমাকে অবাক করে অনুরাধা রাজি হয়ে গেল। সিয়াসের আসর কীভাবে হয় জানতুম না। অরুণেন্দু বুঝিয়ে দিল।

ভাবনা সে রাতের ব্যাপারটা বর্ণনা করলে কর্নেল বললেন, অনুরাধা সুদীপ্তের নাম লিখেছিল?

লিখেছিল–মানে সুদীপ্তের আত্মা ভর করেছিল ওর মধ্যে। সেই লিখেছিল।

আর কী লিখেছিল?

অরুণেন্দু প্রশ্ন লিখছিল আর সুদীপ্তের আত্মা তার জবাব লিখছিল। একটু পরে হঠাৎ অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেল। আসর ভেঙে গেল। কী লিখেছিল ওরা, আর দেখিনি। কাগজটা অরুণেন্দুর হাতেই ছিল। সে একটু পরে ওটা ওর মামা ডঃ রায়কে দিল। উনি রেখে দিলেন কাগজটা।

কাগজটা তাহলে তুমি দেখনি?

না।

বাড়ি ফেরার পর কোনও সময় অনুরাধাকে জিগ্যাসা করোনি কিছু?

করেছিলুম। ও বলেছিল, কিছু জানে না। কী লিখেছিল ওর মনে নেই।

সুদীপ্তের মৃত্যুর পর অনুরাধা ওর সম্পর্কে এমন কিছু কি বলেছিল তোমাকে, যাতে তোমার ধারণা হয়েছিল যে সে কিছু জানত?

ভাবনা একটু ভেবে বলল, না তো। এমন কী কাকে ওর সন্দেহ হয় তাও বলেনি। কিন্তু ….

কিন্তু?

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অনুরাধা হয়তো কিছু জানত। আমাকে বলেনি।

কেন মনে হচ্ছে?

কাল দুপুরে অনুরাধা আমাকে ফোন করে বলেছিল, বিকেলে ফুলঝরিয়া লেকে বেড়াতে যাবে। আমি ওর সঙ্গে যাব কি না। আমি বললুম– গাড়ি ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাবাকে গাড়ির কথা বললে জিগ্যেস করবেন কোথায় যাচ্ছি। ফুলঝরিয়ার নাম শুনলে কিছুতেই যেতে দেবেন না। ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার সময় ট্যাক্সি পাব না। রিকশোও পাব না। হাঁটতে হবে। তাই ওকে বারণ করলুম। অনুরাধা ঠিক আছে বলে ফোন ছেড়ে দিল। তো ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরে ওদের বাড়ি গিয়ে শুনলুম ও এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। আমি ভাবতেই ও একা ফুলঝরিয়া চলে গেছে। কিন্তু এখন অবাক লাগছে, কেন ফুলঝরিয়া যেতে চেয়েছিল অনুরাধা?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন। তারপর বললেন, সিয়াসের আসরের ব্যাপারটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, বুঝতে পারছি। কেন তা তুমি ওই ব্যাপারটাই বলতে গিয়েছিলে শৰ্মাজীর কাছে। অথচ তুমি বলছ, সুদীপ্তের আত্মাই অনুরাধার শরীরে ভর করেছিল।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কর্নেল! একবার মনে হচ্ছে, অনুরাধা ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করেছিল। আবার মনে হচ্ছে, তাহলে ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? অথচ খালি সন্দেহ হচ্ছে, ওর খুন হয়ে যাওয়ার পেছনে যেন সিয়াসের ব্যিাপারটার কোনও যোগাযোগ আছে।

কী যোগাযোগ থাকতে পারে ভাবছো?

এক হতে পারে, অনুরাধার হাত দিয়ে সুদীপ্তের আত্মা এমন কিছু লিখেছিল, যা তার খুনীকে ধরিয়ে দেবে। আর এক হতে পারে, অনুরাধা দুষ্টুমি করে–তার মানে, অভিনয় করে আসরের কাউকে কোনও হিন্ট দিতে চাইছিল।

অর্থাৎ সে জানত কে খুন করেছে সুদীপ্তকে?

ধরুন, তাই।

তাহলে তো বলতে হয়, খুনী ওই আসরেই উপস্থিত ছিল?

ভাবনা চমকে উঠল। আসরে তো ছিল সুমন ব্যানার্জি, অরুণেন্দু, মঞ্জুশ্রী আর আমি। অরুণেন্দু কলকাতায় থাকে। বেড়াতে এসেছে। আমি সুদীপ্তকে খুন করি নি। আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। মঞ্জুশ্রীও তাই। বাকি রইল সুমন। কিন্তু সুমন কেন সুদীপ্তকে খুন করবে? তাছাড়া সুমন অত্যন্ত নিরীহ ছেলে। খুব ভদ্র।

কাগজটা ডঃ রায় নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। ভাবনা জোরের সঙ্গে বলল। কিন্তু উনিই বা কেন সুদীপ্তকে খুন করবেন? সুদীপ্ত তো ওঁরই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। মঞ্জুর সঙ্গে প্রথমে সুদীপ্তেরই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সুদীপ্ত রাজি হয়নি। কিন্তু তাই বলে তাকে মেরে ফেলবেন? এ একেবারে অসম্ভব।

তাহলে স্বীকার করতে হয়, সত্যি সুদীপ্তের আত্মা এসেছিল। কিন্তু খুনীকে ধরিয়ে দেবে এমন কোনও সূত্র লিখেছিল সেই কাগজটাতে–এর প্রমাণ কী? তুমি তো দেখনি ওটা। কাজেই ওতে কী ছিল না দেখা পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় কি?

ভাবনা আস্তে বলল, আমার সন্দেহ যাচ্ছে না। আপনি একবার যাবেন আমার সঙ্গে ডঃ রায়ের কাছে?

কর্নেল, বললেন, চলো, যাই।…

ডঃ কুসুমবিহারী রায় কর্নেলের পরিচয় পেয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাইলেন। কাগজটা তক্ষুনি এনে দিলেন কর্নেলকে। বললেন, ভাবনা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওর সঙ্গে আমি একমত। আমিও ঠিক একই সন্দেহে ভুগছি। কিন্তু পুলিশকে আগ বাড়িয়ে এ ব্যাপারটা জানাতে যাইনি। কারণ আশা করি, বুঝতেই পারছেন। পুলিশ বড় আনপ্রেডিক্টেবল! উল্টে আমাদের কাউকে জড়িয়ে বসবে হয়তো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব চিন্তাভাবনা করেছি। এর একটা আশকারা হওয়া দরকার। দীপ্তেন্দু আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল–অনুরাধাও।

কর্নেল কাগজটা দেখছিলেন। পেন্সিলে লেখা। ৩৪৭ নং পিট, কালো পাথর, মোহান্তজী। বললেন, এই কথাগুলো অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন কি!

ডঃ রায় চিন্তিতমুখে বললেন, খনি এরিয়ার ম্যাপ দেখে বুঝতে পেরেছি, ওটা একটা ডেড মাইন। জায়গাটা আট কিলোমিটার দূরে ফুলঝরিয়া লেকের পশ্চিম দিক দিয়ে যে হাইওয়ে গেছে, সেই রাস্তায় ডেড মাইন এলাকায় যাওয়া যায়। সবই অ্যাবাণ্ডাণ্ড মাইন। মুখ সিল করা আছে। দেখাচ্ছি আপনাকে।

বলে উনি ভেতরের ঘর থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে এলেন। সেটা টেবিলে ছড়িয়ে এলাকাটা দেখিয়ে দিলেন। এই হল পিট নং ৩৪৭। এই দেখুন, লেখাই আছে। মুখটা পাথর আর কংক্রিটের চামড়া দিয়ে সিল করা আছে। এটা ছিল অভ্রের খনি।

কর্নেল বললেন, আর কালো পাথর?

কালোপাথর তো বারাহিয়া ব্লকের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এর অর্থ কী বুঝতে পারিনি।

মোহান্তজী?

ডঃ রায় বলার আগেই ভাবনা বলে উঠল, কেন? পার্বতীমন্দিরের মোহান্তজী!

ডঃ রায় বললেন, হ্যামন্দিরের সেবায়েত উনি। উনি ছাড়া আর এ এরিয়ার তো কোনো মোহান্তজী নেই। কিন্তু মোহান্তজী তো বুড়ো মানুষ। মন্দিরেই থাকেন প্রায় সারাক্ষণ। ওঁর নাম কেন লিখল–অনুরাধা লিখুক অথবা দীপ্তরে আত্মাই লিখুক–কিছুতেই মাথায় আসছে না।

আপনার ভাগ্নে অরুণেন্দু আছেন কি?

মঞ্জুশ্রী বলল, অরুদা একটু আগে বেরিয়েছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি।

ডঃ রায় একটু হাসলেন। ওঁর ওই অভ্যাস! টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। এখানে এসে একদণ্ড ঘরে বসে থাকতে চায় না। ভূতপ্রেতের খোঁজেই হয়তো ঘুরে বেড়ায়।

মীনাক্ষী বললেন, নিশ্চয় মোহান্তজীর কাছে গিয়ে বসে আছে। মোহান্তজীও যে ওর দোসরা ভূতের ওঝা!

ডঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ–মোহান্তজী বস্ত এরিয়ার সব ভূতপ্রেতের একচেটিয়া মালিক। বস্তর মেয়েদের নাকি প্রায়ই ভূতে ধতে। ওঁর পোষা প্রেত কিংবা পিশাচ ভূতটাকে তাড়িয়ে দেয়।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কাগজটা আর এই ম্যাপটা আমি একদিনের জন্য রাখতে চাই, ডঃ রায়। আপত্তি আছে কি?

না, না। রাখুন। ডঃ রায় ঘড়ি দেখে বললেন, আমাকেও এখনই অফিসে যেতে হবে। আবার দেখা হবে। এ বাড়িতে আপনার অবারিত দ্বার। তাছাড়া আমি চাই, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী ধরা পড়ুক। পুলিস হোপলেস! আপনি আমার কাছে সর্বপ্রকার সহযোগিতা পাবেন–আই অ্যাসিওর ইউ।…

রাস্তায় গিয়ে ভাবনা বলল, কর্নেল মোহান্তজীর কাছে যাবেন একবার?

চলো, যাই।

ভাবনা পা বাড়িয়ে বলল, ওই দেখা যাচ্ছে বটগাছের ভেতর মন্দিরের চুড়ো। কাছেই।

মন্দির এলাকা বেশ বড়। পাঁচিল ঘেরা প্রাঙ্গণ। একটা আটচালা আছে প্রাঙ্গণে। ওপাশে কয়েকটা একতলা ঘর। জরাজীর্ণ অবস্থা। মন্দিরটার চেহারা বেশ পরিচ্ছন্ন। পেছনে বিশাল বটগাছ আছে। মন্দিরের ভেতর একাদশ শতাব্দীর পার্বতীমূর্তি। পাশের একতলা ঘরের বারান্দায় খাটিয়া পেতে দাড়িজটাজুটধারী এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তিনিই মোহান্তজী। ভাবনাকে দেখে বললেন, আয় বেটি আয়।

ভাবনা প্রণাম করে শুধু কর্নেলের নাম জানিয়ে বলল, ইনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন মোহান্তজী!

কর্নেল নমস্কার করলেন। মোহান্তজী খাটিয়ার ওধারে একটা চারপায়া দেখিয়ে বললেন, বৈঠিয়ে জী! বৈঠিয়ে!

কর্নেল বসে বললেন, আপনি কত বছর এ মন্দিরে আছেন মোহান্তজী?

এ মন্দিরে আমরা পুরুষানুক্রমে সেবাইত।

আপনার বয়স কত হল?

আশি-পঁচাশি হবে। মালুম নেই।

আচ্ছা মোহান্তজী, সত্যিই কি ভূতপ্রেত বলে কিছু আছে?

মোহান্তজী একটু অবাক হলেন যেন। বললেন, মনুষ্যাত্মা অমর কর্নেলসাব। যতদিন না জীবাত্মা ব্রহ্মলোকে পরমাত্মার সঙ্গে বিলীন হচ্ছে, ততদিন তার মুক্তি নেই। মানুষের মৃত্যু হওয়ার পর কিছুদিন তার জীবাত্মার মধ্যে ইহলোকের সব সংস্কার থেকে যায়। যতদিন সেটা থাকে, ততদিন সে প্রেত। ততদিন মায়া কাটাতে পারে না আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের। তাদের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়।

আপনি দীপ্তেন্দু মিত্রকে নিশ্চয় চিনতেন?

মোহান্তজী ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?

দীপ্তেন্দু মিত্র–যে গতমাসে খুন হয়ে গেছে!

মোহান্তজী তীক্ষ্ণ দৃষ্টে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, সে আপনার আত্মীয়?

হ্যাঁ। কর্নেল কপট গাম্ভীর্যে বললেন। কিছুদিন যাবৎ দীপ্তেন্দুকে খুব স্বপ্নে দেখছি।

হুঁ, স্বপ্নেও মনুষ্যাত্মা দেখা দেয় আত্মীয় স্বজনকে।

দীপ্তেন্দু স্বপ্নে আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলেছে। বুঝতে পারছি না। তাই আপনার কাছে এলাম।

ঝুট! প্রায় গর্জন করলেন মোহান্তজী। নড়ে বসলেন। খাঁটিয় মচমচ করে কেঁপে উঠল। ফের বললেন, সব ঝুট! ডাহা মিথ্যা! আপনি পুলিসের গোয়েন্দা। বেটি ভাবনা, এ কাকে আমার কাছে এনেছিস?

ভাবনার দিকে রক্তরাঙা চোখে মোহান্তজী তাকালে। ভাবনা বিব্রতভাবে বলল, না না। ইনি পুলিসের গোয়েন্দা নন, মোহান্তজী!

আলবত গোয়েন্দা। বলে মোহান্তজী কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। আপনি চলে যান এখান থেকে। আপনার কোনও কথার জবাব দেব না আমি।

কর্নেল অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, এ কী বলছেন মোহান্তজী? আমি গোয়েন্দা হতে যাব কোন দুঃখে? সুদীপ্ত প্রায়ই আমাকে কালো পাথরের কথা বলে। আমি শুনলুম, আপনি প্রেসিদ্ধ। তাই আপনার সাহায্য চাইতে এসেছি।

মোহান্তজী আরও আগুন হয়ে বললে, নিকাল যাইয়ে আপলোগ! তারপর পেছন ফিরে ডাকলেন, এ ভোলা! এ রামু! জলদি ইধার আ তো!

ভাবনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কর্নেল! মিছিমিছি অপমানিত হয়ে লাভ নেই। চলুন।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন মোহান্তজী, চলি চাহলে, আবার দেখা হবে।

মোহান্তজী গর্জন করে আবার ভোলা ও রামুকে ডাকতে লাগলেন। মন্দিরের পেছনথেকে দুট ষণ্ডামার্কা লোক উঁকি দিচ্ছিল। ভাবনা ফিসফিস বলে উঠল, ওরা খুব খারাপ লোক। চলে আসুন, কর্নেল।

বাইরের রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল একবার ঘুরলেন। মোহান্তজী তাঁদের দিকে আঙুল তুলে সেই ভোলা ও রামুকে কিছু বলছেন। লোকদুটোর চেহারা দেখে বোঝা যায়, ওরা গুণ্ডা প্রকৃতির। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, কী বুঝলে ভাবনা?

ভাবনা একটু হাসল। মোহান্তজী কালোথর শুনে এমন সাংঘাতিক রেগে গেলেন কেন, কে জানে!

অনুরাধা এ রহস্যের সঠিক চাবিকাঠিটা রেখে গেছে। শুধু এটুকুই বলতে পারি।

ঠিক বলেছেন, কর্নেল! কালোপাথর জিনিসটা যাই হোক, সুদীপ্ত আর অনুরাধা খুন হওয়ার সঙ্গে তার সল্ট আছে। ওকে অ্যারেস্ট করলে সব বেরিয়ে পড়বে।

আপনি শৰ্মাজীকে বলুন ব্যাপারটা।

বলব। আরও একটু এসে কর্নেল বললে, কি আছে। আমি এবার চলি, ভাবনা। আপাতত এ নিয়ে তুমি কারুর সঙ্গে আলোচনা কোরো না। আর শোনো, সাবধানে থেকো। যথাসময়ে আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

ভাবনা তাদের বাড়ির রাস্তা ধরল। কর্নেল চললেন বাংলার পথে ….

.

০৪.

কিছুক্ষণ পরে বাংলো থেকে সিধে নাক বরাবর হাঁটছিলেন কর্নেল। কাঁধে কিটব্যাগ, হাতে ছিপ আর প্রজাপতি ধরা জাল। ক্যামেরা আর বাইনোকুলার যথারীতি দুপাশে ঝুলছে। বাঁজা ডাঙা, ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটা ক্যানেল। তারপর ভুট্টা অড়হরের ক্ষেত কিছুদূর। তারপর আবার টাড় জমি, পাথুরে মাটি, মাটি, টিলা। ফরেস্ট দফতরের লালিত শালবন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে চোখ রেখে পাখি দেখছিলেন। কোনও প্রজাপতি দেখলেই থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন। কিন্তু বড্ড ছটফটে ওরা। তাছাড়া এখন লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার কাছে পৌঁছনোর তাড়া আছে।

ডোবাটার কাছে পৌঁছে কাল যে পাথরে বসে ছিপ ফেলে ছিলেন, সেখানে ছিপ, কিটব্যাগ ইত্যাদি রাখলেন। জলে চার ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন। কালকের মতই নির্জন।

যে গর্তে অনুরাধা পড়েছিল, প্রথমে গেলেন সেখানে। জলটা এখনও লাল হয়ে আছে। মন খারাপ হয়ে গেল কর্নেলের। কাল একটাও মাঝ ধরতে পারেনি। কিন্তু বঁড়শির টোপ ধরে অনবরত টানাটানি করছিল এবং মনটা ওইদিকেই আটকে ছিল সারাটা সময়। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। এতটুকু টের পান নি।

উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে প্রকৃতি। গর্তটার চারপাশে ঘন ঘাস। মাটিটা সে রাতের বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে এখনও। কাল সন্ধ্যার মুখে আলো ছিল যথেষ্ট কম। একদফা চারপাশটায় খুঁজছিলেন, পায়ের ছাপ অথবা কোনও চিহ্ন যদি পাওয়া যায়। আলোর অভাবে খুঁজে পাননি। এখন প্রায় এগারোটা বাজে। ঘাসের তলায় একখানে এবং গর্তের ধারে কতকগুলো জুতোর ছাপ দেখা যাচ্ছিল। পরীক্ষা করে বুঝলেন, সবই পুলিসের জুতোর ছাপ। দুজনের পায়ে হাল্কা স্যান্ডেল ছিল লক্ষ্য করলেন। সে এখানে এসেছিল দক্ষিণ দিক থেকে–যেখানে কর্নেল বসে মাছ। ধরছিলেন। অনুরাধা এসেছিল কোন দিক থেকে? খুঁজতে খুঁজতে একখানে চোখ গেল। ঘাস দেবে গেছে এবং উপড়ে গেছে শেকড়সুদ্ধ। ধস্তাধস্তির চিহ্ন পরিষ্কার! এখানে হাঁটু সমান উঁচু গুল্মজাতীয় ঝোপগুলো হেলে আছে। ডাল ভেঙে গেছে। তারপর খানিকটা রক্তও দেখতে পেলেন। গর্ত থেকে দুমিটার তফাতে ছুরি মেরেছিল আততায়ী।

এখান থেকেই অনুরাধার গতিপথ খুঁজে পেলেন। দৌড়ে এলে ঘাস ছিঁড়ে ও উপড়ে যাবার কথা। ওর জুতো দুটো এখানেই কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছে পুলিশ। শৰ্মাজী বলছিলেন, গর্তটার কাছাকাছি পাওয়া গেছে।

তার মানে অনুরাধা জুতো খুলে দৌড়ত শুরু করেছিল। কিংবা তার মতলব টের পেয়ে প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।

ঘাস ছাড়িয়ে পশ্চিমে টিলার দিকে এগোতেই অনুরাধার দৌড়ে আসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল। মাটিটা পাথুরে এবং টিলার ঢাল থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে এসে একখানে নালা মতো হয়েছে। তাতে জল নেই। বালি জমে রয়েছে। বালির ওপর ডেবে যাওয়া জুতোর ছাপ অনেকগুলো। ছাপগুলো পরিষ্কার নয়। তবে কিছু ছাপ বেশি গভীর। কিছু কম। কম গভীরগুলো অনুরাধার, তাতে ভুল নেই। বেশি গভীরগুলো নিশ্চয় আততায়ীর।

কর্নেল বালির ওপর দিয়ে এলেন একবার। তারপর নিজের জুতোর ছাপ পরীক্ষা করলেন। আততায়ীর দেহের ওজন তার চেয়ে কিছু কম। লোকটা তার চেয়ে বেঁটে। জুতোর দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয় তার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হতে পারে না। কর্নেলের উচ্চতা সওয়া ছফুট।

কোথাও-কোথাও টিলার ঢালের ওপর অনুরাধার জুতোর ছাপের ওপর আততায়ীর জুতোর ছাপ পড়েছে। সেই ছাপগুলো কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটা প্রকাণ্ড পাথর ঘুরে ছাপগুলো ওপরে উঠেছে। পাথরটার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়লেন। পাথরটার কোণার দিকে টাটকা গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন। এমন কী, একটা ছোট্ট খুরপিও পড়ে আছে।

দেখামাত্র মনে হল, এইমাত্র কেউ গর্তটা খুঁড়ছিল। তাকে আসতে দেখে পালিয়ে গেছে।

কর্নেল ব্যস্তভাবে ওপরে উঠতে থাকলেন। ফুট দশেক ওঠার পর চ্যাটালোত একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে ওধারের ঢাল ও নিচের লেকের দিকে তাকালেন। কাছাকাছি কাউকে দেখতে পেলেন না। দূরে পার্কে এবং ওয়াটার পাম্পিং স্টেশনের ওখানে কিছু লোক আছে। যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে সম্ভবত নিচের বড় বড় পাথরের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। মিনিট দশেক চোখে বাইনোকুলার রেখে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। তারপর গর্তটার কাছে নেমে এলেন।

আবার থমকে দাঁড়ালেন। গর্তের ওপর এবং এই ঢালে আরও নানা সাইজের কালোপাথর পড়ে আছে। কিন্তু কোনটাই এত কালো নয়।

তাহলে কি এটাই সেই কালোপাথর?

গর্তের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসলেন কর্নেল। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে এতক্ষণে চোখে পড়ল, যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে তাকে দেখে পালিয়ে যেতেও পারে বটে, কিন্তু যে জন্য খুঁড়ছিল, তা পেয়ে গেছে। কারণ গর্তটার তলায় আন্দাজ আট ইঞ্চি লম্বা এবং ইঞ্চি ছয়েক চওড়া কী একটা জিনিস ছিল। তার তলার ছাপটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। মাটিটা বৃষ্টিতে যথেষ্ট নরম। কারণ সে রাতের বৃষ্টির জল টিলার ওপর দিকে থেকে গড়িয়ে এসে এই কালো পাথরে বাধা পেয়ে মাটিটাকে গভীর ভাবে ভিজিয়ে দিতে পেরেছিল।

কোনও চৌকো জিনিস এখানে পোঁতা ছিল। ছোট্ট বাক্সের মতো কোনও জিনিস।

খুরপিটার বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। সেটা সাবধানে মাথার দিকে ধরে তুলে নিলেন কর্নেল। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে ঝর্ণার ডোবাটার ধারে ফিরলেন।

কিন্তু ছিপ ফেলার চেয়ে যা দেখে এলেন, সেটাই জরুরী হয়ে উঠেছে। কর্নেল সব গুটিয়ে নিয়ে ফিরে চললেন বাংলোয়। ইন্সপেক্টর শর্মার সঙ্গে শীগগির আলোচনা করা দরকার।

আধঘণ্টার মধ্যে বাংলোয় ফিরে গেটের মুখে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি তাকে দেখে নমস্কার করে বললেন, আপনিই কি কর্নেলসায়েব? ভাবনা আমাকে আপনার কাছে আসতে বলল। আমি অনুরাধার বাবা।

.

০৫.

পরিতোষবাবু বললেন, আপনি বেরিয়েছেন শুনে চলে যাচ্ছিলুম। পরম সৌভাগ্য যে দেখা হল। সকালে অনুর বডি মর্গ থেকে ডেলিভারি দিয়েছিল। দাহক্রিয়া করে বাড়ি ফিরে ওর জিনিসপত্র ঘাঁটতে বসেছিলুম। আমার ছেলে মনীশ বছর দুই আগে বাস অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তারপর অনুও এভাবে গেল। কী পাপে ভগবান এমন শাস্তি দিলেন জানি না। তো যে জন্য এসেছি বলি–

পরিতোষবাবু পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ আগে অনুর ড্রয়ারে এটা পেয়েছি। এ চিঠি কে তাকে লিখেছে, জানি না। পুলিসের কাছে যাব ভাবছিলুম, হঠাৎ অনুর বন্ধু এল। তাকে তো আপনি চেনেন। সে বলল আগে আপনার কাছে যেতে। কারণ ভাবনার সন্দেহ, এর পেছনে প্রভাবশালী লোক আছে। তাই পুলিশ সুদীপ্তের কেসের মতো এই কেসটাও চেপে দেবে।

কর্নেল চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে চমকে উঠলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা ছোট্ট চিঠি। সরলার্থ করলে দাঁড়ায় :

২৬ অক্টোবর বিকেল পাঁচটায় ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকে টিলায় গোর্পনে : গিয়ে অপেক্ষা করবে। সুদীপ্তের হারানো জিনিসটার খোঁজ দেব। ইতি, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

কর্নেল বললেন, খুনী ওকে ফাঁদে ফেলেছিল। কিন্তু সুদীপ্তের হারানো জিনিস কী, সে সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?

পরিতোষবাবু বললেন, অনুর কাছে শুনেছিলুম মনে পড়ছে। সুদীপ্ত কী একটা নতুন মিশ্ৰধাতু আবিষ্কার করেছিল নাকি। একটা ফর্মুলার আকারে সেটা লিখে ব্রিফ কেসে রেখেছিল। ওর ল্যাবরেটরি থেকেই সেটা চুরি যায়।

এটা কতদিন আগের ঘটনা, জানেন?

এই তো গতমাসের। সুদীপ্ত যেদিন খুন হল, তার পরদিন অনু ওর মাকে বলছিল। আমার কানে এসেছিল কথাটা। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলুম। অনু বলল, যে মিশ্ৰধাতু সুদীপ্ত আবিষ্কার করেছিল, তা নাকি যুগান্তকারী। অসম্ভব হালকা, অথচ ভীষণ শক্তিশালী। ওই দিয়ে মহাকাশযান তৈরি করা যাবে ভবিষ্যতে। সুদীপ্ত ওকে কথাটা গোপন রাখতে বলেছিল।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আর কিছু বলছিল মনে পড়ছে কি?

পরিতোষবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ–অনু বলেছিল, মিশ্ৰধাতুর একটা নমুনা তাকে দেখিয়েছে সুদীপ্ত। জিনিসটা দেখতে কালো পাথরের মতো! ওটার কোডনাম দিয়েছিল নাকি ব্ল্যাকস্টোনকালো পাথর!

কালো পাথর? কর্নেল চমকে উঠলেন এবার।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই বলেছিল মনে পড়ছে। ব্ল্যাকস্টোন।

ঠিক আছে পরিতোষবাবু! আপনি তাহলে আসুন। আমি দেখছি, কী করা যায়। আর একটা কথা, এসব কথা আর কাউকে বলবেন না যেন। পুলিসকে যা বলার আমিই বলব।

পরিতোষবাবু কর্নেলের হাত ধরে বললেন, আমার বংশে বাতি দিতে কেউ রইল কর্নেল! এই অভিশপ্ত জীবনে অন্তত একটা সান্ত্বনা পাব, যদি অনুর খুনী ধরা পড়ে এবং শাস্তি পায়।

কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলেন।

তাহলে কালো পাথর-এর প্রকৃত রহস্য এটাই। ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকের টিলায় যে কালো পাথরটা দেখে এলেন, সেটার কোনো তাই রইল না। কিন্তু ওখানে যে জিনিসটা পোঁতা ছিল, সেটাই বা কি? কে তুলে নিয়ে গেল ওটা?

কিছুক্ষণ পরে জিপের শব্দে কর্নেল দেখলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর শর্মাজী আসছেন।

মিঃ শর্মা এসে হাসতে হাসতে বললেন, পার্বতীমন্দিরের মোহান্তজী আমার কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল একটু আগে। আমাদের গোয়েন্দা নাকি ওকে উত্যক্ত করতে গিয়েছিল। যে বর্ণনা দিল, বুঝলুম আপনি ছাড়া আর কেউ নন। বিশেষ করে কেশরলাল শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনাও যখন সঙ্গে ছিল।

কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, মোহান্তজীর কী ব্যাপার বলুন তো মিঃ শর্মা?

পার্বতীমন্দিরের ভেতরে যে মূর্তিটি আছে তার তলায় একটা ছোট্ট বেদী ছিল। ওটা নাকি উল্কা পাথর, নিশ্চয় খুব দামী জিনিস। মোহান্তজীর দুই ষণ্ডামার্কা চ্যালা আছে ভোলা আর রামু। স্বভাবত তাদের সন্দেহ করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারা জেরার চাপে বলেছিল, পাথরের বেদীটা নাকি রিসার্চ সেন্টারের সুদীপ্ত মিত্রকে বেচেছে। সুদীপ্ত মিত্র তার কদিন আগে খুন হয়ে গেছেন। ডেড মাইন এলাকায় ওঁর বডি পাওয়া গিয়েছিল। পেছন থেকে কেউ ছুরি মেরেছিল। যাইহোক, তার বাড়ি সার্চ করে পাথরের বেদীটা আমরা পাইনি।

কিন্তু কালো পাথরের কথা শুনে মোহান্তজী ক্ষেপে যান কেন?

রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে মাঝে মাঝে আমাদের লোক গিয়ে ওঁকে জেরা করে। প্রথম প্রথম অত চটতেন না। পরে ভীষণ চটে যান। বারাহিয়ার প্রভাবশালী লোকেদের ধরে উনি পুলিশের জেরা করতে যাওয়া ঠেকিয়েছেন।

হাসতে লাগলেন মিঃ শর্মা। কর্নেল বললেন, তার মানে মোহান্তজীর প্রতি আপনাদের সন্দেহ আছে বেদী চুরির ব্যাপারে?

নিশ্চয় আছে। আমার অন্তত দৃঢ় বিশ্বাস, মোহান্তজীই ওটা কাউকে বেচেছেন।

আপনি কি জানেন, সুদীপ্তবাবু একটা আশ্চর্য মিশ্ৰধাতু আবিষ্কার করেছিলেন?

মিঃ শর্মা অবাক হয়ে বললেন, না তো। কে বলল আপনাকে?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট আবার জ্বেলে ধোঁয়ার ভেতর বললেন, তাহলে সবটাই এবার বলা দরকার আপনাকে। মন দিয়ে শুনুন।…

আগাগোড়া সবটা শোনার পর মিঃ শর্মা গম্ভীর মুখে বললেন, আমি ভেবেছিলাম সাধারণ কেস–এই শিল্প এলাকায় যা আকছার হয়। আসলে আপনার পথে কতকগুলো সুবিধে আছে–অন্তত যে দুটো কেস প্রতাপগড়ে থাকার সময় দেখেছি। আপনার পদ্ধতিও অবশ্য আলাদা। তাছাড়া আজকাল লোকে বিশ্বাস করে পুলিসের কাছে মুখ খুলতে চায় না। লোকের দোষ কী? রাজনীতির চাপে পুলিসও তেমনি বিপর্যস্ত।

কর্নেল বললেন, খুরপির বাঁটে হাতের ছাপটা তুলতে ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্টে আজই পাঠিয়ে দিন। একটু তাগিদ দিয়ে কাজটা করতে হবে। আর আজই ডেড মাইন এলাকায় ৩৪৭ নং পিটের ওখানে যাওয়া যাক। বিকেল তিনটেয় বেরুব। আপনি তার আগে আগেই আসুন।

মিঃ শর্মা চিন্তিত মুখে বললেন, ঠিক সময়ে এসে আপনাকে নিয়ে যাব। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় এল এই মাত্র। ফুলঝরিয়ার টিলায় যে গর্তটা দেখেছেন, সেই উল্কাপাথরের বেদীটা লুকোনো ছিল না তো? গর্তের তলায় যে ঘাটের কথা বললেন, তার সঙ্গে চুরি যাওয়া বেদীর মাপটা কিন্তু মিলে যাচ্ছে।

তাহলে এখানে বেদীটাই লুকোনো ছিল!

মিঃ শর্মা উঠলেন। নাঃ! আর ভাবলে মাথা ঘুলিয়ে যাবে। হাসতে হাসতে বললেন আপনি লাঞ্চ সেরে নিন। দুটো বাজে প্রায়। আমি পৌনে তিনটের মধ্যে এসে পড়ছি। তারপর উনি খবরের কাগজে জড়ানো খুরপিটা সাবধানে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন।…

.

০৬.

ডেড মাইন এলাকা ঢিবি খানাখন্দ আর জঙ্গল গজিয়ে দুর্গম হয়ে আছে। জিপ এখানে রেখে কর্নেল ইন্সপেক্টর শর্মাজী আর দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল ৩৪৭ নং পিটের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের আমলেই এইসব খনি পরিত্যক্ত হয়ে ছিল। তারপর থেকে আর মানুষজন এদিকে চলাফেরা করে না। শৰ্মাজী গত মাসে একবার মাত্র এসেছিলেন এখানে। সুদীপ্তের লাশ পড়েছিল যেখানে, সেই জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, এখান থেকে ৩৪৭ নং পিট সম্ভবত বেশি দূরে নয়। কর্নেল ম্যাপটা আবার দেখা যাক। না হলে খুঁজে বের করা কঠিন হবে।

ম্যাপ খুলে দেখা গেল, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন–এ জোনের ৩০০ একর খনি সেটা, আর একটু ডাইনে এগোতে হবে। কিছুটা গিয়ে ঘন কাঁটাবন পড়ল। পাশ কাটিয়ে বাঁদিকে ঘুরে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। শৰ্মাজী ছিলেন পেছনে। বললেন, কী হল কর্নেল?

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, চুপ!

একটা ঢিবির সামনে কয়েকটা পাথরের চাঁই পড়ে আছে। তার আড়ালে হুমড়ি খেয়ে বসে কেউ কিছু করছে। তার মাথাটা শুধু দেখা যাচ্ছে। চাপা খস্ খস্ ঠং ঠং শব্দও কানে এল। কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করছে।

কর্নেলের ইশারায় শৰ্মাজী আর কনস্টেবল দুজন তিনদিক থেকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল। কর্নেল একটু অপেক্ষা করছিলেন। ডাইনে ও বাঁয়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঘুরে পুলিশের ছোট্ট দলটি ঢিবির পেছনে গেলে কর্নেল সোজা এগিয়ে গেলেন। তারপর পাথরের চাঁইগুলোর ওপর এক লাফে উঠে একটু কাশলেন।

একটা প্রকাণ্ড গর্তে জলকাদা আর ঘাসের ভেতর বসে একটা বেলচা দিয়ে খোঁড়াখুড়ি করছিল যে, তার জামাকাপড়ে যথেষ্ট কাদা লেগেছে। সে চমকে গিয়ে ঘুরল। তারপর কাঁচুমাচু হেসে উঠে দাঁড়াল।

অত্যন্ত ভদ্র চেহারার এক যুবক। কর্নেল অবাক হয়ে বললেন, কে আপনি! এখানে কী করছেন?

যুবকটি এবার পুলিশদেরও দেখতে পেয়ে আরও হকচকিয়ে গেল। শৰ্মাজী তার দিকে রিভলভার তাক করে গর্জে বললেন, উঠে এস! ওঠো বলছি।

যুবকটি বলল, কী দোষ করেছি আমি? আপনারা আমাকে মিছিমিছি–

কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকে দেখছিলনে। তার কথায় বাধা দিয়ে বললেন, কী নাম আপনার?

অরুণেন্দু মুখার্জি। ডঃ কুসুমবিহারী রায় আমার মামা হন।

শর্মজী ধমক দিয়ে বললেন, বিপদে পড়লে অনেকেই অনেকের ভাগ্নে হয়ে যায়! উঠে না এলে ঠ্যাং ভেঙে দেব গুলি করে।

অরুণেন্দু বিরক্তমুখে বেলচাটা নিয়ে গর্ত থেকে উঠে এল। তারপর বলল, অন্যায়টা কী করেছি, বুঝতে পারছি না, আমি যা করছিলুম, তাতে গভর্নমেন্টেরই লাভ হতো।

মিঃ শর্মাকে ইশারায় থামতে বলে কর্নেল জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার অরুণেন্দুবাবু? আপনি ভূতপ্রেত ছেড়ে হঠাৎ এখানে এসে জলকাদা ঘাঁটছেন কেন?

অরুণেন্দু কর্নেলকে দেখে নিয়ে বলল, ও! আপনিই তাহলে সেই কর্নেলসায়েব? ভাবনা আমাকে আপনার কথা বলছিল কিছুক্ষণ আগে। দাঁড়ান ওকে ডাকি আগে।

সে পাথরের চাঁইগুলোর উপর উঠে চেঁচিয়ে ডাকল, ভাবনা! ভাবনা!

একটু দূরে জঙ্গলের ভেতর থেকে সাড়া এল, যাচ্ছি!

ছেড়ে দাও! চলে এস এখানে!

ডানদিকের ঘন ঝোপজঙ্গল থেকে জলকাদা মাখা ভাবনাকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতেও একটা খন্তা এবং কোমরে আঁচল জড়ানো। চুলেও যথেষ্ট কাদা লেগেছে। সে কর্নেলদের দেখেই অপ্রস্তুত হেসে থমকে দাঁড়াল।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, এস ভাবনা! বুঝতে পারছি, তুমি এ বুড়োর ওপর ভরসা না করে নিজেই গোয়েন্দাগিরি করতে নেমেছে।

ভাবনা এসে ক্লান্তভাবে বসে পড়ল পাথরে। তারপর বলল, অরুদা, তুমিই বলল ব্যাপারটা। আমি হাঁপিয়ে গেছি।

অরুণেন্দু বলল, আপনি আর ভাবনা সকালে যখন মোহান্তজীর কাছে গেলেন, তখন আমি বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলুম। সিয়াসের আসরে সুদীপ্তের আত্মা মোহান্তজী কথাটা লিখেছিল। সেই থেকে মোহান্তজীর ওপর চোখ রেখেছিলুম। আমার সঙ্গে তো ওঁর বহুদিনের আলাপ। যাই হোক, আপনারা চলে গেলেন মোহান্তজীর তাড়া খেয়ে, তার একটু পরে দেখি, মোহান্তজী ওঁর চ্যালা দুটোকে কী বলছেন। বলার পর ভোলা নামে চ্যালাটা একটা খুরপি নিয়ে বেরিয়ে গেল মন্দিরের পেছন দিকে। ভোলাকে ফলো করলুম। ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকে টিলার ঢালে একটা মস্তবড় কালোপাথর আছে। সেখানে ভোলা খোঁড়াখুঁড়ি করে কী একটা জিনিস বের করল। তারপর সেটা লাল একটা কাপড়ে বাঁধছে, এমন সময় দেখি আপনি টিলার নিচে লাফালাফি করছেন। তখন তো চিনি না আপনাকে। তাই

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ–পরীক্ষা করছিলুম বালিতে দৌঁডুলে কতটা পা দেবে যায়।

আমি ভেবেছিলুম পাগলটাগল হবে। অরুণেন্দু হাসল।তো আপনাকে দেখতে পেয়েই ভোলা পালিয়ে গেল। ওকে ফলো করে আবার মন্দিরে চলে এলুম। আড়াল থেকে দেখলুম, মোহান্তজী ভোলাকে আবার কী নির্দেশ দিচ্ছে। এবার ভোলা আর রামু দুজনেই বেরুল মন্দিরের পেছন দিয়ে। ভোলার হাতে লাল কাপড়ে বাঁধা সেই জিনিসটা। ওদের ফলো করে দেড় মাইল এলাকায় এলুম। কিন্তু এখানে এসে ওদের হারিয়ে ফললুম। ঝোপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে অনেক খুঁজলুম ওদের। কিছুক্ষণ পরে দেখি, দুজনে জলকাদা মেখে ভূত হয়ে বেরুচ্ছে এই ঢিবির কাছ থেকে। ওরা চলে যাওয়ার পর খুব খোঁজাখুঁজি করেও জিনিসটা কোথায় পুঁতে রেখে গেল বুঝতে পারি নি। বাড়ি ফিরলুম তখন প্রায় বারোটা বাজে। স্নান-খাওয়া সেরে আমার মামাতো বোন মঞ্জুশ্রীকে বললুম– ব্যাপারটা। তারপর বললুম– তুমি যদি ঢিবির ওপর উঠে চারদিকে নজর রাখো, আমি আশেপাশে গর্তগুলো খুঁজে দেখব। মঞ্জুশ্রী ভীষণ ভীতু। ও যাবে না। শেষে বলল, দাঁড়াও, তাহলে ভাবনাকে ডেকে দিই। ও খুব সাহসী মেয়ে। একটু পরে ভাবনাকে ও ডেকে নিয়ে এল। ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হল। অরুণেন্দু একটু দম নিয়ে ফের বলল, আসার পথে এই হাল্কা বস্তাদুটো একটা বস্তি থেকে ভাড়া করে আনলুম। কারণ ভাবনা বলল, তুমি একদিকে আমি আরেক দিকে খোঁজখুঁজি করব। মাঝে-মাঝে ঢিবিতে উঠে গিয়ে লক্ষ রাখব। আমার এতে আপত্তি ছিল কিন্তু। দেখলে তো ভাবনা, যদি কর্নেলসায়েবদের বদলে মোহান্তজীর চ্যালারা এসে হাজির হতো, কী সাংঘাতিক বিপদে না পড়তুম।

— ভাবনা বলল, আমি ঝোপের আড়ালে ছিলুম। আমাকে দেখতে পেত না। আমি আড়াল থেকে ঢিল ছুঁড়ে ওদের ভয় পাইয়ে দিতুম দেখতে। ওদের ভূতের ভয় কি আর নেই?

সে খিলখিল করে হেসে উঠল। মিঃ শর্মা এদিক ওদিক ঘুরে কী দেখছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, আরে। এটাই তো দেখছি পিট নম্বর ৩৪৭। ওই তো ঢিবির তলায় কাঠের ফলকে লেখা আছে।

ফলকের ওপর ঘাস হাত বাড়িয়ে আছে। তবু পড়া যায়। অরুণেন্দু বলল, ফলকটা চোখে পড়েনি আমার। তবে অনুমান করেছিলুম এটাই ৩৪৭ নম্বর পিট।

কর্নেল গর্তটা ঘুরে ঢিবির নিচে ফলকটার কাছে গেলেন। তারপর জায়গাটা পরীক্ষা করে বললেন, কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে সিল করা ছিল বটে কিন্তু স্ল্যাবটা উপড়েছিল মনে হচ্ছে। মিঃ শর্মা, আসুন তো। খন্তা দিয়ে স্ল্যাবটা ওপড়ানো যায় নাকি দেখি। ওপরের দিকটায় সূক্ষ্ম ফাটল দেখতে পাচ্ছি।

কনস্টেবল দুজন রাইফেল রেখে এগিয়ে গেল মিঃ শর্মার নির্দেশে। দুজনে খস্তাদুটো দিয়ে চাড় দিতেই বিরাট কংক্রিটের চাবড়া সরে কাত হয়ে পড়ল। ভেতড়ে সুড়ঙ্গের মতো প্রকাণ্ড হ। কর্নেল কিটব্যাগ থেকে টর্চ বের করে ঝুঁকে গেলেন সুড়ঙ্গের ভেতরে। তারপর টর্চ জ্বেলে বললেন, হু লালকাপড় বাঁধা জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি। আরও একটা কী দেখা যাচ্ছে যেন।

কর্নেল গুঁড়ি মেরে ভেতরে ঢুকে গেলেন। একটু পরে সুড়ঙ্গের মুখে ফিরে এসে বললেন, মিঃ শর্মা। ধরুন।

প্রথমে লালকাপড়ে বাঁধা জিনিসটা, তারপর একটা ব্রিফকেস–পুরনো, ইষৎ তোবড়ানো।

কর্নেল বেরিয়ে এলেন। লালকাপড়ের গিঁট খুললে বেরিয়ে পড়ল কাদামাখা একটা কালো চৌকো পাথর–অত্যন্ত হাল্কা ওজন। আন্দাজ আটইঞ্চি চওড়া এবং চার ইঞ্চি মতো পুরু। পার্বতীমন্দিরের চুরি যাওয়া সেই উল্কাপাথরের বেদীটাই বটে।

ব্রিফকেসটা অনেক চেষ্টায় খোলা হল। তার ভেতর প্যাকেট করা একগাদা কাগজ–দুর্বোধ্য সব আঁকজোক, নকশা, অঙ্ক, জ্যামিতি। একটা মোড়ক থেকে বেরুলো কয়েক টুকরো কালো অসম্ভব হাল্কা চাকতির মতো জিনিস। অরুণেন্দু ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিল উত্তেজনায়। বলল, এসব কী?

কর্নেল বললেন, দীপ্তেন্দু মিত্রের ব্রিফকেস। সম্ভবত তার আবিষ্কৃত সেই আশ্চর্য মিশ্র ধাতুর ফর্মুলা আর নমুনা আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। এই ব্রিফকেসটা চুরি গিয়েছিল তার ল্যাবরেটরি থেকে।

মিঃ শর্মা বললেন, আর এখানে নয়। এখনই মোহান্তজীকে গ্রেফতার করতে হবে।…

.

০৭.

পরদিন সকালে পুলিশ ইন্সপেক্টর শর্মাজী এলেন সেচবাংলোয়। কর্নেল তখন ছিপ আর প্রজাপতি ধরা জাল নিয়ে বেরোবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। বললেন, কী মিঃ শর্মা? আসামী কবুল করল কিছু।

শৰ্মাজী বললেন, মোহান্তজী ভীষণ ধূর্ত লোক। পেট থেকে কথা আদায় করা গেল না। তার ওপর প্রভাবশালী মহল থেকে ভীষণ চাপ শুরু হয়েছে। ওঁকে ছেড়ে দিতে হবে বলে চাপ দেওয়া হচ্ছে।

ভোলা আর রামুকে পাওয়া যায়নি এখনও?

নাঃ। বেমালুম গা ঢেকে দিয়েছে। শৰ্মাজী হতাশভঙ্গিতে বললেন, তবে মোহান্তজীর পেছনের লোকটি কে, সেটা যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে, ততক্ষণ কালোপাথর ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। বেদীর পাথরটা আর বিজ্ঞানী দীপ্তেন্দু। মিত্রের উদ্ভাবিত মিশ্র ধাতু–যার কোড নেম দিয়েছিলেন ব্ল্যাকস্টোন–উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটা বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল একটু হাসলেন। বোঝা গেছে খানিকটা। কাল রাত্রে দীপ্তেন্দুবাবুর ব্রিফকেসের গবেষণাপত্র ওল্টাচ্ছিলুম। আমি বিজ্ঞানী নই ঠিকই, কিন্তু প্রাথমিক কতকগুলো ব্যাপার আমার জানা আছে। পল্লবগ্রাহিতা বলতে পারেন।

বিলক্ষণ জানি। আপনি সর্বশাস্ত্রবিদ, পণ্ডিত মানুষ!

কর্নেল হো হো করে হেসে ফেললেন। দেখুন মিঃ শর্মা। পণ্ডিত এবং শিং ওয়ালা প্রাণীর কাছ থেকে আমি সব সময় একশো হাত দূরে থাকি। যাইহোক, দীপ্তেন্দুবাবুর নোটগুলোতে দেখছিলুম, একখানে মন্তব্য লেখা আছে : এক ধরনের কালো উল্কাপাথর পাওয়া গেছে বহু জায়গায়। বারাহিয়ার পার্বতীমন্দিরের ভেতর একটা বেদী আছে। সেটাও ওই শ্রেণীর পাথর। এ আসলে পাথরই নয়। একজাতের। মিশ্র ধাতু। খুব হাল্কা এবং শক্তিশালী।.কর্নেল উঠে গিয়ে ব্রিফকেসটা নিয়ে এলেন। এটা আর কাছে রাখা নিরাপদ নয়। আমার পরীক্ষা শেষ। আপনি নিয়ে যান এবার। তাছাড়া এটা কোর্ট এভিডেন্স।

শৰ্মাজী ব্রিফকেসটা নিয়ে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার হল না কর্নেল!

বেদীর পাথরটা দেখেই দীপ্তেন্দু মৈত্র ওইরকম ধাতু কৃত্রিম উপায়ে তৈরির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এটুকু অনুমান করতে পেরেছি। এবার বুঝতে আশা করি অসুবিধে হবে না মিঃ শর্মা, যিনি দীপ্তেন্দুবাবুর এই ব্রিফকেস চুরি, তাকে হত্যা এবং পরে অনুরাধাকে হত্যা–এতসব কাণ্ড করিয়েছেন, তাঁরই ওই বেদীটা হাতানোর চেষ্টা করা স্বাভাবিক। মোহান্তজীর পেছনের যে লোকটির কথা আপনি বলছিলেন, তিনি মূল অপরাধী। মেহান্তজী টাকার লোভে চেলাদের সাহায্যে তাঁরই হুকুম তামিল করেছেন।

মোহান্তজীকে কবুল করানো প্রায় অসম্ভব কর্নেল।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে দীপ্তেন্দু যেভাবে হোক, টের পেয়েছিল তার ব্রিফকেস চুরি করে ডেড মাইনের ৩৪৭ নং পিটে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। হা–মোহান্তজীই লুকিয়ে রেখেছিলেন ভোলা ও রামুর সাহায্যে। নিশ্চয় দরাদরি চলছিল। তাই ওই ব্যবস্থা।

বেশি টাকা চেয়েছিলেন হয়তো।

তাই মনে হচ্ছে। তবে একজায়গায় ব্রিফকেস, অন্য জায়গায় বেদীর পাথর লুকিয়ে রাখার অতিরিক্ত সতর্কতা। দীপ্তেন্দুবাবু রাত্রে পিট নং ৩৪৭-এ ব্রিফকেস উদ্ধার করতে গিয়ে খুন হলেন। তার আগে ব্যাপারটা তার প্রেমিকা অনুরাধাকে বলে থাকবেন। তা না হলে অনুরাধা জানবে কেমন করে?

ঠিক, ঠিক। শৰ্মাজী বললেন। এ-ও বোঝা যাচ্ছে আপনি মোহান্তজীকে কাল সকালে কালোপাথরের কথা বলার পর উনি ভয় পেয়েছিলেন তাই ওটা ফুলঝরিয়ার টিলা থেকে সরিয়ে পিট নং ৩৪৭-এ লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন। এ পর্যন্ত সব স্বচ্ছ।

এই সময় একজন পুলিশ অফিসার সঙ্গে কনস্টেবল সহ হন্তদন্ত হাজির হলেন। শৰ্মাজী বললেন, কী ব্যাপার মিঃ সিং?

সাব ইন্সপেক্টর সুরেশ সিং বললেন, স্যার! ভোলা আর রামুর ডেড বডি পাওয়া গেছে রেল লাইনের ধারে। গুলি করে মারা হয়েছে দুজনকে। দুজনেরই মাথার পেছনে দিকে গুলি লেগেছিল।

শৰ্মাজী লাফিয়ে উঠলেন। কী সাংঘাতিক কাণ্ড!

কর্নেল বললেন, লোকটা এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে, মিঃ শর্মা! ভোলা আর রামুর মুখ চিরকালের মতো বন্ধ করে দিয়েছে।

কিন্তু কে সে?

এখন জানি না আমরা। শুধু এটুকু জানি, দীপ্তেন্দুর উদ্ভাবিত মিশ্ৰধাতুর ফর্মুলা আর কালো বেদীটা সে হাতাতে চেয়েছিল। ভেবে দেখুন মিঃ শৰ্মা, এ দুটো জিনিস যে-কোনও ধনী দেশকে বিক্রি করতে পারলে কোটিপতি হয়ে যেত।

মোহন্তজীকে কবুল করাতেই হবে তাতে আমার ভাগ্যে যা ঘটে ঘটুক। বলে শর্মজী সদলবলে বেরিয়ে গেলেন বাংলো থেকে। ওঁদের জিপ দুটো সবেগে নেমে গেল উতরাইয়ের রাস্তায়।…

সন্ধ্যায় ডঃ রায় তার কোয়ার্টারের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে। একটু পরে সুমন এসে গেল। তারপর এল ভাবনা। আড্ডা জমে উঠল। অরুণেন্দু নেই। ওর টো টো করে ঘোরা স্বভাব। মঞ্জুশ্রী পরিহাস করে বলল, অরুদা ভূত খুঁজতে গেছে। ভূত সঙ্গে নিয়ে তবে ফিরবে দেখে নিও।

গেটের কাছে লম্বা চওড়া একটা মূর্তি ভেসে উঠল আবছা আলোয়। ডঃ রায় বললেন, কে ওখানে? গম্ভীর গলায় সাড়া এল–আসতে পারি ডঃ রায়?

আরে! কর্নেল সাহেব! আসুন, আসুন! ডঃ রায় উঠে গিয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন কর্নেলকে।

কর্নেলকে দেখে ভাবনা মুখ টিপে হেসে বলল, আজ মাছ ধরতে যাননি কর্নেল?

গিয়েছিলুম। আজ দুটো মাছ ধরেছি। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। ইয়ে–একটা প্রয়োজনে এলুম ডঃ রায়। সকালে আপনার ঘরে টাইপরাইটার দেখেছিলুম। একটা জরুরী চিঠি টাইপ করা দরকার। প্লিজ যদি

ডঃ রায় বললেন, স্বচ্ছন্দে! আসুন, ভেতরে আসুন।

ডাইনিং-কাম-ড্রয়িংরুমের একপাশে টেবিলের উপর ছোট্ট টাইপরাইটার। কর্নেল চিঠি টাইপ করতে বসলেন। ডঃ রায় বললেন, আপনি কাজ সেরে নিন। আমরা বাইরে আড্ডা দিই।

কিছুক্ষণ পরে চিঠি টাইপ করে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। ততক্ষণে পটভর্তি কফি আর স্ন্যাক্স এসে গেছে। মীনাক্ষীদেবী সবাইকে কফি পরিবেশন করলেন। কর্নেল বললেন, অরুণেন্দুবাবুকে দেখছি না!

মঞ্জুশ্রী হেসে উঠল। অরুদা ভূত ধরে আনতে গেছে। এখনই এসে পড়বে দেখবেন।

কথায় কথায় মোহান্তজীকে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ এল। তারপর দীপ্তেন্দুর ফর্মুলার কথা। ডঃ রায় বললেন, দীপ্তেন্দু গোপনে কী একটা রিসার্চ করছে, আভাস পেয়েছিলাম। কিন্তু খুলে কিছু বলেনি। ওর প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি বহুবার। আমাকে যদি ব্যাপারটা বলত, গভমেন্ট থেকে ওর সেফটির ব্যবস্থা করতে পারতুম। বোকামি করে নিজের প্রাণটা খোয়ালো।

মীনাক্ষী বললেন, আর একটা প্রাণও গেল বোকামি করে। অরু কেন চেপে রেখেছিল, বুঝতে পারি না। তোমাকে জানিয়ে দিলেও তো পারত!

সুমন বলল, প্রেতশক্তিতে বিশ্বাস করতুম না। কিন্তু এখন করি। আমার ধারণা, অনুরাধা জানত, না কিছু। দীপ্তেন্দুর আত্মাই ওর হাত দিয়ে

মঞ্জুশ্রী বাধা দিয়ে বলল, শাট আপ! আবার আত্মা-টাত্মা আনা হচ্ছে? আবার কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যাবে, দেখবে।

এইসব আলোচনা হতে হতে অরুণেন্দু এসে গেল। কর্নেলকে দেখে সে বলল, আরে আপনি! কতক্ষণ?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, অরণেন্দুবাবু মঞ্জুশ্রীর যদি আপত্তি হবে, আমি কিন্তু সিয়াসের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহী। আজ রাতে যদিও আকাশ পরিষ্কার! তবুও তিথিটা অমাবস্যার।

সুমন বলল, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! শুরু হোক তাহলে।

ডঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন, আজ আমিও আসরে যোগ দিতে রাজি।

মঞ্জুশ্রী বলল, বাবা যদি পার্টিসিপেট করেন, আমার আপত্তি নেই।

অরুণেন্দু কঁচুমাচু মুখে বলল, কিন্তু মিডিয়াম কে হবে; তেমন কাউকে তো দেখছি না।

ভাবনা বলল, আমি হবো।

তুমি–

ভাবনা জোর দিয়ে বলল, দেখ না বাবা মিডিয়ামের উপযুক্ত কি না আমি। পরীক্ষা করে দেখতে দোষ কী? না হলে মঞ্জু তো আছেই।

মঞ্জুশ্রী আপত্তি করে বলল, আমি ওসবে নেই।

অরুণেন্দু একটু ভেবে বলল, ঠিক আছে। দেখা যাক।

সেদিনকার মতো ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল সবাই। দরজা জানালা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে মোম জ্বালানো হল। ভাবনা বসল একদিকে, অন্যদিকে অরুণেন্দু, কর্নেল, ডঃ রায় মঞ্জুশ্রী, মীনাক্ষী ও সুমন।

অরুণেন্দু তার অভ্যাসমতো বক্তৃতা দিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে কলম ও কাগজ দিল ভাবনাকে। তারপর বলল, আজকের আসরে আমরা গান্ধীজীর আত্মাকে চাইব। রেডি!

সে টেবিলে সংকেত করলে সবাই চুপচাপ গান্ধিজীর সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকলেন। মিনিট দুয়েক পরে ভাবনার কলম কেঁপে উঠল। অরুণেন্দু আলতোভাবে কাগজটা টেনে নিয়ে লিখল, আপনি কি গান্ধীজী?

এরপর সে রাতের মতো প্রশ্ন ও জবাব যা লেখা হল, তা এই :

আমি অনুরাধা।

তোমাকে ডাকিনি। তুমি যাও।

আমার বলার আছে।

কী?

কালো পাথর।

আবার এসব কী?

মোহান্তজী।

অরুণেন্দু মুখার্জী।

আমার নাম লিখছ কেন?

অনুরাধা, তামাশা কোরো না।

অরুণেন্দু মুখার্জী।

অরুণেন্দু কাগজটা নিয়ে খাপ্পা হয়ে বলল, নিকুচি করেছে! বললুম– ভাবনাকে দিয়ে হবে না। ভাবনা দুষ্টুমি করছে। সে কাগজটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল রাগ করে। কর্নেল তার হাত থেকে ওটা টেনে নিলেন। সবাই হেসে উঠল। অরুণেন্দু উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দিল।

সেই সময় ভাবনা হঠাৎ টেবিলের ওপর মাথা খুঁজে পড়ে গেল–অনুরাধার যেমনটি হয়েছিল। অবাক হয়ে মীনাক্ষী বললেন, ও কী! অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি ভাবনা? মঞ্জু, শীগগির জল নিয়ে আয়!

জল আনবার আগেই ভাবনা মাথা তুলে একটু হাসল। আস্তে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠেছিল যেন।

অরুণেন্দু বিস্মিত দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি বলছ?

সত্যি!

কিন্তু

কিন্তু কি?

তাহলে আমার নাম বারবার লেখার মানে কি? অরুণেন্দু ক্রুদ্ধস্বরে বলল।

আমি তো জানি না, কী লিখেছি!

অরুণেন্দু গুম হয়ে ভেতরে চলে গেল। মঞ্জুশ্রী হাসতে হাসতে বলল, অরুদা খুব চটে গেছে। কর্নেল, কাগজে কী লেখা হয়েছে, পড়ুন না আমরা শুনি?

কর্নেল প্রশ্নোত্তর গুলো পড়লেন। খুব হাসাহাসি পড়ে গেল। ডঃ রায় বললেন, অরুর চটে যাওয়ার কারণ আছে। ভাবনা তুমি নিশ্চয় দুষ্টুমি করছিলে।

ভাবনা সিরিয়াস হয়ে বলল, না মেসোমশাই! সত্যি বলছি, আমি জানি না কী লিখেছি। আমার হাত দিয়ে আপনা আপনি লেখা হয়ে গেছে।

সুমন বলল, যদি সত্যি অনুরাধার আত্মা এসে থাকে, তাহলে একটা ব্যাখ্যা দওয়া যায়।

মীনাক্ষী বললেন, কী ব্যাখ্যা?

অরুণেন্দু মোহান্তজীর চেলা। মোহান্তজীর নামের সঙ্গে তাই ওর নামটাও এসে যায়। অরুণেন্দু আর একটু ধৈর্য ধরলে পারতো। তারপর কী লেখা হচ্ছে বোঝা যেত কোথায় গড়াচ্ছে ব্যাপারটা।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এবার ওঠা যাক, ডঃ রায়। প্রায় নটা বাজে।

ভাবনাও উঠল। মীনাক্ষী বললেন, একটু দাঁড়াও, ভাবনা। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে সুশীলা।

ভাবনা বলল, থাক! আমি একা যেতে পারব।

কর্নেল বললেন, বরং আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি, ভাবনা।

বেশ তো! ভাবনা পা বাড়াল।

কর্নেল দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, একটা কথা, ডঃ রায়! আপনার কি রিভলভার আছে?

ডঃ রায় চমকে গেলেন। কেন বলুন তো?

এমনি জানতে টাইছি।

ডঃ রায় বললেন, আছে। লাইসেন্সড আর্ম। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় গুণ্ডা ডাকাতদের খুব প্রতাপ। তাই রাখতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একথা জানতে চাইছেন কেন?

প্লিজ! অন্যভাবে নেবেন না। কর্নেল দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে বললেন। যদি কিছু মনে করেন, অস্ত্রটা একটু দেখতে চাই। দেখার অধিকার আইনত আমার নেই। তবু জাস্ট এ রিকোয়েস্ট।

ডঃ রায় অবাক হয়ে দ্রুত ভেতরে গেলেন। মীনাক্ষী, মঞ্জুশ্রী সুমন উদ্বিগ্নমুখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একটু পরেই ডাঃ রায় হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। স্ত্রীকে বললেন, মিনু রিভলভারটা অন্য কোথাও রেখেছ নাকি? আমার ড্রয়ারে তো নেই ওটা। আলমারির লকারেও নেই।

মীনাক্ষী উদ্বিগ্নমুখে বললেন, সে কী! আমি তো কোথাও রাখিনি।

এস তো, ভাল করে খুঁজে দেখি। আশ্চর্য! ওটা যাবে কোথায়?

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে! চলি ডঃ রায়। আমার ধারণা, আপনার রিভলভারটা চুরি গেছে। আপনি এখনই পুলিশে ফোন করে জানান।

বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। রাস্তায় পৌঁছে মৃদুস্বরে বললেন, ভাবনা, ওদিকে নয়। এদিকে এস।

ভাবনার মুখে হাসি ঝিলিক দিচ্ছিল। বলল, ওদিকে কেন? আমাদের বাড়ি তো উল্টোদিকে।

ওই গাছের পেছনে পুলিসের গাড়ি আছে। ওরা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

ভাবনা বলল, এক সাহস হবে না করুর, আমি অনুরাধার মতো বোকা নই।

বোকা বুদ্ধিমানের ব্যাপার নয়, ডার্লিং! আজ সকাল থেকে অনুরাধার খুনীর হাতে একটা রিভলভার এসে গেছে। মরিয়া হয়েই এবার সে রিভলভার জোগাড় করেছে। ভোলা ও রামু তোরবেলা পুলিশের ভয়ে ট্রেনে চেপে কোথাও পালাবে। ভেবেছিল। সে ওদের গুলি করে মেরেছে।

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টার মিঃ সিং কর্নেলকে নমস্কার করলেন। কর্নেল ভাবনাকে বললেন, যাও ডার্লিং! মিঃ সিং তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। সাবধানে থেক কিন্তু!

.

০৮.

বাংলোয় ফিরে কর্নেল ডিনারে বসেছেন, ডঃ কুসুমবিহারী রায় হন্তদন্ত এসে পৌঁছুলেন। মুখে স্বস্তির হাসি। বললেন, কি ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলুম বলার নয়। আসলে হয়েছিল কী, রিভলভারটা সবদিন সঙ্গে নিয়ে ঘুরি না। আমার টেবিলের ড্রয়ারেই থাকে। পরশুদিন অফিস থেকে ফিরে ওটা অন্যমনস্কভাবে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলুম। আমার গিন্নি সেটা কখন তুলে আমার কোটের পকেটে রেখে দিয়েছিলেন। আর বলবেন না! ওঁর যা ভুলো মন!

কোটের পকেটে পাওয়া গেছে তাহলে?

হ্যাঁ, কোট তো সবদিন পরি না। হ্যাঁঙ্গারে ভোলা থাকে। গিন্নি

ঠিক আছে। পাওয়া গেছে যখন, আর কথা কী?

ডঃ রায় একটু ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু হঠাৎ আপনি আবার রিভলভার চুরি যাওয়ার কথা ভাবলেন কেন, প্লিজ যদি সেটা বলেন ধাঁধা কেটে যায়?

কর্নেল একটু হাসলেন। আচ্ছা ডঃ রায়, আপনার রিভলভারে গুলি পোরা ছিল কি?

গুলি বের করে ড্রয়ারে রাখি। তবে পরশু গুলি বের করে রাখতেও ভুলে গিয়েছিলুম।

আশা করি গুলিভরা রিভলভারই পেয়েছেন কোটের পকেটে!

ডঃ রায় ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ।

আপনার রিভলভারটা কত ক্যালিবারের?

পয়েন্ট থার্টি এইট। কোল্ট।

পরপর ছটা গুলি ছোঁড়া যায় তাহলে?

হ্যাঁ।

ছটা গুলিই পেয়েছেন?

ডঃ রায় ঠোঁট ফাঁক করে রইলেন এবার। কর্নেলের খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়েছে। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে সামনে দাঁড়ালেন ডঃ রায়ের। ডঃ রায় ওঁর দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট বের করে আস্তে বললেন, দুটো গুলি নেই চেম্বারে।

কর্নেল বললেন, অরুণেন্দু কোথায় এখন, ডঃ রায়?

ডঃ রায় ফেটে পড়লেন এবার। ওই শুওরের বাচ্চার মতলব আমি আঁচ করেছিলুম ইদানিং ঘন-ঘন আসা এবং মোহান্তজীর আড্ডায় যাওয়া দেখে। ওঃ! শেষে আমাকেও ফাঁসিয়ে ছাড়ল! কর্নেল! বিশ্বাস করুন–আমি ভাবতেও পারিনে যে ও এতদূর এগোবে!

অরুণেন্দু কি এখনও আছে আপনারা কোয়ার্টারে?

না। তখনই কেটে পড়েছে। ওকে সামনে পেলে তো গুলি করে মারতুম।

উত্তেজিত হয়ে আর লাভ নেই, উঃ রায়! কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট বের করলেন। লাইটার জ্বেলে প্রথমে ডঃ রায়ের সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে নিজের চুরুট ধরালেন। কাল ডেড মাইন এলাকায় ৩৪৭ নং পিটের কাছে অরুণেন্দু যখন গর্তে জলকাদার ভেতর খন্তা চালাচ্ছিল, গর্তের ধারে নরম মাটিতে ওর জুতোর স্পষ্ট ছাপ পড়েছিল। ফুলঝরিয়া লেকের টিলার নিচে বালির ওপর যে জুতোর ছাপ দেখেছিলুম, তার সঙ্গে হুবহু এক। এ বয়সেও আমার স্মৃতি প্রখর, ডঃ রায়। জুতোর ছাপের মিলটা না দেখা পর্যন্ত আমার অরুণেন্দুকে সন্দেহ হয়নি, তা নয়। মোহান্তজীর সঙ্গে ওঠাবাসা করে জানার পর থেকে সন্দেহ অবশ্যই হয়েছিল। তবে জুতোর ছাপ দেখে নিঃসংশয় হয়ে বুঝলুম কে অনুরাধার খুনী।

একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কর্নেল ফের বললেন, কাল বিকেলে আমরা না গিয়ে পৌঁছলে ভাবনার দশাও অনুরাধার মতো হতো। অরুণেন্দু জানত মঞ্জুশ্রীকে তার সঙ্গে ডেড মাইন এলাকায় যেতে বললেও সে যাবে না। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল ভাবনাকে ডেকে পাঠানো মঞ্জুশ্রীর মারফত। ভাবনাকে খুন করাটা ভোলা ও রামুর ওপর চাপানো সহজ ছিল।

ডঃ রায় বললেন, ভাবনাকে খুন করার উদ্দেশ্য কী?

ভাবনা তার বন্ধুর মৃত্যুতে আঘাত পেয়ে বড্ড বেশি নাক গলাতে শুরু করেছিল। আমার কাছে তার যাতায়াত, আমাকে সঙ্গে নিয়ে মোহান্তজীর কাছে যাওয়া–সবই সে লক্ষ করে থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা, অরুণেন্দুর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, অনুরাধা ভাবনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অতএব যা জানে, তা ভাবনারও জানার কথা। তাই ভাবনাকে খুন করার জন্য একটা মিথ্যা গল্প ফেঁদেছিল। ফুলঝরিয়া লেকের টিলা থেকে ভোলা বেদীর পাথর আনতে যায়নি–আসলে অরুণেন্দুই ওটা চুরি করে ওখানে পুঁতে রেখে এসেছিল। বেগতিক দেখে সরিয়ে এনে পিট নং ৩৪৭-এ ঢুকিয়ে রেখেছিল। তার চোখের সামনে পিট নং ৩৪৭ এর ফলক। অথচ সে ন্যাকা সেজে খোঁড়াখুঁড়ির ভান করছিল। ভাগ্যিস, ভাবনা অন্য জায়গা খুঁড়তে গিয়েছিল এবং দৈবাৎ আমরা গিয়ে পড়লাম ওখানে।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ভোলা ও রামুর মুখ বন্ধ করতে আপনার রিভলভার চুরি করেছিল অরুণেন্দু। তাদের সঙ্গে তার এঁটে ওঠা অসম্ভব। কিন্তু রিভলভার পেলে আর চিন্তা থাকে না।

কিন্তু ওদের মুখ বন্ধ করার দরকার হল কেন?

বেদীটা ওদের সাহায্যেই চুরি করেছিল বলে। ওরা পুলিশের জেরার চোটে কবুল করত। সেই ভয়ে সম্ভবত ওদের পালাতে পরামর্শ দিয়েছিল এবং ট্রেনে চাপিয়ে দেবার ছুতো করে এসে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরেছিল। খাটালের একজন লোক দেখেছে অরুণেন্দু, ভোলা ও রামু একসঙ্গে রেললাইনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। পুলিশকে বলেছে সেই লোকটা।

মোহান্তজী কিছু জানতেন না?

জানলেও অক্ষম স্থবির মানুষ। ভোলা ও রামুর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।

ডঃ রায় শ্বাস ছেড়ে বললেন, একটা কথা বুঝতে পারছি না। সুদীপ্ত খুন হবার সময় অরুণেন্দু এখানে ছিল। ওই সময় বেদীটাও চুরি যায়। বুঝতে পারছি, তার আগে সুদীপ্তের ফর্মুলাও সে হাতিয়ে নিয়েছে–

এবং ৩২৭ নং পিটে লুকিয়ে রেখেছে।

হ্যাঁ। কিন্তু ওগুলো নিয়ে চলে যায়নি কেন? কেন ও এতদিন অপেক্ষা করছিল। কলকাতা ফিরে গিয়েছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এল আবার ২৪ অক্টোবর বিকেলে।

কর্নেল হাসলেন। খদ্দের ঠিক করতে গিয়েছি। তাছাড়া আর কোনও কারণ থাকতে পারে না। কোনও বিদেশী রাষ্ট্রের এজেন্ট ঠিক করে সে আবার এসেছিল। যাই হোক, এজেন্ট ভদ্রলোক বেগতিক দেখে আজ বিকেলের ট্রেনে কেটে পড়েছেন।

ডঃ রায় চমকে উঠলেন। বলেন কি? পুলিশ তাকে গ্রেফতার করল না কেন?

প্রমাণ করা যাবে না কিছু। কর্নেল জোরালো হেসে বললেন। আমার পাশের ঘরেই ছিলেন ভদ্রলোক।

বিদেশী?

মোটেও না এসব ক্ষেত্রে অত বোকামি করা হয় না।

আলাপ হয়েছিল আপনার সঙ্গে?

না। আলাপের সুযোগ পেলুম কই?

আবার গাড়ির গরগর শব্দ হল বাইরে। তারপর পুলিশ ইন্সপেক্টর মোহন শর্মা এলেন হাসিমুখে। ডঃ রায়কে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দেবার আগেই শৰ্মাজী বললেন, ডঃ রায়কে আমি চিনি। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ডঃ রায়ের ভাগ্নে অরুণেন্দুকে একটু আগে আমরা রেলস্টেশনে গ্রেফতার করেছি।

ডঃ রায় গম্ভীর মুখে বললেন, আমার কোনও দুঃখ নেই। ওর শাস্তি হোক।

কর্নেল পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, এই নিন মিঃ শর্মা! টাইপ করা চার ছত্র কবিতা আছে এতে। আমি নিজে টাইপ করেছি। তবে টাইপরাইটার ডঃ রায়ের। এবার অনুরাধাকে যে টাইপ করা চিঠি লিখে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল, তার টাইপ কেসের সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন। দুটো একই টাইপরাইটারে টাইপ করা। অরুণেন্দু আমার টাইপরাইটারটাই ব্যবহার করেছিল।

ডঃ রায় রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে বললেন, শুওরের বাচ্চা! ওর ফাঁসি হোক।

শর্মাজী হাসতে হাসতে বললেন, সে কী ডঃ রায়! নিজের ভাগ্নেকে শুওরের বাচ্চা বলছেন?

ডঃ রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কে নিজের ভাগ্নে? কোনও রক্তের সম্পর্ক আছে ভাবছেন নাকি? কলকাতায় আমার দিদির পাড়ায় থাকে। তাকে মাসি বলে সেই পাতানোর সম্পর্কে আমাকে মামা বলেছে। দিদির বয়স হয়েছে। একা মানুষ। ওই হতচ্ছাড়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল একবার। সেই থেকে আমি ওর মামা হয়ে গেলুম। মামা!

ডঃ রায় রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন।

শৰ্মাজী বললেন, কাল আপনার প্রোগ্রাম কী, কর্নেল?

ফুলঝরিয়া লেকে ছিপ ফেলা এবং বাগে পেলে দুটো অন্তত প্রজাপতি ধরা। বলে কর্নেল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

শৰ্মাজী বেরিয়ে বললেন, খামোকা বুড়ো-মানুষ মোহান্তজীকে টানাটানি করা হল। পরিণামে হয়তো বরাতে বদলি আছে। ওঁর মুরুব্বিরা প্রভাবশালী। তবে বারাহিয়া আর আমার সহ্য হচ্ছে না, কর্নেল! বদলিটা প্রয়োজন বলেই মনে করব। এমন হুজ্জুতে জায়গা আর কোথাও দেখিনি।

কর্নেল বললেন, আমার অবশ্য বারাহিয়াকে ভালই লাগে।

পুলিশ হলে ভাল লাগত না। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, সেজন্যই পুলিশ হইনি। মিলিটারিতে ঢুকেছিলুম।

খোকন গেছে মাছ ধরতে

সেদিন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমাকে দেখেই বলে উঠলেন–জয়ন্ত কখনওকি ছিপে মাছ ধরেছ?

সবে ওঁর ইলিয়ট রোডের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমের ভেতর পা বাড়িয়েছি, বেমক্কা এই প্রশ্ন। অবশ্য ওঁর নানারকম অদ্ভুত-অদ্ভুত বাতিক আছে জানি, কিন্তু ওঁর মতো ছটফটে মানুষ ছিপ হাতে ফাতনার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে বসে থাকবেন–এটা বিশ্বাস করা কঠিন। যাই হোক্ ধীরে সুস্থে বসার পর বললুম–আজ কি তাহলে কোথাও ছিপ ফেলার আয়োজন করেছেন কর্নেল?

কর্নেল হাসতে হাসতে ছড়া বলে উঠলেন :

খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…

অবাক হয়ে বললুম–আপনি এ ছড়া কোথায় শিখলেন? আপনি তো বাংলা পাঠশালায় পড়েননি।

কর্নেল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বললেন–ছড়াটা কিন্তু ব্রিলিয়ান্ট! অপূর্ব! ভাবা যায় না! বেচারা খোকন বড় সাধে মাছ ধরতে বসেছে। এদিকে কি না দুষ্ট কোলাব্যাংটা তার ছিপখানাই নিয়ে পালাল? ওদিকে কোত্থেকে এক ব্যাটা চিল এসে…ভাবা যায় না! ভাবা যায় না!

কর্নেল ছড়ায় বর্ণিত দৃশ্য যেন চোখ বুজে দেখতে দেখতে খুব মুগ্ধ হয়ে তারিফ করতে থাকলেন এবং সেই সঙ্গে ওঁর প্রাণখোলা হাসি। ওঁর পরিচারক ষষ্ঠীচরণ পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে থ।

কর্নেলের মধ্যে খোকাটেভাব আছে, বরাবর দেখেছি। কিন্তু আজ সকালে আমাকে জরুরি তলব দিয়ে ডেকে এনে নিতান্ত মাছ ধরার প্রোগ্রাম শোনাবেন ভাবিনি। আমি খবরের কাগজের রিপোর্টার এবং কর্নেল এক ধুরন্ধর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার-সোজা কথায় গোয়েন্দাও। আশা ছিল, গুরুতর একটা ক্রাইম স্টোরি পেয়ে যাব। দৈনিক সত্যসেবকের আগামীদিনের প্রথম পাতাটা পাঠকদের মাত করে ফেলবে! কিন্তু এ যে দেখছি, নিতান্ত মাছধরার বদখেয়াল নিয়ে উনি বসে আছেন! আমার মতো ব্যস্ত রিপোর্টারের একটা দিনের দাম খুব চড়া। আমি হতাশ হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলুম।

হঠাৎ কর্নেল কোণের দিকে ঘুরে বললেন–মিঃ রায়, আলাপ করিয়ে দিই। এই আমার সেই প্রিয়তম তরুণ বন্ধু জয়ন্তার কথা আপনাকে বলছিলুম।

এতক্ষণ কোণের দিকে তাকাইনি। এবার দেখি, খবরের কাগজের আড়ালে এক সুদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক উজ্জ্বল ফর্সা রঙ, পরনে নেভিরু আঁটো পাতলুন এবং গায়ে টকটকে লাল স্পোর্টিং গেঞ্জি, ঠোঁটে আটকানো পাইপ, মুখ বের করলেন। ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা গোঁফে কর্নেলের মতো একটা সামরিক জীবনের গন্ধ মেলে। উনি কাগজ ভাঁজ করে রেখে তখুনি আমাকে নমস্কার করলেন। আমিও।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, উনি মেজর ইন্দ্রনাথ রায়। আমার সামরিক জীবনের বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু। সম্প্রতি রিটায়ার করছেন। এঁর জীবন খুব রোমাঞ্চকর, জয়ন্ত। সিক্সটি-টুতে চীনারা নেফাবর্ডারে এঁকে ধরে নিয়ে যায়। জঘন্য অত্যাচার করে। তারপর…

ইন্দ্রনাথ হাত তুলে হাসতে হাসতে বললেন–এনা কর্নেল! আমি আপনার মতো যোদ্ধা ছিলুম নাসুযোগও পাইনি। তাই অত কিছু বলারও নেই।

কর্নেল আপত্তি গ্রাহ্য না করে বললেন–তাছাড়াও এঁর একটা অভিজাত সামাজিক পরিচয় আছে, জয়ন্ত। ইনি মহিমানগরের প্রখ্যাত রাজপরিবারের সন্তান। মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় এঁদের অনেকগুলো খনি ছিল। একটা বাদে সবই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে।

ইন্দ্রনাথ বললেন– ও একটা ডেড মাইন বলতে পারেন অবশ্য। ছেড়ে দিয়েছি আমরা।

কর্নেল প্রশ্ন করলেন–কিসের খনি যেন?

–সীসের। সাত বছর আগে ওটা পোড়া হয়ে গেছে। আর কিছু মেলেনি।

–খনিমুখগুলো তাহলে নিশ্চয় সিল করে দিয়েছেন?

না কর্নেল। সিল করার সুযোগ পাইনি। মানে….একটু ইতস্তত করে ইন্দ্রনাথ মৃদু হেসে ফের বললেন–আমার অবশ্য কোনওরকম কুসংস্কার নেই। আপনি তা ভালই জানেন। কিন্তু আমার কাকা জগদীপ রায় হঠাৎ রহস্যজনকভাবে মারা পড়েন–ওঁর ডেড বডি খনির একটা সুড়ঙ্গে পড়ে ছিল–তারপর কাকিমা জেদ ধরলেন, খনিমুখ যেমন আছে তেমনি পড়ে থাক–তোমরা কেউ ওখানে যাবে না। কারণ কাকা নাকি খনিমুখগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা ঠিক করতেই গিয়েছিলেন ওখানে। আর, আপনি তো জানেন, কাকিমাই আমাদের ফ্যামিলির একমাত্র গার্জেন– কাকার অবর্তমানে। আমাদের ছেলেবেলা থেকে উনিই মানুষ করেছেন। ওঁর কথা আমাদের দু-ভাইয়ের কাছে ঈশ্বরের আদেশ। তাই আমরা আর ওদিকে মাড়াইনি।

কর্নেল বললেন–আপনার কাকিমার কী ধারণা হয়েছিল বলতে পারেন?

ইন্দ্রনাথকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন–একটু খুলে না বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। কাকা ছিলেন খেয়ালি মানুষ। মাছ ধরার বাতিক ছিল প্রচণ্ড। সীসের খনিটা রয়েছে তিনদিকে তিনটে পাহাড়ের মধ্যিখানে, একটি উপত্যকায়। খনির পেছনে আছে একটা হ্রদ। আসলে ওটা একটা নদীর বাঁকের মুখে, ন্যাচারাল ওয়াটার ড্যাম। পরে মুখটা চড়া পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হ্রদটা খুব গম্ভীর হওয়ার জন্য জল কখনও মরে না। আমরা খনিটা ছেড়ে আসার পর নদীতে একবার প্রচণ্ড বন্যা হয়। তখন হ্রদেও জল ঢুকে পড়ে এবং সেই জল খনির মধ্যেও ঢুকে যায়। কিছু কিছু খনিমুখ এর ফলেই আপনা-আপনি ধস নেমে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল তিনটে খনিমুখ, একটু উঁচু জায়গায়। কাকা প্রতিবার অক্টোবরে ওখানে গিয়ে তার বাংলোয় কাটাতেন। বরাবরকার অভ্যাস। জায়গাটার সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, হ্রদে মাছ ধরার নেশা ছিল ওঁর। পাঁচবছর আগের অক্টোবরে কাকিমাকে নিয়ে উনি ওখানে যান। সেবারই খনিমুখ তিনটে বন্ধ করে আসার উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্গে একজন ইঞ্জিনিয়ারও নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর কী হলো, ফোরটিনথ অক্টোবর সারা বিকেল মাছ ধরার পর ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে বলেন–আপনি বাংলোয় চলুন, আমি একটু পরে যাচ্ছি। তারপর অনেক রাত হলো, কিন্তু ফিরলেন না। তখন খোঁজাখুজি পড়ে গেল। হ্রদে স্থানীয় কয়েকজন আদিবাসী জেলে রাতে মাছ ধরতে এসেছিল। তাদের সঙ্গে দেখা হলে জানাল সায়েবকে তারা খোলা খনিমুখের কাছে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালাতে দেখেছে। রাত তখন একটা। জেলেদের কথা শুনে…

কর্নেল বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-জেলেরা তো লেকে ছিল। কীভাবে জানল, উনিই আপনার কাকা?

ইন্দ্রনাথ বললেন নির্জন জায়গা। তাছাড়া ওখানে ভূত আছে বলে স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস। সব পোডড়া খনি কেন্দ্র করেই ভুতুড়ে গালগল্প গড়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। যাইহোক, এই জেলে তিনজন ছিল খুব সাহসী। বয়সে যুবক। টর্চের আলো দেখে ওরা পরস্পর তর্ক জুড়ে দেয় যে ওটা ভূত কিংবা ভূত নয়। তাছাড়া হ্রদটায় প্রচুর মাছ–অথচ ভূতের ভয়ে গরীব জেলেরা মাছ ধরতে ভয় পায়–পাছে ভূতের অভিশাপ লাগে। কিন্তু এই তিনটি সাহসী তরুণ আদিবাসী সে রাতে জেদ করেই এসেছিল। হারাতেই এসে এবং মাছ ধরে ওরা প্রমাণ করে দেবে যে ওখানে ভূতপ্রেত কিংবা অভিশাপ ব্যাপারটা মিথ্যে।

কর্নেল বললেন-তারপর?

–ওরা আলো লক্ষ্য করে ওখানে যায়। দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলে–কে ওখানে? তখন কাকার সাড়া পায়। কাকা ওদের সুপরিচিত। ফলে, ওরা কাছে না গিয়ে হ্রদে নিজের কাজে ফিরে যায়। যাই হোক, এই সূত্র ধরে সেই খনিমুখ তিনটের কাছে যাওয়া হলো। তারপর একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে কাকার লাশ পাওয়া গেল। কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই শ্বাসরোধ করেও মারা হয়নি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে বলা হলো–হার্টফেল করে মারা পড়েছেন। অথচ কাকার স্বাস্থ্য ছিল খুবই ভাল।

কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর কর্নেল বললেন–কিন্তু আপনার কাকিমা খনিমুখ বন্ধ করতে নিষেধ করেন বলছিলেন। কেন–সেটা স্পষ্ট বুঝলুম না মিঃ রায়!

ইন্দ্রনাথ আনমনে মাথা নেড়ে বললেন কাকিমাও স্পষ্ট কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন–ওগুলো যেমন আছে, তেমনি থাক। আমার ছোট ভাই সৌমেন্দু ডাক্তার। ও এখন জব্বলপুরে সরকারী হাসপাতালের চার্জে আছে। কোনও কুসংস্কার নেই। ও জেদ ধরেছিল কাকিমার কাছে। কিন্তু কাকিমা শুধু বলেছিলেন–খনিতে এক সাধু আছেন তিনি নাকি অদৃশ্যও হতে পারেন। সেই সাধু নির্জনে তপস্যা করার জন্য খনির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন কবে। জবরদখল–যাকে বলে! …কথাটা বলে ইন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন।

আমরাও হাসলুম। কর্নেল বললেন–সাধুকে কেউ দেখেছে কখনও?

ইন্দ্রনাথ বললেন–না। আমার ধারণা, কাকিমার নিছক বিশ্বাস। তবে কেন এমন আজগুবি ধারণা হলো, তাও উনি বলেননি। বলবেনও না। খনিমুখ বন্ধ করলে সাধু নাকি রেগে যাবেন।

ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি নিয়ে এল। আমরা কিছুক্ষণ কফি খেলুম চুপচাপ। তারপর কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন–খুব ইন্টারেস্টিং!

ইন্দ্রনাথ বললেন–তবে কর্নেল, ওই ভূতুড়ে রহস্য ফাঁস করার জন্যে আমি নিশ্চয় আপনার কাছে আসিনি। আমি এসেছি, স্রেফ মাছ ধরার প্রস্তাব নিয়ে। অবশ্য, আপনারই কাছে প্রস্তাব আনার কারণ যদি জানতে চান, তাহলে বলবকাকার মৃত্যুর পর থেকে প্রতিবছরই এই সময় আমার চিরিমিরি এলাকার ওই হ্রদে যেতে ইচ্ছে করে–অন্তত স্রেফ ছিপে মাছ ধরার জন্যে। অথচ বুঝতেই পারছেন, ওই ট্র্যাজিক ঘটনার ফলে একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে। দ্বিধা এসে সামনে দাঁড়ায়। একা যেতে শেষ অব্দি সাহস পাইনে। ওদিকে কাকিমা জানতে পারলেও বাধা দেবেন। তাই অবশেষে আপনাকে নিয়ে যাবার প্ল্যান মাথায় এসে গেল। আপনারও মাছ। ধরার হবি ছিল এক সময়–দেখেছি।

কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন–ছিল! এখন সেটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মিঃ রায়। কিন্তু একটা কথা–আপনার কাকিমা আপনাকে বাধা দেবেন না?

ইন্দ্রনাথ বললেন–নিশ্চয় দেবেন। কিন্তু আমি এবার যেভাবে হোক, যাবই কর্নেল। জায়গাটা এত সুন্দর, এত নির্জন, ভাবা যায় না। আমার স্মৃতি আমাকে উত্যক্ত করে মারছে। কাকিমাকে গোপন করেই যাব।

কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–জয়ন্ত! আশা করি, ইতিমধ্যে তুমি ঞ্চল হয়ে উঠেছ! মনশ্চক্ষে চিরিমিরি হ্রদের অপূর্ব সৌন্দর্য এবং রুপোলি মৎস্য অবলোকন করছ!

ইন্দ্রনাথ বললেন–তাহলে দুজন নয় কর্নেল, তিনজন মিলে যাব। জয়ম্বাবুকেও আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

কর্নেল হেসে বললেন রাইট, রাইট। তারপর অস্ফুটস্বরে বাচ্চা ছেলের মতো সেই ছড়াটা আওড়াতে থাকলেন :

খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কুলে…

.

চিরিমিরি পাহাড়ের বাংলোটির নাম ‘দা সোয়ান’। দূর থেকে ধূসর এই পুরনো বাংলোটিকে সত্যি একটা রাজহাঁসের মতো দেখায়–যেন মাঝে মাঝে রাজহাঁসটা জ্যোৎস্নারাতে হ্রদে সাঁতার কেটেও যায়। বাংলোর গেট থেকে একফালি সরু পথ ঘুরে ঘুরে হ্রদে নেমেছে। যেখানে নেমেছে, সেখানে কয়েক ধাপ পাথর বাঁধানো আছে ঘাটের মতো। পথের দুধারে গাছপালা ঝোপঝাড় আছে। পথটাও এবড়োখেবড়ো অব্যবহৃত হয়ে রয়েছে অনেক বছর। ফাটলে ঘাস বা আগাছা গজিয়েছে। আমরা দুপুর নাগাদ তিনজনে পৌঁছুলে কেয়ারটেকার রঘুবীর সিং তক্ষুনি কয়েকজন আদিবাসী লাগিয়ে সব সাফ করার ব্যবস্থা করল। ঘাটের পাথরগুলোয় শ্যাওলা জমে ছিল। তাও সাফ করা হলো। লাঞ্চের আগে কর্নেল স্বভাবমতো চারপাশটা দেখতে বেরিয়ে গেলেন–সঙ্গে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিতেও ভুললেন না। আমাকে ডাকলেন না দেখে অভিমান হলো–অবশ্য ডাকলেও যেতুম না, সারাদিন সারারাত ট্রেনজার্নির পর তখন খুব ক্লান্ত আমি। বিছানায় গড়াচ্ছি। কর্নেলকে ইন্দ্রনাথ সাবধান করে দিলেন এলাকার জঙ্গলে বুনো হাতি আছে অজস্র। বাঘ ভালুকও কম নেই। কর্নেল ঘাড় নাড়লেন মাত্র।

বাংলোর ঘরগুলো এসেই দেখা হয়েছে। পাঁচঘানা ঘর আছে। একটা কিচেন কাম-ডাইনিং-প্লাস ড্রয়িং রুম, একটা বাথরুম-প্রিভি, বাকি তিনটে শোবার ঘর। থাকার ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি নেই। ইন্দ্রনাথ খবর পাঠিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দান সিং নামে ওঁদের পুরনো রাঁধুনিও অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। এবার সে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে কাজে লেগে গেল। আমাদের সঙ্গে তিনখানা হাল্কা মজবুত বিলিতি ছিপ, চার এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রয়েছে। ইন্দ্রনাথ আমাকে ছিপ ফেলার ঘাট দেখতে ডাকলেন একবার। কিন্তু আমার ক্লান্তি লক্ষ্য করে শেষে একজন লোক সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।

একটু পরে বারান্দায় গিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে থাকলুম। হ্রদটা বিশাল। সামনে উত্তরে রয়েছে সেটা। পশ্চিমে মোটামুটি সমতল জায়গায় ওঁদের পোড়ো খনি–এখন জঙ্গল গজিয়ে গেছে। পুবে এবং উত্তরে যতদূর চোখ যায়, শুধু জল। দিগন্তরেখায় কিছু নীল পাহাড়। উত্তরেও পাহাড়–সেগুলো কাছে বলে মনে হলো। বাংলোটা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে–এটা হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ-ঘেঁষা। রঘুবীর এসে সব দেখাল। বাংলোর পিছনে আরেকটা রাস্তা আছে–সেটা চলে গেছে খনিতে। বাংলা থেকে সিকি কিলোমিটার দূরে রাস্তাটা দুভাগ হয়েছে ডাইনে চলে গেছে খনির দিকে। বাঁয়ে গিয়ে মিলেছে একটা ঢালু বড় সড়কে মাইল পাঁচেক দূরে। ওই পথেই আমরা টাঙ্গায় চেপে এসেছি। সড়কটা নদী পেরিয়ে পুবে বরটুঙ্গা স্টেশন হয়ে জব্বলপুরের দিকে চলে গেছে।

রঘুবীর বলল কী ছিল জায়গাটা, কী হয়ে গেল! কত লোকজন– কত আওয়াজ–সবসময় গমগম করত। আমি স্যার, সেই এসেছিলুম রায়সায়েবের সঙ্গে পাঁচ সাল আগে। উনি তো মারা গেলেন। তারপর আমিও চলে গেলুম। আমার মনে বড় কষ্ট হত স্যার। কিন্তু ওনারা ছাড়বেন না। বাংলোর জিম্মাদারি করতে হবে। তো আমার ছেলেই এখানে এসে মাঝে মাঝে দেখাশোনা করে যেত। খুব সাসহী ছেলে স্যার! আমার তো এ বয়সে এই ভূতের আড্ডায় থাকার সাহসই ছিল না। লেকিন দেখুন, আমার ছেলের একচুল ক্ষতি হয়নি। ভূতও নাকি দেখা দেয়নি। তবে…

ও থামলে জিগ্যেস করলুম–তবে?

–ছেলে বলত, খনির ওদিকে আলো জ্বলতে দেখেছে। ওর ধারণা ওসব আলো জেলেদের। রাতে মাছ ধরতে আসে জেলেরা।

–আচ্ছা রঘুবীর, রায়সাহেব মারা যাবার সময় তো তুমি এখানে ছিলে?

জী হুজুর।

–তুমি কি মনে করো উনি হার্টফেল করেই মারা যান?

রঘু গম্ভীর হয়ে বলল–জী হাঁ। আচানক কিছু আজগুবি দেখলে তো হার্টফেল করবেই! আমার মালুম, রায়সাহেব সেই সাধুকে দেখতে পেয়েছিলেন। সাধুর রাগ হয়েছিল। কেন? না–খনির গর্ত বন্ধ করে দেবেন রায়সাহেব। সাধুর ভয়ঙ্কর চেহারা দেখেই মারা যান উনি।

–তাহলে বলছ, খনির মধ্যে কৈানও সাধু ছিলেন? তাকে কেউ দেখেছিল নাকি?

–জী হ্যাঁ। মাইজি দেখেছিলেন।

–তুমি?

রঘুবীর একটু চুপ করে থেকে বলল–স্যার, বিশ্বাস করেন তো বলি। আমি একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক পলকের জন্যে দেখেছিলুম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। তারপর–আর নেই! বিলকুল হাওয়া।

বল কী রঘুবীর!

হ্যাঁ স্যার। দেখামাত্র গর্তে সেঁধিয়ে গেলেন। মনে মনে হেসে সিগারেট ধরালুম। রঘুবীর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। একটু পরে শুনি বাংলোর পিছন দিকে গাড়ির আওয়াজ হচ্ছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য লন ঘুরে পিছনে যেতেই দেখলুম, একটা জিপ থেকে আমার বয়সী একজন যুবক নামল–চোখে সানগ্লাস, পিঠে বন্দুক। তারপর নামলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কর্নেলের বয়সী। তবে কর্নেলের মতো টাক বা দাড়ি নেই। শেষে নামলেন এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। পোশাক দেখেই চমকে উঠলুম। বাঙালী বিধবা। তাহলে কি হঠাৎ ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা এসে পড়লেন? সর্বনাশ!

কিন্তু এই অভিশপ্ত মাটিতে হঠাৎ উনি নিজেই এসে পড়লেন এবং সদলবলে– কেন?

ততক্ষণে রঘুবীর দৌড়ে হাজির হয়েছে। তার হাবভাব দেখে স্পষ্ট জানা গেল, যা ভেবেছি, তাই। বৃদ্ধা বেশ শক্ত সমর্থ মনে হলো। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন–আপনাকে তো চিনলুম না বাবা?

রঘুবীর বলল-মাইজী, ওনারা এসেছেন কলকাতা থেকে। ইন্দর সাহেবের সঙ্গে। লেকে মাছ ধরবেন।

ইন্দ্র! ইন্দ্র এসেছে? বৃদ্ধার মুখে খুবই বিস্ময় ফুটে উঠল।

–জী হাঁ। এই তো দো-তিনঘণ্টা আগে এসেছেন। ঔর এক কর্নেল সাহেব এসেছেন।

বৃদ্ধা গম্ভীর মুখে দলবল সহ বাংলোয় উঠলেন। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগল। ভুতুড়ে বাংলোর সব রোমান্স মাঠে মারা যাবে। বেশি হইচই করা যাবে না। মেপে জুপে চলাফেরা করতে হবে। ইন্দ্রনাথের মুখে ওঁদের গার্জেন এই ভদ্রমহিলার যে ব্যক্তিত্বের আঁচ পেয়েছিলুম, বাস্তবে মনে হচ্ছে তার চেয়েও কড়া কিছু। আশঙ্কাও হলো, ইন্দ্রনাথ ওঁর বিনা অনুমতিতে এবং অজ্ঞাতসারে আমাদের নিয়ে এখানে এসেছেন–এই নিয়ে কোনও মনান্তর দেখা দেবে না তো?

অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় গেলুম। তারপর আরও কিছু এগিয়ে যেতেই আচমকা পাশের একটা ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। টুপিতে মাকড়সার জাল, জামায় কাঁটা আটকে আছে এবং শুকনো পাতা লেগে রয়েছে। আমাকে দেখে যেন একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন–এই যে জয়ন্ত!

বললুম–বন্য জন্তুর মতো ঝোপ জঙ্গলে ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছেন। ওদিকে দেখুন গে, ধুন্ধুমার শুরু হয়েছে এতক্ষণ। ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা ভদ্রমহিলা দলবল নিয়ে। এসে পড়েছেন!

কর্নেল হাত তুলে বললেন–দেখেছি। এত নার্ভাস হয়ে পড়ার কিছু নেই। এবার চুপচাপ একটা জমাট নাটক দেখতে থাকো। আনন্দ পাবে–আই অ্যাসিওর ইউ, ডার্লিং!

নাটক মানে?

কর্নেল টুপি খুলে টাক চুলকে বললেন–হ্যাঁ জয়ন্ত। সম্ভবত একটা রোমাঞ্চকর নাটকের শেষ অঙ্কের পর্দা উঠল এবং আমরা কিছু না জেনে তার মধ্যে এসে। পড়েছি।

বিস্মিত হয়ে বললুম–কর্নেল! প্লীজ-অন্ধকারে রাখবেন না!

কর্নেল সস্নেহে আমার একটা হাত ধরে বললেন–ধৈর্য ধরো, জয়ন্ত। সম্ভবত আমাদের দুজনেই এখন একটা সুবিশাল ধৈর্যের মধ্যে সময় কাটাতে হবে। আই জাস্ট স্মেল ইট।

লাঞ্চ খেতে তিনটে বেজে গেল। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, ইন্দ্রনাথের ঠাণ্ডা ধরনের নির্লিপ্ত আচরণ সত্ত্বেও তার কাকিমা সর্বেশ্বরীদেবী আমাদের বিশেষ করে কর্নেলের প্রতি খুব ভদ্রতা দেখালেন। কিন্তু একটু বিসদৃশ মনে হলো দুই ভায়ের পরস্পর আচরণ। ইন্দ্রনাথ ও সৌমেন্দু পরস্পর বাক্যালাপ পর্যন্ত করলেন না। সর্বেশ্বরীর সঙ্গের ভদ্রলোক সেই ইঞ্জিনিয়ার এবং খনি-বিশারদ, যিনি জগদীপের মৃত্যুর সময় এখানে ছিলেন এবং খনিমুখ বন্ধ করার উপায় বাতলাতে এসেছিলেন। সেই বৃদ্ধের নাম অনন্তরাম শর্মা। মহীশূরের লোক। জগদীপের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন।

কর্নেলের যা স্বভাব, এই তিনজন নবাগতের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলতে দেরি হলো না। লাঞ্চের টেবিলে কর্নেলের অনুরোধে সর্বেশ্বরীও বসলেন। কিন্তু তিনি নিরামিষ খান। আলাদা ব্যবস্থাও ছিল। নিঃসঙ্কোচে খেলেন এবং তাঁর স্বামীর কার্যকলাপ সম্পর্কে গল্পও করলেন। মনে হলো, ভদ্রমহিলার প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অসাধারণ এবং রীতিমতো শিক্ষাদীক্ষা আছে।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ইন্দ্রনাথ তিনটে ছিপ নিয়ে চলে গেলেন হ্রদের দিকে। আমাদের দুজনকে ডেকেও গেলেন। কর্নেল বললেন–খাওয়ার পর আধঘণ্টা জিরিয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস, মিস্টার রায়। আপনি চলুন। আমরা দুজনে যাচ্ছি।

বুঝলাম, আমাকেও কর্নেলের সঙ্গে জিরিয়ে নিতে হবে।

সৌমেন্দুকে দেখলুম লনে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। বারান্দার চেয়ারে আমরা চারজন বসে আছি-কর্নেল, সর্বেশ্বরী, মিঃ শর্মা আর আমি। সর্বেশ্বরী বলছিলেন–তা বুঝলেন কর্নেল? স্বপ্ন দেখার পর তো আমি অস্থির হয়ে উঠলুম। তখনই টেলি করে দিলুম মিঃ শর্মাকে। সৌমেন্দুকেও খবর দিলুম মিঃ শর্মাকে নিয়ে সে যেন অপেক্ষা করে। তারপর…

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–একটা ছোট্ট প্রশ্ন মিসেস রায়। জাস্ট একটা কৌতূহল। ইন্দ্রনাথকে আপনি কথাটা নিশ্চয় জানাননি?

সর্বেশ্বরী গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন–দেখুন কর্নেল সরকার, ব্যাপারটা অবশ্য পারিবারিক এবং প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। কিন্তু আপনাকে বলতে সংকোচের কারণ দেখি না। ইন্দ্রনাথকেই প্রথমে কথাটা বললুম–। কিন্তু ও বরাবর অবিশ্বাসী-নাস্তিক। ও উড়িয়ে দিল। বলল–একটা পোডড়া খনির গর্ত বুজিয়ে ফেলতে একগাদা টাকা খরচা হবে। এর কোনও জাস্টিফিকেশন নেই। ইন্দ্রনাথ গোঁ ধরে বসে রইল। তখন আর কী করি বলুন! প্রত্যক্ষ স্বপ্নে দেখলুম, উনি বলছেন পিট তিনটে শীগগির বন্ধ করে দাও। সাধুবাবা চলে গেছেন!

কর্নেল মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন-রাইট, রাইট মিসেস রায়। মিঃ শর্মাকে জিজ্ঞেস করছি। মিঃ শর্মা কীভবে পিট বন্ধ করবেন, নিশ্চয় প্ল্যান করেই এসেছেন?

শর্মা বললেন–অবশ্যই। সঙ্গে ডিনামাইট নিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধে হবে না। এখন আগে একবার গিয়ে জায়গাটা দেখতে হবে কী অবস্থায় আছে। পাঁচ বছর আগে যেমন দেখেছি, তেমন না থাকতেও পারে। কারণ, বুঝতেই পারছেন–প্রকৃতি সবসময় নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ওলট-পালট ঘটাচ্ছে।…বলে শর্মা হাসতে থাকলেন।

কর্নেল ফের মাথা দুলিয়ে বললেন রাইট, রাইট!

শর্মা একটু ঝুঁকে বললেন–কিছু যদি মনে করেন কর্নেল, তাহলে আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন। সার্ভে এবং ডিনামাইট রাখার ব্যাপারে আপনার মতো অভিজ্ঞ একজন সমরকুশলী থাকা খুবই সঙ্গত। এ ধরনের কাজকর্ম সমর বিভাগের লোকেরা নিশ্চয় করে থাকেন।

কর্নেল তক্ষুণি আমন্ত্রণটা নিলেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন জয়ন্ত, তাহলে তুমি ছিপ ফেলতে যাও। আমি মিঃ শর্মার সঙ্গে যাই।…

সর্বেশ্বরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনারা ঘুরে আসুন। ততক্ষণ আমি বিশ্রাম করে নিই।

সবেশ্বরী ঘরে ঢুকলেন। কর্নেল ও মিঃ শর্মা বেরিয়ে গেলেন। আমি লেকের দিকে পা বাড়ালুম। লন পেরিয়ে যাবার সময় সৌম্যেন্দু হঠাৎ আমাকে ডাকলেন– জয়ন্তবাবু, শুনুন!

কাছে গেলুম। বললুম–আপনি গেলেন না যে?

সৌম্যেন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন–আপনারা কি সত্যি নিছক মাছ ধরতেই এসেছেন?

চমকে উঠে বললুম–নিশ্চয়ই। আপনার অবিশ্বাসের কারণ বুঝলুম না সৌমেন্দুবাবু। দুঃখিত।

সৌম্যেন্দু আমার অনুযোগ গ্রাহ্য না করে প্রশ্ন করলেন–আপনি কি সত্যি রিপোর্টার?

অপমানিত বোধ করলুম। পকেট থেকে আমার আইডেন্টিটি কার্ড (ফটো সমেত) বের করে ওঁর সামনে ধরে বললুম–আপনার কি এটা জাল মনে হচ্ছে?

সৌম্যেন্দু, আশ্চর্য, আইডেন্টিটি কার্ডটা আমার হাত থেকে নিলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টে পরীক্ষা করার পর ফিরিয়ে দিয়ে একটু হাসলেন–জয়ন্তবাবু, আমার এই সংশয়কে ক্ষমা করবেন। আপনাকে খোলাখুলিই বলছি, দাদার প্রতি আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই।

–কেন সৌমেন্দুবাবু?

ওঁর এখানে আসার মধ্যে অবশ্যই কোনও মতলব আছে। কিন্তু শুধু বুঝতে পারছি না–আপনাদের কেন উনি আনলেন? বিশেষ করে ওই কর্নেল ভদ্রলোকের নাম আমার শোনা আছে–উনি একজন শখের গোয়েন্দা–তাই না?

–ঠিক তা নয়। তবে ওঁর রহস্যসম্পর্কে আগ্রহ আছে। তবে একটা পোড়ো খনির মুখ বন্ধ করার মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে, সত্যি আমি বুঝতে পারছি না সৌম্যেন্দুবাবু।

–পারে বইকি।…বলে সৌম্যেন্দু কেমন হাসলেন। তারপর চাপা গলায় ফের বললেন–আমার বরাবর ধারণা, ওই খনির সুড়ঙ্গে কোথাও গুপ্তধন লুকোনো আছে।

বলেন কী মশাই!

-হ্যাঁ জয়ন্তবাবু। এই আমার বরাবরকার অনুমান। কিন্তু কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, ওখানে কে গুপ্তধন পুঁতে রাখতে গেল? কখন পুঁতল?

আমি হতভম্ভ হয়ে গেছি কথাটা শুনে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সৌম্যেন্দু বললেন–চলুন, আপনার ওই কর্নেল সায়েব তো ছিপ নিয়ে বসবেন না। অতএব আমি ওঁর ছিপটা নিয়ে মাছ ধরতে বসব। কিন্তু একটা কথা–আমি ছিপটা দাদার কাছে গিয়ে আনতে পারব না। আমি দূরে দাঁড়াব। আপনি এনে দেবেন। দাদার কাছে জেনে নেবেন কিন্তু, কোন ঘাটে কর্নেলের বসার কথা ছিল। সে ঘটেই আমি বসব।…

.

লেকের এই দক্ষিণ ধারটা পাহাড় থেকে ঢালু বা গড়ানে অবস্থায় জলে নেমে গেছে। অজস্র ঝোপঝাড় ও পাথর আছে এখানে। বাঁদিকে অর্থাৎ পশ্চিমে সেই পাথর বাঁধানো ঘাটে কর্নেলের বসার কথা। সেখানেই সৌম্যেন্দু বসলেন। আমি বসলুম তার আন্দাজ তিরিশ গজ দূরে ঝোপের মধ্যে থেকে একটা পাথর জলঅব্দি নেমে গেছে, তার ওপর। আমি সৌম্যেন্দুর ছিপের ডগাটা শুধু দেখতে পাচ্ছিলুম। আর, ইন্দ্রনাথ বসেছেন আমার ডাইনে আন্দাজ চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে। সেখানেও এমনি পাথর আছে। কিন্তু আমি ইন্দ্রনাথের ছিপটা দেখতে পাচ্ছিলুম না। ওই ঘাটটা সম্পূর্ণ আড়ালে পড়ে গেছে।…

হ্রদের জল এখন মোটামুটি শান্ত। আমার পিছন থেকে বাতাস বইছে বলে আমার ঘাটের জলটা কাচের মতো নিভাজ আর স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল। পশ্চিমের উপত্যকায় সেই ভুতুড়ে খনি অঞ্চল–বেশ কঁকা খানিকটা জায়গা। ঝোপঝাড় অবশ্য আছে। কিন্তু কোনও পাহাড় না থাকায় সূর্যের আলো এসে হ্রদের জলকে গোলাপি আলোয় রাঙিয়ে তুলছিল। ছিপে বসতে যে একাগ্রতার দরকার, এখন তা আর আমার নেই। মাথায় সৌম্যেন্দুর গুপ্তধন কথাটা ভেসে আসছে। বারবার পশ্চিমের ওই উপত্যকার দিকেই তাকাচ্ছি। ফাতনা স্থির হয়ে ভেসে আছে। হ্রদে প্রচুর মাছ আছে শুনেছিলাম, কিন্তু একবারও ফানা নড়তে দেখলুম না। চারে মাছ এলে বুজকুড়ি ফুটবে জলে। তারও কোনও লক্ষণ নেই। বসে থেকে বিরক্তি ধরে গেল। অনেকগুলো সিগারেট খেয়ে ফেললুম। বারকতক ছিপ তুলে টোপও দেখলুম। মাছে ঠোকর দেয়নি। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। হ্রদের জলের গোলাপি রঙ ঘিরে ধূসর কুয়াশা জেগে উঠছে। দূরের পাহাড়গুলো কালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যে সব পাখি হ্রদের আকাশে ওড়াউড়ি করছিল, এতক্ষণে তারা পাহাড়-জঙ্গল লক্ষ্য করে ডানা মেলছে। হঠাৎ আমার ছিপের সুতোয় টান পড়ল এবং হুইলের ঘরঘর শব্দ শোনা গেল। ছিপটা চেপে ধরে, দেখি সুতো প্রচণ্ড বেগে জলের তলায় ছুটছে। নির্ঘাৎ কোনও প্রকাণ্ড মাছ বঁড়শি গিলেই গেঁথে গেছে, আমাকে খ্যাচ মারার সুযোগও দেয়নি।

ছিপের ডগা বেঁকে যাচ্ছিল। সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়ালুম। একটু পরেই মাছটা স্থির হলো। তখন সুতো গুটোতে শুরু করলুম। মাছটা অন্তত কিলো দশকের কম হবে না। কাছাকাছি আসার পর মাছটা এক লাফ দিয়ে ডাইনে ঘুরল। তারপর পাড়ের সমান্তরালে জল ভেঙে দৌড় দিল। পাড়ের কাছাকাছি বলে এসব জায়গায় অজস্র পাথর জলের ভিতরে এবং উপরে ঘাপটি পেতে রয়েছে। ভয় হলো, নির্ঘাৎ এবার মাছটা কোনও পাথরের খাঁজে ঢুকে যাবে এবং আমার সুতোটা ছিঁড়ে ফেলবে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলুম ইন্দ্রনাথবাবু! ইন্দ্রনাথবাবু!

চেঁচানোর উদ্দেশ্য, মাছটা ওঁর ঘাটের দিকেই যাচ্ছে। উনি যদি এখন কোনওভাবে ওঁর বঁড়শিতে বা সুতোয় ওটাকে আটকাতে পারেন, মাছটা হাতছাড়া হবার সুযোগ পাবে না।

আমার ডাকের পর মনে হলো উনি সাড়া দিলেন–সেটা আমার শোনারও ভুল হতে পারে। কারণ, ঠিক তখনই যা ভয় করেছিলুম–তাই হলো। সুতোটা ঢিলে হয়ে নেতিয়ে গেল। গুটিয়ে আনার পর দেখি, ফাতনাসুদ্ধ ছিঁড়ে মাছটা সম্ভবত পাথরের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফাতনাটা খুঁজলুম। আলো কমে গেছে। এখান থেকে দেখা গেল না। তখন আরও ভাল করে দেখার জন্য ইন্দ্রনাথের ঘাটের। কাছে গেলুম।

ঝোপ ঠেলে গিয়ে দেখি, ইন্দ্রনাথ পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে দোলাচ্ছেন। ছিপটা তুলে পাশে রেখেছেন। জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। ব্যাপার কী?

আমার পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। আসুন, আসুন জয়ন্তবাবু। আপনারও দেখছি আমার অবস্থা হয়েছে। লেকের মাছগুলো খুব শক্তিমান। বরাবর এই কাণ্ডটি ঘটে বলে এবার বিলিতি কোম্পানির সুতো আনলুমতাও টিকল না।

বললুম–ডাকছিলুম, শোনেননি?

ইন্দ্রনাথ বললেন—হুঁ শুনেছি। কিন্তু তখন সাড়া দেবার ফুরসত কোথায়? চলুন–আলো কমে গেছে। আজ আর আশা নেই। কাল সকাল থেকে ফের বসা যাবে।

দুজনে পাশাপাশি ঢালু বেয়ে ওঠা শুরু করলুম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন-সৌম্য অবশ্য আমাদের মতো আনাড়ি নয়। আমি জানি জব্বলপুর থেকে গাড়ি করে এসে ও মাছ ধরে। বিলক্ষণ অভ্যাস আছে। এজন্যেই সম্ভবত জব্বলপুর ছেড়ে যেতে চায় না।

বললুম–দেখে আসব নাকি?

–থাক। ও একটু গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে। ডিসটার্ব করলে খুশি হবে না। আসুন, আমরা বাংলোয় গিয়ে আরামে কফি খাব।…..

.

বাংলোয় গিয়ে দেখি, সর্বেশ্বরী বারান্দায় বসে রয়েছেন। রঘুবীরের সঙ্গে কথা বলছেন। ভাসুরপোকে একবার দেখে বললেন–মাছ হলো না? ইন্দ্রনাথ জবাবে একটু হাসলেন মাত্র। তারপর আমরা বারান্দার উত্তরদিকে একটু তফাতে বসলুম। ইন্দ্রনাথ রঘুবীরকে বলে দিলেনকফি খাব।

একটু পরে কফি খেতে খেতে কর্নেল ও শর্মার গলার আওয়াজ পেলুম। তখনও অন্ধকার ঘন হয়নি। গোধূলিকাল বলা যায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম কর্নেল ও শর্মা ঘাটের দিক থেকেই আসছেন। কিন্তু তাঁদের আসার মধ্যে কেমন ব্যস্ততা ছিল। খোলা বারান্দায় আমাদের দেখতে পেয়েই কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু! সৌমেন্দুবাবু ফিরেছেন?

ইন্দ্ৰনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললেনা। ও এখনও ঘাটে আছে।

কর্নেল অমনি ঘুরলেন এবং হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে, যেদিক থেকে আসছিলেন–অর্থাৎ সেই পাথরের ধাপবন্দী ঘাটটার দিকেই চলে গেলেন। শর্মা দাঁড়িয়ে ওঁর চলে যাওয়া দেখছিলেন। ইন্দ্রনাথ ও আমি বারান্দা থেকে তক্ষুনি ওঁর কাছে চলে গেলুম।

ইন্দ্রনাথ বললেন ব্যাপার কি মিঃ শর্মা?

শর্মার যেন এতক্ষণে সংবিত ফিরল। ইন্দ্রনাথ! ঘাটে সৌমেন্দু নেই– ছিপটা জলে পড়ে আছে। আর…আশ্চর্য ঘাটের পাথরে একটুখানি রক্ত। আমরা ভাবলুম, মাছের রক্ত। কিন্তু… ।

কথা শেষ করার আগেই কর্নেলের ডাক এল ইন্দ্রনাথ! মিঃ শর্মা! চলে আসুন।

সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি ঘাটের ওপর দিকে ঝোপে কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। ঝোপে ঢুকে আমার মাথা ঘুরে গেল। শরীর অবশ হয়ে উঠল। ইন্দ্রনাথ ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন-সৌম্য!

সৌমেনের বুকে একটা ছোরা বিধে রয়েছে। বিঁধে আছে বলেই বিশেষ রক্ত পড়েনি। চিত হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে আছেন উনি। চোখদুটো খোলা। মুখে বিকৃত ভাব। মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল, কর্নেলের মুখে শোনা সেই ছড়াটা :

খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…

.

বিন্দিয়া নামে পাঁচ মাইল দূরে একটা ছোট শহর আছে। সেখানেই থানা। ইন্দ্রনাথ সেই গাড়িটা চালিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। ফিরলেন সাতটা নাগাদ। সঙ্গে একদল পুলিশ। অফিসার-ইন-চার্জের নাম মিঃ লাল। ভদ্রলোক খুব রাগী মানুষ। এসেই প্রথমে চোখ পড়ল রঘুবীর আর রাঁধুনী বেচারার দিকে। ধমক দিয়ে বললেন এই ব্যাটারাই খুন করেছে! শুনে ওরা ঠকঠক করে কাঁপতে ঈশ্বর-রামজী-হনুমান গণেশ তাবত দেব-দেবতার কিরিয়া খেতে থাকল। বেগতিক দেখে কর্নেল তার পরিচয়পত্রটি বের করলেন। সম্প্রতি এটি তিনি ভারত সরকারের কাছে লাভ করেছেন। এটি এতদিন ছিল না বলে তাকে নানান অসুবিধায় পড়তে হচ্ছিল। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার পরামর্শে যোগাড় করতে হয়েছে।

পরিচয়পত্র দেখে মিঃ লাল একটু সংযত হলেন। কিন্তু ঠোঁটে বাঁকা হাসিটা থেকে গেল। বললেন–আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব নিশ্চয়। কিন্তু কর্নেল সরকার এ হলো মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল। যত সব খুনে ডাকাতের আড্ডা। কথায় কথায় ওরা খুন খারাবি করে। আশা করি, খবরের কাগজ পড়ে তা আপনি বিলক্ষণ অবগত আছে। এই লোকদুটোর চেহারা দেখেই বুঝেছি এরা ঘোড়েল ক্রিমিনাল। রেকর্ড খুঁজলে নিশ্চয় সব বেরোবে। যাক্ গে, এখন আমাদের রুটিনওয়ার্কে নামতে হবে।

টর্চের আলোয় সরজমিন তদন্ত শুরু হলো। লাশটা সেখানেই পড়ে ছিল। লাশের কাছে একটা হেরিকেন রেখে সর্বেশ্বরী, মিঃ শৰ্মা, এবং আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলুম। কর্নেল বাংলোয় (লাশটা থেকে পঞ্চাশ গজ ওপরে) রঘুবীর ও রাঁধুনীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারপর লাশের কাছে এলেন।

মিঃ লাল টর্চের আলো পেলে লাশ পরীক্ষা করতে করতে বললেন–মনে হচ্ছে ঘাটে মাছ ধরার সময় খুনী ছুরি মেরেছে। তারপর লাশটা টেনে এখানে এনেছে। আপনি কী বলেন কর্নেল সরকার?

কর্নেল একটু কেসে বললেন–ঠিক তাই বটে। কিছু রক্ত পড়ে আছে।

অমনি মিঃ লাল ও দুজন কনস্টেবল রক্ত খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-জয়ন্ত, যদি অসুস্থ বোধ করো, বাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করো।

অসুস্থ বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে হলো, কর্নেল আমাকে কোনও গূঢ় আদেশ দিচ্ছেন। অতএব ভালছেলের মতো আমি বাংলোয় চলে গেলুম।

বাংলোর বারান্দায় একটা কাঁচটকা ল্যাম্প রয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দায় দুজন রাইফেলধারী সেপাই বসে রয়েছে। তারা আমার দিকে তাকাল মাত্র। তারপর চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। আমি ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি দেখেছিলুম দিনে। দেশলাই জ্বেলে একটা ধরালাম। তারপর খাটে বসে পড়লুম।

এ ঘরে একটা বড় বিলাতি খাট আছে তাতে কর্নেল ও আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যপাশে একটা ক্যাম্পখাট পাতা হয়েছে ইন্দ্রনাথের জন্যে। হঠাৎ চোখে পড়ল ওই খাটটার তলায় দলাপাকানো একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। অন্যসময় হলে কিছুই ভাবতুম না। কিন্তু সদ্য খুন হয়েছে এবং কর্নেলের মতো রহস্যভেদী আছেন। সঙ্গগুণে এসব ক্ষেত্রে আমার মধ্যে গোয়েন্দা পোকা অর্থাৎ টিকটিকিটা খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অতএব তক্ষুনি কাগজটা কুড়িয়ে এনে খুলে ফেললুম। খুব পুরনো কাগজ। কোণায় ছাপানো সনতারিখ দেখেই বুঝলুম, এটা কারো ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। তারিখটা হচ্ছে ১৭ আগস্ট ১৯৬৮ রবিবার। পাতার নিচের দিকটা ছেঁড়া। তাতে শুধু লেখা রয়েছে ইংরেজিতে: ‘C2’। খুব বড় হরফে কালো কালিতে কেউ লিখেছে। কালি পরীক্ষা করে মনে হলো খুব পুরনো।

ধুরন্ধর গোয়েন্দার শিষ্য আমি। তাই কাগজটা পকেটে রেখে দিলুম। গুরুদেবকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেব। এবং এরপর স্বভাবত আমার মাথায় তদন্তের পোকাটা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। তখন ইন্দ্রনাথের বিছানা হাতড়াতে ব্যস্ত হলুম। আমার তদন্ত ব্যর্থ হলো। তেমন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। তলায় ওঁর একটা স্যুটকেস রয়েছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম, সেটা ভোলা। তখন সাবধানে খুলে ফেললুম। কয়েকটা প্যান্টশার্ট আর দুটো হুইস্কির বোতল ছাড়া আর কিছু নেই। এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ হতেই ঝটপট সরে এলুম।

দরজায় দেখা দিলেন সর্বেশ্বরী। ব্যস্ত হয়ে বললুম–আসুন, আসুন মা।

সর্বেশ্বরী ঢুকে ইন্দ্রনাথের খাটে বসে পড়লেন। সন্ধ্যা থেকেই দেখছি, উনি স্তব্ধ এবং যেন নির্বিকার কিংবা যেন ভীষণ-বিমূঢ়। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন শুধু, এক ফোঁটা চোখের জল পড়তে দেখিনি। এখন চুপচাপ বসে সেই শক খাওয়া নির্বিকার চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয় হলো, উনি পাগল হয়ে। যাননি তো এই আকস্মিক আঘাতে? একটু অস্বস্তি হলো। বললুম–কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল বলুন তো! কী বলে যে আপনাকে সান্ত্বনা দেব, ভেবে পাচ্ছি না! সৌমেন্দুবাবু…

বাধা দিয়ে সর্বেশ্বরী মুখ খুললেন এবার।–এ আমি জানতুম, বাবা জয়ন্ত।

অবাক হয়ে বললুম–জানতেন?

–হ্যাঁ। ওই অভিশপ্ত খনি কাকেও রেহাই দেবে না। কোনও-না-কোনও ভাবে রায়বংশের সবাইকে শেষ করবে। বলবে, কেউ ছুরি মেরেছে সৌমেন্দুকে। হ্যাঁ– মেরেছে। কিন্তু যে মেরেছে, সে নিজেও জানে না কেন ওকে ছুরি মারল।…দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শোকমবেগ যেন:দমন করলেন সর্বেশ্বরী। ফের বললেন–আমি যা জানি তোমরা কেউ তো, তা জানো না, বাবা জয়ন্ত। বললে বিশ্বাস করবে না।:ওই অভিশপ্ত জায়গাটা কেনার কথাবার্তা চলতে চলতেই আমার ভাসুর আর বড় জা হঠাৎ মারা গেলেন–একমাস আগে-পরে। আমি বাধা দিলুম। তাই কেনা হয়নি। কিন্তু আমার স্বামী না জানিয়ে উনিশ বছর পরে কখন কিনে বসলেন। শর্মা ওর বন্ধু। শর্মাই নাকি কবে সার্ভে করে দেখেছিলেন, ওখানে মাটির তলায় অনেক সীসে আছে। তারপর তো খনির কাজ শুরু হলো। আমার কপাল ভাঙল।…

উনি চুপ করলে বললুম–আপনারা খনি শুরু করার আগে জায়গাটা তাহলে এমনি পড়ে ছিল?

মাথা দোলালেন সর্বেশ্বরী। তারপর বললেন–পড়ে ছিল ঠিকই। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই গুজব রটেছিল যে ওখানে সীসের খনি আছে।

কিন্তু তাহলে ওই উনিশ বছর ধরে কেউ খনির কাজ করেনি কেন?

–ওখানে এক সাধু থাকতেন। তিনিই বরাবর ভূপালের নবাবকে ধরে কাকেও ইজারা নিতে দিতেন না। উনিশ বছর পরে হঠাৎ সাধু অদৃশ্য হলেন। তখন আর আমার স্বামীর পক্ষে কেনার বাধা রইল না। নবাবের এক উত্তরাধিকারীর কাছে সস্তায় কিনে ফেললেন। তখন দেশীয় রাজাদের সম্পত্তি সরকার দখল করতে শুরু করেছেন। তাই বেগতিক দেখে ওরা বেচে দিলেন। কিন্তু বাবা, তোমরা তো একালের ছেলে কিছু বিশ্বাস করো না। সাধু কিন্তু বরাবর অদৃশ্য হয়ে ওখানে বাস করতেন। এতদিনও করেছিলেন। কদিন আগে এক রাতে আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন–বেটি, চলে যাচ্ছি। খনির মুখ বন্ধ করে দে এবার।

–সাধুকে আপনি কি দেখেছেন কখনও? মানে–স্বপ্নের কথা বলছি না।

–হ্যাঁ। একবার প্রত্যক্ষ দেখেছিলুম। খানিকটা দূর থেকে। টকটকে ফর্সা রঙ-লাল জটা, দাড়ি গোঁফও লাল। একেবারে উলঙ্গ বলা যায়। চোখ দুটো নীল–হৃঙ্খল্ করছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র একটু হেসে অদৃশ্য হলেন।

লাল জটা, দাড়ি, গোঁফ। চোখ নীল। টকটকে ফর্সা রং। মনে মনে হাসলুম। অলৌকিক পুরুষ যখন, তখন ভারতবাসীর আদর্শ চেহারা যা, অর্থাৎ একেবারে সায়েবদের মতোই হবেন বই কি। প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনে থেকে আমাদের চোখে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা সায়েবদের ওপর আরোপ করার অভ্যাস হয়েছে।

দুজনেই চুপ করে আছি। এক সময় সর্বেশ্বরী হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন ইন্দ্র আমার কথা শুনছে না। তুমি দেখে নিও, ওরও কী ঘটে। আমার কী?

বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যেমন এসেছিলেন, বেরিয়ে গেলেন। ওপাশে ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। হয়তো অন্ধকারেই শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আমি ওঁর কথাগুলো ভাবতে থাকলুম। তারপর মনে পড়ল কাগজটার কথা। C লেখা আছে। কোনও সংকেত বাক্য কি? কাগজটা কার? কে অমন করে ফেলে দিয়েছে?

এই সময় কর্নেলদের সাড়া পাওয়া গেল। ওঁরা সবাই বারান্দায় এলে বেরিয়ে গেলুম। মিঃ লাল চেয়ারে বসে বললেন–লাশটা আর ওভাবে ফেলে রাখার মানে হয় না। কী বলেন কর্নেল সরকার? আমাদের যা দেখাশোনার ছিল, হয়ে গেছে। এবার একটা খাটিয়া নিয়ে গিয়ে ওটা আনা যাক্।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মিঃ লাল।

–তাহলে ইন্দ্রনাথবাবু, আপনি প্লীজ সেই ব্যবস্থাই করুন। কাল সকালের আগে অ্যাম্বুলেন্স আসার কোনও চান্স নেই। তারপর বডি মর্গে যাক্। এবার আমরা আরও কিছু জরুরী কাজকর্ম সেরে নিই।

ইন্দ্রনাথ রঘুবীর ও রাঁধুনীকে ডেকে বাংলো থেকে একটা ক্যাম্প খাট বের করলেন। লাশের কাছে দুজন সেপাই রেখে এসেছেন মিঃ লাল। বয়ে আনতে কোনও অসুবিধা হবে না। দারোগাবাবু একটা ফাইল খুলে পেন্সিল চালনা শুরু করলেন। কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–চলো জয়ন্ত, আমরা একটু জিরিয়ে নিই। আজ আর ডিনার খাবার বিন্দুমাত্র আশা রেখ না। কেমন?

ঘরে ঢুকে আমাদের খাটে বসলুম দুজনে। তারপর সেই কাগজ দিলুম ওঁকে এবং সংক্ষেপে সর্বেশ্বরীর কথাগুলোও জানালুম। কাগজটা পরীক্ষা করার পর কর্নেল পকেটে ঢোকালেন। চাপা গলায় বললেন–জয়ন্ত, আমি যা অনুমান করেছিলুম, তা যে ভুল নয়–তার প্রমাণ পেলুম।

বললুম–কী অনুমান করেছিলেন, কর্নেল?

কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে হাতের টর্চটা জ্বেলে মেঝেয় আলো ফেললেন। তারপর ইন্দ্রনাথের খাটের কাছে গিয়ে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন জয়ন্ত, দেখে যাও।

কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখি, পাথরের মেঝেয় কয়েকটা দুইঞ্চি-দেড়ইঞ্চি এবং একইঞ্চি দাগ। দাগটা কালো। বললুম–ও কিসের দাগ?

মনে হচ্ছে জুতোর গোড়ালির, কিম্বা ডগার। দেখ জয়ন্ত, আমরা বিকেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ এ ঘরে ঢুকেছিল। সে বাইরে থেকেই এসেছিল।…বলেই কর্নেল আরেক জায়গায় আলো ফেলে অস্ফুট স্বরে বললেন–মাই গুডনেস!

দেখি ওখানেও একই রকম দাগ। কিন্তু এই দাগগুলো সবুজ রঙের। বললুম– কর্নেল, নিশ্চয় তাহলে এসব জুতোর দাগ নয়। অন্য কিছু।

না জয়ন্ত! এবার বুঝলুম, দুজন এসেছিল এই ঘরে। একজন এসেছিল ঘাট থেকে। ঘাটের ধাপে শ্যাওলা আছে। সবুজ দাগ তারই। কিন্তু কালো দাগ কার জুতোর? এখানে কালো মাটি আছে একমাত্র খনির ওখানে। খনিতে তো আমি আর মিঃ শর্মা এই দুজনে গিয়েছিলুম। কিন্তু, আমরা কেউ এ ঘরে আসিনি। অতএব অন্য কেউ এসেছিল। সে কে?

কর্নেল, তখন বাংলোয় রঘুবীর, রাঁধুনী আর সর্বেশ্বরী ছিলেন। তাদের জিগ্যেস করা যায়।

করব। তবে এটা ঠিক, ওরা কেউ এ ঘরে এলেও এই দাগগুলোর জন্য ওরা দায়ী নয়। কারণ, দাগগুলো পুরুষ মানুষের জুতোর। এবং ওই তিনজনের মধ্যে রঘুবীর আর রাঁধুনী জুতো পরে না। সর্বেশ্বরী স্লিপার পরেন। এ দাগ স্লিপারেরও নয়। স্লিপারের দাগ আরও ছোট হওয়া উচিত।

–তাই মনে হচ্ছে।

কর্নেল চিন্তিতমুখে উঠে এসে ফের খাটে বসলেন। তারপর বললেন– ইন্দ্রনাথবাবুকে বলেছিলুম-জব্বলপুরে একটা টেলি পাঠাতে। ওখানে সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টরকে আমার নামে টেলি করা হয়েছে। সম্ভবত ওঁরা কেউ এসে পড়বেন আজ রাত্রে, অথবা সকালে। বলাবাহুল্য মিঃ লাল চটে যাবেন। কিন্তু উপায় কী? এই হত্যাকাণ্ড খুব সহজ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না জয়ন্ত। এর পিছনে একটা জটিল রহস্য আছে যেন।

হঠাৎ সৌমেন্দুর কথাটা মনে পড়ে গেল। কর্নেলকে সেটা জানালুম। শুনে উনি ঘন ঘন মাথা নাড়তে থাকলেন। তারপর বললেন–গুপ্তধন সত্যি করে থাক, বা নাই থাক–একটা গুজবের ব্যাপার নিশ্চয় আছে, তা প্রথমেই অনুমান করেছিলুম। জয়ন্ত, গুপ্তধনের গুজবের মতো ভয়ঙ্কর সর্বনেশে আর কিছু নেই।

কর্নেল! কাগজের ওই সংকেতটা গুপ্তধনের ঠিকানা নয় তো?

কর্নেল হেসে ফেললেন।–তোমার অনুমানে যুক্তি থাকতেও পারে। কিন্তু ডার্লিং, তাহলে ওটা অমন তাচ্ছিল্য করে কেউ ফেলে দেবে কেন?

ফেলে দিয়েছে। কারণ, সে ভেবেছে একটা বাজে কাগজ।

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার যুক্তিতে সারবত্তা উঁকি দিচ্ছে। খুব খুশি হলুম, জয়ন্ত।

উনি চুরুট ধরিয়ে কী ভাবতে থাকলেন। একটু পরে বললুম–থাগে। আপনি আর ডঃ শর্মা খনিতে কী করছিলেন অতক্ষণ? হঠাৎ ঘাটের দিকেই বা গেলেন কেন? কোন পথে গেলেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–খনিটা দেখে মনে হলো, সত্যি ভূতের আড্ডা। খানাখন্দ প্রচুর। তত ঝোপঝাড়। বারোটা পিট ছিল। তিনটে বাদে সব বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনটের মধ্যে একটা ধস নেমে প্রায় বুজে গেছে। দুটো পিট এখনও খোলা। কিন্তু জঙ্গল গজিয়েছে। ভেতরে ঢোকার কথা ভাবা যায় না। শর্মা তো ভেবেই পেলেন না কোথায় ডিনামাইট বসাবেন। ও দুটোর কাছে কোনও পাথর নেই–তাছাড়া মুখগুলোর চারপাশে গভীর খাদ, জলে ভর্তি। মুখের কাছে যথেষ্ট মাটিও নেই যে ডিনামাইট চার্জ করলে ধস ছাড়বে। এক হতে পারে, সুড়ঙ্গের ওপর গর্ত খুঁড়ে ডিনামাইট বসানো। কিন্তু সুড়ঙ্গ কোন পথে কী ভাবে মাটির তলায় গেছে, না জানলে তো কিছুই করা সম্ভব নয়। ওপর থেকে বুঝবে কী করে?

সুড়ঙ্গে ঢোকা যায় না?

–যায়। কিন্তু তখন যথেষ্ট আলো নেই। তাছাড়া ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে। না পরীক্ষা করে ঢোকা যায় না। অবশ্য, আমরা দুজনে সুড়ঙ্গের অন্য মুখ আছে কি না খুব তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। পাইনি। শর্মার তো পরিচিত জায়গা। উনি কোনও মুখ দেখেননি। এবারও দেখতে পাননি।

অন্যমুখ ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না কর্নেল।

কর্নেল ব্যাখ্যা করে বললেন–পোড়ো খনির সুড়ঙ্গে জীবজন্তুরা বাসা বাঁধে। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও কোনও জায়গায় ফাটল দেখা যায়। জীবজন্তুদের স্বভাব হচ্ছে, ঢোকার মুখ পেলেই সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে বেরিয়ে যাবার একটা মুখ খোঁজে। না থাকলে নখের আঁচড়ে গর্ত করে সেটা বানিয়ে নেয়। সজারু ইত্যাদি কয়েক রকম গর্তবাসী প্রাণীর এ অভ্যেস আছে। আমরা ওখানে অজস্র সজারুর কাটা পড়ে থাকতে দেখেছি বলেই অন্যমুখ খুঁজছিলুম। কিন্তু তেমন কিছু দেখলুম না। হয়তো ছোট্ট ফোকর থাকতে পারে–তা দিয়ে মানুষ ঢোকা বা বেরুনো অসম্ভব।

বাইরে লাশটা এসেছে। আমরা বেরিয়ে গেলুম। চাদরে ঢাকা লাশটা বারান্দায় খাটিয়াতে রাখা হচ্ছিল। সর্বেশ্বরী তখনও ঘরের ভেতরে আছেন। ভেতরে অন্ধকার। শর্মা দারোগাবাবুর সামনে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। সম্ভবত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন এতক্ষণ।

কর্নেল গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ইন্দ্রনাথ এদিকের ঘরে এসে ঢুকলেন। আমি একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর ইন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে ফিরে এলুম। ঘরে ঢুকে দেখি, ইন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে বিছানা হাতড়াচ্ছেন। বললুম–কী খুঁজছেন?

ইন্দ্রনাথ কোনও জবাব না দিয়ে স্যুটকেসটা টানলেন। তারপর বলে উঠলেন—হুঁ। যা ভেবেছিলুম, তাই!

কী মিঃ রায়?

ইন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে উঠে তার খাটে বসলেন। বললেন–নিশ্চয় সৌম্যের কাজ। আমি যখন ঘাটে ছিলুম, ও এসে স্যুটকেসের তলা ভেঙেছিল। এ ছাড়া আর কে ভাঙবে?

-কেন বলুন তো ইন্দ্রনাথবাবু!

ইন্দ্রনাথের মুখটা লাল হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে বললেন–ওর মাথায় একটা অদ্ভুত বোকামি ঢুকে পড়েছিল। ও ভাবত, খনিতে কোনও গুপ্তধন আছে এবং তার সন্ধান আমার হাতে আছে। বরাবর সুযোগ পেলেই আমার জিনিসপত্র হাতড়ানো অভ্যাস ছিল ওর।

ওঁকে সেই কাগজের কথাটা বলার জন্যে খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও চেপে গেলুম। কিন্তু আমার মাথায় টিকটিকির উৎপাত। তাই কৌশলে প্রশ্ন করলুম-কিছু খোওয়া গেছে দেখলেন, মিঃ রায়?

ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়েই জবাব দিলেন–হ্যাঁ। কলকাতায় বড়শি কেনার সময় দোকানদার আমাকে একটুকরো কাগজের মোড়কে সেটা জড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে এসে মোড়কটা খুলে দেখি, ওটা একটা ডাইরি বইয়ের ছেঁড়াপাতা। লেখা ছিল C? ইংরেজি হরফে। কিন্তু তারিখটা দেখে অবাক হয়েছিলুম। ১৯৬৮ সালের ১৭ আগস্ট, রবিবার। ওইদিনই কাকা মারা যান। এটা নিছক দৈবাৎ যোগাযোগ ছাড়া কিছু নয়। তবু মনটা একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওটা বালিশের তলায় এমনি-এমনি রেখে দিয়েছিলুম। সেটা এখন আর পাচ্ছি না।

এবার আর না বলে পারলুম না যে ওটা দলাপাকানো অবস্থায় আমিই পেয়েছি এবং কর্নেলকে দিয়েছি। শুনে ইন্দ্রনাথ হতাশভাবে মাথাটা দোলালেন। বললেন– বেশ বুঝতে পারছি। সৌম্যই ওটা হাতড়ে বের করেছিল। তারপর মাথামুণ্ডু বুঝতে পেরে ফেলে দিয়েছিল দলা পাকিয়ে। হয়তো ভেবেছিল, Cকথাটা মুখস্থ রাখা যখন সোজা, তখন কেন চুরি করি দাদার কাছ থেকে?

কিন্তু যেভাবে ছিল, সেভাবেই রাখতে পারত?

সৌম্যের স্বভাব এই। সহজে রেগে যেত। অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা নিয়ে থাকত। খুব খেয়ালী ছেলে ও। ভেবে কোনও কাজ করা ওর স্বভাবে ছিল না।

হঠাৎ কর্নেল ঢুকে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু, রঘুবীর আর রাঁধুনী লোকটাকেই মিঃ লাল আসামী হিসেবে চালান দিচ্ছেন। আমার কোনও কথা কানে তুললেন না।

ইন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বললেন–সে কী! কেন?

রাঁধুনীই বিপদটা ডেকে আনল। সৌম্যেন্দুকে যে ছুরিটা মারা হয়েছে, সেটা নাকি কিচেনেরই ছুরি। বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া একবার নাকি রঘুবীর বিকেলে কিচেনে ঢুকে ছুরিটার খোঁজ করেছিল।

ইন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল আমার পাশে বসে বললেন–তোমাদের আলোচনার শেষাংশ আমি শুনে নিয়েছি, জয়ন্ত। না–এ জন্যে লজ্জা পাবার কিছু নেই। তুমি মুখটা অমন হাঁড়ি করো না। এবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার শোনো। বঁড়শি একটা মোড়কে ছিল, তা সত্যি। কিন্তু সেই ওরিজিন্যাল মোড়ক বদলে এখানে আসার পর কেউ দ্বিতীয় মোড়কটা পাচার করে। ওরিজিন্যালটা আমি এইমাত্র কুড়িয়ে পেয়েছি বারান্দার নিচে। এই দেখ।

মোড়কটা দাদহাজার বিজ্ঞাপনের কাগজ। দেখে নিয়ে বললুম–মোড়ক বদলানোর উদ্দেশ্য কী?

ইন্দ্রনাথকে সম্ভবত উত্যক্ত করা।

বুঝলুম না।

–সি স্কোয়ার কথাটা এবং ওই তারিখ সম্ভবত ইন্দ্রনাথের ওপর কেমন প্রভাব সৃষ্টি করে কেউ দেখতে চেয়েছিল। বলা বাহুল্য, ইন্দ্রনাথ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন বই কি।

-কিন্তু কে সে?

–যে ছুরি চুরি করেছে এবং সৌম্যেন্দুকে হত্যা করেছে। সে ছাড়া নিশ্চয় আর কউ নয়। এবং যে দু-ধরনের দাগ মেঝেয় আছে, তার মধ্যে সবুজ দাগ যদি ৗম্যেন্দুর জুতোর হয়, কালো দাগ নিশ্চয় সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতো থেকে য়েছে।

কর্নেলের এই কথায় রহস্যের জট আরও পাকিয়ে গেল। আমি গুম হয়ে রইলুম। এমন অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের পাল্লায় কখনও পড়িনি।..

.

ডিনার খাওয়া হবে না জানতুন। বিস্কুট আপেল আর কফি খেয়ে শুয়ে পরলুম। আমরা। মিঃ লালের সবুর সইছিল না। আসামী দুজনকে নিজের জীপে তিনজন কনস্টেবলের সঙ্গে চালান দিলেন সেই রাত্রেই। দুজন কনস্টেবল লাশের কাছে। পাহারায় রাখলেন এবং ডাইনিং টেবিলে বিছানা করে আরামে নাক ডাকাতে থাকলেন। ডাইনিংয়ের ওপাশে দুটো রুমের একটায় সর্বেশ্বরী, অন্যটায় শর্মা শুতে গেলেন। এ পাশের রুমে আমি, কর্নেল ও ইন্দ্ৰনাথ শুয়ে পড়লুম। বারান্দায় সেই ল্যাম্পটা জ্বলতে থাকল। বেচারা কনস্টেবল দুজনের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু মিঃ লালের কাছে ডিউটি ইজ ডিউটি।

শুয়ে জঙ্গলে রাতচরা জানোয়ারের ডাক শুনতে পাচ্ছিলুম মাঝে মাঝে। ঘুম আসছিল না। পাশে কর্নেলের কিন্তু দিব্যি নাক ডাকছে। জানালার পর্দার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে। তারপর একসময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেছি, কে জানে!

হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। জেগে ওঠার পর টের পেলুম বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু গাছপালা থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইয়ের আলোয় কোণার দিকে ইন্দ্রনাথকে দেখার চেষ্টা করলুম। দেখতে পেলুম না। ওঁর বিছানা খালি। তখন মাথার কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে সাবধানে জ্বাললুম। ইন্দ্রনাথ নেই। বাথরুমে ঢুকেছে কি? কিন্তু বাথরুমের দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ। তখন ঘরের দরজায় আলো ফেললুম। দরজার ছিটকিনি খোলা কপাট দুটো ঠেস দেওয়া রয়েছে। তার মানে ইন্দ্রনাথ বেরিয়েছেন।

আলো নিভিয়ে কর্নেলের গায়ে হাত রাখলুম। অমনি আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন–চুপচাপ শুয়ে থাকো।

তাহলে কর্নেল জেগে আছেন! নিশ্চয় সব লক্ষ্য করছেন কখন থেকে। উত্তেজনায় অধীর হয়ে শুয়ে রইলুম।

প্রায় দুঘণ্টা কেটে গেল। সময় যে আসলে এত দীর্ঘ, তা এই প্রথম জানলুম। তারপর দরজাটা নিঃশব্দে ফাঁক হলো, বাইরের আলো এল একটুখানি। দেখলুম ইন্দ্রনাথ ঢুকছে। খালি গা, পরনে শুধু আণ্ডারওয়্যার, পায়ে কেডস। ওঁর হাতে যা দেখলুম, তাতে গা শিউরে উঠল। একটা রিভলভার।

ইন্দ্রনাথ নিঃশব্দে দরজাটা এঁটে দিলেন। তারপর অন্ধকারে কীভাবে জুতো খুলে শুলেন, টের পেলুম না। একটু পরেই শুনি ওঁর নাক ডাকছে। তখন খুব হাসি পেল। কর্নেলকে খুঁচিয়ে দিলুম। কর্নেলও শুনি এবার নাক ডাকাচ্ছেন। অদ্ভুত লোক তো!

এইসময় আবার বৃষ্টি এল। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আমার ঘুমের সম্পর্ক নিশ্চয় নিবিড়। ফলে আবার চোখের পাতা খুঁজে এল।

কী একটা স্বপ্ন দেখছিলুম, হঠাৎ স্বপ্নটা ছিঁড়ে এবং ঘুমটাকে বরবাদ করে কোথাও কোনও জন্তু গর্জে উঠল যেন। জাগার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলুম ইন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং আলো জ্বেলেছেন। আমাকে জাগতে দেখে বললেন–আসুন তো জয়ন্তবাবু, পাশের ঘরে কী গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হলো।

কিছু একটা হচ্ছে তা ঠিকই। ধস্তাধস্তির এবং চাপা গর্জনের আওয়াজ। ঘুরে দেখি কর্নেল নেই বিছানায়। বেরিয়ে গেছেন। আমিও বেরোলুম। বারান্দায় যেতেই ডাইনিং থেকে মিঃ লালের চিৎকার শুনলুম–হ্যাণ্ডস আপ!

বারান্দায় যে সেপাই লাশের পাশে ঘাড় গুঁজে একটা কম্বলে পড়ে ছিল, তারা আচমকা জেগে রাইফেল বাগিয়ে ধরল। মিঃ লাল ফের চেঁচালেন বুধন সিং! সূরযলাল! মেরা টারচ খো গ্যয়া। জলদি বাত্তি লে আও!

কয়েক সেকেণ্ডে এসব ঘটে গেল। বারান্দা থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে সেপাইরা ডাইনিংয়ে ঢুকল। আমরাও ঢুকলুম। ঢুকে হাঁ করে তাকালুম। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য।

কর্নেল দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন–দুহাত মাথার ওপরে তোলা। রাতের জামা ছিঁড়ে ফর্দাফাই। ঝুলছে কোমরের নিচে অব্দি। মুখে অপ্রস্তুত হাসি।

তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ লাল রিভলভার তুলে শাসাচ্ছেন। আর কোনও কথা শুনব না। দেখেই আঁচ করেছিলুম, এ ব্যাটা নিশ্চয় একজন এক নম্বর চারশো বিশ। আমার চোখ এড়িয়ে যাবে? কত খুনী জোচ্চোর দেখলুম অ্যাদ্দিন!

খুব রাগ হলো আমার। বললুম–দেখুন মিঃ লাল, আপনি ভুল করছেন। উনি বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ওঁর পরিচয়পত্র আপনি দেখেছেন। ওঁকে এভাবে অপমান করাটা আপনার মোটেও উচিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে কিন্তু!

মিঃ লাল তুমুল গর্জন করে বললেন–ইউ শাট আপ! আপনাকেও আমি ও ব্যাটার সহযোগী বলে গ্রেপ্তার করব।

ইতিমধ্যে দুপাশের দুটো দরজা খুলে সর্বেশ্বরী এবং মিঃ শর্মা বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ বললেন মিঃ লাল, ব্যাপারটা কী হয়েছে বলুন তো?

মিঃ লাল হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–মশাই, আমার এক চোখ ঘুমোয়, অন্য চোখ জাগে। কপাট ফাঁক করে ও ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়েছি কী মাল! : ভাবলুম কী করে দেখা যাক। ও করল কী, একটা ক্ষুদে টর্চের সাহায্যে দেয়াল হাতড়ানো শুরু করল। তারপর দেখি, ওই দেয়াল আলমারিটার একটা ড্রয়ার টানাটানি করছে। তারপর ড্রয়ার খুলে ফেলল দেখলুম। কী একটা বের করল। তখন আমি নেমে পা টিপে টিপে টেবিলের পিছনে গেলুম। যেই বাছাধন আসা, অমনি জাপটে ধরলুম। ভুল করে টর্চটা হাতে নিইনি। যাই হোক, ব্যাটার গায়ে অসুরের বল। জুডোর প্যাঁচে আমাকে ছিটকে ফেলে দিলে। আমি ওর জামা খামচে ধরেছিলুম। ওই দেখুন না। তারপর উঠে এক লাফে বিছানায় গিয়ে রিভলভার হাতে নিলুম।….

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–আপনি ভুল করছেন মিঃ লাল। আমি আপনাকে ফেলে দিইনি। বরং আপনিই আমাকে….

শাট আপ! গর্জালেন মিঃ লাল।

সর্বেশ্বরীকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখলুম। মিঃ শর্মা এগিয়ে এসে বললেন–ড্রয়ার থেকে উনি কী বের করেছেন, সেটা এবার সার্চ করা উচিত মিঃ লাল। জয়দীপ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার ড্রয়ারে উনি কেন রাতদুপুরে হাত ভরতে গেলেন জানা দরকার।

মিঃ লাল এগিয়ে কর্নেলের রাতের পাজামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো বাঁধানো নোটবই কিংবা ডায়রি বের করে নিলেন। মিঃ শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ দুজনে একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললেন–দেখি, দেখি ওটা কী?

মিঃ লাল হয়তো ওঁদের একজনের হাতে দিয়েই ফেলতেন বইটা। কিন্তু : কর্নেল এক লাফে সরে এসে বাধা দিলেন।খবরদার মিঃ লাল! এই ডায়রি ওঁদের হাতে দেবেন না। এটা একটা ভেরি ইমপরট্যান্ট ডকুমেন্ট!

মিঃ লাল রিভলভার তুলে বললেন হ্যাঁণ্ডস্ আপ। নয়তো গুলি ছুঁড়ব!

অমনি কর্নেল দুহাত তুলে দাঁড়ালেন। আমি হাসব না কাদব ভেবে পেলুম না। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কর্নেল ফের বললেন–মিঃ লাল, প্লীজ! ওই ডায়রি সরকারের সম্পত্তি। কারো হাতে দিলে আপনিই বিপদে পড়বেন। আর দু-এক ঘণ্টার মধ্যে ডিটেকটিভ ডিপার্টের অফিসাররা এসে পড়বেন জব্বলপুর থেকে। ততক্ষণ আপনার অপেক্ষা করা কর্তব্য।

মিঃ লাল অমনি ভড়কে গিয়ে বললেন–ডিটেকটিভ ডিপার্টের লোক আসবে? তার মানে?

ইন্দ্রনাথ বললেন–হ্যাঁ। আমি টেলিফোন করে এসেছি কর্নেলের কথায়।

মুখ বিকৃত করে মিঃ লাল বললেন–ভাল করেছেন! এবার দেখুন মশা মারতে কামান দেগে কী অবস্থা হয়। সব জড়িয়ে পড়বেন মাইণ্ড দ্যাট! একজন জোচ্চোরের কথায় আপনি……

বাধা দিয়ে বললুম–মিঃ লাল, আবার আপনি অন্যায় করছেন। ওঁকে এসব কদর্য কথা বলার জন্যে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।

এবার মিঃ লাল আর গর্জালেন না। গম্ভীর মুখে বললেন–আপনিও ভাববেন যে জার্নালিস্ট বলে আপনি বেঁচে যাবেন। ইয়েস–লেট দেম কাম। কিন্তু ততক্ষণ এই লোকটা আর আপনি দুজনেই এই ঘরে বসে থাকুন। ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।

কর্নেল আমাকে চোখ টিপলেন। হাসি টিপে বললুম–বেশ। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, উনি বুড়োমানুষ ওভাবে হাত তুলে কতক্ষণ থাকবেন?

মিঃ লাল ধমক দিয়ে বললেন–হ্যাণ্ডস ডাউন।

ঘরের ভেতর বসে নিঃশব্দে আমরা ভোরের প্রতীক্ষা করতে থাকলুম। তখন রাত চারটে বেয়াল্লিশ। বৃষ্টি সমানে পড়ছে।……

.

ভোরেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। মিঃ লাল টেবিলের বাতির সামনে সেই কালো নোটবই পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন। দুজন সেপাই দরজায় বন্দুক বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু অবাক লাগল, শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ ও ঘর ছেড়ে শুতে যাননি। দুটি লুব্ধ জন্তুর মতো মিঃ লালের নোটবইটার দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকলেন। আমরা দুজন তো মিঃ লালের বন্দী, তাই ঘর ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। বেচারা কর্নেলের জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ওঁর হাতির বরাত, এমন মশা বনে যেতে কখনও দেখিনি! চালে ভুল করেই এই দুর্দশায় পড়েছেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মিঃ লালের খপ্পরে এভাবে পড়ে যাবেন, ভাবেননি। ভাবছিলুম, কর্নেলকে যথেষ্ট বকে দেব। নির্ঘাৎ এবার ওঁকে বাহাওরে ভীমরতি ধরেছে! এভাবে সেখানে যা খুশি করে ফেলে নিজেও বিপদে পড়বেন– আমাকেও ফেলবেন। কোনও মানে হয় না!

কিন্তু ওঁর মুখটা নির্বিকার। মিটিমিটি হাসছেন আর হাসছেন। কী লোক রে বাবা!

সবে পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, মিঃ লালের পড়া শেষ হলো। নোট বইটা বুজিয়ে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। বললেন, বোঝা গেল শ্রীমান চারশো বিশের আগমনের উদ্দেশ্য। ইন্দ্রনাথবাবু, মিঃ শর্মা! আপনাদের সাক্ষ্যের ওপর সব নির্ভর করছে–মাইণ্ড দ্যাট।

ইন্দ্রনাথ বললেন–মিঃ লাল, কী লেখা আছে ওতে বলবেন কি?

মিঃ লাল কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বাধা দিলেন। মিঃ লাল, আবার। আপনাকে, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি। ওই ডায়রি বইটা সৌম্যেন্দুর হত্যকাণ্ডের ব্যাপারে একটা মূল্যবান দলিল।

মিঃ লালের ঠোঁট ফাঁক হলো, কিন্তু কথা বেরুবার আগেই দরজা খুলে ফের সর্বেশ্বরী বেরুলেন। মনে হলো, বৃদ্ধা এতক্ষণ ঘুমোননি। জেগেই ছিলেন। বললেন– মিঃ লাল, ওই ডায়রিটার কথা আমি জানতুম। ওটা আমার স্বামীর ডায়রি। ওতে কী আছে, তা আমার স্বামী অবশ্য কখনও জানাননি–জানতেও চাইনি। এখন মনে হচ্ছে, ওর মধ্যে এমন কিছু আছে–যার জন্য সৌম্যেন্দুর প্রাণ দিতে হলো। ওটা কি আমাকে একবার দেখতে দেবেন?

মিঃ লাল কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন কিন্তু এটা এখন আদালতের একজিবিট হবার যোগ্য। তাই আপনাকে দেখানো যাবে কি?

কর্নেল বললেন–ওঁকে একবার পড়তে দিতে আমার আপত্তি নেই। কারণ উনিই এই হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রধান সাক্ষী হবেন।

–আপনি থামুন! বলে মিঃ লাল সর্বেশ্বরীর দিকে ঘুরলেন। মিসেস রায়, এটা আমার হাতেই থাকবে। আপনি এখানে এসে পড়ে দেখুন।

সর্বেশ্বরী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। মিঃ লাল ডায়রিটা খুলে ধরলেন। কয়েক পাতা পড়ার পর সর্বেশ্বরীর মুখে অদ্ভুত ভাবান্তর লক্ষ্য করলুম। মনে হলো, উনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। আমরা সবাই চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছি।

পড়া শেষ হলে সর্বেশ্বরী কর্নেলের দিকে ঘুরে বললেন-কর্নেল সরকার! আপনি কীভাবে এটার খোঁজ পেলেন বলবেন কি?

কর্নেল বললেন-বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। এই সংকেতটি কি আপনার পরিচিত?

সর্বেশ্বরী ভুরু কুঁচকে বললেন—হ্যাঁ। কেন?

–এর অর্থ কি আপনি জানতেন?

না। কারণ, আমার স্বামী এর অর্থ আমাকে জানাননি। তিনি বেশ কয়েকদিন আমাকে বলেছিলেন–যদি আমি হঠাৎ মারা পড়ি, তুমি C? এই কথাটা মনে রাখবে এবং সৌম্যেন্দুকে জানাবে। ওর সব কথাই ওই রকম হেঁয়ালিতে ভরা থাকত। ভাবতুম ড্রিঙ্কস-এর ঘোরে আবোল তাবোল বকছেন।

–সৌম্যেন্দুকে আপনি জানিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ। ওর মৃত্যুর পর জানিয়েছিলুম। সৌম্যেন্দু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল-কাকামশাইয়ের পাগলামি!

কর্নেল ইন্দ্রনাথকে জিগ্যেস করলেন–আপনি এর আগে C? কথাটা শুনেছিলেন?

ইন্দ্রনাথ গম্ভীরমুখে বললেন না। এখানে আসার পর বঁড়শির মোড়কে লেখা দেখেছিলুম।

কর্নেল সর্বেশ্বরীকে বললেন–মিসেস রায়, লুকোবার কারণ নেই। এবার বলুন তো, আপনিই ইন্দ্রনাথ বাবুর বড়শির মোড়ক বদলে C? লেখা ডায়রির একটা পাতা ও ঘরে রেখেছিলেন কি না?

সর্বেশ্বরী মুখ নামিয়ে জবাব দিলেন–হ্যাঁ। আমার স্বামী যেদিন মারা যান, সেদিনই আনমনে কথাটা অন্য একটা ডায়রির পাতায় আমি লিখেছিলুম। ইন্দ্রনাথ এবার এখানে আসার পর আমার সন্দেহ হলো যে নিশ্চয় একটা কিছু ঘটতে চলেছে–যার কোনও কিছু আমি জানি না। তাই ওই পাতাটা ওর নজরে এনে দেখতে চেয়েছিলুম, ও কী করে।

ইন্দ্ৰনাথ শুকনো হেসে বললেন–অবাক হয়েছিলুম তারিখটা দেখে। কিন্তু ওই কথাটার মানে কী, আমি তো জানতুম না। এখনও জানি না।

কর্নেল মিঃ শর্মার দিকে ঘুরে বললেন–আপনি কিছু জানতেন?

শর্মা অন্যমনস্ক ছিলেন যেন। চমকে উঠে মাথা দোলালেন। ওদিকে মিঃ লাল এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। এবার হাত নেড়ে বললেন–খুব হয়েছে। এটা আদালত নয় এবং ওই লোকটা সরকারী কৌসুলী নয়। সে অধিকার আমি ওকে দিইনি।

সেই সময় বাইরে জিপের গর্জন শোনা গেল। তখন সূর্যের হাল্কা আলো এসে লন পেরিয়ে বারান্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছে। দুটো জিপ দেখা গেল লনে। তারপর ক’জন পুলিশ অফিসার এবং দুজন সিভিলিয়ানের পোশাক পরা ভদ্রলোক জিপ থেকে নেমে বারান্দায় উঠলেন। একজন ঢুকতে ঢুকতে বললেন কই? কোথায় আমাদের মাননীয় কর্নেল সাহেব?…ও হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!

আমি অবাক হলুম না। মিঃ লাল ভীষণ অবাক হলেন নিশ্চয়। কর্নেলের হাত ধরে সেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন–একি কর্নেল সরকার! আপনার এ অবস্থা কেন?

কর্নেল স্মিত হেসে বললেন–ও কিছু না মিঃ আচারিয়া! ও কিছু না! আপনি কেমন আছেন? ইস! দীর্ঘ ছ-সাত মাস পরে দেখা। তাই না?

মিঃ আচারিয়া তখনও অবাক। আমি এবার মিঃ লালের কীর্তি ফাঁস করতে যাচ্ছি, টের পেয়েই কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–মিঃ আচারিয়া, আগে আলাপ করিয়ে দিই আমার এই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে। জয়ন্ত চৌধুরী কলকাতার প্রখ্যাত সংবাদপত্র দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। জয়ন্ত, ইনি আমার এক বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ চন্দ্রমোহন আচারিয়া।

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মিঃ লাল ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছেন এবং সূর্যোদয়ই দেখছেন হয়তো।

হঠাৎ সর্বেশ্বরী বলে উঠলেন–আপনারা বসুন, প্লীজ। আমি আপনাদের কফির ব্যবস্থা করি। কেউ কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা কিচেনের দিকে চলে গেলেন।…

.

ডায়রিতে কী লেখা ছিল, পরে জেনেছিলুম। কিন্তু ঘটনা আগাগোড়া সাজানোর খাতিরে সেটা এখানেই দেওয়া হলো। সংক্ষিপ্তভাবেই বলছি :

জগদীপ রায় একবার বোম্বাইয়ের এক পানশালায় হিগিনস নামে একজন প্রাক্তন ব্রিটিশ যোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হন। হিগিনস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেফটন্যান্ট মেজর ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার পরও তিনি এদেশে থেকে যান। এবং অবসর নেন। হিগিনস বেজায় মদ খেতেন। সেই পানশালায় জগদীপের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় তখন ওঁর প্রচণ্ড মাতাল অবস্থা। তখন জগদীপ ওঁকে ওঁর বাসায় পৌঁছে দিতে যান। হিগিনস ব্যাচেলার ছিলেন। যাইহোক, গাড়িতে নিয়ে যাবার সময় এবং বাসায় গিয়ে নেশার ঘোরে এমন কিছু কথা বলেন, জগদীপের তাক লেগে যায়।

হিগিনস যুদ্ধের সময় মধ্যপ্রদেশের এই এলাকার এক রাজপ্রাসাদে ছিলেন। বলাবাহুল্য বাড়িটি এক দেশীয় রাজার এবং তা ব্রিটিশ সরকার সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দখল করে নেন। সেই বাড়িতে যেভাবেই হোক, হিগিনস এবং তিনজন সহযোদ্ধা মিলে একটি বাক্স পেয়ে যান। বাক্সে সোনাদানা হীরে জহরত ছিল বোঝাই হয়ে। এই গুপ্তধন পাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। সবার চোখ এড়িয়ে এগুলো ভাগাভাগি করা কঠিন। কারণ সেনানিবাসে সব সময় ভিড়। তাছাড়া কাকে কোন মুহূর্তে কোথায় পাঠানো হবে, ঠিক নেই। ধনসম্পদের ভাগ নিয়ে রাখবেন কোথায়? চার বন্ধু মিলে এই চিরিমিরি জঙ্গলে এসে লেকের পশ্চিম উপত্যকায়–যেখানে পরে সীসের খনি খোঁড়া হয়, সেখানে। পুঁতে রাখেন। কথা রইল–যুদ্ধ শেষ হলে ওটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে। ঘটনাচক্রে বর্মা ফ্রন্টে হিগিনস বাদে সবাই মারা পড়েন। হিগিনস ফিরে এসে গুপ্তধনের খোঁজ করেন। কিন্তু তিনবছরের মধ্যে এক ভূমিকম্পে উপত্যকার মাটি ওলটপালট হয়ে গেছে। ফলে হিগিনস খুঁজে বাক্সটা বের করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেন। কিন্তু বাধ্য হয়ে হিগিনসকে থাকতে হলো। এখন তাঁর একমাত্র কাজ, বারবার চিরিমিরি উপত্যকায় যাওয়া এবং অনুসন্ধান।

গুপ্তধনের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড নেশাধরানো লোভ আছে। জগদীপ সেই লোভে পড়ে গেলেন এবং গোপনে একা তল্লাস শুরু করলেন। কিন্তু বারবার ওখানে শিকার কিংবা ছিপে মাছধরার অজুহাত কাঁহাতক দেখানো যায়। বিশেষ করে ক্রমাগত সপ্তাহ কিংবা মাসও লেগে যেতে পারে। অতএব উনি ফন্দি আঁটলেন। অনন্তরাম শর্মা ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খনি ইঞ্জিনিয়ার। ওই উপত্যকায় কোনও খনিজ সম্পদ থাকা সম্ভব বলে মনে হয়েছিল জগদীপের। ওঁর ভাগ্য ভাল শর্মা মাটি পরীক্ষা করে জানালেন, তলায় সীসের খনি আছে। জগদীপ ভূপালের নবাবের কাছে বন্দোবস্ত নিলেন জায়গাটার। খনির কাজ শুরু হলো। কিন্তু সেই গুপ্তধনের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।…….

এরপর জগদীপের নিজের ভাষায় ডায়রির শেষাংশ তুলে দিচ্ছি। তারিখ ১৬ আগস্ট। অর্থাৎ ওঁর মৃত্যুর আগের দিন।

..আজ আমি জীবনের এক ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলুম। শেষ তিনটি পিট সাবধানতার জন্য বুজিয়ে দেওয়া দরকার। তাই শর্মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলুম। শর্মা কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর মাছ ধরতে গেল লেকে। আমি বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এতগুলো বছর আমার বৃথা চলে গেল। এবার ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে এই উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।

….আনমনে বড় সুড়ঙ্গের কাছে যেই গেছি, হঠাৎ দেখি এক আজব মূর্তি। প্রথমে চিনতে পারিনি–পরক্ষণে চিনলুম। হিগিনস! কিন্তু এ কী মূর্তি তার! মাথায় একরাশ চুল, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, পরনে মাত্র একটা ঘেঁড়া হাফপ্যান্ট হাতে বড়বড় নখ, সারা গা নোংরা–খালি পা–সে আমাকে দেখামাত্র অমানুষিকভাবে হেসে উঠল। ও নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে! শিউরে উঠলুম ওর পরিণতি দেখে। তাহলে কি একদিন আমারও ওই পরিণতি ঘটবে?

….হঠাৎ হিগিনস জন্তুর মতো গর্জন করে আমাকে তেড়ে এল। পকেট থেকে। পিস্তল বের করে ছুঁড়লুম। গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো। হিগিনস অমনি ঘুরে সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকল। আমার মধ্যে তখন খুনের নেশা জেগেছে। সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লুম। আন্দাজে গুলি ছুঁড়লুম পাগলের মতো। মনে হলো হিগিনস হাসছে কোথায়। কানের ভুল হতেও পারে।…

….ঠিক করেছি, হিগিনসকে শেষ করতেই হবে। আগামীকাল টর্চ নিয়ে ওই সুড়ঙ্গে ঢুকব। ওকে খুঁজে বের করে হত্যা করব। ও আমার লোভের জন্য দায়ী। ও আমার জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করার মূলে। আজ আমার চোখে শুধু হীরেপান্না জহরতের ঝলমলানি। এ কী অদ্ভুত অভিশাপ! খেতে ঘুমোতে সবসময় ওই গুপ্তধন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঘুমোতে পারিনে–খাওয়া ফেলে উঠে পড়ি। আমার জীবনীশক্তি দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শয়তান হিগিনসই এর জন্যে দায়ী….

বেশ বোঝা যায়, ১৭ আগস্ট হিগনসকে হত্যার উদ্দেশ্যে জগদীপ সুড়ঙ্গে ঢোকেন এবং সম্ভবত হার্টফেল করে মারা পড়েন। ওই মানসিক অবস্থায় এটা স্বাভাবিক ছিল।

সেই সঙ্গে বোঝা গেল সর্বেশ্বরী যে সাধুর কথা বলেন, সে কে। কিন্তু হিগিনস কি এখনও বেঁচে আছেন এবং সুড়ঙ্গে থেকে অভিশপ্ত গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

আর C2 কথার অর্থ কি, কর্নেল আমাকে জানিয়েছে। ওটা দুর্বোধ্য কিছু নয়। ক্যাবিনেট নম্বর টু। ডাইনিংয়ের দেয়াল আলমারির দুনম্বর খোপ। কর্নেল নিছক অনুমানের ভিত্তিতে কাজে নেমেছিলেন এবং অনুমানটা মিথ্যে হয়নি।

আচারিয়া কর্নেলের দুর্দশার কথা শুনে হেসে খুন। ততক্ষণে মিঃ লাল পুরোপুরি বদলে গেছে এবং কর্নেলের উদ্দেশ্যে বারবার বলছেন–খুব দুঃখিত। কিন্তু স্যার, আমার কর্তব্যজ্ঞানই এ জন্যে দায়ী। কর্নেল মিঃ লালের একটা হাত সস্নেহে টেনে নিয়ে তার উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করার পর দেখা গেল, দুজনে পাশাপাশি হাঁটছেন, বসছেন। কর্নেলের এ সব ব্যাপারে জুড়ি নেই। সব অপ্রীতিকর স্মৃতি ঘুচিয়ে দিতে তিনি পটু। অতএব, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছি।

কর্নেল এবং পুলিশ অফিসাররা সবাই ঘাট ঘুরে খনি উপত্যকায় চলে গেলেন। রাতে ভাল ঘুম হয়নি–তাই আমার ক্লান্তি লাগছিল। ভাবলুম ওঁরা তদন্ত করুন– আমি একটু গড়িয়ে নিই।

গড়াচ্ছি, হঠাৎ কানে এল সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথ পাশের ডাইনিংয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। উঠে বারান্দায় গেলুম। তখন অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। একটু পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। সেপাইরা এবং অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিঃ শর্মাকে দেখতে পেলুম না কোথাও। অথচ উনি কর্নেলদের সঙ্গেও যাননি। শরীর খারাপ বলে নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন। সেই ঘরের দরজা খোলা এবং বিছানা শূন্য দেখা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে ডাইনিংয়ের দরজা দিয়ে সেটা আমার চোখে পড়ছিল।

সর্বেশ্বরী তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্দ্রনাথ একটু তফাতে। আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকলুম।

সর্বেশ্বরী। তুমি দেব-দেবতা ভগবান–যার নামই নাও, আমি ও কথা বিশ্বাস করি না।

ইন্দ্রনাথ। আপনার বিশ্বাস করা না করায় আমার কিছু যায় আসে না।

সর্বেশ্বরী। হ্যাঁ, তা তো বটেই। এখন ওকথা বলবে বইকি! মানুষ হয়ে গেছ এখন তো আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু জেনে রেখো, আমার একটি পয়সাও তুমি আশা কোরো না।

ইন্দ্র। নিশ্চয় করি না। আপনার সম্পত্তি যা খুশি করুন, আমি কিছু বলতে চাইনে। কিন্তু দোহাই আপনার, ওই মিথ্যে বদনাম দেবেন না।

সর্বেশ্বরী। একশো বার দেব। সাধুবাবা স্বয়ং আমাকে বলে গেলেন। ফাইলটা তুমিই হাতিয়েছ।

ইন্দ্র। (বিকৃত হেসে) সাধুবাবা! আপনার ওসব গাঁজাখুরি ব্যাপারে আমার কোনওদিন বিশ্বাস ছিল না–এখনও নেই।

সর্বেশ্বরী। (ক্ষেপে গিয়ে) আমি এ ঘর থেকে তোমার পায়ের শব্দ পেয়েছিলুম কাল বিকেলে। উঠে এসে দেখি, তুমি ঝোপের মধ্যে চলে যাচ্ছ।

ইন্দ্র। আপনি পায়ের শব্দ বুঝতে পারেন?

সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় পারি!

ইন্দ্র। তাহলে শুনুন, যাকে দেখেছিলেন সে সৌম্য। আমি তাকে ফলো করে এসেছিলুম। ঝোপের আড়াল থেকে দেখলুম–সে এঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার হাতে কী একটা ছিল দূর থেকে বুঝতে পারলুম না।

সর্বেশ্বরী। আমি বিশ্বাস করি না।

ইন্দ্র। আপনার পা ছুঁয়ে বলব?

সর্বেশ্বরী। না–আমার পায়ে হাত দেবে না। নিজের ছোট ভাইকে খুন করেছে যে, তাকে ……. ।

ইন্দ্র। (আর্তস্বরে) কাকিমা! ওকে আমি খুন করিনি।

সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় করেছ! যদি তোমার ওই কথাটা সত্যি হয় যে ফাইলটা সৌম্য নিয়ে যাচ্ছিল, তাহলে ওটা হাতাতে তুমিই খুন করেছ।

ইন্দ্র। (ভাঙা স্বরে) না না! ফাইলে কী ছিল আমি এখনও জানি না!

সর্বেশ্বরী। তুমি ন্যাকা!

এইসময় দূরে কোথাও গুলির শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠলাম। ফের। কয়েকবার শব্দ হতেই একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। সিপাইরা দৌড়ে ঘাটের দিকে গেল। ইন্দ্রনাথও বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই জিগ্যেস করলেন কী হলো জয়ন্তবাবু?

মাথা নেড়ে দৌড়ে গেলুম ঘাটের দিকে। গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলুম। লেকের জলে অনন্তরাম শর্মা গলাঅব্দি ডুবে রয়েছেন-দুহাত ওপরে তোলা। সবাই হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিঃ আচারিয়া চিৎকার করছেন–উঠে আসুন। বলছি। এক মিনিটের মধ্যে উঠে না এলে আবার গুলি ছুঁড়ব।

শর্মা আর্তনাদ করে বললেন–উঠছি। দোহাই! গুলি ছুড়বেন না। উনি এবার দুহাত তুলে ঘাটের দিকে আসতে থাকলেন। কর্নেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। কাছে গিয়ে বললুম–এই নাটকের অর্থ কী কর্নেল?

কর্নেল বললেন–তুমি এখনও নাবালক, জয়ন্ত! বুঝতে পারছ না কিছু?

কী সর্বনাশ! শৰ্মাই কি সৌম্যেন্দুকে খুন করেছেন?

–হ্যাঁ।

–সে কী! কেন?

–হিগিনসের একটা ফাইল হাতাতে। চলো, বাংলোয় গিয়ে সব বলছি।

তবে শেষপর্যন্ত লেকের জলে সত্যিই মাছ ধরা হলো। তাই না? বলে কর্নেল সহাস্যে সেই ছড়াটা আওড়ালেন; ‘খোকন গেছে মাছ ধরতে…..’

.

ফাইলটার কথা একটু আগে সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথের ঝগড়ার মধ্যে শুনেছি। বাংলোয় ফিরে বাকিটা শুনলুম বিশদ ব্যাখ্যা সহ। সর্বেশ্বরীও সব ফাঁস করে দিলেন।

হিগিনসই সর্বেশ্বরীর সাধুবাবা। কদিন আগে কলকাতা গিয়ে সর্বেশ্বরীকে একটা ছোট ফাইল দিয়ে আসেন। ইন্দ্রনাথ ব্যাপারটা টের পান। কিন্তু এর রহস্যটা কী জানতেন না। তাই কর্নেলের শরণাপন্ন হন। আশ্চর্য, কর্নেল আমাকেও কিছু খুলে বলেননি। যাই হোক, হিগিনস দেশে ফিরে গেছেন। গুপ্তধনের মায়া ত্যাগ করেই গেছেন। ওঁর ফাইলে উপত্যকার একটা ম্যাপ ছিল–১৯৪৩ সালের ম্যাপ। ম্যাপে গুপ্তধনের অবস্থান চিহ্নিত ছিল। কিন্তু ১৯৪৬-এর ভূমিকম্পে সব ওলটপালট হয়ে যায়। তাই হিগিনস বছরের পর বছরখোঁজাখুঁজি করেও পাত্তা পাননি। তাছাড়া বোঝাই যায়, ওঁর ক্রমশ মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল। তা না হলে হয়তো বের করা। অসম্ভবও হত না। জগদীপ তখন ফাইলটা পেলে নিশ্চয় হদিশ করতে পারতেন। এখন সর্বেশ্বরীর ভুল হলো–ফাইলের কথাটা শর্মাকে জানানো। শর্মা তক্কেতক্কে ছিলেন। সর্বেশ্বরী এখানে আসার পর ফাইলটা সতর্কতা হিসাবে সৌম্যেন্দুর বিছানার তলায় রেখে দেন। কারণ, শর্মার মতিগতির ওপর ক্রমশ তার সন্দেহ জাগছিল।

কর্নেল ও শর্মা চলে যাবার পর সর্বেশ্বরী রঘুবীরকে দিয়ে সৌম্যেন্দুকে ডাকতে পাঠান। সৌম্যেন্দু আসতে দেরি করে। সম্ভবত মাছে টোপ খাচ্ছিল তখন। সে একটু পরে এলে সর্বেশ্বরী তাকে বলেন, বিছানার তলায় যেটা আছে–সেটা সে যেন সাবধানে লুকিয়ে রাখে। কারণ, ওটা একটা দামী দলিল।

সৌম্যেন্দু দলিলের ফাইলটা নিয়ে চলে যায়, সে ঘাটে বসে পড়ে দেখার কথা ভেবেছিল। ওদিকে কর্নেল ও শর্মা গর্তগুলোর অন্যমুখ খুঁজছেন। ওই সময় এক ফকে কর্নেলের অজানতে শর্মা ফাইল চুরি করতে চলে আসেন। অভাবিত সুযোগ। সর্বেশ্বরী তখন একা আছেন। দরকার হলে তাকেও খুন করে ওটা হাতাবে। কিন্তু সৌম্যেন্দুর দুর্ভাগ্য, ঘাটে তখন ফাইলটা পড়ছে। শর্মা আগেই কিচেনের ছুরিটা হাতিয়েছিলেন। তাই দিয়ে সৌম্যেন্দুকে খুন করেন। ফাইলটা কেড়ে নেন। জঙ্গলে পাথর চাপা দিয়ে রেখে ভালমানুষের মতো কর্নেলের সামনে আবির্ভূত হন।

ইন্দ্রনাথ তার একটু আগে সৌম্যেন্দুকে বাংলোয় যেতে দেখে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ফাইলটা যে সৌম্যেন্দু নিয়ে আসছে, বুঝতে পারেননি। নিজের ঘরে ঢুকে দেখে আসেন সৌম্যেন্দু বরাবরকার মতো তার জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছে কি না। তার শ্যাওলাভরা জুতোর দাগ আমরা ঘরের মেঝেয় দেখেছি। কালো দাগগুলো শর্মার। শৰ্মা সৌম্যেন্দুকে খুন করার পর ওঘরে একবার ঢোকেন। কারণ, সর্বেশ্বরীর মোড়ক বদলানোটা তারই পরামর্শে। ইন্দ্রনাথের রি-অ্যাকশন জানা। যখন দেখলেন, ইন্দ্রনাথের নজরে মোড়কটা এসেছে এবং সযত্নে রাখা আছে উনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওটা দলা পাকিয়ে ফেলে দেন। তখন খুন করার পর ওঁর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ফাইলটাও লুকোতে হবে। কিন্তু নিজের ঘরে গেলে সর্বেশ্বরীর চোখে পড়বে। তাই তক্ষুনি বেরিয়ে উপত্যকার দিকে চলে যান। ওদিকে কর্নেলও তার দেরিতে সন্দিগ্ধ হতে পারেন।

ইন্দ্রনাথ কিন্তু বারবার ঘাট থেকে উঠে বাংলোর দিকটা দেখছিলেন। অর্থাৎ লক্ষ্য রেখেছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, শৰ্মা চলে যাচ্ছেন। যদি ইন্দ্রনাথ সৌম্যেন্দুর ঘাট হয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো পাশের ঝোপে লাশ পড়ত। কিন্তু সৌম্যেন্দুর চোখে পড়ার ভয়ে তিনি আরও ওপর দিয়ে শর্মাকে অনুসরণ করেন। উঁচু থেকে দেখতে পান, শর্মা কী একটা পাথরের তলায় পুঁতে রাখছেন। গতরাতে সেটা খুঁজতেই গিয়েছিলেন। পান নি।

আজ সকালে অবশ্য ফাইলটা কর্নেলরা উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ম্যাপটা নেই। ওটা শর্মার পকেটস্থ হয়েছিল। কাজেই লেকের জলে ভিজে দুমড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কালি ধেবড়ে গেছে। অতএব গুপ্তধন মানুষের চোখের আড়ালেই থেকে গেল।…..

জানালার নীচে একটা লোক

০১.

ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক
গোরস্থানে সংহত কফিনে…

শ্রীদিগন্ত সেন থামল। এবং তখন সন্ধ্যা ও সবরকম শব্দ খুব বিষাদগ্রস্ত নরমতায় গলে পড়ছে, এমনকি আকাশে কিছু জলহাঁসকেও ‘আঁক আঁক’ ধ্বনিপুঞ্জ নখের আঁচড় দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে দেখছি আমরা–ঠিক ওইভাবেই গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে যায়, হয়তো চারজনের মধ্যে আমিই একা বুকে ও মস্তিষ্কে হিমবাহ চলনশীল টের পাচ্ছি, এ একটা অদ্ভুত সন্ধ্যা চিকনডিহির বাংলোয়।

শুধু শ্ৰীঅমর্ত্য (৩৪), আমাদের দ্বান্দ্বিক তত্ত্ববাদী বন্ধু এবং হার্বার্ট মারকুইসের ভক্ত অমর্ত্য রায় বলে উঠল, বড় সেকেলে–কিন্তু আমরা কেউ-ই বাক্যটা নিলুম না।

কবি দিগন্তের (৩৬) খুনীদের মতো চৌকো চোয়াল, একরাশ চুল পেঁয়াজের শেকড়ের মতো, তামাটে রঙ, ক্ষুদে কুতকুতে চোখে পুরু কাচের চশমা। টকটকে লাল শার্টের নিচে ডোরাকাটা ঢিলে পাতলুন, পায়ে বেঢপ পেতলের বকলেসলাগা চটি। সেই পেতলটা থেকে আলো, চিকনডিহির মাঠে বালির পাহাড়ের চূড়া থেকে যে আলো আসছিল, মুছে যেতে দেখলুম। এবং আমার মনে হল, সত্যি কি ও ত্রিশদশকী বিষাদবায়ুগ্রস্ত প্রেমিক? রাত্রি আমাদের হোস্টও মাননীয় বন্ধু জেলাশাসক শ্রীবিহ্বল মজুমদারের (৪২) বউ শ্ৰীমতী রাত্রি (২৬) দরজার ধারে দাঁড়িয়ে কী দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে বলে চলে গেলেন পর্দার আড়ালে।

মনে হল, কারো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কিছুক্ষণ। এটা কি দিগুর ওই ত্রিশদশকী কবিতা আবৃত্তির দরুণ, নাকি নির্জন চিকনডিহির মাঠের এই প্রাকৃতিক ঘটনাবলী? ঠিক বোঝা গেল না।

এই সময় চাপা স্বরে অমু বলল বিহ্বলকে (ডি এমকে বিহুটিহু বলতে পারা যায় না), লুম্বিনীতে কিছু হল না তো এক কাজ করলে পারতেন–ডক্টর বাগচীর কাছে, মানে এস কে বাগচী, নার্ভ স্পেশালিস্ট যিনি… ।

বিহ্বল একটু হেসে বললেন, সেও হয়ে গেছে। ও কিছু হবার নয়।

আমরা ফের দুতিন মিনিট চুপ করে থাকলুম। হুঁ, কবিতায় কিংবা চিকনডিহির মাঠে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় কী ছিল বা কী থাকে, সব সুবচনীকে ধীরে বইতে হয়। আর কী হিম মস্তিষ্কে! কিছু ভাবতে ভালো লাগে না, কিছু ভালো লাগে না! ঘুলিয়ে যায় যুক্তি ও বিবেক, মরিয়া হতে ইচ্ছা করে অনিবার্যের বিরুদ্ধে। আমি হতভাগিনী রাত্রির কথা ভাবতে চেষ্টা করলুম। রাত্রি আমার নতুনতম আবিষ্কার–এখানে চিকনডিহির বাংলোয় জেলা শাসকের ঘরণী! মুখ তুলে ঘাড় উঁচু করে কষ্টে তাকাতে হচ্ছে তার দিকে। আর ওই রাত্রিকে একদা মাথা নিচু করলেই দেখতে পেতুম–এবং বুকের নিচে। হায়, সে এখন মাথার ওপর কতদূরে! চেনা যায় না, চেনা যায় না!

সেই রহস্যময় রুদ্ধবাক যেন জড়ভরত, ভারত বেয়ারা (আমার নাম-অ ভারত অ-অছি) দুটো সাদা জীনের বোতল রেখে গেল আর পাঁচটা গ্লাস। তিনজনে তাকাতাকি করলুম। রাত্রিও বসবে নাকি? কিন্তু লনে চেয়ার রয়েছে ছটা–একটায় রাত্রি এসে একবার বসেছিল তিন-চার মিনিট। তারপর জানালার ধারে যাই বাবা, এসব পোষায় না, বলে উঠে গিয়েছিল। ডি এম বেচারা সত্যি বড্ড বিব্রত বোধ করছেন স্ত্রীকে নিয়ে। পাগল হলে বেঁধে রাখা যায়, কিংবা রাঁচিটাচিতে রাত্রির অসুখ দুর্বোধ্য। কতকটা হ্যালুসিনেশান আর সিজোফ্রেনিয়ার মাঝামাঝি। তা এতক্ষণে আমাদের যেন চমক লাগল। চেয়ার ছ’টা কেন? গ্লাসই বা পাঁচটা কেন?

বিহ্বল মৃদু উচ্চারণ করলেন, ভারত, বরফ। ভারত-অ চলে গেল শূন্য ট্রে নিয়ে। তখন উনি ঘড়ি দেখলেন কবজির, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সম্ভবত চাঁদ উঠছে– কি না দেখলেন, তারপর রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ গাড়ির শব্দ পাচ্ছেন?

আমরা ব্যস্ত হয়ে কানগুলোতে মন রাখলুম এবং চোখগুলো দিলুম ঢালু হয়ে যাওয়া ধূসর রহস্যময় রাস্তায়। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। হরেক জাতের ক্যাকটাস আর কেয়াঝাড়। আর সরকারী প্রযত্নে খচিত ঝাউবন। বিশ সাল আগে দশ মাইল দূরের সমুদ্রে এসে এতখানি ভূগোল বদলে দিয়েছিল নাকি। সব মাটি ঢেকে বালিয়াড়ি আর টিলা গড়ে উঠেছিল। সরকারী যোজনা তাদের আরও শোভন করেছে। কখনও কখনোও রাষ্ট্রীয় এবং প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সৌন্দর্য প্রয়োজনকে খুন করে। কারণ আমরা তিনজন আসবার সময় পথের গ্রামে প্রচুর পাঁজরের হাড় গুণে এসেছি মানুষ ও জন্তুদের!

কিন্তু তেমন কোনও শব্দ কি শুনলুম? শুধু মৃদুগামী সান্ধ্য বাতাস, দূরের ঝাউবনে, অস্পষ্ট কী স্বর, উড়ন্ত জলহাঁস, ধূসরতা, বালিয়াড়ি জুড়ে বিষাদের নরম শিশির–সেই কবিতাটি ফিরে এল।

ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে–মৃত্যু অনুগামী….

শিউরে উঠলুম। এই কি মৃত্যুর স্বাদ? অনুগামী মৃত্যু কি পা টিপে টিপে সত্যি সত্যি আসছে–ধীর অনুসরণে, বালিয়াড়িতে দীর্ঘ ছায়া ফেলে, তার পায়ের শব্দ ফুটে উঠছে ক্রমশঃ, এই নির্জন সন্ধ্যার বাংলোয়? অথচ মস্তিষ্কে এ কীরকম হিমবাহ স্বপ্নের মধ্যে বিপদ আসার মতো অসহয়তা, এবং যখন শরীর জড়বস্তু ছাড়া কিছু নয়।

কিছুতেই এই ভাবটা ঘুচল না। জিনের গ্লাসটা হোস্টের আগেই তুলে নিলুম অভদ্রতা নিশ্চয় হল কিন্তু যুদ্ধের গোলাগুলির মধ্যেও আত্মরক্ষার উপায় বালায় যে সনাতন বোধ, সে যেন খুঁচিয়ে দিল–তৈরি থাকো, তৈরি হয়ে পড়ো, ঝটপট! আসন্ন যা-যা অনিবার্য, তার জন্যে।

আর কেউ আসবেন নাকি? অমু প্রশ্ন করল।

হোস্ট জেলাশাসকটি বললেন, হু। কর্নেল।

দিগন্ত চেয়ার ছেড়ে সোজা হল।…..কর্নেল! কে তিনি?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এলে দেখবেন, এক অসাধারণ পারসোনালিটি! যে কোনও বয়সের লেডি অর জেন্টলম্যান হোক না, অ্যাটওয়ান্স সে টের পাবে, কর্নেল ইজ এ ভেরি ভেরি গুড কমপানিয়ান! সো চারমিং, সো ইনটেলিজেন্ট, সো মাইটি সেন্স অফ ডিডাকশান ফ্রম দা ফ্যাকটস, সো এলাবোরেট নলেজ অফ ডিটেকশন…..,

মলোচ্ছাই! বাংরেজি ঝাড়ছে দেখি! এ যে মাল না টানতেই গন্ধে বেহেড হয়ে গেল! বিকেলে লোকটা তার মানসিক রুগী বউ (আহা, আমার রাত্রি! আমার রহস্যময়ী রাত্রি!) আর তার এই চাকরি প্রসঙ্গে একটা শব্দ বারবার ব্যবহার করছিল : হামড্রাম একজিস্টেন্স। লালচে চুলওয়ালা লম্বা নাকবিশিষ্ট এই লম্বু ফর্সাগুলো বরাবর ব… নির্বোধ হয় দেখেছি। রাত্রি, হায়, রাত্রির মতো আত্মসচেতন সহস্রচক্ষু সেনসেটিভ মেয়ে তো কম দুঃখে পাগল হয়নি!

কিসের ডিডাকশন-ডিটেকশন বুঝলুম না। অমু স্পষ্টভাষী স্বভাবে আস্তে বলল।

হি ইজ অ্যাকচুয়ালি এ প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।

অফ?

ক্রাইম। বলে খুক খুক করে হেসে বিহ্বল গেলাস তুলে বললেন–চিয়ার্স!

আবার আমার মাথার ভিতর একটুকরো বরফ ধসল। ক্রাইম! স্বপ্নের মতো চেঁচানোর চেষ্টা করে বললুম–কী ক্রাইম?

জেলাশাসক ঠোঁটে হাসি রেখে জবাব দিলেন–মার্ডার! অমনি আরর এই দন্ত জিহ্বা কম্পনকারী ধ্বনিটি বিস্তৃত হতে হতে কোথাও দূরে আরও ভয়ঙ্কর হতে থাকল এবং বালিয়াড়ির মাথায় ঝাউবনে যেন আগুন লাগল। তখন বিহ্বল মজুমদার খিকখিক করে হেসে বললেন, আসছেন। কর্নেল ইজ কামিং!

যেন মহানন্দে পরপর দুটানে গেলাস শেষ করে এবং ফের ভরে ও শেষ করে জ্বলজ্বলে চোখে সেইদিকে তাকালেন। চাউনি দেখে ভয় লাগল। কী নীল, কী জাম্ব!

মার্ডার! বাবার শিউরে উঠলুম। অথচ সবই স্বপ্নের মধ্যে এত অসহায়, কিছু করা যায় না, কারণ উজ্জ্বলতাগুলি বুকে নিল কঠিন শামুক গোরস্থানে সংহত কফিনে।…..

এবং ঠিক সেই সময় ঘর থেকে রাত্রির আর্ত চিৎকার শোনা গেল–তোমরা এস, তোমরা এস! জানালার নিচে সেই লোকটা এসেছে। জানালার নিচে সেই লোকটা?

মুহূর্তে একটা হতচকিত হুলুস্থুল ঘটে গেল এবং তাই স্বাভাবিক ছিল।

আমার ডাইনে, যেখানে দিগু ছিল–তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাউবনের কালো বাসায় তখন লাল চাঁদটা পাখির ডিম ভেঙে যাওয়া ব্যাপার, হলফ করে বলছি ঠিক তাই এবং না হলে সেই লাল থলথলে গোটাটার মধ্যে প্রথমে আমার চোখদুটো তারপর মগজসমেত আমি নিজে আঠালো চ্যাটচ্যাটে বস্তুতে আটকে পড়তুম না অন্তত আধমিনিটের জন্যে! দুদ্দাড় ধুপধাপ অস্পষ্ট শব্দগুলো পরিস্থিতিকে মুচড়ে ভয়ের বস্তায় ভরে ফেলছিল। দিগুর চেয়ারটা পড়ে যেতে দেখলুম, কিংবা আমারটাই–(পরে দেখেছিলুম সবকটা চেয়ারই পড়ে গিয়েছিল টেবিলটা বাদে) অমুর কথা শুনলুম–কী ব্যাপার এবং লম্বা নির্বোধ ভদ্রলোকটি, আমাদের মাননীয় বন্ধু ও হোস্ট, কুসুমগলা লালচে, ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পিছলে যেতে যেতে চেঁচিয়ে উঠলেন–রাত্রি! রাত্রি! ভয় নেই–ভয় নেই! আর আমার তখনও স্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়া মাকড়সার মতো হয়েছে। কিন্তু তাহলে তো চলবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। রাত্রি–আমার রাত্রির ডাক! দ্বিতীয়বার রাত্রি বুক ফেটে চেঁচাল–সেই লোকটা এসেছে। জানালার নিচে সেই লোকটা! বাঁচাও, বাঁচাও! একটু পরে দেখলুম, আমি দিগু আর অমুকে ঠেলে বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ভারি পর্দাটা ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলেছি। কখন লনের ছইঞ্চি খাপি দলদলে ঘাসে সেই আঠালো রঙীন ব্যাপারটা মুছে ফেলে এসেছি, হুঁশ নেই। মুছে ফেলেছি বলার কারণ, এখন আমার শরীর ভীষণ খসখসে শুকনো লাগছিল। আর ডাইনে দুতিন মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলুম ব্যাটাছেলে ভারত-অমুকে-খাকি হাফপ্যান্ট হাফশার্ট থাকায় দুর থেকে বিষাদময় আজকের সন্ধ্যা ও লাল আঠাটার মধ্যে তাকে সনাক্ত করা। কঠিন যে সে একটি সজীব পদার্থ।

ভিতরে কিছু ঘটছিল। নির্বোধ ভদ্রলোকের রাত্রি রাত্রি চিৎকার, দুমদাম শব্দ, রাত্রির চেরাগলায়–বাঁচাও বাঁচাওকরুণ কান্না। দিগু বিকট গৰ্জাল–অ্যাই ভারত, জানালার নিচেটা দেখে এস শীগগির!

অমু বলল, টর্চ! টর্চ নিয়ে যাও!

আমি বললুম– লাঠি! লাঠি!

ভারত করুণ কেঁদে বলল, মুই একা পারিবু না সার! আপুনি আসুন।

তখন অমু, দ্বান্দ্বিক জড়বাদী ও অমর্তে অবিশ্বাসী অমর্ত্য তার বলিষ্ঠ বেঁটে দেহ নিয়ে তার হাত ধরে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিল পূর্বদিক। ঘুরে পেছনে চলে গেল বাংলোটার। তার যাওয়ার মধ্যে খুনে স্বভাবের লক্ষণ ছিল। যেন বিপ্লব এলে এরকম মরণাপ সে দেবে পরিখায় এবং জানালার নীচের লোকটার মতো শ্রেণীশত্রুর চুল খামচে ধরবে। ফের শিউরে উঠলুম।

ঢুকে দেখি সুদৃশ্য হারিকেন ল্যাম্প জ্বলছে এবং এটা বসার ঘর। আমরা দুজনে দুদিকে দৌড়ে গেলুম। সৌভাগ্যবশত, আমি আরেকটা পর্দা ছিঁড়ে (পরে দেখেছি এত ভয় পেয়েছিলুম, কিংবা রাত্রির অসুখের বিরুদ্ধে এত বেশি অবচেতন হিংসা ছিল যে দুটো পর্দা ফেড়ে ফেলেছি) আরেক ঘরে ঢুকে আরেকটা ছোট্ট আলোর গম্বুজ হাতে নিয়ে জেলাশাসককে দেখলুম, অচেতন স্ত্রীর মুখের দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। আমার শব্দ পেয়ে বললেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে!

সামনে বিছানার ওধারে খোলা পর্দা ওঠানো জানালা। তার নিচে অমু ভারতকে দেখতে পেলুম। অমু বলল, কই, কেউ তো নেই! এখানটায় ঘাস বড্ড, বালি থাকলে পায়ের দাগ পাওয়া যেত!

বিহ্বল বললেন, ও কিছু না চলে আসুন! ওর হ্যাঁলুসিনেশা!

অমু জানালায় নাক ঠেকিয়ে বাইরে থেকে নিস্তব্ধ রাত্রিকে দেখছিল। চমকে উঠলুম ওর চোখ দেখে। কী নীল, কী জান্তব! অমু বলেছিল, রাত্রি তার চেনা মেয়ে। আমি কাকেও বলিনি কিছু। তবে দিগুও ইশারা দিয়েছিল, রাত্রিকে সে চিনত। এই চেনাচেনির ব্যাপারটা এইসময় মাথায় এসে মনে হল, আমরা সবাই আজ এক ভয়ঙ্কর নাটকের পাত্রপাত্রী যেন।

হ্যালুসিনেশান! ভুল ঘরে ধাক্কা খেয়ে দিও চলে এসেছিল। এখন সবিস্ময়ে বলল।

হ্যাঁ আজ দুপুর থেকেই এই হচ্ছে। এ নিয়ে চারবার হল। জেলাশাসক বললেন।

আমি বললুম– সেন্ট্রি গার্ড রাখলে ভাল হতো মিঃ মজুমদার।

জেলাশাসক হাসলেন। নাঃ। স্রেফ হ্যালুসিনেশান! এক্ষুণি ঠিক হয়ে যাবে। তারপর সম্ভবত স্মেলিং সল্টের শিশি নিয়ে এলেন হোয়াটনটের মাথা থেকে।…

.

০২.

কিছুক্ষণ পরে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে ফের লনে পৌঁছলুম। ভারত চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করে দিল। এখনও চাঁদ খুব ঝকমক করছে না। রাত্রি এখন আমাদের সঙ্গে। সে হাসিখুশি। পায়ের ওপর পা তুলে দোলাচ্ছে এবং দিগুকে কবিতা শোনাতে বলছে। সেই কবিতাটাই শুনতে চায় সে বারান্দা থেকে নাকি শুনছিল কিছুক্ষণ আগে। দিগু একটু কেসে রেকর্ড বাজানোর ভঙ্গিতে চাপা আবৃত্তি করে গেল

ধীরে বৃও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক–
গোরস্থানে সংহত কফিনে…

হঠাৎ রাত্রি বাধা দিল, দিগম্বাবু! এ কিন্তু আচমকা রসভঙ্গ হলো–যাই বলুন। রাত্রি হেসে উঠল।

দিগু বলল, কেন বলুন তো? (আশ্চর্য, দিগুর চোখদুটও অত নীল কেন? জান্তব কেন?)

বেশ চলছিল। হঠাৎ শামুক গোরস্থান কফিন…এসব কী। যেন পূরবী-তে আচমকা ঝাঁপতালে মালকৌষের আক্রমণ!..রাত্রি মাঝে মাঝে কী চমৎকার সুস্থ ও স্বাভাবিক কথা বলছে! তার স্বামী দুঃখিত মুখে তাকালেন কি তার দিকে? মৃদু চাঁদের গোলাপী আভা ছাড়া আলো নেই–তাই সব দুঃখময় মনে হচ্ছিল।

দিগু বলল, একটা গোরস্থান দেখলুম ওখানে। তাই।

জেলাশাসক জানালেন, হ্যাঁ। দ্যাটস এ ট্রাজিক স্টোরি। ১৯৪২-এ এদিকে অগাস্ট আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ সরকার একদল সোলজার পাঠায়। তারা সেই ভয়ঙ্কর সমুদ্রবন্যায় মারা যায়। তারপর…..বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে কী দেখতে দেখতে ফের বললেন, আশ্চর্য! কর্নেলের গাড়ির শব্দ শুনলুম কতক্ষণ আগে, মনে হলো আলোও দেখেছি–অথচ এখনও আসছেন না তো!

রাত্রি সুস্থ। ও বলল, ওঁর যা অভ্যাস। কোনও বালিয়াড়ির চুড়োয় বসে চাঁদ দেখছেন।

এই সময় ফাঁক পেয়ে তাকে জিগ্যেস করলুম, মিসেস মজুমদার, ইয়ে–আপনি জানালার নিচে যে লোকটা দেখেছিলেন, তার পোশাক কী রকম?

নিশ্চয় ভুল করলুম। কারণ, অমনি রাত্রি ফের সুস্থতা হারাল। সে হি-হি-হি-হি করে এত জোরে হাসল যে চুল খুলে গেল। তার চশমা পড়ে গেল। সে দিগুর দিকে আঙুল তুলে অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল–এর মতো–ঠিক এই ভদ্রলোকের মতো! ওই পোশাক! ওইরকম চেহারা! আমি ওকে আর তাবলে ভয় পাচ্ছিনে। উ–আমি কি কচি মেয়ে? এবং তাতেও ক্ষান্ত হলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে আরও বলল–কী ভেবে এসেছ তোমরা? কী মতলব? এই ডি এম বাহাদুর! এদের অ্যারেস্ট করছ না কেন? এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কী জন্যে এসেছে জানো?

বিহ্বল বিব্রতমুখে টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর কাধ ধরে বললেন, প্লীজ, প্লীজ! রাত্রি, আর নয়। ছি ছি, এ কী করছ তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে ওকে ধরলেন। নিয়ে গেলেন বাংলোর দিকে। আমি প্রচণ্ড অপ্রস্তুত-মুখ নিচু করে বসে রয়েছি। দিগন্ত চাঁদ দেখছে। অমু রাগী-চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে।

তারপর বিহ্বল এলেন। এসে বললেন, নেভার মাইণ্ড! হ্যালুসিনেশান তো সজ্ঞানে হয় না। তবে আশ্চর্য, ও প্রতিবারই জানালার নীচেকার লোকটার যা বর্ণনা দিচ্ছে, তার সঙ্গে দিগন্তবাবুর পোশাক বা চেহারার আশ্চর্য মিল!

দিগন্ত নার্ভাস হেসে বলল, কিন্তু আমি তো বরাবর এখানে আছি। পিছনে যাই-ই নি।

ডি এম বললেন, সেই হচ্ছে মজা। এক মিনিট–দেখাচ্ছি। ডাক্তারদের হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই ভাবছিলুম কিছু করা যায় নাকি। আফটার অল, এ তো মানসিক ব্যাপার। দেন–হুঁ ইজ হার অলটাইম কম্পানিয়ান, তার পক্ষে অনেককিছু করা সম্ভব। আমি তাই হ্যাঁলুসিনেশানের ব্যাপারে পড়াশুনা আরম্ভ করলুম। আশ্চর্য লাগছে–এই একটু আগে মনে পড়ল, আমার কাছে একটা ভালো বই রয়েছে তার এক জায়গায় অবিকল জানলার নিচে একটা লোকের হ্যালুসিনেশান বর্ণনা করা হয়েছে। ভারত! আমার টেবিল থেকে সবচেয়ে মোটা বইটা নিয়ে এস তো।

ভারত তক্ষুনি এনে দিল। এবং একটা হারিকেনও। বিহ্বল পাতা উল্টে খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। আমি টেবিলে আদ্ধেকভরা অসমাপ্ত গ্লাসগুলোর দিকে তাকালুম। এবার একটু উত্তেজনার দরকার। কিন্তু কেউ খাচ্ছে না কেন?

বিহ্বল পড়া শুরু করলেন : বইটার নাম ফেনোমেনোলজি অফ পারসেপসান। লেখক মার্লো পোঁতি। এই যে, ৩৪২ পাতায়।

The hallucination is not a perception, but it has the value of reality, and it alone counts for the victim. The world has lost its expressive force and the hallucinatory system has usurped it. এরপর দেখুন ইয়েস, পেজ aptats 2115 63PS: Hallucination causes the real to disintegrate before our eyes, and puts a quasi-reality in its place. তারপর এই চরম জায়গা–যা অবিকল আমার মিসেস বলছে, She could see a man standing in the garden under her window and pointed to the spot, giving a description to the mans clothes and general bearing, was astonished when someone was actually placed in the garden at the spot in question, wearing the same clothes and the same feature. She looked carefully, and exclaimed, yes, there is someone but it is somebody else!

তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠলুম-আশ্চর্য তো!

সম্ভবত রাত্রি বইটা পড়েছে। সেটা স্বাভাবিক। ও ছিল ফিলসফির ছাত্রী। এ বইটা আসলে বুঝতেই পারছেন নাম শুনে একটা ফিলসফির বই। এবং এই অংশটা পড়েই শী ইজ কোয়াইট ইমপ্রেসড। মাথায় ঢুকে গেছে।

অমু আস্তে বলল–অ্যাণ্ড অ্যাটাকড উইথ হেল। হ্যাঁ চিয়ার্স! সে অধীর হয়ে গ্লাস তুলল।

সবাই তুললুম অসমাপ্ত গ্লাসগুলো। বিহ্বলও চিয়ার্স বলে নতুন দফায় শুরু করার ভঙ্গিতে গ্লাস তুলে ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেলেন।

সেই সময় দূরে গরগর গাড়ির শব্দ হচ্ছিল, চঁদটাও সোনালি হয়ে পড়েছিল কখন, একটা আচমকা জোরাল বাতাস এসে ল্যাম্প নিবিয়ে দিল, তারপর প্রথমে আমিই দেখলুম বিহ্বল মজুমদার পড়ে গেলেন খালি চেয়ারটার ওপর এবং নিঃশব্দে এবং সেই চেয়ারটাও ধুড়মুড় করে ওঁকে নিয়ে উল্টে পড়ল। ওঁর পা দুটো টেবিলের দিকে ছিটকে এল। জিনের সাদা বোতলটা উল্টে পড়ে গেল। তিনজনেই লাফিয়ে উঠলুম একসঙ্গে। মাত্র এক সেকেণ্ড। আমার হাতে লেগে নিভন্ত বাতিটা পড়ে ভাঙল।

তারপর অমু ভারি গলায় ডাকল–মিঃ মজুমদার। মিঃ মজুমদার।

এরই মধ্যে নেশায় ভদ্রলোক টাল সামলাতে পারলেন না? আরও কয়েক সেকেণ্ড গেল। তখন দিগু লাফ দিয়ে এগিয়ে দুকাধ ধরে ওঠানোর চেষ্টা করল ভদ্রলোককে। পরক্ষণে ওঁর মুখে চাঁদের আলো পড়ায় আঁতকে উঠলুম। কষায় ফেনা বুজবুজ করছে। নাকের নিচে কালো দাগটা কিসের–ধাবমান ঠোঁটের দিকে? ও কি রক্ত? আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, রক্ত রক্ত! আর–আরও দেখলুম, চোখদুটো সাদা, ওল্টানো তারা, সে এক ভয়ঙ্কর মুখ।

দিগন্ত চেঁচিয়ে উঠল, ভারত ভারত! আলো লে আও, লাইট! ভারত যে ওড়িয়া, তা সে ভুলে গেছে নির্ঘাৎ।

আমাদের ওপর কার ছায়া পড়ল। আমরা মুখ ফিরিয়ে নোকটাকে দেখলুম। বিলিতি পোশাকপরা লোকটা..মুখে সাদা দাড়ি রয়েছে, মাথায় টাক চকচক করছে জ্যোৎস্নায়, হাতে একটা ছড়ি–এসে বললেন, মাই গুডনেস! মজুমদার! হোয়াট হ্যাপনড?

আমরা কী জবাব দেব? ইনিই তাহলে সেই কর্নেল সরকার–ছনম্বর খালি চেয়ারের লোকটি! হাঁটু দুমড়ে বসে কী সব পরীক্ষা করে মুখ তুলে আমাদের উদ্দেশে বললেন, হি ইজ ডেড। হোয়াট হ্যাপনড?

ডেড! একসঙ্গে তিনটি গলা চিড় খেল।.. মারা গেছেন! সে কী! তারপর একটু নড়ে চড়ে অমু আস্তে বলল, জানি না। গ্লাস থেকে জীনটুকু খেয়েই নাকি এমন হলো?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, রাত্রি! রাত্রি!

কিন্তু রাত্রি ঘর থেকে সেই মুহূর্তে আবার বুক ফেটে কেঁদে উঠল–সেই লোকটা এসেছে! জানালার নীচে সেই লোকটা।

কিন্তু আমরা কেউ এবার নড়ছি। ভারত দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা হেরিকেন ল্যাম্প আনল। তখন বুড়ো মানুষটি ঠিক সামরিক ভঙ্গিতে বললেন, মাই ইয়ং ফ্রেণ্ডস! প্লীজ আপনারা এখান থেকে সরে আসুন। হিয়ার ইজ এ কেস অফ মার্ডার! আই জাস্ট স্মেল। ডোন্ট টাচ এনিথিং। ইস, একটু আগে এলে…ভারত! তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়িতে চলে যাও–এক্ষুণি। কন্টিডিহি থানায় চলে যাও। আমার কথা বলবে। যা সব করার ওরাই করবে। মহিন্দর! এদিকে এস।

মার্ডার! আমরা নিমূর্তি একটু তফাতে ঘাসের মধ্যে পা ডুবিয়ে মড়াটা দেখতে থাকলুম–নাকি রাত্রির জন্য, নাকি ভয়ের জন্য, হতচেতন, শীতল এবং বাকশূন্য। চাঁদটা আবার গলে আঠায় ডুবে যেতে থাকল চিকনডিহির মাঠ। চটচটে জ্যোৎস্নায় কে যেন সুর করে সেই কবিতাটি পড়তে থাকল :

ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায়
আজ বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।

পরে শুনেছিলুম, রাত্রিই আবৃত্তি করছিল তার ঘরে–একলা, কিন্তু কেন যেন বারবার দুট লাইনই কানে আসতে লাগল : উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক/গোরস্থানে সংহত কফিনে…

.

০৩.

চিকনডিহির এই বাংলোয় চারদিকে কয়েক কিমির মধ্যে কোনও বসতি নেই। শুধু পোড়ো শুকনো বালির ঢেউখেলানো মাঠ, বমিং টলা, কেয়াঝাড় ক্যাকটাস, আর মাঝে মাঝে ঝাউবন। বাংলোটা বিলিতী আমলের-যখন এই সব মাঠে শস্য ও শল্প ছিল। একটা গ্রামও ছিল গোরা সৈনিকদের গোরস্থানের পাশে। এখন ধু ধু শূন্য বালিয়াড়ি সেখানে। সব গেছে, বাংলোটা যায়নি। কদাচিৎ কোনও খেয়ালী আমলা এসে থেকে যায়–নির্জনে ফুর্তির জন্যে। দিগুর ভাষায় রাণ্ডীবাজী করতে। বিহ্বল মজুমদার কবিতা অথবা পদ্য লিখতেন। তিনি নির্জনতা ও বন্ধু বান্ধব (রাত্রিকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে মুশকিল) আর মদ্যপান সমেত সাহিত্যালোচনা চেয়েছিলেন। আমন্ত্রণ তাঁরই। রাতটাও হবে জ্যোৎস্নার। বালিয়াড়ি ঝাউবন চাঁদ নগ্ননির্জনতা ওপেন মাইণ্ডের ওপেন টকস অ্যাণ্ড রিল্যাকসেশান অফ টেনশানস! এই ছিল হতভাগ্য কবি ডি এম এর প্রোগ্রাম। আমরা তিনজন পরস্পর বন্ধু–তবু নিজ নিজ সময় এবং ইচ্ছায় একে একে জুটেছিলুম। আমি ২-১৫ মি: বিকেলে–পায়ে হেঁটে। ডি এমএর জীপগাড়ির ড্রাইভার আমাকে চিনতে পারেনি–আমিও কন্টডিহিতে বাস থেকে নেমে নাক বরাবর চার কিমি দিব্যি হেঁটে এসেছিলুম। দিগন্ত জীপে পৌঁছয় আমার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ২-১০ এ। অমুও আসে জীপে, জীপটা তার জন্যে ফিরে গিয়েছিল কডিহি, তখন বিকেল ৩-৩০মিঃ। আর হোস্ট এসেছিলেন সকাল দশটায়।

সেই জীপটাই কর্নেল সরকারের জন্যে পাঠানো হয়েছিল এবং আটকে পড়েছিল। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, দারুণ খামখেয়ালিই বলব–কারণ পথে বালিয়াড়িতে দুতিন ঘণ্টা কাটিয়ে এসেছেন। তার গলায় ঝুলছে ছোট্ট বাইনোকুলার। ওই দিয়ে তিনি এক বিরল জাতের পাখি আবিষ্কার করে আটকে পড়েন। কর্নেল কি অর্নিথোলিজিস্ট? নো, নেভার মাই ইয়ং ফ্রেণ্ডস! বরং ন্যাচারালিস্ট বলতে পারেন–অফ কোর্স, দ্যাটস এ হবি। বার্ডওয়াচিং!

সৌখিন গোয়েন্দা নাকি ভদ্রলোক। বিহ্বল বলেছিলেন। কিন্তু মহিন্দর আর ভারত না ফেরা অব্দি বাংলোর বারান্দায় আমাদের নিয়ে, আশ্চর্য, নির্বিকার গল্পগুজব আর ফাঁকে ফাঁকে ওটা সেটা প্রশ্নও করেছিলেন। কে কী করি, কোথায় থাকি, কখন পৌঁছেছি জেনেও নিলেন। তখন হতভাগিনী রাত্রি হ্যাঁলুসিনেশানের, ঘোরে, মাঝে মাঝে ভুল বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কর্নেল কী কায়দায় ওকে ব্রোমাইড জাতীয় ওষুধ খাইয়ে দিলেন–আমরা লক্ষ্য করেছি। কর্নেল বলেছেন– ও ঘুমোক। সকালে দেখা যাবে কী করা যায় ওকে নিয়ে। তাই রাত্রি নিস্তব্ধ এবং গাঢ় ঘুমে ডুবেছে তার বিছানায়।

সোফাগুলো টেনে আমরা বারান্দায় বের করে বসেছিলুম। কর্নেলই কথা বলছিলেন আসলে। আমরা তিনজন ফ্রিজের ঠাণ্ডায় রাখা তিনটি কালো বোতলের মতো। অন্তত নিজের কথা বলতে পারি। বিহ্বল মজুমদারের মৃত্যুটা যদি খুনই হয়, তাহলে–মাই গুডনেস! আমরা তিনজন–আমরা তিনজনই….।

আর ভাবা যায় না। যতবারই এগোচ্ছি, সামনে দেখছি–একটা অতল গভীর খাদ। চুল শক্ত হয়ে উঠছে। হা–ওই খাদটা মারাত্মক। মানে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ দায়ী কি না–তা নির্ভর করছে জানালার নিচের লোকটার ওপর অর্থাৎ রাত্রির ওপর। রাত্রি আমাদের এখন কম্পাস। কিন্তু কী ছিল সব ইচ্ছে আর কল্পনা–চাঁদ, ঝাউবন, বালিয়াড়ি, নির্জনতা, মদ্যপান! আর কী ঘটে গেল নিয়তির অনিবার্তার মতো! আড়চোখে লনে খোলামেলায় ঘাসে বিহ্বল মজুমদারের মড়াটা দেখছি জ্যোৎস্নায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। অবিশ্বাস্য! এও রাত্রির মতো একটা হ্যালুসিনেশান।

এমন সময় অমু একটু কেসে বলল, কর্নেল, আপনি তো গোয়েন্দা?

বেখাপ্পা হাসলেন কর্নেল।…নাহ্। এও একটা হবি। তা যা বলছিলুম, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনও লোককে হত্যা করার সঠিক সময় খুনী বেছে নেয় কখন জানেন? যখন সেই লোকটি অবচেতন ভাবে তোক কিংবা সচেতন ভাবে–নৈতিক দুর্বল অবস্থায় থাকে। তখনই আঘাত হানলে কাজ সফল হয়। সেজন্যেই দেখবেন– সমাজের ওই স্তরের ওই ধরনের লোক অধিকাংশ সময়ে রক্ষিতা বা প্রেমিকার কাছে। থাকার সময় খুন হয়। বাট হিয়ার ইজ এ কোয়াইট ডিফারেন্ট কেস।…..

অমু সোজা হয়ে বলল, মিঃ মজুমদারের খুনী আমাদের তিনজনের একজন। তাই তো কর্ণেল সরকার? ইট অ্যাপিয়ার্স সো। কিন্তু জানালার নিচে সত্যি সত্যি যদি কাকেও দেখে থাকেন রাত্রি?

কর্নেল হাত তুলে বললেন, সেকথা পরে হবে। অফিসারদের আসতে দিন।

অমু কঁপা গলায় বলে উঠল, দেখুন কর্নেল, আমার দৃঢ় ধারণা–মিঃ মজুমদারের গ্লাসে নিশ্চয় কেউ বিষ মিশিয়েছিল–সে বাইরের লোক। আর মিসেস মজুমদারের ওটা হ্যালুসিনেশান নয়। সত্যি কেউ এসেছিল–যখন আমরা ওঁর চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘরে আসি তখন সে

ওর কথাটা যুক্তিসিদ্ধ মনে হলো। কেড়ে নিয়ে বললুম–সেটাই খুব সম্ভব। আমরা কী উদ্দেশ্যে মিঃ মজুমদারকে খুন করব? তাই না অমু? এই তো সব বালির ঢিবি, ঝোপঝাঁপ রয়েছে। কেউ নিশ্চয় লুকিয়ে থাকতে পারে।

অমু ঘোঁত ঘোঁত করে বলল, আলবত পারে। আমরা মিঃ মজুমদারের শত্রু। ছিলুম নাবন্ধু। আর খুন করতে হলেই বা বোকার মতো এভাবে করব কেন বলুন। কর্নেল? এ তো সুইসাইডাল ব্যাপার। মোডাস অপারেণ্ডিটা.. ।

কর্নেল ফের হাত তুলে বললেন, প্লীজ, প্লীজ। এবং সেই সময় ফের রাত্রির কণ্ঠস্বর শোনা গেল–দিগুর কবিতাটি আবৃত্তি করেছে। কিন্তু দুটো লাইন বারবার ফিরে আসছে তখনকার মতো : উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক/গোরস্থানে সংহত কফিনে…। আমার কান গরম হয়ে উঠছে ক্রমশ। ওই কবিতাটি কেন লিখল দিগু? তখন সত্যি কি নিয়তি তার কল্পনাকে ভর করেছিল? না আকস্মিক যোগাযোগ?

কর্নেল শুনে বললেন, দেখি কী ব্যাপার? বলে দ্রুত উঠে ঘরে ঢুকলেন।

আমরা পরস্পরের দিকে তাকালুম। কিন্তু কিছু বললুম– না। তিন জোড়া নীল জ্বলজ্বলে চোখ শুধু। আমার গা শিউরে উঠল বারবার। জানালার নিচে একটা লোক–দিগুর মতো পোশাক!

রাত্রি বলেছিল। কিন্তু দিগু তো আমাদের সঙ্গেই ছিল তখন। রাত্রি ভুল করেছে, মস্ত ভুল করেছে।

কর্নেল ফিরে এসে বললেন, ঘুমের ঘোরে বলছে। কবিতাটি ভারি অদ্ভুত তো?

দিগন্ত বলল, ওটা আমার লেখা।

তাই বুঝি? আইডিয়াটা বেশ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ঝাউবনের শব্দ শুনেছেন তো? সেই রকম কীসব ইমেজ আসে। বলে কর্নেল দূরের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–ওরা আসছে এতক্ষণে। কিপ কোয়ায়েট। ভয় পাবার কিছু নেই।…

একটু পরেই দুটো জীপ এসে গেল। তারপর বালির ওপর টর্চের আলো পড়ল ঝলকে ঝলকে। একটা জ্বলন্ত হ্যাঁজাকও বের করা হচ্ছিল গাড়ির ভিতর থেকে। দেখলুম, সাত-আটজন পুলিশ অফিসার আর রাইফেলধারী কনেস্টবল আর গলায় স্টেথো-ঝোলানো ডাক্তার এগিয়ে আসছে। এতক্ষণে প্রচণ্ড ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। … সেই উজ্জ্বল আলোয় স্লেটে আঁকা খড়ির স্কেচের মতো দেখাল আমাদের।

কর্নেল লাফ দিয়ে লনে নামলেন। আমরা নড়তেও ভয় পাচ্ছিলুম। লাশটার ওপর কুকুর ও শকুন পড়ল বলা যায়। এগোনো পিছন হাঁটু ভাঁজ, ফিতে মাপজোক। সেই খুটিনাটি ব্যাপারগুলোর দিকে আমার একটুও মন নেই। আমার মন রাত্রির দিকে। এখন একবার রাত্রিকে দেখে আসতে কী যে ইচ্ছে করেছে!

ওঁরা মজুমদারের ভাঙা গ্লাসটা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। বারান্দার নিচে সশস্ত্র সেপাইরা সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আমি আর থাকতে পারলুম না। উঠলুম। অমু চাপা গলায় জিগ্যেস করল, কোথায় যাবি? যাসনে। আমরা খুনের আসামী।

গ্রাহ্য করলুম না। রাত্রি আমাকে টানছিল। নেশার ঝোঁকে ঘরে ঢুকে গেলুম। এত বড় দুর্যোগে রাত্রির পাশে দাঁড়ানো দরকার। তাকে সাহস দেওয়া জরুরী কাজ। রাত্রির ঘরে আলো থাকার কথা–নেই কেন? ছেঁড়া পর্দা তুলতেই চমকে উঠলুম।

জানালা দিয়ে যথেষ্ট আলো পড়েছে চাঁদের। রাত্রির বিছানা খালি–কেউ নেই।

দৌড়ে বেরিয়ে ডাকলুম কর্নেল! কর্নেল। মিসেস মজুমদার বিছানায় নেই।

সবাই একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। তারপর কর্নেল আর একজন অফিসার টর্চ হাতে দৌড়ে এলেন। ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা দেখে নিলেন। অফিসারটি কাদের ডেরেক বললেন, চাকলাদার! এক্ষুণি দুজন সেপাই নিয়ে খুঁজুন। ভদ্রমহিলা লুনাটিক–আই মিন ডি এম-এর স্ত্রী কুইক!

চাকলাদার আর সেপাই দুজনের সঙ্গে আমিও বেঁকের বশে দৌড়লুম। কেউ বারণ করল না। কিন্তু রাত্রির জন্যে আর কিছু সইতে পারছিলুম না। আমার অবচেতনে লুকানো ডিনামাইট প্রেমের পিণ্ড ফেটে আগুন ও আওয়াজ দিচ্ছে। বালিয়াড়িতে উঠে ভাঙা গলায় চিৎকার করলুম, রাত্রি! রাত্রি! ওরা চারিদিকে আলো ফেলতে লাগল টর্চের। কিন্তু কখন আমি একা হয়ে পড়েছি দল থেকে। সামনে জ্যোৎস্নায় নির্জন বালিয়াড়ি ঘুমের দেশের মতো পড়ে রয়েছে। তারপর দেখলুম গোরা গোরস্থানের সেই ভাঙাচোরা মনুমেন্টটা। ওখানেই গোরস্থান। কয়েকপা এগোতেই চোখে পড়ল–কে যেন টলতে টলতে হেঁটে যাচ্ছে! হ্যাঁ– রাত্রি! বালির ওপর এগোতে তার কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। কয়েকটি লাফে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালুম।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে উঠল–না, না! দোহাই তোমার-আমাকে মেরো না। খুন করো না আমাকে!

ধমক দিয়ে বললুম–আঃ কী হচ্ছে! রাত্রি, রাত্রি, শোনো

তার হাত ধরামাত্র সে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করল–কিন্তু গোঁ গোঁ শব্দ হল শুধু–আর তখনই চাকলাদারের জোরালো আলো এসে পড়ল আমাদের ওপর।

অচৈতন্য রাত্রিকে ধরাধরি করে বয়ে আনলুম আমরা।

এসে দেখি রীতিমতো কনফারেন্স বসেছে ভিতরের বড় ঘরটায়। বাইরে অমু বসে রয়েছে। বারান্দায় সেপাইরা, ভারত আর ড্রাইভার দুজন ফিসফিস করে কথা বলছে। অমু চাপা স্বরে বলল, দিগুর স্টেটমেন্ট নিচ্ছে। আমাদেরও নেবে।

আমি ক্লান্ত। রাত্রিকে তার ঘরে নিয়ে গেল চাকলাদাররা। আমি রাত্রির কথা ভাবতে থাকলুম। কেন রাত্রি আমাকে দেখে চমকাল? কী উদ্দেশ্যে সে গোরস্থানে। যাচ্ছিল? আর আমাকে দেখামাত্র কেন অমন করল? কী ছিল আমার চোখে মুখে? সেই অবচেতন ডিনামাইট ফেটে যাবার পরের চিহ্নগুলো বা ভাজ, পোড়া পাথর, উষ্ণতা?

অমুর ডাক এল। সে মার্চ করে ঢুকল যেন। সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল লনে টেবিল সাজানোর সময় যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছিলুম, অমু তখন একবার বেরিয়েছিল। বালির ঢিপির আড়ালে তাকে হারাতে দেখেছিলুম। মাই গুডনেস! ওই ঢিবির ওদিকেই তো কবরখানাটা! তবে কি

না, আর ভাবব না। ভাববার কিছু থাকলে, রাত্রির কথা। রাত্রির বড় দুঃখের দিন এল, নাকি রাত্রির বড় সুখের দিন এল! অনেক টাকা পাবে রাত্রি। ইনসিওরেন্সের টাকা, সরকারী সহায়তাবাবদ টাকা।

কিন্তু হঠাৎ আমার গা ঘুলিয়ে হাসি ঘৃণা রাগ বিরক্তি অস্বস্তির হুটোপুটি বেধে গেল–মুরগির ঘরে শেয়াল ঢোকার মতো অবস্থা। কলকাতার হরকান্ত সেন লেনের তেলেভাজাওয়ালা ভুজঙ্গের সেই পিলেওঠা সুন্দর মেয়েটা যুবক ও কিশোররা বাগে পেলেই যার নতুন স্তনের নরমতার খবর নিত, তার নাম কী ছিল? নিশ্চয় রাত্রি নয়–অন্য কিছু। গোপালী? –গোপালী। গোপালীকে ভুজঙ্গ কলেজ অব্দি পড়িয়েছিল। তারপর গোপালী হলো রাত্রি। থিয়েটারে নেমেছিল কিছুকাল। ফিলমেও অল্পস্বল্প। খুব উঁট হয়েছিল কয়েকটা বছর। ভুজঙ্গ মারা গেছে। ভুজঙ্গের বউ তো গোপালীর দেড় বছর বয়সে মারা যায়। তারপর রাত্রি হিন্দুস্থান পার্কে সঁটের সঙ্গে বাস করত কোন এক মিলন গাঙ্গুলির বউ হয়ে। তারপর সে এক লম্বা কাহিনী। ডি এম কী বেকায়দায় পড়ে ওকে বিয়ে করে ফেলেছিলেন, জানিনে। তারপর মিলন গাঙ্গুলির অবস্থা বোঝা যায়। মাই! মাই! তবে কি সবটাই

না। জানলার নিচের লোকটা স্রেফ হ্যাঁলুসিনেশন। মার্লো পোঁতি লিখেছেন।

ঘৃণা-ঘৃণা জীবনকে থুঃ, থুঃ! রাত্রিকে–থুঃ থুঃ! ছেনাল খানকি বেশ্যাকে থুঃ থুঃ! তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে–থুঃ থুঃ।

সেপাইটা পিছন থেকে বলল, বমিবমি লাগছে স্যার? আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে। দেখলুম। লোকটার চোখে সন্দিগ্ধতা! তারপর আমার ডাক এল।…

.

০৪.

সেই রাত কখন শেষ হলো, বালিয়াড়ির ওপর ফুড়ুত করে উড়ে এল সূর্য, তারপর উড়তে উড়তে চলল আরেক বালিয়াড়ির দিকে–অস্থির গরম কড়াইয়ে অসম্ভব ঠাণ্ডা থেকেও সেদ্ধ ভাজা ভাজা হলুম, সে বর্ণনা দিচ্ছি না। কিন্তু আমরা ভাল খেতে পেয়েছি, শোবার জায়গা না পেলেও। জেলাশাসকের হত্যাকাণ্ড। সরকারের বড় বাড়ি থরথর করে কেঁপেছে। চিকনডিহির বাংলো পুলিশ আর লোজনে থইথই করল সারাদিন। ফোরেনসিক এক্সপার্টরা দফায় দফায় পরীক্ষা করলেন সবকিছু। আমাদের জুতোর ছাপ নিলেন। কেন নিলেন, তা কর্নেল এসে জানালেন যখন আমরা দায়মুক্ত হয়েছি। আর একজন লোক সত্যি ছিল–ওঁরা প্রমাণ নাকি পেয়েছেন সেই জানলার নিচের লোকটি। তাই আমরা বেকসুর খালাস। খালাস তবে সরকারী সাক্ষী হতে হবে।

তখন চিকনডিহির বাংলো বিলকুল ফাঁকা। আমরা বেরিয়ে এসে একটা ঝাউবনের কাছে চুপচাপ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা নিয়ে এবার কণ্টডিহির পথে হেঁটে যাব। সেই সময় নির্জন তালাবন্ধ বাংলোর দিক থেকে কে ডাকল–হ্যালো ইয়ং ফ্রেণ্ডস! চমকে দেখি-কর্নেল সরকার।

আমরা ওঁকে শেষ দলটির সঙ্গে চলে যেতে দেখেছিলুম না? সবটাই রহস্যময় মনে হল। একি কোনও চতুর ফাঁদ পুলিশের? সেই ফাঁদে না পড়ার জন্য আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

এসে হাসি মুখে বললেন, বরং আজ রওনা না দিলেই পারতেন আপনারা। বাংলোর চাবি আমি নিয়েছি। আসুন না, গল্পগুজব করে আর একটা রাত্তির কাটিয়ে দিই। এমন জায়গা ফেলে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

অমু দিগু ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু ইয়ে, খাওয়াটাওয়া…

কর্নেল জোরে হাসলেন।…আমার লোক এসে পড়বে এক্ষুণি। বলা আছে– আজ রাতটা এখানে কাটাব। আসুন। কোনও অসুবিধে হবে না।

দিগু বলল, কিন্তু আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না।

অমুও বলল, হা কী হবে? এমন একটা ইয়ের পর-ওঃ, হরিবল!

আমি বললুম– না কর্নেল, আমরা যাই। ভীষণ খারাপ লাগছে।

কর্নেল গম্ভীর মুখে মাথা দোলালেন, দ্যাটস নথ দা টুথ মাই ফ্রেণ্ডস।

চমকে উঠলুম, কেন? দিগুও ফুঁসে উঠল একই সঙ্গে কী বলতে চান আপনি? আর অমু হাতের মুঠো পাকিয়ে বলল, তাহলে টুথটা কী!

নিজেদের মনকে প্রশ্ন করুন, জবাব পাবেন। কর্নেল ছড়ি দিয়ে বালির ওপর ঢ্যারা এঁকে ফের বললেন, আপনাদের প্রত্যেকের মনে এই চিহ্নটা রয়েছে–জাস্ট এ ক্রস। দুট রেখা যে বিন্দুতে মিলেছে দেখছেন, ওটা হলো মিঃ মজুমদারের মৃত্যু। ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন, তাহলে আমরা চারদিকে চারটে রেখা পেয়ে যাচ্ছি। আপনারা তিনজন তার তিনটে–অ্যাণ্ড দা ফোর্থ..হু ইজ হি? পুলিশ বলছে জানলার নিচের লোকটা। গোরস্থানের দিকে তার জুতোর চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর কী পাওয়া গেছে, জানেন? একটা ভাঙা কবরের কোণায় বালিতে ঢাকা একটা সমুদ্র-শামুক, তখুনি দিগু ছটফট করে বলল, আমি জানতুম–! কিন্তু কিছু বুঝিনি।

১৯৪২ এ এখানটা সমুদ্রের বানে ডুবেছিল। তাই অনেক বড়োবড়ো সমুদ্র শামুক এখানে পাওয়া যায়। খুব কঠিন খোল।–

দিগু কাঁপছিল। বলল, হা-হা, আমার কবিতায়

ওয়েট। কর্নেল হাত তুললেন।…যে কন্ট্রাক্টার সেই যুদ্ধের বাজারে সরকারকে কফিনের কাঠ সাপ্লাই করেছিল, তা বাজে কাঠ। তাই উইয়ের ঢিবিতে জমাট বেঁধে যায়।

দিগু বলল, সংহত কফিনে—

হ্যাঁ। তার মধ্যে শামুক ছিল এবং তার ভিতর লুকানো ছিল উজ্জ্বল স্ফটিকের মতো ভয়ঙ্কর বিষাক্ত পদার্থ ড্রাই এওজিন–যা জলে গলে যায়। বরফের সঙ্গে ভেজাল দিলে ধরা পড়ে না। মিঃ মজুমদারের মৃত্যুর কারণ তাই। ফোরেনসিক এক্সপার্টরা বলেছেন। তা–মিঃ দিগন্ত সেন, আপনি নিশ্চয় কোনওভাবে ওটার কথা। জানতেন, কবিতার মাধ্যমে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো কাকেও সতর্ক করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পুলিশকে বলেননি। আর পুলিশ কবিতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বিশেষ করে একালের কবিতা!..হেসে উঠলেন কর্নেল।

আমি বললুম– তাহলে কোন ফাঁকে খুনী মিঃ মজুমদারের গ্লাসে ড্রাই এওজিন রাখল?

আপনারা যখন মিসেস মজুমদারের চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়েছিলেন, তখন।

কিন্তু ভারত তো বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল।

লোকটা রাতকানা। আর তখন জ্যোৎস্নাও ছিল ক্ষীণ। তাছাড়া ওই ব্যস্ততা আর আতঙ্কের সময় লনের দিকে তাকানোর কথা তার নয়। সে ভাবছিল–মেমসাহেবের ঘরে ঢুকবে কি না।

দিগু বলল, জীপে আসবার পথে দূর থেকে একটা লোককে বালি সরাতে দেখেছিলুম ওই গোরস্থানে। সন্দেহ হয়েছিল। পরে এক ফাঁকে ওদিকে যাই। কিন্তু তখনই আমার কিছু কথা মনে পড়ে যায়। থমকে দাঁড়াই। একটু ভাবি। কোনও ফাঁদে ফেলবার জন্যে আমাকে এখানে ডাকা হয়নি তো? যাইহোক, গিয়ে ব্যাপারটা আবিষ্কার করি। কিন্তু আমি ভেবেছিলুম-ডায়মণ্ড স্মাগলিং, এর ব্যাপার।

এই সময় অমু বলল, আমি তোকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কবরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তারপর আরও অদ্ভুত ভঙ্গিতে তুই চলে এলি। প্রতিটি জুতোর ছাপ মুছতে মুছতে!

দিগু বলল, হ্যাঁ–ফাঁদে পড়ার ভয়ে।

কর্নেল বললেন, ফাঁদ! রাইট, রাইট। বাই এনি চান্স–মিঃ সেন, রাত্রিদেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল?

ভীষণ ছিল–হিন্দুস্থান পার্কে থাকার সময় থেকে।

এগেন বাই এনি চান্স বিহ্বলবাবু আসতে বলার পর রাত্রিদেবী আপনাকে কিছু লিখেছিলেন? ভয় নেই–আমি প্রাইভেট হ্যাঁনড। পুলিশ নই।

হ্যাঁ। সাংঘাতিক একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

যেমন?

মিঃ মজুমদারকে কোনও এক ফাঁকে খুন করতে হবে। তারপর রাত্রি আমার হবে।

আপনি সেই মতলব নিয়ে এসেছিলেন?

হুঁ।

আমি কাঁপছিলুম। রাত্রি! রাত্রি! কী সর্বনাশ, কী ধুরন্ধর! দিগুকে সে…।

অমু বলে উঠল, আশ্চর্য! কর্নেল! কর্নেল! রাত্রি আমাকেও তাই লিখেছিলেন। আমিও মিঃ মজুমদারকে খুন করতে এসেছিলুম। ঠিক একই পুরস্কার রাত্রি আমার হবেন।

কর্নেল আমাকে প্রশ্ন করলেন, অ্যাণ্ড মিঃ সকাল গুপ্ত?

গলা কাঁপল জবাব দিতে।…হ্যাঁ। আমাকেও। কিন্তু দ্যাট ইজ অ্যাবসার্ড, অসম্ভব।

দিগন্ত অস্থির হয়ে বলল, আমি তো খুন করিনি! এখানে এসে বিহ্বলবাবুকে খুন করার কথা আর ভাবতেও পারছিলুম না। সেটা হয়তো ভীষণ ভয়ে। জীবনে কখনও কারো গায়ে হাত তুলিনি। প্রেম আমাকে মানুষ খুন করাবে–প্রেমের এত বড় মর্যাদা দেবার সাহস আমার ছিল না।

কর্নেল বললেন, বাদশা জাহাঙ্গীর এবং শের আফগানের স্ত্রী নূরজাহানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! ভালমন্দ যাই হোক, জাহাঙ্গীর প্রেমের ঐরকম মর্যাদা। দিয়েছিলেন।

অমু বলল, বিশ্বাস করুন। হয়তো পারতুম, কিন্তু ওইভাবে কাপুরুষের মতো নয়। মদ খেয়ে বিহ্বলবাবুকে টেনে নিয়ে যেতুম বালিয়াড়িতে–তারপর গলা টিপে মারতুম। এই ছিল আমার প্ল্যান।

আমি বললুম– হ্যাঁ–ওইভাবে খুন করা নীচতার পরিচয়, প্রেমিকের নয়। প্রেমিক ডুয়েল লড়বে। ওইভাবে বিষ খাইয়ে কাপুরুষের মতো মারে যে–সে প্রেমে নয়, প্রতিহিংসায় উগ্র।

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে দেয়ার ওয়াজ এ ফোর্থ প্রেমিক–তাকেও চিঠি লিখেছিলেন রাত্রি, দ্যাটস মাই পয়েন্ট।

তিনজনে একসঙ্গে বললুম– হ্যাঁ। ঠিকই।

কিন্তু কে সে? কোথায় গেল সে? গোরস্থানে জুতোর ছাপ রেখে সে রাত্রিদেবীকে ফেলে কোথায় পালালো বলুন তো?

তিনজনে ঘাড় নাড়লুম। জানি না। সেই সময় কর্নেল একটা অদ্ভুত কথা বললেন। বিহ্বলবাবু তাকে নাকি আসতে বলেছিলেন, কী একটা রহস্যময় ব্যাপার ঘটছে বলে তার সন্দেহ। সেটা এখানেই নাকি ঘটছে ঘটতে পারে কর্নেল উপস্থিত থাকলে সেটার রহস্য ফাঁস করার আশা আছে। বিহ্বলবাবু তা নিয়ে খুব ধাঁধায় পড়েছেন। বিহ্বলবাবুর দুর্ভাগ্য!

তারপর স্তব্ধতা ভেঙে আমি বললুম– কাল রাত্রে রাত্রি গোরস্থানের দিকেই যাচ্ছিলেন। কেন, অনুমান করতে পারেন কর্নেল?

কর্নেল জবাব দিলেন, নিশ্চয় ড্রাই এওজিনভরা শামুকটা ফেলতে। কারণ দিগন্তবাবু যেভাবে হোক কিছু আঁচ করেছেন–এটাই ভেবেছিলেন উনি। তাছাড়া দিগন্তবাবু যে ওটা আবিষ্কার করেছেন, এটাই তো ওঁর পক্ষে বিপজ্জনক ঘটনা। সব প্ল্যান ভেস্তে যেতে পারে। তবে ভেস্তে যায়নি। এর কারণ, দিগন্তবাবু বিষকে হীরে ভেবেছিলেন–স্মাগলিং অ্যাফেয়ার।

দিগন্ত বলল, তাহলে রাত্রি মাত্র একজনকেই প্রেমিক হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। তার জন্যেই কি তিনি ওই সাংঘাতিক জিনিসটা লুকিয়ে রেখেছিলেন?

কর্নেল বললেন, তাই দাঁড়ায়। আততায়ীর প্রেমিকটিকে তিনি চিঠিতে জানিয়ে থাকবেন–

বাধা দিলুম–তা কেন? তাহলে তো তিনি যে কোনও সময় স্বামীকে ওই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারতেন!

তাতে বিপত্তি ছিল, মাই ইয়ং ফ্রেণ্ড! তার চেয়ে নির্বাচিত প্রেমিকাকে দিয়ে কাজ করিয়ে অন্য প্রেমিকদের ওপর দায় চাপানো এবং সেই সঙ্গে নিজেও নিরাপদ থেকে যাবার উপায় তিনি বের করেছিলেন। তার অসুখ তো ভান–অভিনয় মাত্র। তিনি আততায়ীকে গ্লাসে বিষ রাখার সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। ব্রোমাইড খাইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় আমি তো টের পেয়েছিলুম। সম্ভবত বিহ্বলবাবুও একটা কিছু আঁচ ইতিমধ্যে করেছিলেন তাই আমাকে আসতে লিখেছিলেন। আমার দুর্ভাগ্য।

কথা বলতে বলতে সূর্য ডুবে গেল। কর্নেলের লোকটি সাইকেল চেপে এসে পড়ল। কিন্তু আর কেন থাকব? আমি বললুম–আমার থাকার উপায় নেই। কাজ আছে। আমার এখানে থাকতে একটুও ইচ্ছে করছে না।

দিণ্ড পা বাড়িয়ে বলল–ক্ষমা করবেন, কর্নেল। আমি যাই। তারপর আমাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে লম্বা পায়ে চলে গেল।

অন্তু ইতস্তত করে বলল, যাবি সকাল থেকে যা না।

ক্রমশ একটা গভীর অন্ধ জেদ আমাকে পেয়ে বসছিল। কী ব্যর্থতা চারিদিকে! রাত্রিকে–যা বোঝা গেল, গ্রেফতার করা হবে এবার। প্রচণ্ড শূন্যতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার ওপর। রাত্রি-মোহময়ী রাত্রি! বললুম– না রে! আমি যাই। চলি কর্নেল। কর্নেল আর অমু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

একেই বলে গোধূলিকাল। রাস্তা ছেড়ে সোজা যে পথে এসেছিলুম, চললুম। বালিয়াড়ি ও ঢিবিগুলো ডিঙিয়ে। দিগুকে ধরা দরকার। কিন্তু তাকে রাস্তায় কোথাও দেখতে পেলুম না। এখানে ওকে খুঁজে বের করা কঠিন।

একটু পরে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালুম। হাঁটু দুমড়ে যেন ক্লান্তি আমাকে চাপ দিল। টেনে ধরল বালির স্তূপ।….

তারপর পিছনে হঠাৎ দিগুর কণ্ঠস্বর শুনলুম–সকাল! ও কী করছিস?

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

সকাল, কাল আসবার পথে কবরে তুই

অমনি বালি মাখানো বড় ছুরিটা তুলে লাফ দিলুম তার দিকে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, কর্নেলের মিলিটারি আওয়াজ এল ঢিবির ওপর থেকে–খবদার! হাত ওঠান–হ্যাণ্ডস আপ!

আমি হুমড়ি খেয়ে বালির ছোট্ট স্কুপের পাশে সদ্য বেরকরা একজোড়া জুতো আর প্যান্টশার্ট বুকে চেপে, ছুরিটা সুদ্ধ আঁকড়ে ধরলুম। তারপর দৌড়ে যেতেই দিগু আমাকে পিছন থেকে চেপে ধরল। কর্নেল কাছে এসে বললেন, এইরকমটি আশা করেছিলুম।

না, কর্নেল একা নয়–অমু এসেছে। সে জুতোদুটো দেখে চেঁচাল–এই তাহলে চার নম্বর লোক!

না, আরও সব আসছে। পাঁচজন পুলিশ উঁচু বালিয়াড়ি দিয়ে নেমে আসছে আমার দিকে। আমি হাহাকার করার মতো বুক ফাটিয়ে গলা ভেঙে চেঁচিয়ে উঠলুম–আমি মিলন গাঙ্গুলী, দা ফোর্থ ম্যান। একই শরীরে থার্ড অ্যাণ্ড ফোর্থ ম্যান। সকাল গুপ্ত এবং মিলন গাঙ্গুলী। আমার স্ত্রী রাত্রিকে ফিরে পাবার লোভে মজুমদারকে খুন করেছি। তোমরা আমাকে মেরে ফেলল! লাথি মারো! আমি শালা মিলন গাঙ্গুলী…. কে আমার মুখে থাবার মতো হাত রাখল।

একটু পরে সবাই আস্তে আস্তে চলেছি রাস্তার দিকে। কর্নেল সরকারের গত রাত থেকে পেতে রাখা এত বড়ো ফাঁদটা টের পেয়েও পাইনি। আসলে আমার উপায় ছিল না। কিন্তু কী হবে বেঁচে? জীবনে এত ঘৃণা নিয়ে বাঁচা যায় না। কাল রাতে ওই ঘৃণাই রাত্রিকে খুন করবার জন্য তার গলায় আমার হাত উঠিয়েছিল– কিন্তু পুলিশের আলো তাতে বাধা দিয়েছিল।

তখন চিকনডিহির মাঠে সন্ধ্যা নেমেছে। পাশের ঝাউবনে চাপা শনশন শব্দে একটা বাতাস আসতে শুনলুম। আর স্তব্ধ মিছিল, বালিয়াড়ি, ওপরের হাঁস ও মৃদু ধূসরতা মিলে বিশাল একটা নির্জনতাই ফুটে উঠল। সেই বিষণ্ণ নির্জনত ঝাউবনের বাতাসটাকে বলতে থাকল :

ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী….

জিরো জিরো জিরো

আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ঘরে ঢুকেই আমি হতবাক। তিনি চাঁদের হাট বসিয়ে মৌজ করছেন। এ যে জলে শিলা ভেসে যায়, বানরে সঙ্গীত গায়, দেখিলেও না হয় প্রত্যয়!

না, কর্নেল মোটেও বদমেজাজী মানুষ নন। কিংবা প্রেমে ব্যর্থ, তাই নারী বিদ্বেষী গোঁয়ার গোবিন্দও নন। বরং সুরসিক বলে খ্যাতি আছে ওঁর। বিশেষ করে সুন্দরী যুবতীদের প্রতি ওঁর পক্ষপাতদুষ্ট স্নেহ সুপ্রচুর। কিন্তু, আমার বিস্ময়ের কারণ অন্য। ইলিয়ট রোডের এই অ্যাপার্টমেন্টে অনেকদিন ধরে যাতায়াত করছি, কখনও কোনও সুন্দরী যুবতীকে এখানে পদার্পণ করতে দেখিনি, তা নয়। সচরাচর বেশি যাঁরা আসেন, তাঁরা রাশভারি মানুষ সব। বিষয়ী এবং কেজো প্রকৃতির লোক। কোনও না কোনও গূঢ় মতলব নিয়েই তারা আসেন।

আজ যাদের দেখছি, এরা একেবারে উল্টো প্রকৃতির। এক পলকেই আন্দাজ করেছি–খবরের কাগজের রিপোর্টারের অভ্যাসলব্ধ চাতুর্যেই, এরা সংখ্যায় তিন এবং আঠারো থেকে বাইশটি বসন্ত ঋতু দেখেছে। প্রত্যেকেরই চেহারায় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিকণ মেদ ও শ্রী পরিস্ফুট। এরা কথায় কথায় প্রচুর হাসছে। প্রচুর কথা বলার চেষ্টা করছে। এবং কর্নেল হংস মধ্যে বক যথা বসে আছেন।

আমাকে দেখেই অবশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধতা জাগল। তারপর কর্নেল খুব খুশি দেখিয়ে বলে উঠলন–হ্যাল্লো ডার্লিং! এসো, এসো তোমার কথাই ভাবছিলুম।

নিছক মিথ্যা, তাতে ভুল নেই। গম্ভীর হয়ে সামান্য দূরে একটা গদীআঁটা চেয়ারে বসে পড়লুম। তারপর বললুম–আমার কথা ভাববার ফুরসৎ পাচ্ছিলেন এতে সন্দেহ আছে।

কর্নেল হাততালি দিয়ে উচ্চহাসি হাসলেন। ব্র্যাভো জয়ন্ত! ঠিকই বলেছ।

যুবতী তিনটি আমাকে দেখছিল। আমি সামনের টেবিলে চোখ রাখলুম। তারপর কর্নেলকে বলতে শুনলুম–মাই ডিয়ার লেডিস অ্যাণ্ড জেন্টলমেন……

একজন মেয়ে বলে উঠল কর্নেল কর্নেল! এখানে জেন্টলম্যান কিন্তু একজনই।

অন্য একজন বলল–সোনালী, তুই কিছু বুঝিস না। কর্নেল নিজেকেও কাউন্ট করছেন যে!

আবার প্রচুর হাসিতে ঘর ভরে গেল। কর্নেল গলা ঝেড়ে শুরু করলেন–যাই হোক, পরিচয় করিয়ে দেওয়া গৃহকর্তা হিসেবে আমার কর্তব্য ইনি হচ্ছেন, দৈনিক সত্যসেবকের স্বনামধন্য জয়ন্ত চৌধুরী।

আমার চোখের ভুল হতেও পারে, হয়তো ইচ্ছাকৃত চিন্তা বা উইশফুল থিংকিং গোছের কিছু মনে হলো ওদের চোখে বিস্ময় মেশানো শ্রদ্ধা ফুটে উঠল।

–আর জয়ন্ত, ইনি সোনালী ব্যানার্জি, ইনি রত্না চ্যাটার্জি–সোনালীর মাসতুতো বোন। আর ইনি দীপ্তি চক্রবর্তী। দুজনের বন্ধু, সহপাঠিনী। এঁরা কিন্তু কেউ কলকাতার বাসিন্দা নন। রানীডিহি নামে প্রখ্যাত পার্বত্য শিল্পাঞ্চলে সম্প্রতি একটি তৈলশোধনাগারও গড়ে তোলা হয়েছে। শ্রীমতি সোনালীর বাবা শ্ৰীঅনিরুদ্ধ ব্যানার্জি তার ডিরেক্টর। আমার বিশেষ স্নেহভাজন বন্ধু। এবং…..।

সোনালী হাত তুলে হাসতে হাসতে বললকর্নেল, যথেষ্ট হয়েছে। আমরা কেউই জয়ন্তবাবুর মতো খ্যাতিমান নই। অত বলার কিছু নেই।

কর্নেল হতাশ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন এবং চুরুট ধরালেন। কর্নেলের ভাষণের মধ্যেই আমরা পরস্পর নমস্কার পর্ব সেরে নিয়েছি। এবার আমিও সিগারেট ধরালুম। এই সময় চোখে পড়ল, ওরা মহিলাসুলভ সতর্ক ভঙ্গিতে কিছু বলাবলি করছে–সেটা চোখের ভাষাতেই, এবং তাদের লক্ষ্য যে আমি, তাতে কোনও ভুল নেই। তারপর সোনালী কর্নেলের দিকে তাকাল, ঠোঁটে চাপা কুণ্ঠিত হাসি কর্নেল! জয়ন্তবাবু যদি কিছু মনে না করেন… ।

ধুরন্ধর বৃদ্ধ খুশি হয়ে বলে উঠলেন–কিচ্ছু মনে করবে না ও। সোনালী, তুমি ওকে স্বচ্ছন্দে তোমার জন্মদিনের নেমন্তন্নটা করতে পারো। বরং জয়ন্তের মতো একজন প্রাণবন্ত যুবক থাকলে তোমাদের অনুষ্ঠানের ষোলোকলা পূর্ণ হবে।

আবার হাসির ধূম পড়ল। সোনালী তার ব্যাগ থেকে একটা সুদৃশ্য কার্ড এবং খাম রে করে সযত্নে আমার নাম লিখল। লিখে আমার কাছে এসে বিনয় দেখিয়ে বলল–হয়তো অডাসিটি হচ্ছে, তবু আপনাকে পেলে আমি–আমরা সবাই খুব খুশি হবো। প্লীজ, আসতে ভুলবেন না।

একটু দ্বিধা দেখিয়ে বললুম–কিন্তু মুশকিল কি যানেন? রিপোর্টারের চাকরি করি। কখন কোথায় কোন অ্যাসাইনমেন্ট এসে কাঁধে চাপে বলা যায় না!

কর্নেল প্রায় ধমক দিয়ে বলে উঠলেন–জয়ন্ত, বাজে বকোনা! রানীডিহি এবং আমার কন্যাবৎ এই মেয়ে দুটোই মর্ত্যের এক দুর্লভ বস্তু। সুতরাং কোনওরকম বাচালতা না করে কার্ডটি পকেটেস্থ করো। এবং তোমার ক্ষুদে রিপোর্টিং বহিটি বের করে তারিখটা লিখে রাখো। লেখ, ১৭ সেপ্টেম্বর, সকাল সাড়ে সাতটায় হাওড়ায় ট্রেন। দশ নম্বর প্লাটফর্ম। আমার বাসায় আসার দরকার নেই। কারণ, তাহলে তুমি ট্রেন ফেল করবেই। তারও কারণ, তুমি লেটরাইজার।…..

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ওরা চলে গেল। তখন কর্নেলের কাছে গিয়ে বসলুম। বললুম–হ্যালো ওল্ড ম্যান! এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কী?

–কিসের?

–এই নিছক একটি মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের তিনশো কিলোমিটার ভ্রমণের?

কর্নেল চোখে মুগ্ধতা ফুটিয়ে বললেন–জয়ন্ত, ডার্লিং! রানীডিহির সৌন্দর্য তুলনাহীন। মর্ত্যের স্বর্গ।

–হাতি! আমি শুনেছি, রানীডিহি শিল্পনগরী। আকাশ বাতাস কুচ্ছিত ধোঁয়া আর গ্যাসে ভরা। নরক বিশেষ।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু সোনালীদের কোয়ার্টার যেখানে অবস্থিত, সেখানে গেলে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নমুনা তুমি পাবে। নদী, পর্বতমালা, অরণ্য…

–এবং দুর্লভ প্রজাপতি পাখি কীটপতঙ্গ!

–ডার্লিং, আমি কথা দিচ্ছি, এবার আমি প্রকৃতিবিদ হিসাবে রানীডিহি যাবো না। যাবো…

ওঁকে থামতে দেখে বললুম–হুঁ, বলুন।

–যাবো আমার আসল মূর্তিটা পোশাকের তলায় লুকিয়ে নিয়ে।

–তার মানে?

–প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার হিসেবেই।

চমকে উঠে বললুম–সে কী! কেন?

কর্নেল চোখ বুজে দুলতে দুলতে বললেন–একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে জয়ন্ত। এটা না ঘটলে শ্রীমতী সোনালীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমি অতদূরে কিছুতেই যেতুম না। স্বীকার করছি, জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি আছে। কিন্তু তার চেয়েও একটা জরুরী বিষয় সম্প্রতি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তোমাকে আগাগোড়া সবটা বলছি। ভাল করে শোনো।

কর্নেল আমাকে যা শোনালেন, তা সংক্ষেপে এই: এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ৩রা সেপ্টেম্বর সোনালীর বাবা অনিরুদ্ধবাবু কর্নেলের সঙ্গে দেখা করেন। তারও দুদিন আগে রানীডিহিতে ওঁর কোয়ার্টারে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে, তাই কর্নেলের পরামর্শ চাইতে আসেন। সেদিন ছিল রবিবার। বেলা একটায় লাঞ্চের পর উনি অভ্যাস মতো গড়াচ্ছেন, পরিচারিকা এসে খবর দেয় যে এক ভদ্রলোক জরুরী ব্যাপারে দেখা করতে এসেছেন। অনিরুদ্ধবাবু বিরক্ত হন। এটা দেখা করার সময় নয়। তাছাড়া উনি কোয়ার্টারে অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। অফিসেই যেতে বলেন। পরিচারিকা সব জানে এবং বুঝিয়ে বলা সত্ত্বেও সেই লোকটি শোনেনি। বলেছে, দেখা না করলেই চলবে না। এবং এই দেখা করার পিছনে নাকি অনিরুদ্ধবাবুরই বিশেষ স্বার্থ আছে। অনিরুদ্ধবাবু বিরক্ত হলেও কৌতূহল দমন করতে পারেননি। তাই বলেন–ঠিক আছে, তুমি আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলল। এই আধঘণ্টা ভাতঘুম বাঙালীর মজ্জাগত এবং অনিরুদ্ধবাবু মনে মনে ভীষণ বাঙালী। যাইহোক, পরিচারিকা গিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে বললে সে ততক্ষণ সময় কাটানোর জন্যে একটা বই চায়। এটাই অদ্ভুত যে সে অন্য কোনও বই পছন্দ করেনি। আলমারিতে পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি নামে প্রকাণ্ড ইংরেজি বই ছিল, সেটাই চায়। তারপর পরিচারিকা বইটি তাকে দিয়ে চলে আসে। আধঘণ্টা পরে অনিরুদ্ধবাবু ড্রয়িং রুমে যান। কিন্তু লোকটিকে দেখতে পান না। টেবিলে সেই বইটি পড়ে থাকতে দেখেন। বইটি রাখতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করেন, একটা ভাজ করা কাগজ উঁকি মারছে ফাঁকে। কাগজটা খুলে পড়ার পর হতভম্ব হয়ে যান উনি। তাতে ডটপেনে ইংরেজিতে লেখা আছে : যা বলতে এসেছিলুম, বলা হলো না। ওরা আমাকে ফলো করে এসেছে টের পেলুম। তাই চলে যাচ্ছি। আজ রাত এগারোটায় আপনি জলের ট্যাংকের পিছনে আমার সঙ্গে দেখা করুন। আমি সেখানে থাকব। আপনি কাকেও দেখামাত্র বলবেন–জিরো নাম্বার? সে যদি বলে–জিরো জিরো জিরো, তাহলে জানবেন সে আমিই। অন্য কিছু ঘটলে তখুনি পালিয়ে আসবেন। জিরো জিরো জিরো। ভুলবেন না।

নামের বদলে তিনটে শূন্য বসানো। বলা বাহুল্য, অনিরুদ্ধ এই অদ্ভুত চিঠি পেয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। ভাবেন, পুলিশের কাছে যাবেন। কিন্তু শেষ অব্দি কৌতূহল তার সব মতলব দাবিয়ে রাখে। যথাসময়ে সেই জলের ট্যাংকের কাছে যান। জায়গাটা খেলার মাঠ ও বড় রাস্তার সঙ্গমে রয়েছে। কিছু ঝোপঝাড় ও পাথরও আছে। উনি গিয়ে একটা লাশ দেখতে পান। পিঠে ছুরিমারা হয়েছে। তখনও রক্ত তাজা। সুতরাং ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসেন।

সকালে লাশটার খবর পেয়ে পুলিশ আসে। অনিরুদ্ধবাবু নিজেকে এ ব্যাপারে জড়াতে চাননি। লোকটাকে সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। যাইহোক, অনিরুদ্ধবাবুর মনে পড়ে যায় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা। পরদিনই কলকাতা এসে দেখা করেন। সেই চিঠিটাও নিয়ে আসেন।

কর্নেল এই সাতটা দিন কি সব করেছেন, আমাকে কোনওরকম আভাস দিলেন না। শুধু বুঝলাম, হঠাৎ এই প্রখ্যাত ব্যক্তিটি রানীডিহি হাজির হলে পুলিশমহলে ঔৎসুক্য জাগতে পারে এবং সম্ভাব্য শত্রুপক্ষ–যারা সেই অজ্ঞাতনামা লোকটিকে খুন করেছে, তারাও সতর্ক হয়ে যায়–তাই সোনালীর জন্মদিনের অছিলা। অবশ্য, সোনালী এসব ব্যাপার জানেই না। সে তার জন্মদিনে আর সবাইকে নেমতন্ন করার জন্য কলকাতা এসে বাবার কথামতো কর্নেলকেও নেমতন্ন করে গেল।…..

কর্নেল চুপ করলে বললুম–ব্যাপারটা রহস্যময়। আমার মনে হচ্ছে, সেই সঙ্গে বিপজ্জনকও বটে। সচরাচর আপনি যে সব ব্যাপারে নাক গলান এবং কৃতিত্ব অর্জন করেন, এটা তত সহজ মোটেও নয়। আপনার লাইফ রিক্সের কথা ভেবেছেন তো?

কর্নেল একটু হাসলেন। কিছু বললেন না।

বললুম–এসব ব্যাপারে নাক না গলানোই উত্তম, আমার মতো সরকারী লোকেরা যা পারে, করুক! আপনি গোয়েন্দাবিদ্যায় যত ধুরন্ধরই হোন, ভুলে যাবেন না যে এই কেসে খুনী কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, সম্ভবত একটা দল এবং এতে কোনও ব্যক্তিগত অভিসন্ধি কাজ করছে না। কে বলতে পারে, কুখ্যাত মাফিয়া দলের মতো কোনও আন্তর্জাতিক গুপ্তদল এর পেছনে আছে কি না? তাদের কী উদ্দেশ্য, তাও তো আপাতত আপনার জানা নেই।

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন–তোমার পরামর্শ খুব উৎকৃষ্ট জয়ন্ত। যুক্তি আছে। তোমার অনুমানও সম্ভবত ঠিক।

উৎসাহে বললুম–আলবাৎ ঠিক। একটা ব্যাপার তো পরিষ্কার বোঝা যায়, লোকটা সেই দলেরই লোক। কোনও কথা ফাঁস করে দিতে চেয়েছিল অনিরুদ্ধবাবুকে। তা টের পেয়ে তাকে মেরে ফেলল ওরা। তাছাড়া….

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–বলে যাও ডার্লিং!

–অনিরুদ্ধবাবু কে? না–উনি এক তৈল শোধনাগারের ডিরেক্টর। দ্বিতীয় পয়েন্ট লক্ষ্য করুন : লোকটা যে বই বেছে নিয়ে চিঠি রেখেছিল, সেটা পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি। এবং পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি একান্তভাবে তৈলশিল্পকেন্দ্রিক। এই যোগাযোগ কি আপনি আকস্মিক মনে করছেন?

কর্নেল সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–অপূর্ব জয়ন্ত! এজন্যেই সব কেসে আজকাল তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ব্রিলিয়ান্ট! বলে যাও ডার্লিং!

সবার আগে সেই বইটা আপনার পরীক্ষা করা দরকার!

–হ্যাঁ!

–অনিরুদ্ধবাবুর উচিত ছিল, রিফাইনারিতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা।

কারণ?

–আমার ধারণা, ওখানে কোনও অন্তর্ঘাত ঘটাবার ষড়যন্ত্র চলেছে। সে কথাটাই লোকটা বলতে এসেছিল। সুযোগ পায়নি। তাই দেখা করতে বলে ওইভাবে। এবং খুন হয়ে যায়।

–রিফাইনারিতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা তখনই করেছেন অনিরুদ্ধবাবু।

–আমার আরও ধারণা, রিফাইনারির অফিসার ও কর্মীদের মধ্যে ওই দলের লোক আছে।

–অসম্ভব নয়, জয়ন্ত।

আমি আরও কিছু তত্ত্ব খুঁজছি, দেখি কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং মেঝেয় কয়েকপা হেঁটে আমার দিকে হঠাৎ ঘুরে হো হো করে হেসে উঠলেন। বললুম– আমাকে তাচ্ছিল্য করতে পারেন, কিন্তু আমি বাজী রেখে বলতে পারি–একচুলও অযৌক্তিক কথা বলিনি।

কর্নেল বললেন–তাহলে জয়ন্ত, সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে বলা যায়। কিন্তু একটা পয়েন্ট তুমি আমল দিচ্ছ না যে যদি কোনও অন্তর্ঘাত সম্পর্কে অনিরুদ্ধবাবুকে কেউ সতর্কই করতে চাইত, তাহলে চিঠি বা ফোনেই জানাতে পারত! দেখা করতে আসা, ওই বিশেষ বইটা চেয়ে নেওয়া এবং…জয়ন্ত, শুধু তাই নয়, যে পাতায় চিঠিটা ছিল, তার পেজমার্ক কত জানো? থ্রি জিরো–মানে তিরিশ!

বলেন কী!

–ওই পাতায় কী আছে, তাও জেনে নিয়েছি। চ্যাপ্টারটা পুরো লেখা হয়েছে সেই সুবিখ্যাত টি. ই. লরেন্স সাহেবকে নিয়ে। অর্থাৎ লরেন্স অফ অ্যারাবিয়ার কার্যকলাপ। আশা করি, লরেন্স সম্পর্কে তুমি বিশদ জানো। এমনকি সিনেমাতেও তার ক্রিয়াকলাপ দেখে থাকবে।

হাত তুলে বললুম–দেখেছি। আশ্চর্য ছবি!

.

ষোলো সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ সোনালীর জন্মদিনের একদিন আগেই আমরা দুজনে রানীডিহি পৌঁছলুম। রিফাইনারি থেকে দূরে চমৎকার পাহাড়ী এলাকায় ডিরেক্টর সায়েবের বাংলো এবং অন্যান্য অফিসারদের কোয়ার্টার। ছবির মতো দেখাচ্ছিল ঘরবাড়িগুলো। প্রাকৃতিক দৃশ্যও অপূর্ব।

সবে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। কর্নেল ড্রয়িং রুমে গল্প করছে। আমি দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে বসলুম। টিলার ওপর বাংলোটা। তাই জ্যোৎস্নায় নীচের উপত্যকাটা ভাগ্নি রহস্যময় দেখাচ্ছিল। বারান্দার ওপরে একটা হাল্কা আলোর বাল্ব রয়েছে। আলোটা নিভিয়ে দিলে বাইরের সৌন্দর্য পুরোপুরি ফুটত ভেবে সুইচ খুঁজছি, এমন সময় সোনালী, রত্না, দীপ্তি আর একটি অচেনা যুবক এল। সোনালী বলল–আলাপ করিয়ে দিই জয়ন্তবাবু। রত্নার দাদা দিব্যেন্দু। মানে আমারও মাসতুতো দাদা। দির্য, তোমাকে তো এঁর কথা বলেছি। জয়ন্ত চৌধুরী ….

দিব্যেন্দু নমস্কার করল হাসিমুখে।–দৈনিক সত্যসেবকে আপনার রিপোর্টগুলো আমি কিন্তু মন দিয়ে পড়ি। খুব ইন্টারেস্টিং!

রত্না বলল–তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা এবার আলোচনা করা যাক দিব্য। সোনালী, তুই শুরু কর।

চারটি মুখে ষড়যন্ত্রসঙ্কুল হাসি দেখছিলুম। বললুম–কী ব্যাপার?

সোনালী দ্রুত এদিক ওদিক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল–জয়ন্তবাবু, ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে? আপনি নিশ্চয় ওই গোয়েন্দা ভদ্রলোকের অ্যাসিস্ট্যান্টের রোলেও কাজ করেন?

হেসে ফেললুম। ব্যাপার কী? অবশ্য, আমি ওঁর নিছক ভ্রমণসঙ্গী।

সোনালী ফিসফিস করে বলল-কর্নেলকে নিয়ে আমরা একটু মজা করলে মানে জাস্ট এ ফান–আপনার আপত্তি হবে না তো?

–মোটেও না। বরং আমি আপনাদের দলে ঢুকে পড়ব। কিন্তু সাবধান, বুড়ো ভারি ধুরন্ধর।

রত্না বলল, –এত নাম ডাক শুনেছি। এত অদ্ভুত ব্যাপার নাকি করতে পারেন! এবার দেখা যাক্ হাতে নাতে!

সোনালী বলল–আমরা একটা মার্ডার কেস সাজাব, বুঝলেন?

হ্যাঁ, বলে যান।

এই সময় ড্রয়িং রুমের দরজা থেকে একটি মুখ উঁকি মারল চিনলুম। একটু আগেই আলাপ হয়েছে। অনিরুদ্ধের পি. এ. রণধীর চোপরা! বেশ স্মার্ট হাসিখুশি যুবক। এসে বিশুদ্ধ বাংলায় বলল–ডিসটার্ব করলুম না তো?

সোনালী উৎসাহ দেখিয়ে বললব্যস, মেঘ না চাইতেই জল। রণধীরদা, তোমাকে দলে নিলুম তাহলে। ব্যস, আমরা মোট ছ’জন ব্যাপারটা জানলুম। এবার প্ল্যানটা বলি। আমরা একটা চমৎকার মার্ডার কেস সাজাব। কিছু ক্লু রাখব। দেখব, কর্নেলের গোয়েন্দা বুদ্ধি কতখানি।

রত্না বিরক্ত হয়ে বলল–আহা, বলেই ফেল না বাবা। শুধু ভূমিকা করছিস।

সোনালী সিরিয়াস হয়ে চাপা গলায় বলতে শুরু করল–ওই যে গেট রয়েছে, তার বাইরে ঝোপঝাড়গুলোর মধ্যে একজায়গায় আমরা একটা ডেডবডি রাখব।

চোপরা বিস্ময়মেশানো আতঙ্কে বলল–সর্বনাশ! ডেডবডি?

সোনালী ধমক দিয়ে বলল–ভ্যাট, কিস্যু বোঝে না! রিয়েল ডেডবডি নয় নকল। আমরা দীপ্তিকে ডেডবডি করব। আমাদের থিয়েটার ক্লাবের একটা টিনের ছোরা আছে। ছোরাটার ডগাটা চাপ দিলে ভেতরে ঢুকে যায় এবং বডিতে আটকে পড়ে। কেমন? দীপ্তির বুকে সেটা আটকে থাকবে।

দীপ্তি এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলে উঠল–না, না! পিঠে!

–বেশ, পিঠেই। পিঠে আটকে দিয়ে লাল রঙ ছড়িয়ে দেব। সে আমি ম্যানেজ করব’খন। একেবারে টাটকা দল-দলা রক্তের মতো দেখাবে। দীপ্তি মড়া সেজে পড়ে থাকবে। এবার ক্লু। ক্লু থাকবে একটা পোড়া দেশলাই কাঠি, আধপোড়া সিগারেট তিন চারটে…

দিব্য বলল–তাহলে আমাকে ধরে ফেলবে। আমি চেইন স্মোকার।

চোপরা বলল–আমাকেও। আমিও চেইন স্মোকার।

সোনালী বলল–তাহলে অন্য ক্লুর কথা ভাববো। জয়ন্তবাবু কী বলেন?

বললুম–কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা খুনী হিসেবে একজনকে নিশ্চয় ধরে রাখছেন! সে রোলটা কে নিচ্ছেন?

–দিব্য। দিব্য, তুমি রাজী তো?

দিব্যেন্দু আমতা হেসে বলল–বেশ। কিন্তু…

সোনালী বলল–কোনও কিন্তু নয়। তুমিই কিলার। এবার জয়ন্তবাবু বলুন।

বললুম–ক্লু খুব সহজ হওয়া চাই। কারণ, এটাতো জাস্ট এ গেম। নিছক খেলা! কর্নেলের যা স্বভাব, প্রথমে সত্যিকার খুন ভেবে খুব সিরিয়াস হয়ে পড়বেন এবং তক্ষুণি পুলিশ ডাকতে বলবেন। ফোরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আসতে বলবেন। এবং অ্যাম্বুল্যান্স ইত্যাদি এসে যাবে।

সোনালী ব্যস্তভাবে বলল–সর্বনাশ! তাহলে তো ওঁকে…

বাধা দিয়ে বললুম–উনি ডেডবডি দেখে তেমন কিছু করার আগেই আপনারা দৌড়ে গিয়ে তখন বলবেন, আপনিই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করুন! দেখি, আপনি কেমন গোয়েন্দা! না পারলে পুলিশ তো আছেই।

সবাই হেসে উঠল। সোনালী বলল–ইউরেকা! একটা ক্লু আমার মাথায় এসেছে। নীচের দিকে নদীতে এখন ফ্লাডটা কমেছে। কিন্তু পলি জমে আছে পাড়ের জঙ্গলে। দিব্যর পায়ে জুতোর সেই কাদা লেগে থাকবে। এবং দীপ্তির ডেডবডির কাছে কিছু কাদা ফেলে রাখা হবে। যতক্ষণ খেলা চলবে, দিব্য সেই জুতোই পরে থাকবে। কেমন? জয়ন্তবাবু, কর্নেল অত খুঁটিয়ে কি লক্ষ্য করবেন?

বললুম–কে জানে! তবে বুড়ো বড্ড সেয়ানা।

দিব্যকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল–তাহলে সন্দেহ তো একজনের ওপরেই পড়ার মতো ক্লু রাখা হচ্ছে। এমন সব চিহ্ন রাখো, যাতে কর্নেল প্রত্যেককেই সন্দেহ করেন।

রত্না সায় দিয়ে বলল–এই! দাদা কিন্তু ঠিকই বলেছে রে! রণধীরদা, তোমাকে সন্দেহ করার মতো কী চিহ্ন রাখা যায় বলে তো?

চোপরা একটু ভেবে নিয়ে বলল–আমার লাইটারটা ফেলে রাখব কোথাও। ডেডবডির কাছাকাছি। তার মানে, আমি ও দীপ্তি ধরো কথা বলছিলুম ওখানে। আমি চলে এলুম, দীপ্তি থাকল। তারপর খুন হয়ে গেল ও।

সোনালী বলল–চমৎকার। আমরা সাক্ষী দেব, মানে আমিই বলব যে দীপ্তি আর রণধীরদার ঝগড়া হচ্ছিল ওখানে। বাংলোর এই বারান্দা থেকে শুনেছি।

চোপরাকেও এবার নার্ভাস দেখাল। সে বলল–তাহলে দুজন মোটে সাসপেক্ট?

সোনালী বলল–আরেকজন হলে ভাল হতো। কর্নেলকে গোলমালে ফেলা যেত। কিন্তু পুরুষমানুষ ছাড়া মার্ডারার হয় না। মানায়ও না!

দিব্য আপত্তি করে বলল–মোটেও না। মেয়েরাও ছোরা চালায়।

সোনালী, রত্না, দীপ্তি একসঙ্গে বলে উঠল–না, না! মোটেও না।

আমি একটু হেসে বললুম–হ্যাঁ, ছোরাটোরা মেয়েদের মার্ডার উইপন নয় সচরাচর। রিভলবার বরং চালাতে শুনেছি। তবে সেটা বিরল কেস। সচরাচর বিষই মেয়েদের মার্ডার উইপন! এক্সকিউজ মি, এ কিন্তু স্বয়ং কর্নেলেরই সিদ্ধান্ত।

চোপরা বলল–মহিলা গোয়েন্দাকাহিনীকার আগাথা ক্রিস্টিরও এই মত।

মেয়েরা একসঙ্গে সায় দিয়ে হেসে বলল–খানিকটা কারেক্ট।

সোনালী বলল–তৃতীয় পুরুষমানুষ অবশ্য জয়ন্তবাবু আছেন। কিন্তু…

বললুম– কর্নেল আমাকে হিসেবে ধরবেনই না। সুতরাং আমারই খুনী হবার স্কোপ ছিল এবং আপনারা কর্নেলকে পরাস্ত করতে পারতেন।

দিব্যেন্দু অমনি ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল–সোনালী! তোমরা বরং জয়ন্তবাবুকেই খুনী করো।

সোনালী রত্না ও দীপ্তির দিকে তাকাল। ইতিমধ্যে ওদের ফানটা আমার দারুণ ভাল লেগে গেছে। কর্নেলকে নিয়ে এমন মজা করার সুযোগ কখনও পাইনি। তাই বলে উঠলুম-ঠিক আছে। আমিই খুনী হলুম। নদীর পলিতে হেঁটে আসব আমিই। আর দিব্যবাবু বরং অন্যতম সাসপেক্টেড হয়ে ওঠার জন্য অন্য কোনও ক্লু রাখবেন।

দিব্যেন্দু বলল–আমি…আমি ওখানে আমার একটা বিশেষ ব্ৰাণ্ডের সিগ্রেটের টুকরো ফেলে আসব। এই সিগ্রেট জয়ন্তবাবু বা রণধীর খান না। খান কি?

আমি ও চোপরা ওর ব্রাণ্ড দেখে বললুম–না।

সোনালী খুব খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল-এবার কফি খাওয়া যাক। এতক্ষণ তৈরি নিশ্চয়। কফি খেতে-খেতে আরও ডিটেলস আলোচনা করা যাবে।

ওকে সতর্ক করে দিয়ে বললুম–দেখবেন, কর্নেল যেন এদিকে না এসে পড়েন! কী অবস্থায় আছেন, দেখে আসবেন কিন্তু।

সোনালী মাথা দুলিয়ে চলে গেল। আমি দীপ্তির দিকে তাকালুম। দীপ্তি কি নার্ভাস হয়ে পড়ছে ক্রমশ? তাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। হেসে বললুম– ভয় পেয়েছেন দীপ্তি?

দীপ্তির হাসিতে শুকনো ভাবটা ঢাকা গেল না। রত্ন বলল-ও ভয় পাবে কী? আপনি তো জানেন না, আমাদের থিয়েটার ক্লাবের সবচেয়ে পাকা অভিনেত্রী ও। নাচতে গাইতেও পারে। কাল সোনালীর জন্মদিনে ওর কীর্তি দেখে আপনার তাক লেগে যাবে।

দীপ্তি যেন বিরক্ত হলো। বললবাজে বকিসনে, রত্না। জয়ন্তবাবু কলকাতায় থাকেন, ভুলে যাস্ নে। আদাড়ে গাঁয়ে শেয়াল রাজা আমি।

কথা কেড়ে রত্না বলল-রানী বলো, দীপ্তি।

সবাই হাসল। চোপরা বলল–কাল ফাংশানের প্রোগ্রাম কি এখনও আমায় জানানো হয়নি কিন্তু। একেবারে লাস্ট মোমেন্টে বলবে, তখন ম্যানেজ করতে পারব না বলে দিচ্ছি। প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নিশ্চয় রত্না?

রত্নাকে একটু বিরস দেখাল। বলল–বেশি কিছু করা যাবে না। মেসোমশাই বলেছেন–খুব ধুমধাম করা হবে না। বেশি কেউ আসছেনও না। লোকাল লোক আর বাইরের মিলে বড় জোর জনা দশ বারো। অবশ্য ড্রইংরুমটা বড়ো। স্টেজ হবে না। দীপ্তিই নাচবে-গাইবে!

দীপ্তি বলল–এবং তুমিও।

রত্না কী বলতে যাচ্ছিল, সোনালী ও একজন পরিচারিকা ট্রে নিয়ে এল। সোনালী ফিসফিস করে বলল-কর্নেল গম্ভীর মুখে কী একটা প্রকাণ্ড বই পড়ছেন। বাবা পাশে তেমনি গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেছে। মা জানতে পেরেছেন সব। বারণ করেছিলেন। আমার ভয় করছে বাবার কানে না তোলেন!

রত্না বলল-এই রে! সেরেছে! মাসিমাকে জানাল কে?

দিব্য বলল–আমি তো কিছু বলিনি। নিশ্চয় দীপ্তি বলেছে।

কাঁচুমাচু হয়ে দীপ্তি বলল–মানে, ওঘরে যখন সোনালী আর রত্নার সঙ্গে এনিয়ে আলোচনা করছিলুম, মাসিমার কানে গিয়েছিল। আমি বেরোলে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–মার্ডার-টার্ডার কী সব বলছি? উনি যা মানুষ, হইচই করে ফেলবেন–এই ভয়ে বলতে হলো। উনি আমাকে নিষেধ করছিলেন।

চোপরা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল–তাহলে দি গেম ইজ ফিনিশ। উনি বাধা দেবেন। আই নো ইট।

সোনালী একটু ভেবে বলল–এক কাজ করা যাক। টাইমটা পাল্টে সকাল ন’টার বদলে ভোর ছটা। অত সকালে মায়ের ঘুম ভাঙবে না। রণধীরদা, তুমি কিন্তু ভোর পাঁচটায় আসছ। দিব্য, রত্না, দীপ্তি–সবাই ঠিক ওই সময়ে। জয়ন্তবাবু, আপনার ঘুম ভাঙবে তো?

বললুম–হ্যাঁ। তবে কর্নেলেরও ভাঙবে। এবং উনি অভ্যাসমত বেড়াতে বেরোবেন।

সোনালী বলল–বাঃ! তাহলে তো চমৎকার সুযোগ। উনি ফিরলেই আমরা ঝটপট দীপ্তিকে ওখানে রেখে চলে আসব। খবর দেবে–এই রে! মার্ডারটা কার প্রথম চোখে পড়বে ঠিক করা হয়নি যে!

রত্না বলল-দাদাই দিক না। দাদাও ধরো মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে চোখে পড়েছে! ব্যস!

দিব্য বলল–বেশ। কিন্তু মোটিভ কী রাখছ খুনের? বলে সে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকল।

রত্না মুখ টিপে হেসে বলল–মোটিভ ইজ প্রেমের প্রতিহিংসা। দাদা, চোপরা এবং জয়ন্তবাবু তিনজন প্রেমিক, একজন প্রেমিকা।

দীপ্তি হইচই করে বলল–যাঃ!

তার মুখ রাঙা দেখাচ্ছিল। বললুম–এতে সংকোচের কী আছে মিস দীপ্তি? জাস্ট এ গেম। অভিনয়। আপনি নিশ্চয় প্রেমিকার ভূমিকায় থিয়েটারে অভিনয় করেছেন।

সোনালী বলল–একশোটা করেছে। তুলনাহীন অভিনয়।

দীপ্তি হঠাৎ ঘুরে বলল–আচ্ছা, ধরুন যদি এমন হয়–মানে, আপনারা তিনজনের একজন কোনও গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং আমি সেটা টের পেয়েছিলুম বলেই আমাকে… মানে…

চোপরা হো হো করে হেসে বলল–চমৎকার! কিন্তু ষড়যন্ত্র কিসের?

ধরুন, এখানে অয়েল রিফাইনারিতে কোনও সাবোটাজ করার জন্য …..

দিব্য বাধা দিল–এক মিনিট। ব্যাপারটা খুব জটিল আর কষ্টকল্পিত।

দীপ্তি যেন জেদ ধরল। কেন? এমন হচ্ছে না আজকাল? সরকারী প্রজেক্টে বিদেশী এজেন্টের লোকেরা অন্তর্ঘাত করার চেষ্টা করেছে না?

চোপরা বলল–ব্রিলিয়ান্ট! খুব স্বাভাবিক মোটিভ। কিন্তু তার তো ক্লু থাকা চাই।

দীপ্তি বলল–ধরুন, আমার কাছে কোনও টুকরো কাগজ থাকবে এবং তাতে কোনও সাংকেতিক কিছু লেখা থাকবে! ভাববেন না, সে আমি নিজেই ম্যানেজ করব’খন। কাগজটা ছেঁড়া হবে এবং আমার মুঠোর মধ্যে লুকানো থাকবে।…

সোনালী হাসতে হাসতে বলল-বুঝেছি। দীপ্তি এই তিনজনের প্রেমিকা হতে চায় না! পছন্দ হচ্ছে না। তাই বাপস! অয়েল রিফাইনারিতে সাবোটাজ! বাবাকেও জড়াচ্ছে! তবে এই মোটিভটা খুব সিরিয়াস। গেমটা আরও জমবে। কর্নেলের বুদ্ধি গুলিয়ে যাক্ না!

আমি কিন্তু চমকে উঠেছিলুম। দীপ্তির মুখে কী একটা টের পাচ্ছিলুম। সেটা ঠিক কী, বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। একটা দৃঢ়তাই কি দেখলুম? অস্বস্তি হলো। সেই মুহূর্তে কর্নেলকে দেখা গেল দরজায়। আমরা তাকালুম। কিন্তু কর্নেল ফের ঢুকে গেলেন। সোনালী চাপা হেসে সন্দিগ্ধ মুখে বলল–শুনলেন না তো কিছু?

.

সে-রাত শুতে গিয়ে দেখি কর্নেল বেজায় গম্ভীর। আমি শুয়ে পড়লুম। উনি টেবিল ল্যাম্পের সামনে বসে একটা প্রকাণ্ড বই পড়তে থাকলেন। বললুম–ব্যাপার কী? সরাদিন ট্রেনজার্নির পর ওই বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখানো কেন? আলোয় আমার ঘুম আসে না।

কর্নেল বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললেন–এক মিনিট, জয়ন্ত। টি ই লরেন্স চ্যাপটারটার আর এক প্যারা বাকি। তুমি প্লীজ একটুখানি ধৈর্য ধরো। লাভবান হবে।

–আমার কিসের লাভ?

–থ্রি জিরোর তত্ত্ব আঁচ করেছি ডার্লিং! দৈনিক সত্যসেবক-এ এটা ছাপা হলে কাগজের বিক্রি বাড়বে এবং তোমারও বেতনের ইনক্রিমেন্ট হবে। লাভটা তো তোমারই।

অতএব ধৈর্য ধরলুম। কিন্তু সকাল-সকাল ঘুমিয়ে না পড়লে ভোর পাঁচটায় ওঠা কঠিন হবে। মনে মনে হাসলুম। ওঁকে নিয়ে সোনালীরা যা মজা করতে যাচ্ছে, উনি তো টেরও পাচ্ছেন না। মার্ডার গেমটা যে নিছক ফান, তা টের পাবার মুহূর্ত অব্দি উনি ওই থ্রি জিরোর তত্ত্বের সঙ্গে দীপ্তির এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড জড়িয়ে কী না নাজেহাল হবেন! মাথায় একটা মতলব গজালো। দীপ্তি কর্নেল যাওয়ামাত্র যেন ধরা না দেয়। অন্তত আধঘণ্টা ওঁকে নাজেহাল করা যাবে। তারপর ফাঁস করা হবে যে ব্যাপারটা ফান। ভোরে এই প্রস্তাবটা ওদের দেব।…

চোখ খুলতেই দেখি আমার বৃদ্ধ বন্ধুটি কখন নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং আমাকে দেখছেন। বললেন–তুমি চোখ বুজে হাসতে অভ্যস্ত, তা তো জানতুম না ডার্লিং! নিশ্চয় তেমন কিছু ব্যাপার ঘটেছে। আর শোন, তোমার ওই হাসিটুকুর মধ্যে দুষ্টু ছেলের আদল লক্ষ্য করছিলুম। নিশ্চয় কোনও মতলব ভাঁজছিলে।

গম্ভীর হয়ে বললুম–ভাঁজছিলুম। আপনি তো গোয়েন্দা– নাকি মনের চিন্তার আভাস মুখেও বুঝতে পারেন। আপনিই বলুন, কী মতলব ভাঁজছিলুম?

কর্নেল আমার পাশেই খাটে পা ঝুলিয়ে বসলেন। তারপর বললেন-জয়ন্ত, আমি অন্তর্যামী নই। তবে এটুকু টের পাচ্ছি যে তোমরা কজন যুবক যুবতী মিলে একটা কিছু ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যাক্ গে–এবার শোনো থ্রি জিরোর ব্যাপারটা। পশ্চিম এশিয়ার অর্থনীতি বইটার তিরিশ পাতায় লরেন্সের কাহিনী আছে। খুব মন দিয়ে পড়ছিলুম আর মনে হচ্ছিল, সত্যি-বড় বিচিত্র মানুষ ওই লরেন্স! কী বিপুল ইচ্ছাশক্তি! কী সাহস আর ধৈর্য! পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাও কী অসাধারণ! ওঃ!

ওঁর যেন ভাবাবেগের ঘোর লেগে গেল। চোখ বুজে যেভাবে মাথা নাড়া দিলেন, বারকতক, মনে হলো রোমাঞ্চ সামলাচ্ছেন। অবাক হয়ে বললুম–ব্যাপারটা কী? হঠাৎ লরেন্সকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস কেন?

কর্নেল চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–তুমি জানো না জয়ন্ত! একটা প্রচণ্ড প্রাণশক্তি না থাকলে তুরস্ক সরকারের অস্ত্রশস্ত্র আর রসদবাহী মালগাড়ির ওপর মাত্র জনাকতক বেদুইন গ্যাংস্টার নিয়ে হামলা করা যায় না। বোঝে ব্যাপারখানা। মালগাড়িতে সশস্ত্র সেনারাও ছিল। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে লরেন্স নিতান্ত সাধারণ অস্ত্র নিয়ে লড়লেন! এবং…

বাধা দিয়ে বললুম–শুনেছি, মানে ছবিতে দেখেছি–আগে থেকে ডিনামাইট পোঁতা হয়েছিল লাইনের তলায়। যাই বলুন, এটা নিছক সাবোটাজ! এমন অন্তর্ঘাতমূলক কাজ যেকোনও বাচ্চাই করতে পারে। লরেন্সের মহিমাটা টের পাচ্ছি না।

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–পাচ্ছ না বুঝি?

নাঃ।

কর্নেল হঠাৎ হাসলেন একটু। তারপর মাথা নেড়ে বললেন-হ্যাঁ, তা ঠিক। সাবোটাজ করতে খুব একটা বীরত্ব লাগে না! রাইট, রাইট! সাবোটাজ!

কর্নেল বারবার সাবোটাজ শব্দটা আওড়াতে-আওড়াতে ফের টেবিলে গিয়ে বসলেন। বইটা খুললেন। তখন বিরক্ত হয়ে বললুম–আবার পড়তে বসলেন নাকি?

কর্নেল বইটা খুলে কী দেখে নিয়েই বন্ধ করলেন এবং টেবিল-বাতির সুইচ অফ করে বললেন-জয়ন্ত, আশা করি এবার তোমার সুনিদ্রা হবে।

ওঁর ছোট টর্চটা জ্বলতে জ্বলতে কোণের অন্য বিছানার দিকে এগোল। একটা চাপা শব্দ হলো অন্ধকারে। বুঝলুম, উনি শুয়ে পড়লেন।

এবং কয়েক মিনিট পরেই ওঁর নাক ডাকা শুরু হলো। কী অদ্ভুত মানুষ!….

.

অচেনা জায়গায় আমার ঘুম হয় না। তাতে ভোরে ওঠার তাগিদ ছিল। রাতটা প্রায় জেগেই কাটালুম। পাশের ড্রইং রুমের দেয়ালঘড়ির ঘণ্টা প্রত্যেকবারই শুনেছি। যখন তিনবার বাজল, তখন টের পেলুম ঘুমের টান আসছে। অমনি সিগ্রেট ধরালুম। কর্নেলের নাক ডাকা মাঝে মাঝে বন্ধ হচ্ছে। অস্ফুট কী যেন বলছে–হয়তো ঘুমের ঘোরে। আবার নাক ডাকছে। সিগ্রেট খাওয়ায় কাজ হলো। ঘুম আর এলও না। চারটেয় আমি উঠে বাথরুমে ঘুরে এলুম, তারপরে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলুম। পাঁচটায় কর্নেল উঠলেন। বাথরুমে গেলেন। তারপর যথারীতি টুপি ও ছড়ি নিয়ে বেরোলেন। দরজাটা আস্তে বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিলেন। ওঁকে খুব ঠকাচ্ছি ভেবে আমার মনটা খুশি।

পাঁচটায় বাইরের (দক্ষিণে) সেই বারান্দায় পায়ের শব্দ পেলুম। কোথায় গাড়ির আওয়াজ হলো। বেরিয়ে দেখি, সোনালী রত্না দিব্য তৈরি হয়ে আমার অপেক্ষা করছে। বারান্দায় কফি খেতে খেতে চোপরা এল। কথামতো সে দীপ্তির বাসা থেকে দীপ্তিকে সঙ্গে এনেছে। কফি খাওয়া শেষ হলে সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! কুইক! চলুন, আমরা সাইট সিলেকশনটা করে ফেলি।

সোনালী একটা ব্যাগে থিয়েটারের ছোরা আর পেন্টের সরঞ্জাম নিয়েছে। আমরা তক্ষুণি গেট পেরিয়ে ছোট একটা রাস্তায় গেলুম। তার ওধারে ঘন গাছপালা ঝোপঝাড় ঢালু হয়ে নীচের উপত্যকায় নেমে গেছে। রাস্তা থেকে আন্দাজ পনের ফুট দূরে ঝোপের মধ্যে একটা বড় পাথর পাওয়া গেল। গাছপালা ঘাস এবং পাথরটা শিশিরে চবচবে হয়ে আছে। আমি ভেবেই পেলুম না, কীভাবে দীপ্তি মড়া হয়ে এখানে শোবে। দীপ্তির দিকে তাকালুম। এখন দেখি, সে যেন মরীয়া। তার মুখেচোখে দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ পাচ্ছে। সে বসে পড়ল এবং সোনালী তার পিঠে ছুরিটা সেট করতে থাকল। দিব্য বলল–জয়ন্তবাবু! আপনি সোজা এই রাস্তা দিয়ে এগোলে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে পড়বেন। সেখান থেকে পলি এনে ছড়িয়ে বাংলোয় যাবেন নিজের ঘরে। রণধীর, তুমি বরং পূর্বে এগিয়ে ওই বড় রাস্তায় যাও। আমি যাচ্ছি পশ্চিমে বড় রাস্তায় ঘুরতে। সোনালী আর রত্না যাবে বারান্দায়। সবাই বাংলোয় ফিরে আধঘণ্টা অপেক্ষা করবে। তারপর এখানে আসবে একেবারে কর্নেলকে নিয়েই।

দীপ্তি ওই অবস্থায় বসে খুঁতখুঁতে গলায় বলল–এতক্ষণ পড়ে থাকতে হবে এই ঠাণ্ডায়?

সোনালী ধমক দিয়ে বলল– প্রোপাজালটা কিন্তু তোমারই। ভুলে যেও না।

দীপ্তি করুণ মুখে ফের বলল–যদি কর্নেলের ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যায়।

আমি বললুম– হবে না। ঠিক ছটায় আজকাল উনি যোগাসন করেন।

সোনালী কাজ করতে করতে বলল কুইক! দেরী হয়ে যাচ্ছে। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ হয়ে গেল।

দিব্য ও চোপরা পরস্পর উল্টোদিকে চলে গেল। আমি পা বাড়িয়ে একবার ঘুরে দেখে নিলুম–দীপ্তির পিঠে ছোরাটা অদ্ভুত কৌশলে বসানো হয়েছে এবং সোনালী অশেষ যত্নে টকটকে লাল রঙ মেশাচ্ছে–অবিকল টাটকা রক্ত যেন! আমার গা শিউরে উঠল। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্যই না দেখাচ্ছে! ..

ছোট্ট রাস্তাটা একটু পুবে এগিয়ে রাস্তার গা ঘেঁষে দক্ষিণে ঘুরেছে এবং নীচের দিকে নেমেছে। বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা ও ভরা নদী চোখে পড়ল বাঁক থেকে। ভোরের ধূসর আলো কুয়াশায় নীল রঙ ছড়াচ্ছে। একটু শীত লাগছিল। কিন্তু চারপাশে পাখির ডাক, এই সবুজ সুন্দর বনভূমি নেশা ধরিয়ে দিচ্ছিল।

হাঁটছিলুম বেশ জোরে। কারণ খুব শিগগির ঘুরে আসতে হবে। জুতোর তলায় পলি নিয়ে সেই পলি ছড়িয়ে আসতে হবে অকুস্থলে। তারপর যেন কিছু জানিনে এইভাবে নিজের ঘরে বসে কর্নেলের অপেক্ষা করতে হবে। প্ল্যানটা নির্ভর করছে প্রত্যেকের সময় জ্ঞান এবং দক্ষ অভিনয়ের ওপর।

দশ মিনিটের মধ্যেই নদীর ধারে পৌঁছলুম। পাহাড়ী নদী। স্রোত বইছে প্রচণ্ড। পাড়ে যেখানে পলি জমেছে, সেখানে বার কতক হাঁটলুম। যখন জুতোর রবারের সোলে যথেষ্ট পলি জমল, তখন ফেরা শুরু হলো।

ওঠার সময় হঠাৎ বাঁদিকে দূরে একটা টিলা থেকে কর্নেলকে নেমে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালুম। কর্নেল নীচে অদৃশ্য হলেই হুঁশ হলো যে সময় চলে যাচ্ছে। বেশ জোরে হাঁটা শুরু করলুম।

অকুস্থলে পৌঁছে একটু অস্বস্তি হলো। কিন্তু এ সবই তো নিছক ফান ভেবে হাসতে হাসতে জুতোর তলা থেকে খানিকটা পলি ছড়িয়ে দিলুম। তারপর ঝোপের ফাঁকে উঁকি মেরে পাথরটার কাছে দীপ্তিকে দেখতে পেলুম। দৃশ্যটা মারাত্মক। তাই ফের অস্বস্তি জাগল। দীপ্তি কাত হয়ে পাথরে হেলান দেওয়ার মতো মাটিতে বসেছে–মাটিতে ঘাস নেই। ওর শাড়িটা পাথরে ও মাটিতে এমন কায়দায় রাখা যে ওকে শিশিরের ঠাণ্ডাটা পেতে হচ্ছে না। পিঠে বাঁদিকে ছোরার বাঁট এবং অবিকল রক্ত চবচব করছে! দীপ্তি চোখ বুজে মুখ নামিয়ে পাথরে মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে। ফিসফিস করে ডেকেছি–হঠাৎ শিসের শব্দ হলো। ঘুরে দেখি, রাস্তা থেকে সোনালী হাত নাড়ছে। কিছু পলিমাটি দীপ্তির কাছে ছড়িয়ে তক্ষুণি ওর কাছে গেলুম। সোনালী বলে উঠল-কুইক! কর্নেল ফিরছেন–ওই দেখুন!

পশ্চিমে বাংলোর গেট। ফুল গাছের আড়ালে ওঁর টুপি চোখে পড়ল। আমরা দুজনে গেট দিয়ে প্রায় দৌড়ে বারান্দার উঠলুম। দিব্য ও চোপরাকে বসে থাকতে দেখলুম। রত্না মুখে দুষ্টু-দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে বসে আছে।

সোনালী বলল-জয়ন্তবাবু! আপনি আর ঘরে যাবেন না! এখানে থাকুন। প্রথমে আমিই কিন্তু হইচই জুড়ে দেব। রেডি! পাঁচ গোনার পর গেম শুরু হবে। রেডি! ওয়ান…টু…থ্রি…ফোর…

পাঁচ বলার সঙ্গে সঙ্গে দিব্যেন্দু উঠল এবং বিকট ভঙ্গি করে চেঁচিয়ে উঠল– খুন! খুন!

একই মুহূর্তে আমার চোখ গেল সোনালীর দিকে। সোনালী যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে কারণ এখানে তার ভূমিকাই প্রথম এবং মূল ছিল। অবাক আমিও। দিব্যেন্দুর মতো ভব্য ছেলে এই সুন্দর শারদীয় ভোরবেলাটাই যেন খুন করে ফেলল!

তারপর সোনালী একঝিলিক হেসেছে এবং ভুরু কুঁচকে দিব্যেন্দুকে যেন ধমকই দিয়েছে। দৌড়ে গেছে কর্নেলের উদ্দেশে। দিব্যেন্দু সমানে চেঁচাচ্ছে–খুন! খুন! এবং চোপরাও গলা মেলাল। রত্না হাসি চাপছে দেখলুম। দিব্যেন্দু আমার দিকে হাত নেড়ে তার সঙ্গে গলা মেশাতে ইশারা দিল। আমি ঘাবড়ে গেছি।

মাত্র কয়েকটি সেকেণ্ড এসব ঘটল।

বাবুর্চি-চাকর-দারোয়ান-মালী-পরিচারিকাপ্রমুখ ভৃত্যগোষ্ঠী যেন দুপাশের উইংস থেকে স্টেজে প্রবেশ করল। তারপর রাতের গাউনপরা এবং আরক্ত চোখ নিয়ে স্বয়ং অনিরুদ্ধ বেরিয়ে এলেন।

এও কয়েক সেকেণ্ডের ঘটনা।

তারপর কর্নেলকে বেরুতে দেখলুম। তার পাশে সোনালী হাতমুখ নেড়ে কী বলতে বলতে এগোচ্ছে। কর্নেলের ভঙ্গিতে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। সত্যিসত্যি খুনের গন্ধ পেয়ে যেন শকুনের মতো ওঁর স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে এগিয়ে আসছেন। সোনালী অদ্ভুত অভিনয় করছে বলা যায়। সে হাত তুলে ওদিকটা দেখিয়ে ভয়ার্ত স্বরে চেঁচাল-ওদিকে! ওখানে-ওখানে!

অনিরুদ্ধের মুখেও ভীষণ আতঙ্কের ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে দেখলুম। বাকশক্তি রহিত।

এরপর সোনালী ও কর্নেলের পিছন পিছন আমরা লন পেরিয়ে গেট দিয়ে ছোট রাস্তায় পড়লুম। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলুম বারান্দায় রত্না রয়ে গেছে এবং অনিরুদ্ধকে কিছু বলছে। দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখলুম, অনিরুদ্ধ ঘরে ঢুকছেন–অর্থাৎ মজাটা জেনে গেছেন। রত্না দৌড়ে আসছে।

ঝোপ ঠেলে পাথরটার সামনে কর্নেল দাঁড়ালেন এবং দীপ্তিকে ওই অবস্থায় দেখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন–এ কী!

ওঁর পিছনে দাঁড়িয়ে চোপরা এবার নিঃশব্দে হাসতে থাকল। দিব্যেন্দু ভুরু কুঁচকে ওকে ধমকাল বটে, নিঃশব্দে চুপিচুপি নিজেও হাসতে শুরু করল। সোনালী কান্নার গলায় বারবার বলতে থাকল–বেঁচে আছে তো কর্নেল? দীপ্তিকে কে খুন করল?

সত্যি, বড় চমৎকার অভিনয় করতে পারে মেয়েটি।

হঠাৎ কর্নেল ঘুরে আমাদের সবাইকে যেন একবার দেখে নিলেন। তারপর পা বাড়িয়ে দীপ্তির কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। আমরা সবাই চুপ। মজার চরম মুহূর্ত উপস্থিত।

কর্নেল যেই দীপ্তির একটা হাত তুলে নাড়ি পরীক্ষা করতে গেলেন, অমনি রত্না আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সব নিষেধ ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠল। সোনালীও নিঃশব্দ ধমক দিতে গিয়ে তাল হারাল। এবং সেও হেসে ফেলল। দেখাদেখি আমিও হো হো করে হেসে উঠলুম। দিব্যেন্দু আমার পাঁজরে চিমটি। কাটল। চোপরা একটু পিছনে দাঁড়িয়ে হাসছে। ভৃত্যগোষ্ঠী আমাদের হাসি দেখে প্রথমে হতবাক, স্তম্ভিত–পরে মজাটা টের পেয়ে গেছে। তাদেরও দাঁতগুলো ভোরের লালচে আলোয় ঝকমক করতে দেখলুম।

রত্নার হাসি শুনেই কর্নেল ঘুরেছিলেন। কিন্তু ওঁর মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। উনি সিরিয়াস হয়েই নাড়ি পরখ করছেন। এবং ওঁর চোখে সেই সুপরিচিত তীক্ষ্ণতা লক্ষ্য করে আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলুম।

সোনালী হাসতে হাসতে বলে উঠল দীপ্তি! দি গেম ইজ ওভার! উঠে পড়!

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। রত্না হাসতে হাসতে বলল কর্নেল! এবার কিন্তু মার্ডারারকে আপনার খুঁজে বের করা চাই। অনেক ক্লু আছে!

সোনালী দীপ্তির দিকে এগিয়ে ধমকের সুরে বলল–আঃ! ওঠ না! এই দীপ্তি! ওঠ!

কর্নেল গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন দীপ্তি উঠবে না।

সোনালী বললে উঠবে না মানে?

–ওর ওঠার ক্ষমতা আর নেই।..বলে কর্নেল আমার দিকে দ্রুত ঘুরলেন। জয়ন্ত, শীগগির যাও। অনিরুদ্ধবাবুকে খবর দাও। এবং ফোনে থানায় জানাতে বলো।

বাধা দিয়ে দিব্যেন্দু বলল–কিন্তু স্যার, পুলিশ এলে ফানটা মাঠে মারা যাবে।

কর্নেল হঠাৎ গর্জন করে উঠলেন–নো, নো মাই ইয়ং ফেণ্ড! ইট ইজ নো ফান! এটা সত্যিকার খুন। দীপ্তিকে কেউ সত্যিকার ছোরা দিয়ে খুন করেছে।

দিব্যেন্দু, রত্না ও চোপরা একসঙ্গে বলে উঠল–অসম্ভব! আমিও বলে উঠলুম– কর্নেল! কী বলছেন! এ তো নিছক মজা করার জন্যে…

কর্নেল ফের গর্জে উঠলেন শাট আপ! যা বললুম– করো গিয়ে। কুইক!

আমি যন্ত্রের মতো পা বাড়ালুম। পিছনে স্তব্ধতা। এতক্ষণে টের পেয়েছি, কর্নেল সত্যি রসিকতা করছেন না এবং দীপ্তি সত্যি সত্যি খুন হয়ে গেছে। আমার পা কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে টাল সামলালুম।

বারান্দায় উঠে এবার পিছু ফিরে দেখি, দলটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।..

.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক হত্যাকাণ্ড দেখেছি আমি এযাবৎ। কিন্তু এটি সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং অদ্ভুত। পনের মিনিটের মধ্যে রানীডিহির পুলিশ এসে গিয়েছিল। এখানে একটা অয়েল রিফাইনারি থাকায় কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর লোকজনও ছিল। আর ছিল রাজ্যের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কুশলী অফিসারগোষ্ঠী। পরবর্তী আধঘণ্টায় তারা সবাই এসে পড়লেন। কর্নেল এই হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ খুন বলে গণ্য করেননি, তা বোঝা যাচ্ছিল।

যেখানে মানুষ খুন হয়, সেখানে অফিসাররা কী পদ্ধতিতে রুটিন তদন্ত করেন– আমার দেখা আছে। এখানে তার ব্যতিক্রম ঘটল না। নীচের উপত্যকাটাও একদল অফিসার ঘুরে দেখলেন। অকুস্থলের তদন্তে যা দেখা গেল তা অদ্ভুত। সোনালী থিয়েটার ক্লাবের যে ছোরাটা দীপ্তির পিঠে আটকে দিয়েছিল, তা পাওয়া গেল দীপ্তির বুকের তলায়। সেই লাল রঙ আর সত্যিকার রক্ত একাকার হয়ে গেছে। সত্যিকার ছোরাটার বাঁটের গড়ন দেখেই অবাক হতে হয়–একেবারে হুবহু নকল ছোরাটার মতন। নকল ছোরাটা ছিল ফলার দুভাগ করা…ভেতরে ফাঁপা এবং স্প্রিং আছে। ডগাটা একেবারে ভোঁতা ভিজে মাটিতেও ঢোকানো যায় না। বাঁট ধরে কোথাও রেখে চাপ দিলে ডগাটা ভেতরে ঢুকে যায় এবং ভাগকরা জায়গা থেকে একটা ক্লিপ বেরিয়ে শরীরে আটকে যায়! তখন দেখে মনে হয়, আধখানা শরীরে ঢুকে গেছে। ভেতরে স্পঞ্জে রং থাকে। স্পঞ্জে চাপ পড়ামাত্র ছিটকে রঙটা বেরিয়ে আসে। থিয়েটারের খুনখারাপিতে ভারি চমৎকার কাজ দেয়। এক্ষেত্রে খুনী ওটা দীপ্তির পিঠ থেকে খুলেছে। খোলার পর আসল ছোরাটা মেরেছে এবং নকলটা বুকের তলায় লুকিয়ে রেখেছে।

কর্নেলের সঙ্গে ডিটেকটিভ অফিসার কিষাণ সিংয়ের কথাবার্তা আমি শুনেছি। দুজনেই একমত যে খুনী আমাদের দলেরই কেউ। দীপ্তিকে ফেলে রেখে সরে যাওয়ার পর সে ওর কাছে ফের যায় এবং সম্ভবত বলে যে ছোরাটা খুলে যাবে মনে হচ্ছে। তাই ওটা ভালভাবে আটকানো দরকার। এই অছিলায় সে হত্যার কাজটি সেরে ফেলেছে। কর্নেলের মতে–খুবই যুক্তিসিদ্ধ এটা। অপরিচিত লোক হলে অমনটা সম্ভব হতো না।

আমরা ক্লু রেখেছিলুম : পলিমাটি, দিব্যেন্দুর ব্রাণ্ডের সিগ্রেটের টুকরো এবং চোপরার লাইটার। এসবই আছে। কিন্তু সবটা শোনার পর ডিটেকটিভ অফিসাররা এসব আর আমল দেননি। শুধু কর্নেল সেগুলো সযত্নে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখেছেন। ও দিয়ে কী হবে কে জানে!

অকুস্থল থেকে ফিরে ব্যানার্জি সায়েবের বাংলোয় আমাদের ডাকা হলো। দীপ্তির মা বাবা কেউ নেই–মামার কাছে মানুষ হচ্ছিল। মামা ভবেশ চক্রবর্তী রিফাইনারি অফিসের হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট। দীপ্তির মামা-মামী সবাই এসেছেন। ওঁরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। সোনালীর মা সোনালী ও রত্নাকে ক্রমাগত ভর্ৎসনা করে যাচ্ছেন। অনিরুদ্ধ স্তম্ভিত। খুব ভয় পেয়েছেন মনে হলো। সোনালীর জন্মদিনের আনন্দটাও মাঠে মারা গেল!

ড্রয়িং রুমে কর্নেল ও একদঙ্গল অফিসার বসার পর প্রথমে ডাক পড়ল আমার। স্মার্ট হয়ে ঢোকার চেষ্টা করলুম। কিন্তু বুক কাঁপছিল। চেয়ারে বসার পর প্রশ্ন শুরু হলো। কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানছেন।

আমার নাম-ধাম, কর্নেলের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি শেষ হলো। তারপর গত রাতের ঘটনা নিয়ে জেরা চলল। আমি যা যা জানি, জবাব দিয়ে গেলুম। ওঁরা নোট করে নিলেন। তারপর কর্নেলের কাশির শব্দ হলো–এক মিনিট। উইথ ইওর কাইণ্ড পারমিশান প্লিজ!

কিষাণ সিং বললেন–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন কর্নেল।

–আমি জয়ন্তকে কিছু প্রশ্ন করব।

–অবশ্যই করবেন।

জয়ন্ত! তাহলে তুমি বলছ যে সোনালীর মুখেই তুমি শুনেছ মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা দীপ্তিই তুলেছিল?

-হ্যাঁ।

–তুমি বলছ যে গত রাতে দীপ্তির মুখে খুব নার্ভাসনেস দেখেছিলে!

–হ্যাঁ।

এবং আজ তার উল্টো অর্থাৎ মরীয়া মনে হচ্ছিল ওকে?

হ্যাঁ

দীপ্তিই তাহলে মার্ডার ফানের মোটিভ হিসেবে…

বিরক্ত হয়ে বললুম–বলেছি তো! রিফাইনারির সাবোটাজের কথা বলেছিল।

–ওক্কে। এবং দীপ্তিই বলেছিল, মোটিভের ক্লু হিসেবে একটুকরো কাগজ হাতে ধরে থাকবে–তাতে সংকেত বাক্যে সাবোটাজের উল্লেখ পাওয়া যাবে?

–সবই তো বলেছি।

–কিন্তু আমরা ওর হাতে তেমন কোনও কাগজের টুকরো পাইনি!

–সেজন্য কী আমি দায়ী?

সবাই হেসে উঠলেন আমার জবাব শুনে। কর্নেল বললেন–আচ্ছা, আচ্ছা! মাত্র আর একটা প্রশ্ন! তুমি যখন নদীর ধারে যাও, কিংবা সেখান থেকে ফিরে আসো, তখন কোনও শব্দ শুনেছিলে?

–হুঁ। অনেক শব্দ।

অফিসাররা নড়ে উঠলেন। কর্নেল ব্যর্থ হয়ে বললেন–অনেক শব্দ? কিসের?

–পাখিটাখির।

সবাই হাসলেন। কর্নেল বললেন–কাকেও দেখেছিলে, জঙ্গলে অথবা খুনের জায়গায়?

–হুঁউ। তবে খুনের জায়গায় নয়। পশ্চিমের একটা টিলায়।

ফের সবাই নড়ে বসলেন। কর্নেল বললেন–দেখেছিলে? চিনতে পেরেছিলে?

হুঁউ

কিষাণ সিং বললেন–কে সে? চোপরা না দিব্যেন্দু?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বায়ুসেবনে বেরিয়েছিলেন।

কর্নেল গোমড়ামুখে কী অস্ফুট বললেন। কিষাণ সিং দরজার দিকে ইশারা করে কাকে বললেন–সোনালী ব্যানার্জি! জয়ন্তবাবু, আপনি প্লীজ ওখানটায় বসুন।

কোণের সোফায় গিয়ে বসলুম। বুঝলুম, এখন বেরুনো যাবে না। সিগ্রেট ধরিয়ে টানতে থাকলুম। সোনালী পাথরের মূর্তির মতো ঘরে ঢুকল এবং নমস্কার করে ওঁদের সামনের চেয়ারে বসল।

নামধাম পরিচয় পর্ব হলো। তারপর জেরা চলতে থাকল।

মিস ব্যানার্জি, ঠিক কখন প্রথমে আপনারা মার্ডার ফানের কথাটা ভেবেছিলেন এবং প্রথম কে ভেবেছিল?

দীপ্তি। কদিন আগে কর্নেলকে বাবা আমার জন্মদিনে নেমন্তন্ন করতে পাঠালেন। রত্না আমার সঙ্গে যেতে চাইল। দীপ্তিও তা শুনে যাবে বলল। কর্নেলের বাড়ি থেকে ফেরার সময় রাস্তায় ট্যাক্সিতে দীপ্ত বলল–এই ভদ্রলোক তাহলে গোয়েন্দা? ওকে নিয়ে তোর জন্মদিনে একটা ফান করলে কেমন হয়? তারপর …

–ডেডবডি সাজতে কি দীপ্তিই চেয়েছিল?

–হ্যাঁ। ট্যাক্সিতে বসেই সব ঠিক হয়ে যায়।

হঠাৎ কর্নেল বললেন–ট্যাক্সির নাম্বারটা কি লক্ষ্য করেছিলে সোনালী?

–আমি করিনি। ওসব কেই বা লক্ষ্য করে? কেন বলুন তো?

–জাস্ট এ চান্স! যদি দৈবাৎ করে থাকো।

করিনি।… বলেই সোনালী নড়ে উঠল। হ্যাঁ, আমি করিনি। কিন্তু …।

–কিন্তু দীপ্তি…।

দীপ্তি করেছিল?

–হ্যাঁ ব্যাপারটা এখন মনে হচ্ছে, ভারি অদ্ভুত। জানেন? হাওড়া স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে আমরা ভবানীপুরে মামার বাসায় গেলুম, সেটাই আমাদের ইলিয়ট রোডে কর্নেলের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার সময়ও একই ট্যাক্সি। দীপ্তি এটা লক্ষ্য করেছিল। বলেছিল ব্যাপার কী রে? এই একটা ট্যাক্সিই পাচ্ছি খালি? আমি অবশ্য ট্যাক্সিওয়ালাকে লক্ষ্য করিনি। বলেছিলুম–তোর চোখের ভুল। বাইরের লোক তো তুই, তাই সব ট্যাক্সিওয়ালাকে একই লোক বলে ভুল করছিস! যেমন সব চীনেম্যানকে দেখে একই লোক। মনে হয়!

কিষাণ সিং বললেন–বেশ ইন্টারেস্টিং তো!

কর্নেল বললেন হাওড়া স্টেশনের ট্যাক্সি ভবানীপুরে নিয়ে যায় তোমাদের। তারপর সম্ভবত ওই ট্যাক্সিটাই তোমার মামার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল এবং তোমরা রাস্তায় নামতেই নিজে থেকে অফার দেয়।….

সোনালী সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। লোকটা আমাদের ডেকে বলল-আইয়ে মেমসাব! দীপ্তি বলল–সেই ট্যাক্সিঅলা না? আমি আর রত্না গ্রাহ্য করিনি। ট্যাক্সি পাওয়াই বড় কথা।

-রাইট। তোমরা যখন আমার বাসায় গেলে, আমি অভ্যাসমতো জানালায় দাঁড়িয়েছিলুম। দেখলুম ট্যাক্সিটা তোমাদের নামিয়ে দিয়েই ফিরল। কিন্তু চলে গেল না। ওধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নাম্বারটা আমার মনে আছে।..বলে কর্নেল পকেট থেকে নোটবই বের করলেন। বললেন–লিখে নিন মিঃ সিং। এক্ষুণি কলকাতায় খোঁজ নিতে হবে। এটা বিশেষ জরুরী।

কিষাণ সিং একজন অফিসারকে তক্ষুনি ফোনের কাছে পাঠালেন। তারপর কর্নেল বললেন–সোনালী, দীপ্তির ব্যক্তিগত জীবনের দু-একটা কথা তোমার মুখেই শুনতে চাই।

বলুন। যা জানি, বলব।

–ইয়ে, ওর কি কোনও প্রেমিক ছিল? লজ্জার কারণ নেই, বলো।

সোনালী মুখ নামিয়ে বলল–দিব্যের সঙ্গে একসময় ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাছাড়া দিব্যের সঙ্গেই ওর বিয়ের কথাও চলছিল। দিব্য রিফাইনারিতে চাকরিটা পেয়ে গেলেই বিয়েটা হতো।

–আই সী! কিন্তু ঘনিষ্ঠতাটা একসময় ছিল বলছ কেন?

–ইদানিং দীপ্তি যেন দিব্যকে এড়িয়ে চলছিল। আর…

বলো!

–আর রণধীরদার সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা করছিল।

–মানে তোমার বাবার প্রাইভেট অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটির সঙ্গে?

–হ্যাঁ। তবে এ নিয়ে দিব্যর সঙ্গে কোনওরকম মনকষাকষি দেখেনি। আমরা একসঙ্গেই বেশিরভাগ সময় থাকি। তেমন কিছু ঘটলে টের পেতুম। দিব্যও এসব মাইণ্ড করার ছেলে না।

ইদানিং দীপ্তির মধ্যে কোনও বিশেষ ভাবান্তর টের পাচ্ছিলে কি?

সোনালী একটু ভেবে বলল–তেমন কিছু দেখেনি। তবে…

-তবে?

মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকত। জিগ্যেস করলে কিছু বলবে মনে হতো–কিন্তু শেষ অব্দি বলত না। শুধু বলত–শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।

–আচ্ছা, ওকথা থাক। আজ সকালে তুমি দীপ্তিকে ওভাবে রেখে বারান্দায় চলে এলে! তখন বারান্দায় রত্না ছিল। তাই না?

-হ্যাঁ। আমরা দু’জন ছিলুম।

–ওদিক থেকে কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলে? কিংবা কাকেও যেতে দেখেছিলে?

না।

–ভেবে বলো।

সোনালী জোরের সঙ্গে মাথা দোলাল। আমরা দুজনেই ওদিকে তাকিয়েছিলুম।

তারপর প্রথমে দিব্য না চোপরা ফিরে এল?

–চোপরা।

–কোনদিক থেকে?

পুবদিক।

–তার মধ্যে কোনও ভাবান্তর ছিল?

নাঃ। হাসতে হাসতে এল।

–ভেবে বলো। কারণ তোমার উইশফুল থিংকিং হতে পারে।

সোনালী ভেবে নিয়ে জবাব দিল-মনে হচ্ছে, হাসতে দেখেছি। তারপর একটু গম্ভীর হয়েছিল মনে পড়ছে। একটু…হ্যাঁ কর্নেল, ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। কারণ রত্না ওকে ডাকলে শুনতে পেল না। তখন রত্না বলল, খুব ঘাবড়ে গেছ মনে হচ্ছে! ও যেন চমকে উঠে আবার হাসতে লাগল।

দিব্য এল কোনদিক থেকে? কতক্ষণ পরে?

–পশ্চিমদিক থেকে। মিনিট তিন-চার পরে। দিব্যকে কিন্তু খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। এখন মনে পড়ছে। ও এসেই বলল–খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে যেন!..বলেই সোনালী নড়ে উঠল। কর্নেল! মনে পড়ছে, দিব্য যেন হাঁফাচ্ছিল।

বলো কী!

-হ্যাঁ। রত্না ওকে ধমক দিয়ে বলল–দাদা সবতাতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমি ঠাট্টা করে বললুম–হবু ব্রাইড ইজ মার্ডারড। কষ্ট হচ্ছে না বুঝি? তা শুনে দিব্য রাগ দেখিয়ে বলল–খুব ডেঁপো মেয়ে হচ্ছ। সেই সময় দেখি জয়ন্তবাবু ঝোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো। পলিমাটিগুলো ছড়িয়ে চলে আসার কথা। অথচ উনি যেন কী দেখছেন। তাই আমি দৌড়ে গেটে গেলুম ওকে ডাকতে।

তার মানে জয়ন্তকে তুমি ফিরতে দেখনি?

না। মানে, তখন আমরা নিজেদের মধ্যে ওইসব কথাবার্তা বলছি তো। তাই ওদিক আর তাকাচ্ছিলুম না!

-রত্না আর তুমি বারান্দায় থাকার সময়ও কেউ ওখানে গেলে তাহলে তোমার চোখে পড়ার চান্স বেশি ছিল না।

সোনালী ব্যস্ত হয়ে বলল না না, ছিল। তখন…

–অবশ্য দক্ষিণের ঢালু থেকে ঝোপ ঠেলে কেউ এলে তাকে পেতে না।

হ্যাঁ। তা পেতুম না।

-ঠিক আছে সোনালী। তুমি জয়ন্তের কাছে গিয়ে বসো। নাকি মিঃ সিং কিছু প্রশ্ন করবেন?

সবাই মাথা দোলালেন। সোনালী আমার পাশে এসে নিঃশব্দে বসে গেল। কিষাণ সিং ডাকলেন–দিব্যেন্দু চ্যাটার্জিকে ডাকো..

.

দিব্যেন্দুর প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর যথারীতি জেরা শুরু হলো। আমি ও সোনালী দুজনেই তাকিয়ে রইলুম দিব্যের দিকে।

কিষাণ সিং বললেন–মার্ডার ফানের কথা কখন কোথায় প্রথম কার কাছে শোনেন?

কাল রাত্রে সোনালী রত্না আর দীপ্তি তিন জনের কাছেই।

–তিনজনের কাছে? দিস ইজ অ্যাবসার্ড। নিশ্চয় প্রথমে একজনই বলেছিল। কে?

দিব্য ভড়কে গিয়ে বলল–হ্যাঁ, মানে তখন বারান্দায় তিনজনই ছিল। প্রথমে অবশ্য সোনালীই বলল।

–শুনে আপনি কী বললেন?

বাধা দিলুম। বললুম– এ বড্ড বাজে ব্যাপার। অন্য কোনও ফানের প্ল্যান করা যাক। ওরা শুনল না। অগত্যা আমি মত দিলুম।

–কেন বাধা দিয়েছিলেন?

ব্যাপারটা..ব্যাপারটা আমার কাছে উদ্ভট মনে হয়েছিল।

–ফান মানেই উদ্ভট কিছু।

–তাহলেও দীপ্তিকে আমি ডেডবডি করাটা পছন্দ করিনি।

কর্নেল বলে উঠলেন দীপ্তিকে তো তুমি ভালবাসতে দিব্য? না–না, লজ্জার কারণ নেই। আমরা আধুনিক যুগের মানুষ।

দিব্য মাথাটা একটু দোলাল।

–তোমার সঙ্গে তো ওর বিয়ের কথা ছিল?

–হ্যাঁ। কিন্তু…

–বলো, বলো!

ইদানিং দীপ্তি আমাকে এড়িয়ে থাকতে চাইত যেন। আমি অবশ্য তাতে কিছু মাইণ্ড করিনি। ও বড্ড খামখেয়ালি মেয়ে ছিল। আমার ধারণা, শিল্পীরাই খামখেয়ালী।

দীপ্তি ইদানিং চোপরার সঙ্গে মেলামেশা করত কি?

দিব্য মুখ নামিয়ে বলল–হ্যাঁ। আজ ভোরেও চোপরা ওকে গাড়ি করে এখানে পৌঁছে দেয়। অথচ কথা ছিল, আমিই ওকে নিয়ে আসব। তাই বেরুতে যাচ্ছি, দেখি চোপরার গাড়িতে ও আসছে। মানে গাড়িটা তখন গেটে ঢুকছিল।

কিষাণ সিং বললেন–মিঃ চ্যাটার্জি! গত আগস্টে রানীডিহির ইভনিং লজ নামে একটা বাড়ি থেকে আপনাকে জুয়াখেলার জন্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখন আপনি মাতাল অবস্থায় ছিলেন। খবর পেয়ে মিঃ ব্যানার্জি–মানে আপনার মেসোমশাই আপনাকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। শুধু এই নয়–আরও দুবার আপনাকে মারামারির অভিযোগে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল এবং আপনার মেসোমশাইয়ের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান। এসব কারণেই রিফাইনারিতে আপনার চাকরি পাবার অসুবিধা হচ্ছে। দিস ইজ দা রেকর্ড। এবার বলুন, ঠিক এসবের জন্যেই কি দীপ্তির সঙ্গে আপনার ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?

সোনালী মুখ ফিরিয়েছে। আমি অবাক। কর্নেল দিব্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঘরটা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। কিষাণ সিং আবার বললেন–জবাব দিন মিঃ চ্যাটার্জি।

দিব্য ঠোঁট কামড়ে বলল–না।

–আপনার বাবা মা কলকাতায় থাকেন। তাই তো?

—হ্যাঁ।

–আপনাকে মিঃ অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি কাছে এনে রেখেছেন আপনার স্বভাব শোধরাতে। অস্বীকার করে লাভ নেই। অনিরুদ্ধবাবুর কাছেই আমরা সব শুনেছি।

না। মেসোমশাই আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে ডেকেছিলেন। আমার বোন রত্নার কাছে জানতে পারেন।

–আপনার বোন রত্নার নামেও কিছু রেকর্ড আছে দিব্যবাবু।

দিব্য মুখ তুলল। সাদা হয়ে গেছে মুখটা।

রত্না একসময় নকশালপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ওকেও আপনার বাবা এখানে পাঠিয়ে দেন। আমাদের ধারণা, আপনারা ভাইবোন দুজনেই সেই দলের সঙ্গে এখনও যুক্ত। অস্বীকার করতে পারেন?

দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–মিথ্যা। একেবারে মিথ্যা। কে বলল এসব?

রেকর্ড। আচ্ছা, এবার বলুন, গত সপ্তাহে মিঃ চোপরা আর আপনি সান ভিউ রেস্তোঁরায় ঘুষোঘুষি করেছিলেন। আপনাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল। তাই না?

–হ্যাঁ। চোপরা আমাকে জাত তুলে গাল দিয়েছিল।

–আপনাদের তৃতীয় লোকটির নাম বলুন।

ও আমার বন্ধু। দিল্লিতে থাকত। নাম রাজীব শেরগিল। এখানে বেড়াতে এসেছিল। ওর কথাতেই তর্ক বাধে। শেষে ঝগড়া হয় চোপরার সঙ্গে। প্রভিন্সিয়ালিজম নিয়ে।

–আমরা জানি রাজীব শেরগিলের বয়স চল্লিশের ওপারে। আপনি তিরিশের নীচে। বন্ধুতার অবলম্বনটা কী?

দিল্লিতে আলাপ হয়েছিল। আলাপ থেকেই বন্ধুতা। কেন? ওই জয়ন্তবাবু যদি এই বৃদ্ধ কর্নেলসায়েবের বন্ধু হতে পারেন–আমার বেলা দোষ হবে কেন?

কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। কিষাণ সিং বললেন–আপনি নিশ্চয় জানেন, ওয়াটারট্যাংকের কাছে যে লোকটির লাশ পাওয়া গেছে–সে লোকটাই সেই রাজীব শেরগিল?

দিব্য মুখ নামিয়ে বলল–হ্যাঁ।

–আমরা আপনাকে ওই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে গ্রেফতার করতে পারি।

দিব্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–কেন? আমি ওকে খুন করিনি। কেন ওকে খুন করব?

কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন ঠিক আছে। এবার বলুন, এই সিগ্রেটের টুকরো দুটো মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে আপনিই কি ফেলে রেখেছিলেন ওখানে?

কাগজের মোড়ক খুললে দিব্য দেখে নিয়ে বলল–আমি তো মোটে একটা টুকরো ফেলেছিলুম। আর…এ কী! দুটোই যে আমার ব্রাণ্ডের!

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–বোঝা যাচ্ছে, খুনী ক্লুর ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছে।

কিষাণ সিং বললেন–ছোরার বাঁটে আঙুলের ছাপ থাকবে।

দিব্য বলে উঠল–হাতে দস্তানা পরলে?

অমনি কিষাণ সিং একটু ঝুঁকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন–আপনি বলছেন! মাই গুডনেস! কীভাবে জানলেন? পরেছিলেন তাই না?

দিব্য থতমত খেয়ে বললে-জাস্ট কমনসেন্স!

এনা! আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। অ্যাণ্ড নেক্সট মিঃ রণধীর চোপরা।

.

রণধীর স্মার্ট হয়ে হাসিমুখে ঢুকল। নমস্তে করে বসল। কিষাণ সিং তার প্রাথমিক পরিচয় যথারীতি নিয়ে জেরাপর্বে চলে গেলেন। লক্ষ্য করলুম, দিব্যর সঙ্গে ওর ঝগড়া বা দীপ্তিসংক্রান্ত কোনও প্রশ্নই করছেন না। আজ সকালের ঘটনাই তুলছেন।

–আচ্ছা মিঃ চোপরা, আপনি যখন পুবদিকে বড় রাস্তায় গেলেন, সেখান থেকে আপনাদের মার্ডার ফানের জায়গাটা কি দেখা যচ্ছিল?

-হ্যাঁ। কারণ ওখানটা উঁচুতে। এই টিলার দক্ষিণ অংশ ওটা। আর আমি ছিলুম অনেকটা ফাঁকা বড় রাস্তায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল জায়গাটা।

কাকেও দেখতে পেয়েছিলেন। মানে–আপনি চলে আসার পর?

–হ্যাঁ।

কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন। কিষাণ সিং বললেন–দেখতে পেয়েছিলেন?

–হ্যাঁ।

–সে কে?

-চিনতে পারিনি। সবুজ ফুলহাতা জামা ছিল গায়ে। প্যান্ট দেখা যাচ্ছিল না ঝোপের আড়ালে। মুখটা ওপাশে ছিল বলে দেখতে পাইনি। বেশ মোটাসোটা লোক।

-মানে ফ্যাটি?

–হ্যাঁ। প্রকাণ্ড। তবে বেঁটে বলেই মনে হচ্ছিল।

–তাকে দেখে আপনার কিছু মনে হয়নি?

হয়েছিল। ভাবলুম, খেলাটা বরবাদ হয়ে গেল হয়তো। এক্ষুণি হুলুস্থুল বাধবে। কিন্তু লোকটা ঝোপের আড়ালে ডুবে গেল। তখন ভাবলুম, কেউ বেড়াতে বেরিয়েছে। উপত্যকার দিকে সোজাসুজি নেমে গেল। তারপর আর তাকে দেখিনি।

-সবুজ ঝোপঝাড়ের মধ্যে সবুজ জামা! চোখে পড়া তো অস্বাভাবিক!

চোপরা একটু ইতস্তত করে বলল–না, মানে–তখন আমার ওখানেই মন পড়ে ছিল কি না! দ্যাটস ন্যাচারাল। তাই না স্যার?

কিষাণ সিং জবাব দিলেন না। কর্নেল বললেন রাইট, রাইট।

তাছাড়া স্যার, ব্যাপারটা আমার খুব গোলমেলে লাগছিল।

কর্নেল বললেন–কেন বলুন তো?

দীপ্তির মার্ডার মোটিভটা শুনে যদিও খুব ফানি মনে হয়েছিল। পরে মনে হলো–দীপ্তি কি কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছে। মানে আমাকেই যেন

–ইঙ্গিত? কিসের?

–মানে, অয়েল রিফাইনারিতে সাবোটাজের। দ্যাটস অলসো ন্যাচারাল।

–ঠিক বলেছেন। কিন্তু দীপ্তির সঙ্গে তো আপনার ইদানিং ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল?

–হ্যাঁ। একটু একটু। আই লাইকড হার।

–দুজনে একসঙ্গে ঘুরেছেন, কিংবা নিভৃতে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন?

–হুঁউ। দ্যাটস ন্যাচারাল।

-ওইসব সময় দীপ্তি আপনাকে অনায়াসে তেমন কিছু গুপ্ত ব্যাপার থাকলে জানাতে পারত?

–তা তো পারতই।

কিন্তু জানায়নি। তাই না?

না। সম্ভবত গত রাতেই ও তেমন কিছু আঁচ করে থাকবে। তাই…।

–এক মিনিট। তাহলে তো আজ ভোরে ওকে যখন নিয়ে এবাড়ি এলেন, তখন বলতে পারত আপনাকে?

ও চাপা মেয়ে ছিল। কিংবা হয়তো সাবোটাজকারীদের কেউ গতরাতে বারান্দায় আমাদের মধ্যে উপস্থিত ছিল। তাকেই দীপ্তি সতর্ক করতে চেয়েছিল।

মিঃ চোপরা! আপনি বয়সে তরুণ হলেও খুব বুদ্ধিমান। খুবই যুক্তিপূর্ণ কথা বলেছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, কারা উপস্থিত ছিল তখন? জয়ন্তবাবু, দিব্য, রত্না আর সোনালী। এখন বলুন–আপনার ধারণা অনুযায়ী কে সাবোটাজকারী দলের লোক হতে পারে? খুব ভেবে বলবেন কিন্তু।

চোপরা একটু ভেবে নিয়ে বললে–আমি কিন্তু স্ট্রেটকাট কথাবার্তা বলা পছন্দ করি। এজন্যই দিব্যের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে বেধে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দিব্যকেই সতর্ক করতে চেয়েছিল দীপ্তি। এই সঙ্গে লক্ষ্য করবেন, দিব্যের সঙ্গে ওর বিয়ে প্রায় ঠিক। অথচ ও দিব্যকে এড়িয়ে চলছিল ইদানিং। অতএব আমার ডিসিশানে দাঁড়াচ্ছে, দীপ্তি দিব্যের কার্যকলাপ টের পেয়েই ঘৃণা করে সরে এসেছিল।

এবং আপনার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল!

–কারেক্ট স্যার। ভেরি ভেরি কারেক্ট। দিব্যের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আমি। আমি ছাড়া দিব্যের সঙ্গে লড়ার তাকত এখানে কারো নেই, দীপ্তি জানত। কিংবা এও হতে পারে, আমি অয়েলরিফাইনারির ডিরেক্টরের পি.এ.। আমার সঙ্গে মেশার মধ্যে দীপ্তির একটা উদ্দেশ্য থাকতেও পারে। তা হলো- দিব্যকে সতর্ক করে দেওয়া সাবধান, জানি কর্তৃপক্ষের কানে তুলে দিতে পারি! ইজ ইট ইল্লজিক্যাল?

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন রাইট, রাইট। মিঃ সিং! এবার আপনি কিছু জানতে চাইলে প্রশ্ন করুন।

কিষাণ সিং বললেন না। আমার প্রশ্ন নেই। নেক্সট রত্না চ্যাটার্জি।…

.

রত্না সাদা মুখে এল। যন্ত্রের মতো হাত তুলে নমস্কার করল। দেখলুম ওর পায়ের কাছে শাড়ির পাড় থরথর করে কাঁপছে।

–আপনি রত্না চ্যাটার্জি?

হুঁ।

বাবার নাম, ঠিকানা, পেশা এসব কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করা হলো না, এতে অবাক হলুম। কিষাণ সিংয়ের কাছে একটা ফাইল ছিল। ফাইলটা খুলে আধ মিনিট কী দেখার পর উনি মুখ তুললেন। তারপর বললেন-দীপ্তির সঙ্গে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর সকালে আপনি পাতালকালীর মন্দিরে গিয়েছিলেন কি?

রত্না মাথা দোলাল।

-কেন?

রত্না একটু ইতস্তত করে আস্তে বলল–যে জন্যে সবাই যায়!

মন্দিরে যাবার কথা কে তুলেছিল? আপনিনা দীপ্তি?

–দীপ্তি।

দীপ্তি ভক্তিমতী মেয়ে ছিল–এমন কথা আমরা এখনও কারো কাছে শুনিনি। ওর মামা-মামী এবং মামাতো ভাই-বোন বরং বলেছেন, দীপ্তির ওসব বিশ্বাস ছিল না। আপনি কী বলেন?

হ্যাঁ। ও নাস্তিকটাইপ ছিল। বরাবর ধর্মটর্ম নিয়ে ঠাট্টা করত।

–তাহলে বলুন দীপ্তি পাতালকালীর মন্দিরে নিছক বেড়াতে গিয়েছিল?

আমাকে তাই বলেছিল। পরে অবশ্য…

–হুঁ, বলুন।

পরে আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওর যেন অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।

–সেটা কী?

কারও সঙ্গে দেখা করা।

–কেন এমন মনে হলো আপনার?

–ওর চোখমুখের ভাব দেখে। খুব খুঁজছিল–মানে ভিড়ের সব মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। তা লক্ষ্য করে আমি ওকে বলেছিলুম, কাকেও খুঁজছিস নাকি রে? ও জবাব দিয়েছিল, না, এমনি। চেনা কেউ আছে নাকি দেখছি। কিন্তু কারও সঙ্গে ও কথা বলেনি শেষ পর্যন্ত। অবশ্য, আমার খটকাটা থেকেই গিয়েছিল। ফেরার পথে যখন ওকে চেপে ধরলুম, ও কবুল করল না। আগের মতোই নিছক বেড়াতে আসার কৈফিয়ত দিল। তখন বললুম– তোর কি হঠাৎ দেবদেবতায় বিশ্বাস ফিরে এসেছে? দীপ্তি হাসল শুধু। ভাবলুম, দাদার সঙ্গে একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে, তাই হয়তো। মনে অশান্তি চলছে বড্ড। পাতালেশ্বরীর কাছে মনে মনে তাই প্রার্থনা করে গেল। অবশ্য খটকাটা আমার থেকেই গেল।

একটু ভেবে ও ফাইলটা দেখে কিষাণ সিং বললেন বাড়ি থেকে মন্দির এবং মন্দির বাড়ি সারাক্ষণ আপনি ওর সঙ্গে ছিলেন?

-হ্যাঁ।

যাবার সময় কিসে গেলেন?

–রিকশোয়।

–ফিরলেন কিসে?

রণধীরদার গাড়িতে। হঠাৎ পেয়ে গেলুম। ও স্টেশন থেকে আসছিল।

–আমরা সেটা জানি। রণধীর চোপরার গাড়িটা আপনাকে আগে নামিয়ে দিয়ে পরে দীপ্তিকে পৌঁছে দিতে যায়। অথচ আগেই দীপ্তির মামার বাসাটা পড়ে। তাই না?

–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমার খারাপ লেগেছিল নিশ্চয়। চোপরার সঙ্গে ইদানীং ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। দাদার জন্যে আমার কষ্ট হত। কিন্তু এসব তো দীপ্তিকে বলা যায় না।

যাকগে, এবার বলুন, গাড়িতে আপনারা কী আলোচনা করেছিলেন?

–সোনালীর জন্মদিনের কথা। রণধীরদা বরাবর সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেয়। ন্যাচারালি ওর সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল।

–আপনারা কলকাতা গিয়ে কর্নেল সরকারকে নেমন্তন্ন করবেন, একথাও নিশ্চয় উঠেছিল?

হুঁ।

-চোপরা কর্নেল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেছিলেন?

না। মানে জিগ্যেস করল যে ভদ্রলোক কে? আমরা ওঁর পরিচয় দিলে ও খুব উৎসাহ দেখিয়ে বলল, দারুণ জমবে! গোয়েন্দাদের কখনও দেখিনি। তারপর কথায় কথায় ফাংশানের ডিটেলস এসে পড়ল। তখন রণধীরদা বলল, এক কাজ করা যায়। অ্যাজ ইউ লাইক ইট খেলার বদলে অন্য কোনও ফান হোক না? মার্ডার ফান! গোয়েন্দা ভদ্রলোককে নিয়ে মজা করা যাক।

ঘরের সবাই নড়ে বসলেন। আমরা কজন, সোফায় বসে আছি যারা, তারাও ঘুরে টেবিলের দিকে তাকালাম। আড়চোখে দেখি, চোপরা শুকনো হাসছে, কর্নেল হেসে উঠলে ওই ভাবটা ঘুচে গেল।

কর্নেল বললেন–তাহলে দীপ্তির মাথায় মার্ডার ফানের প্রস্তাবটা প্রথম ওঠেনি, বোঝা গেল।

আমাদের পাশ থেকে চোপরা বলে উঠল–দ্যাটস ন্যাচারাল! আমি আগাথা ক্রিস্টি প্রচুর পড়েছি। তা থেকেই ওটা মাথায় এসেছিল। নিশ্চয় এটা কোনও ক্রাইম নয়!

কিষাণ সিং হাত তুলে বললেন–আপনি কোনও কথা বলবেন না, প্লীজ।

রত্না ক্রমশ আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠেছে। সে বলল–কিন্তু এটা সত্যি যে দীপ্তি নিজেই ভিকটিম হতে চেয়েছিল।

–ওই গাড়িতে বসেই কি ভিকটিম হবার প্রস্তাব দীপ্তি দিয়েছিল?

রত্না জোরে ঘাড় নাড়ল। না, না। ও তখন জোর আপত্তি করেছিল। এসব বাজে খেলা–অন্য কিছু ভাবো। দীপ্তি বলেছিল। পরে বাসায় ফিরে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বললে সোনালীও আপত্তি করেছিল। কিন্তু শেষে দেখি, দীপ্তিই মার্ডার ফানের ব্যাপারে জেদ ধরেছে।

–আপনি যে প্রথমে সোনালীকে মার্ডার ফানের কথা বলেছিলেন, তা সোনালী কিন্তু আমাদের বলেনি।

আমার পাশ থেকে সোনালী বলল, ভুলে গিয়েছিলুম। এখন মনে পড়ছে, রত্না বাইরে থেকে ফিরে ওই প্রোপোজালটা দিয়েছিল।

কিষাণ সিং ফের হাত তুলে বললেন কথা বলবেন না, প্লীজ।

হঠাৎ কর্নেল একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন–ইয়ে রত্না, তোমার দাদা দিব্যেন্দুর কি কোনও সবুজ পাঞ্জাবি আছে?

রত্না বলল–হ্যাঁ। কেন?

অমনি একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। দিব্যেন্দু আমাদের কাছ থেকে তড়াক করে এক লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোল। একজন পুলিশ অফিসার ওর কলার ধরে ফেললেন। দিব্য ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিল। পারল না।

এই সময় কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–মিঃ সিং! আমার মনে হচ্ছে আপাতত এ পর্যায় এখানেই শেষ। অবশ্য আপনার ইচ্ছে করলে এগোতে পারেন। আমি একটু বাইরে যেতে চাই।

কিষাণ সিং একটু হেসে বললেন–ক্ষমা করবেন কর্নেল। দিস ইজ দা অফিসিয়াল প্রসিডিওর। আমরা এখানেই থামতে পারি না। বাড়ির সারভ্যান্টদের প্রশ্ন করা বাকি আছে।

কর্নেল জিভ কেটে বললেন–সরি, ভেরি সরি মিঃ সিং। দ্যাটস কারেক্ট। বলে টেবিল থেকে উঠে এসে আমার দিকে তাকালেন। তারপর কিষাণ সিং-এর দিকে ঘুরে বললেন মিঃ সিং! আমার এই হতভাগ্য বন্ধুটিকে কি বাইরে যাবার অনুমতি দেবেন?

কিষাণ সিং হেসে বললেন–অবশ্যই।

–এস জয়ন্ত, আমরা একবার বাইরে খোলা হাওয়ার গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। বাইরে লনে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে বললুম–কর্নেল, তাহলে দিব্যকে মনে হচ্ছে গ্রেফতার করা হলো।

কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন তাই মনে হচ্ছে। দিব্যেন্দুর ওই সবুজ জামাটাই ভাইটাল এ কেসে। অবশ্য যদি চোপরার কথাটা সত্যি হয়, তবেই। যাক গে, এস– আমরা একবার নদীর ধারটা ঘুরে আসি।

নদীর ধারে যেতে হলে এই ছোট রাস্তা ধরে যেতে হবে, কিন্তু কর্নেল ওদিকে গেলেন না। সোজা অকুস্থলের পাথরটার কাছ দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে চললেন। দেখলুম, দীপ্তির লাশটা সরানো হয়েছে। পাথরের একধারে কিছু রক্ত লেগে আছে। ঘাসে ও মাটিতেও আছে। সেটা সত্যিকার রক্ত হতেও পারে, আবার সোনালীর পেন্টও হতে পারে। কিন্তু একবার তাকিয়েই চোখ ফেরালুম। যেন দীপ্তিকে দেখতে পাচ্ছিলুম–একটু ঝুঁকে পাথরে গাল রেখে শুয়েছে। তাজা ফুলের মতো একটা মেয়ে–স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিল এই কুৎসিত পৃথিবীতে। খুব কষ্ট নিয়েই পা বাড়ালুম। জানতুম কর্নেল বিস্তর পাহাড়ে চড়েছে। তাই এই ঢালু দুর্গম জায়গায় ওঁর কোনও কষ্ট না হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমার মতো আনাড়ির পক্ষে মারাত্মক। একখানে পাথরে পা স্লিপ করে গড়িয়ে পড়লুম এবং গড়াতে গড়াতে প্রায় পনের কুড়ি ফুট নীচে একটা গর্তে গিয়ে আছাড় খেলুম। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি, শুনি কর্নেল ওপরে দাঁড়িয়ে হাসছে।

রেগে বললুম–আর কখনও কোথাও যাব না আপনার সঙ্গে। গেলেই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ব এবং বিদঘুটে কাণ্ড ঘটবে! ভ্যাট!

ওপর থেকে নেমে এসে কর্নেল একটু হেসে বললেন–ডার্লিং, মাঝে মাঝে আছাড় খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। ছেলেবেলায় মানুষ প্রায়ই আছাড় খায়। এতেই বোঝা যায় প্রকৃতি ওইভাবে তাকে স্বাস্থ্য আয়ু সাহস ও সহ্যশক্তি যোগান দেন। বড় হয়ে আছাড় খাবার ব্যাপারে সতর্ক হয় মানুষ। এটা প্রকৃতির বিরুদ্ধতা। এ জন্যেই তো প্রকৃতি সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দেন যে… ।

কর্নেল প্রায়ই উদাত্তকণ্ঠে লেকচার দিচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে কি যেন দেখতে থাকলেন কুঞ্চিত ভুরু। তারপর বাইনোকুলারটি চোখে তুললেন। কিন্তু সর্বনাশ! নির্ঘাৎ বাতিকগ্রস্ত প্রকৃতিবিদ কোনও বিরল প্রজাপতি অথবা পাখি দেখতে পেয়েছেন এবং তার মানে এবার নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে হয়তো গোটা দিনটাই পাখিটার পিছনে বনবাদাড় নালা ডিঙিয়ে ঘোরাঘুরি করবেন–আমাকেও হন্যে করবেন!

কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে সম্মোহিত মানুষের মতো–নিশির ডাকে মানুষ যেমন যায়, এগোতে থাকলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম। বাংলোয় ফিরব। শরীর ক্লান্ত। মনও ভাল নেই। সেই ঢাল জায়গা বেয়ে অনায়াসে লেজে ভর করে দাঁড়ানো গিরগিটির মতো কর্নেল ফাঁকা বরাবর অন্তত একশো ফুট এগোলেন। তারপর একটা প্রকাণ্ড পাথরের সামনে হাঁটু ভাজ করলেন। ওই অবস্থায় ওঁকে প্রায় তিন মিনিট চুপচাপ থাকতে দেখলুম। তারপর ঘুরে আমার দিক হাত নেড়ে বললেন–জয়ন্ত, দেখে যাও।

পৌঁছানো আমার পক্ষে বেশ কষ্টকরই হলো। কিন্তু কৌতূহল আমাকে টেনে নিয়ে গেল। গিয়েই যা দেখলুম, অবাক হয়ে গেলুম। রণধীর চোপরার কথা মিথ্যে নয়–একটা সবুজ পাঞ্জাবি সাবধানে পাথরের ফাটলে রাখা হয়েছে।

কর্নেল বললেন–দিব্যের বাঁচা কঠিন হয়ে গেল। চোপরা বলেছে একটা বেঁটে মোটাসোটা নোক দেখেছিল। আসলে একটা জামা পরা অবস্থায় এই পাঞ্জাবি পরলে দূর থেকে তাই-ই দেখাবে। জয়ন্ত, দেখতে পাচ্ছ। পাঞ্জাবিতে রক্তের ছোপ লেগে আছে।

দেখে আঁতকে উঠলুম। বললুম–দিব্য এমন বোকার মতো কাজ করে ফেলল?

কর্নেল বললেন-সবুজ পাঞ্জাবি পরে খুন করার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছ? সবুজ ঝোপঝাড় বা গাছের মধ্যে ক্যামোফ্লেজের কাজ করবে। কারো হঠাৎ নজরে পড়বে না। দ্বিতীয়ত…বলে উনি থেমে গেলেন। সাবধানে পাঞ্জাবিটার পকেটের দিকটায় আঙুলের চাপ দিলেন।

বললুম–কী? ·

–সিগ্রেটের প্যাকেট। মার্ডার ফানের ক্লু হিসেবে একটা টুকরো ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দুটো পাওয়া গেছে। তার মানে পকেটে সিগ্রেট থাকায় আরেকটা সিগ্রেটের টুকরো ফেলে রাখা সম্ভব হয়েছে। খুনী যেন একটা খেলার ক্লু রেখে দিতে চেয়েছে। কেন?

প্রশ্নটা কর্নেল আপন মনেই করলেন। বিরক্ত হয়ে বললুম–খুনী-খুনী করছে কেন এখনও? দিব্য বললেই আমার কাছে আপনার জটিল কথাবার্তার মানে বোঝা সহজ হয়ে ওঠে।

কর্নেল ঘুরে বললেন–দ্যাট ডিপেণ্ডস্ ডার্লিং!

অন হোয়াট?

–আরও সাক্ষ্য-প্রমাণ।

–যেমন?

–দিব্য এই পাঞ্জাবিটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, নাকি পরে পশ্চিমের দিকে ঘুরতে যাবার সুযোগে বাংলোয় ঢুকে নিয়ে এসেছিল?

ভেবে বললুম–পশ্চিমেই তো বাংলো বাড়ির সদর গেট। কারো চোখে পড়া স্বাভাবিক।

কর্নেল বললেন–ঠিক আছে। এটা এখানেই থাক। আমরা আপাতত বাংলোয় ফিরি। একটা কথা জয়ন্ত, তুমি ঘুণাক্ষরে একথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না।

নিশ্চয় নয়।

হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমার ভয় হয় জয়ন্ত! যুবতী, স্ত্রীলোকদের প্রতি তুমি সময়ে খুবই পক্ষপাতিত্ব দেখাও।

হো হো করে হেসে বললুম–দ্যাটস ন্যাচারাল!

–ওটা চোপরার মুদ্রাদোষ, তাই না জয়ন্ত?

কী কথায় কী! বললুম–হ্যাঁ। এবং আমার ক্ষেত্রে সঙ্গদোষ। চোপরার কাছে শুনে এই হয়েছে।…

আন্দাজ ফুট বিশেক ওপরে উঠেছি, হঠাৎ কর্নেল দাঁড়ালেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন–উঁহু, হয়তো খুবই ভুল করছি। তুমি এক কাজ কোরো জয়ন্ত। এখানে ঝোপের আড়ালে বসলে পাঞ্জাবিটার ওপর লক্ষ্য রাখা যায়। তোমার রিভলভারটা কি কাছে আছে?

না। ওসব নিয়ে ঘোরাঘুরি করি নাকি? কী দরকার?

–ঠিক আছে। কোনও দরকার নেই। তুমি প্লীজ একটু সাহায্য করো আমাকে। এখানে বসে চুপচাপ লক্ষ্য রাখো। কেউ এসে যদি দেখ পাঞ্জাবিটা সরাচ্ছে– কিংবা কিছু করছে–তুমি কিছু করবে না। সে যাই করুক, শুধু তাকে চিনে রাখবে। ব্যস!

বেশ।

–ভয়ের কোনও কারণ নেই ডার্লিং! যথাসময়ে আমি ফিরে আসব।

–অত বলার কী আছে? আজ তো নতুন আপনার চেলাগিরি করছি নে। বলে একটু হাসলুম। অবশ্য আমার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়েছে ঠিকই।

কর্নেল কাঁধে থাপ্পড় মেরে স্নেহ প্রকাশ করে চলে গেলেন। আমি ওৎ পেতে বসলুম। কর্নেল না বলে দিলেও বুঝেছি, সিগ্রেট খাওয়া চলবে না। সকালের রোদ বেয়াড়া রকম বেশি তাপ ছড়াচ্ছে। ছায়ায় বসে আছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে মন দিতেও পারছি না–এ এক অদ্ভুত অবস্থা। প্রায় আধ ঘণ্টা কেটে গেল।

হঠাৎ দেখি নীচরে একটা ঝোপের মধ্যে রত্না দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ চমকে উঠলুম। ভুল দেখছি না তো?

ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। মনে হলো, কিছু খুঁজছে। তারপর পা বাড়াল। বুঝলুম, ওদের জেরা শেষ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো দিব্যকেই শুধু আটকে রেখেছে। রত্না কি পাঞ্জাবিটা খুঁজতেই এসেছে? ও কীভাবে জানল যে পাঞ্জাবিটা এখানেই লুকানো আছে? একটু পরেই বুঝলুম, পাঞ্জাবিটা কোথায় আছে, রত্না জানে না। কারণ সে ওটার পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করল। তারপর আরও নীচে নামতে থাকল। মিনিট পাঁচেক পরে সে ঘুরল এবং সোজা আমার দিকে ওঠা শুরু করল। আমি একটু সরে বসলুম। কিন্তু সে সোজাসুজি উঠে এসে যেই ডানদিকে ঘুরেছে, আমার মধ্যে হঠকারী ঝোঁক এসে গেল। কর্নেলের নিষেধ ভুলে গেলুম। আসলে আমার মধ্যে গোয়েন্দাসুলভ কৌতূহলের তাগিদ চাগিয়ে উঠেছিল সম্ভবত। আমি গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলুম-মিস চ্যাটার্জি।

রত্না ভীষণ চমকে গেল। তারপর অপ্রস্তুত হেসে বলল–এই মানে…একটু ঘু ঘুরতে বেরিয়েছি। আপনি কী করছেন? নিশ্চয় আমার মতো ঘুরতে?

খুবই গোমড়ামুখে বললুম–মোটেও না। অন ডিউটিতে আছি।

রত্না হাসবার চেষ্টা করে বলল–তাই বুঝি? আচ্ছা চলি।

–মিস চ্যাটার্জি, শুনুন!

রত্না দাঁড়াল। সে ভীষণ ঘামছে। ঠোঁট কাঁপছে। মনে হলো, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবে এক্ষুণি। তারপর অতিকষ্টে বলল-বলুন।

কী খুঁজতে এসেছেন?

–দাদার পাঞ্জাবিটা।

কীভাবে জানলেন যে আপনার দাদার পাঞ্জাবিটা এখানে লুকোনো আছে?

–আমি পাঞ্জাবি-পরা দাদাকে দেখতে পেয়েছিলুম দীপ্তির কাছে।

-চোপরাও দেখেছিল। যাক গে, ওটা দিয়ে কী হবে এখন? আপনার দাদার বিরুদ্ধে তো অন্য সব প্রমাণ আছে।

না কিছু নেই। শুধু এটা ছাড়া। …বলে রত্না হু হু করে কেঁদে উঠল।

একটু পরে বললুম–আপনি এত সহজে ভেঙে পড়তে পারেন। অথচ পুলিশের রেকর্ডে আছে, আপনি নাকি নকশালপন্থী ছিলেন?

রত্না ফোঁস করে উঠল–একসময় ছিলুম। এখন আর নেই।

এই সময় চোখে পড়ল ওপরের দিকে ঝোপের কাছ থেকে কর্নেলের টুপিপরা মুণ্ডুটা দেখা যাচ্ছে। তখনি রত্নাকে চুপ করতে এবং সরে যেতে ইশারা করলুম। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে ততক্ষণে। কর্নেল গুম হয়ে গুঁরি মেরে এগোচ্ছেন– রত্নাও দেখতে পেল। কাছে এসে কর্নেল হঠাৎ দুজনকে টেনে বসিয়ে দিলেন এবং ফিস ফিস করে বললেন–চুপ!

পাঞ্জাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলুম, অর্থাৎ ওদিকে এতক্ষণ চোখ ছিল না। এবার দেখি, ওখানে রণধীর চোপরা বসে রয়েছে। হতভম্ব হয়ে গেলুম। সে ব্যস্তভাবে পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছিল রত্না হিস হিস করে উঠল বাস্টার্ড!

মেয়েদের মুখে বাস্টার্ড শুনে আমার হাসি পেল।

তারপর কর্নেল আচমকা উঠে বিকট গর্জন করলেন–চোপরা! নড়ো না! নড়লেই গুলি করব।

চোপরার দুপাশের ঝোপ ও পাথরের আড়াল থেকে ততক্ষণে কয়েকজন পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়েছেন।

.

এরপর যা হবার তাই হল–অর্থাৎ রণধীর চোপরা চালান গেল। এখন ওসব ব্যাপার কানুনের এক্তিয়ারে। তা সব দেখার জন্য এবং তদারক করার জন্য সরকার যথেষ্ট লোকজন রেখেছেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সেখানে কোনও ভূমিকা অবান্তর এবং উনি ওতে নাক গলাবেনও না। বাংলোয় আমাদের ঘরে, অর্থাৎ যে ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, আমি কর্নেল, সোনালী এবং তার বাবা অনিরুদ্ধ ব্যানার্জি ও জয়ন্তী দেবী বিকেলের চায়ের মজলিশ জমাচ্ছিলুম। দিব্য এল না। রত্না এসে বলল-দাদা চুপচাপ শুয়ে আছে।

সেটা স্বাভাবিক। বেচারা ভীষণ আঘাত পেয়েছে মনে।

সবার চোখে মুখে কৌতূহল ফুটে উঠেছিল। সুতরাং মুখপাত্র হয়ে আমিই প্রথম তুললুম– কর্নেল, চোপরা সবুজ পাঞ্জাবিতে কী খুঁজতে গিয়েছিল?

কর্নেল একটু হেসে জবাব দিলেন দীপ্তির হাতের মুঠোয় একটুকরো কাগজ ছিল। খুন করার পর চোপরা সম্ভবত তাড়তাড়িতে সেটা পকেটে ঢুকিয়েছিল। তখন তো ওর নার্ভাস অবস্থা। কে দেখে ফেলবে এই আতঙ্কে রয়েছে। তাই পাঞ্জাবি রেখে পালাবার সময় কাগজটা বের করে নেয়নি। ভেবেছিল, পরে এসে নেবে। এমন না হলে পাঞ্জাবিটা সে প্রকাশ্যে কোথাও ফেলে রাখত। কারণ তার উদ্দেশ্য দিব্যের কাঁধে দায়টা চাপানো। আসলে খুন করার পর খুনীর খানিকটা হতবুদ্ধি অবস্থা থাকে বলেই তাদের ধরা সম্ভব হয়। কোনও না কোনও ক্ষেত্রে একটু ভুল করবেই। আজ পর্যন্ত আমি খুনী দেখিনি, যে কোনও ভুল করেনি, অর্থাৎ কোনও ক্লু রাখেনি।

অনিরুদ্ধ বললেন কাগজটাতে কী ছিল? দীপ্তি তা পেল কোথায়?

বিশেষ কিছুই ছিল না। ছিল তিনটে জিরো লেখা। এটা একটা বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের দেশীয় গুপ্তচর এজেন্সির সাংকেতিক নাম। চোপরাকে তারাই মিঃ ব্যানার্জির পি. এ. করে পাঠাতে পেরেছিল।

অনিরুদ্ধবাবু কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করলেন। কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন জানি, আপনার দোষ নেই। আপনি কী করতে পারেন? যাক গে, যা বলছিলুম। হতভাগিনী দীপ্তি তার বোকামির জন্যই কিন্তু খুন হলো। ও যেভাবেই হোক জানতে পেরেছিল যে চোপরা থ্রি জিরো দলের মেম্বার। কিন্তু কথাটা সরাসরি অনিরুদ্ধবাবুর কানে তুলতে পারত। তা না করে সে সম্ভবত চোপরাকে নিয়ে একটু মজা করতে চেয়েছিল। সে বোঝেইনি চোপরা যে দলের মেম্বার, তাদের সঙ্গে রসিকতা করার পরিণাম বড় সাংঘাতিক।

রত্না বলে উঠল–আমার মনে পড়েছে! দীপ্তি চোপরাকে দেখলেই বলত কী মশাই, তিন শূন্যের অঙ্ক মিলল? চোপরার মুখটা কেমন সাদা হয়ে যেত যেন।

তা শুনে সোনালীও বলে উঠল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। ভাবতুম, নিছক, জোক করছে।

কর্নেল বললেন–চোপরা ভেবেছিল, দীপ্তির মুঠোর কাগজটা সত্যি সত্যি কোনও সাংঘাতিক দলিল–হয়তো কোনও সুত্রে দীপ্তির হাতে এসেছে। অদৃশ্য কালিতে নিশ্চয় কিছু লেখাটেখা আছে। কারণ তিনটে জিরো কোনও কাগজে দেখলেই তাকে সতর্ক হতে হবে। দীপ্তি সত্যি বড় বোকামি করেছে। তবে একটা কথা ঠিক যে ও হাতের মুঠোয় কাগজটা না রাখলেও তাকে খুন করত। কারণ হত্যার পরিকল্পনাটা সেই মন্দিরে যাবার দিনই সে করে নিয়েছে। কাজেই দীপ্তিকে একদিন না একদিন খুন হতেই হতো।

সোনালী বলল কলকাতায় ট্যাক্সির ব্যাপারটা কী হলো, কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন। বললেন–শুধু দীপ্তিকে ফলো করা হচ্ছিল সারাক্ষণ। চোপরার দলের লোকেরা কত তৎপর, তারই প্রমাণ ওটা। আজকালের মধ্যেই সেই ট্যাক্সি চালক ধরা পড়ে যাবে। আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে পড়বে। দীপ্তি মন্দিরে যাবার দিনও যথারীতি চোপরার দলের লোক ওকে ফলো করেছিল। তা না হলে চোপরা হঠাৎ গাড়ি নিয়ে মন্দিরের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত না।

রত্না বলল কিন্তু মন্দিরে তো দীপ্তি কারও সঙ্গে দেখা করেনি।

-ওটা সম্ভব হয়নি। কারণ, রাজীব শেরগিল তখন অলরেডি নিহত।

আমি চমকে ওঠে বললুম– বুঝতে পারছিনে কর্নেল। রাজীব শেরগিলের সঙ্গে দীপ্তির আলাপ হলো কীভাবে? রাজীব কেন তাকে ওখানে যেতে বলবে?

কর্নেল জবাব দিলেন–সবটা দিব্যের মুখেই শোনা ভাল। কিন্তু সে কি এখন আসবে?

রত্না মাথা দুলিয়ে বলল–মনে হয় না। আপনিই বলুন কর্নেল।

–দিব্য পরে পুলিশকে একটা লং স্টেটমেন্ট দিয়েছে। হয়তো চেপেই যেত সব। কিন্তু তারই পাঞ্জাবি চুরি করে চোপরা তার ঘাড়ে খুনের দায় চাপাতে চেয়েছিল। এতে ওর ভীষণ রাগ হয়ে গেছে। তাই সব বলে দিয়েছে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলি।…চোপরার সঙ্গে যেদিন একটা রেস্তোরাঁয় তার মারামারি হয়না, ভুল বলছি, প্রকৃতপক্ষে মারামারি হয়নি–হবার উপক্রম হয়েছিল এবং রাজীব সেটা থামিয়ে দেয়, সেদিন কিন্তু দীপ্তিও সেখানে উপস্থিত ছিল। চোপরার সঙ্গে আগে থেকেই দীপ্তি ওখানে গিয়েছিল। ইদানিং ওরা ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, তোমরা তা জানো। যাই হোক, স্টেশন থেকে রাজীবকে নিয়ে দিব্য দৈবাৎ ওখানে ঢোকে। বলাবাহুল্য, দীপ্তিকে চোপরার সঙ্গে দেখে মনে মনে জ্বলে ওঠে। সুযোগ খোঁজে চোপরাকে পিটুনি দেবার।

চোপরার ভঙ্গিতে আমি গম্ভীর মুখে বলে উঠলুম–দ্যাটস ন্যাচারাল।

কেউ তাতে হাসল না। কর্নেল ছাড়া। কর্নেল বললেন–দ্যাটস রাইট। তা, দিব্যও ঠিক রত্না বা সোনালীর মতো দীপ্তিকে, কী মশাই, জিরো জিরোর অঙ্ক মিলল?–চোপরার উদ্দেশ্যে এই জোক করতে শুনেছে। সেদিন ওখানে দীপ্তি, মারামারি থামাতে বলে ওঠে–এই থ্রি জিরোটিকে নিয়ে আর পারা যায় না। দিব্য লক্ষ্য করেনি কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি রাজীব শেরগিল খুবই চমকে উঠেছিল। সে থ্রি জিরো দলের লোক। কিন্তু কোনও কারণে সম্ভবত দলের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েই হোক, অথবা নিছক অর্থের লোভে রানীডিহি এসেছিল। অর্থাৎ চোপরাকে ব্ল্যাকমেল করতে অথবা প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে অয়েল ডিরেক্টরের কানে সব তুলে দিতে। আমার ধারণা, চোপরাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সে অনিরুদ্ধবাবুর কাছে সব ফাঁস করতে চেয়েছিল। যাইহোক, রাজীব বা দীপ্তি এখন বেঁচে নেই। কিন্তু দীপ্তির ঘরে একটা চিঠি পুলিশ আবিষ্কার করেছে। রাজীব শেরগিলের হাতের লেখার সঙ্গে মিলে যায়। নীচে নামের বদলে তিনটে জিরো নেই অনিরুদ্ধবাবুকে লেখা সেই চিঠির মতো। সোজা নামসই রয়েছে চিঠিতে। বলাবাহুল্য ইংরাজিীতে লেখা : …থ্রি জিরোর রহস্য কি জানেন? না জানা থাকলে ১৩ তারিখে সকাল নটায় পাতালকালীর মন্দিরে আসুন। কিন্তু দীপ্তি একা যেতে সাহস করে নি। রত্নার বুদ্ধি ও সাহসে তার আস্থা ছিল স্বাভাবিক। তাই রত্নাকেই সঙ্গে নেয়। দীপ্তি জানত না যে ট্যাঙ্কের কাছে পাওয়া লাশটা রাজীবের।

সোনালী বলল-ওদিন আমার একটু জ্বর মতো হয়েছিল।

আনলাকি থার্টিন নিহত রাজীবের কাছে ওই দিনকার দিল্লীর রিজার্ভেশন টিকিট পাওয়া গেছে। তার মানে, দীপ্তির সঙ্গে দেখা করে এবং সম্ভবত সদুপদেশ দিয়ে সে নিরাপদে দিল্লী চলে যাবে ভেবেছিল। সদুপদেশ দেবার কারণ, দিব্য তাকে বলেছিল যে দীপ্তির সঙ্গে তার বিয়ের কথা ছিল। কিন্তু বিয়েটা আর করা যাবে না। তখন রাজীব বলে, আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি ভেবো না। চোপরাকে আমি চিনি। ও খুব খারাপ লোক। দীপ্তিকে সতর্ক করা দরকার। চোপরার হালহদিশ সব ওকে বাতলে দিয়ে যাবো।

এতক্ষণে জয়ন্তীদেবী মুখ খুলে বললেন–এত সব কাণ্ড ভেতর-ভেতর!

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। এ খুব জটিল কেস। কিন্তু খুনের প্রসঙ্গে এলে বলব, এত সহজ এমন চমৎকার মোডস অফ অপারেণ্ডি খুব কমই দেখেছি। আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, চোপরা পুবের রাস্তায় গিয়ে বাগান হয়ে এই বাংলোর পূর্ব-উত্তর কোণে দিব্যের ঘরে ঢোকে এবং সবুজ পাঞ্জাবিটা নিয়ে চলে যায়। চোখে পড়ে শুধু পরিচারিকার। তার চোখে না পড়লেও চোপরাকে আমরা ধরে ফেলতুম। সে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। তারপর কী ঘটেছে, তাও দেখতে পাচ্ছি। সে দীপ্তিকে বলছে–তোমার ছুরিটা খসে যাচ্ছে যে! ঠিক করে দিই। তারপর…থাক। বড় বীভৎস ঘটনা।

রত্না আস্তে বলল–আমি ওকে দেখে দাদা ভেবেছিলুম!

কর্নেল বললেন–দিব্যও দেখেতে পেয়েছিল। সবুজ পাঞ্জাবিটা তার মনে কিছুটা সন্দেহ জাগিয়াছিল কিন্তু জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সে চুপ করে গিয়েছিল।

বললুম–সব তো বুঝলুম! কিন্তু লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া?

কর্নেল চুরুট বের করে বললেন–ওই পাতায় একটা সাবোটাজের বিবরণ আছে। অনিরুদ্ধবাবুকে সাবোটাজের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল রাজীব।

অনিরুদ্ধ শিউরে উঠে শুধু বললেন হ্যাঁ।

ত্রিশূলে রক্তের দাগ

সম্প্রতি চিৎপুর এলাকায় আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের কার্যকলাপ ফাঁস হাওয়ার ঘটনা সব কাগজে বেরিয়েছিল। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পক্ষ থেকে এর একটা ফলোআপ সংগ্রহের জন্যে বেরিয়ে ট্রাফিক জ্যামে আটকে গেলাম। ঘিঞ্জি রাস্তা। বেলাও পড়ে এসেছিল। তার ওপর ঠিক এই সময়টাতেই লোডশেডিং। বিরক্ত হয়ে গাড়িতে বসে সিগারেট টানতে টানতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলাম, আর এই অব্যবস্থার জন্যে ট্রাফিক পুলিশদেরই দায়ী করছিলাম। লরি বা ট্রাকের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ যে অনেক সময় জ্যামবিভ্রাট বাধায়, তাতে কোনও ভুল নেই।

বাঁ পাশে বসে থাকার ফলে পরপর কয়েকটা হার্ডওয়্যার স্টোর্স, যাত্রা, থিয়েটারের পোশাকের দোকান, এবং তার মাঝখানে একটা বইয়ের দোকান চোখে পড়ল। আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার। নিশ্চয় সুখ্যাত বটতলা প্রকাশনের ঐতিহ্যসম্পন্ন দোকান। সামনের শোকেসে যাত্রানাটক, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত, প্রভাস খণ্ড, বৃহৎ তন্ত্রসার ইত্যাদি টাইটেল সাজানো ছিল। আলো কম হলেও, আমার দৃষ্টিশক্তি মোটামুটি ভালই। তাছাড়া পঞ্জিকার পাতায় এমন বইয়ের বিজ্ঞাপন আমাকে আকৃষ্ট করে। এইসব দোকান যেন এক রহস্যময় পৃথিবীর তথ্যে ভরা। বশীকরণতন্ত্র ডাকিনীতন্ত্র, ভোজবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র…এক আশ্চর্য অন্ধকার মায়ালোকের দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেত করে যেন।

হঠাৎ হকচকিয়ে গেলাম। এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ আনন্দময়ী পুস্তক ভাণ্ডার থেকে বেরোলেন। তার হাতে লাল মলাটের একটা বই। তার মাথায় ধুসর টুপি, মুখের সাদা দাড়ি, এবং বাঁ হাতে একটা বিদঘুটে গড়নের যষ্ঠি। ফুটপাতে নেমেই তিনি কয়েক পা এগিয়ে অন্য একটা দোকানে ঢুকলেন। এ দোকানটার সাইন বোর্ডে লেখা আছে : আর দাশ অ্যাণ্ড কোং। যাত্রা-থিয়েটারের যাবতীয় পোশাক, স্টেজ, সিন সুলভে ভাড়া পাওয়া যায়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

হ্যাল্লো ওল্ড ডাভ বলে অভ্যাসমতো চেঁচিয়ে ডাকার কথা স্রেফ ভুলে গিয়েছিলাম, কারণ এই ধুরন্ধর বৃদ্ধকে এখানে দেখতে পাওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। গতকাল উনি ফোনে জানিয়েছিলেন, এক জার্মান উদ্ভিদবিজ্ঞানীর সঙ্গে নেপাল রওনা হচ্ছেন–আমার সঙ্গদান সম্ভব কি না। বলা নিষ্প্রয়োজন, এ আমন্ত্রণ একটা ছুতোনাতা করে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। নেপাল যত সুন্দর দেশ হোক দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির অর্কিডের তল্লাসে পাহাড়-জঙ্গলে টো টো করে ঘোরা আমার ধাতে সইবে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে কোনও কারণে হোক, ওঁর নেপাল যাওয়া হয় নি।

হয়নি কিন্তু এই এবেলায় চিৎপুরে কী করছেন? বটতলার বই কেনারই বা উদ্দেশ্য কী? আর যাত্রা-থিয়েটারের পোশাকের দোকানেই বা কেন ঢুকলেন? রহস্যের গন্ধ পেলাম। ভাবলাম, নেমে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ট্রাফিকজট কোনও যাদুবলে খুলে গেল। আমাদের গাড়ির বাঁ দিকে ইতিমধ্যে কয়েকটা রিকশো, ঠেলা, টেম্পো ঢুকে পড়েছিল। জট ছাড়লে স্বভাবত হল্লা আর যানবাহনের গর্জনও প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। আমার ডাক উনি শুনতে পেতেন না।

অফিসে গিয়ে ব্যাপরটা ভাবছিলাম। আর দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানির দোকানে ঢুকে , কি ছদ্মবেশ ধরার জিনিসপত্র কিনছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? কিছু কি ঘটেছে, কোথাও? নাকি সম্প্রতি ফঁস-হয়ে-যাওয়া আন্তর্জাতিক চোরাচালানচক্রের সঙ্গে ওঁর এই কাজকর্মের কোনও সংস্রব আছে?

রাত আটটায় অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা ইলিয়ট রোডে সানি লজ নামে বিশাল বাড়িটির তিনতলায় হানা দিলাম। দরজা খুলে ষষ্ঠীচরণ জনান্তিকে জানাল, বাবুমশাই আসনে বসে জপ করছেন। অবাক হয়ে ভেতরের ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, কতকটা তাই বটে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু ডিভানে আসন করে বসে সেই বটতলার লাল মলাটের বইটি পড়ছেন। ঠোঁটদুটো কাঁপছে। তার মানে, উচ্চারণ করেই পড়ছেন। আমার সাড়া পেয়ে চোখ কটমটিয়ে হুংকৃত স্বরে বলে উঠলেন, ওঁং হ্রীং ক্রীং জয়ন্তং মারয়ঃ মারয়ঃ তাড়য়ঃ ফট ফট স্বাহা।

একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, সর্বনাশ! এ আবার কী?

কর্নেল হো হো করে হেসে ডিভান থেকে নেমে আমার হাতে বইটা খুঁজে দিলেন। লাল মলাটের ওপর সোনালী হরফে লেখা আছে ডাকিনীতন্ত্র। শ্রী হরিশরণ শর্মা তন্ত্ৰার্ণব সিদ্ধাচার্য কতৃক সংগৃহীত। পাতা উল্টে দেখি, ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই গুপ্ত তন্ত্র আসামের কামরূপ অঞ্চলের পর্বত-অরণ্যে বহু বৎসর ভ্রমণ করিয়া সিদ্ধাই ডাকিনীগণের নিকট হইতে সংগৃহীত। তন্ত্ৰাৰ্ণব শ্রীহরিশরণ শর্মা মহাশয় বহুবার একচুলের জন্য বাঁচিয়া গিয়াছে। সাধক পাঠকবর্গের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করি যে বাৎসরাধিক কাল তাহাকে ডাকিনীগণ মন্ত্রবলে মেষশাবকে রূপান্তরিত করিয়াছিল। দেবী কামাখ্যার করুণায় তিনি মনুষ্যদেহ পুনঃপ্রাপ্ত হন।…

বললাম, এই গাঁজা কেনার জন্যে আজ বিকেলে চিৎপুরে আনন্দময়ী পুস্তক। ভাণ্ডারে ঢুকেছিলেন।

হুঁ–তুমি তোমাদের প্রেসমার্কা কালো গাড়িতে বসে লোলুপ দৃষ্টে শো-কেসের বইগুলি দেখছিলে বটে!

ঠিক ঠিক। তারপর আপনি আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকানে ঢুকলেন ছদ্মবেশ কিনতে। কই, দেখি, কী কিনলেন?

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, আমি কি বুড়োবয়সে যাত্রাদলে নাম লেখাব ভাবছ?

যাত্রাদলে ঢুকলে পোশাক নিজেকে কিনতে হয় না। নিশ্চয় ছদ্মবেশ ধরার দরকার হয়েছে আপনার। তা এক কাজ করলেই তো পারেন। গোঁফদাড়ি সাফ, করে ফেললেই হল। কেউ আর প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে চিনতে পারবে না। অবশ্য মাথার টাকটি অতি প্রসিদ্ধ। কিন্তু তার জন্য টুপিই যথেষ্ট।

ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, তুমি তো এ যাবৎ দেখেছ ডার্লিং, আমি কদাচ ছদ্মবেশ ধরি না। ছদ্মবেশ ব্যাপারটা বড় বাজে। ওর ভেতর প্রচুর পোকা থাকে। আসলে মাথার ভেতরকার কোমল সারপদার্থকে ঠিক মত কাজে লাগাতে পারলেই হল। চাই শুধু কিছু তথ্য-সঠিক, অকপট তথ্য। সত্যকে আবিষ্কারের জন্য আমি তাই ডিডাকটিভ পদ্ধতির পক্ষপাতী। আগে সিদ্ধান্ত পরে তথ্য সংগ্রহ নয়, আগে তথ্য সংগ্রহ পরে সিদ্ধান্ত।

বললাম, বেশ। আপনারই ডিডাকটিভ পদ্ধতি অনুসারে গতকাল থেকে এ পর্যন্ত আপনার ক্রিয়াকলাপের যে তথ্য পাচ্ছি, তা থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে আপনার নেপালযাত্রা বরবাদ করার মতো একটি ঘটনা ঘটেছে এবং সেই ঘটনার সূত্রে আজ বিকেলে আপনাকে চিৎপুরে গিয়ে…।

হাত তুলে বাধা দিয়ে সহাস্যে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, এনাফ জয়ন্ত, এনাফ। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিযে তুমি কাগজের লোক হয়েও কাগজ পড় না।

ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না। কিন্তু কাগজে কী বেরিয়েছে? চিৎপুরের আন্তর্জাতিক চোরাচালানীচক্রের খবর তো? যতদূর জানি, লালবাজারের তরুণ গোয়েন্দাকর্তা আপনাকে এতে নাক গলাতে দেবেন না। কারণ, আপনি এসব ব্যাপারে যুক্ত হলে তার কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ মিলবে না।

কর্নেল কফির পেয়ালা রেখে চুরুট ধরালেন। তারপর মৃদু হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, চলো ডার্লিং, আগামীকাল একবার ভৈরবগড় ঘুরে আসি।

ভৈরবগড়! নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস! মনে পড়ে গেছে। আসলে এসব খবর চোখের কোণা দিয়ে ছুঁয়ে দেখার মত। তাছাড়া দেশজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য খুনোখুনি হচ্ছে। কিন্তু ভৈরবগড়..কর্নেল! ভৈরবগড়ে গোটা দুতিন খুন হয়েছে তার জন্য নেপাল-যাত্রা পণ্ড করে আপনার চিৎপুরে যাত্রার তাৎপর্য মাথায় ঢুকছে না? মফস্বলে দলাদলি আজকাল বেড়ে গেছে। দলে দলে সংঘর্ষ আকছার হচ্ছে। কাজেই এ খুনোখুনিতে রহস্য কিসের?

কর্নেল বললেন, আছে। তুমি তৈরি থেক–আগামীকাল সকাল নটায় ট্রেন।

.

০২.

ভৈরবগড় বর্ধমানের সীমান্তে খনি অঞ্চলের একটি বনেদী জনপদ। গ্রাম-শহরের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। চারদিকে অসমতল রুক্ষ মাটির বিস্তার। গাছপালা স্বভাবত কম। এদিকে ওদিকে কিছু পোড়ো এবং চালুখনি রয়েছে। বেশির ভাগই কয়লাখনি, কয়েকটা অভ্র খনিও আছে। তবে ভৈরবগড়ের উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তিও কম নয়। বিশেষ করে পাঁচশো বছরের বাবা ভৈরবের বিশাল মন্দিরটা।

ট্রেনে যেতে যেতে গোয়েন্দাপ্রবর আমাকে ভৈরবগড়ের ভূপ্রকৃতির এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বললেন, আজ ১১ মার্চ মঙ্গলবার। গত ৭ মার্চ শুক্রবার সকালে ভৈরবমন্দিরের চত্বরে মহেশ্বর ত্রিপাঠী নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। মহেশ্বরবাবু নির্বিরোধ মানুষ ছিলেন। স্থানীয় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে প্রচুর টাকাকড়ি সাহায্য করতেন। কাজেই তার জনপ্রিয়তাও ছিল। এমন মানুষকে কেউ খুন করবে, ভাবা যায় না। রাত্রিবেলা মন্দিরেই বা কেন তিনি গিয়েছিলেন, পুলিস তদন্ত করে প্রথমে জানতে পারেনি। পরে জেনেছে ৬ মার্চ বৃহস্পতিবার এক তান্ত্রিক সাধুবাবা, নাকি তার বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজে সেই সাধুবাবার পাত্তা আর মেলেনি।

জিজ্ঞেস করলাম, খুন করা হয়েছিল কীভাবে?

মহেশবাবুর পিঠের দিকে হার্টের পেছনে সমান ব্যবধানে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন ছিল। সম্ভবত বসে থাকা অবস্থায় অতর্কিতে তাকে পেছন থেকে আঘাত করা হয়। কর্নেল ট্রেনের জানালার দিকে চোখ রেখে বললেন, পরবর্তী হত্যাকাণ্ড ঘটে ঠিক পরদিনই–শনিবার। একই জায়গায় একই অবস্থায় পাওয়া যায় নবারুণ ভদ্র নামে একজন রিটায়ার্ড খনি-ইঞ্জিনীয়ারের লাশ। এক্ষেত্রেও আগের দিন নবারুণবাবুর কোয়ার্টারে সেই সাধুবাবা এসেছিলেন। কিছুক্ষণ গোপনে দুজনের মধ্যে নাকি কী কথাবার্তা হয়নবারুণবাবুর স্ত্রীর কাছে পুলিশ এটুকু জানতে পেরেছে। সাধুবাবাকে যে মহেশ্বরবাবুর খুনের ব্যাপারে পুলিশ খুঁজছে, নবারুণবাবুর স্ত্রী বা নবারুণবাবুও তা জানতেন না। বাড়িতে ওই সময় আর কেউ ছিল না। এর পর যেটুকু জানা গেছে, তা হল : দুজনেই আসছি বলে বাড়ি থেকে আন্দাজ সন্ধ্যা সাতটায় বেরিয়ে যান। আর ফেরেন নি।

কর্নেল চুপ করলে বললাম, তন্ত্রসাধনায় নরবলির কথা শুনেছি। এ তো দেখছি তাই।

গতকাল বর্ধমানের পুলিসসুপারের ট্রাঙ্ককল পেলাম–তখন সবে নেপাল যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছি। ভৈরবমন্দিরের একই জায়গায় একই ভাবে পাওয়া গেছে। ভবেশ মজুমদার নামে আর একজন ব্যবসায়ীর লাশ। বসে থাকা অবস্থায় খুন। পিঠে তিনটি গভীর ক্ষতচিহ্ন। এবারও জানা গেছে, আগের দিন এক সাধুবাবা এসেছিলেন ভবেশবাবুর কাছে। তিনিও আসছি বলে সন্ধ্যা ছটায় বেরিয়ে যান। এবারও ভবেশবাবু বা কেউ জানতেন না, সাধুবাবাকে পুলিস খুঁজছে। তাই গতকাল সঙ্গে সঙ্গে পুলিস তেঁড়রা পিটিয়ে ঘোষণা করেছে, ঢ্যাঙা, রোগা গড়নের কোনও লাল কৌপিন ও জটাধারী সাধুবাবাকে দেখলেই যেন জনসাধারণ পুলিশে খবর দেন। বলার দরকার নেই, এলাকার সব সাধু গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ জনতার হাতে প্রচণ্ড মারধরও খেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ যাকে খুঁজছে, তাঁরা কেউই তিনি নন। নিহতদের বাড়ির লোকের সাক্ষ্যে সেটা বোঝা গেছে। তবু ভুল হতেও তো পারে। জনাতিনেক সাধু ভৈরবগড় হাসপাতালে এখন আহত অবস্থায় রয়েছেন। আজ দুপুরে ফের এসপি ট্রাঙ্ককল করে এসব কথা জানিয়েছেন।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে গম্ভীর মুখে টানতে থাকলেন। বললাম, পুলিস ঢেঁড়রা পিটিয়ে ভুল করেছে।

তুমি ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত। কর্নেল একটু হাসলেন। পুলিস অনেক সময় একটু বেশি উৎসাহ দেখিয়ে বসে। তবে এই তিনটি অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের আরও একটি অদ্ভুত ধরনের কমন ব্যাপার আছে। সেটা পরে লোকের চোখে পড়েছে। ভৈরবমন্দিরের, চূড়ায় অন্তত পঁচিশ-তিরিশ ফুট উঁচুতে একটা ত্রিশূল আছে। প্রতিবার হত্যাকাণ্ডের পর সেই ত্রিশুলের গায়ে রক্ত দেখা যাচ্ছে কয়েকপোঁচ। জ্বলজ্বলে টাটকা রক্ত। কাছের একটা খনি থেকে ফায়ারব্রিগেড আনিয়ে পুলিশ ত্রিশূলের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে কলকাতায় বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়েছে। মানুষের রক্ত হলে সত্যি বড় রহস্যময় ঘটনা বলতে হয়। এত উঁচুতে কেউ উঠে রক্ত মাখিয়ে আসবে, এ তো অসম্ভব! মোচার আকৃতি মন্দিরচূড়া পাথরে তৈরি এবং ভীষণ পিছল। অত উঁচু মই কার আছে?

কর্নেল! তাহলে বেশ বোঝা যাচ্ছে, হত্যার অস্ত্র ত্রিশূল ছাড়া কিছু নয়। তিনটে সমান ব্যবধানে ক্ষতচিহ্ন, একমাত্র ত্রিশূলই সৃষ্টি করতে পারে।

ঠিক ঠিক। বলে কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার চোখে রেখে টেলিগ্রাফের তারে পাখি দেখতে থাকলেন। পাখিটা দ্রুত পিছিয়ে পড়ল। তখন উনি জানালায় ঝুঁকে গেলেন। পাখি দেখলেই আমার এই বাতিকগ্রস্ত বন্ধুটির ঘিলু যেন গলে যায়। জ্ঞানগম্যি আর থাকে না।….

সরকারী বাংলোটা ভৈরবগড়ের শেষপ্রান্তে! দক্ষিণে সামান্য দূরে জি.টিবোড়। পূর্বদিকে বেশ কিছুটা দূরে ভৈরবমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। বিকেলে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়ার পর লনে বসেছিলাম। আমার বৃদ্ধ বন্ধু হঠাৎ উঠে গেলেন। তারপর বরাবর যা দেখেছি, তাই দেখতে পেলাম। চোখে বাইনোকুলার রেখে উনি পূর্বের অনাবাদী মাঠে হনহন করে হেঁটে চলেছেন। ওঁর লক্ষ্যবস্তু পাখি যদি হয়, তাহলে সে-পাখি কোনও গাছের নয়। কারণ ওদিকে কোনও গাছই নেই। একটু পরে একটা ঢিবির আড়ালে ওঁর ধূসর রঙের টুপিটা অদৃশ্য হলে ঘরে ঢুকে সটান শুয়ে পড়লাম। ট্রেনজার্নির ক্লান্তি ছিল।

সন্ধ্যার পর গোয়েন্দাপ্রবর ফিরে এসে আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে অকালনিদ্রার জন্যে মৃদু ভৎর্সনা করলেন। তারপর বললেন, যাই হোক, অনেকখানি ঘোরাঘুরি করা গেল। ভৈরবমন্দির দর্শন করলাম। তারপর গেলাম রাজবাড়ি দর্শনে। রাজত্ব না থাকতে পারে, রাজা এখনও আছেন। গতবার এ তল্লাটে এসে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কাল সকালে আমাদের দুজনেরই ওখানে নেমন্তন্ন বড় অমায়িক মানুষ। আমার মতো নানারকম খেয়াল আছে ওঁর। বাড়িতে একটা চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। কয়েক রকম জন্তুজানোয়ার আর পাখি আছে। গিয়ে দেখবেখন।

চৌকিদার চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে বললাম, বাইনোকুলারে কী দেখছিলেন মাঠে?

ঘুঘু পাখির একটা ঝাঁক। এই লাল রঙের ঘুঘু পাখিরা ঝাঁক বেঁধে থাকে। এদের…

কথায় বাধা পড়ল। বাইরে কেউ ভরাট গলায় বলল, আসতে পারি কর্নেল?

কর্নেল ঘুরে সহাস্যে বললেন, আরে আসুন, আসুন মিস্টার সিনহা। আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম।

একজন প্রকাণ্ড আকৃতির পুলিস অফিসার ঘরে ঢুকলেন। আলাপ-পরিচয় হল। যদুপতি সিনহা। এখানকার থানার অফিসার-ইন-চার্জ। একথা ওকথার পর বললেন, আপনার কথা সত্য কর্নেল! মহেশ্বরবাবু, নবারুণবাবু আর ভবেশবাবু প্রত্যেকের বসার ঘরে এককপি করে ডাকিনীতন্ত্র পাওয়া গেছে। এই দেখুন। তিনটে বই-ই এনেছি।

এই বইটাই কর্নেল চিৎপুর থেকে কিনেছেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা উল্টে দেখার পর একটু হেসে বললেন, আনন্দময়ী পুস্তকভাণ্ডার থেকে গত ৫ মার্চ এক ভদ্রলোক একসঙ্গে ৭ কপি ডাকিনীতন্ত্র কিনেছিলেন। পাশের আর দাশ অ্যাণ্ড কোংয়ের দোকান তেকে তিনিই কেনেন একটা জটাচুল, একটা কমণ্ডলু, একটা ত্রিশূল আর কাপালিক সাধুর কাপড়চোপড়। চেহারার বর্ণনা থেকে বুঝতে পেরেছি একই লোক।

যদুপতিবাবু বললেন, চেহারার বর্ণনাটা শোনা যাক একটু।

লম্বাটে গড়ন। মোটা নাক। মাথায় আমার মত টাক।

কিন্তু সাধুবাবার বর্ণনার সঙ্গে তো ঠিক মিলছে না। সাধুবাবাকে যারা দেখেছেন, তারা বলছেন ঢ্যাঙা রোগা গড়ন। লম্বা ধারালো নাক।

নাক লম্বা আর ধারালো হওয়াটাই সুবিধেজনক। কর্নেল হাসলেন। তারপর চৌকিদারকে ডেকে যদুবাবুর জন্যে একটা খালি কাপ আনতে বললেন।

চৌকিদার কাপ দিয়ে গেল! কর্নেল পট থেকে চা ঢেলে সযত্নে যদুপতিবাবুর জন্যে চা তৈরি করে বললেন, ত্রিশুলের রক্তের রিপোর্ট কি এসেছে মিস্টার সিনহা?

যদুপতিবাবু বললেন এসেছে। ফোরেনসিক বিশেজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলেছেন, মানুষেরই রক্ত।

আমি চমকে উঠলাম। গায়ে কাঁটা দিল। কর্নেল যদুপতিবাবুর দিকে নিষ্পলক চোখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বললেন, বিকেলে ভৈরবমন্দিরে গিয়েছিলাম। মন্দিরের চূড়ার গড়ন মোচার মত। একেবারে খাড়া উঠে গেছে অন্তত কুড়িবাইশ · ফুট উচ্চতা তো বটেই। তার ডগায় ত্রিশূল বসানো আছে। মন্দিরের মূল দেয়ালের উচ্চতাও প্রায় দশ-বারো ফুটের কম নয়। যদি না কেউ মূল দেয়ালের অংশটুকুতে উঠতে পারে মোচার মত চূড়ার অংশে উঠবে কিভাবে? ভীষণ পিচ্ছিল আর খাড়া।

যদুপতিবাবু বললেন, কেন? বাঁশের মই দিয়েও ওঠা যায়।

কর্নেল মাথা নাড়লেন। তাহলে মইয়ের গোড়া নিচের মাটিতে দুটো ছাপ রাখবে। মাটিটা পুত্থানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেছি বিশেষ ধরনের আতশ কাচ দিয়ে। কোনও ছাপ নেই। দ্বিতীয়ত, মইয়ের ডগাও চূড়ার ওপর দুটো ছাপ ফেলবে। বাইনোকুলারের সাহায্যে তাও খুঁটিয়ে দেখেছি। দুটো ছাপ চূড়ায় শেষপ্রান্তে ত্রিশূলের ঠিক নিচেই আছে। কিন্তু ওটা নিশ্চয় ফায়ারব্রিগেডের মইয়ের ডগার ছাপ। ত্রিশূলের রক্তের নমুনা নেওয়ার সময় আপনারা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এনেছিলেন। ফায়ার ব্রিগেডের মই গাড়ির সঙ্গে ফিট করা থাকে। তাই নিচের মাটিতে মইয়ের দাগ পাইনি।

যদুপতিবাবু হাসলেন। পুলিসোচিত ভঙ্গিতে চোখ নাচিয়ে বললেন, জাস্ট আপনার ওপিনিয়ন নিলাম। আমরাও ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেছি, কর্নেল! মানুষের রক্ত ত্রিশুলে লেগে থাকার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভৈরবমন্দিরের ট্রাডিশন কিন্তু সাংঘাতিক। শুনেছি, প্রাচীনকালে শিবচতুর্দশীর রাতে শিবলিঙ্গে জলের বদলে মানুষের রক্ত ঢালা হত। আর এই কাপালিক সাধুরাও আসলে হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক। তা না হলে নরবলি দিতে পারে, বলুন?

কর্নেল বললেন, এক্ষেত্রে কিন্তু নরবলি দেওয়া হয়নি। মন্দির প্রাঙ্গণে হাড়িকাঠ আছে। তা সত্ত্বেও ভিকটিমদের মুণ্ডু কাটা হয়নি। পিঠে ত্রিশূল বিঁধিয়ে মারা হয়েছে।

তান্ত্রিক ব্যাপার। এ হয়তো কামাখ্যার ডাকিনীতন্ত্রের মতে আলাদা পদ্ধতিতে বলিদান।

যদুপতিবাবু হো হো করে হাসতে লাগলেন। কর্নেল বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। বললেন, আশ্চর্য তো! প্রতিটা বইয়ের মারণতন্ত্র অংশটা আণ্ডার লাইন করা দেখছি।

যদুপতিবাবু মন্তব্য করলেন, ধাঁধার পর ধাঁধা! ত্রিশূলে মানুষের রক্তও ব্যাপারটাকে অলৌকিক করে তুলেছে।

কর্নেল বললেন, সাধুর কথায় মহেশ্বর ত্রিপাঠী না হয় মারণতন্ত্র জপতে রাত্রিবেলা মন্দিরে গেলেন। কিন্তু তার পরিণতি দেখে পরবর্তী ভিকটিম নবারুণবাবু কেন ভয় পেলেন না বা তার মনে সন্দেহ জাগল না এবং তিনিও মন্দিরে গেলেন? তারপর দেখুন তৃতীয় ভিকটিম ভবেশবাবুও ঠিক তাই করলেন। বড় অদ্ভুত!

যদুপতিবাবু দুলতে দুলতে বললেন, মানুষ যত শিক্ষিত হোক, কুসংস্কার বড় কঠিন রোগ কর্নেল!

এই সময় আরেকজন পুলিশ অফিসার এলেন। পরিচয়ে জানলাম, ইনি আই বি দারোগা খগেন্দ্র বিশ্বাস। গম্ভীর মুখে বললেন, জরুরি খবর আছে স্যার। বিকেল চারটে নাগাদ রঞ্জন আঢ্যির বাড়িতে সেই সাধু এসেছিলেন। সাধুকে বসতে বলে, রঞ্জনবাবু ভেতরের ঘরে গিয়ে থানায় ফোন করেন। আমরা ছুটে যাই–আপনি তখন বাইরে ছিলেন। রঞ্জনবাবুর বাড়ি গিয়ে সাধুকে পাইনি। রঞ্জনবাবু ফোন করে গিয়ে দেখেন, সাধু নেই। সম্ভবত ব্যাপারটা আঁচ করে কেটে পড়েছিল।

কর্নেল বললেন, সাধুবাবা রঞ্জনবাবুকে কী বলছিলেন?

খগেন্দ্রবাবু বললেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র কিনতে পীড়াপীড়ি করছিলেন।

আর কিছু?

না স্যার! রঞ্জনবাবু বললেন, এছাড়া আর কিছু বলেননি সাধু। কিন্তু ফোন করে এসে রঞ্জনবাবু দেখেন, এককপি ডাকিনীতন্ত্র বসার ঘরে পড়ে রয়েছে। পাতা উল্টে দেখেছি, মারণমন্ত্রের তলায় ডটপেন দিয়ে আণ্ডার লাইন করা।

রঞ্জনবাবু এখন কোথায়?

বাড়িতেই থাকার কথা। ওঁর বাড়িতে আর্মড গার্ড মোতায়েন করেছি। ওঁকে বেরোতেও নিষেধ করেছি।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এখনই রঞ্জনবাবুর কাছে যাওয়া দরকার। ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। চলুন মিস্টার সিনহা। জয়ন্ত, তুমিও এস।

বাইরে জীপ দাঁড় করানো ছিল। যদুপতিবাবু ড্রাইভ করছিলেন। আলো-আঁধারি আঁকাবাঁকা রাস্তায় এগিয়ে বাজার এলাকায় ঢোকার মুখে হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল। যদুপতিবাবু অস্ফুট স্বরে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

অনেক গলিঘুজি ঘুরে একস্থানে জীপ দাঁড়াল। সামনে একটা দোতলা নতুন বাড়ির বারান্দায় হ্যাঁজাক জ্বলছিল। বেঞ্চে দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসেছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট ঠুকল। বাড়িটা নিঃঝুম কেন বুঝতে পারলাম না। যদুপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, রঞ্জনবাবু বেরোননি তো?

একজন কনস্টেবল মাথা নেড়ে বলল, না স্যার! কিছুক্ষণ আগেও ভেতরে ওঁর। গলা শুনেছি।

দরজার কড়া নাড়লে হেরিকেন হাতে একটি লোক জানালা খুলে প্রথমে আমাদের দেখে নিল, তারপর দরজা খুলল। বুঝলাম, রঞ্জনবাবু খুব সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। যদুপতিবাবু বললেন, তোমার মনিবকে খবর দাও হে! বলল, আমরা এসেছি।

লোকটি বলল আজ্ঞে হুজুর, বাবু তো নেই!

আমরা চমকে উঠলাম। খগেন্দ্র বিশ্বাস চোখ কটমটিয়ে বললেন, নেই মানে?

ভেতর দিকের দরজার পর্দা তুলে বিবর্ণ মুখে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে ফোন বাজল। দাদা ফোন ধরল। কী কথাবার্তা হল। তারপর দাদা ব্যস্ত হয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বলল, এক্ষুণি আসছি। জরুরি কাজ আছে। আমি নিষেধ করলাম, শুনল না। আর বৌদি তো শয্যাশায়ী।

কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, মিস্টার সিনহা। এখনই ভৈরবমন্দিরে যাওয়া দরকার। শীগগির!

আবার আমরা জীপে উঠলাম। অন্ধকার ঘোরালো সঙ্কীর্ণ রাস্তায় জীপ ছুটে চলল প্রচণ্ড গতিতে। মিনিট পনেরো পরে যখন থামল, জীপের হেডলাইটের আলোয় বিশাল এবং জরাজীর্ণ এক মন্দিরের ফটক দেখতে পেলাম। আবছা আলোয় ডাইনে-বাঁয়ে ধ্বংসস্তূপ আর আগাছার জঙ্গলও চোখে পড়ল।

টর্চ জ্বেলে মন্দিরের ফটক পেরিয়ে আমরা প্রাঙ্গণে ঢুকলাম। তারপর সবাই থমকে দাঁড়ালাম। প্রাঙ্গণে ফুট তিনেক উঁচু একটা চত্বরের ওপর পা মুড়ে আসনে বসা অবস্থায় কেউ মুসলিমদের নমাজ পড়ার ভঙ্গিতে উবু হয়ে রয়েছে। মাথাটা ঝুঁকে মাটিতে ঠেকেছে। সবার আগে চত্বরে উঠলেন কর্নেল। বললেন, হুঁ–যা ভাবছিলাম।

খগেনবাবু ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, বোকা! বোকা! অত করে বললাম ভদ্রলোককে।

যদুপতিবাবু চারধারে টর্চের আলো ফেলছিলেন। বললেন, বিশ্বাস? জীপ নিয়ে যাও। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এস সঙ্গে।

কর্নেল ঝুঁকে টর্চের আলোয় হতভাগ্য লোকটিকে দেখছিলেন। পিঠে তিনটি ক্ষতচিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। কর্নেল বললেন, মারা গেছেন সঙ্গে সঙ্গে। খুনী শরীরের ভাইটাল পয়েন্টগুলো ভালই জানে।

এদিন আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে অস্বাভাবিক গম্ভীর এবং অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে দেখছিলাম। আমার কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি। যেন আমার কথা ওঁর কানে ঢুকছিল না। গতিক দেখে মুখ বন্ধ করেছিলাম। চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলাম ওঁর ক্রিয়াকলাপ।

ওঁর সারাটা দিনের গতিবিধি ও ক্রিয়াকলাপ বর্ণনা করতে গেলে আরব্য উপন্যাস হয়ে যাবে। ডাইরীতে যেভাবে লিখে রেখেছিলাম, সেভাবেই সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরছি।

…সাড়ে সাতটায় কর্নেলের ডাকে নিদ্রাভঙ্গ। রাতের সেই বীভৎস ঘটনার পর মন বিভ্রান্ত। গোয়েন্দাপ্রবর অভ্যাসবশে সম্ভবত প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। দাড়িতে সাদা কী লেগে আছে। পাখির পালক? বিষণ্ণ হেসে ফেলে দিলেন। ভীষণ গম্ভীর হাবভাব। রাজবাড়িতে ব্রেকফাস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। রেডি হতে তাড়া দিলেন। তারপর আপন মনেই বললেন, আশ্চর্য জয়ন্ত! আজও ভৈরবমন্দিরের ত্রিশূলে রক্তের নতুন দাগ ফুটে উঠেছে। চমকে উঠলাম শুনে। এ নিশ্চয় অলৌকিক কাণ্ড।

আটটায় রাজবাড়ির গাড়ি এল। রাজবাড়ি ভৈরবমন্দিরের পেছনে। রাজবাহাদুর সুপ্রতাপ সিংহ অমায়িক মানুষ। খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন। কর্নেলের মতোই প্রকৃতিবিদ্যার বাতিক আছে। কত রকম দুপ্রাপ্য অর্কিড, ক্যাকটাস, আরও বিচিত্র গাছগাছড়ার সংগ্রহ আছে। ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানাও আছে। বেশি নেশা পায়রার। পৃথিবীর নানাদেশের পায়রা পুষেছেন। কথায় কথায় কর্নেল জানতে চাইলেন, মুসিলিটা ক্যালিটা (শব্দ দুটো এরকমই মনে হল) জাতের পায়রা আছে নাকি। রাজাবাহাদুর মুচকি হেসে চোখ নাচিয়ে বললেন, আসুন। দেখে যান। কাঠের খাঁচার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় মেঘে বলে সে কী রাজকীয় হাঁক। বাড়ি কেঁপে উঠল। উঁকি মেরে দেখি, একটা সাদা পায়রা ঝিম ধরে বসে আছে খাঁচায়। ঢ্যাঙা নোগা মত এক ভদ্রলোক এলেন। মাথায় নীল টুপি, গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি, পরনে আঁটো প্যান্ট, হাতে একটা ছড়ি। এসেই গাল চুলকে বললেন, তোমাকে খবর দিতে যাচ্ছিলাম। কাল বিকেলে ওড়াবার সময় মাদীটা বেশি দুরে চলে গিয়েছিল। ভাবলাম, সন্ধ্যার মুখে ফিরে আসবে। বোমের মাথায় লাল আলোটা জ্বেলে নাড়াচাড়া করলাম। ফিরে এল না।

রাজবাহাদুর খাপ্পা হয়ে বললেন, ব্যস! গেল। টাকাকে টাকা, পরিশ্রমকে পরিশ্রম!

মেঘেন্দ্রবাবু বললেন, বাজপাখির পাল্লায় না পড়ে তো ফিরে আসবে। এতদিন ধরে ট্রেনিং দিচ্ছি। বেঁচে থাকলে ফিরতেই হবে। আর যদি নাই ফেরে, কথা দিচ্ছি–আমি এর একটা জোড়া এনে দেব।

রাজাবাহাদুর পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেঘেন্দ্রলাল ঘোষ। ওঁর শ্যালক। একসময় সার্কাসে ছিলেন। নানা ঘাটের জল খেয়েছে জীবনে। চিরকুমার মানুষ। চেহারায় জীবনসংগ্রামের পোড়-খাওয়ার ছাপ স্পষ্ট। রাজাবাহাদুর শ্যালকের হাতে পশু পাখির দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। মনে হল, শ্যালককে খুব স্নেহ করেন।

চিড়িয়াখানা থেকে ফের ড্রইংরুমে। কর্নেলের সঙ্গে রাজাবাহাদুরের পায়রা নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা। তারপর এল খুনোখুনির প্রসঙ্গ। রঞ্জন আঢ্যির কথা উঠতেই রাজাবাহাদুর মুখ বিকৃত করে বললেন, ওই সুদখোরটার এমন পরিণতি স্বাভাবিক। বুঝলেন না? নকশালরা আবার অ্যাকশানে নেমেছে।

কর্নেল বললেন রঞ্জন আঢ্যি সুদখোর নাকি?

হ্যাঁ। তাছাড়া যে কটা লোক মারা পড়েছে, সব কটাই সুদখোর। মহাজনী কারবার ছিল।

কিন্তু নবারুণবাবু? উনি তো রিটায়ার্ড মাইন ইঞ্জিনীয়ার!

হাসলেন রাজাবাহাদুর। নবারুণও তো সুদখোরের বংশ মশাই! রক্তে ওটা আছে। শুনেছি, সেও টাকা ধার দিত খনিশ্রমিকদের। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা, বুঝলেন না? খনিশ্রমিকরা নেশাভাঙ করে আর জুয়া খেলে ফতুর হয়। নো প্রপার এডুকেশান, নো হেলদি অ্যাটমসফিয়ার। ওদের দোষ কী?

কিন্তু তাহলে কাপালিক সাধুর ব্যাপারটা কী মনে হয় আপনার?

ছদ্মবেশী নকশাল-স্কোয়াড। রাজাবাহাদুর রায় দিলেন। আমার ডাইরীতে পরবর্তী অংশ ফের সংক্ষিপ্ত।..রাজাবাহাদুরের কাছে বিদায় নিয়ে পুলিস স্টেশন। সেখানে কর্নেল-যদুপতিবাবুর দুর্বোধ্য গোপন মন্ত্রণা। ডাকবাংলোতে প্রত্যাবর্তন। আমার পুনঃপুনঃ প্রশ্ন। কর্নেলের উৎকট নীরবতা। আমি খাপ্পা। কর্নেলের চোখ বুজে কিয়ৎক্ষণ ধ্যান। তারপর হঠাৎ নিষ্ক্রমণ। প্রশ্নের জবাব পেলাম না।

বেলা একটায় কর্নেলের ফোন। লাঞ্চটা যেন আমি একা সাবাড় করি। এবং বিকেল চারটেয় যেন থানায় যাই রহস্যের পর্দা উন্মোচন দেখতে যদি আমার আগ্রহ থাকে।

.

০৩.

কাঁটায় কাঁটায় চারটেতে থানায় হাজির হলাম। ভেতরকার বড় ঘরে রীতিমত কনফারেন্সের আয়োজন হয়েছে। পুলিসসুপারও এসেছেন। বড়-ছোটো একঝাঁক গোমড়ামুখো পুলিস অফিসার বসে আছেন। মধ্যমণি হয়ে মিটিমিটি হাসছেন আমার বৃদ্ধ বন্ধু। তারপর চা এল।

চা খেতে খেতে গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, মিস্টার বিশ্বাস আসামীকে নিয়ে আসার আগেই এই হত্যারহস্যের পর্দা তোলা যাক। দুটি সূত্র থেকে আমি উপকৃত। প্রথমটি হল : রাজাবাহাদুরের সংগৃহীত একটি বিশেষ জাতের ট্রেণ্ড পায়রার অন্তর্ধান। দ্বিতীয়টি হল : রাজাবাহাদুরের উক্তি–ভিকটিমরা প্রত্যেকে চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনী কারবারে লিপ্ত ছিলেন। থানায় এসে মিস্টার সিনহাকে নিহত ব্যক্তিদের বাড়ি তল্লাস করে কারবারের খাতাপত্র তদন্ত করার নির্দেশ দিলাম। আশাতীত ফল পাওয়া গেল। মিস্টার সিনহা, আপনার তদন্ত রিপোর্টটি পড়ুন একবার।

যদুপতি সিনহা একটা ফাইল খুললেন। মহেশ্বর ত্রিপাঠীর খাতায় আসামীর নামে কর্জখাতে খরচ লেখা আছে দুহাজার টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা তিরিশ টাকা। নবারুণবাবুর মহাজনী খাতা পাইনি। নোটবইয়ে আসামীর নামে লেখা আছে, আড়াই হাজার টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা কুড়ি টাকা। ভবেশবাবুর খাতায় একই লোকের নামে কর্জখাতে খরচ লেখা আছে পাঁচ হাজার পাঁচশো টাকা। সুদের হার মাসিক শতকরা চল্লিশ টাকা। রঞ্জন আঢ্যির খাতায় আসামীর নামে কজখাতে লেখা রয়েছে সাত হাজার টাকা। মাসিক সুদ শতকরা তিরিশ টাকা।

পুলিশ সুপার বললেন, এত চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে কী করতেন ভদ্রলোক?

যদুপতিবাবু বললেন, এই ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকায় একটা জুয়াচক্রের রিং লিডার হতে গেলে প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করতে হয় স্যার। গুণ্ডাদল এবং মেয়েমানুষও পুষতে হয়। কিন্তু আমাদের চাপ সৃষ্টিতে এই চক্র বিশেষ সুবিধা করতে পারছিল না।

কর্নেল বললেন, এবার হত্যাপদ্ধতির কথায় নামা যাক। ভিকটিমরা সন্ধ্যার দিকে ফোন পাবার পরই ব্যস্তভাবে ছুটে যেতেন। বোঝা যায়, ফোনের অপরপ্রান্তে লোক অর্থাৎ আমাদের আসামীটিকে ওঁরা খুবই গুরুত্ব দিতেন। রঞ্জনবাবুর কথাই ধরুন। কাপালিক সাধুর আগমন এবং এককপি ডাকিনীতন্ত্র রেখে যাওয়ার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক থাকছে জেনেও রঞ্জনবাবু ছুটে গিয়েছিলেন ফোন পেয়ে। কেন? এর ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে : প্রথমত, কাপালিক সাধু ও ডাকিনীতন্ত্র ব্যাপারটার সঙ্গে ওই জরুরি ফোন পাবার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে, তিনি মোটেও জানতেন না। দ্বিতীয়ত, এমন ঝুঁকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যাবার কারণ টাকাকড়ি ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না। আশা করি, আপনারা সুদখোর মহাজনদের মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত। যখন সুদ কেন, আসল টাকাও ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তখন হঠাৎ যদি দেনাদার খাতক ফোনে ডেকে বলেন, এক্ষুণি চলে আসুন টাকা যোগাড় হয়েছে এবং সুদে আসলে সব মিটিয়ে দিচ্ছি, এবং সেই খাতক যদি হন এক গণ্যমান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি–তাহলে অর্থগৃধু মহাজন পাগল হয়ে দৌড়ে যাবেন বৈকি। টাকার সঙ্গে এঁদের রক্ত নেচে ওঠারই কথা।

পুলিশসুপার বললেন, ঠিক, ঠিক। কিন্তু মহেশ্বরবাবুর খুন হওয়া দেখেও কেন নবারুণবাবু কিংবা নবারুণবাবুর খুন হওয়া দেখেও ভবেশবাবু, এবং ভবেশবাবুর খুন হওয়া দেখেও রঞ্জনবাবু একই ফাঁদে পা দিতে গেলেন?

কর্নেল বললেন, নবারুণবাবু কেমন করে জানবেন, আমাদের আসামী ওরফে। ঘাতক লোকটি মহেশ্বরবাবুর কাছেও টাকা ধার করেছিলেন? তেমনি ভবেশবাবুও জানতেন না, তিনি ছাড়া আরও অনেকের কাছে এই লোকটি টাকা ধার করেছেন এবং ফেরত পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। এই ভিকটিম মহাজনরা প্রত্যেকে স্বাভাবিক কারণেই ভাবলেন, একমাত্র তার কাছেই ওই লোকটি দেনাদার। বিশেষ করে লোকটি যদি বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ হন, তিনি যে রাজ্যজুড়ে সকলের কাছে দেনা করে বেড়াবেন–কে ভাবতে পারে?

যদুপতিবাবু মুচকি হেসে বললেন, অথচ ইনি তাই করেছে।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–অন্তত সাতজন মহাজনের কাছে তো বটেই। কারণ আমরা সাতকপি ডাকিনীতন্ত্র চিৎপুরে এক ক্রেতার কেনার খবর জানি। শিল্পাঞ্চলে মহাজনদের ছড়াছড়ি। আপাতত আমরা চারজনকে জেনেছি। কারণ তারা খুন হয়েছেন, বাকি তিনজনকে জানি না। তবে বলা যায়, এই তিনজন জোর বেঁচে গেলেন। বাই দা বাই, মিস্টার সিনহা, এই চারজন মহাজনের কাতোর বাড়িতে কোনও হ্যাণ্ডনোট পেয়েছে কি–আসামীর স্বাক্ষরিত কোনও হ্যাণ্ডনোট?

না, কর্নেল।

তাহলেই বুঝুন, ভিকটিমদের বলা হয়েছে হ্যাণ্ডনোটসহ যেতে। ওঁরা ছুটে। গেছেন। ঘরে বসিয়ে রেখে আসামী টাকা আনার ছলে ভেতরে গেছেন। তারপর অতর্কিতে পিঠে ত্রিশূল বিঁধিয়ে মেরেছে। বডি বয়ে নিয়ে গেছে ভৈরবমন্দিরে। আসামীর বাসস্থানের অতি সন্নিকটে মন্দির। বেশি কষ্ট করতে হয়নি।

পুলিশসুপার বললেন, সন্নিকটে? মন্দিরের কাছে তো আর কোনও বাড়ি নেই!

কর্নেল দ্রুত বললেন, মিস্টার সিনহা, এবার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের তদন্তরিপোর্ট, প্লিজ!

যদুপতিবাবু ফাইলের দিকে ঝুঁকে বললেন, রঞ্জনবাবুর বাড়ির লাইন চাওয়া হয়েছিল রাজবাড়ি থেকে।

মাইগুডনেস! নড়ে বসলেন পুলিসসুপার। অসম্ভব। রাজাবাহাদুর অত্যন্ত সৎ মানুষ!!

যদুপতিবাবু বললেন, এক্সচেঞ্জের অপারেটার রাজাবাহাদুর বা রাজবাড়ির অনেকের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত। সে বলেছে, অচেনা কণ্ঠস্বরে লাইন চাওয়া হয়েছিল। ছয়ুই মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় মহেশ্বরবাবুর, সাতুই মার্চ সন্ধ্যা ছটায় নবারুণবাবুর এবং নয়ুই। মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় ভবেশবাবুর বাড়ির লাইন চাওয়া হয়েছিল রাজবাড়ি থেকেই। কণ্ঠস্বর অচেনা।

কণ্ঠস্বর বদলানো খুব সহজ। কর্নেল বললেন, যাই হোক মিস্টার সিনহা, এবার আমাদের মূল সাক্ষীকে উপস্থিত করুন।

হতবাক হয়ে দেখি, যদুপতিবাবু টেবিলের তলা থেকে একটা পাখির খাঁচা বের। করে টেবিলে রাখলেন। খাঁচার ভেতর একটা সাদা পায়রা। তার গলায় খয়েরি রঙের খানিকটা তুলো বাঁধা রয়েছে। বললাম, কর্নেল! আজ সকালে আপনার দাড়িতে কি এই পায়ারাটিরই পালক দেখছিলাম?

কর্নেল হাসলেন। অত উঁচুতে ত্রিশূল। কিভাবে রক্ত মাখানো সম্ভব, ভাবতে গিয়ে হঠাৎ মনে হয়েছিল–ট্রেণ্ড পাখির সাহায্য নেওয়া হয়েছে কি? এ-ক্ষেত্রে পায়রার কথাই সবার আগে মনে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এবং পরে নানা ক্ষেত্রে ট্রেণ্ড পায়রা দিয়ে চিঠি পাঠানো হত। অন্যান্য কাজও করা হয়েছে পায়রা দিয়ে। তাই রাজাবাহাদুরের পায়রাগুলোর কথা মনে পড়েছিল। মিস্টার সিনহাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম গতরাতে রঞ্জনবাবুর হত্যাকাণ্ডের পর। ফায়ার বিগ্রেডের সাহায্যে ত্রিশূলে ফাঁদ পেতে রাখতে বলেছিলাম।

যদুপতিবাবু বললেন, রাত তিনটের মুকহরবস্তীতে গিয়ে পাখি ধরা একটা লোককে ওঠালাম। ফায়ার ব্রিগেডের একটা গাড়িও চুপচাপ আনা হল। মুকহর লোকটি কিছুতেই ফায়ার ব্রিগেডের মইয়ে উঠবে না। ভয়টয় দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ হল। ভোর পাঁচটায় দেখি, পক্ষিবরের আবির্ভাব এবং গলায় তুলোতে রক্ত। ত্রিশূলে এসে গলা ঘষতে গিয়েই বাছাধন ফাঁদে পড়ল। তারপর দেখি, কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে মাঠ দিয়ে আসছেন।

কর্নেল বললেন, তখনও বুঝিনি, কে এর পেছনে। সকাল আটটার পর রাজবাড়িতে ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণে গিয়ে দেখলাম, রাজাবাহাদুরের পায়রার খাঁচায় জোড়াপায়রার একটা নিখোঁজ। অমনি সব জল হয়ে গেল। হা-ওই যে আসামী হাজির। ওঁর টুপিটা খুললেই দেখবেন, মাথায় আমার মত টাক আছে। চিৎপুরের দোকানে যে চেহারার বর্ণনা পেয়েছিলুম, আজ সকালে ওঁকে দেখামাত্র তা মিলে গিয়েছিল।

সবাই দরজার দিকে ঘুরে দেখলাম, খগেন্দ্র বিশ্বাস এবং আরও সব অফিসারের সঙ্গে হাতকড়া ও কোমরে দড়ি পরে আসামী সত্যি হাজির। কিন্তু কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি, রাজাবাহাদুরের শ্যালক সেই মেঘেন্দ্রবাবু?

কর্নেল বললেন, মিস্টার বিশ্বাস, আশা করি, চিৎপুরের আর দাশ অ্যাণ্ড কোম্পানির জটাজুট গোঁফ-দাড়ি পোশাক-আশাক পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ স্যার। খাটের তলায় পিচবোর্ডের বাক্সে প্যাক করা ছিল।

ত্রিশূলটা?

পেয়েছি। এই দেখুন। এতে কিন্তু রক্তক্ত নেই। ধুয়ে ফেলা হয়েছে।

ত্রিশূলটা দেখে আঁতকে উঠলাম। যাত্রাদলে ব্যবহারের জন্য নিছক টিনের তৈরি ত্রিশূল। সূচনো তিনটে ফলা। একটু বেঁকে আছে শুধু।

কর্নেল বললেন, তিন কপি ডাকিনীতন্ত্র উদ্ধার করতে পেরেছেন তো?

খগেন্দ্রবাবু সহাস্যে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। পিচবোর্ডের বাক্সেই ছিল।

লালমলাটের তিনকপি বই টেবিলে রাখলেন খগেন্দ্র। বইগুলো হাতে হাতে ঘুরল কিছুক্ষণ। দেখলাম, প্রত্যেকটি বইয়ের ভেতর মারণতন্ত্রের তলায় আণ্ডারলাইন করা। শিউরে উঠলাম এই ভেবে যে আরও তিনটি মানুষের বরাতে কী নিষ্ঠুর মৃত্যু অপেক্ষা করছিল!

মেঘেকে হাজতঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় কর্নেল তার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার প্ল্যানিং অনবদ্য মেঘেন্দ্রবাবু। কাঁপালিকের আবির্ভাব, ডাকিনীতন্ত্র বই এবং মারণমন্ত্রে আণ্ডারলাইন করা, ত্রিশূলের আঘাতে হত্যা করে ভৈরবমন্দিরের চত্বরে আসনে জপরত অবস্থায় রেখে আসা-সবই চমৎকার পরিকল্পনা। বস্তুত একজন নন একজিস্টেন্ট কাপালিক সাধুর পেছনেই হন্যে হত পুলিশ। বিভ্রান্ত করার কী অপুর্ব কৌশল আপনার! খামোকা নিরীহ সাধুরা মার খেলেন–আরও। অনেকে মার খেতেন জনসাধারণের হাতে। শেষ পর্যন্ত কোনও বদ্ধ পাগল সাধুর ঘাড়ে দোষটা পড়ত এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে তার সাজা হতো। কিন্তু একটা উইক পয়েন্ট আপনাকে ধরিয়ে দিল। বাড়তি একটু অলৌকিকতার টাচ দিতে গেলেন মন্দিরের দুর্গম ত্রিশূলে রক্তের দাগ মাখিয়ে। এর ফলে ঘটনার অলৌকিক রহস্য নিশ্চয় দানা বেঁধেছিল। কিন্তু এটাই আসলে আবার একটা ভীষণ দুর্বল পয়েন্ট। অতিচালাকি করতে গিয়ে আপনি ধরা পড়ে গেলেন।

মেঘেন্দ্র পেছন ফিরে হাজতঘরে ঢুকলেন। তার মুখ দেখতে পেলাম না। কর্নেল ফের বললেন, আপনি সার্কাসে ছিলেন। নিশ্চয় ক্লাউন সাজার অভিজ্ঞতা আছে। কণ্ঠস্বর বদলাতেও পারেন, খাড়া ধারালো নাককে মোটা নাকে পরিণত করতেও পটু। কাপালিক সাজা কী এমন কঠিন কর্ম! শুধু ত্রিশূলে রক্ত মাখাতে গিয়েই বিপত্তি ঘটল। আপনাকে ধরিয়ে দিলে নিছক একটা পায়রা।

সবাই খাঁচার ভেতর পায়রাটা দেখতে থাকলাম। বেচারা চুপচাপ বসে পিটির পিটির তাকাচ্ছে।…

.

টয় পিস্তল

হঠাৎ আজব দৃশ্য দেখে ঘরসুদ্ধ লোক প্রথমে হতভম্ব হলো, পরে প্রচণ্ড অট্টহাসির ধুম পড়ে গেল। আমি তো হাসতে হাসতে দুহাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে প্রায় মরার দাখিল–ফুসফুস ফেটে যাবে মনে হচ্ছিল। তারপর কর্নেলের করুণ ও অস্ফুট স্বগতোক্তি শুনলুম-ওটা কেড়ে নিন ওর হাত থেকে। কেড়ে নিন!

মুখ তুলে টেবিলের ওপর দুহাত ভোলা, অর্থাৎ হ্যাঁণ্ডস আপ ভঙ্গিতে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম এবং ফের দমফাটানো হাসির চাপ এল। মেঝেয় ছোট্ট মেয়ে নিন তখনও খেলনার পিস্তলটা তাক করে আছে।

কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের বোধ থেকে জানলুম-কর্নেলের মুখে এবং ওই ভঙ্গিতে দেখেছি তা যেন একটি ছোট মেয়ের সঙ্গে কৌতুক নয়। তা যেন ভান নয় মোটেও। যেন কোনও হিংস্র আততায়ী সত্যি সত্যি একটা প্রকৃত মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র তার দিকে তাক করেছে।

একি আমার নিছক দেখার ভুল? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার স্বভাবত সিরিয়াস টাইপের মানুষ। তার মানমর্যাদাও সামান্য নয়। বিশেষত প্রতাপপুর অখনির মালিকের এই বাড়িতে তিনি এখন একজন বরেণ্য অতিথি।

বিজয়েন্দু রায়ের সাত বছরের মেয়ে নিনা টয় পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকেই তাকে তাক করে যেই বলেছে–হ্যাণ্ডস আপ, অমনি কি না ওই রাশভারী বৃদ্ধ কর্নেল আচমকা একলাফে কোণায় উঁচু টেবিলে উঠে দাঁড়ালেন–শুধু তাই নয়, দুহাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন–নো নো নো! মিসেস রায়! মিসেস রায়! ওটা কেড়ে নিন।

পরক্ষণে চন্দ্রকণা মেয়ের হাতের টয় পিস্তলটা কেড়ে নিয়েছেন বাবাঃ! খুব ভয় পেয়েছেন কর্নেলদাদু। দেখছ না–হ্যাণ্ডস আপ করেছেন? ব্যস! এবার তুমি অন্য খেলা খেল গে কেমন?

ঘরে তখনও হাসির আবহাওয়া। কর্নেলকে নামতে দেখলুম! কিন্তু আশ্চর্য, মুখটা গম্ভীর। সোফার আগের জায়গায় বসে কঁচুমাচু হয়ে বললেন–আপনারা ক্ষমা করবেন আমায়। জাস্ট এ ফান। কিন্তু রিয়েলি–এত হঠাৎ ও অমনভাবে ঢুকল যে…মাই গড! হোয়াট এ ফান!

ফের সবাই হাসল। নিনা ওর মায়ের হাত থেকে পিস্তলটা নেবার চেষ্টা করছে। আমি বললুম–দিয়ে দিন না! তখন চন্দ্রকণা সেটা ওকে ফেরত দিলেন। মুখে প্রচুর হাসি।

নিনা পিস্তলটা নিয়ে ফের কর্নেলের দিকে তাক করতেই কর্নেল এবার সব গাম্ভীর্য এবং কঁচুমাচু ভাব ভেঙে হো হো করে হেসে ফেললেন এবং ডাকলেন– নিনি! চলে এস। দেখি তোমার পিস্তল! হুঁ–দেখি দেখি!

খুব ভয় পেয়েছিলুম। দারুণ ভয়! বসে কর্নেল ওর পিস্তলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।বাঃ! চমৎকার পিস্তল কিন্তু! আজকাল আমাদের খেলনা তৈরিতে খুব উন্নতি করেছে। ইয়ে মিসেস রায়, এটা–এটা বুঝি সম্প্রতি কেনা হয়েছে?

চন্দ্রকণা জবাব দিলেন—হ্যাঁ। পরশু উনি কলকাতা থেকে এনে দিয়েছেন। নিনা কদিন থেকে টয় পিস্তলের বায়না ধরেছিল, আজকাল বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ওয়েস্টার্ন ফিল্মের কায়দায় গানডুয়েল খেলতে ভালবাসে। নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন–তাই বটে! তবে আর একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন মিঃ রায়? আজকালকার খেলনা কিন্তু মোটেও খেলনার মতো দেখায় না। অবিকল আসলের ক্ষুদে সংস্করণ। তাই না? যেমন এই টয় পিস্তলটাই দেখুন। পরীক্ষা করার আগে কার সাধ্য এটা খেলনা ভাবতে পারে? তাছাড়া ওজনও দেখছি প্রকৃত পিস্তলের মতো।

এবার সকৌতুকে বললুম–তাই বুঝি আপনি প্রাণভয়ে টেবিলে চড়েছিলেন? কিন্তু আপনার কিলার নিনাও যে একটা বাচ্চা মেয়ে সে কথাটা নিশ্চয় মাথায় ঢোকেনি?

কর্নেল একটু হেসে রহস্যময় ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন। বিজয়েন্দু হাসতে হাসতে বললেন–যদি সিরিয়াসলি ধরেন তাহলে বলব কর্নেলের গোয়েন্দা। মানসিকতারই এটা একটা প্রকাশ। অনবরত হত্যাকারীর মুখোশ ফাস করা যার নেশা ও পেশা, তার মনে এমন আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক।

একটু পরে সুদৃশ্য ট্রে এবং পট-পেয়ালায় কফি তার সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস এল। এখন সকাল সাতটা। যে ঘরে আমরা বসে আছি তা পাহাড়ের গায়ে একটা বাংলোবাড়ি। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিস্তৃত সুন্দর উপত্যকা, পূর্বে ছোটোখাটো পাহাড় এবং উপত্যকা পেরিয়ে একটা নদী, পূর্বের পাহাড় ঘেঁসে দক্ষিণে চলে গেছে। সময়টা সেপ্টেম্বর। তাই প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলনাহীন।

খনি রয়েছে এই পাহাড়ের উত্তর দিকের অন্য একটা উপত্যকায়। এখান থেকে দুমাইল দূরে একটা সুন্দর পীচের রাস্তা বাংলোর পশ্চিম গেট থেকে শুরু হয়ে উত্তর ঘুরে উতরায়ে নেমেছে এবং বড় সরকারী সড়কে মিশেছে। ওই সড়ক ধরে এগোলে খনিতে পৌঁছানো যায়।

আমরা, দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার শ্রীমান জয়ন্ত চোধুরী এবং তার বৃদ্ধ বন্ধু গোয়েন্দা ও প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার দৈবাৎ এসে পড়েছি এখানে। দক্ষিণ-পশ্চিমের উপত্যকার জঙ্গলে কর্নেল কিছু বিরল প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহ করবেন এবং আমি তাকে নিছক সঙ্গ দেব। ফরেস্ট বাংলোয় ওঠার কথা ছিল। কিন্তু পথে হঠাৎ বিজয়েন্দুর সঙ্গে দেখা এবং কর্নেল তার পরিচিত–অতএব কিছুতেই জঙ্গলে কাটাতে দেবেন না। তার অতিথি হয়ে গতকাল সন্ধ্যায় এখানে আসতে হলো। এখন এ ঘরে রায়দম্পতি ও তাদের মেয়ে নীনা ছাড়া আরও তিনজন ভদ্রলোক আছেন। আলাপ হয়েছে পরস্পর। সতীনাথ চাকলাদার কলকাতা থেকে এসেছে নিছক শিকারে। তিনি নামকরা শিকারী। আমাদের যে ফরেস্ট বাংলোয় থাকার কথা তিনি সেখানেই একটা ঘরে আছেন। এসেছেন গত পরশু। বিজয়েন্দু ওঁর বন্ধু। নরেন্দ্র সিংহরায় পাঁচ মাইল দূরের প্রতাপগড় বাজারের একজন ব্যবসায়ী। আর আছেন শ্যামল মুখার্জি বিজয়েন্দুর খনির ম্যানেজার।

বিজয়ের বয়স চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ গড়নের মানুষ, কেমন যেন বন্য চেহারা। গোঁরগোবিন্দ বলে মনে হয়েছে। শিকারী সতীনাথ কিন্তু উল্টো চেহারার ও স্বভাবের। ওঁর হাসিটি এত চমৎকার যে, ভাবাই যায় না এই মানুষ হিংস্র বন্য জন্তুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তেও ওস্তাদ। রোগা, ঢ্যাঙা, বয়সে বিজয়ের কাছাকাছি। নরেন্দ্রবাবু হোঁদলকুতকুতে গড়নের সুখীসুখী চেহারার মানুষ বয়স অনুমান পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। সবসময় পান খান। কথা খুব কম বলেন। বেশি হাসেন। শ্যামলবাবু আমার বয়সী, অর্থাৎ বত্রিশ। সফিস্টিকেটেড বলা যায়, একটু গম্ভীর। তীক্ষ্ণ চোখজোড়ায় সর্বজ্ঞের হাবভাব। চন্দ্রকণা কিন্তু স্ত্রী হিসেবে বিজয়েন্দুর। বেমানানই বলব। অসাধারণ সুন্দরী তো বটেই বয়সেও মনে হলো অন্তত দশ বারো বছরের ছোট, স্বামীর চেয়ে।

কফি খেতে খেতে এবার শিকারের গল্প শুরু হলো। আমারও শিকারে এক আধটু নেশা ও অভিজ্ঞতা আছে। সঙ্গে রাইফেলও এনেছি একথা শুনে সতীনাথ আমার দিকে ঝুঁকলেন। বেগতিক দেখে কর্নেল বলে উঠলেন–তবে সাবধান মিঃ চাকলাদার, জয়ন্ত মাঝেমাঝে ভুলে যায় যে ওর হাতে রাইফেল আছে। ও খাঁটি রিপোর্টারের মতো বধ্য জন্তুর দিকে তাকায় যেন সত্যসেবকে কীভাবে ফাস্ট লাইনটা শুরু করবে। সুতরাং সাবধান!

সবাই হাসলেন। ওঁকে আশ্বস্ত করে বললুম–আমি এবার শিকার-টিকারে বেরুচ্ছিনে। এখানে বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখেই সময় কাটাব।

সতীনাথ বললেন কর্নেলও তো শুনেছি পাকা শিকারী! সুতরাং বেরুতে হলে তিন জনেই বেরুব। কী বলেন কর্নেল?

এইসব গপ্পসপ্প হতে হতে আটটা বেজে গেল। চন্দ্রকণা ততক্ষণে মেয়েকে নিয়ে অন্য ঘরে গেলেন। নিনা খুব চঞ্চল মেয়ে।

তারপর সতীনাথ আমাদের দুজনকে ফরেস্ট বাংলোয় আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন। একটু পরে নরেন্দ্র বেরিয়ে গেলেন। তার কিছু পরে শ্যামলবাবু ও বিজয়েন্দু কাজকর্ম নিয়ে পাশের ঘরে কথা বলতে চলে গেলেন। ঘরে রইলুম কর্নেল ও আমি।

কর্নেলের মুখটা আবার গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললুম–হ্যালো ওল্ড ম্যান! ব্যাপারটা কী, বলুন তো!

কর্নেল তাকালেন–কিছু কি বলছ, ডার্লিং?

উনি কি যেন ভাবছিলেন। বললুম–এনিথিং সিরিয়াস?

কর্নেল ঘাড় নাড়লেন। তারপর ঠোঁট ফাঁক করলেন–কিন্তু কিছু বললেন না।

মনে হচ্ছে একটা কিছু চক্রান্ত করছেন?

কর্নেল হঠাৎ আমার হাতে হাত রেখে চাপা গলায় বললেন-জয়ন্ত! ওই টয় পিস্তলটা–

উনি থামতেই চমকে উঠে বললুম–কেন? আপনার কি মনে হলো ওটা টয় পিস্তল না।

-হ্যাঁ, ডার্লিং। ওটা একটা খেলনার পিস্তলই বটে!

–তাহলে?

–কিন্তু আশ্চর্য, জয়ন্ত, আশ্চর্য!

এবার বিরক্ত হলুম। সব তাতেই ওঁর যেমন নাক গলানো অভ্যাস তেমনি যেন আজকাল সব কিছুতেই রহস্য টের পাবার বাতিক দাঁড়িয়েছে। বললুম–একটা টয় পিস্তলে কী আশ্চর্য থাকতে পারে বুঝলুম না! ছেড়ে দিন।

কর্নেল আমার বিরক্তি অগ্রাহ্য করে ফের বললেন–ওটা অবিকল আসল পিস্তলের মতো দেখতে। এমন কি ওজনও একই। কেন জয়ন্ত, কেন?

নির্ঘাৎ ওঁর এবার ভীমরতি ধরেছে। অগত্যা উঠে দাঁড়িয়ে বললুম–আপনার কিঞ্চিৎ ভোলা বাতাস সেবন করা দরকার। টুপি খুলে টাক বিকশিত করে, হে প্রাজ্ঞ ঘুঘুমশায়, নদীর ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। ঘিলুর ধুলোময়লা সাফ হয়ে। যাবে। আসুন।

কর্নেলও উঠে দাঁড়ালেন, তখুনি সায় দিয়ে বললেন–ঠিকই বলেছ ডার্লিং। এর চেয়ে আপাতত আরামদায়ক কিছু নেই। ওঃ, এই ঘরে যেন আমার দম আটকে আসছে।

.

সেই যে বেরুলুম দুজনে, পুরো দুপুর কেটে গেল জঙ্গলে-জঙ্গলে। কর্নেলকে স্বাভাবিক দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। কাঁধে কিটব্যাগ নিয়েছিলেন। তার মধ্যেese প্রজাপতি ধরা জাল আর ভাজকরা খাঁচাও ছিল। আড়াইটে অব্দি সাতটা প্রজাপতি ধরলেন উনি। পাখির পিছনেও বাইনোকুলার চোখে নিয়ে ছোটাছুটি করলেন। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অবশেষে কর্নেলের দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটার দিকে আনা গেল এবং দুজনে গলদঘর্ম হয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালুম। ..

কিন্তু নদীর ধারে এসে হঠাৎ কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, মনে হচ্ছে আমরা ফরেস্ট বাংলোর কাছে এসে পড়েছি। একবার অন্তত মিঃ চাকলাদারের সঙ্গে দেখা করা উচিত। কী বলে?

বিরক্ত হয়ে বললুম–লাঞ্চের সময় চলে গেল যে। তাছাড়া উনি এখানে, আছেন, না জঙ্গলে ঘুরছেন–ঠিক নেই!

কর্নেল আমার হাত ধরে সস্নেহে টানলেন। –ডার্লিং, এটা ভদ্রতা। জঙ্গলে আছি কিন্তু আমরা মানুষ।

বলে উনি যেন বীরবিক্রমে হাঁটা শুরু করলেন। একটু পরেই টের পেলুম, এ যাওয়া স্বাভাবিক গতিতে নয়। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো ঝোপঝাড় ভেঙে আগাছা মাড়িয়ে যেন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে যাওয়া। কয়েকবার ওঁর টুপি কাঁটায় আটকে গেল। দ্রুত ছড়িয়ে নিলেন। আমিও প্রায় ক্ষতবিক্ষত হলুম। তারপর হঠাৎ কর্নেল আমাকে টেনে ধরে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও বসলেন। ঝোপের আড়াল ছিল। তার ওধারে ফরেস্ট বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। নদীর এপারেই একটা টিলার গায়ে রয়েছে সেটা। তারপর দেখলুম, কর্নেল বাইনোকুলার দিয়ে বাংলোটা দেখছেন। আমি অবাক এবং অস্থির।

একটু পরে ঘুরে কর্নেল চাপা গলায় বললেন–এক মিনিট, জয়ন্ত। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি এখুনি আসছি। সাবধানে, যেভাবে বসে আছ, তাই থাকবে। নড়ো না।

কোনও প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে উনি গুঁড়ি মেরে এগোলেন। ওঁর ভঙ্গি দেখে, মনে হলো, একটা ক্ষুধার্ত সিংহ যেন চুপিসারে তার শিকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। একটু পরেই ওঁকে গাছপালা ও ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখলুম। এই অদ্ভুত কাণ্ডের মাথামুণ্ডু না খুঁজে পেয়ে অগত্যা হাল ছেড়ে দিতে হলো। ঝোপের ফাঁকে দুরের ওই বাংলোর দিকে চোখ রইল আমার।

কিন্তু বাংলো যেমন নির্জন ছিল তেমনিই আছে। জনপ্রাণীটি নেই। পনের মিনিট কেটে গেল। তারপর সামনের দিকে শুকনো পাতা মচমচ করে উঠল। শব্দটা এগিয়ে আসতে থাকল। রাইফেলটা সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি। তাই অসহায় হয়ে আশা করতে থাকলুম যে, ওই শব্দ যেন কর্নেলেরই হয়। শেষ অব্দি আশা মিটল। আন্দাজ দশ গজ দূর থেকে কর্নেলের টুপি চোখে পড়ল। ওঁর মুখে অমায়িক হাসি। কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন–যে পথে এসেছি সেই পথে এই ভাবেই ফিরতে হবে, জয়ন্ত। সাবধান।

অতএব ফের সেইসব কাঁটায় খোঁচা খেতে খেতে আগের জায়গায় পৌঁছানো গেল এবং এবার উনি চড়া গলায় জঙ্গলের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে করতে সুপথে পা বাড়ালেন।

বিজয়ের বাংলোর কাছে পৌঁছে এতক্ষণে বললুম–এসবের মানে কী?

কর্নেল আমার হাত টেনে নিয়ে বললেন-অধৈর্য হয়ো না। ঠিক মতো সব কিছু চললে তুমি এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে। জয়ন্ত, এটা আমার দূরদৃষ্টি বলতে পারো। যেখানে যাই, এক মারাত্মক আততায়ী আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে এগিয়ে আসে। না, না, ডার্লিং। তুমি ভয় পেয়ো না। আশা করি, খুব বেশি কিছু ঘটবে না।

অস্থিরতা চেপে রাখতে হলো। আর তখন খিদেয় নাড়িভুঁড়ি জ্বলছে।

.

সেদিন সন্ধ্যায় বিজয়ের সেই ঘরে আবার আজ্ঞা চলেছে। তবে এ-বেলা সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক, অর্থাৎ নরেন্দ্র সিংহরায় আসেননি। শিকারী বা ম্যানেজারও না। আমি, কর্নেল ও রায়দম্পতি গল্প করছি। গল্প করার সময় কর্নেলের অন্যমনস্কতা লক্ষ করছিলুম। মাঝেমাঝে ঘড়ি দেখছেন আড়চোখে। কে যেন আসবে, প্রতীক্ষা করছেন। কে সে?

পাশের ঘরে নিনা ইংরেজি ছড়া মুখস্থ করছে, শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার কথাও বলছিল। বাইরে তখন ফুটফুটে শরঙ্কালীন জ্যোৎস্না।

কর্নেলের চঞ্চলতা এবার বিজয়ের চোখে পড়ল। বললেন কর্নেলের কি। শরীর খারাপ করছে?

কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন–ও নো নো! আমি–ইয়ে মিঃ রায়, ভাবছি যে আজ রাতটা বরং ফরেস্ট বাংলোয় গিয়ে কাটাব। ভারি চমৎকার জ্যোৎস্না ফুটেছে। তাছাড়া আজ দুপুরে জায়গাটা দেখে এসেছি–অপূর্ব। আপনি যদি কিছু না মনে করেন

বিজয়েন্দু বললেন, না। মনে করার কি আছে?

চন্দ্রকণা বললেন কিন্তু এক শর্তে। এখানে ডিনারে না খেয়ে নয়।

কর্নেল বেজার মুখে বললেন–প্লিজ মিসেস রায়। আপনার রাঁধুনীকে কিন্তু আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছি। সে আপনাকে কিছু বলে নি?

চন্দ্রকণা ক্ষুব্ধমুখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-কই না তো। তারপর ভেতরে চলে গেলেন। হয়তো রাঁধুনীকে ধমক দিতেই গেলেন।

বিজয়েন্দু একটু হেসে বললেন–তাহলে যা ভেবেছি। শরীর খারাপ। মুশকিল– কী জানেন, এ জায়গাটা একটা বিউটি স্পষ্ট। কিন্তু জলবায়ুটা তেমন ভাল নয়। আমারও মাঝে মাঝে পেটের অসুখ হয়।

কর্নেল এ সময় আমাকে গোপনে একটু খুঁচিয়ে দিলেন। তারপর বললেন-হ্যাঁ। জয়রেও সেই অবস্থা। তাই ওকেও বলেছি, রাত্তিরটা আমার সঙ্গে উপোস করতে।

আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলুম। পাশের ঘরে চন্দ্রকণা শুনলুম মেয়েকে বকাবকি করছেন–এখন খেলে না। এখন কি খেলার সময়? নিনা অনুযোগ করছে, শোনা গেল।

বাইরে কার সাড়া পাওয়া গেল রায়, আসতে পারি? বিজয়েন্দু উঠে গেলেন। তারপর দেখি, সতীনাথ ঢুকছেন ওঁর সঙ্গে। কর্নেলের মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটল। বললেন–আসুন, আসুন মিঃ চাকলাদার। আপনি না থাকায় মোটেও আচ্ছা জমছিল না। তারপর বলুন, আজ কী শিকার-টিকার করলেন।

সতীনাথ হাসিমুখে বসে বললেন–একটা সাপ মেরেছি। হ্যামাড্রায়াড। অর্থাৎ শঙ্খচুড়।

এরপর ফের গল্পের আবহাওয়া জমজমাট হয়ে উঠল। চন্দ্রকণা ফিরলে সতীনাথ। ফের গোড়া থেকে সাপ মারার ঘটনা শুরু করলেন। তারপর এক ফাঁকে হঠাৎ নিনা। সকালের মতো সেই টয় পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ল। বিজয়েন্দু হেসে বললেন নিনি, এবার আর কর্নেলদাদুকে নয়–তোমার শিকারীকাকুকে অ্যাটাক করো! জোরে ট্রিগার টিপবে কেমন? তাহলেই কাকু ব্যস!

অমনি নিনা পিস্তল তাক করল সতীনাথের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য, সতীনাথ, ঠিক সকালে কর্নেল যা করেছিলেন, তার চেয়েও হাস্যকর কাণ্ড করে বসলেন। এক লাফে তিনি প্রায় চোখের পলকে ঘর তেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপর বাইরে ওঁর। প্রচণ্ড গর্জন শোনা গেল–বিশ্বাসঘাতক। ব্রুট। এর শধ একদিন নেবই নেব।

কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন–মিঃ চাকলাদার। ফিরে আসুন। কোনও ভয় নেই।

কিন্তু চেঁচিয়ে ওঠার মধ্যেই উনি একলাফে নিনার পিস্তলটাও ধরে ফেলেছেন। নিনা কেঁদে উঠেছে। চন্দ্রকণা স্তম্ভিত। বিজয়েন্দু হাঁ করে আছেন। সতীনাথের কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক কি সত্যি চলে গেলেন?

নিনার হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে কর্নেল হাসতে হাসতে জানালা দিয়ে তাক করলেন এবং আমাদের আরও হতবুদ্ধি ও আতঙ্কিত করে ট্রিগার টিপতেই সত্যিকার পিস্তলের আওয়াজ রাতের স্তব্ধতা খানখান করে দিল। আমার বুক চিব ঢিব করতে থাকল।

বিজয়েন্দু লাফিয়ে উঠে বললেন–সর্বনাশ! নিনা করেছে কী!

কর্নেল ভৎর্সনার ভঙ্গিতে বললেন–আপনার পিস্তলের সঙ্গে নিনার খেলনা পিস্তল বদল হয়ে গেছে, মিঃ রায়। আপনি এবার থেকে অস্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হবেন।

বিজয়েন্দু বললেন–আমি খুব দুঃখিত, কর্নেল। আমার পিস্তলটা ড্রয়ারে থাকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলুম। কী সর্বনাশ ঘটে যেত এক্ষুণি! কর্নেল পিস্তলটা ওঁকে দিয়ে বললেন–এবার চলি। জয়ন্ত তুমি গুছিয়ে নাও আর মিঃ রায়, মানুষকে ক্ষমা করতে শিখুন।

বিজয়েন্দু কোনও কথাও বললেন না। পিস্তলটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকলেন। নিজেদের ঘরে গিয়ে গোছগাছ করছি, সেই সময় চন্দ্রকণার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুনলুম। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন-জয়ন্ত, ওই জটিল দাম্পত্য • • সমস্যা মেটাবার ক্ষমতা আমাদের নেই। অতএব দ্রুত বেরিয়ে পড়া যাক।

রাস্তায় গিয়ে বললুম–কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন–এখনও টের পাচ্ছ না? সতীনাথ চন্দ্রকণার পুরনো প্রেমিক। বিজয়েন্দু এবার ঠিক করেছিলেন সতীনাথ এলেই মেয়ের হাত দিয়ে ওঁকে খুন করাবেন। খুব সরল পন্থা। দৈবাৎ বাচ্চা মেয়ে তাঁর অটোমেটিক পিস্তলের সঙ্গে নিজের টয় পিস্তল বদল করে নিয়েছে। অতএব হত্যাকাণ্ডের দায়টা আইনের ফাঁকে উড়ে যাবে। আজ সকালে আমি যে আচরণ করেছিলুম, তা বিজয়েন্দুকেই সতর্ক করে দিতে। নির্বোধ বিজয়েন্দু তা আঁচ করেননি। আর, আজ দুপুরে আমার অত সতর্কতার কারণ আর কিছু নয়–বিজয়েন্দু খনিতে যাওয়ার পর চন্দ্রকণা প্রেমিকের কাছে আসবেন, এই ধারণা ছিল। তাই পাছে প্রেমিকদ্বয়ের চোখে পড়ি, একটু সতর্ক হয়েছিলুম।

বললুম–এবং গোপনে গিয়ে সবটা প্রত্যক্ষও করে এসেছিলেন।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। কারণ আজ সকালেই চন্দ্রকণা ও সতীনাথের হাবভাবে আমার সন্দেহ জেগেছিল। যাকগে, এখন চলো বেচারা সতীনাথকে সান্ত্বনা ও উপদেশ দেওয়া যাক।…

 দুই নারী

সব লেখকই পাঠকপাঠিকাদের চিঠি পান। কোনও লেখা ভাল লাগলে লেখককে তা না জানাতে পারলে স্বস্তি পান না অনেকে। তবে অনেক চিঠিতে কড়া সমালোচনাও থাকে। কেউ কেউ নিখাদ গালিগালাজও খামে পুরে পাঠিয়ে দেন। এ ধরনের চিঠি আমি অনেক পেয়েছি। আবার কোনও কোনও পাঠিকা এমন চিঠি লিখেছেন, যা বটতলার সচিত্র প্রেমপত্র থেকে নিখুঁত কপি করা। এমন কি অপটু হাতে আঁকা ফুল ও ভোমরা ইত্যাদি সমেত।

কিন্তু রাখী মিত্র নামে মফস্বলের এক পাঠিকার চিঠি পেয়ে সত্যি অভিভূত হয়েছিলুম। এই বুদ্ধিমতী পাঠিকা সরাসরি প্রেম নিবেদন করেননি বটে; কিন্তু যা লিখেছিলেন, তাতে আমার কোনও নিজ্ঞান ইচ্ছার ওপর মিষ্টি একটা ছোঁওয়া লেগেছিল এবং তার জবাবও দিয়েছিলুম পুরো চার স্লিপ!

এমনি করে রাখীর সঙ্গে আমার দূর থেকে প্রেম হয়ে যায় এবং পরস্পরকে না পেলে জীবন ব্যর্থ হবে, এই ধারণা গড়ে ওঠে। অথচ তখনও আমরা কেউ কাউকে চোখের দেখাও দেখিনি অর্থাৎ রক্তমাংসের শরীর নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াইনি। অবশ্য দুজনেই নিজের নিজের ফোটো পাঠিয়েছিলুম। বলাই বাহুল্য, একটু আগের ভরাট চেহারার ফোটোই পাঠিয়েছিলুম। রাখীও তাই করেছিল, পরে তা বুঝলুম।

ফোটোর রাখীকে দেখেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তারপর যখন হাওড়া স্টেশনে কথামতো সে এল, তখন ঘুরে যাওয়া মাথার ঘিলু গলে গেল। ফোটোর। কথা ভুলেই গেলুম। এত আশ্চর্য সুন্দর আর সেক্সি চেহারা সচরাচর দেখা যায় না। হাল্কা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিল সে, হাতাকাটা ব্লাউজ ছিল গায়ে, বেণী বাঁধা ঘন কালো চুল ঝুলছিল কোমর অব্দি–এবং তার উদ্ধত বুকের ওপর একটা শঙ্খের মালা ঝুলছিল। আমি মনে মনে পাগল হয়ে গেলুম। বললুম–একটা কবিতা মনে পড়ছে। জীবনানন্দ দাশের শঙ্খমালা নামে এক নারীর কথা আছে তাতে।

কথা ছিল আমরা ওখান থেকেই সোজা বাইরে এক জায়গায় চলে যায়। সেই জায়গাটা পছন্দ করেছিল রাখীই। আমার অমত করার কী আছে? চন্দনপুর অন-সীর মতোন সুন্দর সমুদ্রতীর সারা ভারতে আর একটিও নেই। হিলক শ্রেণীর পাহাড়, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, তার নিচে সমুদ্র–মাত্র একবার গিয়েছিলুম কবছর আগে। খুবই ভাল লেগেছিল।

ট্রেনে আমরা কোনও প্রেমাত্মক কথাবার্তা বললুম– না। খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করলুম। শুধু একবার আস্তে বলেছিলুম-আমাকে দেখে তোমার ইমেজ নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে, রাখী!

রাখীও আস্তে জবাব দিয়েছিল–পাগল! কী যে ভাল লাগছে!

চন্দনপুর অন-সী পৌঁছতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছিল। সময়টা বর্ষার। ভাগ্যিস আমরা পৌঁছানোর সময় বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। ভাল হোটেল কয়েকটা। আছে ওখানে। কিন্তু রাখীর পছন্দ মিসেস জেভিয়ারের হোটেল। লোকে বলে মিসেস জেভিয়ারস্ লজ। প্রাইভেট বাড়ির মতো ব্যবস্থা। সমুদ্রের এক খাড়ির কাছে পাথুরে জমির ওপর বাড়িটা বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ আর্মির লেফটন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড জেভিয়ার–সে ১৯৩০ সালের কথা। মিসেস আর দেশে ফিরে যাননি। একা  এখানেই থেকে গেলেন। বয়স প্রায় সত্তর। কিন্তু শক্ত সমর্থ মহিলা। আমাদের দেখেই সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। কারণ, এখন অফ সিজন। খুব কম লোকই এই বর্ষায় এখানে বেড়াতে আসে। একটা ডাবল বেড ঘর খালি ছিল দোতালার পুবদক্ষিণ কোণে। পুবে সমুদ্র, দক্ষিণে কিছু ছোটো পাহাড় আর বাংলো বাড়ি। বসতি এলাকা গোটা পশ্চিম-উত্তর জুড়ে।

ঘরটা খুবই ভাল লাগল। সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা আছে। রাখীর প্রতি সপ্রশংস তাকিয়ে বললুম– নিশ্চয় তুমি এখানে কখনও এসেছিলে?

রাখী জবাব দিল–মোটেও না। এই প্রথম।

–তবে মিসেস জেভিয়ারের লজে আসতে বললে যে?

আমার বিস্ময় কাটিয়ে দিল রাখী। বলল–আমার এক আত্মীয় এখানে আসেন। তাঁর কাছেই শুনেছিলুম।

ইচ্ছে ছিল, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সব কিছুর আগে ওকে বুকে চেপে ধরব। ওকে দুহাতে তুলে নিয়ে তুমুল চিৎকার করে বলব-রাখী, তুমি আমার! কিন্তু কে জানে কেন, সেসব কিছু করলুম না। খুব শান্ত ও ভদ্র হয়ে গেলুম। সেও যেন বিশেষ উৎসাহ দেখাল না। সোজা বাথরুমে চলে গেল আগে।

মিসেসের লোক এসে সব দেখিয়ে শুনিয়ে চলে গিয়েছিল। একটু পরে উনি নিজে এলেন। বিরক্ত করার জন্য বারবার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–কোনও অসুবিধে হলে যেন তক্ষুনি জানাই। এ বাড়িতে যাঁরাই আসেন, তারাই ওর কাছে পুত্রকন্যাবৎ। নো কোয়েশ্চেন অফ মানি। প্রবাসের আনন্দটুকু, পুরোপুরি সবাই যাতে উপভোগ করতে পারে, সেটা দেখা ওঁর কর্তব্য।

রাখী কিন্তু খুব ভাব জমাবার চেষ্টা করল। যত শীগগির উনি চলে যান, তাই ভাল কারণ, আমি একা হতে চাই রাখীর কাছে। অথচ রাখী এটা ওটা নানা প্রশ্ন করল। অবশেষে আন্টি পাতিয়ে বসল। মিসেস জেভিয়ারও দেখলুম রাখীকে পছন্দ করেছেন। এমন কি, যাবার সময় ওর গালে সস্নেহ চুমুও দিয়ে বসলেন।

চলে গেলে দরজা বন্ধ করে রাখী বলল–কেমন ম্যানেজ করলুম দেখলে? বুড়িটা অবশ্য খুব ভাল মানুষ। দেখবে, একটুও অসুবিধে ঘটতে দেবেন না।

রাখী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মাঝে মাঝে পাশের খোলা জানলায় উঁকি দিয়ে সমুদ্র দেখছিল। দেখা যায় না–সব অন্ধকার। শুধু নিচের দিকে অবিশ্রান্ত গর্জন শোনা যায়। বর্ষার সমুদ্র এমনিতেই উত্তাল থাকে। তাতে এ বাড়ির নিচে খাড়ি আছে। পাথরের ওপর ঠেউ এসে দারুণ গর্জনে ভেঙে যাচ্ছে। মিসেস বলছিলেন–ঝোড়ো হাওয়া বইলে জানলা খোলা যেন না থাকে। লোনা জল এত উঁচুতে ছিটকে এসে ঘর ভিজিয়ে দেবে।

আমি বিছানার দিকে তাকিয়ে একটা কিছু ভাবছিলুম। পাশাপাশি দুট নিচু খাট আছে। ডানলোপিলো গদি আছে। মধ্যে একহাত ব্যবধান ওই ব্যবধান রেখেই কি শুতে হবে?

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মুখের সেই লোভ, অসহায়তা ও কাকুতির দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করল রাখী–প্রতিবিম্বে। সে ঘুরে একটু হেসে বলল–যে মেয়ে সোজা এভাবে চলে আসতে পেরেছে সে তোমার কোনও সমস্যাই সৃষ্টি করবে না। সাহিত্যিক হয়ে এটুকুও তুমি বুঝতে পারছ না গৌতম?

অপ্রস্তুত হয়ে বললুম–কী বলছ! যাঃ!

রাখী তার খোলাচুলের ঝাপি নিয়ে আমার পাশে এসে বসে পড়ল হঠাৎ! তারপর আমার চিবুক ধরে সোজা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল বলো তো, আমাকে তুমি বাজারের মেয়ের মতো ভেবেছ কি না?

আবেগ সংযত করে বললুম–তুমি এসব কেন ভাবছ রাখী? বাজারের মেয়ে আমি জানি না। জানলেও তোমাকে তা ভাবব কেন? আমি তো তোমাকে দেখে তোমার প্রেমে পড়িনি! সে প্রশ্নও ওঠে না।…

রাখী আমার মুখে হাত চাপা দিল। ওর চিরোল সাদা আঙুলগুলো আমার ঠোঁটের খিদে জাগিয় তুলল। কিন্তু এখনই হুট করে কিছু করে বসলে রাখীর মনে আমার সাহিত্যিক ইমেজে আঘাত লাগতে পারে। তাই সংযমী হলুম।

রাখী বলল–চলো না গো, ওই ব্যালকনিতে গিয়ে বসে সমুদ্র দেখি!

এই ডাকে সহজ সম্পর্কের তীব্র মাধুর্য ছিল। তখুনি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম আমরা। তারপর রাখী কেমন চুপ করে গেল। তার মৌন নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না। অথচ আমার চুপচাপ থাকতে ভাল লাগছিল না। এই অসাধারণ সৌন্দর্য পাশে নিয়ে কেউ চুপ থাকতে পারে না।

একটু পরেই আবার বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ছাঁটে পুবের ব্যালকনি ভিজতে থাকল। সেইসঙ্গে সমুদ্রের দিক থেকে জোর একটা বাতাস এল! তখন আমরা উঠে এসে দরজা বন্ধ করলুম। শুধু জানালা খোলা রইল। সমুদ্রের গর্জন বেড়ে গেল। অস্বস্তি জাগছিল যদি সমুদ্রের ঝাপটায় নিচের পাথর ধসে যায়। এই বাড়িটাও তো তখুনি সমুদ্রের তলায় চলে যাবে।

সেই সময় রাখী বলে উঠল–ভীষণ খিদে পেয়েছে। তোমার পায়নি?

নিশ্চয় পেয়েছে। কিন্তু ওদের যে খাবার এখানে আনতে বলা হয়নি।

চলো না, নিচে ডাইনিং হলে গিয়ে খেয়ে আসি।

একটু হেসে বসলুম–চেনাজানা কারো চোখে পড়লে কী বলবে বলোত? তুমিই বা কী বলবে–যদি তোমার চেনা কেউ থাকেন?

রাখী তাচ্ছিল্য করে জবাব দিল–আমি বলব, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে এসেছি। তুমি বলতে পারবে না?

খুব পারব। ওর সাহস আমার সাহস বাড়াল। উঠে দাঁড়ালুম।

রাখী বলল–এক মিনিট। তুমি নিচে গিয়ে বসো। আমি যাচ্ছি। কাপড়টা বদলে নিতে যেটুকু সময় লাগবে!

ওর কথা মেনে নিয়ে সুড়সুড় করে নিচে চলে এলুম। ডাইনিং হলটা মোটামুটি প্রশস্ত। মৃদু আলো জ্বলছে সেখানে। বেশ রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ্য করলুম কোণার দিকে একজন বুড়ো কাপ্তেন গোছের ভদ্রলোক একা বসে রয়েছেন। মাথায় টাক, মুখে সাদা গোঁফ আর দাড়ি, কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ চেহারা। ওঁর কোলে একটা বর্ষাতি রয়েছে। মনে হলো, এইমাত্র বাইরে থেকে এসেছেন। ভদ্রলোকের উদ্দেশে কাউন্টার থেকে মিসেস জেভিয়ার চাপা গলায় কিছু বললেন। উনি অমায়িক হেসে মাথা নেড়ে পাল্টা কিছু বললেন। কথাগুলো শোনা গেল না।

অন্যদিকের কোণে এক দম্পতি বসে রয়েছেন। অবাঙালী মনে হলো। চল্লিশ বেয়াল্লিশ বয়স পুরুষটির, মহিলাটির পঁয়ত্রিশ-সাঁইত্রিশের কম নয়। আলো কম থাকলেও এটা আঁচ করা গেল। আমার ডাইনে দুটো টেবিল পরে বসে আছে একটি মেয়ে। হাল্কা ছিপছিপে গড়ন। ডিমালো মুখ। বেণীবাঁধা চুল। পরনে ফিকে নীল রঙের শাড়ি আর গায়ে সাদা লম্বাহাতা ব্লাউস। স্কুলমিসট্রেসের আদল যেন।

টেবিলে একটা কালো ব্যাগ রয়েছে। আমি নেমে আসার সময় মুখটা একবার। ঘুরিয়েছিল মেয়েটি, কেমন চোখে তাকিয়েছিল যেন। যতক্ষণ আমি এই টেবিলে না এলুম, সে তাকিয়েই ছিল। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিলো, তারপর আর তাকায়নি। কেন যেন মনে হলো, তার দুই চোখে ঘৃণা বা ব্যঙ্গ ছিল।

কিন্তু ও যে বাঙালী মেয়ে, তা চিনতে আমার অসুবিধে হয়নি। শুধু ভাবছিলুম, আজকাল বাঙালী যুবতীরাও একা এতদূর সমুদ্রতীরে বেড়াতে আসার সাহস রাখে! ওকে সাহসী মেয়ে বলেই মনে হলো। চেহারা খুব সুশ্রী বলব না। কিন্তু মুখে ব্যক্তিত্ব কিংবা এমন একটা কিছু আছে–যা ওকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দেখাতে বাধ্য। কিন্তু একটু পরে হঠাৎ মনে হলো ওকে কোথায় যেন দেখেছি।

আমার ডাইনের দিকের একটা টেবিল বাদে বসেছেন একজন রুক্ষ কঠোর চেহারার ভদ্রলোক–একা। গোঁফ আর বড়বড় চুল আছে মাথায়। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। হাতে একটা বালা রয়েছে। খাড়া নাক, চোখদুটো কেমন হিংস্র যেন। এইসব চেহারায় হানাদারের আদল থাকে এবং অকারণে অস্বস্তি জাগায়।

বসে থাকতে থাকতে উনি হঠাৎ উঠে গেলেনে। সিঁড়িতে ওঁর পা দুটো মিলিয়ে গেল। মিসেস জেভিয়ার ওঁকে কী যেন বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, কিন্তু বললেন না। ঘরে প্রায় স্তব্ধতা। শুধু অবাঙালী দম্পতি চাপা গলায় কথা বলছেন। বাইরে চাপা বৃষ্টি ও সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে। ওপরে সম্ভবত কেউ ঘরের জানালায় হুক লাগায়নি–মাঝে মাঝে জানালার কপাটই হয়তো শব্দ করছে। ঘড়ি দেখলুম, আটটা বারো। এখনও ডিনার সার্ভ করছেন না কেন মিসেস জেভিয়ার? কিচেনের কাউন্টারের পাশে তিনজন উর্দিপরা বয় পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ আমার কেমন অস্বস্তি জাগল। ওই বেয়াড়া রুক্ষ চেহারার লোকটা ওপরে গেল। ওপরে রাখী একা আছে।

কিন্তু রাখীই বা এত দেরি করছে কেন? সিঁড়ির দিকে বারবার ঘুরে তার আশা করতে থাকলুম। এসময় মিসেস জেভিয়ার কাউন্টার থেকে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। এসে সস্নেহে চাপা স্বরে বললেন মাফ করবেন। আর আট মিনিট পরে ডিনার সার্ভ করা হবে, মাই ডিয়ার ইয়াং ম্যান। একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে কিচেনে। তাই ইলেকট্রিক চুলোয় সব রান্না হচ্ছে। একটা হিটার জ্বলে গিয়ে এই সামান্য দেরি। খুব কষ্ট হচ্ছে না তো?

শশব্যস্ত বললুম–না, না!

মিসেস জেভিয়ার বললেন–যা অবস্থা হচ্ছে দিনে দিনে বলার নয়। জিনিসপত্র আগুনের দর। মিলছে না সবকিছু। গ্যাস প্রায় মেলে না। ইলেকট্রিসিটি–তাও প্রায় লোডশেডিং হচ্ছে ঘন ঘন। তোমাদের ভাগ্য ভাল যে আজ প্রায় সারাটা দিনই ভাল। গেছে। এখন অব্দিও ভাল যাচ্ছে। পরে কী হয় বলা যায় না। তোমাদের টেবিলের ওপর মোম রাখা আছে। আশা করি লক্ষ্য করেছ?

দেখিনি–তবু মাথা দোলালুম। ভদ্রমহিলার আচরণ মায়ের মতো। সহজে হৃদয় গলে যায়।

আরও কিছু কথা বলে উনি চলে গেলেন। তখন লক্ষ্য করলুম, সেই একলা বাঙালী মেয়েটি নেই। কখন হয়তো ওপরে উঠে গেছে।

কিন্তু আট মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট হলো, তখনও ডিনার এল না, রাখীও না, অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ালুম। মিসেস জেভিয়ার কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করলেন আবার–কিন্তু বললেন না। আমি সিঁড়িতে কয়েক ধাপ সবে উঠেছি, হঠাৎ রাখীর চিৎকার শুনলুম যেন চিৎকারটা হঠাৎ বেখাপ্পাভাবে থেমে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর কার সঙ্গে ধাক্কা লাগল আমার। উঠেই চেঁচিয়ে ডাকলুম রাখী! রাখী!

মাত্র কয়েকটি সেকেণ্ডের মধ্যে এসব ঘটল। আমার সঙ্গে যার ধাক্কা লেগেছিল, সে যেন নীচে নেমে গেল। নীচে মিসেস জেভিয়ারের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনলুম হীরা সিং! মোম জ্বালাও। জলদি মোম জ্বালাও।

ওপরের করিডোরে ঘন অন্ধকার। আবার ডাকলুম রাখী! রাখী! আমার গলা শুকিয়ে গেছে–অজানা ভয়ে প্রচণ্ড কাঁপছি। দেশলাই আছে, তাও ভুলে বসেছি। কেবল বেমক্কা ঘড়ঘড়ে গলায় ডাকছি রাখীকে। নিজেদের ঘরও চিনতে পারছিনে।

সেইসময় করিডরের শেষদিকে দরজা খুলে কে বেরোল। তার হাতে টর্চ জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দেখলুম, আমার ঘরের দরজার সামনে রাখী অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। লাফিয়ে গিয়ে রাখীর মাথাটা তুলে বোকার মতো চেঁচালুম-ডাক্তার! ডাক্তার!

টর্চের আলোটা কাছে এসে গেল। কে বলে উঠল–ও কী! হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি? কী ব্যাপার?

মনে হলো, সেই রুক্ষ চেহারার ফো লোকটিই। রুদ্ধশ্বাসে বললুম–প্লীজ একটু জল আনুন না দাদা! আমাদের রুমেই পেয়ে যাবেন।

ততক্ষণে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ তুলে কারা সব উঠে আসছে। তারপর মোমের আলো হাতে বেয়ারা, মিসেস জেভিয়ার আর কারা এসে পড়লেন। ভিড় জমে গেল। রাখীকে আমি আর কে যেন ধরল। তুলে নিয়ে ঘরে ঢোকালুম। ঘরে ঢুকে দেখি, সেই ফো ভদ্রলোক দেশলাই জ্বেলে টেবিলের মোমটা ধরাচ্ছেন।

ঘরে স্বভাবত ভিড় হলো। রাখীর মুখে জল ছিটিয়ে দিতেই সে জ্ঞান ফিরে পেল। চোখ খুলে শশব্যস্তে উঠে বসতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু মিসেস জেভিয়ার… বাধা দিলেন–চুপ করে শুয়ে থাকো ডার্লিং। প্লীজ। অন্তত মিনিট দশেক। তারপর কোনও কথা।

এবার দেখলুম, টেকো মাথা দাড়িওলা বুড়ো ভদ্রলোকটিও আমাদের রুমে এসেছেন। ভুরু কুঁচকে রাখীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মিসেস জেভিয়ার ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন–চলুন কর্নেল, আমরা একে সুস্থ হতে সময় দিই। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন–থাক বাছা, তোমাদের আর কষ্ট করে নীচে যেতে হবে না। এখানেই ডিনার খাবে। আর, দেখো–একে বেশি নাড়াচাড়া করতে দিও না। মনে হচ্ছে, হঠাৎ লোডশেডিং হওয়ায় ভয় পেয়েছিল। এ খুবই স্বাভাবিক। কর্নেল, আপনার মনে পড়ছে, সেবার এক ভদ্রমহিলা তো প্রতিরাত্রে সমুদ্রে ভূত দেখে চেঁচামেচি করতেন!

বুড়ো লোকটি তাহলে কোনও কর্নেল–তবে পোশাক ও বয়স দেখে মনে হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। উনি চাপা হাসলেন। হাসিটা খুবই ভদ্র আর অমায়িক। মুহূর্তে ভালো লেগে গেল আমার।

মিসেস জেভিয়ার ফের হেসে বললেন–ও নো নো! অফ কোর্স এটা কোনও ভূতের বাড়ি নয়। সবাই তা জানে। তোমরা মিছিমিছি ভয় পেয়ো না–আসলে অনেকের নার্ভের অসুখ থাকে-হ্যালুসিনেশা দেখে তারা।

উনি বেরোলেন প্রথমে। তারপর গুফো লোকটি গেল। তার পেছনে অবাঙালী দম্পতি। বেয়ারা পিছনে মোমের আলো হাতে এগোল।

কর্নেল ভদ্রলোক তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললুম–বসুন স্যার!

কর্নেল হাত তুলে মিঠে গলায় বললেন–ধন্যবাদ ইয়ংম্যান। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। থাকি কলকাতায়। আর ইয়ে…

চমকে উঠে বললুম–কী কাণ্ড! আপনি কি সেই প্রখ্যাত কর্নেল সরকার প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার? এই তো সেদিন খবরের কাগজে আপনার আরেক কীর্তির কথা পড়লুম! কী সর্বনাশ! রাখী, আমাদের কী সৌভাগ্য। পরিচয় করিয়ে দিই।

রাখী ক্লান্তভাবে চোখ বুজল! তখন নিজের পরিচয় দিলুম–আমি গৌতম চৌধুরী। সামান্য সাহিত্যচর্চা করে থাকি।

কর্নেল ব্যস্ত হয়ে বললেন-সামান্য কী অসামান্য আমি জানি। গৌতম চৌধুরী! মাই গুডনেস! আপনি তো আমার প্রিয় লেখক গৌতমবাবু। আপনার লেখায় প্রকৃতি থাকে অনেকটা জায়গা নিয়ে। আর আমি সত্যি বলতে কী– একজন প্রকৃতি-প্রেমিক। এই দেখুন না, এখনও গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। দিনমান টোটো করে ঘুরি। বিরলজাতের পাখি প্রজাপতি পোকামাকড় আর অর্কিড দেখার বাতিক আছে প্রচণ্ড। আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব প্রীত হলুম।

রাখী চোখ খুলছে না দেখে অস্বস্তি জাগল। আস্তে বললুম– রাখী তোমার কি কষ্ট হচ্ছে এখনও?

চোখ বুজে ও জবাব দিল-হ্যাঁ।

তখন কর্নেল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন–এখন তাহলে আসি গৌতমবাবু। পরে আলাপ করা যাবে। ওঁকে একটু সাবধানে রাখবেন। আর নার্ভ ঠাণ্ডা রাখার জন্যে আমার কাছে একরকম ট্যাবলেট আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি। দুটো খাইয়ে দেবেন নির্ভয়ে। দেখবেন, সকালে ফ্রেশ হয়ে উঠেছেন আবার!

কর্নেল চলে গেলেন। এমন একজন প্রখ্যাত ধুরন্ধর গোয়েন্দার সঙ্গে আলাপ : হওয়া এখন আমার পক্ষে যতটা খুশির–ততটা অস্বস্তিরও। কারণ, রাখীর ব্যাপারে আমি নার্ভাস বোধ করছিলুম। নিশ্চয় ওই ঘুঘু ভদ্রলোক আঁচ করে নিয়েছেন ইতিমধ্যে যে এই মেয়েটিকে নিয়ে আমি বেড়াতে অর্থাৎ ফুর্তি করতেই এসেছি। আবার মনে হলো, ভদ্রলোক নিশ্চয় আধুনিক মনের মানুষ। যুগোপযোগী উদারতা। কি ওঁর থাকতে নেই? আজকাল বান্ধবী নিয়ে ছেলেদের বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে তেমন খারাপ কী থাকতে পারে?

দরজায় কেউ নক করল। অমনি রাখী চোখ খুলে উঠে বসল। ব্যস্তভাবে বললনা, না। দরজা খুলল না। আমার ভয় করছে!

বাইরে থেকে সাড় এল–খানা সাব!

তখন দরজা খুলে দিলুম। বেয়ারা ট্রেতে রাতের খাবার রেখে গেল। কোণের টুলে জলের কুঁজো আর গ্লাস দেখিয়ে দিয়েও গেল।

এবার রাখীকে প্রশ্ন করলুমকী হয়েছিল বলো তো? হঠাৎ কী দেখে ভয় পেয়েছিলে?

রাখী আমার কাছ ঘেঁষে এসে চাপা গলায় বলল–তুমি যাবার পর শাড়ি বদলে নিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, হঠাৎ দরজায় কে নক করল! বললুম– কে? সাড়া নেই। একটু ভয় পেলুম! কিন্তু ভাবলুম হয়তো তুমিই দুষ্টুমি করছ। দ্বিতীয়বার নক করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললুম। কিন্তু করিডোর ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। অমনি ভীষণ ভয় হলো। কিছুতেই একা ওই পথটুকু পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে যাবার সাহস হলো না। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ভাবলুম–চুপচাপ বসে থাকি। দেরি দেখলে তুমি নিশ্চয় আসবে। তখন দুজনে একসঙ্গে বেরোব। কিছুক্ষণ পরে আবার দরজায় কে নক করল। এবার ভাবলুম, নিশ্চয় তুমি আমার দেরি দেখে চলে এসেছ। তবু জিজ্ঞেস করলুম-কে? যে নক করছিল, সে বলল–আমি!

কী আশ্চর্য!

হ্যাঁ! শুধু আমি বলল। মনে হলো তোমার গলা। তখন গিয়ে দরজা খুলে দিলুম। কিন্তু দরজা খুলেই আমি আবার অবাক। কেউ কোথাও নেই। আর সঙ্গে সঙ্গে আলো নিভে গেল। তখন….

রাখী প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে। ফের বলল–তখন, বিশ্বাস করো–মনে হলো, কী একটা ঠাণ্ডা শরীর তামাকে চেপে ধরেছে হঠাৎ। অমনি চেঁচিয়ে উঠলুম। তারপর কী হলো কিছু মনে নেই!

ওর কথার মধ্যে সরলতা এত বেশি যে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ভয়ে। আড়ষ্ট হলুম। তাহলে কি সত্যি ভূতপ্রেত বলতে কিছু আছে? পরক্ষণে মনে। হলো-রাখীর মনের ভুলও হতে পারে।

হাসতে হাসতে বললুম–তুমি বড্ড অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে তো! তাই বৃষ্টির রাতে সমুদ্র তীরের বাড়িতে এটা ঘটেছে। আসলে বাতাস বইছে জোরে। তাই দরজায় শব্দ হয়েছে। আর বৃষ্টির বাতাস তো বেশ ঠাণ্ডাই। আচমকা একটা ঝাপটানি এসে গায়ে লাগতেই ভেবেছ, কেউ চেপে ধরল।

রাখী বলল–তা নয়। আমি স্পষ্ট নক করতে শুনেছি। আর ওই আমি বলাটা? নিশ্চয় কেউ বদমাইশির তালে ছিল। সাহস পায়নি। পাশের ঘরে ঢুকে পড়েছিল।

তাও আশ্বস্ত হওয়া গেল, রাখীর ভয়টা ভূতের নয় তাহলে কোনও লম্পট বদমাইশের। বললুম–আমার সামনে শাড়ি বদলালে এসব হতো না!

রাখীর মুখ লজ্জায় রাঙা হলো–যাঃ! আমি তা পারি না।

ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এবার চুমু খেলুম। ও ছাড়িয়ে নিয়ে বলল–এস, খাওয়াটা সেরে নিই আগে….

.

সে রাতে যখন শুতে যাচ্ছি, তখন ঘড়িতে নটা তিরিশ। এত সকালে ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই দাখীর সঙ্গে প্রেমিকসুলভ কথা বলছি আর সিগারেটের পর সিগারেট খাচ্ছি। এই সময় মনে হলো, বাইরে কারা সব ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছে! তখন বৃষ্টি অনেকটা কমেছে, কিন্তু লোডশেডিং চলছে। আমাদের টেবিলে মোমের আলো জ্বলছে। বাইরের চাপা শব্দে কৌতূহলী হলুম। উঠে দরজা খুলতে যাচ্ছি, রাখী বাধা দিয়ে বলল–যে যা করছে করুক। দরজা খুলল না।

সরে এসে আবার বসলুম। কিন্তু নাবাইরের চলাফেরা ও কথা বলার চাপা আওয়াজ থামল না। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে।

কয়েকমিনিট পরে রাখীর নিষেধ না মেমে দরজা খুললুম। উঁকি মারতেই দেখি, করিডরে মিসেস জেভিয়ার শশব্যস্তে ওদিকে কোথায় চলেছেন। তার সঙ্গে আলো হাতে দুজন বেয়ারা দৌড়ে চলেছে। তারপর সিঁড়ির মুখ থেকে কর্নেলের ভারি গলার আওয়াজ পেলুম–আপনি তাহলে ওকে করিডোরে দেখেছিলেন মিঃ সেন?

ঠাহর করে দেখি সেই গুফো লোকটি টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেলের সামনে। কী ব্যাপার? দরজা খুলে বেরিয়ে গেলুম ওঁদের দিকে।

আমাকে দেখে কর্নেল বললেন-এই যে গৌতমবাবু। আসুন, আসুন। আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি। ইয়ে–একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।

চমকে উঠলাম। অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল মাথার চুল। ব্যস্তভাবে বললুম– কী হয়েছে কর্নেল?

কর্নেল গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন মিস রমা রায় নামে একটি মেয়ে আজ সন্ধ্যায় এই লজে আসে। রাত আটটা দশ অব্দি মেয়েটিকে ডাইনিং হলে দেখেছি আমরা। তার রুম নাম্বার আঠারো। কিন্তু আশ্চর্য, তার পাত্তা নেই। আর…

বাধা দিয়ে বললুম–হা, হ্যাঁ। আমার ডাইনের দুটো টেবিলের ওদিকে একা বসেছিল–সেই তো! রোগা ছিপছিপে চেহারা ফিকে নীল শাড়ি?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। সেই। তবে তার চেয়ে সাংঘাতিক ঘটনা হচ্ছে তিন তলায় মিসেস জেভিয়ারের ঘর থেকে একটা দামী জিনিস হারিয়েছে। যার দাম অন্তত লাখ তিনেক হবে।

–সে কী! সর্বনাশ!

-হ্যাঁ, একটা জুয়েল নেকসেল। ওপরের ঘরে মিসেস জেভিয়ার আজকাল থাকেন না। ওঁর জিনিসপত্র থাকে। উনি ভেবেছিলেন, যেহেতু অত দামী জিনিস, তাই ওঘরে আর সব অকেজো জিনিসের মধ্যে এটা রাখলে চোরডাকাতের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হবে না। সচরাচর দামী জিনিস লোকে নিজের শোবার ঘরেই রাখে। অথচ, কী আশ্চর্য ব্যাপার–চোর কীভাবে তা টের পেয়েছিল এবং সুযোগমতো হাতিয়েছে!

গুঁফো লোকটি বলল–এবং হাতিয়ে কেটেও পড়েছে।

আমি বললুম–এর সঙ্গে মিস রমা রায়ের বেপাত্তা হওয়াটা খুব অদ্ভুত লাগছে কিন্তু!

কর্নেল বললেন–ঠিকই বলেছেন গৌতমবাবু। হঠাৎ সে বেপাত্তা হলো কেন? যাক গে–এসব পুলিসের ব্যাপার। পুলিশ এসে যা হয় করুক।

বললুম–মিসেস জেভিয়ার হঠাৎ কীভাবে টের পেলেন যে ওঁর নেকলেস খোয়া গেছে?

–ভদ্রমহিলা যেমন কর্মঠ, তেমনি অভিজ্ঞ। বুদ্ধি ওঁর প্রখর। ডিনার টেবিলে রমা নেই–অথচ আপনার ঘরের দরজায় ওই কাণ্ড হলো, তবু ওকে দেখা যায়নি। তাছাড়া বোর্ডারদের সম্পর্কে খোঁজখবর তো মিসেস জেভিয়ারকে রাখতেই হয়। বেয়ারা দিয়ে খাবার পাঠালেন ঘরে। বেয়ারা ফিরে এসে জানাল–দরজা খোলা কিন্তু ঘরে কেউ নেই। এমনকি কোনও জিনিসপত্রও নেই ওর। অমনি স্বভাবত মিসেস জেভিয়ারের মনে সন্দেহ হলো। তারপর…

-কিন্তু আশ্চর্য! রমা পালাল কোন পথে?

–সেটাই বুঝতে পারছি না। যেতে হলে এই সিঁড়ি দিয়েই ওঁকে যেতে হবে।

গুঁফো লোকটি বলল–তখন আমরা সবাই এই ভদ্রলোকের স্ত্রীকে নিয়ে ব্যস্ত। এঁর ঘরে ঢুকে গেছি। তখন সে কেটে পড়েছে।

কর্নেল বললেন–এও একটা পয়েন্ট বটে। কিন্তু নীচে নামলে বেয়ারা আর দারোয়ানের চোখে না পড়েই পারে না। তারা বলছে, কেউ বেরিয়ে যায়নি।

দারোয়ানদের কথা ছাড়ুন স্যার! ব্যাটারা গাঁজাখোর। তখন তো লোডশেডিং –অন্ধকার। ওরা কি টের পাবে নাকি? তার ওপর বৃষ্টি। ঘরে ঢুকে বসেছিল সব।

হাতে টর্চ ছিল। হেরিকেনও জ্বেলে নিয়েছিল লোডশেডিং শুরু হতেই। অবশ্য, তাতেও রমার পালাবার সন্স থাকে। রাউট রাইট মিঃ সেন। আপনার যুক্তি অগ্রাহ্য করা কঠিন। কিন্তু..

–কোনও কিন্তুর ব্যাপার নেই। পুলিসে খবর গেছে। দেখবেন, স্টেশনেই ধরা পড়ে যাবে!

আরও একটা আলোচনার পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এলুম। রাখী আমার প্রতীক্ষায় উত্তেজিত মুখে বসেছিল। বলল–কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

সব বললুম–! শুনে রাখী আরও ভয় পেয়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে বলল–আমার ইনটুইশান বলছিল কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটছে। ওগো, তুমি খাটটা সরিয়ে নিয়ে এস। আমরা পাশাপাশি শোব…

.

বেড-টি দিয়ে গেল ভোর সাড়ে ছটায়। রাখী তখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে জাগালুম না। কর্নেল দুট ট্যাবলেট দিয়েছিলেন খেতে। তাই অত ঘুম। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুম।আমার চোখ জ্বালা করছিল। একটুও ঘুম হয়নি। রাখী জেগে থাকলে নিশ্চয়ই ওর শরীরের সঙ্গে কিছু একটা শারীরিক ব্যাপার ঘটে যেত কিন্তু বিবেক আর শালীনতা অথবা চিরকালের ভীরুতা আমাকে সংযত রেখেছিল। রাখীকে মনে হচ্ছিল, ঝড়ে ক্লান্ত এক ছোট্ট সুন্দর পাখি। সে আকাতরে ঘুমোচ্ছে যখন–ঘুমোক। ওকে বিরক্ত করব না। বিরক্ত করিনি। বরং সাবধানে দূরত্ব নিয়ে শুয়েছিলুম–যাতে আমার মনের অন্ধ কামনা বাসনা ওই অবস্থাতেই হঠকারী কোনও ঘটনা না। ঘটিয়ে ফেলে।

আকাশ আজ পরিষ্কার। সূর্যোদয় দেখলুম। রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়াতেই নিচে বাঁদিকে চোখ পড়ল। চমকে উঠলুম। দেখি, খাকি উর্দি পরা পুলিসদল, আর কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন একটা পাথরের ওপর। পিছনে আরও একটা ভিড় রয়েছে। এবং কজন জেলে ধরনের আধন্যাংটা লোক জাল দিয়ে নীচে থেকে কী যেন টেনে ওপরে তোলার চেষ্টা করছে।

তক্ষুনি ভেতরে এসে দরজা আস্তে খুলে বেরিয়ে গেলুম।

ডাইনিং হলে দুজন কনস্টেবল বসে রয়েছে। মিসেস জেভিয়ারকে দেখতে পেলুম না।

বাইরে রাস্তায় গিয়ে একজনকে পেলুম। তাকে জিগ্যেস করলুম–ওদিকে পুলিশ কেন অত?

লোকটা নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল–যাকে দেখিয়ে না। কুছ অ্যাকসিডেন হুয়া জুরুর। যাইয়ে–দেখিয়ে! কই বড়া মছলি পাকড়া, মালুম।

বাড়ির উত্তর ঘুরে পাথুরে সরু পথ ধরে কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল, জালটা টেনে ওপরে ভোলা হয়েছে। ভিড় ঘিরে ধরেছে।

কাছে গিয়ে আমার চোখ দুট নিষ্পলক হয়ে উঠল। জালে যা তুলেছে, তা একটি বডি। এবং ডেডবডিলাশ!!

সেই লাশটার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠলুম–কে ও?

কর্নেল চাপাস্বরে বললেন রমা রায়। দ্য পুওর গার্ল!

রমা! সেই মেয়েটি! কীভাবে সমুদ্রে পড়ল?

কর্নেল জবাব দিলেন–ওর ঘরের ব্যালকনি থেকে।

–অ্যাকসিডেন্ট?

–কে জানে! কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিতেও পারে।

আঁতকে উঠলুম। ফিকে নীল শাড়িটা জড়িয়ে আছে গায়ে-রমার মুখে আতঙ্কের চিহ্ন নোনা জলেও মুছে যায়নি। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে পালিয়ে এলুম।…

সিঁড়িতে ওঠার সময় অন্যমনস্ক হয়ে ছিলুম। শেষ ধাপে উঠলে আমাদের ঘরটা ডাইনে সামনে পড়ে এবং কোনও বাধা না থাকায় দরজাটা স্পষ্ট দেখা যায়। আমার অন্যমনস্কতা কেটে গেল। সেই গ্রুফো ভদ্রলোক যেন এইমাত্র আমাদের দরজা থেকে সরে আসছে, এমন কি পর্দাটাও স্পষ্ট নড়ে ওঠা দেখেছি। প্রথম মুহূর্তের চমক কাটলে ব্যাপারটা চোরে ভুল বলে সন্দেহ করলুম।

এই লোকটাকে কর্নেল সাহেব মিঃ সেন বলে সম্বোধন করছিলেন। আমার সামনে এসে সে একটু হাসল। হাসিটা অপ্রস্তুত ও হতচকিত মানুষের যেন।–এই যে মিঃ চৌধুরী। দেখে এলেন নাকি?

গম্ভীর হয়ে পড়েছিলুম নিজের অজান্তে। বললুম–হ্যাঁ।

সে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করল যেন। বলল–কিন্তু কী মারাত্মক ঘটনা বলুন তো! আমি তো গত পাঁচ-ছ বছর ধরে জেভিয়াস লজে আছি। এমন বীভৎস কাণ্ড কখনও ঘটতে দেখিনি! আচ্ছা, আপনারা সাহিত্যিকরা তো খুব পাওয়ার অব অবজার্ভেশনের অধিকারী। দেখে কী মনে হলো বলুন তো?

উত্তেজনা দমন করে বললুম–কী মনে হবে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

সেন চাপা গলায় বলল, বোঝার সমস্যা নিশ্চয়। প্রথম ধরুন, এটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলেও মনে হতে পারে। রমার ব্যালকনির নিচেই খাড়ি এবং গভীর জল। আনমনে রেলিং-এ পা ঝুলিয়ে বসলে পড়ে যাবার চান্স আছে! সম্প্রতি বোম্বেতে ফিল্ম প্রডিউসার ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে এভাবেই তো এক অভিনেত্রী শাবানা সমুদ্রে পড়ে গেছেন। খবরের কাগজে দেখেননি?

–দেখেছি। কিন্তু রমা হঠাৎ ডাইনিং থেকে উঠে এসে ওভাবে বসতে যাবে কেন রেলিং-এ?…অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই প্রশ্নটা তুললুম। কারণ, আমি ঘটনাটায় গুরুত্ব চাপিয়ে ওকে আঁচ করাতে চাইছিলুম যে যত সহজে ভাবছ উড়িয়ে দেওয়া যাবে, তত সহজ এটা নয়। অবশ্য ওকেই আমি অপরাধী ভেবেছি, তাও নিঃসংশয় নই। শুধু কেমন-কেমন লাগছে মাত্র।

আমার প্রশ্ন শুনে গুঁফো সেন সায় দিয়ে বলল–ঠিক, ঠিক। ওটাই ভাইটাল কথা! তবে এমনও হতে পারে, খাবার দেরি দেখে বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিল রমা এবং রেলিং-এ বসেছিল!

সবই সম্ভব! তবে খুব জোরাল যুক্তি এতে নেই!

–তা তো নেই-ই। কিন্তু ওকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে কেন?

আমরা তো পিছনের ঘটনা কিছু জানি না। ওর শত্রু থাকতে পারে।

নিশ্চয় পারে। কিন্তু যার শত্রু আছে, সে দরজা খোলা রেখে একা এইভাবে অন্ধকারে ব্যালকনিতে গিয়ে শত্রুকে সুযোগ দিল?

লোকটি যে ধুরন্ধর, তাতে সন্দেহ রইল না! ওর প্রশ্নে যুক্তি আছে। বললুম– হ্যাঁ, সেও একটা পয়েন্ট। দ্বিতীয়ত মিসেস্ জেভিয়ারের হার চুরির ঘটনা।….

কথা কেড়ে সেন বলল–হ্যাঁ, হার চুরি। দুটো প্রায় একই সময়ে ঘটেছে। আপনি কি মনে করেন দুটোর মধ্যে কোনও লিঙ্ক আছে?

থাকতে পারে। হয়তো রমা চোরকে মুখোমুখি দেখেছিল এবং তার ফলে তাকে মরতে হয়েছে।

সেন সোসাহে বলল–চমৎকার যুক্তি! জানেন, ওই কর্নেল ভদ্রলোকও তাই মনে করেন। পুলিসও তাই ধরে নিয়েছে। হাজার হলেও আপনারা সাহিত্যিকরা অর্ডিনারি ব্রেন তো নন!

সে সপ্রশংস তাকাল আমার দিকে। কিন্তু ওর চাউনিটা পছন্দ করছিলুম না। গায়ে পড়ে এমন ভাব করতে চায় কেন সে? তাছাড়া আমাদের ঘরের দরজায় ওকে দেখলুম, যদি চোখের ভুল না হয় তার কারণটাই বা কী? সেই সময় চকিতে মনে পড়ল, গতরাতে রাখীর মুছা যাবার সময় সে আমাদের ঘরে ঢুকেছিল–মোম জ্বেলে দিয়েছিল। তখন আবছা ভাবে মনে হয়েছিল, নোকটা যেন আমাদের ঘরের প্রতি কোনও অজানা কারণে আগ্রহী। কেন এই ধারণা মাথায় এসেছিল তখন? এটা ইনটুইশানের মতো।

সেন আরও দু-একটা কথা বলে চলে গেল। আমি ঘরের দরজা ঠেললুম। যেমন ভেজিয়ে রেখে বেরিয়েছিলুম, তেমনি রয়েছে। কিন্তু খাটে রাখী নেই। বাথরুমে জলের সব্দে তার সাড়া পেলুম। কী বোকা মেয়ে! দরজাটা বন্ধ আছে কী নেই দেখেনি! এবার আমাদেরই কিছু চুরি গেল না তো? প্রেমিকারা এমনি সরল গোবেচারা হয়!

প্রথমে চোখ পড়ল রাখীর ভ্যানিটি ব্যাগটার দিকে। সেটা গতরাত থেকে ওর বালিশের পাশে রয়েছে। সেই মুহূর্তে চমকে উঠলুম। ব্যাগের মুখটা খোলা একটা ভাঁজকরা কাগজ উঁকি মেরে রয়েছে। ব্যস্ত হয়ে ব্যাগটা ফাঁক করলুম। সর্বনাশ! নির্ঘাৎ কিছু, চুরি গেছে। রাখী শোবার সময় হাতের সোনার কাকন দুটো খুলে ওতে ঢুকিয়ে রেখেছিল মনে পড়ছে।

কাগজটা কিন্তু আমারই লেখা চিঠি। রাখী সঙ্গে এনেছে তাহলে! ওর কাকন খুঁজতে–যদিও ওর ব্যাগে হাত ভরা উচিত নয়–এই অনধিকার চর্চা করতে হলো, কারণ আমিই তো এখন ওর গার্জেন।

টুকিটাকি কাগজপত্র, প্রসাধনী, রুমাল কিন্তু কাকন জোড়া কই? রুমালটা তুলতেই বুকে জোর এল। এই যে রয়েছে।

কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার চোখ ঝলসে গেল। মাথা ঘুরে উঠল। কয়েকটা সেকেণ্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। রুমালের তলা থেকে একটা নেকলেস যন্ত্রের মতো টেনে তুললুম। হা-হীরেরই নেকলেস।তা না হলে এত উজ্জ্বল সাদা হতে পারে না। সাদাসিদে নেকলেস নয় রীতিমতো জড়োয়া হার!

কোথায় পেল এ হার রাখী? এটাই সেই চুরি যাওয়া নেকলেস ম্যাডাম জেভিয়ারের? থরথর করে কাঁপতে থাকলুম। রাখীই কি….কিন্তু না–তা তো অসম্ভব। রাখীর মতো একজন সাদাসিধে নিরীহ মেয়ে সুশিক্ষিতা, সংস্কৃতিমতী, মার্জিত রুচির মেয়ে–যে শুধু ভালবাসা ছাড়া, সৌন্দর্য ও শিল্প ছাড়া জীবনে কিছু শ্রেয় ও প্রেয় মনে করে না–সে হার চুরি করবে কেন? গতকাল থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত এই তেইশটি ঘন্টায় ওর যা পরিচয় পেয়েছি, তাতে ওকে কিছুতেই ক্রিমিনাল চরিত্রের মেয়ে বলে ভাবা যায় না। তাহলে যা চোখের ভুল ভেবেছি, তাই ঠিক। ওই সেন ব্যাটাই খুনে ডাকাত। সে রাখীর ব্যাগে হারটা পাচার করে গেল এইমাত্র। হয়তো হজম করতে পারল না–তাই।

হারটা হাতে নিয়ে অবশ হয়ে বসে আছি, এমন সময় রাখী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল হাসিমুখে ক্ষণে সে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল–ও কী? ওটা কী?

আড়ষ্টস্বরে বললুম–হীরের নেকলেস।

রাখী আমার পাশে লাফিয়ে এসে বসল। রুদ্ধশ্বাসে ভয়ার্ত গলায় বলল হীরের নেকলেস! এ কোথায় পেলে তুমি? কার নেকলেস?

–সম্ভবত মিসেস জেভিয়ারের সেই চুরি যাওয়া নেকলেস। তোমার ব্যাগের মুখ ভোলা দেখে সন্দেহ হয়েছিল, তারপর দেখি ওতে ভরা আছে।

রাখী কেঁদে ফেলল তখুনি। সে কী! কে রাখল ওখানে? হা গো, আমার গায়ে হাত দিয়ে তুমি বলোতুমি বলো আমার গা ছুঁয়ে–তুমি…

অবাক হয়ে বললুম–রাখী! কী বলতে চাও তুমি? আমি হার চুরি করেছি?

রাখী আমার বুকে ভেঙে পড়ল! না, না, না। তুমি সাহিত্যিক, তুমি শিল্পী তুমি কেন তা করবে? ছি ছি ছি! আমার মনে এখনও পাপ আছে গো? আমায় ক্ষমা করো, ক্ষমা করো তুমি। বলল, ক্ষমা করেছ? বলো!

তার মাথাটা এবার আমার পায়ে পড়ার উপক্রম হলো। ব্যস্ত হয়ে ওকে দুহাতে চেপে ধরে সামলে নিলুম। বললুম–না, রাখী। তোমার স্বাভাবিক সংশয় তুমি প্রকাশ করেছ মাত্র। কিন্তু আমি ভাবছি, অন্য একটা কথা। দরজাটা ভেতর থেকে লক না করে তুমি বোকার মতো বাথরুমে ঢুকেছিলে, আর চোর সেই সুযোগে ঘরে ঢুকে এটা পাচার করে গেছে।

রাখী চমকে উঠে বলল–সে কী! দরজা ভেজানো ছিল?

-হ্যাঁ।

রাখী ভুরু কুঁচকে কিছু ভেবে বলল–আমারই ভুল। ট্যাবলেট দুটোর ঘোর এখনও চোখ থেকে যায়নি। টলতে টলতে সোজা বাথরুমে ঢুকেছি। ভেবেছিলুম তুমি হয়তো ব্যালকনিতে বসে আছ।

কিন্তু যা হবার হয়েছে। এখন এটা নিয়ে কী করা যায়, দেখি। বরং কর্নেলের সঙ্গে পরামর্শ করে… ।

বাধা দিল রাখী!–উঁহু। ঠাণ্ডা মাথায় এটা ভাবা দরকার। আমার মনে হচ্ছে, এখন কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। পুলিস জানলেই আমাদের জড়াবে। তার ফলে একটা ভীষণ ক্ষতি হবে অন্তত আমার। কারণ, আমি মেয়ে–এবং একটা স্কুলের শিক্ষিকা। আমার চাকরি যাবে। কেলেঙ্কারি রটবে–এমনি করে, তোমার সঙ্গে বাইরে এসেছি বলে!  রাখী বুদ্ধিমতী। ঠিকই তো। আমরা দুজনে গোপনে বেড়াতে এসেছি স্বামী স্ত্রী সেজে। রটলে রাখীর শুধু নয়, আমারও কি কম বদনাম হবে? তার ওপর সবচেয়ে সর্বনাশ হবে আমার বাড়িতে। সত্যিকার স্ত্রী ভদ্রমহিলা হিস্টেরিক মেয়ে। নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করে বসবে। এ ব্যাপার ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেও কতটুকু কাজ হবে? কারণ, সাহিত্যিক হিসাবে আমার খ্যাতি আছে। খ্যাতিমান লোকেদের কোন কিছু চাপা থাকে না। এক সময় ফঁস হয়ে যায়। খবরের কাগজের রিপোর্টাররা এ নিয়ে যা শুরু করবে, তা ভাবতেই আমার গা হিম হয়ে গেল।

বললুম–হা, ঠিকই বলেছ রাখী। আমরা এখন অজ্ঞাতবাসে এসেছি। কর্নেলকে জানানো মানেই পুলিসকে জানানো। ব্যাপারটা সহজে হয়তো মেটার বা চেপে দেওয়ার একটা চান্স ছিল কিন্তু তা আর নেই। কারণ সেই বেপাত্তা রমা রায়ের লাশ পুলিস খুঁজে পেয়েছে!

অমনি রাখীর মুখটা আবার আতঙ্কে ছাই হয়ে গেল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল–সে কী! সেই মেয়েটি খুন হয়েছে?

–হ্যাঁ। ব্যালকনিতে গেলেই দেখতে পাবে। ওর ঘরের নীচের খাড়ি থেকে লাশটা তোলা হয়েছে।

রাখী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলতে পারল না।

বললুম–কাজেই এই হারটা খুব সহজ হার নয়। খুনের সঙ্গে তার বাস্তব যোগাযোগ থাক বা নাই থাক, এখন আপাতত দুটো একসুত্রে জড়িয়ে গেছে। তুমি ঠিকই বলেছ, হারটা আমরা দিতে গেলেই জড়িয়ে যাব!

রাখী অস্ফুটস্বরে বলল–এ কী বিপদে পড়লুম আমরা।

ওকে আশ্বস্ত করার ক্ষমতা নেই। তবু বললুম–আমাদের ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। তাহলে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে। তুমিও ভাব, কী করলে ভাল হয়।

একটু পরে রাখী বলে উঠল–এক কাজ করা যেতে পারে। হারটা যে কোনও ভাবে পাচার করা। বরং ওটা ব্যালকনি থেকে এক্ষুণি সমুদ্রের জলে ফেলে দাও।

-এখন চারদিকে পুলিসের চোখ, রাখী!

রাখী ঠোঁট কামড়ে একটু ভেবে বলল–তাহলে…তাহলে ওটা এবাড়ির মধ্যে কোথাও ফেলে রেখে এস।

–তা সম্ভব। কিন্তু কয়েক লাখ টাকা দামের জিনিস এটা। যদি অন্য কেউ হজম করে দেয়? আমাদের বিবেক তত আছে, রাখী! মিসেস জেভিয়ারের এই সম্পদ তো শুধু টাকার জিনিষ নয়!

–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ! আহা বেচারা!

–একটা কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু সেটায় রিস্ক আছে।

কী, কী?

–হারটা ম্যাডামের হাতের নাগালে রেখে দেওয়া।

–কোথায় রাখবে?

–ভাবছি।

-শোনো, এক কাজ করা কিন্তু অনেকটা সহজ। ওপরে ওঁর যে ঘর থেকে এটা চুরি গিয়েছিল, সেখানেই রেখে আসা।

–কিন্তু সেখানে তো তালা আটকানো।

কপাট বা অন্য কোথাও ফোকর থাকা সম্ভব। গলিয়ে দিলেই তো ঝামেলা চুকে গেল। তাই না? ম্যাডাম ভাববেন, চোর ভয়ে ফেরত দিয়েছে। হজম করতে পারেনি।

ঘামতে ঘামতে বললুম–তাহলে তা এখনই করতে হয়। তুমি সিঁড়ির মুখে দাঁড়াও। ম্যাডাম এখন নীচে আছেন! আমি কোনও কায়দায় তিনতলায় ঝটপট গিয়ে এটা পাচার করে আসি।

রাখী হঠাৎ একটু হাসল–হাসিটা অবশ্য খুবই করুণ। বলল–হ্যায় সাহিত্যিক। তোমার প্রেমের মূল্য হয়তো এভাবে শোধ দিতে হচ্ছে!

ওর একথায় আপ্লুত হলুম। উঠে দাঁড়ালুম। আমার পা থরথর করে অবশ্য কাঁপছে। মাথা টলমল করছে।

পা বাড়াতেই রাখী উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে একটা দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠল। ফিসফিস করে বলে উঠল সেনা, না! তোমাকে অমন ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। আমি তা প্রাণ থাকতে হতে দিতে পারব না। তুমি দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তোমার মর্যাদার দাম কে দিতে পারে! ওগো, তুমি যেওনা। জীবনে তোমার এখনও কত কী দেবার আছে মানুষকে? তার চেয়ে আমি তো সামান্য অজ্ঞাতকুলশীল মেয়ে–আমার কিছু ঘটলেও কিছু যায় আসে না। শোনো, আমার কথা শোনো তুমি!

রাখীকে আবেগে উচ্ছসিতা দেখলুম। এই সেই সত্যিকার রাখী, ঠিক কণ্ঠস্বর তার চিঠিতে পেয়ে এসেছি বরাবর। আবেগময়ী প্রেমিকা মেয়ে সে। আমি ওর চিবুক ধরে চুমু খেলুম। বললুম–না। তুমি অসামান্যা, রাখী। তুমি মেয়ে বলেই তোমার মর্যাদা আমার চেয়ে বেশি।

না, না! ওগো, তা নয়। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি যেও না!

তবে কে যাবে?

রাখীর নাসারন্ধ্র কাঁপছিল। তার মুখে ফুটে উঠেছে এক দৃপ্ত দৃঢ়তা। এদেশের মেয়েরা হয়তো এমনি করেই প্রেমিকের সম্মানে আত্মদান করতে যায়। সে বলল আমি যাব। আমিই রেখে আসব। ভেবো না–মেয়েরা এমন অনেক কিছু পারে, যা পুরুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। তুমিই তো একথা কত উপন্যাসে লিখেছ?

তুমি যাবে?

হ্যাঁ। তার আগে তুমি বাইরেটা ভাল করে দেখে এস। তারপর তুমি কাশলে আমি বেরোব। তুমি বাঁদিকে নীচে যাবার সিঁড়ির মুখে দাঁড়াবে। কেউ এলে খুব জোরে কাশবে। আমি করিডরে ডাইনে তেতলার সিঁড়িতে উঠব। তোমার দ্বিতীয়বার কাশি শুনলে নেমে আসব। কেমন? আর কেউ না এলে তুমি চুপচাপ থাকবে। মনে রেখ।

বেরিয়ে এলুম অগত্যা। ওর দৃঢ়তার কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই। করিডর ফাঁকা। সব দেখে শুনে বাঁদিকে এগিয়ে নিচে যাবার সিঁড়ির মুখে কথামতো দাঁড়ালুম এবং কাশলুম অর্থাৎ পথ পরিষ্কার।

আমাদের ঘর থেকে রাখী বেরোল। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় চলে গেল সে করিডর পেরিয়ে তেতলার সিঁড়ির দিকে। অবশ গায়ে ও দুরুদুরু বুকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এতদিন পরে দেবতাকে খুব ডাকাডাকি করছি মনে মনে। মানত মানছি। সেকেণ্ডগুলো কাটতেই চায় না।

আর কাশবার দরকার হলো না। রাখীকে নেমে আসতে দেখলুম। সে চোখ নামিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকলে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা ভাল করে লক করলুম। তারপর রুদ্ধশ্বাসে বললুম–কোথায় রেখে এলে?

রাখী জবাব দিল–ভেবো না। ঠিক জায়গায় রেখেছি।

এই সময় বাইরে ভারী পায়ের শব্দ হলো। পুলিস নাকি? শব্দ অন্য দিকে সরে গেল। ইস্ আর একটু দেরি করলে কী যে ঘটত! …

.

তারপর যা সব হলো, বিস্তারিত বলার দরকার নেই। পুলিস আমাদের নীচে ডাইনিং হলে ডেকেছিল। জিজ্ঞাসাবাদ যা হলো, তা চূড়ান্ত। এরপর সার্চের পালা পড়ল। প্রত্যেকটি ঘর এবং প্রত্যেককে সার্চ করা হবে। মেয়েদের বডিসার্চ করবে এক মহিলা পুলিস। সবাইকে নিয়ে ওপরে আসা হচ্ছে, এমন সময় দেখা গেল মিসেস জেভিয়ার তেতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে নামছেন। কর্নেল সাহেবই দৌড়ে গিয়ে বুড়িকে ধরলেন। বুড়ির হাতে সেই চোখ ধাঁধানো জড়োয়া  নেকলেস! সবাই তাজ্জব।

বুড়ি হেসে কেঁদে বাঁচেন না! তারপর সকলের কাছে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। বোঝা গেল, হারটা মোটেও খোওয়া যায়নি। ওটা ওঁর স্মৃতির ভুল। লকারের অন্য তাকে রেখেছিলেন। এই স্মৃতিভ্রংশের জন্য উনি ভীষণ লজ্জিত।

সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কর্নেল ওঁর হাত থেকে হারটা নিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বুড়ি তখন প্রায় পাগল-হারানিধি ফিরে পেয়েছেন। পাত্তাই দিলেন না।

আমরা আবার ডাইনিং হল-এ নেমে এলুম। বেলা বারোটা তখন। লাঞ্চের এক ঘণ্টা দেরি। এখন মিসেস জেভিয়ারের আন্তরিক কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে কফি খেতে হবে বিনা দামে। বলা বাহুল্য, সবাই খুশি মনে কফি খেতে বসলেন।

কিন্তু আমার মন খারাপ করছিল। বেচারা রমার কথা ভাবছিলুম। কীভাবে পড়ে গেল সে রেলিং থেকে? রাখী আমার মনমরা ভাবটা টের পেয়ে বলল তুমি কিন্তু এখনও নার্ভাস হয়ে রয়েছ গৌতম?

-না, না। এমনি!

–এমনি নয়। কী ভাবছ, বলব?

বলো না?

রমার কথা।

হাসলুম। হয়তো ভাবছি। বেচারা ওভাবে মারা পড়ল!

দুঃখ নিশ্চয় হওয়া স্বাভাবিক। হ্যাঁ গো, যদি রমা না পড়ে আমি ওভাবে পড়ে যেতুম…

না, না! কী বলছ অলক্ষুণে কথা!

–আচ্ছা, হ্যাঁ গো, যদি রমা হতে রাখী–তাহলে এমন করে ভালবাসতে নিশ্চয়? বলল না!

-যাঃ! কী বলছ!

–আহা, বলোই না বাবা! যদি আমি অন্য কোনও মেয়ে হতুম, আর রমা হতো তোমার ভক্ত সেবিকা এবং প্রেমিকা!

যা হয়নি, তা নিয়ে ভাবি না, রাখী।

ভাবতে দোষ কী? তুমি তো সাহিত্যিক মানুষ। কত সব কল্পনা করতে পারো। এটা কল্পনা করে দেখ না কেন একবারটি।

–তুমি সামনে না থাকলে পারতুম রাখী।

–তাহলে রমাকে আমার মতোই আদর করতে? কাছে নিয়ে শুতে– চুমু খেতে?

যাঃ! শুনবে ওরা!

আচমকা আমার বাঁ দিক থেকে কর্নেলের সাড়া পেলুম-হ্যালো গৌতমবাবু! এই যে মিসেস চৌধুরী! এতক্ষণ কথা বলার ফুরসতই পাইনি। ট্যাবলেট খেয়ে ভাল ঘুম হয়েছিল তো?

বলতে বলতে কর্নেল এসে আমাদের পাশে বসে পড়লেন। রাখী সলজ্জ মুখে বলল–বসুন, বসুন কর্নেল। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। খুব ঘুমিয়েছি।

কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–সবই সুরাহা হলো। শুধু বেচারা রমা! ভেরি স্যাড রিয়্যালি!

রাখী বলল-হা, বেচারার জন্য কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা কর্নেল, আপনার কি মনে হয় সত্যি ওটা অ্যাকসিডেন্ট?

তাই বলছে পুলিস। রেলিং-এর ফাঁকে ওর শাড়ির একটা টুকরো আটকে রয়েছে। আর–ওর হাতের ব্যাগটাও ছিটকে পড়েছে-অবশ্য জলে পড়েনি, পাথরের ওপর পাওয়া গেছে ওটা। এসব দেখে পুলিস বলছে, অ্যাকসিডেন্ট। বৃষ্টিতে রেলিং ভীষণ পিছল ছিল। বসতে গিয়ে পিছলে পড়ে গেছে।

আমি বললুম–আপনার ধারণা কী বলুন কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন। আমার আর কী আলাদা ধারণা থাকবে?

-এটা খুন নয় তো?

–তেমন ক্লু তো পাওয়া যায়নি এখনও। অবশ্য মেয়েটির সত্যিকার পরিচয়। পুলিস উদ্ধার করতে পারলে সব বোঝা যেত।

রাখী ভুরু কুঁচকে বলল–সত্যিকার পরিচয়? তার মানে-ও কি রমা নয়, অন্য কেউ?

কর্নেল জবাব দিলেন–আমি ডেফিনিট নই। কিন্তু…

বললুম–কিন্তু?

–কিন্তু ওর মধ্যে কেমন একটা অপ্রকৃতিস্থ ভাব লক্ষ করেছিলুম। আমার স্বভাব, মানুষকে লক্ষ করা। অবশ্য আমার চোখের ভুল হতেও পারে। তাছাড়া ও আসে গত রাত্রে সাতটা দশের ট্রেনে।

–আমরাও তো ওই ট্রেনে এসেছি।

-তাই বুঝি? তা ও যখন নাম রেজিস্ট্রি করাচ্ছিল মিসেস জেভিয়ারের খাতায়, আমি কাছাকাছি ছিলুম। লক্ষ করলুম, নাম লেখবার সময় একটু ইতস্তত করল। আমার ওই এক কুঅভ্যাস। একটু পরে পাশে গিয়ে একটা অজুহাতে দাঁড়ালুম। দেখলুম আর লিখে ও হরফটা দুবার বুলিয়েছে–যেন অন্য কী হরফ লিখতে যাচ্ছিল–হয়তো অভ্যাসে।…অবশ্য সবই আমার ভাসা ভাসা ধারণা। এর পিছনে কোনও বাস্তব তথ্য নাও থাকতে পারে।

রাখী কৌতূহলী হয়ে বলল ঠিকানা কোথাকার?

-বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ।

–সে কী! আমিও তো…বলে চুপ করে গেল রাখী।

–আপনি কি বহরমপুরের মেয়ে?

রাখীর বিব্রত অবস্থা টের পেয়ে আমি বললুম–হা কর্নেল। আমার শ্বশুরালয় বহরমপুর। কিন্তু সবাইকে চেনা তো রাখীর পক্ষে সম্ভব নয়। কী বলল রাখী?

রাখী বলল–নামটা…নামটা কেমন চেনা লাগল। বহরমপুরে রমা বলতে সে ভুরু কুঁচকে ভাবতে থাকল।

কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে খারাপ লাগল। রাখীর সিঁথিতে অবশ্য সরু সিঁদুরের রেখা রয়েছে। হাতে শাঁখাটাখা নেই–আমরা তো মডার্ন দম্পতি! বললুম–একটা শহরে অনেক রমা থাকা সম্ভব!

কর্নেল বললেন–রাইট, রাইট। সে তো সম্ভবই।

রাখী হঠাৎ বলল–ও, মনে পড়েছে! রমা রায়! কিন্তু তাকে তো আমি চিনতুম!

–কে সে?

রাখী হেসে ফেলল।–এক দাগী ডাকাতের বউ। পরে ওর স্বামীর জেল হয়। জেল থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়ে। বউটি বহরমপুরে মার্কামারা মেয়ে ছিল। সবাই চিনত। পুলিসের সঙ্গে খাতির ছিল প্রচণ্ড। তারপর কোথায় যেন চাকরি-টাকরি নিয়েছিল। ও হ্যাঁ–স্কুলে।

–স্কুলে ডাকাতের বউকে চাকরি দিল?

বুঝতেই পারছেন, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খাতির করে নিয়েছিল। ওর মতো মেয়ের পক্ষে অসম্ভব তো কিছু ছিল না!

আমি রাখীকে সমর্থন করে বললুম–আজকাল তো সব জায়গায় এরকম হচ্ছে। মরালিটি নিয়ে কজনই বা মাথা ঘামায়? অবশ্য, সাহিত্যিক হিসেবে আমি বলব–এতে ইম্মরালও কিছু নেই। স্বামী দাগী ডাকাত হলেই যে বউ ভাল মেয়ে হবে না, তার মানে নেই। তাছাড়া স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বাঁচতে হবে তো!

কর্নেল বললেন–সে রমা নিশ্চয় দেখতে খুব সুন্দরী ছিল?

কর্নেলের বেমক্কা প্রশ্নে অবাক হলুম। রাখী কিন্তু হাসল।-কেমন করে বুঝলেন?

হিউম্যান সাইকলজি এরকমই, মিসেস চৌধুরী। রূপের বেলা সাতখুন মাফ। অবশ্য এটা জেনারেল ল।

রমা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল। গরীব ঘরের মেয়ে তো? বি এ পাশ করার আগেই বাবা ওর বিয়ে দেন–অবশ্য রমা প্রেম করেই বিয়ে করে। আর করল করল, এক মাস্তানের সঙ্গে। তার ফলটা ভালই ভুগল।

–তাহলে বলছেন, সে রমা এই রমা নয়?

–মোটেও না।

আমি হঠাৎ বলে উঠলুম কিন্তু তুমি তো এই রমাকে দেখইনি, রাখী?

রাখী ভুরু কুঁচকে বলল–দেখিনি? পরক্ষণে হেসে ফেলল। কী কাণ্ড! সত্যি তো! আমি ওকে এখানে দেখিইনি। অথচ কেবলই মনে হচ্ছে–দেখেছি! আসলে ওই নামটার জন্যে এমন হচ্ছে!

কর্নেল মাথা নেড়ে সায় দিলেন। রাইট, রাইট। যাকে বলে উইশফুল থিংকিং। তবে ও বডিটা আপনার একবার দেখা দরকার। অবশ্যই দরকার। আপনি সনাক্ত করলে পুলিসের খুবই সুবিধে হয়। দায়িত্ববান নাগরিকের পক্ষে এটা কর্তব্যও বটে।

এই বলে কর্নেল খুব ব্যস্তভাবে উঠলেন এবং রাখী অসহায় মুখে আমার দিকে তাকাল। বিব্রত বোধ করছিলুম। রাখীকে এভাবে মড়ার সামনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তাই শেষ রক্ষার জন্যে, বললুম–ইয়ে দেখুন কর্নেল, ওর নার্ভ খুব শক্ত নয়। একসময় নার্ভের অসুখেও ভুগেছে। তার প্রমাণ তো গতরাতে পেয়েছেন। তাই বলছিলুম, মড়াটড়া দেখে ও হয়তো ভীষণ ভয় পাবে এবং হিতে বিপরীত ঘটে যাবে।

কর্নেল মানুষটি দেখলুম খুবই সহানুভূতিশীল। ব্যাপারটা বুঝতে ওঁর দেরি হলো না। আবার বসে পড়লেন। বললেন–হ্যাঁ, সেও ঠিক। ওঁর নার্ভ তেমন শক্ত নয়। আচ্ছা মিসেস চৌধুরী, তাহলে যদি ওর ডেডবডির একটা ফোটো আপনাকে দেখানো হয়, কোনও আপত্তি হবে?

রাখী নিশ্চয় মনে মনে বিরক্ত হলো। পুলিসে যা করবার করুক, তুমি কে বাপু যে এত উৎসাহ দেখাচ্ছ–এরকম ভাব রাখীর মুখে ফুটে উঠল। কিন্তু সে আস্তে ঘাড় নেড়ে ছোট্ট করে শুধু বললেউ।

কর্নেল বললেন–ছবি তোলা হয়েছে। লাশও এতক্ষণ মর্গে চলে গেছে। ছবিটা পেতে ঘণ্টা চার-পাঁচ দেরি হবে। যাই হোক, অপেক্ষা করা যাক।

রাখী বলল-চার-পাঁচ ঘণ্টা! আমরা যে এগারোটা ছত্রিশের ট্রেনে চলে যাব ঠিক করেছি কর্নেল!

আমি অবাক হয়ে তাকালুম ওর দিকে। কখন ঠিক করলুম রে বাবা! চলে যাওয়া মানেই তো রাখীর সঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া! আর এক্ষুণি চলে যাব বলে তো এতদূরে বেড়াতে আসিনি।

রাখী আমার দিকে চোখের ইশারা করল। তখন বুঝলুম, আসলে ও ডেডবডির ছবিও দেখতে চায় না। এড়িয়ে যাবার মতলব এঁটেছে! অতএব ওকে সায় দিয়ে বললুম–হা কর্নেল। যে বীভৎস কাণ্ড হলো–এরপর এখানে ওকে নিয়ে থাকা খুব রিস্কি! আবার ভয়টয় পেয়ে সিন ক্রিয়েট করে বসবে। তাছাড়া রমা ঠিক পাশের ঘরেই উঠেছিল!

হাসতে হাসতে বললুম– কথাটা। কর্নেল গম্ভীর হয়ে মাথাটা কয়েকবার দোলালেন মাত্র। কিছু বললেন না। অবশ্য এও জানি যে, পুলিস আইনত আমাদের আটকাতে পারে। বুক কেঁপে উঠল–আমাদের নিয়ে পুলিস টানাটানি করলেই বিপদ। রাখী ও আমার গোপন সম্পর্ক ফাঁস হয়ে যায় যদি! পুলিসের চোখে ফাঁকি দেওয়া কি সহজ হবে যে আমরা আসলে স্বামী-স্ত্রী নই?

অবশ্য এটা পশ্চিমবঙ্গ হলে নিজের কিছু প্রভাব খাটাতে হয়তো পারতুম। কিন্তু এটা ওড়িশা। ভিন ভাষার রাজ্য। এখানে কারো কাছে গৌতম চৌধুরী সাহিত্যিক বলে কোনও আলাদা গুরুত্ব নেই।

হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন–এক্সকিউজ মি। আবার দেখা হবে। কেমন?

উনি চলে গেলে রাখী ফিসফিস করে রাগ দেখিয়ে বলল–ভদ্রলোক বড্ড কুচুটে মানুষ! যেন সব দায় ওঁর! এই, আর এখানে থাকব না আমরা। বরং অন্য কোনও জায়গায় চলে যাই। এই বিশ্রী ঘটনার পর তোমার ইচ্ছে করবে ফ্রিলি চলাফেরা করতে?

ঠিকই বলেছে রাখী। এই পরিবেশে প্রেমের বারোটা বেজে যাবে। মোটেও জমবে না। ওকে সায় দিলুম। বললুম–তাই হবে। লাঞ্চ খেয়ে আর দরকার নেই। চলল, গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিই। মিসেস জেভিয়ারকে আমি বলে আসছি তুমি এগোও।

রাখী তখুনি ওপরে চলে গেল। আমি মিসেস জেভিয়ারকে কথাটা বলতেই উনি দুঃখিত মুখে বারবার ক্ষমা চাইলেন। বললেন কী করব বাছা, আমারই দুর্ভাগ্য! আবার কিন্তু আসবে তোমরা।

সিঁড়ির মুখে সেই গুঁফো সেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল–হ্যাল্লো মিঃ চৌধুরী, আর কিছু শুনলেন?

-কিসের বলুন তো?

–আবার কিসের? যা ঘটে গেল!

বিরক্ত হয়ে বললুম–কিচ্ছু শুনিনি। স্রেফ সুইসাইড। কেন? আর বেশি কী শোনার আছে?

হঠাৎ লোকটা অভদ্রভাবে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে মুচকি হেসে চাপা গলায় বলে উঠল–ওই ভদ্রমহিলা কি সত্যি আপনার স্ত্রী?

রাগে সারা শরীর বি রি করে উঠল। হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললুম–কী বলছেন মশাই যা-তা! একটু ভদ্রতাও শেখেননি!

গুঁফো সেন হাসতে লাগল।

আরও রেগে বললুম–আপনি অত্যন্ত অভদ্র! আপনি জানেন কার সঙ্গে ইতর রসিকতা করছেন? তেমন শিক্ষা-সংস্কৃতি থাকলে গৌতম চৌধুরীর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে লজ্জা পেতেন!

গুঁফো একটুও না দমে বলল–আমি মশাই এখানকার ভেটারেন ট্যুরিস্ট। আপনার সঙ্গিনীকে অনেকবার দেখেছি এখানে। এই লজেই–অন্য ভদ্রলোকের প্লঙ্গে। মিসেস জেভিয়ার বুড়ি মানুষ–চোখেও কম দেখেন। নয়তো চেনা মুখকে। অচেনা ভাবতেন না। এবেলার চেনা মানুষ উনি ওবেলায় চিনতে পারেন না। কিন্তু আমি পারি!…..

বলেই গুঁফো সেন আচমকা চলে গেল। আর দুটো চড়া কথা বলার সুযোগ দিল না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরের দিকে পা বাড়ালুম।

রাখী তাহলে অন্য কারও সঙ্গে অনেকবার এখানে এসেছে? কার সঙ্গে এসেছে? অন্য প্রেমিক? নাকি ওই মাস্তান লোকটা আমাকে নিয়ে মজা করল? রাখীকে কথাটা বলার সাহস পেলুম না। ও দুঃখ পাবে। আমাদের সুন্দর সম্পর্কটা নড়ে ওঠারও আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে রাখী যা ভাবপ্রবণ মেয়ে! অত আবেগ। যার মনে–তাকে এসব প্রশ্ন করা মানেই বারুদে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দেওয়া! আর এযুগে অত সংকীর্ণচেতা হওয়া সাজে না।

মনের অস্থিরতা মনেই চেপে রাখলুম। কিন্তু গোছগাছ করতে করতে বুদ্ধিমতি রাখী তা যেন টের পেল। বলল–তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন বল তো? মাথা ধরেনি তো?

বললুম–হ্যাঁ?

ট্যাবলেট আছে। খেয়ে নাও না! দেব?

থাক। বেরুলে ছেড়ে যাবে।

সব গোছানো হয়ে গেলে রাখী একবার ব্যালকনিতে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে ডাকল–এই! শুনে যাও না!

তার ডাকের কোনও তুলনা নেই। খুব ঝটপট যেটুকু সেজে নিয়েছে, তাতে, ওর চেহারা আশ্চর্য লাবণ্যময় হয়ে উঠেছে। ওর কোমর, নিতম্ব ও পেটের কিছু নগ্ন অংশ, এবং ওর ঠোঁট চিবুক গলা ঘাড় চুল–আমার চোখে অলৌকিক আর মায়াময় হয়ে উঠেছিল। প্রায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে তার পাশে গেলুম। সে তার চাপা অভ্যস্ত আবেগময় স্বরে বলল–চলে যাবার আগে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে বলে যাবে না যে, আমরা এসেছিলুম–তুমি সাক্ষী রইলে?

-হ্যাঁ। বলব। বলব যে আবার আসব, আমাদের মনে রেখ।

–গৌতম!

উঁ?

–এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে সাক্ষী রেখে আমাকে তুমি একটা চুমু দাও না লক্ষ্মীটি।

বলার দরকার ছিল না। পাগলের মতো ওকে দুহাতে বুকে টেনে ওঁর ঠোঁটে ঠোঁট রাখলুম–দীর্ঘ একটা মিনিট। তারপর ও সরিয়ে দিল। ঠোঁট মুছল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল–আরও কিছু তোমাকে দেবার ছিল এই সমুদ্রের সামনে। তুমি আরও কিছু চেয়েছিলে–তাই না গৌতম?

–হ্যাঁ। আরও কিছু বাকি থেকে গেল, রাখী।

রাখী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হঠাৎ ঘরে চলে এল। আমি ওর পিছন পিছন এসে ওকে গভীর আবেগে আকর্ষণ করে বললুম–রাখী! আমার আত্মা! আমার প্রাণ!

রাখী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল–এবার আমরা কোথায় যাব গৌতম? আমার ছুটি কিন্ত আরও তিনদিন আছে।

–চলো তো, আগে স্টেশনে যাই। তারপর ঠিক করে নেব।

কাছাকাছি আর কোথাও সি-বিচ নেই ভাল?

–আছে। সে অনেক দূর। প্রায় ছ-সাত ঘণ্টার জার্নি। তার চেয়ে তিন ঘণ্টার ট্রেনে ও বাসে আমরা কোনারক পৌঁছাতে পারি।

–কোনারক! রাখী নেচে উঠল। ওগো, তাহলে তাই চলো! …

একটু পরে নির্বিবাদে আমরা বেরোলুম। ফো সেন বা কর্নেল কাউকেও দেখতে পেলুম না। অনেকটা স্বস্তি এল। রিকশায় আমরা স্টেশনের দিকেই চললুম। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার আজ। অবশ্য এখানে ওখানে কিছু সাদা মেঘ আছে। বাতাসও বইছে প্রচণ্ড জোরে। পিছন থেকে বইছে বলে রিকশা প্রায় পক্ষীরাজের মতো উড়ে চলল।

চন্দনপুর অন-সী জংশন স্টেশন। খুব ভিড়ও ছিল। কোনারকের দিকে যাবার ট্রেন আসতে দেড় ঘণ্টা দেরি। ফার্স্ট ক্লাশ ওয়েটিং রুমে রাখীকে বসিয়ে রেখে এনকোয়ারিতে দাঁড়িয়ে ছিলুম। ভাবছিলুম, দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সেরে নিই। কারণ ট্রেন থেকে নেমে কোনারকের পথে বাসে যেতে হবে। কখন পৌঁছব কিছু ঠিক নেই।

হঠাৎ চমকে দেখি সেই গুফো সেন সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়ছে। আপদটা এখানে কেন? অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলুম। ওর চোখ এড়িয়ে তক্ষুনি সরে গেলুম। ক্যান্টিনটা খুঁজে বের করতে হবে!

ক্যান্টিন থেকে অবস্থা দেখে বেরিয়ে রাখীকে ডাকতে আসছি, চোখে পড়ল প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা জায়গায় কিছুটা দূরে একটা পিপুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছেন সেই ধুরন্ধর গোয়েন্দা ঘুঘু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার বুকে রক্ত ছলকে উঠল।

দ্রুত ওয়েটিং রুমে গিয়ে ঢুকলুম। কিন্তু রাখী কোথায়? প্রায় দৌড়ে গিয়ে দেখি শুধু আমার সুটকেসটা পড়ে আছে–আমার মগজ খালি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথা ঘুরতে লাগল। পাশের টেবিল ধরে সামলে নিলুম। তারপর চারদিকে ঘুরে ঘটনাটা বাস্তব কি না টের পেতে চাইলুম।

সেই সময় দরজায় দেখা গেল কর্নেলকে। মুখে স্বভাবসিদ্ধ হাসি বুডোর। গা জ্বলে যাচ্ছিল। কাছে এসে বাও করে বললেন–গুডমর্নিং মাই ডিয়ার চৌধুরী। তাহলে সত্যি সত্যি চন্দনপুর ছেড়ে চললেন? আপনার স্ত্রী কোথায়?

হঠাৎ আমার সব উত্তেজনা ঝিমিয়ে গেল। বললুম– কর্নেল, আমি হয়তো ভুল করেছিলুম কোথাও কিছু সাংঘাতিক একটা ভুল ঘটেছে। আমার ইনটুইশন বলছে একথা! রিয়্যালি কর্নেল–আমি যেন বড্ড ঠকে গেছি।

কর্নেল আমাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলে বললেন–নেভার মাইণ্ড গৌতমবাবু! আপনারা সাহিত্যিকরা বড্ড আবেগপ্রবণ এবং বেহিসেবী মানুষ। তাই এটা স্বাভাবিক। তবে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই–পস্তেও ফল হবে না। স্টেশনটা পুলিস ঘিরে ফেলেছে। আপনার জাল প্রেমিকা পালাতে পারবে না।

চমকে উঠে বললুম–জাল প্রেমিকা মানে?

-মানে রমা রায়!

–কিন্তু রমা রায় তো মৃত!

না গৌতমবাবু, যে সমুদ্রের জলে পড়ে মারা গেছে সেই হচ্ছে খাঁটি রাখী–আপনার সত্যিকার প্রেমিকা–মানে, সরি। পাঠিকা–গুণমুগ্ধা পাঠিকা।

–আমি কিছু বুঝতে পারছি না কর্নেল।

–খুবই সহজ। বহরমপুর গার্লস স্কুলের দুই শিক্ষিকা–একজন রমা রায়– কুখ্যাত ডাকাতের উইডো, অন্যজন রাখী মিত্র-সরলমনা কালচার্ড মেয়ে। কিন্তু যেভাবে হোক, দুজনের মধ্যে ভাব ছিল। এমন কি বিশ্বাস করে রাখী রমাকে আপনার সব চিঠিই দেখিয়ে থাকবে। এসব কিন্তু হাইপথিসিস। এখনও বাস্তবে প্রমাণিত হয়নি। তবে আমার সিদ্ধান্ত প্রায়ই ভুল হয় না। যাই হোক, রমার লক্ষ ছিল মিসেস জেভিয়ারের নেকলেসটার প্রতি। একদা এখানে এসে, হয়তো তার স্বামীও সঙ্গে ছিল-ওটার খবর পেয়ে যায়। কিন্তু কোনও সুযোগ পায়নি। অথচ ওটার কথা ভোলেনি রমা। এবার সে একটা চান্স নিল। রাখীকে সেই সম্ভবত প্ররোচনা দিল চন্দনপুরে বেড়াতে যেতে-সাজতে হবে গৌতম চৌধুরীর স্ত্রী। তাই পুলিস বা কেউ ভুলেও সন্দেহ করবে না। এবার একটা প্রশ্ন করি। আপনি রাখীকে বহরমপুরে কোন ট্রেন ধরতে বলেছিলেন?

-পাঁচটা পাঁচের। ভোরে। পরের ট্রেন ছটা তেইশে। ওটাতেও হাওড়া এসে চন্দনপুরের ট্রেন ধরা যায়–তবে লেট করলে যায় না। তাই প্রথম ট্রেনেই আসতে বলেছিলুম।

–হুঁম্! রেডিও মেসেজে বহরমপুর পুলিসের পাওয়া তথ্য শুনুন। স্কুলে দুজনেই ছুটি নেয়। ওইদিন সাড়ে পাঁচটায় হোস্টেলে রমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনে অন্য ঘরের একটি মেয়ে দেখে ভিতরে রাখী বন্দী। বাইরে কেউ শেকল তুলে দিয়েছে। ঘরে রমা ছিল না। রাখী তখন সেজেগুজে বেরিয়ে যায়। বলে– কলকাতা যাচ্ছে কথামতো। রাখী তাহলে বোধহয় ছটা তেইশের ট্রেন ধরেছিল। ট্রেনটা হয়তো লেট করেনি। ফলে আপনাদের দেখে থাকবে। অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। সে চন্দনপুরের ট্রেনে চেপে বসেছিল। কোনও এক সুযোগে ব্যাপারটা ফাঁস করে দেবার ইচ্ছে নিশ্চয় ছিল–আপনার সঙ্গে গোপনে দেখা করত হয়ত। এবার বাকিটা সহজ। রমা এখানে এসে কোনও ভাবে ওকে আবিষ্কার করুক, কিংবা রাখী নিজেই রমাকে একা পেয়ে মুখোমুখি চার্জ করার সুযোগ নিক কিছু একটা ঘটেছিল।

–ঠিক বলেছেন কর্নেল। আমার মনে পড়ছে যখন জাল রাখীকে ঘরে রেখে আমি নীচে এসেছি, হঠাৎ ওই মেয়েটি কখন ওপরে চলে গিয়েছিল।

–তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাখীই গিয়েছিল রমার কাছে। রমা কোনও অজুহাতে তাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে যায় এবং ব্যালকনিতে গিয়ে বোঝাপড়া করার অছিলায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় সমুদ্রে।

ইস্! কী সাংঘাতিক মেয়ে।

ব্যাপারটা প্রথমে টের পাই, রাখীর পড়ে যাওয়া ব্যাগে আপনার কিছু চিঠি দেখে। মুহূর্তে অনেকটা বুঝতে পারি কী ঘটেছে। দ্বিতীয় আবিষ্কার–মিসেস জেভিয়ারের ফিরে পাওয়া নেকলেস–যা নকল!

নকল!

–হ্যাঁ! ওটা নকলই। আসলটা রমা মেরে দিয়েছিল এবং নকলটা …

বলছি। সে আমাকে ভুল বুঝিয়ে সিঁড়ির মুখে পাহারা দিতে বলল, এবং নেকলেসটা রাখতে গেল। আঃ, তখনই সন্দেহ করা আমার উচিত ছিল। কারণ। তেতলার ঘরের চাবি…

–চাবি কোনও প্রশ্ন নয় ওর কাছে। দেখবেন, কবে ওই তালার ছাঁচ নিয়ে গিয়ে চাবি তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। ধরা পড়ে যাবে। আর কয়েকটা মিনিট পর দেখতে পারবেন আপনার জাল প্রেমিকাকে!

কর্নেল হাসতে লাগলেন। আমার মন দুঃখে ভেঙে পড়ছিল। হায় রাখী! চিঠিতে অত গভীর প্রেম আর সৌন্দর্যময় ব্যক্তিত্বের প্রমাণ দিয়েছিলে–বাস্তবে তুমি যাই হও, তোমাকে মনেপ্রাণে বরণ করে নিতে এতটুকু বাধত না!

কর্নেল বললেন–দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক গৌতমবাবু। আপনারা সাহিত্যিকরা অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। কিন্তু তত চালাকচতুর নন। প্র্যাকটিকাল হওয়া আপনাদের ধাতে নেই।

এমন সময় সেই গুঁফো সেন দৌড়ে এল–কর্নেল! আসামী ধরা পড়েছে। আসল নেকলেস আর একগোছ চাবি পাওয়া গেছে। পিস্তল ছোঁড়ার চেষ্টা করেছিল কী সাংঘাতিক মেয়ে!

কর্নেল বললেন–এই যে আলাপ করিয়ে দিই–বহরমপুরের ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর রমেন সেন। ইনিই রমাকে সারা পথ ফলো করে এসেছিলেন!

যন্ত্রের মতো গুঁফো সেনকে নমস্কারের জবাব দিলুম। সে বলল–আপনি হাওড়ায় আমাকে জিগ্যেস করলেন চন্দনপুর এক্সপ্রেস কোন প্লাটফর্মে? মনে পড়ছে?

না তো।

গুঁফো সেন হাসল–তখন অত লক্ষ করার মুড ছিল না আপনার।

কর্নেল বললেন–তাহলে এগোনো যাক্। আসুন গৌতমবাবু, আপনার কিছুক্ষণের সঙ্গিনীকে এবার অন্যরূপে দেখবেন আসুন।

আমি করজোড়ে বললুম–ক্ষমা করবেন কর্নেল।

–কিন্তু আপনাকে এখন পুলিশের দরকার হবে স্যার। গুঁফো সবিনয়ে বলল।–এবার আপনাকে আগাগোড়া একটা স্টেটমেন্ট দিতে হবে যে।

–ঠিক আছে, দেব। চলুন–। কিন্তু ওই শয়তানীর সামনে নয়–নেভার।

ওঁরা দুজনে হেসে উঠলেন। সুটকেসটা তুলে নিয়ে ভারি পা দুটো কোনও ভাবে টেনে নিয়ে চললুম। যেতে যেতে গুঁফো সেন বলল–গত রাত্রে আর এক মিনিট আগে ওপরে গেলে হতভাগিনী রাখীকে বাঁচাতে পারতুম। আমি ব্যাপারটা এভাবে দেখিনিজানেন? অর্থাৎ রাখীই যে আপনার সত্যিকার প্রেমিকা এবং সে এতদূর চলে এসেছে, জানতুম না। কীভাবে জানব বলুন? শুধু নির্দেশ আছে রমা যেখানে যাচ্ছে ওকে ফলো করতে হবে। এটা কর্তাদের স্ট্যাণ্ডিং নির্দেশ। তাই বরাবর হোস্টেলের দিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা। হাওড়া স্টেশনে এসে আপনার সঙ্গে রমাকে দেখে ভাবলুম নিশ্চয় বড় শিকারে যাওয়া হচ্ছে। আপনাকেও ভাবলুম কোনও বড় মাল। সাহিত্যিক গৌতম চৌধুরী যে আপনি, কেমন করে জানব? পরে জেভিয়ার্স লজে এসে জানলুম। তখন আরও শিউরে উঠলুম। সর্বনাশ, নিরীহ শিল্পী ভদ্রলোককে শয়তানী ফাঁদে ফেলেছে যে। সাবধান করার স্কোপ পেলুম না।

গুঁফো সেন অনর্গল বকবক করতে করতে একটা জিপের সামনে দাঁড়াল। দেখলুম পুলিশের জিপ। উঠে বসলুম তিনজনে। জিপটা স্টার্ট দিল।

আমাদের আগে-আগে একটা কালো প্রিজনভ্যান যাচ্ছিল। জানি, ওর মধ্যে সেই রহস্যময়ী যুবতীটি খাঁচায় বন্দী বাঘিনীর মতো ছটফট করছে। এখন তো আমি ওর কেউ নই। সামনে গেলে মাংস ছিঁড়ে খাবে। এখন আমি ওর ঘোর শত্রু।

বাঁকের মুখে সমুদ্র দেখা দিল। সেই সমুদ্রবর্ষার দুরন্ত উচ্ছ্বাসে বিক্ষুব্ধ। এখন তাকে মনে হলো না প্রেমের আবেগে চঞ্চল হয়েছে। মনে হলো প্রচণ্ড দুঃখে ক্রোধে কান্নায় ফেটে পড়ছে। চোখে জল এসে গেল। রুমাল চাপলুম।

প্রেম, হত্যা এবং কর্নেল

বারান্দা থেকে কয়েক একর পাথুরে জমির ওধারে কয়েকটা শালগাছ আছে। দুটো কুকুর ভোরবেলা থেকে শালগাছ ঘিরে খুব খেলা জমিয়েছিল। তারপর একটা মাটি শুঁকতে শুঁকতে স্টেশনের দিকে চলে গেছে। অন্যটা মদ্দা, একটা কিছু আঁচ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে মুখ তুলে–যেন গন্ধ শুঁকেছে কিছু। তারপর দু-পা সামনে ছড়িয়ে থাবায় চিবুক রেখে টানটান বসে আছে। ওর গায়ে আস্তে আস্তে একটা ছায়া সেঁটে যায়। সাদা কুকুরটা ধূসর হয়ে বস্তুজগতের সঙ্গে ওতোগোতভাবে সংলগ্ন হয় এবং স্তব্ধতায় গুপ্ত থাকে।

মেঘেন–বরমডিহি স্টেশনের রেলবাবু মেঘে লাল বোস, তার লাল কোয়ার্টার থেকে সকালের অবসরে সবুজ বনের খেলা দেখছিল। সাদা কুকুরটা শুলে সে বারান্দা থেকে নামল। খানিক দূরে গিয়ে একটুকরো পাথর ছুঁড়ল। কুকুরটা মুখ ঘুরিয়ে দাঁত বের করল। দ্বিতীয়বার মেঘেন পাথর তুললে সে গরগর করে তেড়ে এল। মেঘেন পিছিয়ে আসে।

বারান্দা থেকে মন্দিরা চেঁচায় কী হচ্ছে ওখানে? ওর পিছনে লাগলে কেন?

মেঘেনও ঘুরে দাঁত বের করে–অর্থাৎ হাসে।

–পাগলা কুকুর ওটা। শীগগির চলে এস।

স্ত্রীলোকের ইনটুইশান। মেঘেন ভাবে। কিন্তু পাগলা কুকুর কি সঙ্গিনী নিয়ে। খেলে? কে জানে! পৃথিবীর অনেক ব্যাপারের অনেকটাই মানুষের জানা হয় না। জানা যায় না। প্রাণীজগতটা তো মনে হয় একেকটি দুরুহ কোডে ভরা জিনপুঞ্জসমন্বিত দুয়ে ক্রোমোসোম নিয়ে তৈরি। তার মধ্যে মানুষ বিশেষত স্ত্রীলোক, যাদের রামকৃষ্ণদেব বলতেন, প্রকৃতির অংশ। অংশ কেন–হাতের পুতুল। কী করে কী বলে নিজেরাও বোঝে না। যেমন মন্দিরা। কেন সে সারারাত মেঘেনের পিঠ আঁকড়ে শুয়ে থেকেছে, কে বলবে? পিঠটা আয়নায় দেখেছে সে, নখের চেরা লাল দাগ পড়ে গেছে। কারও কারও নখে নাকি বিষ থাকে। মন্দিরার নেই তো?

জামার ভেতর হাত চালিয়ে পিঠের দাগটা ছুঁতে-ছুঁতে মেঘেন বারান্দার সামনে রোদ্দুরেই দাঁড়িয়ে যায়। চৈত্রের আকাশ এই এলাকায় এত নীল কখনও সে দেখেনি। ঈশানকোণে কয়েকটা পাখি বিন্দুর মতো নড়ছে। শকুন নাকি? মেঘেনের চোখ নিস্পলক হয়ে ওঠে।

মন্দিরা সকালের স্নান সেরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কী ভাবছে সে হয়তো নিজেও জানে না। খুব পবিত্রতা দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে, এমনি শান্ত অবস্থিতি। মেঘেনের মনে মন্দিরা, চোখে দূরের কয়েকটা সাংঘাতিক বিন্দু অবশেষে সে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

–রোদ্দুরে কী করছ? চলে এস।

মন্দিরার গলাটাও এখন পবিত্র, স্নেহে ভিজে, শান্ত। মেঘেনের ভাল লাগে ডাকটা। অনেকদিন এমন করে সে যেন ডাকেইনি।

একটু পরে মেঘেন বারান্দায় বসে যখন চা খাচ্ছে, ফাদার খ্রিস্টমাস চেহারার বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক এলেন। বয়স মেঘেনের বাবার সমান মনে হয়। কিন্তু টাক পড়েছে মাথায়। খাড়া নাক, চাপ চাপ সাদা দাড়ি, বড় বড় কান, চওড়া কপালে তিনটে ভঁজ! মেঘেন ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

কোয়ার্টারের পিছনদিক এটা। বেড়ায় ঘেরা একটুকরো সবজিক্ষেত বা বাগিচার জন্য জমি আছে। এদিকে কারও আসার কথা নয়।

-নমস্কার। আপনি কি মেঘেনবাবু?

মেঘেন পাল্টা নমস্কার করে বাঁ হাতে, কারণ ডানহাতে চায়ের পেয়ালা।

–আমি মোহনপুর জংশন থেকে আসছি।

বলুন?

বৃদ্ধ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হাসেন।বসব। না বসে তো বলা যায় না।

মেঘেন হন্তদন্ত হয়ে ওঠে। আসুন, আসুন! খালি মোড়াটার দিকে আঙুল বাড়ায় সে। বেড়ার গেট দিয়ে লোকটা ঢোকে। মোড়ায় বসে পড়ে। হাসিমুখে তাকিয়ে বলে–কাল ইভনিং-এ কখন থেকে কখন অব্দি ডিউটি ছিল আপনার?

-কেন বলুন তো? বিকেল পাঁচ থেকে রাত বারোটা।

বরমডিহি তো খুব বড় স্টেশন নয়।

নয়। কেন বলুন তো?

–আপনার দেশ কোথায়?

পশ্চিমবঙ্গ। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। কেন ব…..

এখানে ছমাস এসেছেন?

–হ্যাঁ কিন্তু কেন……..

এর আগে মোহনপুরে ছিলেন?

–ছিলুম। কে…….

–মোহনপুরের ডিভিসনাল সুপারিন্টেন্টে রথীনবাবুও তো বহরমপুরের লোক?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু…..

রথীনবাবুর মেয়ে তিথিকে তো চেনেন?

–চিনি। কী ব্যা…….

–গতকাল সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশের ডাউন ঠিক ক’টায় ইন্ করেছিল মেঘেনবাবু?

-সাতটা সাঁইত্রিশে। আগের স্টেশনে মেল পাস ক…

–তিথি নেমেছিল স্টেশনে?

এ্যাঁ? তি… … …।

দরজায় মন্দিরা এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রথমে চোখ দুটো বড় ছিল। তারপর ছোট হয়েছে, ভুরু কুঁচকে গেছে, ঠোঁটের নিচে ভাজ ফুটেছে–যা তাকে সুন্দর করে। সে মুখ খোলে।

আপনি কে?

বৃদ্ধ অমনি নমস্কার করেন তাকে। আপনি মিসেস মন্দিরা বোস?

–হ্যাঁ! আপনি কে?

–আপনি ভাগলপুরের মেয়ে?

–সবই তো জানেন দেখছি? আমার বলা কেন? কে আপনি শুনি?

–গত মাসের এগারো তারিখে আপনি নারায়ণগড় মন্দিরে যাচ্ছি বলে মোহনপুরে গিয়েছিলেন?

মন্দিরা লাল মুখে প্রায় গর্জায়। হ্যাঁ, গিছলুম। কিন্তু তাতে আপনার এত মাথাব্যথার কী আছে? আগে বলুন তো, কে আপনি–নয়তো…রাগে সে কথা হারিয়ে ফেলে।

বৃদ্ধ মিটিমিটি হাসেনা হাত তুলে বলেন–প্লীজ! প্লীজ! আচ্ছা, মন্দিরাদেবী, আপনি সেদিন তিথিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন? হ্যাঁ কিংবা না বলুন, প্লীজ!

বলব না।

–প্লীজ!

না! চলে, যান আপনি! এখুনি চলে যান। নয়তো লোক ডাকব!..মন্দিরা হাঁফাতে হাঁফাতে কথা বলে। তারপর মেঘেনের দিকে ঘোরে। তুমি চুপচাপ এই অপমান হজম করছ? একটা কোথাকার কে এসে যা খুশি জিগ্যেস করবে বাড়ি চড়াও হয়ে, তার জবাব দিতে হবে? কী–ভেবেছে কী? মগের মুলুক?

মেঘেন গম্ভীর ও অপ্রস্তুত হয়ে থাকে। বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলেন–ভীষণ রেগে গেলেন দেখছি! প্লীজ, শান্ত হোন। আচ্ছা মেঘেনবাবু!

–উ?

–আপনার স্ত্রী গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে বাসায় ছিলেন? নাকি বেরিয়েছিলেন–আপনার কী ধারণা?

–ওকে জিগ্যেস করুন!

–আপনার ধারণাটাই আমি জানতে চাই।

হয়তো….

বলুন! বলুন!

–হয়তো ছিল, হয়তো বেরিয়েছিল। জানি না।

–তিথির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনি মাঠের দিকে গিয়েছিলেন তাই না?

মন্দিরা চেঁচাল। –কোনও কথা না! চুপ করে থাকো!

–মেঘেনবাবু!

–উ? হুঁ। তিথি আমাকে জরুরি কিছু কথা আছে বলে ডেকে নিয়ে গেল।

তারপর?

–কিন্তু তেমন কিছু বলল না। শুধু…

–! বলুন!

রাতকাটানোর আশ্রয় চাইল। বলল বাড়ি থেকে চলে এসেছে! আর ফিরবে না।

–আপনি কী করলেন তখন?

–আমি বললুম– আমার বাসায় তো অসম্ভব! তবে রামু সিগন্যালম্যানের কোয়ার্টার এখন খালি আছে। তিথি আপত্তি করল। তখন আমি ওই যে দেখছেন জঙ্গলের ওপাশে লাইনের ওপর খালি একটা ওয়াগনের সঙ্গে গার্ডের কামরা রয়েছে–ওইযে!

–হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছি।

ওটাই সিলেক্ট করলুম। রামুকে কিছু খাবার তৈরি করে দিতে বলেছিলুম। তিথি তা খায়নি। বিছানার তেমন ব্যবস্থা হলো না। একটা মাত্র শতরঞ্জি দিল রামু। একটা বাড়তি লণ্ঠন দিল।…মেঘেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বাসায় ফিরেছিলেন ঠিক কটায়?

–একটা প্রায়।

–তখন আপনার স্ত্রী ছিলেন?

মেঘেন মন্দিরার দিকে তাকাল। মন্দিরা মুখ ঘুরিয়ে মাঠ দেখছে। নাকের ফুটো কাঁপছে। চোখ দুটো লাল। চাপা শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছে।

মেঘেন বলেনা। তারপরই মাথাটা কয়েকবার দোলায়।

আপনার নিশ্চয়ই বাকি রাত ঘুম হয়নি?

হয়নি। জেগেই ছিলুম। কারণ রাত তিনটে চল্লিশের ডাউনে…

–থামবেন না, প্লীজ।

রাত ৩-৪০-এর ডাউনে কলকাতা যাবার কথা ছিল! তিথির সঙ্গে।

মন্দিরা চকিতে মেঘেনকে দেখে নিয়ে আবার মাঠের দিকে ঘুরল। বিশাল ঢেউ খেলানো মাঠ–শস্যহীন, বেশির ভাগই অনুর্বর রুক্ষ মাটি, দুরে টিলার সার এবং খড়কুটো উড়িয়ে ছোটখাট ঘূর্ণি হাওয়া চলেছে কোনাকুনি। কাছাকাছি ফণিমনসার ঝোপের গায়ে একটা সাপের খোলস উড়ছে, এক ফালি পতাকা যেন।

–কিন্তু শেষঅব্দি যাওয়া হলো না?

না। হলো না। মন্দিরা–আমার স্ত্রী আমাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছিল।

একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরা সাঁৎ করে ভেতরে চলে গেল। তারপর কয়েকটা সেকেণ্ড বারান্দায় স্তব্ধতা। পাখির ডাকও স্তব্ধতা বলে ভুল হয়। তারপর মাঠ থেকে ঘূর্ণি নিয়ে একটা বাতাস এসে বারান্দায় উঠল। দরজার পর্দা দুলিয়ে ঢুকে গেল ঘরে।

কখন উঠলেন মেঘেনবাবু?

–সাতটার কাছাকাছি।

–সেই গার্ডের কামরায় গেলেন না?

না।

–কোথাও গেলেন না?

গেলুম। ওই শালবনটায়। রোজ ভোরে ওখানে বেড়ানো অভ্যাস আছে। এক মিনিট স্তব্ধতা। তারপর…–তিথি কোথায় মেঘেনবাবু?

জানি না। মেঘেন মাথা দোলায়।

–গার্ডের কামরার মেঝেতে রক্ত পাওয়া গেছে মেঘেনবাবু।

মেঘেন সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে ওঠেনা না না! তিথি… না না!

–প্লীজ, আস্তে।

–গেট আউট! গেট আউট! চলে যান আপনি বেরিয়ে যান!….মেঘেন হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়ায়! গলা আরও চড়িয়ে চেঁচায়–গেট আউট!

-আমার আরও প্রশ্ন আছে মেঘেনবাবু!

শাট আপ। আপনাকে আমি খুন করে ফেলব। গেট আউট ইউ ওল্ড ফুল!

বৃদ্ধ হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ান। তারপর অমায়িকভাবে নমস্কার করে চলে যান।

তিনি বাঁদিকে স্টেশনের রাস্তায় ওঠেন। থমকে দাঁড়ান হঠাৎ। তারপর ফিরে আসেন বাঁজা জমিটার ওপর এবং মেঘেনের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে পশ্চিমের সেই শালবনে এগিয়ে যান।

বনের ভেতরে ঢুকে ছায়ায় সেই বৃদ্ধ দু’পকেটে হাত ভরে দাঁড়িয়ে আছেন। কুকুরটা তেমনি চুপচাপ শুয়ে আছে একই জায়গায়। মেঘেন তাকিয়ে দেখে। মাথার ভিতরটা খালি, দৃষ্টিতে ক্রমশ একটা নীল চওড়া কিছু এসে আটকে থাকে। একটু পরে তিনি নেমে আসেন। তারপর বাঁদিকে ঘুরে স্টেশনে চলে যান। মেঘেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

.

পরদিন মেঘেন স্টেশনে সকালের ডিউটিতে আছে, সেই বৃদ্ধ এলেন। স্টেশনের ভেতরে আর কেউ নেই। পশ্চিমের জানলার বাইরে কুয়োয় পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা জল তুলছে, কাপড় কাঁচছে, স্নান করছে। তার ওপাশে বেড়া, বেড়ার ওধারে কয়লার স্তূপ, দুটো কাক বসে আছে।

নমস্কার মেঘেনবাবু!

–আবার কী চান?

—অনেক কিছু।

কিছু বলার নেই আর।

–আছে। এক মিনিট। ..বলে তিনি পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে পাতা ওল্টান। তারপর একটা খালি চেয়ারে বসে পড়েন। মেঘেন টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

–মেঘেনবাবু, আপনি-সরি, আপনার সঙ্গে তিথি যতক্ষণ ছিল, এমন কোনও কথা বলেছিল কি যাতে আপনার স্ত্রীর উল্লেখ ছিল?

মেঘেন তেতো মুখে বলে খুবই থাকা উচিত।

–আমি পজিটিভ উত্তর চাই, মেঘেনবাবু।

–তাহলে ছিল।

–তিথি কি মন্দিরাদেবীর দ্বারা কোনও বিপদের আশঙ্কা করেছিল?

–তাই স্বাভাবিক।

–ঠিক কী ধরনের আশঙ্কা?

–আমি অন্তর্যামী নই।

–আপনি তিথিকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন বলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কী কিছু স্পষ্ট নির্দেশ ছিল?

তার মানে?

তার মানে-ধরুন, আপনি গিয়ে গার্ডের কামরার দরজায় নক করবেন, অথবা ডাকবেন–এমন কিছু?

–ডাকা নিরাপদ মনে করিনি! তিনবার নক করার কথা ছিল।

–দেখুন তিথির লাশ আমরা পেয়েছি।

–পেয়েছেন? মেঘেন প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

–হাওড়া এক্সপ্রেসের কামরায়। কিন্তু মাথাটা পাইনি।

–আমি লুকিয়ে রাখিনি। না, না!

বলছি না। মেঘেনবাবু, আপনার স্ত্রী তিথিকে খুন করেছে বলে মনে করেন?

–আমি কিছুই মনে করি না।

–কিন্তু আপনি সিওর যে আপনি নিজে তিথিকে খুন করেননি। কেমন?

না। সিওর নই। মেঘেন দৃঢ়কণ্ঠস্বরে জবাব দেয়!

–সিওর নন?

না।

বৃদ্ধ হাসেন। কয়েক সেকেণ্ড পরে বলেনতিথির পেটে বাচ্চা ছিল।

মেঘেন তাকায়। ঠোঁটে ফাঁক করে কিছু বলার জন্যে কিন্তু বলে না।

–ফোরেনসিক এক্সপার্টদের মতে তিথির মৃত্যু হয়েছে সে রাতে ঠিক বারোটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে কোনও একসময়ে। আর…আর তার দেহে সেক্সয়াল ইন্টারকোর্সের লক্ষণ স্পষ্ট পাওয়া গেছে। সেও ওইসময়ের মধ্যে ঘটেছে। মনে হয়, তিথি বাধা দিয়েছিল–পারেনি। এইতে সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যে কোনও পুরুষমানুষই খুনী। কিন্তু রেপ–হ্যাঁ, রেপই বলছি আপাতত-রেপ এবং খুন দুটো আলাদা ঘটনা হওয়া সম্ভব, অর্থাৎ যে খুন করেছে–সেই রেপ করেছে–এটা ঠিক হতেও পারে।

মেঘেন আবার ঠোঁট ফাঁক করে। কিন্তু কিছু বলে না।

গতকাল অন্তত দুপুরের মধ্যে এসব জানা গেলে আপনাকে আমরা নিয়ে যেতুম এবং মেডিক্যাল একজামিন করা হতো। কিন্তু টু লেট!

–আমি তিথির সঙ্গে শুইনি। সে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমরা চলে যেতে চেয়েছিলুম। তারও কারণ তিথি রথীনবাবুর নির্বাচিত বিগ অফিসারকে ফেলে সামান্য একজন এ. এস. এমের ঘর করবে–যার একটি বিবাহিতা স্ত্রীও রয়েছে, এটা রথীনবাবু বরদাস্ত করতেন না। আর মন্দিরা……

বলুন। মন্দিরা….

–মন্দিরাও তা বরদাস্ত করত না। তাছাড়া আইনও সইত না।

–তাই নিরুদ্দিষ্ট হতে চেয়েছিলেন দুজনে?

হুঁ।

–মেঘেনবাবু, আমাদের ধারণা, তিথির মুণ্ডুটা সম্ভবত বাক্সে ধরাতে পারেনি খুনী। তিথির মাথায় নাকি প্রচুর চুল ছিল। ওঁর মা বলছিলেন-বংশের ধারা।

-হ্যাঁ। খুব ঘন আর সুন্দর চুল ছিল ওর। ওতেই ওকে সুন্দর লাগত। নয়তো স্বাস্থ্য বা দেহের দিক থেকে মন্দিরার চেয়ে অনেক কুৎসিত ছিল তিথি।

–আপনি স্বাভাবিক হয়েছেন দেখে খুশি হলুম।

–তিথির আর এক সৌন্দর্য ছিল ওর অস্ফুট কণ্ঠস্বর। অর্ধেক বলা অর্ধেক না বলা কথা ওকে রহস্যময়ী করে রাখত। ওর শরীরে শরীর রাখলে ও ছটফট করতবারবার না না না বলত, কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত না, বারবার বলত– এ তুমি কী করছকী করছ তুমি–কেন এমন করছ….

–মেঘেনবাবু, আবার ধন্যবাদ যে আপনি এখন এত স্বাভাবিক।

হঠাৎ মেঘেন পকেটে হাত ভরে একটা মোড়ক বের করে। ব্যগ্রস্বরে বলে– খুলে দেখুন। এর মধ্যে তিথির কয়েক গোছা চুল আছে।

সে ব্যস্ত হয়ে মোড়ক খোলে। বৃদ্ধ শান্ত মুখে বলেন আই সি! কোথায় এ চুল পেলেন মেঘেনবাবু?

কাল ভোরে ওই শালবনের তলায়। শুকনো ঘাসে। তারপর….

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।

–আমি একখানে মাটির চাবড়া দেখলুম। কী খেয়াল হলো, সরালুম–দেখি তিথির মাথা! মাথাটা তুলে নিয়ে একদৌড়ে জঙ্গলে ঢুকলুম। ওদিকে একটা জলনিকাশী ন্যাচারাল ড্রেন আছে–রেল ব্রিজ আছে না? তার ষাট-সত্তর মিটার পুব-দক্ষিণে শুকনো বালির তলায় পুঁতে ছিলুম। তারপর ফিরে এসে শালবনের সেই গর্তটা বুজিয়ে দিলুম। কাঠকুটো কুড়িয়ে ছড়ালুম। খুব স্বাভাবিক দেখাল জায়গাটা।

বলে যান, প্লীজ।

কাল বিকেলে গিয়ে দেখি, তিথির মাথাটা জন্তুজানোয়ারে তুলে কোথায় নিয়ে গেছে। কিছু চিহ্ন পড়ে ছিল। আবার বালিতে ঢেলে দিলুম।

–কেন এমন করলেন?

মন্দিরার স্বার্থে।

–তাহলে মন্দিরাদেবীই খুন করেছেন–আপনার মতে?

কী? ও-হ্যাঁ। তাই মনে হয়।

–আপনার স্টেটমেন্ট অনুসারে মন্দিরাদেবীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে।

–ও! তাই বুঝি? কিন্তু…..আপনি কে? কে আপনি?

–মেঘেনবাবু, মন্দিরাদেবীকে এইমাত্র বিরক্ত করে এসেছি। তিনি অনেক কিছু বলেছেন।

-অ্যাঁ?

হ্যাঁ। উনি সব জানতে পেরেছিলেন। আপনাদের ফলো করে সেই গার্ডের কামরায় গিয়েছিলেন। রাত বারোটার পর আপনি কোয়ার্টারে আসার একটু আগেও উনি ওখানে লুকিয়ে ছিলেন। আপনি চলে এলে কিছুক্ষণ পরে উনি তিথির দরজায় তিনবার নক করেন। দরজা খোলে তিথি। পরস্পর তীব্র বচসা হয়। কিন্তু মন্দিরার কথামতো–সেটা কান্নায় শেষ হয়। শেষে নাকি মন্দিরা আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে চলে আসেন। আসার পথে রামুর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়। রামু ওখানে নাকি পায়খানায় গিয়েছিল। রামুকে ডাকুন না, প্লীজ।

রামু কাল বিকেলে ছুটি নিয়ে জংশনে গেছে। এখনও ফেরেনি। অথচ গতরাতেই ফেরার কথা ছিল। মোহনপুর বলছে, রামুকে কেউ দেখেনি সেখানে।

রামুর কথা আপাতত তাহলে থাক। আপনি নিজের কথা বলুন।

সবই তো বললুম—

–একটা ভাইটাল কথা এখনও বলেননি।

কী?

-রাত এগারোটা পাঁচের ডাউনে মোহনপুর জংশন থেকে একজন নামেন সে রাতে। তার কথা এড়িয়ে গেছেন।

অ্যাঁ! হ্যাঁ–তিথির বাবা নেমেছিলেন।

–আপনি তখন…..

–আমি তখন তিথির শতরঞ্জি বিছানা হাতে রামুর কোয়ার্টার থেকে বেরচ্ছি সবে–পিছনে তিথি আছে, প্ল্যাটফর্মে দেখতে পেলুম রথীনবাবুকে; তক্ষুনি আমরা চলে গেলুম মাঠের দিকে। ফিরে আসার পর রথীনবাবুকে আর দেখতে পাইনি।

–মিথ্যা বলছেন মেঘেনবাবু! গিরিধারী খালাসি আপনাকে ও রথীনবাবুকে কথা বলতে দেখেছিল।

–ও, হ্যাঁ। মনে পড়ছে।

-রাত একটায় রথীনবাবু আপ-সিগনালের দিকে যান। হাতে টর্চ ছিল! গিরিধারী যেতে চেয়েছিল সঙ্গে। ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গিরিধারী দেখেছে, রামু হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ে এসে তার কোয়ার্টারে ঢুকল। তার আগে গিরিধারী মেয়েলি গলায় একটা চিৎকার শুনেছিল দূরে।

রামু কি…..

আমার সিদ্ধান্ত, রামুই রেপ করে তিথিকে।

–স্কাউড্রেল!

-চুপ! আস্তে। গিরিধারী তার একঘণ্টা পরে রথীনবাবুকে ফিরতে দেখে। রথীনবাবু তাকে একটা জিনিস আনতে বলেন।

-ওঃ! একটা বাক্স।

–গিরিধারী সব কবুল করেছে, মেঘেনবাবু।

–কে খুন করেছে তিথিকে?

–ওর বাবা।

–ওঃ তিথি!

–আমার কাজ আপাতত শেষ! শুধু ভয় হচ্ছে, হয়তো রামুকেও…।

–ঠিক এসময় দুজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত ঢোকেনকর্নেল! লাশটা পাওয়া গেছে। ওই মাঠের নালায় পোঁতা ছিল। স্ট্যাবড বডি। ধস্তাধস্তি হয়েছিল সম্ভবত।

মেঘেন ভারি গলায় বলে রামুর লাশ!

দাড়িওলা বৃদ্ধ একটু হাসেন।-হ্যাঁ, রামুর। রথীনবাবু মেয়েকে খুন করলেন। আর আপনি–মেঘেনবাবু, আপনি করলেন রামুকে। মিঃ ভদ্র, হেয়ার ইজ দা সেকেণ্ড মার্ডারার।

মেঘেনের সামনে পুলিশ অফিসার এসে দাঁড়ায়।

ফাঁদ

এ সমুদ্রে অ্যালবাট্রস পাখি নেই। তবু একটা রেস্তোঁরা-কাম-বারের নাম অ্যালবাট্রস। ভারতের পূর্ব-উপকূলে এমন চমৎকার মিষ্টি স্বভাবের টাউনশিপই বা কটা আছে? সমুদ্রও এখানে বেশ শান্ত। মার্চের দক্ষিণবায়ু দুপুরের দিকে দাপাদাপি করলেও বিকেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঢেউগুলো খুব আড়ষ্ট হয়ে বালির বীচে শুয়ে পড়তে চাইছে। আমার জুতোর তলা একটুখানি ভিজে যাচ্ছিল। এটাই আমাকে সমুদ্রস্নানের আনন্দ দিল। আমার বৃদ্ধ সঙ্গী বলেন, অনেকের অনেকরকম আতঙ্ক থাকে। যেমন বেড়ালের জলাতঙ্ক। জানি, উনি আমাকেই ঠাট্টা করেন। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সমুদ্র যতই শান্ত হোক, সমুদ্র হচ্ছে সমুদ্রই। তার জল লোনা, বিশ্রী রকমের স্বাদ তার। আত্মহত্যার দরকার না হলে কখনও আমি সমুদ্রে নামব না।

যতক্ষণ বীচে জলের ধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে বেড়ালুম, আড়চোখে লক্ষ্য করে গেলুম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টুপি খুলে অ্যালবাট্রসের লনে বসে আছেন। তাঁর টাকের ওপর নারকেল গাছের ছায়ার ফাঁক দিয়ে রোদের চিরুনি চলছে–অবশ্য বৃথাই। উনি খুবই আলাপী, সদালাপী এবং গায়েপড়া–তা সত্ত্বেও এখনও কোনও আগন্তুক ওঁর পাশে বসে নেই। এতদিন বাদে ওঁকে দারুণ একলা দেখাচ্ছিল। আমার মায়া জাগছিল।

পিছনে পাহাড়ের আড়ালে সূর্য নেমে গেলে সমুদ্রে এতক্ষণে রঙের খেলা শুরু হলো। এই দৃশ্যের বর্ণনা ভাষায় দেওয়া যায় না, ছবি এঁকে খানিকটা যা অনুসরণ করা যায়। আমি না লেখক, না ছবি আঁকিয়ে–নিতান্ত সাংবাদিক। এই ব্যাপারটার রিপোর্টাজ লিখতে হলে আমার চাকরি রাখা কঠিনই হতো। আমি রিপোর্টার। আমার চিফ বলেন, জয়ন্তের মেটিরিয়াল থাকে–কলম থাকে না এবং এটাই হচ্ছে ট্রাজেডি।

মিনিট পাঁচেক ওই রঙের খেলা দেখে চোখ ব্যথা করতে থাকল। তখন ঘুরে দাঁড়ালুম এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য উপকূলনগরীকে রহস্যময় অন্ধকারে ডুবে থাকতে দেখলুম। চোখ পিটপিট করে সেই অন্ধকারকে তাড়াতে চাইছি, এমন সময় পাশ থেকে কে বলে উঠল–কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাঙালী?

বাঙালী ব্যারাম আমারও একটু-আধটু আছে। তবে সেজন্য নয়, যার প্রশ্ন তিনি এক মহিলা। এটাই আমাকে অসাধারণ ভব্য করে তুলল। রঙচমকানো চোখের অস্বচ্ছতায় একটা শাড়িপরা মূর্তি ভেসে উঠল। বললুম–আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি……

-নমস্কার। আমি…..আমি কলকাতা থেকে এসেছি। আমি একটু বিপদে পড়েছি–একটু সাহায্য পেতে পারি কি?

চোখের স্বচ্ছতা তখনও ফেরে নি। তাই মুহূর্তে মাথায় এল, নির্ঘাৎ কিছু ভিক্ষেটিক্ষে চাইবার ব্যাপার ঘটছে। তক্ষুণি গম্ভীর হয়ে বললুম–বিপদ! কী বিপদ?

–আমার স্বামীকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।

হাসি চেপে বললুম–খুঁজে পাচ্ছেন না? আপনার স্বামীকে? তার মানে?…..

–হ্যাঁ। আমরা এখানে এসেছি গতকাল সন্ধ্যায়। তারপরেই এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল, খুব ভয় পেয়ে গেলুম। উনি অবশ্য গ্রাহ্য করলেন না। আজ দুপুরে খাওয়ার পর উনি আসছি বলে বেরিয়ে গেলেন। তখন প্রায় একটা বাজে। এখন পাঁচটা। দেরি দেখে সম্ভবপর সব জায়গায় খুঁজলুম, কিন্তু কোন খোঁজ পেলুম না। আমার বড় ভয় হচ্ছে……

বলেই ভদ্রমহিলা যেন কান্নার আবেগ সামলাতে থেমে গেলেন। ততক্ষণে আমার চোখ থেকে রঙের ভেলকি ফুরিয়ে গেছে। দৃষ্টি স্পষ্ট হয়েছে। দেখলুম, মহিলার বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হতেই পারে না, মোটামুটি ফর্সা রঙ, হালকা গড়ন কিন্তু চেহারা মন্দ না, চোখ দুটো টানাটানা এবং দুটো শক্তিশালী ভুরুর প্রশস্তে একটু প্রগলভও বটে। বড়লোকের বউ বলে মনে হলো না। আবার গরীব বা নিম্নমধ্যবিত্তও নয়। ব্যক্তিত্ব আছে এবং তাই তাঁর বিবরণে কোনও ফাঁকি থাকতে পারে না।

রহস্যের গন্ধে চঞ্চল হয়ে উঠলুম। আড়চোখে দূরে অ্যালবাট্রসের লনে কর্নেলকে দেখে নিলুম। উনি যেন চোখ বুজে ঝিমুচ্ছেন।

বললুম–খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো! কিন্তু আপনার স্বামী তো মাত্র চার ঘণ্টা আগে বেরিয়েছেন–কোথাও নিশ্চয় কোনও জরুরী কাজে আটকে পড়েছেন। এতে ভাববার কারণ আছে বলে তো মনে হয় না। আরও কিছুক্ষণ দেখুন না–নিশ্চয় ফিরে আসবেন। আর…ইয়ে, আপনার স্বামীর নামটা জানতে পারি?

পুলকেশ মৈত্র। আমি তৃণা মৈত্র।

–আমি জয়ন্ত চৌধুরী।…একটু ইতস্তত করে কেন কে জানে বলে ফেললুম আপনি প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবকের নাম নিশ্চয় জানেন। আমি ওই কাগজের রিপোর্টার।

শুনে তৃণা মৈত্র উজ্জ্বল মুখে বলল–আপনি রিপোর্টার? জয়ন্তবাবু, প্লীজ, এ বিপদে আমাকে সাহায্য করুন একটু। এখানে এসে একজনও বাঙালী দেখতে পেলুম না। তাই বিশ্বাস করে কাউকেও কথাটা বলতে পারিনি। হঠাৎ দূর থেকে আপনাকে দেখে কেন যেন মনে হলো… ।

বাধা দিয়ে বললুম–আপনার স্বামীর বিপদ হয়েছে, একথা ভাবছেন কেন?

তৃণা বলল–ভাবতে বাধ্য হচ্ছি জয়ন্তবাবু। বললুম– না, গতকাল সন্ধ্যা থেকে এমন কতকগুলো ব্যাপার ঘটল–যাতে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলুম। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনও বিপদ ঘটবে। ওকে বারবার বললুম– চলো-আমরা ফিরে যাই। ও শুনল না।

আপনারা কি এই প্রথম নীলাপুরমে এলেন? উঠেছেন কোথায়?

–হ্যাঁ। এই প্রথম। আমরা উঠেছি সি ভিউ হোটেলে।

–কোন বিশেষ কাজে, নাকি বেড়াতে?

–বেড়াতে।…বলে তৃণা ব্যস্ততার ভাব দেখাল–জয়ন্তবাবু, আপনাকে আমি সবই বলব। এখন ওকে খুঁজে বের করতে আমায় একটু সাহায্য করুন।

চিন্তিত মুখে বললুম–তাহলে একটা কাজ করা যেতে পারে। থানায় যাওয়া যাক। কী বলেন? পুলিশকে সবটা জানানো দরকার। তারপর…।

তৃণা বাধা দিয়ে বলল–না। প্লীজ! পুলিশকে আগেভাগে সব জানাতে গেলে অনেক গোলমালে পড়ে যাব।

–কিন্তু পুলিশের সাহায্য ছাড়া আমরা কতটুকু কী করতে পারি বলুন? আমিও তো এখানে নতুন এসেছি।

তৃণা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল নীলাপুরম জায়গাটা তো ছোট্ট। আমি একা খুঁজে বেড়াতে সাহস পাচ্ছি না। পেতুম–যদি কাল রাতে ওই ব্যাপারগুলো না ঘটত! আপনি আমার সঙ্গে থাকলে আমার একটুও ভয় করবে না। প্লীজ, জয়ন্তবাবু!

এ একটা বিচিত্র ব্যাপার সন্দেহ নেই। একলা হলে নিশ্চয় এমন সহজ শান্ত স্বরে কথা বলতে পারতুম না। উদ্বেগে অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে পড়তুম। কিন্তু হাতে আমার তুরুপের তাস আছে রহস্যভেদী বৃদ্ধ বন্ধু। ওঁর সঙ্গেই বেড়াতে এসেছি নীলাপুরমে। অমন ধুরন্ধর সাহসী প্রাজ্ঞের ব্যাকগ্রাউণ্ডে থেকে আমি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারি।

কিন্তু উনি আপাতত বাইরে থাকুন। দৈনিক সত্যসেবকের প্রখ্যাত ও দুঁদে রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরী কি এত নাবালক যে এক ভদ্রমহিলার হারানো স্বামীর খোঁজে বেরিয়ে পড়তে পারবে না? অবশ্য, এমনও হতে পারে যে পথেই পুলকেশ মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! ব্যাপারটা চুকেও গেল।

পা বাড়িয়ে পর মুহূর্তে একটু আড়ষ্ট হলুম। কী ঘটেছিল গতরাতে? এক্ষুণি পথে যেতে যেতে নিশ্চয় জেনে নেব। সেটা কতটা বিপজ্জনক হবে কে জানে! যদি, সত্যি সত্যি তেমন কিছু হয়, তাহলে পরিণামে কর্নেলকে ডাকতেই হবে।

বীচের উপরে পাথরের চাঙড়! তার উপরে বাঁধ। বাঁধের পরে একটা পাহাড়ের ঢালু গায়ে  অ্যালবাট্রস। তার পাশ দিয়ে একফালি পিচের পথ পাহাড়ের কাঁধ বরাবর এগিয়ে ওদিকে নেমে গেছে বড় রাস্তায়। পিচের সরু পথের দুধারে বড় বড় পাথর আর ঝোপঝাড়। সাবধানে ডানদিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলুম। কর্নেল আমাকে দেখতে পেলেন বলে মনে হল না। যতক্ষণ পাহাড়টা না পেরোলুম দুজনে কোনও কথা হলো না। বড় রাস্তার দুধারে সমতল জমিতে টাউনশিপ ও ছোট্ট বাজার। সেখানে পা দিয়ে মুখ খুললুম–দেখুন মিসেস মৈত্র, সবার আগে আমাদের একটা প্ল্যান করে নেওয়া দরকার। খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার কোনও মানে হয় না। মিঃ মৈত্রের কি এখানে পরিচিত কেউ আছে? মানে–ওঁর মুখে তেমন কিছু কি শুনেছিলেন?

তৃণা মাথা নেড়ে বলল-না।

–তাহলে খুঁজবটা কী ভাবে?

তৃণার মুখটা করুণ দেখাল। সে বলল–চলুন না, ওইসব লোককে জিগ্যেস করে দেখি। কারো না কারো সঙ্গে নিশ্চয় দেখা হয়েছে ওর। ছোট্ট জায়গা। বাঙালী তো নেই-ই।

হাসি পেল। হাসিটা চেপে বললুম–আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে উনি এতক্ষণ হোটেলে ফিরেছেন! চলুন না–হোটেলে আপনাদের রুমটা আগে দেখে আসি।

তৃণা একটু চঞ্চল হলো। বলল–ঠিক বলেছেন। আমার মাথা ঘুরছে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! কিছু ভাবতে পারছিনে। চলুন, চলুন! কথাটা সত্যি আমার মাথায় আসেনি।

সে ব্যস্ত হয়ে বড় রাস্তা ধরে এগোল। ‘সী ভিউ’ হোটেল পাহাড়ের উত্তর দিকে। ‘অ্যালবাট্রস’ পূর্বে। অ্যালবাট্রস থেকে ওখানে যাওয়ার পথ নেই, যদিও বাড়ির মাথা নজরে পড়ে। আমরা অবশ্য উঠেছি সরকারী ডাক বাংলোয়। সেটা সমুদ্রের ধারে আরও খানিকটা উত্তরে সমতল জমির ওপর। তার পিছনে সরকারী জঙ্গল আছে।

বাজারের মাঝামাঝি গিয়ে ডানদিকে, অর্থাৎ পূর্বে ঘুরে আগেরটার মতো সরু পিচের পথে উঠলুম। কিছু দূরে চড়াই ভেঙে উঠতে হলো। এখানে ওখানে সুদৃশ্য কিছু বাড়ি আছে। মাঝেমাঝে গাড়ি আসছে যাচ্ছে। লোকজনের ভিড় আছে। বীচের দিকে চলেছে বা ফিরে আসছে। বছরের এসময়টা সমুদ্র-বিলাসীদের ভিড় থাকে এখানে।

সী ভিউয়ের লাউঞ্জে ঢুকে তৃণা হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল রিসেপশনিস্ট মহিলাকে–গুড ইভনিং মিস আয়ার। আমার স্বামী মিঃ মৈত্র ফিরেছেন?

গোমড়ামুখী দক্ষিণভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গী ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর কি-বোর্ড থেকে চাবিটা দিলো। তৃণা চাবি নিয়ে ব্যস্তভাবে পা ফেলল। কার্পেটমোড়া সিঁড়ি। দোতালায় তের নম্বর ঘরের দরজার সামনে সে একটু দাঁড়াল। হতাশভাবে মাথাটা দোলাল। মুখে ঘামের বিন্দু লক্ষ্য করলুম। নিঃশব্দে আমার দিকে তাকাল একবার। যেন বলল–দেখলেন তো ও ফেরেনি!

দরজা বাইরে থেকে বন্ধ আছে। অতএব ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু কী যেন ভাবল তৃণা। অস্ফুটস্বরে বলল–এক মিনিটের জন্যে আসবেন? সমস্ত ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে আগে বলা দরকার।

সে দরজা খুলল। ঢুকে আবার বলল–আসুন!

ভিতরে ঢুকে তাজ্জব বনে গেলুম। সী ভিউ হোটেলের খ্যাতির কথা জানা ছিল। কিন্তু এই ছোট্ট নীলাপুরমের সমুদ্রতীরে কখনও পাঁচতারা মার্কা বড় হোটেলের ব্যবস্থা আশা করিনি। মৈত্র দম্পতির এই সুইটের মাঝে সবটা নকশি কার্পেটে মোড়া এবং জুতো কয়েক ইঞ্চি দেবে যায়। ড্রয়িং রুম আর বেডরুম নিয়ে রীতিমতো অ্যাপার্টমেন্ট। দেয়ালে দেশী-বিদেশী আর্ট, কোণায় কোণায় অপূর্ব সব ফুলদানি এবং দামী আসবাবপত্র। আমার এই ভাবটা আঁচ করেই হয়তো তৃণা বলল–আমার স্বামী একটু বিলাসী-প্রকৃতির মানুষ। আপনি বসুন প্লীজ।

সে পুবের ব্যালকনির দিকে দরজা খুলে দিতেই সারা সমুদ্র ভেসে উঠল। কাছাকাছি একটা সোফায় বসে পড়লুম। সেই সময় হঠাৎ মনে হল, এখনই যদি মিঃ মৈত্র ফিরে আসেন, তৃণার উদ্বেগ ঘুচবে–কিন্তু আমি পড়ে যাব অস্বস্তিতে। কোনও স্বামীই এই অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে অচেনা পুরুষকে দেখে খুশি হবে না। বিশেষ করে ঘরে যখন আর কেউ নেই এবং দরজাটা বন্ধ।

তাই, এই সান্নিধ্য যতই ভাল লাগুক কিংবা পরিবেশ যত প্রীতিপদ হোক, শীগগির কেটে পড়া উচিত। বললুম–যাক গে। এবার সংক্ষেপে বলুন তো গতরাতে কী হয়েছে?

তৃণার কপালে ভাঁজ দেখা দিলো। তাকে অবশ্য চঞ্চল দেখাচ্ছিল বরাবর। সে বলল–হ্যাঁ, বলছি। গত সন্ধ্যায় আমরা এখানে এসে উঠলুম। ঘরেই ডিনার সার্ভ করার ব্যবস্থা আছে–সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু ও বলল–নিচের ডাইনিং হলে যাবে। চেনাজানা কেউ আছে নাকি দেখবে। ওর স্বভাবই এ রকম। সব সময় হুল্লোড় পছন্দ করে। ড্রিংক করার অভ্যেসও আছে।

তৃণা এই কথাগুলো বলার সময় পুবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিল। নীচে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে আবার বেমক্কা ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে গেছে। ওই অংশটা পাথরের চাতালের মতো। তার নীচে খাড়া দেয়াল, দেয়াল ছুঁয়ে বালির বীচ। সে কথা থামিয়ে হঠাৎ সেদিকে কী যেন দেখতে থাকল।

হেসে বললুম–কী? মিঃ মৈত্রকে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়?

তৃণার মুখে কিন্তু অন্য ভাব। কেমন ভয়ার্ত চাহনি। ঠোঁট কাঁপছে মনে হল। সে ঘুরে চাপাস্বরে বলল–সেই লোকটা! বাইনোকুলার চোখে দিয়ে এদিকে কী দেখছিল। এইমাত্র সরে গেল।

চমকে উঠেছিলুম। বললুম–কে? কোন লোকটা?

তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে বাইনোকুলারওয়ালা কোন বদমাশকে দেখব বলে উঠতেই তৃণা সেদিককার দরজা বন্ধ করে দিলো। কাঁপতে কাঁপতে বললনা, না! আমার বড্ড ভয় করছে। আপনাকে মিঃ মৈত্র ভেবে যদি গুলি ছুঁড়ে বসে!

উত্তেজিত হয়ে বললুম–কেন গুলি ছুঁড়বে? ব্যাপারটা কি?

তৃণা বলল বলছি, সব বলছি। আপনি বসুন প্লীজ। একটু…একটু স্থির হতে দিন!

তার চেহারা লক্ষ্য করে ঘাবড়ে গেলুম। সে কাঁপছে, মুখটা সাদা হয়ে গেছে। টলতে টলতে সোফার কাছে এসে দাঁড়ালে বললুম–মিসেস মৈত্র! আপনি একটুও ভয় পাবেন না, অন্তত আমি থাকতে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি বসুন। বসে সব বলুন।

তৃণা বসল না। ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে তাকাল শুধু।

বললুম–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কারণ, শুধু আমি নই–আমার সঙ্গে নীলাপুরমে যিনি এসেছেন, তার নাম আপনি শুনে থাকবেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।

তৃণা বলে উঠল–তার মানে, গোয়েন্দা?

-হ্যাঁ। অ্যালবাট্রসের লনে নিশ্চয় কোনও টাকমাথা বুড়ো ভদ্রলোককে দেখে থাকবেন! মুখে সাদা দাড়ি আছে। ইউরোপীয়ান বলে ভুল হতে পারে কিন্তু।

–যেন দেখেছিলুম!..হ্যাঁ, হা–দেখেছি।

–উনিই আমার ফ্রেণ্ড ফিলসফার অ্যাণ্ড গাইড বলতে পারেন। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। এক্ষুণি ওঁকে আমি খবর দিতে পারি। দেব?

তৃণা একটু ভেবে বলল–দেখুন, আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে এত শীগগির হইচই করলে নিশ্চয় আমাদের কোনও ক্ষতি হবে। আপনি আগে সবটা শুনুন। তারপর যদি মনে হয়, তাকে জানানো দরকার–জানাব।

বেশ, বলুন।

তৃণা নড়ে উঠল হঠাৎ। করুণ ধরনের হাসল–ওই দেখুন! আমি কী ভীষণ অভদ্র! আমার ঘরে গেস্ট-আর আমি সব ভদ্রতা ভুলে বসেছি! এক মিনিট!

বলে সে কোণার টেবিল থেকে ফোনটা তুলল। তারপর আমার দিকে ঘুরল। মুখটা আবার ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

একটু বিস্মিত হয়ে বললুম–কী ব্যাপার?

ফোনটা রেখে সে ব্যস্তভাবে বলল–আশ্চর্য তো! ফোনটা ডেড।

–ডেড?

–হ্যাঁ। এক মিনিট…আমি দেখছি করিডরে বেয়ারারা কেউ আছে নাকি!

সে দরজার দিকে যাচ্ছে দেখে বললুম–কলিং বেল নেই?

–তাই তো! সরি!…বলে তৃণা কাছেই দেয়ালে সুইচ টিপল।

কোনও শব্দ শোনা গেল না। আরও কয়েকবার টিপল, তবুও না। সে আমার দিকে ফ্যাকাশে মুখে তাকাল। আমি ততক্ষণে বেশ ঘাবড়ে গেছি। বললুম–আশ্চর্য তো! আচ্ছা–দেখছি!

উঠে আলোর সুইচ টিপলুম। জ্বলল না। সেই সময় চোখে পড়ল সুইটে এয়ার কনডিশানের ব্যবস্থা আছে। হন্তদন্ত হয়ে যন্ত্রটার চাবি ঘোরাতে শুরু করলুম। কোনও সাড়া নেই। তখন ঘুরে বললুম–লোডশেডিং চলছে না তো?

তারপর দেখলুম তৃণা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

বাইরে রোদ মুছে গেছে ততক্ষণে। ঘরের ভিতরটা ধূসর হয়ে উঠেছে। ব্যালকনির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে তৃণার অপেক্ষা করতে থাকলুম। একটা রহস্যময় ঘটনার মধ্যে এসে পড়েছি, তাতে কোনও ভুল নেই। মনে মনে কর্নেলের উদ্দেশে বললুম–ওহে বৃদ্ধ ঘুঘু, তুমি সব সময় আমাকে অতি বুদ্ধিমান বলে ঠাট্টা করো। আমি গোয়েন্দা হলে নাকি বিস্তর ওলট-পালট কাণ্ড ঘটবে! এবার তুমি বসে বসে দেখবে, গোয়েন্দা হবার এবং রহস্যের পর্দা ফাঁস করবার মতো বুদ্ধি জয়ন্তের ঘিলুতে প্রচুর পরিমাণেই আছে। মাননীয় গোয়েন্দামহোদয়! অপেক্ষা করো এবং দেখ!

কিন্তু তৃণা ফিরছে না। পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করেও তার কোনও পাত্তা নেই। তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি শুরু করলুম। সেই সময় একটা আইডিয়া মাথায় এল। এখন তো তদন্তের চমৎকার সুযোগ হাতে পাওয়া গেছে। এই দম্পতির ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানার মতো কোনও জিনিস কি সুইটে নেই?

যেমন কথাটা মাথায় আসা, অমনি বেডরুমে ঢুকে পড়লুম। চমৎকার আধুনিক উপকরণে সাজানো ঘর। সঙ্গে টয়লেট। তার দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। আলো খুব কম। কিন্তু ওই ফাঁকে স্পষ্ট একজোড়া জুতো-পরা পা দেখতে পেলুম। পাদুটো মেঝেয় শুয়ে থাকা মানুষের।

বুকের মধ্যে রক্ত শিসিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। এক লাফে এগিয়ে দরজাটা পুরো ফাঁক করতেই যা দেখলুম, তাতে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।

সুটপরা এক ভদ্রলোক চিত হয়ে পড়ে আছেন। কপালে দুটো রক্তাক্ত ক্ষত। একপাশে একটা রিভলভার পড়ে আছে।

ওটা মৃতদেহ তাতে কোনও ভুল নেই। প্রথমে ঝোঁকের বশে রিভলভারটা তুলে নিলুম। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম সেটার দিকে। কেন এমন করলুম, জানি না।…

.

অ্যালবাট্রসের লনে বেঞ্চে বসে শেষ বেলায় দরদর করে ঘামছি আর কর্নেল আমাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। যন্ত্রের মতো জবাব দিচ্ছি। গোড়ায় উনি হাসছিলেন। ক্রমশ দেখলুম, ওঁর হাসিটা মিলিয়ে গেল। গম্ভীর মুখে বললেন–তাহলে রিভলভার তুমি হাতে নিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

-কেন?

–এমনি। হঠাৎ যেন পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হল।

–বোকার মতো কাজ করেছ ডার্লিং!

–সে তো এখন বেশ বুঝতে পারছি।

–আসার সময় করিডরে কেউ তোমাকে বেরিয়ে আসতে দেখেনি?

–সম্ভবত না।

–সম্ভবত কেন?

–তখন তো আমি ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসছি। খুঁটিয়ে দেখার মতো মনের অবস্থা ছিল না।

–সিঁড়িতে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে?

-হ্যাঁ। একজন বেয়ারার সঙ্গে। সে চায়ের ট্রে নিয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গে তার একটু ধাক্কা লাগে।

কর্নেল আরও গম্ভীর হয়ে বললেন–রিসেপশনে মিসেস মৈত্রের সঙ্গে দেখা হয়নি বলছ। রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে ওঁর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?

না। তখন আমার মনের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন।

কর্নেল আপনমনে মাথা দোলালেন। তারপর বলেলেন–খুব বোকার মতো কাজ করেছ, জয়ন্ত। তুমি এমন বোকামি করবে, তা ভাবাই যায় না। পারিপার্শ্বিক এভিডেন্সে তোমাকেই খুনী সাব্যস্ত করা এখন খুবই সহজ।

শিউরে উঠে বললুম–সর্বনাশ!

–রিভলভারে তোমার আঙুলের ছাপ রয়েছে। কাজেই জজসাহেব তোমাকে অনায়াসে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারেন।

এই অব্দি শুনেই আঁতকে উঠে বললুম–ওরে বাবা! তাই তো!

কর্নেল এবার উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়িয়ে বললেন–দেখা যাক কী করতে পারি!

দুজনে অ্যালবাট্রসের লাউঞ্জে ঢুকে সোজা রিসেপশনে গেলুম। তারপর কর্নেল ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। আমি উদ্বিগ্ন মুখে কাচের দেয়ালের বাইরে সমুদ্র দেখতে থাকলুম। হঠাৎ চোখে পড়ল, বাঁদিকে দূরে সমুদ্রের খাড়ির উপর পাথরের চাতালে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখে বাইনোকুলার। সমুদ্রের দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে সে কী যেন দেখছে। তৃণা যাকে সী ভিউ থেকে দেখেছিল, নিশ্চয় ওই লোকটা সেই। ওখানেই তো পাহাড়ের পিঠে সী ভিউ হোটেলটা রয়েছে–এখান থেকে যদিও সেটা দেখা যাচ্ছে না। তৃণা বলেছিল– লোকটা গুলি ছুঁড়তে পারে। কিন্তু তৃণাই বা হঠাৎ উধাও হলো কেন?…।

কর্নেলের ডাকে সংবিত ফিরল। চাপাস্বরে বললুম– কর্নেল! এই দেখুন সেই লোকটা!

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন জয়ন্ত, থাক্। আর গোয়েন্দাগিরি, করতে যেও না। কেউ বাইনোকুলার দিয়ে কী দেখছে, তাতে আপাতত তোমার কিছু সুবিধে হবে না। এখন চলো, আমরা সী ভিউতে যাই। পুলিশ অফিসাররা এখনই সেখানে এসে পড়বেন।

ইতস্তত করে বললুম–কিন্তু আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?

হ্যাঁ। তোমার গ্রেফতার হবার সম্ভাবনাটা তো আছেই।

বুক ঢিপঢিপ করতে থাকল। বললুম–তাহলে আমি বরং ঘরে গিয়ে থাকি।

–মোটেও না।…বলে কর্নেল আমার ডানহাতের কবজি চেপে ধরলেন এবং বলির পাঁঠার মতো আমাকে টানতে টানতে বেরোলেন।

আগের রাস্তা দিয়ে ঘুরে আমরা সী ভিউ পৌঁছলুম। কিন্তু এখন সেখানে অন্য দৃশ্য। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে আছে। ভিড়টা চাপাগলায় কী সব আলোচনা করছে। মাদ্রাজী রিসেপশনিস্ট মিস আয়ার শুকনো মুখে ফোন ধরে কার সঙ্গে কথা বলছে। বেয়ারারা সিঁড়িতে হন্তদন্ত হয়ে উঠছে আর নামছে। কলে মিস আয়ারকে কিছু বলার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করছেন, এমন সময় একজন বেয়ারা আমার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল–এই লোকটা! এই লোকটা! মিস আয়ারও ঘুরে আমাকে দেখেই বলে উঠল-মাই গড! এই তো সেই লোক!

অমনি বেয়ারার দল তুমুল হইচই করে আমাকে ঘিরে ফেলল। দারোয়ানকেও দেখলুম এগিয়ে আসতে। আমি বিকট চেঁচিয়ে বললুম–আমি নই, আমি নই!

ভিড়সুদ্ধ পাল্টা চেঁচালো–পাকড়ো! পাকড়ো! শালা খুনীকো পাকড়া!

ভয়ে চোখ বুজে ফেললুম। মুখের সামনে অনেকগুলো হাতের মুঠো নড়ছিল। প্রচণ্ড মার আমাকে দেবেই–এই ভয়েই চোখ বুজে ফেললুম। অমনি শুনি কর্নেল তাঁর সামরিক গর্জনে সী ভিউকে যেন ফাটিয়ে দুভাগ করে ফেললেন–খবর্দার! যে যেখানে আছেন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। যা করার, পুলিশকে করতে দিন।

মারমুখী ভিড়টা হকচকিয়ে গেল। তারপর দেখি, লন থেকে কয়েকজন পুলিশ অফিসার আর কনেস্টবল হন হন করে এগিয়ে আসছে। একজন অফিসার কর্নেলের সামনে এসেই হাত বাড়ালেন–হ্যাল্লো ওল্ড বস! এবারও দেখছি, আসামাত্র খুন খারাপি করে ফেলেছেন!

কর্নেল একটু হেসে করমর্দন করে বললেন–হ্যাঁ, মিঃ বেঙ্কটেশ! এই আমার ভাগ্য। যেখানে যাই, সেখানেই এক ইটার্নাল মার্ডারার আড়াল থেকে একটা ডেডবডি সামনে ফেলে দিয়ে তামাশা করে।

বেঙ্কটেশ বললেন–তাই বটে! চলুন, দেখি।…

বেয়ারারা আগে আগে উঠতে থাকল। তিনজন পুলিশ অফিসার, কর্নেল আর আমি তৃণা মৈত্রদের ঘরে চললুম। নীচে দুজন অফিসার আর কনেস্টবলরা রয়ে গেল। আর কাউকেও উঠতে দেওয়া হলো না।

সেই ভয়ঙ্কর ঘরে ঢুকতেই আমার দম আটকে এল। তবে একদিক থেকে আশ্বস্ত বোধ করছিলুম যে বেয়ারাদের করিডরে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওরা আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে এখনও খুব ছটফট করছে নিশ্চয়। ভাগ্যিস, কর্নেল সঙ্গে আছেন।

বাথরুমে লাশটা তেমনি পড়ে আছে। কিন্তু এবার নতুন দৃশ্য চোখে পড়ল। লাশের ওপর মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে আছে সেই তৃণা মৈত্র। বেঙ্কটেশ ঝুঁকে ওর নাড়ি দেখে নিয়ে বললেন–শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। মিঃ আচারিয়া! আপনি দেখুন–ডাক্তার এলেন নাকি।

একজন অফিসার তক্ষুণি চলে গেলেন। কর্নেল ও বেঙ্কটেশ তৃণাকে সাবধানে তুলে সংলগ্ন বেডরুমের খাটে শুইয়ে দিলেন। কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। ওই গ্লাসে জল ঢালো।

কর্নেলের হুকুম তামিল করছি, সেই সময় বাথরুমে বেঙ্কটেশের কথা শুনে চমকে উঠলুম। কী আশ্চর্য। এটা দেখছি একটা খেলনা রিভলভার।

কর্নেল বললেন–টয় রিভলভার? মাই গুডনেস!

–হ্যাঁ, কর্নেল সরকার।

–ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো।…বলে কর্নেল আমার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে তৃণার মুখে জলের ঝাপটা দিলেন।

একটু পরেই তৃণা চোখ খুলল। অস্বাভাবিক লাল চোখ। নিষ্পলক তাকিয়ে সে কর্নেলকে দেখল। তারপর আমাকে দেখেই আর্তনাদ করে উঠল–ওই, ওই লোকটা ওকে খুন করেছে। পুলিশ! পুলিশ!

আঁতকে উঠে বললুম–ছি ছি! কী সব যা-তা বলছেন। আপনিই তো আমাকে…..

বেঙ্কটেশ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়েছেন। কর্নেল চোখ টিপে আমাকে থামতে ইশারা করলে আমি থেমে গেছি। তৃণা দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদতে থাকল। কান্নার মধ্যে যা বলছে, তা একটু একটু বুঝতে পারছি। এখনও কেন আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই অভিযোগ করছে সে। এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলুম, কিন্তু এবার রাগ এসে সাহস বাড়াল। মনে মনে বললুম–—শয়তানী, এ সবই তোমার ষড়যন্ত্র। নিজের স্বামীকে এভাবে খুন করিয়ে কারও কাঁধে চাপাবার মতলব করেছিলে। সেই মতলবে তুমি সী বীচে গিয়ে উপযুক্ত লোক খুঁজছিলে। আমিও বোকার মতো তোমার ফাঁদে ধরা দিতে এসেছিলুম। রোস, তোমার মজা দেখাচ্ছি।

কর্নেল বললেন মিঃ বেঙ্কটেশ, একটু পরেই ব্যাকগ্রাউণ্ডটা আপনাকে জানাব। আপাতত আপনি আপনার কর্তব্য করতে থাকুন।….

.

সী ভিউয়ের গ্রাউণ্ড ফ্লোরে রিসেপশনের পিছনে ম্যানেজারের ঘর। ম্যানেজার ভদ্রলোক বাইরে গিয়েছিলেন। এসে সব দেখে শুনে অনবরত ঠক ঠক করে কাঁপছেন। ওঁর ঘরেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমার স্টেটমেন্ট ও জেরাপর্ব চুকে যাবার পর তৃণা মৈত্রকে ডাকা হলো। তখন সাড়ে ছটা। বাইরে সমুদ্র অন্ধকারে গর্জন করছে। হোটেলের সবগুলো আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৃণা আস্তে আস্তে মিস আয়ারের কাঁধে হাত রেখে ঘরে ঢুকল। মিস আয়ার চলে গেলে বেঙ্কটেশ বললেন বসুন মিসেস মৈত্র। খুব দুঃখিত আমি আপনার মনের অবস্থা জেনেও আপনাকে বিব্রত করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কর্তব্য। তাই ক্ষমা করবেন।

তৃণা বসে বলল বলুন, কী জানতে চান?

–আপনারা কবে এসেছেন এখানে?

–সে তো হোটেলের রেজিস্টারে পাবেন। গতকাল সন্ধ্যা ছটা নাগাদ।

–আপনি জয়ন্তবাবুকে বলেছিলেন, আপনার আসার পর কী সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কী ঘটনা?

তৃণা একটু ভেবে নিল যেন। তারপর বলল কাল রাতে দুবার আমাদের দরজায় কে নক করেছিল। উনি দুবারই দরজা খুললেন, কিন্তু কাকেও দেখতে পেলেন না। প্রথমবার রাত ন’টায়, দ্বিতীয়বার সাড়ে দশটায়। আজ সকালে ব্যালকনিতে দুজনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল একটা লোক খাড়ির উপরে পাথরের চাতাল থেকে বন্দুক তাক করছে। উনিই দেখতে পেলেন। অমনি আমাকে টেনে বসে পড়লেন। সেই অবস্থায় গুঁড়ি মেরে আমরা ঘরে ঢুকলুম। উনি ভীষণ কাঁপছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করেও কোনও জবাব পেলুম না।

-বেশ। তারপর? আর কী ঘটনা ঘটল, বলুন।

নীচের ডাইনিংয়ে আজ দুজনে লাঞ্চ খেতে এসেছি, একজন বয় ওঁর হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিল। লাউঞ্জে কে একজন তাকে নাকি দিয়েছে চিঠিটা! চিঠি পড়ে ওঁর মুখ শুকিয়ে গেল যেন। জিজ্ঞেস করলুম–কিন্তু এবারও কোনও জবাব দিলেন না। শুধু বললেন–পরে সব বলব। তারপর খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলেন। লাউঞ্জে গিয়ে দেখলুম-সত্যি, এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মিঃ মৈত্র আমাকে ঘরে যেতে বলে ওই ভদ্রলোকের কাছে গেলেন। আমি আমার স্বামীর কোনও ব্যাপারে কখনও কৌতূহল প্রকাশ করিনি। কিন্তু এবার খুব উদ্বিগ্ন বোধ করছিলুম। আধঘণ্টা পরে উনি ফিরলেন। তারপর বললেন–একটু কাজে বাইরে যাচ্ছি। শীগগির ফিরব। ভেবো না। তখন প্রায় দুটো। পাঁচটা পর্যন্ত যখন ফিরলেন না, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বেরিয়ে পড়লুম। তারপর ওই ভদ্রলোক–জয়ন্তবাবুর সঙ্গে দেখা হলো।….

বেঙ্কটেশ হাত তুলে বললেন–এবার, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিন। জয়ন্তবাবুকে ঘরে বসিয়ে রেখে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?

তৃণা মুখ তুলে নিষ্পলক তাকাল। বলল–আমাদের রুমের ইলেকট্রিক কানেকশান কাটা দেখে নীচে বলতে এসেছিলুম। কিন্তু লাউঞ্জে নেমেই চোখে পড়ল, সেই পাথরের চাতালে সকালের বন্দুকঅলা লোকটা আর কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চেহারা অবিকল মিঃ মৈত্রের মতো–পোশাক একই রকম। বেশ খানিকটা দূর বলে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছিল না। তাই তক্ষুণি দৌড়ে সেদিকে গেলুম। কিন্তু আমি যেতে যেতে ওরা পাথরের আড়ালে চলে গেল। তখন কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে হোটেলে ফিরে এলুম। এসেই দেখি…

সে দুহাতে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠল। বেঙ্কটেশ বললেন–প্লীজ মিসেস মৈত্র। আমাদের আরও অনেক কিছু জানবার আছে। আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে আপনার সাহায্য খুবই দরকার।

তৃণা ভেজা চোখ তুলে বলল–বলুন, আর কী জানতে চান।

–আপনার স্বামীর পেশা কী ছিল?

স্থায়ী কিছু ছিল না। খুব খেয়ালী মানুষ। নানারকম ট্রেডিং এজেন্সি নিয়ে থাকতেন। সম্প্রতি নতুন কোনও ব্যবসা করা কথা ভাবছিলেন।

এবার কর্নেল বললেন–মিসেস মৈত্র, আপনার স্বামী নীলাপুরমে কেন এলেন, আপনি নিশ্চয় জানেন।

তৃণা ঘাড় নাড়ল। জানি না। আমি কখনও ওকে প্রশ্ন করতুম না। এটা আমার স্বভাবও বটে–তাছাড়া প্রশ্ন করলেই উনি বলতেন–পরে বলব ‘খন। এবার হঠাৎ নীলাপুরমে আসবেন বললেন, তখন আমি কোনও প্রশ্ন করিনি।

আপনার স্বামীর কি কোনও শত্রু ছিল জানেন?

না। থাকলেও আমাকে বলেননি।

–আপনার স্বামীর নিশ্চয় বন্ধুবান্ধব ছিলেন?

–হ্যাঁ, তা ছিলেন বই কি। তবে উনি খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। আড্ডা দিতে ভালবাসতেন।

–খুব ঘনিষ্ঠ এমন কারও-কারও নাম নিশ্চয় বলতে পারবেন?

পুরো নাম আমি বলতে পারব না। যেমন এক ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আমাদের কলকাতার বাসায় আসতেন। অবনীবাবু নাম। আরেকজন আসতেন তার নাম মিঃ রক্ষিত।

আপনারা কোন ট্রেনে এসেছেন হাওড়া থেকে?

তৃণা একবার ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল–কেন?

–এমনি জিজ্ঞেস করছি।

–হাওড়া থেকে ডিরেক্ট আসা যায় না কোনও ট্রেনে।

সরি! বলে কর্নেল একটু হাসলেন। বিন্ধ্যাচল-অব্দি আসা যায়। বিন্ধ্যাচলে কখন নেমেছিলেন?

গতকাল তিনটে পাঁচটাচ হবে।

–আপনার স্বামীর সঙ্গে কারও দেখা হয়েছিল ওখানে?

তৃণা নড়ে উঠল। হ্যাঁ, হ্যাঁ। হয়েছিল। আমি ভুলে গেছি বলতে–মানে, ওই খাড়ির উপরকার চাতালে যে লোকটাকে দেখেছি, তারই সঙ্গে। বিন্ধ্যাচল স্টেশনে ওকে দেখেই উনি এগিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন–তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আসছি। পনের কুড়ি মিনিট লোকটার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলেন। তখন ওঁকে কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।

কর্নেল শুধু বললেন–আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। মিঃ বেঙ্কটেশ, ইউ প্রসিড।

বেঙ্কটেশ ঘড়ি দেখে বললেন মিসেস মৈত্র, আপাতত এই। আপনি ওখানে গিয়ে বসুন। মিঃ আচারিয়া, এবার ডাকুন বয় রণদীপকে।

রণদীপ বয়সে তরুণ। ঘরে ঢুকে সেলাম করার পরই তার চোখ গেল আমার দিকে। অমনি ওর ঠোঁটে বাঁকা হাসি উঠল। নির্ঘাৎ ও ব্যাটা আমাকে তখন বেরিয়ে আসতে দেখেছিল ঘর থেকে। সে দাঁড়িয়ে রইল। বেঙ্কটেশ তাকে বসতে বললেও সে বসল না। তখন একটু হেসে বেঙ্কটেশ বললেন–তুমি রণদীপ সিং?

জী হাঁ।

কতদিন সী ভিউতে এসেছ?

–তা বছর খানেক হয়ে গেল স্যার।

–গতকাল তোমার ডিউটি ছিল কখন?

–ছটা থেকে রাত একটা।

–ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্র ছাড়া নতুন কেউ এসেছিলেন হোটেলে?

–দুজন সাহেব এসেছিলেন, ওনারা এখনও আছে। তবে রেজিস্টার দেখলেই সব মালুম হবে, স্যার।

–ঠিক বলেছ। আচ্ছা রণদীপ, ওই সময়ের মধ্যে মিঃ মৈত্রের ঘরে–মানে তের নম্বর ঘরে কাউকেও নক করতে বা ঢুকতে দেখেছিলে?

না স্যার। আমি তো হরদম করিডরেই ঘুরি।

–আজ কখন ডিউটি তোমার?

দুপুর দুটো থেকে রাত নটা অব্দি আছে, স্যার।

–এই সময়ের মধ্যে কাউকে তের নম্বরে… বাধা দিয়ে রণদীপ আমার দিকে আঙুল তুলল। ওই যে স্যার…

না। উনি ছাড়া আর কেউ ঢোকেনি?

–ঢুকেছিলেন। কিন্তু…

ওকে থামতে দেখে কর্নেল ঝুঁকে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন–যিনি ঢুকেছিলেন, তাকে আর নিশ্চয় বেরোতে দেখনি? তাই না?

রণদীপের ঠোঁট কাঁপছে। সে কী বলতে চায়, অথচ পারছে না–খুব অবাক আর হতভম্ব যেন।

কর্নেল বললেন–এবং যাকে ঢুকতে দেখেছিলে, তারই লাশ বাথরুমে দেখা গেল। তাই তো রণদীপ?

রণদীপ লাফিয়ে উঠল–হ্যাঁ স্যার। তাই বটে স্যার। এতক্ষণে সেটা খেয়াল হয়নি স্যার!

ঘরে সবাই নড়ে উঠেছিল–তারপর ভীষণ স্তব্ধতা। কর্নেল শুধু বললেন–মাই গুডনেস!

তারপর শুনলুম তৃণা মৈত্র চিৎকার করে উঠল–মিথ্যা! একেবারে মিথ্যা! যে খুন হয়েছে, সেই আমার স্বামী!

তারপর দেখলুম সে অজ্ঞান হয়ে কোণার সোফা থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। কর্নেল আমাকে ডেকে বললেন–এস জয়ন্ত। বাইরে যাই। মিঃ বেঙ্কটেশ, দরকার হলে রিং করবেন কিংবা আসতেও পারেন। ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। অ্যালবাট্রস রুম নম্বর থ্রি। অ রিভোয়া!

.

রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত, কী ভাবছ?

–ভাবছি, লাশটা তবে পুলকেশ মৈত্রের নয়?

না। তৃণার স্বামীর নয়।

–কিন্তু এর মানেটা কী?

–মানে এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। তাই ডার্লিং, চলো–আমরা একবার ওই খাড়ির উপর পাথরের চাতালে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। জায়গাটা ভারি চমৎকার।

— একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। বললুম–বন্দুক আর বাইনোকুলারধারী কারো পাল্লায় পড়ব না তো?

কর্নেল হেসে বললেন–তোমার দৃষ্টিবিভ্রম নয় তো জয়ন্ত?

–মোটেও না। স্পষ্ট দেখেছি একজন নীল শার্ট পরা লোক চোখে বাইনোকুলার রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য, তার হাতে বন্দুক দেখিনি।

পাহাড়ের ঢালুতে নামতে গিয়ে হঠাৎ কর্নেল বললেন বরং তার আগে একবার ওই দি সোয়ান নামে হোটেলটা থেকে ঘুরে আসি।

হঠাৎ ওখানে কেন?

নিছক বিয়ার খেতে। বিয়ার মদ নয়। অন্তত এ বেলা খাওয়া যাক।

দুজনে সোজা এগিয়ে সেই খাড়ির খানিকটা উত্তরে দি সোয়ান নামে ছোট্ট হোটেলের দিকে এগোলুম।

হোটেলটা বাংলোবাড়ির মতো। লাউঞ্জে তেমন ভিড় নেই। একপাশে বার। বারে ঢুকে দেখলুম যা ভিড় তা এখানেই। নীল আলোয় মৌমাছির মতো একঝাঁক মাতাল গুঞ্জন করছে। চাপা সুরে বিলিতি অর্কেস্ট্রা বাজছে। আমরা খালি টেবিল খুঁজতে খুঁজতে কোণায় চলে গেলুম। একটা টেবিলে একজন লোক একা বসে আছে। টেবিলের গ্লাসে রঙিন মদ। কর্নেল ভদ্রতা করে বললেন-বসতে পারি?

লোকটা ঘাড় নাড়ল মাত্র। তারপর গেলাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল।

আমরা বসে পড়লুম। ওয়েটার আমাদের পেছন পেছন এসে দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল বিয়ার দিতে বললেন। এই সময় আমার চোখে পড়ল তৃতীয় চেয়ারের ওই লোকটার কোমরের কাছে একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। অমনি শিউরে উঠে কর্নেলের ঊরুতে চিমটি কাটলুম। কর্নেল কিন্তু গ্রাহ্যই করলেন না। নির্বিকারভাবে দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। তখন আমি লোকটাকে আরও ভাল করে লক্ষ্য করতে থাকলুম। দূর থেকে কম আলোয় দেখেছি, ভুল হতেও পারে। কিন্তু এর পোশাকও স্পষ্ট বলে দিচ্ছে পাথরের চাতালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই বটে। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে ওর। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। মুখের চামড়ায় পোড়খাওয়া ভাব আছে। খাড়া নাক আর চৌকো চোয়াল দেখে সহজেই বোঝা যায় লোকটা ডানপিটে না হয়ে পারে না।

বিয়ার এসে গেল। কর্নেল বোতল থেকে গ্লাসে খানিকটা বিয়ার ঢেলে বললেন–জয়ন্ত নিশ্চয়ই এই নিরামিষ পানীয়ে সন্তুষ্ট হবে না?

কর্নেল আমার চিমটিতে সাড়া দেননি বলে ক্ষুব্ধ ছিলুম। তাই গম্ভীর হয়ে মাথাটা দোলালুম মাত্র তার মানে হ্যাঁ এবং না দুই-ই হতে পারে। কর্নেল একটু হেসে গ্লাসটা তুলে ‘চিয়ার্স’ বলে চুমুক দিলেন।

এই সময় তৃতীয় চেয়ারের লোকটা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর বেরিয়ে গেল। তখন ব্যস্ত হয়ে চাপা গলায় বললুম–যাঃ। চলে গেল যে!

কর্নেল গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন–কে গেল, ডার্লিং?

ক্ষেপে গিয়ে বললুম–ন্যাকামি করবেন না। সেই বাইনোকুলারঅলা লোকটা এতক্ষণ দিব্যি আপনার সামনে জলজ্যান্ত বসে রইল–আমি আপনাকে চিমটি কাটলুম, অথচ গ্রাহ্য করলেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি কি ভাবছ বাইনোকুলার সঙ্গে থাকলেই তাকে খুনী বলে সন্দেহ করতে হবে।

–নিশ্চয়। ওই লোকটাই তো তখন খাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে..

কর্নেল হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললেন–চুপ। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে চোখের তারা ঘুরিয়ে ওঁর ডান-দিকটা নির্দেশ করলেন। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ওই টেবিলে তিনজন লোক বসে আছে। দুজন সর্দারজী, অন্য একজন ধুতিপাঞ্জাবি পরা বাঙালী ভদ্রলোক। বাঙালী ভদ্রলোকটি যে সর্দারজীদের সঙ্গে আসেননি, তা দেখামাত্র বোঝা যায়। উনি আপনমনে একটা পেন দিয়ে একটুকরো কাগজে কাটাকুটি করছেন। পাশের গ্লাসে মদ। মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝলুম, প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। কাগজের টুকরোটা বারেরই বিল মনে হলো। তার উপরে যেভাবে কলম চালাচ্ছেন, বাঙালী যে জাত কেরানী তা নির্দ্বিধায় প্রমাণ করা যায়। আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না।

হাসি শুনেই ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। দেখি, উনিও গদগদ হয়ে হাসছেন। মাতালের এমন হাসি আমার পরিচিত। আমি ওঁর কাজে সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা দোলালুম। ভদ্রলোক শুধু মাতাল নন, রসিকও বটে। অমনি দ্বিগুণ উৎসাহে কলম চালনা শুরু করলেন এবং মাঝেমাঝে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এমন মজা পেলে ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

ব্যাপারটা সর্দারজীদের চোখে পড়ল এতক্ষণে। একজন ভুরু কুঁচকে অস্পষ্ট কিছু বলল। মুখে বিরক্তির চিহ্ন।

হঠাৎ কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন।–আমি একবার বেরুচ্ছি, জয়ন্ত। তুমি আমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করো। বার দশটা অব্দি খোলা। আমি সড়ে নটার মধ্যেই ফিরব।

আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেলেন উনি। আমার ক্ষোভ হলো ওঁর ওপর। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওঁর কথামতো না চললে উনিও বড্ড বিরক্ত হবেন। বিশেষ করে খুনখারাপির তদন্তের ব্যাপারে উনি তখন অন্যমানুষ। তাই বসে থাকতে হলো।

এই অবস্থায় ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব না জমিয়ে উপায় নেই। নিঃসঙ্কোচে বললুম–চলে আসুন না এখানে!

ভদ্রলোক যেন সেটাই চাইছিলেন। টলতে টলতে কলম কাগজ আর গেলাস নিয়ে আমাদের টেবিলে এলেন। তারপর নমস্কার করে বললেন–বাঁচলুম। আমার নাম পরিতোষ কারফর্মা। টালিগঞ্জে কাঠগোলা আছে। মশাই যে বাঙালী, তা আঁচ করেছিলুম। কিন্তু বুঝলেন? ওই দুই সর্দারজীর ভয়ে টেবিল ছেড়ে উঠতে পারছিলুম না।

-কেন বলুন তো?

–ওদের আমি মশাই ভীষণ ভয় করি। টেবিল থেকে উঠলেই যদি মেরে বসে।

হো হো করে হেসে উঠলুম। বলুলম–একা এসেছেন নীলাপুরমে?

পরিতোষবাবু বললেন–হ্যাঁ। আমি মশাই ব্যাচেলার মানুষ। দোকা-টোকা ভালবাসিনে। আপনি?

–আমিও তাই।

বাচ্চা ছেলের মতো হি হি হেসে পরিতোষবাবু বললেন–খুব ভাল। খুব ভাল! খবর্দার স্ত্রীলোকের ছায়া মাড়াবেন না। মাড়িয়েছেন না মরেছেন। তা ব্রাদারের নামধাম?

পরিচয় দিতেই লাফিয়ে উঠে বললেন–ওরে বাবা কী আনন্দ, কী আনন্দ। তারপর হাস্যকরভঙ্গিতে শিস দিয়ে বেয়ারাকে ডাকলেন। আমার আপত্তি সত্ত্বেও হুইস্কির অর্ডার দিলেন। বললেন–আপনার মতো সঙ্গী যখন পেয়ে গেছি, আজ মশাই বারসুদ্ধ শুষে খাব।

বলুলম–উঠেছেন কোথায়?

পরিতোষবাবু ছাদ দেখিয়ে বললেন–মাথার ওপরে। এই সোয়ানেই। আপনি?

–অ্যালবাট্রসে।

–খুব ভাল, খুব ভাল।…বলে একটু ঝুঁকে চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করলেন ওই বুড়ো সায়েবটি কে? এখানে এসেই আলাপ হয়েছে বুঝি? আমেরিকান নয় তো? দেখবেন ব্রাদার–সি. আই. এ. ঘুরঘুর করছে সবখানে। খুব সাবধান। দেশের কোনও কথা ফাঁস করবেন না। আপনারা জার্নালিস্ট। আপনারা দেশের সব গুহ্যখবর রাখেন কি না। তাই বলছি।…

বাধা দিয়ে বললুম–না, না। উনি ভারতীয়। শুধু ভারতীয় নয়, বাঙালী।

পরিতোষবাবুর চোখের ঢেলা বেরিয়ে গেল। অ্যাঁ? উনি বাঙালী? ওরে বাবা! কী আনন্দ! কী আনন্দ! ওয়েটার। ইধার আও!..

এই আনন্দে আবার হুইস্কি এসে গেল। এমন আমুদে লোক খুব কমই দেখেছি। মেজাজ ভাল হয়ে গেল ক্রমশ। বিয়ারের পর দু পেগ হুইস্কি পেটে পড়ার ফলে নেশাও ধরে যাচ্ছিল। এর পর কীভাবে সময় কেটেছে, বলা কঠিন। যখন কর্নেল ফিরে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, তখন আমার চোখে নানারঙের খেলা ভাসছে।…

.

রাত কীভাবে কেটেছে, মনে নেই। সকালে উঠে দেখি পাশের বেডে কর্নেল নেই। মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। তাই স্নান করলুম। বয় এসে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট সেরে সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গেলুম। সকালের শান্ত সমুদ্র রোদে ঝকমক করছে। সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কর্নেল এসে গেলেন–হ্যাল্লো ডার্লিং! উঠে পড়েছ দেখছি!

একটু হেসে বললুম–মদে আমার তেমন নেশা হয় না কর্নেল!

-তাই বটে! কর্নেল মৃদু হেসে বললেন। আশা করি, তাহলে গতরাতে কীসব ঘটেছে তোমার সামনে–সব মনে আছে?

নিশ্চয় আছে।

বলে যাও, ডার্লিং।

–পরিতোষবাবু আর আমি জমিয়ে খাচ্ছিলুম। তখন আপনি এলেন। তারপর আমরা দুজনে অ্যালবাট্রসে চলে এলুম।

কর্নেল আবার হেসে উঠলেন।

-হাসছেন যে?

হাসছি। কারণ, গতরাতে তোমার প্রচণ্ড নেশা হয়েছিল।

–প্রমাণ অনেক। তোমাকে নিয়ে সাইকেল রিকশো করে ফিরে আসছি, পথে ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়াল থেকে একটা লোক রিভলভার থেকে গুলি ছুঁড়ল। আমাদের সৌভাগ্য, রিকশোটা জোরে যাচ্ছিল তাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো।

আঁতকে উঠে বললুম–সর্বনাশ!

কর্নেল বললেন–যাই হোক, আমি তৈরি ছিলাম। পাল্টা গুলি ছুঁড়ে ওর রিভলভারটা ফেলে দিলুম। হাত চেপে ধরে সে পালালো। তখন রিকশোঅলাকে বললুম– তোমাকে পৌঁছে দিতে। আর আমি সেই রিভলভারটা খুঁজে নিয়ে মিঃ বেঙ্কটেশের কাছে গেলুম। ফোরেন্সিক টেস্টে নিশ্চয় ধরা পড়ছে–ওটাই মার্ডার উয়েপন।

–এত কাণ্ড! অথচ কিচ্ছু টের পাইনি!

–পাবে কীভাবে? পরিতোষবাবু তোমাকে মাতাল করে দিতেই চেয়েছিলেন যে!

-কেন? ওঁর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

তুমি মদে বেহুঁশ থাকলে ফেরার পথে আমাকে একা খতম করাটা খুব সহজ হবে ভেবেছিলেন!

কর্নেল, খুলে বলুন।

কর্নেল পা ছড়িয়ে বসে বললেন–জয়ন্ত, এই কেসটা ইন্সিওরেন্স-ঘটিত।

বুঝলুম না।

–পুলকেশ মৈত্রের তিনটে ইন্সিওরেন্স করা আছে তিন দেড়ে সাড়ে চার লাখ টাকার। সে মরলে টাকাটা তৃণা পায়। অতএব পুলকেশ ঠিক করেছিল, সে মরবে। আত্মহত্যার কেসে আজকাল ইন্সিওরেন্স অনেক ঝামেলা করে। কিন্তু কোথাও বেড়াতে গিয়ে খুন হলে ঝামেলা নেই। পুলকেশ ও তৃণা ঠিক করল যে নীলাপুরমে গিয়ে পুলকেশ খুন হবে। হলোও। তার মানে স্ত্রী যদি কোনও ডেড বডিকে স্বামীর বলে চালায়, অসুবিধে নেই। এবার তৃণাকে বাকিটা করতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ইন্সিওরেন্সে স্বামীর টাকা ক্লেম করবে। টাকা পেয়ে যাবে। তখন পুলকেশ অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে তৃণার সঙ্গে কোনও নতুন এলাকায় পাড়ি জমাবে। আবার সে অন্য নামে, ইন্সিওর করবে। আবার খুন হবে। আবার তৃণা টাকা ক্লেম করবে–তখন সেও অবশ্য আর তৃণা নয়, অন্য নাম তাকেও নিতে হয়েছে। এটা হলো ওদের তিন নম্বর কেস। এর আগে পুলকেশ আর তৃণা ছিল অরুণ আর মাধবী।

তার আগের নাম ছিল পরিমল আর কেতকী। প্রত্যেকবারই তৃণার নির্বোধ প্রেমিকরা খুন হয়।

বাঃ! বেড়ে বুদ্ধি তো! কিন্তু এবারকার ডেড বডিটা কার?

তৃণার আরেক নির্বোধ প্রেমিক অবনী রায়ের। হাওড়াতে পুলকেশ একটা মারাত্মক ভুল করে। এ ভুল সব বুদ্ধিমান শয়তানের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। না হলে তাদের ধরা যেত না। পুলকেশ তিনটি বার্থ রিজার্ভ করেছিল একই শ্লিপে। কিন্তু এখানে পৌঁছে সে অবনীকে নিয়ে যায় দি সোয়ানে। ওখানে অবনীর নামে কিন্তু রুম বুক করা নেই। আছে পরিতোষ কারফর্মার নামে। পুলকেশ অবনীকে বলেছিল–ওর এক বন্ধু পরিতোষ কারফর্মার নামে দি সোয়ানে একটা ডাবল রুম বুক করা আছে। পরিতোষ হঠাৎ অন্য কাজে আটকে গেছে। তাই আসছে না। অতএব ওই রুমে সে থাকতে পারে। কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু পরিতোষ তো একজন চাই। তা না হলে দি সোয়ান অবনীকে থাকতে দেবে কেন? অতএব পুলকেশ অবনীকে বলে–সে নিজেই বরং পরিতোষ হয়ে পরিচয় দেবে। রসিদ তো তার কাছেই আছে। এতে ব্যাপারটা দাঁড়াল বেশ মজার। পুলকেশ ধুতি-পাঞ্জাবি পরে খাঁটি বাঙালী বেশে পরিতোষ নামে দি সোয়ানে অবনীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়। আবার সী ভিউতে সাহেব সেজে পুলকেশ নামে স্ত্রীর কাছেও থাকে। অবনী নির্বোধ এবং তৃণার প্রেমে অন্ধ না হলে ফাঁদটা টের পেত। দি সোয়ানে তদন্ত করার পর ব্যাপারটা আমরা টের পেয়ে গেলুম।

— পুলকেশকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছে তো পুলিশ?

–হুঁউ। গতরাতেই। দি সোয়ানে সেই ঘরটায় ব্যাটা শুয়ে কাতরাচ্ছিল। হাতে জখম। রুমাল বেঁধেও রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না। বেসিনে ডেটলের ছড়াছড়ি। তাকে অবশ্য তক্ষুণি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।

–সব তো বুঝলুম। কিন্তু ওদের ব্যাকগ্রাউণ্ড এত শীগগির পেলেন কোথায়?

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন তৃণা সব কবুল করেছে।

একটু পরে বললুম–বাইনোকুলার চোখে রেখে খাড়ির ওপর যে লোকটা সী ভিউয়ের দিকে লক্ষ্য রেখেছিল, সে নিশ্চয় পুলকেশ। কিন্তু লক্ষ্য রাখত কেন?

তৃণার কাছে সংকেত পাবার জন্যে। গ্রিন সিগন্যাল পেলেই সে স্ত্রীর কাছে যেত।…..বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।–তবেই দেখ জয়ন্ত, তোমাকে বলেছিলুম–আমার খুনের কপাল। সত্যি ডার্লিং, কোথাও বেড়াতে গিয়ে আরামে কাটাব, তার উপায় নেই। দা ইটার্নাল মার্ডারার সবসময় আমাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে।…

লাভার্স বিচ

দুদিন ধরে ওদের এই অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা দেখছি। ছেলেটি এসে সমুদ্রতীরে উঁচু বালি-মাটিতে ভাঙাচোরা পাথরের বাড়িগুলোর ভেতর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মেয়েটিকে আসতে দেখলেই লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটি এসে তাকে খোঁজে। যেই টের পায় তার অস্তিত্ব, অমনি শুরু হয় ওই লুকোচুরি। কখনও বা উল্টোটা। আগে মেয়েটি এসে অপেক্ষা করে। তারপর ছেলেটিকে আসতে দেখলে অমনি লুকিয়ে পড়ে। একই লুকোচুরি খেলা শুরু হয়। শেষে দেখি, ঢালু পাড়ের বালিয়াড়ি ভেঙে দুজনে হাত ধরাধরি, গড়াতে-গড়াতে বিচে নামে। এবং ছেলেটি, কখনও মেয়েটি আগে দৌড়ুতে থাকে। দুর্বিনীত সামুদ্রিক বাতাসে দুজনের চুল ওড়ে। শাড়ির আঁচল খসে পড়ে। পরস্পরকে তাড়া করার ভঙ্গিতে প্রলম্বিত সংকীর্ণ বিচ ধরে কতদূর-বহুদুর ছটে চলে। তারপর শালীনতাবশে আমি বাইনোকুলার নামিয়ে ফেলি চোখ থেকে। আমি এক বৃদ্ধ মানুষ। চিরকুমার। আমার জীবনে কখনও এমনতরো ঘটনা ঘটেনি, যদিও আমার একদা ওই বয়স ছিল। চপলতা ছিল। আবেগ ছিল। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে পারতুম। অথচ কখনও সে-বয়সে কোনো তরুণীর সঙ্গে এমন খেলা খেলার সুযোগ পাইনি। তাই ওদের ওই খেলাটাকে ঈর্ষাজনক এবং অদ্ভুত লাগে। কী সুখ এমন খেলায় আমি জানি না, বুঝতে পারি না।

চন্দনপুর-অন-সি ওড়িশার সমুদ্রতীরে একটি ছোট্ট জনপদ। বেমরশুমে, এই সেপ্টেম্বরে তার বিচ একেবারে জনহীন খাঁ খাঁ। সেই ভোরে–অতি প্রত্যুষে দীর্ঘ বিচের উত্তরপ্রান্তে যেখানে জেলেবস্তি, তেলুগুভাষায় যাদের বলে নুলিয়া, ঝাঁক বেঁধে ছোট-ছোট নৌকো নিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ে নামে। এ সমুদ্র বড় উদ্ধত। অহঙ্কারী। তবু এক ঝক কালো কালো শীর্ণকায় মানুষের এ লড়াই বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই। এই লড়াই দিয়েই আবহমানকালব্যাপী মানুষ প্রকৃতিকে পরাজিত করেছে। এ সমুদ্রও প্রকৃতি। তার বুকে ছোটবড় নানা গড়নের কালো পাথর মাথা উঁচিয়ে আছে। প্রচণ্ড ঢেউ আর ওইসব কালো পাথরের অস্ত্র দিয়ে সমুদ্র মানুষকে রুখতে চায়। পারে না। দুপুর নাগাদ যখন ক্লান্ত নুলিয়ারা ফিরে আসে, তখন তাদের নৌকো-ভরা ঝকঝকে রুপোলি সমুদ্র শস্য। তারপর আবার বিচ জনহীন খাঁ খাঁ-নিরুপদ্রব। পাড়ে বালিয়াড়ির মাথায় শক্ত মাটিতে দাঁড়ানো প্রচীনযুগের পর্তুগীজ আর মুঘল বণিকদের পাথরের বাড়িগুলো নিজস্ব নির্জনতা ফিরে পায়। কী গম্ভীর প্রগাঢ় সেই নির্জনতা–যেন জমহাকালের হাঁ-করা মুখ। সমুদ্রের গর্জন, জলপাখিদের চিৎকার, প্রেমিক-প্রেমিকায় কণ্ঠস্বর আর হাসি, সবকিছুই সেই হাঁ-করা মুখের ভেতর লুপ্ত হয়ে যায়। কোনো শব্দ আর তখন শব্দ নয়। দিনের আলোও দিনের আলো নয়, কিংবা অন্ধকার বা জ্যোৎস্নাও অন্ধকার বা জ্যোৎস্না নয়। সবই ওতপ্রোত একাকার, গম্ভীর এক সময়সত্তা।

ঠিক বোঝাতে পারছি না, চন্দনপুর-অন-সি বেলাভূমিতে আসলে যেন বিরাটেরই স্বাদ অনুভব করতে পারছিলুম। তাই নিজেকে একা আর তচ্ছ লাগছিল। মনে হয়েছিল ছেলেটি ও মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করি। কিন্তু ওদের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারছিলুম না। যখনই পা বাড়িয়েছি, ওরা দ্রুত সরে গেছে

তৃতীয় দিনের বিকেলে বিচে একটা প্রকাণ্ড পাথরের ওপর বসে আছি, হঠাৎ ঘসঘস শব্দে চমকে উঠলাম। দেখলাম, ছেলেটি ধ্বংসস্তূপের নিচেকার বালিয়াড়ি দিয়ে একরাশ বালি ধসিয়ে অন্যদিনের মতোই নেমে এল। এসে আমার থেকে আন্দাজ পনের মিটার দূরে দাঁড়াল। তার পরনে অন্য দিনের মতোই হাল্কা ছাইরঙা গেঞ্জি আর জি, পায়ে নীলচে কেডস। তার রুক্ষ বড়-বড় চুলের কাঁপ সামুদ্রিক বাতাসে ছত্রখান হচ্ছিল। কয়েক মিনিট সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বড় ঢেউ এসে ভেঙে পড়ল এবং সাদা একরাশ ফেনিল জলের হাল্কা একটা স্তর তাকে পেরিয়ে গেল। তবু সে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু কাশলুম। তখন সে আমার দিকে একবার মুখটা ঘোরাল। গলা ঝেড়ে নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললুম, আকাশ আজ দারুণ পরিষ্কার। কালকের মতো বৃষ্টি নামার লক্ষণ নেই। অথচ সমুদ্রকে কেমন যেন পাগলাটে দেখাচ্ছে। তাই না?

ছেলেটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যে। দেহের-গড়নে স্পোর্টস-ম্যানের আদল আছে। ওর বাহুর পেশী শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে এবং মুখেও একটা শক্ত ভাব, চোয়াল আঁটো। চোখে কী একটা হিংস্রতানাকি অভিমান, কিংবা ক্ষোভ, সঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একটু অবাক লাগছিল ওর চাউনি দেখে। আমার কথা শুনছিল কি না, জানি না। তবু আলাপ করার প্রগলভতায় এবং চিরাচরিত স্বভাবে বলতে থাকলুম, আসলে পাহাড় বলুন, জঙ্গল বলুন, কী মরুভূমি বলুন– প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস হলো সমুদ্র। ওই গুমগুম চাপা গম্ভীর শব্দটা শুনুন! পর্দার আড়ালে কী তুমুল একটা কাণ্ড ঘটছে মনে হয়। যেন হয়, এবার প্রকাশ্যেই দেখতে পাব সাংঘাতিক কিছু–জাস্ট লাইক অ্যান নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোসান!

এইসব কথা বলতে বলতে পাথরটা থেকে নেমে আমি ওর কাছাকাছি গেলুম ও সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে আস্তে বলল, আর য়ু আর লেকচারার অফ ফিলসফি?

হেসে ফেললুম। ও নো, নো। জাস্ট অ্যান অবজার্ভেশান।

দেন হু আর য়ু?

নিতান্ত একজন ট্যুরিস্ট।

দীর্ঘ একমিনিট চুপচাপ থাকার পর বলল, আপনার কাছে বাইনোকুলার কেন? আপনি কি বার্ডওয়াচার?

ইংরেজিতেই দুজনের কথা চলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যুবকটি বাঙালি। আজকাল আর আগের মতো বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের দেখে বাঙালি-অবাঙালি কিছু বোঝা যায় না। তাহলেও এ চোখ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। আমি আরও এক পা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম। সে দ্রুত, যেন, অপ্রত্যাশিত গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় খাপ্পা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি। আমিও দ্রুত বলে উঠলুম, হোয়াট হ্যাঁপড়, ইয়ং ম্যান? কী ঘটেছে?

আস্তে কাঁধ থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, নাথিং! কেন এ প্রশ্ন করছেন?

এবার সেও আমারই মতো দ্বিতীয় বাক্যটি বাংলায় উচ্চারণ করল। একটু হেসে বললুম, আপনার চেহারায় কথাটি লেখা আছে। নানা। সংকোচের কোনো কারণ নেই। এই দূরদর্শন যন্ত্রটি দিয়ে প্রকৃতি এবং মানুষ উভয়ই আমি পর্যবেক্ষণ করি। এ আমার একটা হবি। আপনার বন্ধুটি কি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে?

যুবকটির মধ্যে মুহূর্তের জন্য হিংসা ঝিলিক দিল–তার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এক ধূর্ত বৃদ্ধ নাক গলাচ্ছে বলেই। কিন্তু পরমুহূর্তে সে সংযত হলো। লক্ষ্য করলুম, সে কাকতাড়ুয়ার মতো বিশীর্ণ আর শুকনো হয়ে যাচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে। যেন এখনই ভেঙে পড়বে ভিজে বালির ওপর। সে মুখটা নামাল। তার নাসারন্ধ্র ফুলে উঠল। চোয়াল আরও ঠেলে উঠল।

ফের বললুম, মানুষের গতিবিধিও আমার পর্যবেক্ষণের বিষয়। তাছাড়া

আমাকে থামিয়ে দিয়ে হিসহিস করে বলে উঠল, তাহলে আপনি সবই দেখেছেন! য়ু আ পার্ভাটেড ওল্ড ম্যান! আই হেট য়ু! তারপর সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

বললুম, শুনুন! আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!

আই কেয়ার আ ফিগ ফর আ গন্ড্যাম কর্নেল অর আ ব্লাডি হেল! এই গজরানি দিয়ে সে দ্রুত হাঁটতে থাকল সিধে বিচ বরাবর দক্ষিণে। ওদিকে সাদা ও লাল লাইটহাউসটি শূন্যনীল শেষবেলার আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধু ধু করছে ধূসর জনহীন উঁচু টিলার মতো বালিয়াড়ি। নিচের বিচে একটা নেড়ি কুকুর আর একটি ন্যাংটো নুলিয়া বালক আপনমনে খেলা করছে।

যুবকটি তাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে বালিয়াড়িতে উঠে গেল এবং ওপাশে অদৃশ্য হলো। তখন আমি আস্তে আস্তে পেছনকার বিধ্বস্ত পাথুরে বাড়িগুলোর ভেতর উঠে গেলুম। গাঢ় ছায়া সেখানে। কী এক অবচেতন কৌতূহলে– কিংবা ইনটুইশান বশে কী যেন খুঁজতে থাকলুম। একটু পরে মনে হলো, কী খুঁজছি এখানে? কী? কেনই বা অনুসন্ধানবৃত্তি পেয়ে বসল ভূতের মতো?

ঘরগুলোর দেয়াল ভাঙাচোরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও খানিকটা ছাদের টুকরো ঝুলে আছে। সে-সবের ভেতর দিয়ে শেষদিকে উত্তরপ্রান্তে ঘুপটি একটুকরো ঘর আবিষ্কার করলুম। তার এদিকের দেয়ালে একটা প্রকাণ্ড ফোকর। ফোকরে উঁকি দেওয়ার আগে জ্যাকেটের পকেট থেকে টর্চ বের করে নিলুম। ছোট্ট ঘরটা নিশ্চয় গুদাম ছিল। ওপাশে ভাঙা দরজা। ভেতরটা এখনই গাঢ় আঁধারে ভরে গেছে। টর্চের আলোয় মেঝেটুকু স্পষ্ট হয়ে উঠল।

এইসব বিধ্বস্ত পাথরের বাড়িগুলোর ভেতর শুধু বালি আর বালি ভর্তি। এই টিকে থাকা খুদে ঘরটির মেঝেতেও চাপ-চাপ বালি। সেই বালিতে কয়েকটা জুতোর সোলের স্পষ্ট ছাপ এবং ব্যাপারটা অদ্ভুত একারণেই যে ছাপগুলো শেষ হয়েছে এই ফোকরের নিচেই।

হুঁ, কেউ দাঁড়িয়ে ফোকর দিয়ে কিছু লক্ষ্য করেছিল অথবা লক্ষ্য করত। কিন্তু কে সে? কী লক্ষ্য করত সে?

.

চন্দনপুর-অন-সিতে আমি যে ছোট্ট বাংলোবাড়িতে উঠেছি, সেটি আমার এক বন্ধু অরবিন্দ পাণিগ্রাহীর। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। থাকেন মেহেরগঞ্জে এখান থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরের শহরে। এই বাংলোবাড়ির নাম উদয়াচল। কেয়ারটেকার আছে। তার নাম গউড়-অ। ওড়িয়া ভাষার অ-কারান্ত উচ্চারণ বাংলায় লেখা কঠিন। তাই তাকে বরং গউর বলা যাক, গৌরের বাংলা অপভ্রংশ। তাছাড়া এই গউর বা গউড়-অ-চমৎকার বাংলা বলে। শুধু তাই নয়, সে হিন্দি এবং তেলুগুও বলতে পারে। এই চতুর্ভাষাবিদ লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। অতিশয় বুদ্ধিমান এবং মালিকের অতিথির চমৎকার সার্ভিস দিতে পটু। সে রাতে খেতে বসে তাকে জিগ্যেস করলুম, সমুদ্র তার কেমন লাগে?

আমার প্রশ্নটা নিশ্চয় তার অদ্ভুত লাগল। তাই যেন বলল, কেমন লাগবে স্যার? সমুদ্রের ধারে যার জন্ম আর এতকাল থাকা, তার কাছে সমুদ্র তো সমুদ্রই। আপনি যদি নতুন কিছু দ্যাখেন, তাহলে বুঝবেন সেটা ভাল না খারাপ।

একটু হেসে প্রশ্নটা শুধরে দিলুম। ..নামানে, তুমি সকাল-বিকেল বা কোনো সময় ফুরসত পেলে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাও কি না?

গউর হাসতে লাগল। …তা যাই স্যার। তবে সমুদ্রের আর নতুন কী দেখব? যাই নুলিয়াদের কাছে মাছ-টাছ আনতে। কখনও কারুর সঙ্গে দেখা হলে বিচে একটু বসে গপ্পসপ্প করি–এই আর কী?

আচ্ছা গউর, গত কয়েকদিনে তুমি কি কোনও যুবক-যুবতী–মানে ছেলে মেয়েকে দেখেছ বিচে?

গউর আরও হাসতে লাগল। …স্যার, চন্দনপুর বিচের একটা পুরনো নাম আছে। আজকাল নামটা সবাই ভুলে গেছে। ব্রিটিশ আমলে–তখন আমি এইটুকু ছেলে, তবু মনে আছে, লোকে বলত লাবার্স বিচ! বড় বদনাম ছিল, স্যার!

লাবার্স বিচ, নাকি লাভার্স বিচ?

ওই হলো আর কী। গউর ঈষৎ লজ্জায় আড়ষ্টভাবে বলল। কবছর আগে অব্দি অফ-সিজন বলতে কিছু ছিল না। সব সময় জোড়া-জোড়া–মানে স্যার, বুঝলেন তো? লাজলজ্জার বালাই নেই–সেকালের সায়েবমেমদের মতো নেকিড হয়ে বিচে, নয়তো বালিয়াড়িতে…।

সংকোচে সে থেমে গেলে বললুম, বুঝেছি।

গউর বলল, তো শেষে পুলিশ খুব পেছনে লাগল। মাঝে-মাঝে খুনখারাবিও হতো। মানে কে কার বউ ভাগিয়ে নিজের বউ সাজিয়ে এনেছে, আর তার হাজব্যান্ডো তক্কেতক্কে চলে এসেছে। শেষে–গউর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে ফের বলল, কাগজে লেখালেখির চোটে পুলিশ ক্যাম্প বসালে বিচের মাথায়। তারপর এই অবস্থা। ওই এক শীতকালটা যা ভিড়ভাট্টা, তারপর বাকি সময় খাঁ খাঁ পড়ে থাকে। যদি বা কেউ এস পড়ে, মন টেকে না। একটা দিন থেকে চলে যায়।

কেন? গউর এ প্রশ্নে একটু অবাক হল। বলল, মানুষ আসলে ভিড়ভাট্টাই বেশি ভালবাসে, স্যার। এখানে আছেটা কী? না বাজার, না কিছু। একটা মোটে হোটেল বা কারুর এইরকম লজ বা বাংলো। আর হোটেল মানে কী, নিশ্চয় দেখেছেন স্যার?

দেখেছি। মাটির ঘর।

মাটির ঘর। গউর রিপিট করল। শীতের সময়টা বাদ দিলে খাঁ খাঁ। না খদ্দের, না কিছু।

খাওয়া শেষ করে জল খাচ্ছিলুম। তখন গউর এঁটো থালাবাটি গোছাচ্ছিল টেবিল থেকে! জল খেয়ে বললুম, হুঁ–তাছাড়া লাইটহাউসের পেছনে ডিফেন্স ডিপার্টের বিভিন্ন দফতর আছে। আর্মি ট্রেনিং সেন্টার আছে। তাই এখানে আসতে স্পেশাল পারমিট লাগে। সেই ঝামেলায় এই অবস্থা হয়েছে।

আজ্ঞে, আজ্ঞে। গউর সায় দিয়ে বেরিয়ে গেল কিচেনের দিকে।

আরাম করে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছি, সবে জ্যোৎস্না ফুটেছে, মনে পড়ল, ওই যা! গউর তো আমার মূল প্রশ্নের জবাব দেয়নি। তাকে ডাকলুম। বললুম, হুঁ–তোমার কাছে যা জানতে চাইছিলুম তখন। গত দু-তিন দিনে বিচে কোনও ছেলেমেয়েকে

এ পর্যন্ত শুনেই গউর খ্যাখ্যা করে হাসল। …বুঝেছি। আপনি মেহেরগঞ্জের মহাপাত্ৰমশায়ের ছেলের কথা বলেছেন তো? ওনাকে দেখেছি বৈকি। সঙ্গে, বউমা ছিল, তাও দেখেছি। তবে স্যার, দীপবাবু ছেলেটা গোয়ারের হদ্দ। জিগ্যেস করতে গেলুম, বিয়েতে অধম নেমন্তন্ন কেন পায়নি, তো এমন চোখ করে তাকাল!

আস্তে বললুম, কেমন করে বুঝলে মেয়েটি ওর বউ?

গউর মাথা চুলকে বলল, তাছাড়া আর কে হবে? সিথেয় সিঁদুর ছিল মনে পড়ছে।

ওরা কি বাঙালি?

তা বলতে পারেন। মেদিনীপুরের কাথির লোক মহাপাত্রমশাই। কঁথিতে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে স্যার। তাছাড়া পাণিগ্রাহীমশাই ওনার বন্ধু বটেন। সেই লাইনে চেনাজানা আমার সঙ্গে।

ওরা কোথায় উঠেছে জানো কি?

গউর ঝটপট বলল, কেন? ওই তো রাস্তার ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার নিচে মহাপাত্ৰমশাইয়ের বাংলোবাড়ি।

ঘড়ি দেখলুম। রাত সাড়ে আটটা বাজে মোটে। সামুদ্রিক আবহাওয়ায় কী যে রাক্ষুসে খিদে পায় মানুষের। খুব সকাল-সকাল খাওয়া হচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, গউর! আমি একটু ঘুরে আসি। তুমি শুয়ে পড়তে পারো।

গউর বলল, নানা, আপনি ঘুরে আসুন বিচে। আমার ঘুমুতে রাত একটা দুটো।…

.

বিচের দূরত্ব এই বাংলোবাড়ি থেকে বড়জোর সিকি কিলোমিটার। কৃষ্ণপক্ষের ঈষৎ ক্ষয়াটে হলুদ জ্যোৎস্নায় সমুদ্রতীর অবশ্যই আমার পক্ষে এখন লোভনীয়। কিন্তু সেই ইনটুইশন-চিরদিন যে অতীরিন্দ্রিয়জাত বোধ আমাকে কাটার মতো খোঁচা মারে, এদিনই শেষ বেলায় বিচের মাথায় ভাঙা পাথুরে ঘরের ভেতর যা আমাকে উঁকি মারতে বাধ্য করেছিল, তাই আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল রাস্তার ওধারে ন্যাড়া পাথরের টিলার নিচে একটি বাড়ির দিকে।

একটা বিশাল ও কাছিমের খোলের গড়ন ঘাসে ঢাকা জমির ওপারে বাড়িটার একটা জানালায় আলো দেখা যাচ্ছিল। ঘাসের জমিটা চিরে আবছা জ্যোৎস্নায় একফালি পায়েচলা পথ চোখে পড়ল। সেই পথে অনেকটা এগিয়ে গেছি, মনে হলো কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। দ্রুত ঘুরে কাউকে দেখতে পেলুম না! হয়তো মনের ভুল। জমিটার (৫ ৭ ঘন অস্থির জঙ্গল। তারপর একটা সরু এবং খোয়াঢাকা রাস্তা। শাল বাড়িটার গেটে পৌঁছুলে আবার মনে হলো, পেছনে কেউ আসছে। আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালুম এবং এবার টর্চ জ্বাললুম। কেউ নেই।

কিন্তু তারপরই বাড়িটার আলোজ্বলা জানালা থেকে কেউ বলে উঠল, হুজ দেয়া?

হুঁ, সেই ছেলেটি–দীপ। যে কণ্ঠস্বর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার জীবনে একবার শোনে, আর তা ভোলে না। একটু কেশে সাড়া দিয়ে বললুম, হ্যাল্লো দীপ!

হু আর য়ু?

দ্যাট ওল্ড ফেলা, হুম ইউ মেট অন দা সি-বিচ!

কিছুক্ষণ পরেও! এখানে আপনি কী করছেন?

আপনার–তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, দীপ!

আমি গায়ে-পড়া আলাপ ডিজলাইক করি মিস্টার! হোয়াট দা হেল য়ু থিংক য়ু আর গোয়িং টু ডু উইথ মি?

আমি মনে মনে হাসছিলুম। কাথির কোনও এক ব্যবসায়ী, যিনি মেহেরগঞ্জে ব্যবসা করতে এসে বসবাস করছেন, তাঁর ছেলে দীপের এই অ্যাংলিয়ানা। অবশ্য ছেলেটি নিশ্চয় কলকাতায় থেকে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া শিখেছে এবং ইদানিংকার রীতি অনুসারে ব্ল্যাসে পরিণত হয়েছে, এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই।

কিন্তু তারপর দেখলুম, সে বেরিয়ে এসে গেটের তালা খুলে দিল। তার হাতের টর্চ আমাকে কয়েক সেকেন্ড ঝলসে দিয়ে নিভে গেল।

তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আস্তে বলল, ওক্কে। আসুন!

ছোট্ট লনের ডাইনে গ্যারেজ একটা ঝকমকে গাড়ি দেখতে পেলুম– সরাসরি তার ওপর জ্যোৎস্না পড়েছে বলেই। বারান্দায় উঠে সে ফের চাপা গলায় বলল, প্লিজ কাম ইন!

ড্রইং রুমটি ছোট এবং সাজানো। ওর পরনে শর্টস আর হাতকাটা গেঞ্জি। গলায় সরু রুপোলি চেন। আমি বসলে বলল, এনি ড্রিংক?

ধন্যবাদ। সদ্য ডিনার সেরে আসছি। …নিভন্ত চুরুটটি জ্বালিয়ে নিলে সে। অ্যাসট্রেটি এগিয়ে দিল। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বললুম, হোয়াট হ্যাঁপ দীপ?

প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আমার নাম কে বলল আপনাকে?

গউর। তুমি–তুমি বলার জন্য কিছু মনে কোরো না ডার্লিং, এ আমার অভ্যাস–তো তুমি আজ বিকেল থেকে একা কেন?

একটু চুপ করে থাকার পর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বলল, হু আর য়ু? আপনি কে?

আমার নাম তোমাকে বিকেলে বলেছিলুম। বলে বুঝতে পেরেছিলুম এই নামটির সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি একজন ন্যাচারালিস্ট–নেচার পর্যবেক্ষণ আমার হবি। নেচারকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তার অন্তর্ভুক্ত আরও অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে যায়।

মুখ নামাল এবং দু হাত দুই গালে রেখে নগ্ন হাঁটুতে দুটি কনুই রেখে আস্তে বলল, য়ু হ্যাঁভ আ বাইনোকুলার!

ইয়া। একটু হেসে বললুম।

আপনাকে আমরাও–আমি ওয়াচ করেছিলুম। প্রথমে ভেবেছিলুম, আপনি একজন ফরেন ট্যুরিস্ট। ইউ লুক জাস্ট অ্যান য়ুরোপিয়ান। সুভদ্রা বলল, বাজি রাখছি, হি ইজ আ খ্রীস্টিয়ান ফাদার!

সুভদ্রা কোথায়?

দুটো হাত গাল থেকে সরে পুরো মুখে ঢেকে গেল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, জানি না। সাড্‌নলি শি ইজ ভ্যানিশড–আ ট্র্যাজিক ম্যাজিক ইনডিড। তাকে দুপুর থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। সারা চন্দনপুর তন্নতন্ন খুঁজেও–বাট শি ওয়জ নট আ গার্ল অফ দ্যাট টাইপ! ও ছিল– দ্রুত কথা কেড়ে বললুম, সুভদ্রা কি তোমার স্ত্রী?

মুখ থেকে হাত-দুটো সরে গেল। দেখলুম, চোখ দুটো লাল এবং ভিজে। নাসারন্ধ্র স্ফুরিত। সেই তখনকার মতো চোয়াল শক্ত। দাঁতে দাঁতে। একটু পরে বলল, শি ওয়জ মাই ফিয়াঁসে! শীগগির আমাদের বিয়ে হতো।

হুঁ–সুভদ্রার বাড়ি কোথায়?

কলকাতা–ফিয়ার্স লেনে। বাবার বিজনেসের সূত্রে ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার। পরিচয়। কিন্তু বাবার এ বিয়েতে মত ছিল না। তাই বাবা জানেন না, সুভদ্রাকে নিয়ে এখানে এসেছি। ওর কথামতো স্টেশনে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম লাস্ট ফ্রাইডে। আজ সানডে। স্টেশন থেকে ওকে নিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছিলুম।

তোমার বাবা জানেন তুমি চন্দনপুরে আসছ?

বাবা জানেন, আমি একা আসছি।

পারমিট লাগে চন্দনপুরে ঢুকতে। তুমি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পারমিট নিয়েছিলে?

দ্যাটস ওক্কে।

শেষবার সুভদ্রাকে–মানে কখন সে বাংলো থেকে…

প্রশ্নটা বুঝে দ্রুত বলল, দুপুরে দুজনে রান্না করে খেলুম। একটা ক্যাসেট চালিয়ে মিউজিক শুনতে শুনতে আমার ঘুম এসেছিল। সুভদ্রা পাশে শুয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। আমার ঘুম ভাঙল তিনটেয়। তারপর ওকে দেখতে পেলুম না। ভাবলুম বিচে গেছে। সেখানে গেলুম। ভাবলুম রোজকার মতো লুকোচুরি খেলছে। কিন্তু–

আমার দুহাতে মুখ ঢাকল। ডাকলুম, দীপ!

বলুন!

ডু য়ু থিংক দেয়ার ইজ এনি ফাউল প্লে সামহোয়্যার?

ইয়া। আই স্মেল সামথিং। বলে উঠে দাঁড়াল হঠাৎ।…আপনাকে দেখাচ্ছি। জাস্ট এ মিনিট!

সে পাশের ঘরে চলে গেল। ঠিক তখনই আবার আমার মনে হলো, কেউ কোত্থেকে আমার দিকে নজর রেখেছে। চিরদিন এ ধরনের রহস্যময় ঘটনার মাঝখানে গিয়ে পড়লে এই অনুভূতিতে আক্রান্ত হই। দ্রুত উঠে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মেরে টর্চ জ্বেলে এদিক-ওদিক দেখে নিলুম। পেছনের ন্যাড়া টিলাটা এখন জ্যোৎস্নায় কালো। টর্চের আলো তার কিনারা ছুঁল। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। বসার ঘরে ঢুকে দেখি, দীপ ফেরেনি। পাশের ঘরে খসখস শব্দ হচ্ছে। কিছু খুঁজছে যেন ব্যস্তভাবে। খুঁজে পাচ্ছে না হয়তো। সে চাপা অশ্লীল ইংরেজি খিস্তি করছে কানে এল।

তখন সোজা ওঘরে ঢুকে গেলুম পর্দা তুলে। আমাকে দেখে সে স্থির হয়ে দাঁড়াল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ ওটা আমার জিনসের পেছন পকেটে গোঁজা ছিল। মনে পড়ছে না–তারপর কোথাও রেখেছিলুম কি না। আসলে বিকেল থেকে আমার মাথার ঠিক নেই–দা ব্লাডি হেল অফ আ মেস!

জিনিসটা কী, দীপ!

একটুকরো কাগজ। ওটা ওই কোণের টুলে যে স্কাল্পচারটা দেখছেন, ওখানে খোলা অবস্থায় রাখা দেখেছিলুম। যেন আমার চোখে পড়ার জন্য কেউ রেখেছে। পড়ে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলুম, সুভদ্রা মূর্তিটার তলায় কোণাটা চাপা দিয়ে রেখেছে, যাতে আমার চোখে পড়ে।

কী লেখা ছিল কাগজে?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দীপ বলল, কাগজটা তখনই পেছন পকেটে গুঁজে আবার বিচে চলে গিয়েছিলুম। কিন্তু গিয়ে মনে হলো, দেরি হয়ে গেছে বড়। এখন আর কিছু করার নেই।

তারপর তুমি প্যান্ট বদলেছ। শর্টস পরেছ।

ইয়া।

বাথরুমে ঢুকেছিলে কি?

দীপ তাকাল বড় চোখ করে। বলল, মাই গুডনেস! ইউ আর রাইট, কর্নেল।

তখন ড্রয়িংরুমের দরজা খোলা ছিল কি?

ছিল, ছিল! নড়ে উঠল দীপ। আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না। আপনি আসার জাস্ট কয়েক মিনিট আগে খেয়াল হলে গেটে তালা দিয়েছি। ড্রয়িং রুমের দরজাও বন্ধ করেছি।

আর কোনও দরজা খোলা ছিল না–মানে বাইরের কেউ ঢুকতে পারে এ ঘরে, এমন কোনও দরজা?

নাঃ।

নাও টেল মি প্লিজ, কী লেখা ছিল কাগজে?

একজ্যাক্ট ল্যাঙ্গোয়েজ ভুলে গেছি। জাস্ট মনে পড়ছে, লেখা ছিল : জরুরি একটা কাজে বেরুচ্ছি–বিচে যেও। ওখানে থাকব। …বলে দীপ নাকের ডগা আঙুলে ঘষে বলল ফের, না–বিচে গিয়ে আমার খোঁজ কোরো–অথবা ওইরকম কিছু।

মনে করে দ্যাখো, আর কিছু লেখা ছিল কী না!

দীপ ব্যাকুলভাবে স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। একটু পরে বলল, আর তো কিছু মনে–ও, হ্যাঁ! মনে পড়েছে! লাস্ট কথাটা ছিল : ভুল বুঝো না। একটা বোঝাঁপড়া করা উচিত। কিছু বুঝতে পারিনি।

এ ঘরটা বেডরুম। আলো তত উজ্জ্বল নয়। টর্চ জ্বেলে বললুম, কোন প্যান্টটাতে চিঠিটা ছিল?

দীপ খাটের বাজুর মাথায় আটকে ঝোলানো প্যান্টটা দেখাল। সেটার সব পকেট খুঁজে দেখার পর, আবার মেঝে পরীক্ষা করতে থাকলুম টর্চের আলোয়। এবার চোখে পড়ল লাল সিমেন্টের মেঝেয় কিছু বালির ছাপজুতোর ছাপেরই চিহ্ন। অবশ্য ওগুলো দীপের জুতোরও হতে পারে।

বললুম, তোমার বাংলোয় টেলিফোন আছে?

আছে। দীপ আস্তে বলল।…কিন্তু আপনি কি পুলিশকে জানাতে চাইছেন? তাতে আমার আপত্তি আছে। স্ক্যান্ডালাস হয়ে পড়বে পুরো ব্যাপারটা।

ওর চোখে চোখ রেখে বললুম; দীপ! তুমি ফাউল প্লের কথা বলছিলে। হোয়াট ডিড য়ু মিন? সুভদ্রা পালিয়ে গেছে?

দীপ জোরে মাথা নেড়ে অস্থির ভঙ্গিতে বলল, ও নো নো! আই ডিডন্টু মিন দ্যাট কর্নেল! আমার মনে হচ্ছে, ও কারুর ট্র্যাপে পড়েছে–ওর লাইফের সব কথা তো আমি জানি না। জাস্ট মাস কয়েকের পরিচয় ওর সঙ্গে।

তাহলে কী ঘটতে পারে? ট্র্যাপ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? দীপ আবার দুহাতে মুখ ঢেকে নিচু খাটের বিছানায় বসে পড়ল। ভাঙা গলায় বলে উঠল, আমি জানি না। কিছু জানি না।

তার কাধ আঁকড়ে বললুম, দীপ, দীপ! মাথা ঠাণ্ডা রাখো। শক্ত হও। এমন ভেঙে পড়লে কিছু করা যাবে না। বি স্টেডি, ডার্লিং!

দীপ শান্ত হবার চেষ্টা করে বলল, বাট হোয়াট ক্যান আই ডু?

আমার মূল প্রশ্নের জবাব দাও। কেন তুমি ভাবছ, সুভদ্রা তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়নি? তুমি বলছ চিঠিতে লেখা ছিল : ভুল বুঝো না। এতেই তো বোঝা যায়, সে কারুর সঙ্গে কিছু নিয়ে রফা করতে গিয়েছিল–ধরো, তার আগের কোনও প্রেমিকের সঙ্গে–

দীপ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি না। তাহলে সে আমাকে বলত।

কোনও মেয়ের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, দীপ।

দীপ আমার চোখে চোখ রেখে ঈষৎ শান্ত হয়ে বলল, ওকে! কিন্তু সুভদ্রার সঙ্গে আপনার পরিচয় নেই, তাই একথা ভাবতে পারছেন। যদি তার আগের প্রেমিক কেউ থাকে, সে ওকে ফলো করে এখানে আসে–আমার চোখে পড়ত। কারণ আমি একমাত্র একটা লোককে ভয় পাই, তিনি আমার বাবা। বাবা নিজে বা কাউকে পাঠিয়ে চন্দনপুর-অন-সিতে আমি কী করছি, সে খবর নিতে পারেন–সেটা তার মতো লোকের পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই আমি চারদিকে চোখ রেখেছিলুম। এক আপনি বাদে এখানে আর কোনও আউটসাইডারকে দেখিনি। তাছাড়া সবসময় সুভদ্রা আমার সঙ্গে থেকেছে। তারও কোনও সন্দেহজনক লোককে চোখে পড়েনি। পড়লে সে আমাকে বলত।

কিন্তু আজ তুমি দুপুরে যখন ঘুমিয়ে ছিলে, তখন যদি কেউ এসে ওকে। ডেকে নিয়ে গিয়ে থাকে?

বাবার লোক, কিংবা বাবা নিজে?

দীপের কণ্ঠস্বরে চমক লক্ষ্য করে বললুম, না। ধরো-সুভদ্রার আগের কোনো প্রেমিক?

দীপ হঠাৎ যেন পাগল হয়ে গেল। গর্জন করে দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে উঠল, গেট আউট ইউ ওল্ড ফুল! গেট আউট ইউ ব্লাডি হ্যাগার্ড! আই সে–। আউট! লিভ মি অ্যালোন।…

বেগতিক বুঝে দ্রুত বেরিয়ে এলুম। একালের ছেলেমেয়েদের রীতিনীতি সত্যি অদ্ভুত! গেট দিয়ে বেরিয়ে সংকীর্ণ এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ডাইনে পুবের দিকে পা বাড়ালুম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সব সময় মনে হচ্ছিল কেউ আড়ালে থেকে আমাকে অনুসরণ করছে। কিছুতেই এই অস্বস্তিকর অনুভূতি এড়াতে পারলুম না। প্রতি মুহূর্তে পিছন বা পাশ থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে শেষ পর্যন্ত জ্যাকেটের ভেতর-পকেট থেকে ২২ ক্যালিবারের খুদে নতুন কেনা পিস্তলটি বের করতে হলো। এতে আঠারোটি গুলি ভরা আছে। সুতরাং অজানা

আততায়ীর সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে এটি যথেষ্ট।

আজ রাতে সমুদ্রকে জ্যোৎস্নায় একটা বিশাল বিস্ফোরণের মতো দেখাচ্ছিল। প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছিল। জনহীন বিচে একটা সাদা কুকুরকে বালি শুকে বেড়াতে দেখছিলুম। গউর বলেছিল, বিচের বালি শুকে ওরা টের পায়, কোথায় পাঁকাল জাতীয় সাপ-মাছ ঢুকে আছে। বালি নখের আঁচড়ে সরিয়ে কিলবিলে সামুদ্রিক প্রাণীটিকে ওরা তারিয়ে তারিয়ে খায়। তাছাড়া কঁকড়াও কুকুরদের প্রিয় খাদ্য– যদিও বিদ্যুতের মতো গতিশীল এইসব কাকড়া পাকড়াও করা ওদের কাছে আকাশকুসুম সাধ!

বেশ বলতে পারে বটে রসিক গউর। কিন্তু এ মুহূর্তে গউর বা তার রসিকতা অথবা ওই একলা অনুসন্ধানী ক্ষুধার্ত সাদা কুকুরটির চেয়ে আমার মনে অন্য একটি ভাবনা পাথরের মতো আটকে গেছে। আর প্রতিমুহূর্তে অতর্কিতে আক্রান্ত হওয়ার অস্বস্তি!

পাথরের ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর ধ্বংসস্তূপের ভেতর ঢুকতে গিয়ে মনে হলো, ঠিক করছি না। মানুষখেকো বাঘের মতো অদৃশ্য আততায়ী আমাকে আত্মরক্ষার সুযোগ দেবে না এমন একটা পরিবেশে। ধ্বংসপুরীটি আন্দাজ তিনশো মিটারের বেশি লম্বা। বিচে খোলামেলায় নেমে উত্তর প্রান্তের বালিয়াড়ি দিয়ে আবার ওপরে উঠলুম। ঘুরে দক্ষিণমুখী হতেই সেই ছোট্ট টিকে থাকা কুঠুরিটি সামনে পড়ল, যার ওপাশের দেয়ালের ফোকর দিয়ে মেঝের বালিতে জুতোর ছাপ দেখেছি।

পিস্তল ও টর্চ বাগিয়ে ধরে মরিয়া হয়ে কয়েকটি পা বাড়িয়েছি সেদিকে, অমনি আমার পাশে ধপাস করে একটুকরো পাথর বা কিছু পড়ল। থমকে যেতেই আবার একটা ঢিল বা পাথর পড়ল। টর্চ জ্বেলে কিছু দেখতে পেলুম না সামনে। অথচ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সামনের ধ্বংসপুরীর দিক থেকেই আসছিল।

টর্চের আলোয় পিস্তলটি বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললুম, গুলি ছুঁড়ব বলে দিচ্ছি। সাবধান!

কিন্তু অদৃশ্য আততায়ী গ্রাহ্য করল না। হয়তো, সে নিরাপদে দেয়াল বা পাথরের স্কুপের আড়ালে আছে বলেই। আবার পাথরের টুকরো এসে পড়তে শুরু করল। আলোয় দেখতে পাচ্ছিলুম, সেগুলো খুবই ছোট্ট। খাপ্পা হয়ে আন্দাজ করে ট্রিগারে চাপ দিলুম। গুলি বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড সামুদ্রিক হাওয়ায় পিস্তলের গুলির শব্দটা অতিরিক্ত কোনও সাড়া জাগাল না। আর আরও অদ্ভুত ব্যাপার, পাথর ছোঁড়া কিন্তু থেমে গেল না।

জনহীন জ্যোৎস্নারাতে পর্তুগিজ আর মুঘলদের ধ্বংসপুরীতে এতক্ষণে অন্য এক অস্বস্তির তীব্র শিহরন ঘটে গেল মনে। এ কি কোনও অশরীরী আত্মার ক্রিয়াকলাপ? এই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এ জীবনে অসংখ্য অদ্ভুত..অদ্ভুত ভৌতিক রহস্যের মোকাবিলা করেছে। কিন্তু এমন ভৌতিক ঘটনার মুখোমুখি কখনও হয়নি। আবার ঢিল পড়তে শুরু করলে কী এক দুজ্ঞেয় আতঙ্ক আমার রক্ত হিম করে ফেলল। আমি হনহন করে ফিরে চললাম পাণিগ্রাহীর বাংলো উদয়াচলের দিকে।

গউর ঘুমোচ্ছিল। দরজা খুলে দিয়েই টলতে টলতে যেভাবে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল এবং একটি কথাও বলল না, তখন বুঝলাম লোকটা গাঁজাখোর।

পোশাক বদলে ফোনের কাছে গেলুম। কিন্তু ফোন তুলেই দেখলুম, ডেড! অথচ আজ দুপুরেও ফোন ঠিক ছিল। মেহেরগঞ্জে পাণিগ্রাহীর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছি ফোনে। অবাক হয়ে একটু বসে থাকার পর চুরুট ধরালুম এবং তারপরই একটা কথা মাথার ভেতর নড়ে উঠল।

এতগুলো ঢিল ছুঁড়ছিল কেউ, কিন্তু একটাও আমার গায়ে লাগেনি। ভূতের ঢিল নাকি মানুষের গায়ে লাগে না। কিন্তু ওই, অশরীরী–যে আমাকে অতক্ষণ ধরে আড়াল থেকে অনুসরণ করছিল, তার ঢিলগুলো টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখেছি, সবই আমার আশেপাশে পড়ছিল!

তার মানে, সে আমাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ছিল ঠিকই কিন্তু আমার শরীর তার লক্ষ্যস্থল ছিল না। কেন?

সে যেই হোক, আমাকে আঘাত করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। যেন উদ্দেশ্য ছিল, আমাকে ওই কুঠুরিতে ঢোকা থেকে নিবৃত্ত করা? কেন?

মাই গুডনেস! আমি নড়ে বসলুম। সাদা দাড়ি আঁকড়ে ধরলুম উত্তেজনায়।…

.

পরদিন ভোর ছটায় গউর বেড-টি দিয়েছিল যথারীতি। আমিও চিরাচরিত নিজস্ব অভ্যাসে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলুম। সমুদ্রতীরে ধ্বংসপুরীর সামনে পৌঁছে রাতের কথা ভেবে যুগপৎ হাসি ও দুঃখে বিচলিত বোধ করছিলুম। দিনের প্রথম ধূসর আলো, সমুদ্রে পূর্ব দিগন্তে আজ ঘন মেঘ এবং বাতাসও জোরালো, আমাকে অকুতোভয়ে সেই ছোট্ট কুঠুরিতে পৌঁছে দিতে সাহায্য করল। ভেতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম।

কোণের দিকে একখানে বালির মেঝে কেউ যত্ন করে সমান করে রেখেছে। একই জুতোর সোলের অনেকগুলো ছাপ। কাল দিনশেষে দেখা ছাপের ওপর এই ছাপগুলো দেবে বসেছে। কেউ ভারী কিছু তুলেছে যেন! তারপরই ফোকরটার দিকে চোখ পড়ল। ফোকরের কিনারা এবড়ো-খেবড়ো এবং ধারালো। সেখানে কয়েকটা লম্বা কালো চুল আটকে আছে।

দেখা মাত্র ফোকর গলিয়ে ওপাশে গেলুম। বালির ওপর বড়-ছোট পাথরের ধসে পড়া চাঁই পড়ে আছে। সেই বালিতেও দেবে যাওয়া জুতোর ছাপ। বাঁদিকে ঘুরে গেছে ছাপগুলো। একটা ফুট তিনেক খাড়া দেয়ালের ভাঙা অংশের নিচে সটান ঢালু বালিয়াড়ি বিচের কিনারায় শেষ হয়েছে। সেই ঢালু বালিয়াড়িতে একটা জায়গা ধস ছেড়েছে এবং এখন জোয়ারের সময় সমুদ্রের ফেনিল জলের হাল্কা স্তরগুলো বিচের কিনারা অব্দি ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ধস ছাড়া জায়গাটা দেখে বুঝলুম, এখান দিয়েই ভারী জিনিসটা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিচে। বিচের সব চিহ্ন জোয়ার এসে ধুয়ে ফেলেছে। কিন্তু সবই স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে।

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলুম প্রথমে দীপের বাংলোয়। কিন্তু ডাকাডাকি করেও তার সাড়া পেলুম না। তখন থানায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালুম।

কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে কী একটা বোধ মাথার ভেতর ঝিলিক দিল। ডাইনের ঘাস-জমিতে পায়ে চলা রাস্তাটা দিয়ে ফিরে গেলুম উদয়াচলে–আমার ডেরায়। গিয়ে দেখি, গেটে তালাবন্ধ করে গউর রোজকার মতো সাইকেলে চেপে বাজারে গেছে। সাড়ে ছটা বাজে। ডুপ্লিকেট চাবি আছে আমার কাছে। গেট খুলে বারান্দায় পৌঁছুতে দু সেকেন্ডও লাগল না। প্রথমে ঘরে ঢুকেই ফোনের লাইন চেক করলুম। ফোন তেমনি ডেড। তখন তারটি টেনে বের করলুম ওয়াড্রোবের পেছন থেকে। তারপর আবিষ্কার করলুম–হ্যাঁ, আমি তো এটা জানতুমই, তারটা কাটা রয়েছে।

কিটব্যাগে কখন-কী-কাজে-লাগে ভেবে সব সময় টুকিটাকি স্কুড্রাইভার, খুদে ছুরি এসব মজুত রাখি। ঝটপট তার জোড়া দিতেই লাইন চালু হলো। প্রথমেই রিং করলুম আর্মিক্যাম্পের কমান্ডান্ট মিঃ চোপরাকে। চোপরা আমার এক সামরিক অফিসার বন্ধুর ছেলে। তাকে যখন জিগ্যেস করলুম, চন্দনপুর বিচে পৌঁছুনোর জন্য এনট্রি-গেট ছাড়া আর কোনও পথ আছে কি না– বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে, সে খুব অবাক হয়ে হাসতে লাগল। বলল, না। সি-বিচের দক্ষিণে লাইটহাউসের পর ব্যাকওয়াটার–ভীষণ কাদা আছে। আর উত্তরে বিচের শেষদিকে চোরাবালি আছে। প্রটেক্টেড এরিয়া। এছাড়া উত্তরে আর্মির গুলিগোলা প্র্যাকটিসের জায়গা। কাজেই প্রটেক্টেড এরিয়া। দক্ষিণে আর্মিক্যাম্প। পশ্চিমে ওই গেট আর দুধারে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। অতএব গাড়ি নিয়ে ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। পায়ে হেঁটে? অসম্ভব। মিলিটারির চোখ এড়িয়ে কোনো ট্রেসপাসারের ঢোকার সাধ্য নেই। কিন্তু এসব প্রশ্ন কেন?

পরে জানাব, বলে ফোন রাখলুম। এবার ডায়াল করলুম এনট্রি গেটের অফিসারকে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে–গতকাল পর্যন্ত কেউ চন্দনপুরে ঢুকেছে কি না? অফিসারটি চোপরার সুবাদে আমাকে খাতির করেন। জানালেন, তিনজন ঢুকেছেন এই সময়ের মধ্যে। এক : আমি। দুই : মেহেরগঞ্জের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্রের পুত্র দীপঙ্কর এবং পুত্রবধূ সুভদ্রা।

পুত্রবধূ! আমার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেলে অফিসার ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন। বললেন, ওকে কর্নেল! মে বি হিজ ফিয়াসে অর আ লাভ-গার্ল! আপনি নিশ্চয় শুনেছেন চন্দনপুর বিচকে লাভার্স বিচ বলা হয়?

ফোন রেখে চুরুট ধরালুম। ছটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। একটু ইতস্তত করে থানায় রিং করলুম। ডিউটি অফিসারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললুম, প্লিজ ও সি মিঃ মোহন পটনায়ককে বলুন, আমি একটা খুব জরুরি কথা বলব।

এক মিনিট পরে পটনায়কের সাড়া পেলুম। …হ্যালো ওল্ড ম্যান। ইউ আর হেয়ার অ্যাট লাস্ট! ও মাই গড! শুনেছি, প্রবাদ আছে : কর্নেল যেখানে, ডেডবডি সেখানে। উঃ! আপনাকে নিয়ে পারা যায় না মশাই! কবে এসেছেন? একবার রিং করবেন তো! সেই কবে ভুবনেশ্বরে ডঃ সীতাকান্তের বাড়িতে দেখা–এক বছর আগে! তো–

দ্রুত বললুম, শিগগির দলবল নিয়ে সি-বিচে চলে যান। আমি সেখানেই ওয়েট করব।

ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালুম। এবার একটা কাজ বাকি। জরুরি কাজ। গউর ফেরার আগেই সেটা সেরে ফেলতে হবে। জানি না সফল হব, না ব্যর্থ। কিন্তু এই কাজটাই এখন আসল কাজ।…

.

কে যেন বলেছিলেন, সমুদ্র অন্যের কিছু নেয় না নিলে তা ফিরিয়ে দেয়। ফিরিয়ে দিয়েছে সুভদ্রাকে।

একদল নুলিয়া ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল বিচের একখানে-কাল বিকেলে বিচের যে পাথরটায় বসেছিলুম, সেখানে। আমিও পৌঁছেছি বালিয়াড়ির মাথায়, পটনায়কের জিপও এসে পড়েছে একই সময়ে। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল আর একজন এস আই। পটনায়ক জিপ থেকে নেমেই সহাস্যে বললেন, হোয়্যার ইজ ইওর ডেডবডি, কর্নেল?

আঙুল দিয়ে নিচের বিচের নুলিয়াদের ভিড়টা দেখিয়ে দিলুম। পুলিশবাহিনী বালিয়াড়ি ভেঙে ধস ছাড়ার মতো নেমে গেল। আমি গেলুম–অন্তত এক মিনিট পরে।

গলায় শাড়ির ফঁস শক্ত করে আটকানো ধূসর এক মৃতদেহ প্রায় উলঙ্গ যুবতীর নিস্পন্দ শরীর। নোনাজলে সাদাটে দেখাচ্ছে। জিভ দাঁতের ফাঁকে। ব্লাউস ফর্দাফাই–একাংশ টিকে আছে। ব্রা নেই।

পটনায়ক ঠোঁট কামড়ে ধরে দেখছিলেন। এসে আমার একটা হাত নিয়ে একটু তফাতে গিয়ে চাপা স্বরে বললেন, বলুন কর্নেল!

সংক্ষেপে দ্রুত সব বললুম। শোনার পরই পটনায়ক চাপা গর্জন করলেন, দা ব্লাডি বাস্টার্ড! তারপর আমার দিকে ঘুরে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, লাভার্স বিচের ট্রাডিশন, কর্নেল! এই বিচে কী আছে জানি না, এই এক বছর ধরে দেখছি–এ নিয়ে তিনটে মেয়ের ডেডবডি পাওয়া গেল। আগের দুটোকেও মারতে নিয়ে এসেছিল তাদের প্রেমিক। আগের বহু কেস-হিসট্রিতেও একই ব্যাপার দেখেছি। এবার আমার আমলে দিস ইজ দা থার্ড কেস। আই ড্যাম কেয়ার অফ দা ওয়েলদি বিজনেসম্যান মহাপাত্র! শুনেছি, তার পলিটিক্যাল গার্জেন ইজ দা মোস্ট পাওয়ারফুল ম্যান ইন ওড়িশা! সো হোয়াট? আইন তার নিজের পথে চলবে।

মিঃ পটনায়ক! ডাকলুম ব্যস্তভাবে।

পটনায়ক ঘুরে বললেন, বলুন কর্নেল!

দীপঙ্কর তার ফিয়াসেকে খুন করেনি।

হোয়াট? পটনায়ক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ফের বললেন, হোয়াই নট? পয়েন্টটা কি আপনার?

শান্তভাবে বললুম, সুভদ্রাকে একটা লোক মিথ্যা কথা বলে ডেকে এনে ওই কুঠুরির ভেতর রেপ করেছিল কাল বেলা আড়াইটের মধ্যে। হ্যাঁ-ওটাই সম্ভাব্য সময়। শি ওয়াজ বুটালি রেল্ড অ্যান্ড কিল্ড বাই হিম। কারণ রেপ করার পর এ ছাড়া তার বাঁচার উপায় ছিল না।

পটনায়ক আস্তে বললেন, কে সে?

পকেট থেকে দলা-পাকানো একটুকরো ভাঁজ করা কাগজ–যা আমি ভজ করেছি, ওঁর হাতে গুঁজে দিলুম। বললুম, সুভদ্রা–যা বুঝতে পেরেছি, খুব সরল আর বোকা মেয়ে ছিল। তাকে বহুবার–গত দু-দিন ধরে বাইনোকুলারে ওয়াচ করেছি। হ্যাঁ–সে হাসিখুশি সরল মেয়েই ছিল। পাছে ওভাবে গতকাল বেলা দুটোর পর দীপঙ্কর তাকে একা বেরুতে দেখলে কী ভাববে, তাই সরল মনেই এই চিঠিটা লিখে রেখে এসেছিল। দীপঙ্কর ঘুমুলে তার একা আসা হতো না। আর একটা কথা, লোকটা জানলার ফাঁক দিয়ে অথবা কোনোভাবে সুভদ্রাকে চিঠিটা লিখতে দেখেছিল বলেই আমার ধারণা। তাই সে গতরাতে সাতটা নাগাদ এক সুযোগে ওটা চুরি করে নিয়ে আসে। দীপঙ্কর তখন বাথরুমে ছিল। দরজা ও গেট ছিল খোলা। ওর মাথার ঠিক ছিল না তখন।

পটনায়ক বললেন, কিন্তু-কিন্তু চিঠিটা দীপঙ্কর কোথায় রেখেছে সে জানল কীভাবে?

বললুম, খুব সহজে। দীপঙ্কর চিঠিটা পেয়েই বিচে খুঁজতে আসে সুভদ্রাকে। আততায়ী তার দিকে লক্ষ্য রেখেছিল। চিঠিটা স্বাভাবিকভাবেই দীপঙ্করের হাতে এই বিচে দাঁড়িয়ে আবার তাকে পড়তে দেখেছিল আততায়ী। তার ভয়ও ছিল, দীপঙ্কর ডেডবডিটা খুঁজে পায় যদি! অবশ্য তখন ডেডবডিটা ওই কুঠুরির ভেতর বালিতে পোঁতা ছিল। কাল রাতে একই কারণে সে ঢিল ছুঁড়ে আমাকে ওদিকে পা বাড়াতে দেয়নি।

পটনায়ক শ্বাস ছেড়ে বললেন, ওকে! কিন্তু আপনি এটা পেলেন কোথায়?

পাণিগ্রাহীর উদয়াচল বাংলোর কিচেনের পেছনে ছাইগাদায়।

হোয়াট? পটনায়ক আবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। হোয়াট ডু য়ু মিন বাই দ্যাট কর্নেল? হু ইজ দা ব্লাডি কিলার? কে সে?

আমার সঙ্গে চলুন। আপনি একাই যথেষ্ট। ওঁদের বলে আসুন, বডি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।

এই কথা বলে ধীরে সুস্থে আমি বালিয়াড়ির দিকে পা বাড়ালুম।…

.

গউর আমার ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল। একবার তাকিয়েই কিচেনে গিয়ে ঢুকল। পটনায়ক এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। সোজা কিচেনে ঢুকেই তার জামার কলার আঁকড়ে ধরলেন।

অমনি চমকে উঠে কয়েক সেকেন্ডের জন্য গোবেচারা ধরনের ওই মধ্যবয়সী লোকটির মধ্যে হিংস্র চিতাবাঘের রূপ দেখলুম। তারপর আবার তার রূপা ঘটল। আগের মতো গোবেচারা সরল মুখ। পটনায়ক তাকে টানতে টানতে আমার সামনে দিয়ে নিয়ে গেলেন। একটিবারও সে মুখ খুলল না।

আর তার তৈরি ব্রেকফাস্ট খাওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে। নিজে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ইচ্ছে করছিল না। পটনায়কের জিপের শব্দ মিলিয়ে গেলে তালা এঁটে বেরিয়ে পড়লুম।

দীপঙ্করের বাংলোয় গিয়ে দেখি গেটে তালা। তখন বিচের দিকে এগিয়ে গেলুম। হ্যাঁ–যা আশা করেছিলুম, ঠিক তাই।

তখনও নুলিয়া ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ির একটা দল আর দুজন কনস্টেবল সুভদ্রার মৃতদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এস আই ভদ্রলোক নিশ্চয় অ্যামবুলেন্সে খবর দিতে গেছেন।

দীপঙ্কর একটু দূরে একটা পাথরে বসে আছে। একটুকরো প্রাচীন ভাস্কর্য যেন। সমুদ্রের জল এসে আছড়ে পড়ছে পাথরটার ওপর। ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাকে। কাছে গিয়ে ডাকলাম, দীপ! ডার্লিং!

দীপঙ্কর তাকাল না।

দীপ, সুভদ্রার খুনী ধরা পড়েছে।

দীপঙ্কর নড়ে উঠল। তারপর একলাফে পাথর থেকে নেমে দৌড়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। আঁটো চোয়াল। লাল চোখ। উস্কোখুস্কো চুল মুখের ওপরটা বারবার ঢাকা পড়ছে। হিসহিস করে বলল, কে? সে কে?

আস্তে বললুম, আচ্ছা দীপ, গউর নামে পাণিগ্রাহীর বাংলোর কেয়ারটেকারকে তো তুমি চেনো?

দীপঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। বলল, নাও আই আন্ডারস্ট্যান্ড।

কী দীপ?

গউর আমাদের ফলো করে বেড়াত।

সে তোমার বাংলোয় গেছে কখনও?

হ্যাঁ। দীপঙ্কর ভাঙা গলায় বলল। কাজকর্ম করে দিত একটু-আধটু। গতকালও সকালে সে জানতে গিয়েছিল কিছু দরকার আছে নাকি। কিন্তু–

তাকে থামিয়ে দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে চললুম তার বাংলোয়। সেখানে পৌঁছেই ফোন করলুম থানায়। পটনায়ক সাড়া দিয়ে খ্যা খ্যা করে হেসে বললেন, এক গুঁতোতেই কবুল করেছে কর্নেল! শয়তানটা বলছে, সে চুপিচুপি সুভদ্রাকে বলেছিল, মহাপাত্ৰমশাই সুভদ্রার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে এসেছেন। ছেলের বিরুদ্ধে তাঁর কিছু বলার আছে, সেটা সুভদ্রাকে গোপনে জানতে চান। তাই শুনেই সুভদ্রা ওর কথামতো ওই ছোট্ট কুঠুরিতে গিয়ে মহাপাত্রমশাইকে খোঁজে এবং–

দীপঙ্করের গলায় বলে উঠলুম, ওক্কে! আই আন্ডারস্ট্যান্ড! বাট–অফ কোর্স ইটস নট দা ট্রাডিশনাল অ্যাফেয়ার অফ দা লাভার্স বিচ। এ একটা নতুন ঘটনা–তাই না মিঃ পটনায়ক?

পটনায়কের খ্যাখ্যা হাসি ভেসে এল দূর থেকে। হ্যাঁ কর্নেল, ট্রাডিশান ভেঙে দিয়েছে হারামজাদা গউড়—অ।…

 লাল ফিতের আড়ালে

পূর্ব উপকূলে কুম্ভকোণম নামে ছোট্ট সুন্দর একটি বেলাভূমির কথা জানতাম না যদি না আমার স্নেহভাজন তরুণ পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ শান্তনু দাস মহাপাত্র সেই খবর দিত।

একটু খটকা অবশ্য লেগেছিল। কারণ শান্তনু খবরটা ট্রাঙ্ককলে দিয়েছিল এবং আমাকে আমার শরৎকালীন ভ্রমণ-সূচী বদলে শিগগির সেখানে যেতে বলেছিল। তার শেষ বাক্যটি ছিল, আপনার আগ্রহ জাগানোর মতো কিছু জিনিস এখানে আছে।

তো গিয়ে দেখলাম, চন্দ্রকলার মতো একটুকরো বিচের মাথায় বিত্তবানদের ডজনখানেক নতুন বাংলো, একপ্রান্তে ছোট্ট জেলেবসতি, সরকারি ট্যুরিস্ট লজ এবং পাশাপাশি দুটি অফিস–একটি সমুদ্রবিজ্ঞান, অপরটি পরিবেশবিজ্ঞান সংক্রান্ত। কিন্তু প্রথমেই চোখে পড়ার মতো বিষয় নির্জনতা। বাইনোকুলারে অবশ্য জেলেবসতির দিকে কিছু মানুষজন চোখে পড়ল। তারা ভেলা নৌকো, জাল, অন্যান্য গেরস্থালি নিয়ে ব্যস্ত। একদঙ্গল কাচ্চাবাচ্চা সমুদ্রের সঙ্গে অকুতোভয়ে খেলছে। ওখানে বিচটা মারাত্মকভাবে ঢালু। মাথার ওপর একটা কাছিমের গড়ন টিলা। তারই গায়ে এলোমেলো সাজানো কুঁড়েঘর।

ওদের কি এই বিচে আসতে দেওয়া হয় না?

আমার এই প্রশ্ন শুনে শান্তনু বলল, কাটাতারের বেড়া দেখতে পাচ্ছেন না? পুরোটা নেটিফায়েড এরিয়া।

এতক্ষণে বেড়াটা বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তবে ওটা না থাকারই শামিল। বালিতে ডুবে গেছে কোথাও এবং কোথাও বা গলিয়ে আসার মতো যথেষ্ট ফাঁক।

শান্তুনু একটু হাসল। কৈফিয়ত একটা আছে। ওরা বিচ নোংরা করে। কিন্তু কোটিপতিদের অনেক সময় প্রকৃতিকে এবং নির্জনতার দরকার হয়। সরকারি ট্যুরিস্ট লজটাও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। সেখানে অবশ্য সরকারি আমলারা কিংবা কোম্পানি-একজিকিউটিভরা ওঠেন। এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টে। আর মাঝে মাঝে সেমিনার।

বিচের উল্টো প্রান্তে বাইনোকুলারে সমুদ্রে আছড়ে পড়া একটা ধ্বংসস্তূপ দেখে বললাম, প্রাচীন স্থাপত্য মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ। আমার ধারণা, কোনও বৌদ্ধস্তূপ ছিল। এলাকার লোকেরা বলে, ওটাই নাকি সমুদ্রমন্থনে পাওয়া অমৃতকুম্ভের একটা টুকরো। তাই কুম্ভকোণম নাম।

বাইনোকুলার নামিয়ে প্রচণ্ড সামুদ্রিক হাওয়া আড়াল করে চুরুট ধরালাম। তারপর বিচে নেমে গিয়ে বললাম, তবে এই বিচটা চন্দ্রকলার চেয়ে কুম্ভ বা কলসির অর্ধেক ভাঙা কানার মতো। তা থেকেও কুম্ভকোণম নাম হতে পারে। স্থান নামের ব্যাপারে আমার তত্ত্ব হল, সচরাচর সাধারণ লোকেরা খুব চেনাজানা জিনিস দিয়ে কোনও স্থানকে চিহ্নিত করতে চায়। পরে শিক্ষিতেরা মাতব্বরি করে নামটা ভদ্রস্থ করে ফেলেন।

শানু পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, সমুদ্রবিজ্ঞানী রেড্ডি সায়েবের মতে এটা আসলে একটা খাড়ি ছিল। কারণ এমন অদ্ভুত গড়নের বিচ কোথাও দেখা যায় না। তো উনি তা প্রমাণের জন্য নিজেই খোঁড়াখুঁড়ির প্ল্যান করেছিলেন। হঠাৎ মারা গেলেন।

ঘুরে শান্তনুর দিকে তাকালাম। বিকেল পাঁচটাতেই বিচে ছায়া নেমেছে। ওর চোখে কী একটা ছিল। বললাম, কত দিন আগে?

আপনাকে ট্রাঙ্ককল করার আগের দিন। ভোরে এই বিচে জগিং করার অভ্যাস ছিল। এখানেই ওঁর বডি পাওয়া যায়।

একটু হেসে বললাম, তোমার ট্রাঙ্ককলে একটু খটকা লেগেছিল।

শান্তনু হাসল না। বিষণ্ণ মুখে বলল, আগেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভেবেছিলাম। পরে পতেছি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ছাড়া এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ তো আজকাল দেখি না। পুলিশকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা মানেই হইচই এবং হয়রানি। তাছাড়া ইদানীং এ রাজ্যে শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তামিলদের আনাগোনা বেড়েছে। কার কোথায় ঘা লাগবে।

সামুদ্রিক হাওয়া বড্ড বেশি জোরালো হচ্ছিল এবং অস্বস্তিকরও। আমার দাড়ি যেন উপড়ে নেবে সমুদ্র। টুপিটাও সামলানো যাচ্ছে না। বললাম, চলো। ফেরা যাক।

ছোট-বড় নানা গড়নের পাথর বিচের ওপরে ওঠার জন্য প্রায়-নৈসর্গিক একটা সোপান। ওপরে উঠে একজন প্রৌঢ় শক্ত সমর্থ গড়নের ভদ্রলোককে দেখলাম। তাঁর এক হাতে ছড়ি, অন্য হাতে চেনে বাঁধা প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ান। বললেন, হাই মহাপাত্র!

শাক্তনু পাল্টা মার্কিন রীতিতে বলল, হাই ডঃ কেশবন

কদিন থেকে দেখছি সন্ধ্যার দিকে সমুদ্র যেন খেপে যাচ্ছে! ব্যাপার কী?

ইংরেজিতে কথা হচ্ছিল। শান্তনু আলাপ করিয়ে দিল। ডঃ আর কেশবন। আমার দফতরের প্রধান। ডঃ কেশবন, ইনি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, উঃ কেশবন আমাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে দেখে নিয়ে সহাস্যে বললেন, আপনা) ভারতীয় ভাবিনি। আপনাকে দেখে আমার ধারণা, আপনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল!

বললাম, অবশ্যই। আমার বয়স প্রায় সত্তর হয়ে এল।

আপনার চেহারা ফাদার ক্রিসমাসের মতো! কিছু মনে করবেন না কর্নেল সরকার! এ যাবৎ যত সামরিক মানুষজন দেখেছি, সবার চেহারায় কাঠখোট্টা ছাপ থাকে। আপনার চেহারায় কোমলতা আছে।

ডঃ কেশবন প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। শান্তনু কেটে পড়ার ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকল। একটু তফাতে গিয়ে বলল, লোকটা বেজায় দাম্ভিক। মেজাজ থাকলে বড় বাজে রসিকতা করে। সব চেয়ে অসহ্য ব্যাপার, সব সময় সঙ্গে ওই কুকুর। অফিসেও কুকুর নিয়ে যায়।

ওর বাংলো ধাঁচের কোয়ার্টারের বারান্দায় বসলাম। এখান থেকে বিচ দেখা যায় না। সমুদ্র বিশাল হয়ে চোখে আটকে যায়। শান্তনু ভুবনেশ্বরের ছেলে। ওর স্ত্রী মালবী কলকাতার মেয়ে এবং বাঙালি। নিজেই ট্রে সাজিয়ে কফি এবং স্ন্যাক্স আনল। মিষ্টি চেহারার মেয়ে। কফি তৈরি করে দিয়ে বলল, ফাদার ক্রিসমাসের চোখে কোনও রহস্য ধরা পড়ল কি?

শান্তনু বিব্রতভাবে বলল, আহ্! বড় বাজে রসিকতা এটা। একটু আগে ডঃ কেশবনও—

ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমি এই কথাটা উপভোগ করি। মালবী, তুমি রহস্যের কথা বলছিলে। হুঁ, কুম্ভকোণমের বিচ সত্যিই রহস্যময়।

মালবী অন্যমনস্কভাবে বলল, বিচটা ওপর থেকে দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু নামলে কেমন অস্বস্তি হয়। যেন এক্ষুণি সমুদ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

বসো মালবী! বলল, তোমার রিসার্চ কতদূর এগোল?

মালবী বেতের চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসে বলল, এগোচ্ছে না। সোর্স মেটিরিয়্যালসের জন্য বারবার কলকাতা ছোটাছুটি। হঠাৎ ওকে এখানে ট্রান্সফার করে দেবে জানলে–

বিয়েই করতে না! শান্তনু বলল। কিন্তু দেখুন কর্নেল, আমি মোটেও ওকে জোর করে এখানে টেনে আনিনি।

বললাম, ডার্লিং! এটা তোমাদের ক্ষেত্রে চমৎকার হনিমুন ধরে নাও।

মালবী বলল, ওসব কথা থাক। কাল বিকেলে অফিস থেকে ফিরে শান্তনু যখনই বলল, আপনি আসছেন, আমি অমনিই ব্যাপারটা হয়ে গেলাম। আচ্ছা কর্নেল, একটা প্রশ্ন। গোয়েন্দা উপন্যাসে দেখা যায় গোয় কোনও হত্যাকাণ্ডের পর তবেই হত্যাকারীকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে গোয়েন্দা টের পাচ্ছেন কাউকে হত্যার চক্রান্ত হচ্ছে। অথচ গোয়েন্দা যেন চরম মূহুর্তের অপেক্ষায় আছেন। কেন? আগেভাগে তাকে ধরিয়ে দিলেই তো বেচারা বেঁচে যায়।

বললাম, উপন্যাসে হোক বা বাস্তবে হোক, যতক্ষণ না সত্যিই কোনও হত্যাকাণ্ড ঘটছে, ততক্ষণ হত্যাকারী নিছক বিমূর্ত সত্তা। চরম মুহূর্তের পর সে মূর্ত রক্ত-মাংসের মানুষে পরিণত হয়। আর তুমি হত্যাকারীর চক্রান্ত টের পেয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলছ। ব্যক্তিগত এবং ডেলিবারেট খুনখারাপির চক্রান্তের কেসে চক্রান্তকারীকে আগে ধরাতে গেলে আইনের ধোপে টেকে না। তাকে জানিয়ে দিলে কিংবা শাসিয়ে দিলে সে প্ল্যান বদলাবে। ভিকটিমের ক্ষেত্রেও তাই। এসব কারণেই যিনি গোয়েন্দাগিরি করেন, তাঁর প্রকৃত ভূমিকা শুরু হয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে।

শানু বলল, কোনও মার্ডারই আটকানো যায় না, যদি তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের ডেলিবারেট মার্ডার হয়।

মালবী আস্তে বলল, তুমি যা-ই বল, ডঃ রেড্ডিকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল।

দিলেও কোনও লাভ হত না। মার্ডারার অন্য কোথাও অন্য কোনও ভাবে তাঁকে মারত। শান্তনু চেয়ারে হেলান দিয়ে ফের বলল, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, উনি খুন হয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, ঘটনাগুলোর যেন গুরুত্ব ছিল। আগে তো আমার কাছে সেগুলো যত অদ্ভুত হোক, অর্থহীন ঘটনা।

বললাম, যেমন?

শানু খুব আস্তে বলল, ডঃ রেড্ডি এবং ওঁর দফতরের ডঃ পোট্টেকাট একদিন বিকেলে বিচের মাথায় দাঁড়িয়েছিলেন। একটু তফাত থেকে শুনতে পেলাম ডঃ পোট্টেকাট ওঁকে বলছেন, তুমি ওসবে নাক গলাতে যেও না। মারা পড়বে। ডঃ রেড্ডি খটরাগী মানুষ ছিলেন। চটে উঠে বললেন, আমার হাতে প্রমাণ আছে। আর একদিন ডঃ রেড্ডিকে সন্ধ্যাবেলায় ওঁর কোয়ার্টারের গেটে দেখে যেই পেছন থেকে ডেকেছি, অমনিই ভীষণ চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু সেটা অদ্ভুত লাগেনি। অদ্ভুত লাগল ওঁকে প্যান্টের পকেট থেকে দ্রুত ফায়ারআর্মস বের করতে দেখে। তারপর অবশ্য সেটা লুকিয়ে ফেলে নার্ভাস হেসে আমাকে বললেন, ও! তুমি? আমি ভাবলামকাকে ভেবেছিলেন বললেন না। আমারও জিজ্ঞেস করা ঠিক হত না। সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল, বিচের উত্তর প্রান্তে যে ধ্বংসস্থূপ দেখলেন, সেখান থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে ছুটে পালিয়ে আসা। কাছাকাছি পৌঁছুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? উনি বললেন, ওখানে সামুদ্রিক অজগর আছে। ভুলেও ওদিকে পা বাড়িয়ো না।

ততক্ষণে কফি শেষ। আধপোড়া চুরুট জ্বেলে বললাম, বডি ভোরবেলা বিচে পাওয়া যায় বলেছ। কী অবস্থায় ছিল?

উপুড়। মাথার ডানদিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়েছিল। স্পষ্ট ডেড।

কে প্রথম বডি দেখেছিল?

অনেকেই ওই সময় বিচে জগিং করতে যায়। বিশেষ কেউ আগে দেখেছিল বলে শুনিনি। তবে ডঃ রেড্ডি বরাবর সবার আগে যেতেন জানি। কারণ আঞ্জি খুব ভোরে উঠি। বিচে যাওয়ার পথটা এই বারান্দা থেকে দেখা যায়।

তুমি খুব ভোরে ওঠ কেন?

শান্তনু হকচকিয়ে গেল। মালবী অস্থির হেসে বলল, গোয়েন্দাদের রীতি প্রত্যেককে সন্দেহ করা। নাও! এবার এক্সপ্লেন করো!

শান্তনু হাসল না। একই ভঙ্গিতে বলল, কিছু বিশেষ প্রজাতির উদ্ভিদে শিশিরের এফেক্ট নিয়ে আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছি।

মালবী মন্তব্য করল, বেঁচে গেলে। কর্নেল, এবার আমাকে সন্দেহ করুন।

একটু হেসে টাকে হাত বুলিয়ে বললাম, ডঃ রেড্ডি যদি শান্তনুর মতো তরুণ, স্বাস্থ্যবান এবং রূপবান হন–

মালবী দ্রুত বলল, প্রেমিক হিসেবে একেবারে অযোগ্য। রোগা, বেঁটে, কুচকুচে কালো টিপিক্যাল দ্রাবিড়। বয়স আমার দ্বিগুণ। তার চেয়ে সাংঘাতিক, ভদ্রলোকের স্ত্রী জেলাস টাইপ মহিলা। শান্তনুকে জিজ্ঞেস করুন। ওঁর অফিসেরই কাজে কোনও মহিলাকর্মী গেলে জেরায় জেরবার করে ছাড়তেন। একবার আমি কী বিপদে পড়েছিলাম বলার নয়।

সে হেসে উঠল। শান্তনু বলল, ডঃ রেড্ডি একানড়ে স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমি যতবার দেখেছি, অফিসের বাইরে ওঁকে একা দেখেছি। দৈবাৎ কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে এবং সেই লোকটা কথা বললে কিছুক্ষণ সঙ্গ দিতেন। যেমন দেখেছিলাম ডঃ পোট্রেকাটের সঙ্গে। কিংবা আমার সঙ্গেও কিছুক্ষণ কথা বলতেন।

বললাম, জগিংয়ের সময় কি উনি শর্টস্ পরতেন?

হ্যাঁ। চালচলনে খুব স্মার্ট এবং সায়েবি কেতাদুরস্ত ছিলেন।

ওঁর পকেটে কোনও ফায়ারআর্ম পাওয়া গিয়েছিল?

পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের একটা রিভলবার ডান হাতের কাছে পড়েছিল। সেটা ওঁরই এবং লাইসেন্স করা অস্ত্র। মর্গের রিপোর্টে বলা হয়েছে একই রিভলবারের গুলি মাথার ভেতরকার হাড়ে আটকানো ছিল। বুলেট কেসে ছটা বুলেটের মধ্যে একটা ফায়ার্ড।

তাহলে পুলিশের বক্তব্য, এটা আত্মহত্যা?

শান্তনু শ্বাস ছেড়ে বলল হ্যাঁ!

কিন্তু তুমি বলতে চাইছ এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা?

ডেলিবারেট মার্ডার।

তোমার এই ধারণার কারণ কি একটু আগে যে ঘটনা তিনটি বললেন, তা-ই?

শান্তনু একটু চুপ করে থাকার পর বলল, কোনও সুইসাইডাল নোট পাওয়া যায়নি। কিন্তু পুলিশ বলেছে, খটরাগী স্বভাবের লোকেদের পক্ষে এভাবে আত্মহত্যা স্বাভাবিক। ওঁর কলিগ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিসের ধারণা হয়েছে, উনি শিজোফ্রেনিক টাইপ ছিলেন। অনেক সময় জানতেন না কী করছেন। একবার নাকি একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাঁইলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

তোমাদের দফতরের সঙ্গে ডঃ রেড্ডির দফতরের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকা উচিত।

আছে। আমরা পরস্পর ডেটা বিনিময় করি।

মালবী উঠে গেল পরিচারিকার ডাকে। এতক্ষণে আলো জ্বলল। বললাম, আত্মহত্যার চিঠি না পাওয়া গেলেও তোমার বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনাটা আত্মহত্যাই দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু তুমি জোর দিয়ে বলছ হত্যা।

শান্তনুকে ঈষৎ উত্তেজিত মনে হল। কর্নেল! ডঃ রেডিন্ড লেফট্‌হ্যাঁন্ডার ছিলেন। তার পক্ষে নিজের মাথার ডানদিকে কানের ওপর রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গুলি চালানো সম্ভব নয়।

তুমি নিশ্চিত?

অবশ্যই। কিন্তু আশ্চর্য, পুলিশ এবং অন্য কারও মাথায় এল না প্রশ্নটা!

তুমি প্রশ্নটা কেন—

আমার কথার ওপর শান্তনু বলল, সাহস পাইনি। এখানে যত হোমরাচোমরা লোকের বসবাস। কার কোথায় কী ইন্টারেস্ট আছে, জানি না। মালবীর সঙ্গে আলোচনার পর আপনাকে আসতে বলেছি।

মিসেস রেড্ডি কি আছেন, না চলে গেছেন?

কাল বিকেলে চলে গেছেন। মাদ্রাজের ওদিকে কোন্ গ্রামে ডঃ রেড্ডির পৈতৃক বাড়ি। সেখানে ওঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। একটু চুপ করে থাকার পর শান্তনু ফের বলল, এমন হতে পারে, পুলিশের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মিসেস রেড্ডি অর্ধশিক্ষিত মহিলা। তাছাড়া সেকেলে এবং গ্রাম্য স্বভাবেরও বটে।

চুরুট অ্যাশট্রেতে ঘষটে নিভিয়ে বললাম, তাহলে হত্যার সময় ধস্তাধস্তি অনিবার্য ছিল। নিজের রিভলবার খুনীকে পকেট থেকে বের করে দেবেনই বা কেন ডঃ রেড্ডি? কিংবা ধর, খুনীকে শাসাতে বা খুনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রটা বের করেছিলেন। খুনী তা কেড়ে নিয়ে গুলি করে। এনি ওয়ে! ধস্তাধস্তি অনিবার্য ছিল। বিচের নরম বালিতে ছাপ থাকা উচিত ছিল।

ডেডবডির তলা দিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের স্তর বয়ে এসেছিল। আমি লক্ষ্য করেছি।

হুঁ। তাহলে তেমন কোন চিহ্ন মুছে যাওয়াই স্বাভাবিক। দাড়ি থেকে অভ্যাস মতো চুরুটের ছাই ঝেড়ে ফেলে বললাম, ডঃ রেড্ডির সঙ্গে এখানে কার ঘনিষ্ঠতা ছিল–মানে বন্ধুত্ব।

শান্তনু মাথা নাড়ল। কারও সঙ্গে না। ওঁর রগচটা স্বভাবের জন্য কেউ ওকে পছন্দ করত না। আমিও না।

মালবী দরজার পর্দার ফাঁকে দাঁড়িয়ে বলল, সেকেন্ড রাউন্ড কফি?

বললাম, জিজ্ঞেস করছ ডার্লিং? ওঃ! তুমি যে ফাদার ক্রিসমাসকে শীতের কলকাতায় দেখেছিলে, সে এই শরতে একটুও বদলায়নি।

মালবী একমুখ হাসি নিয়ে অদৃশ্য হল। ওর মুখে এখনও বালিকার আদল।

শান্তনু বলল, আচ্ছা কর্নেল, এমন কি হতে পারে না, ডঃ রেড্ডি জগিংয়ের সময় ফায়ারআর্ম সঙ্গে রাখতেন না কারণ তখন বিচে আরও অনেকে আসে?

ঠিক বলেছ। সেই সময় খুনী ওঁর বাড়ি থেকে রিভলবার হাতিয়ে–

শান্তনু থেমে গেল। বললাম, হুঁ। একটা পয়েন্ট বটে। তবে ওঁর স্ত্রীর অগোচরে তা সম্ভব ছিল কি না, এটাই প্রশ্ন। ধরা যাক, খুনী জানত কোথায় অস্ত্রটা থাকে। খুনীর ও বাড়িতে গতিবিধি অবাধ হওয়ার কথা। তো ওঁর বাড়িতে নিশ্চয় কাজের লোক ছিল?

স্থানীয় একটি মেয়ে। আধ কিলোমিটার দূরে একটা বস্তি আছে। আমাদের এই কাজের মেয়েটিও সেখান থেকে আসে। এখনই চলে যাবে।

কখন আসে?

প্রায় সাতটা বেজে যায়। মারিয়াম্মাকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়। পায়ে হেঁটে ফেরে। কারণ পিচরাস্তা পর্যন্ত কোন সাইকেল-রিকশো যাতায়াত করতে দেওয়া হয় না। বিগ গাইদের ডেরা এই কুম্ভকোণম। দেখে থাকবেন, সাইনবোর্ডে লেখা আছে, নোটিফায়েড এরিয়া। কিন্ত অনুমতিতে আসা যায় না।

শিগগির কফি এসে গেল। লক্ষ্য করলাম, মারিয়াম্মা লন পেরিয়ে চলে গেল। মালবী ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে এল। নিচু বাউন্ডারি ওয়ালের মাথায় তারকাটার বেড়া এবং ঘন দেবদারু শ্ৰেণী।…

শান্তনুর সঙ্গে আমার এই দীর্ঘ বাক্যালাপ থেকে শান্তনুর বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হবে। সে সরাসরি কোন ঘটনাতে পৌঁছাতে চায় না। তার সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে হয়। কলকাতায় থাকার সময় তার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলাম।

হ্যাঁ, এটা এক ধরনের ব্যক্তিগত অভ্যাস বা চরিত্রগত লক্ষণ বলা চলে। কিন্তু তা কিছুটা অস্বাভাবিক তো বটেই। কুম্ভকোণমে এসে এ নিয়ে চিন্তা-ভবনার পর আমার ধারণা হয়েছিল, প্রচণ্ড আতঙ্ক মনের তলায় চেপে রাখলেও এমনটা হতে পারে। এটা তার স্বভাবভীরুতা। অন্য কেউ হলে প্রথমেই ডঃ রেড্ডির মৃত্যুসংক্রান্ত রহস্যময় ঘটনা আমাকে জানিয়ে দিত। তাছাড়া ঘটনাটা যে আত্মহত্যা নয়, স্রেফ হত্যা, তা জানিয়ে দিতে এত সময় নিত না। এমন কি। শা বিকেলে নিচে নেমে একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ তোলার পর প্রথমে শুধু একটি বাক্য দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত করেছিল, হঠাৎ উনি মারা গেলেন। ওর এই আতঙ্কটা অস্বাভাবিক। কেন এত ভয় পেয়েছে ও?

পরদিন সাড়ে পাঁচটায় উঠে অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণের জন্যে বেরুতে গিয়ে দেখলাম, শান্তনু উঠেছে এবং বাংলোর পেছনের দিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঝুঁকে সম্ভবত শিশিরের এফেক্ট পরীক্ষা করছে। সে আমার অভ্যাস জানে। তাই গেটের তালা খুলে রেখেছে। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলাম।

এখন সমুদ্র কিছুটা শান্ত। যেন ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। জনহীন বিচের মাথায় ল্যাম্পপোস্টে যে আলোগুলো জ্বলছে, তাদের রঙ ফিকে। সমুদ্র পূর্বে। পূর্বের দিগন্তে গাঢ় মেঘ। টুপি এবং রেনজ্যাকেট থাকায় বৃষ্টি এলেও ভিজব না। পিঠের কিটব্যাগে প্রজাপতি ধরা নেট এবং স্টিক গোঁজা। হঠাৎ মনে হল, বিচে কি প্রজাপতির আশা করছি? অনাবশ্যক বোঝা। বাইনোকুলারে প্রথমে দক্ষিণের জেলেবসতি, তারপর উত্তরের জলে আছড়ে পড়া ধ্বংসস্তূপের দিকটা দেখে নিলাম। জেলেবসতির দিকে ভেলা নৌকো (এই নৌকোর কোন তলা থাকে না) নিয়ে জেলেদের ব্রেকওয়াটারের সঙ্গে মর্মান্তিক লড়াই চোখে পড়ল। চিরকালের বাঁচার লড়াই। উত্তরের ধ্বংসাবশেষের ওপর দিকটায় জঙ্গল গজিয়ে আছে। আবছা একটা নড়াচড়া দেখলাম যেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটা লোক নেমে এল বিচে। পরনে শর্টস। সে জগিং করতে করতে এদিকে আসছে। বলিষ্ঠ গড়নের মধ্যবয়সী একটা ফর্সা লোক।

বিচের মাঝামাঝি ইচ্ছে করেই তার গতিপথে দাঁড়ালাম এবং কাছাকাছি হওয়ার মুহূর্তে বলে উঠলাম, ধ্বংসস্তূপে কিছু কি খুঁজছিলেন?

থমকে দাঁড়িয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রায় গর্জন করলেন ভদ্রলোক। কী?

বাইনোকুলারে দেখছিলাম আপনি যেন কিছু—

কে আপনি?

পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে দিলাম। একটু হেসে বললাম, ওখানে নাকি সামুদ্রিক অজগরের আস্তানা। তাই আমার কৌতূহল জেগেছে।

কার্ড পড়ে আমাকে ফেরত দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, সামুদ্রিক অজগর সাংঘাতিক। কৌতূহল বিপজ্জনক হতে পারে।

যেমন হয়েছে ডঃ রেড্ডির পক্ষে।

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে ফোঁস ফোঁস শব্দে বললেন, আপনি যে-ই হোন সাবধান করে দিচ্ছি। কোথায় উঠেছেন আপনি?

তার আগে আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?

না। বলে ভদ্রলোক আমার পাশ কাটিয়ে জগিং করতে করতে চলে গেলেন। সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম, ওঁর গলায় সোনার চেন আছে।

জনহীন বিচে উত্তরদিকে হাঁটতে থাকলাম। মাঝে মাঝে থেমে বাইনোকুলারে দেখে নিচ্ছিলাম, সেই ভদ্রলোক জেলেবসতির সীমানা অব্দি গিয়ে ঘুরে আসছেন। তারপর বিচের মাথায় উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করতে থাকলেন।

ধ্বংসস্তূপের মাথায় সহজেই ওঠা যায়। শান্তনুর ধারণা ঠিক। এটা একটা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারই ছিল। যথেচ্ছ গজিয়ে ওটা জঙ্গলের ফাঁকে একটুকরো পাথরে পদ্ম, তারপর একটা টুকরোয় ধর্মচক্রের ক্ষয়টে চাপ চোখে পড়ল। খুঁটিয়ে চারপাশ বাইনোকুলারে দেখে নিলাম সতর্কতাবশে। তারপর এদিকে ওদিকে বালিতে মাথা উঁচু করে থাকা পাথর, ভাঙা স্কুপের শীর্ষাংশ এবং উঁচু নিচু গাছপালার ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ লাল রঙের একটা কুচি (কতকটা ঝরে পড়া রঙ্গনা ফুলের মতো দেখতে) চোখে পড়ল। ওপরে ঝোপে কোন ফুল ফোটেনি এবং ফোটে বলেও মনে হল না। কাছে যাওয়ার আগে বাইনোকুলারে দেখে নিলাম, প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে বিচেরা মাথায় সেই ভদ্রলোক তেমনই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে এতক্ষণে একজন-দুজন করে জগিংয়ের ভঙ্গিতে নামতে শুরু করেছে বিচে। তাদের মধ্যে যুবতীরাও আছে।

বুঝলাম, সামুদ্রিক হাওয়া বালি সরিয়ে দিয়েছে। এই ঝোঁপের তলায় সূর্যের আলো পৌঁছায় না। কারণ রঙ্গনা ফুলের কুচির মতো জিনিসটা ঝোপটার উত্তরে এবং কাণ্ডের কাছে পড়ে আছে। বালি সরানোর আগেই জিনিসটা চিনতে পারলাম। সরু লাল ফিতের মাথা।

বালি সরানোর পর পাথরের একটা পাতলা চাঙড় (স্ল্যাব) বেরুল। সেটা সরালে একটা ফাইল বেরুল। এ ধরনের রদ্দি হলদেটে ফাইল সব সরকারি অফিসের টেবিলে দেখা যায়। ফাইলটা না দেখেই ঝটপট পিঠের কিটব্যাগ খুলে ভেতরে ঢোকালাম। তারপর কিটব্যাগ পিঠে এঁটে প্রজাপতি ধরা জাল হাতে নিয়ে প্রজাপতির পেছনে ছোটাছুটির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করার পর ধ্বংসাবশেষের চাঙড়ে পা ফেলে নেমে এলাম বিচে।

জগিংরত একজন যুবক এবং এক যুবতী আমাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে থেমেছিল। তারপরই তারা এক বুড়ো হাবড়া খেয়ালি লোকের আচরণ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে চলে গেল। সেই ভদ্রলোক তখন বিচের মাথায় একটা পাথরে বসে আছেন। আমি সোজা জেলেবসতির দিকে এগিয়ে গেলাম। একখানে কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে টিলায় উঠলাম। টিলার গায়ে কুঁড়েঘরগুলোর বাসিন্দারা আমাকে গ্রাহ্য করল না। কিন্তু একটু পরেই কাচ্চাবাচ্চাদের দঙ্গল প্রথমে তামিল ভাষায়, তারপর ভাঙা ইংরেজিতে পয়সা দাবি করতে থাকল। এই সময় টিলার মাথায় পাথরের তৈরি ছোট্ট এবং পুরনো গির্জাঘর চোখে পড়ল। এই জেলেরা তাহলে খ্রিস্টান। কাচ্চাবাচ্চাদের চেহারায় যেন পোর্তুগিজদের আদল। প্রাচীন ইতিহাস আমাকে টানে। কিন্তু ফাইলটার টান আরও জোরালো। বাচ্চাগুলোকে কয়েক মুঠো চকোলেট (সব সময় পকেটে রাখি) বিলি করে বাইনোকুলারে শান্তনুর বাংলো খুঁজে বের করলাম। টিলার পশ্চিম ঢাল বেয়ে নেমে গেলাম ঢেউখেলানো বালিয়াড়িতে। তারপর থমকে দাঁড়াতে হল। উঁচু এবং ঘন করে দেওয়া তারকাটার বেড়া। মধ্যে-মধ্যে একটা করে লোহার খুঁটি। একখানে সাঁটা একটুকরো ফলক। তাতে কয়েকটা ভাষায় লেখা : ছুঁলেই মৃত্যু। সাবধান। তার মানে, বিদ্যুত্বহী তার আছে। তার তিনসার এবং কাঁটাতারের বাইরে সমান্তরালে টানা আছে। খুঁটির গায়ে সাঁটা অংশটা কালো নন-কন্ডাক্টিভ জিনিসে তৈরি। হঠাৎ করে চোখে পড়ে না।

অতএব খুব হরয়ানি হল। প্রায় এক কিমি.। বালিয়াড়ি এবং পাথুরে অসমতল মাটি পেরিয়ে অবশেষে পিরাস্তা পেলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে কুম্ভকোণমের প্রবেশপথ। প্রহরীরা পারমিট দেখতে চাইল না, এর নানা কারণ থাকা সম্ভব।

শান্তনুর বাংলোয় পৌঁছুতে আটটা বেজে গেল। মালবী হাসি মুখে বলল, কোনও ক্লু পেলেন?

শুধু বললাম, কফি। আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।…

.

শান্তনু অফিস নটায়! দুপুরে খেতে আসে। ফাইলটার কথা বলে ওকে উত্তেজিত বা নার্ভাস করতে চাইনি। তবে গলায় সোনার চেন এবং ফর্সা রঙের ভদ্রলোকের কথা তুললে সে বলল, বিগ গাই। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিফট। জগদীশ নায়েক। এক সময় মন্ত্রী ছিলেন। গত ভোটে হেরে যান। এখন আর প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেন না শুনেছি। তবে রাজনৈতিক এবং আমলামহলে প্রচণ্ড প্রভাব আছে। থাকারই কথা। কিছু বললেন নাকি আপনাকে?

নাহ্। নিজের পরিচয় দিয়ে পরিচয় চাইলাম। দিলেন না।

শান্তনু আস্তে বলল, ডঃ রেড্ডাি মারা যাওয়ার দুদিন আগে ব্যাটাচ্ছেলে এসেছে। আমাদের হেড ডঃ কেশবন ওর ঘনিষ্ঠ লোক। দেখছি, রোজই। কেশবনকে টেলিফোন করে।

হাসলাম। তোমার আড়িপাতা স্বভাব আছে নাকি?

শান্তনু ব্যস্তভাবে বলল, নাহ্। আসলে ডঃ রেড্ডির ব্যাপারটা নিয়ে—

বুঝেছি। বলে কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালাম। একটু পরে বললাম, ডঃ রেড্ডিকে খুনের কী মোটিভ থাকতে পারে বলে তোমার ধারণা?

শানু বলল, এমন কিছু জানতে পেরেছিলেন, যা খুনীর পক্ষে বিপজ্জনক হত। তাই ওঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে চিরকালের মতো। আর নিজের কানেই তো শুনেছি ডঃ পোট্টেকাট ওঁকে কী বলছিলেন।

ডঃ পোট্টেকাটকে তোমার এখানে চায়ের নেমতন্ন করলে কি উনি আসবেন?

আসতে পারেন। ওঁর মেয়ে রঞ্জাবতীর সঙ্গে মালবীর বন্ধুত্ব আছে।

তুমি বরং আমার কথা বলে–অর্থাৎ তোমার গেস্টের প্রসঙ্গ তুলে ওঁকে নেমন্তন্ন কর। আজ সন্ধ্যার দিকে। তবে সাবধান, বেস কিছু বলবে না।

নাহ্। আপনি নিজেও তো প্রকৃতিবিজ্ঞানী।…

শান্তনু অফিস গেল জিপে। ব্রেকফাস্টের পর আমার ঘরের দরজা এঁটে কিটব্যাগ থেকে ফাইলটা বের করলাম। প্রচুর বালি ঝরল। লাল ফিতের গিট পরীক্ষা করে শান্তনুর কথার সত্যতা বোঝা গেল। ডঃ রেড্ডি লেফ্টহ্যাঁন্ডার ছিলেন। বাঁ হাতেই কাজ করতেন। ফাঁইলের ওপর কিছু লেখা আছে তামিল ভাষায়। ফাইল খুলতেই প্রথমে বেরুল একটা নকশা। খুঁটিয়ে দেখার পর বুঝলাম, এটা কুম্ভকোণমেরই ম্যাপ ছাড়া কিছু নয়। অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ লেখা আছে। একটা চৌকো জায়গায় লাল ডটপেনে টিক মারা আছে।

পরের কাগজটাও ম্যাপ। কিন্তু উপকূলবর্তী সমুদ্রের ম্যাপ। একটা বাঁকা তীরচিহ্ন দিয়ে কুম্ভকোণমকে নির্দেশ করা হয়েছে। তারপর চমকে উঠলাম। যেন হাতের কাছেই সাপ। কয়েকটা ইংরেজিতে লেখা চিঠির জেরক্স কপি। তলার সইটা অস্পষ্ট। চিঠিতে এক একটা জাহাজের নাম, তারিখ, কোন্ অবস্থানে কখন পৌঁছুবে এই সব তথ্য।

হুঁ। তাহলে এই ব্যাপার! একটা গুপ্তচক্ৰ কুম্ভকোণমের সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরকে কাজে লাগাচ্ছে। কিংবা সঠিকভাবে বলতে গেলে কোন সমুদ্রবিজ্ঞানীকে।

কিন্তু জাহাজের চালকরা মুখ বুজে থাকে কেন? পয়সা খেয়ে, নাকি অন্য কারণে? কিন্তু এই দফতর তো কেন্দ্রীয় সরকারের এবং জাহাজ নাবিক সবই নৌবাহিনীর তদারকে থাকার কথা। নৌবাহিনীও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা দফতরের অধীনে। ব্যাপারটা জানা দরকার।

দুপুরে শান্তনু খেতে এসে বলল, ডঃ পোট্টেকাট আসবেন পাঁচটা নাগাদ। রঞ্জাবতীও আসবে। ওর মা আডিয়ারে গেছেন। থিওসফিক্যাল সোসাইটির মেম্বার।

একটু পরে কথায় কথায় বললাম, সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের জাহাজঘাট কোথায়?

শান্তনু তাকাল। তারপর বলল, পাঁচ কি. মি. দক্ষিণে কোড্ডালমে। ওখানে একটা নেভি বেস আছে।

সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের নিজস্ব জাহাজ আছে নিশ্চয়?

আগে ছিল না। নৌবাহিনীর ছোট জাহাজ ভাড়া নিত। এখন একটা ছোট। জাহাজ এবং একটা মোটরমোট কেনা হয়েছে নেদারল্যান্ডস থেকে।

কুম্ভকোণমের সমুদ্রে দেখলাম ডুবো পাথর প্রচুর। সমুদ্রও এখানে বড্ড রাফ।

জেলেবসতির দিকে সমুদ্র মোটামুটি নিরাপদ। ব্রেকার অংশটা পেরিয়ে ওরা যেখানে মাছ ধরতে যায়, সেখানে সমুদ্র শান্ত বলা চলে।

ফাইলটার কথা তখনও চেপে গেলাম। বললাম, ওঁদের দফতরের হেড কে? ডাইরেক্টরের নাম মহাবীর প্রসাদ। নর্থ ইন্ডিয়ান। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর একজন মিল। ডঃ নাগরাজন। রিসার্চ সেকশনেও তামিল বেশি। ডঃ পোট্টেকাট কেরালার লোক। এই সেকশনের হেড। ডঃ রেড্ডি তামিল ছিলেন। তিনি ছিলেন ডেটা সেকশনের চার্জে। রিসার্চ সেকশন থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, ডঃ রেড্ডি তা বিশ্লেষণ করে কম্পিউটারাইজড় কোড তৈরি করতেন।

আর কথা বাড়ালাম না। শান্তনু খেয়ে অফিস চলে গেল। বারান্দায় বসে চুরুট টানছি, মালবী এসে মিটিমিটি হেসে বলল, ফাদার ক্রিসমাসকে আজ ভীষণ গম্ভীর দেখাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে ক্লু পেয়ে গেছে।

হঠাৎ বললাম, একটা টেলিফোন করতে চাই। কিন্তু এখানে কি এস টি ডি। লাইন আছে?

হ্যাঁ, গত মাসে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ এবং এস টি ডি চালু হয়েছে। শান্তনু তো আপনাকে এস টি ডি করেছিল।

উঠে দাঁড়ালাম। একটা দুর্ভাবনা গেল। আমি ভেবেছিলাম ট্রাঙ্ককল-মানে, যেভাবে ও কথা বলছিল।

মালবী হাসল। কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কী যেন বলল! আপনার আগ্রহ—

আপনার আগ্রহ জাগানোর মতো কিছু জিনিস এখানে আছে।

মালবী আস্তে বলল, আসলে শানুর ভয়ের কারণ আছে। তামিলনাড়ু বড্ড গোলমেলে হয়ে উঠছে ক্রমশ। ও ট্রান্সফার হওয়ার চেষ্টা করছে।

চল। টেলিফোন করব। কিন্তু গোপনে।

করুন না। এক মিনিট! আমি মারিয়াম্মাকে আগে বাইরের কাজে সরিয়ে রাখি। আজকাল যা হচ্ছে, কাকেও বিশ্বাস করা কঠিন।……

.

রঞ্জাবতাঁকে দেখে বাঙালি বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাছাড়া সে ভাল বাংলা জানে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। ছুটিতে বাবার কাছে কাটাচ্ছে। ডঃ পোট্টেকাট বাংলা জানেন না। ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাল জানেন। সমুদ্রবিজ্ঞানে খেই ধরিয়ে দিলাম। উনি প্রায় আধঘণ্টা বকবক করার পর মুখ খোলার সুযোগ পেলাম। বললাম, আপনাদের একজন বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছেন শুনলাম।

ডঃ পোট্টেকাট বললেন, দাম্পত্য অশান্তি। রেড্ডির বউ গ্রামের মেয়ে। মানিয়ে চলার সমস্যা ছিল। এদিকে রেড্ডিও ছিল বদরাগী হটকারী স্বভাবের লোক।

সতর্কভাবে বললাম, উনি নিশ্চয় আপনার মতো মিশুকে স্বভাবের মানুষ ছিলেন না?

নাহ্। যেচে কথা না বললে কথাই বলত না।

ওঁর কোন শারীরিক ত্রুটি–মানে অসুখবিসুখ কিংবা–

কিচ্ছু না। রোগা হলেও চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল। জগিং করত নিয়মিত। তবে মানসিক গণ্ডগোল ছিলই। শিজোফ্রেনিক টাইপ। ডঃ পোট্টেকাট হাসলেন। একটা ফাঁইলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন অবশ্য খুব, সিগারেট খেত। যদিও বিশেষ করে ওর সেকশনে ধূমপান নিষিদ্ধ। তো দুর্ঘটনাও হতে পারে। একবার কম্পিউটারে ভুল ডেটা ফিড করিয়ে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ নষ্ট করে ফেলেছিল।

অমনোযোগিতা! এই ম্য করে ডঃ পোট্টেকাটের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকালাম।

উনি বললেন, রেড্ডি ছিল একজন অদ্ভুত চরিত্রের লোক। যেমন ধরুন, ওর কাছে একটা রিভলবার। ওটা কেন ও সঙ্গে রাখত? বুঝতে পারি না।

আপনি জানতেন ওঁর রিভলবার আছে?

ডঃ পোট্টেকাট সোজা হয়ে বসলেন। সে একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হতে পারত। একদিন বিচে নেমে যাচ্ছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখানে সমুদ্র সন্ধ্যার আগে থেকে ভীষণ রাফ হতে শুরু করে। তো হঠাৎ পেছন থেকে ডেকেছি, ভীষণ চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ওর হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকে বেরিয়ে আসছিল। আমার চোখের ভুল নয়। রিভলবারের বাঁট!

পরে জিজ্ঞেস করেননি?

করেছিলাম। ডঃ পোট্টেকাট অন্যমনস্কভাবে বললেন, তামিলদের ইদানীংকার হাবভাব আমি বুঝতে পারি না। রেড্ডি বলেছিল, ওর কোন ফায়ারআর্মস নেই। কাজেই আমার নাকি চোখের ভুল।

শান্তনু এই সুযোগটা নিল। ডঃ পোট্টেকাট যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

স্বচ্ছন্দে।

এক বিকেলে বিচের মাথায় আপনারা দুজনে কথা বলছিলেন। একটু তফাত থেকে আমার কানে এসেছিল, আপনি ওঁকে কিসে নাক না গলাতে নিষেধ করছিলেন–

ডঃ পোট্টেকাটের চশমা ঝুলে পড়েছিল। চশমার ওপর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে বললেন, তুমি যা শুনেছিলে, কাকেও কি বলেছ?

নাহ্।

আমি এখান থেকে বদলির চেষ্টায় আছি। তুমিও চেষ্টা কর। কুম্ভকোণম বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ওই লোকটা–শিল্পপতি এবং প্রাক্তন মন্ত্রী জগদীশ নায়েক সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরকে কাজে লাগাচ্ছে।

এবার বললাম, শ্রীলঙ্কার জঙ্গি তামিলদের অস্ত্র মজুতের ঘাঁটি হয়ে উঠছে। কুম্ভকোণম।

তাহলে আপনি জানেন? ডঃ পোট্টেকাট সোজা হয়ে বসলেন। সন্দিগ্ধভাবে বললেন, আপনি কি সি বি আই-এর লোক?

শান্তনু বিব্রতভাবে বলল, না না! ওঁর যে পরিচয় আপনাকে দিয়েছি, উনি  তা-ই। প্রকৃতিবিজ্ঞানী এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল।

বললাম, ডঃ পেট্টেকাট! আমার একটা বাতিক আছে। রহস্যময় কিছু ঘটলে নাক গলাই।

ঈশ্বরের দোহাই কর্নেল সরকার। এতে নাক গলাবেন না। ডঃ পোট্টেকাট প্রায় আর্তস্বরে বললেন। তাহলে শান্তনু এবং আমি ভীষণ বিপদে পড়ব।

জানি। তবে আমার কাজ শুধু সত্যে পৌঁছানো!

কী সত্য?

কে খুন করল ডঃ রেড্ডিকে।

কী? ডঃ পোট্টেকাট চমকে উঠলেন। রেড্ডি তো আত্মহত্যা করেছে।

ডঃ পোট্টেকাট! আপনি কি জানেন না ডঃ রেড্ডি লেহ্যাঁন্ডার ছিলেন। তিনি কেমন করে নিজের মাথার ডানদিকে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে ট্রিগারে চাপ দেবেন?

উনি মাতৃভাষায় বিস্ময়সূচক কিছু বললেন। তারপর বললেন, কী আশ্চর্য! এটা তো আমার মাথায় আসেনি! আপনি ঠিক বলেছেন।

এতক্ষণে মালবী এবং রঞ্জাবতী লন থেকে বারান্দায় এল। মালবী বলল, খুব গুরুতর আলোচনা হচ্ছে। বাধা দিলাম না তো?

ডঃ পোট্টেকাট মেয়ের দিকে তাকিয়ে মালয়ালমে কিছু বললেন। রঞ্জাবতীর মুখে চমক খেলে গেল এবং সেও মালয়ালমে কিছু বলল।

তারপর রঞ্জাবতী আমার দিকে তাকাল। বাংলায় বলল, মালবীদির কাছে। আপনার সত্যিকার পরিচয় পেলাম।

হাসলাম। মেয়েদের পেটে নাকি কথা থাকে না বলে একটা প্রবচন আছে।

মালবী দ্রুত বলল, না। আসলে রঞ্জু একটা অদ্ভুত কথা বলল। তাই—

কী অদ্ভুত কথা?

রঞ্জাবতী এবং সে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল। তারপর রঞ্জাবতী বলল, আমাদের কোয়ার্টার থেকে বিচের একটা অংশ পরিষ্কার দেখা যায়। আমি খুব ভোরে উঠে যোগব্যায়াম করি। রেড্ডিকাকা যেদিন মারা যান, সেই ভোরে বিচে ওঁর পেছনে একজনকে জগিং করতে দেখেছিলাম। একটু পরে এঁরা আড়াল হয়ে যান।

তুমি লোকটাকে চিনতে পেরেছিলে?

নাহ। তখনও আবছা আঁধার ছিল। তবে রেড্ডি কাকাকে চিনতে পেরেছিলাম। কারণ এঁর হাঁটাচলা এবং বিশেষ করে জগিংয়ের একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল।

যেমন?

ডানহাতটা বুকের পাঁজরের সমান্তরালে থাকত। নড়ত না।

ডঃ পোট্টেকাট মেয়েকে মাতৃভাষায় আবার কিছু বললেন এবং সে শান্তভাবে জবাব দিল। মালবী আজ বিকেলেই মারিয়াম্মাকে ছুটি দিয়েছিল। সে বলল, রঞ্জু! আমাকে একটু সাহায্য করবে এস। রঞ্জাবতী তার সঙ্গে ভেতরে গেল। এতক্ষণে আলো জ্বালল। ডঃ পোটেকাট ঘড়ি দেখলেন।

শান্তনু বলল, এখনও ছটাই বাজেনি। আপনার ডিনারের নেমন্তন্ন তো আটটায়।

আমি একটু উদ্বিগ্ন শান্তনু! জগদীশ নায়েকের ডিনারে যাওয়া আমার পছন্দ নয়। কিন্তু ওকে তো জানো। এড়িয়ে থাকার সমস্যা আছে।

শান্তনু বাঁকা হাসল। ও আমাকে কখনও নেমন্তন্ন করে না। আমি নিশ্চয় ওর সুনজরে নেই।

ডঃ পোট্টেকাটও একটু হাসলেন। এক সময় জগদীশ কেরালার লোক মাত্রেই কমিউনিস্ট ধরে নিত। এখন বাঙালি মাত্রেই এর কাছে কমিউনিস্ট। আমাকে বলেছে।

বললাম, আচ্ছা ডঃ পোট্টেকাট, রেডি সাহেবের পক্ষে কি জগদীশ নায়েককে ব্ল্যাকমেল করা সম্ভব ছিল?

উনি ঝুলে পড়া চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আস্তে বললেন, অসম্ভব ছিল না, এটুকু বলতে পারি। কেন্দ্রীয় সরকার এই রাজ্যে বেশি কিছু না করতে পারুন, এই নোটিফায়েড এলাকা থেকে জগদীশকে উচ্ছেদ করতে পারেন। কাছাকাছি কোল্ডালমে নৌবাহিনীর ঘাঁটি আছে। তার ওপাশে স্থলবাহিনীর একটা ঘাঁটি আছে। পূর্ব উপকূলে যতদুর যাবেন, কেন্দ্রীয় হিনীর অজস্র ঘাঁটি। শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে ভারত সরকারের মাথাব্যথা আছে।

কিন্তু আপনাদের জাহাজ কিংবা বোটের গতিবিধি অবাধ।

হ্যাঁ। জগদীশ সেই সুযোগটা নিচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি। কী বলব?

এই সময় মালবী এসে খবর দিল, কর্নেল! আপনার ফোন।…

.

কোল্ডালমের নেভি কমান্ডার জয়পাল সিংহের সঙ্গে কিছুক্ষণ প্রয়োজনীয় কথা বললাম। সামরিক সাংকেতিক ভাষায় কথা হল। সমুদ্রবিজ্ঞান দফতরের জাহাজ এবং বোটের গতিবিধি আর অবাধ থাকছে না এর ফলে। সঙ্গে নজরদার। নেভিবোট থাকবে।

এরপর ফোন গাইডের পাতা থেকে জগদীশ নায়েকের ফোন নাম্বার নিলাম। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কেউ সাড়া দিল। বললাম, মিঃ জগদীশ নায়েকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তিনি ব্যস্ত। আপনি কে বলছেন স্যার?

ওঁকে বলুন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কথা বলবেন। খুব জরুরি।

প্রায় দুমিনিট পরে সাড়া এল। নায়েক বলছি। আপনি আজ ভোরে—

হ্যাঁ। ফাইলটা আমি খুঁজে পেয়েছি। আসলটা তো ডঃ রেড্ডি আপনার টাকা খেয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু জেরক্স কপি লুকিয়ে রেখেছিলেন সতর্কতার জন্য। সেটা আপনাকে ফেরত দিতে চাই।

একটু পরে নায়েক বলল, কোথা থেকে বলছেন? নাম্বার দিন। পরে কথা বলব। এখন আমি ব্যস্ত।

আন্দাজে বলে দিলাম, পাবলিক বুথ থেকে।

খোঁজ নিয়েছি, আপনি ট্যুরিস্ট লজে ওঠেননি। কোথায় উঠেছে?

আপনি ফাইলটা চান কি না বলুন! নাকি ওটা কোল্ডালমে নেভি বেসে পাঠব?

আবার একটু দ্বিধা যেন। তারপর নায়েক বলল, কত দিতে হবে?

এক লাখ।

ঠিক আছে। ভোর পাঁচটায় জেলে বস্তির পশ্চিমের বালিয়াড়িতে যাবেন। দেখা হবে।

আপনার নিজে আসা চাই।

বোকার মতো কথা বললেন না। আমি নিজেই সমস্যার সমাধান করি।

তাহলে সেই কথা রইল। রাখছি।

টেলিফোন রেখে দিলাম। আজ ইচ্ছে করেই বেরোইনি। শান্তনুর কোয়ার্টারের বাইরে থেকে ওই বারান্দাটা দেখা যায় না। বাউন্ডারি ওয়ালের তারকাটা ঘন ঝুমকোলতায় ঢাকা এবং দেবদারু গাছগুলোও পরস্পর গাড় আলিঙ্গনাবদ্ধ। লনের দুধারে উঁচু রঙ্গনা এবং ঝাউ। বারান্দাটা গেট থেকে সরাসরি নজরে আসে না।

ফিরে গিয়ে দেখি, তেলেভাজা এবং পপিরভাজা খাওয়া হচ্ছে। ডঃ পোট্টেকাটের পাশে বসে আস্তে বললাম, একটা অনুরোধ। আপনার এবং শান্তনুর নিরাপত্তার স্বার্থে বলছি। নায়েকের ডিনারে যেন ভুলেও আমার কথা বলবেন না। বরং ভুলে যান, আপনার সঙ্গে আমার দেখা বা আলাপ হয়েছে।

ডঃ পোট্টেকাট দ্রুত বললেন, আমি কি রেড্ডির মতো উন্মাদ?…

.

আমার কিটব্যাগে অনেক জিনিস থাকে। কখন কী কোন প্রয়োজনে লাগে, ঠেকে শিখেশিখে জোগাড় করেছি। শান্তনুকে বলা ছিল। রাত চারটায় বেরোলাম। ওকে কিছু জানাইনি। তাই তার মুখে উদ্বেগ লক্ষ্য করলাম। সে একবার বলল, আমি যেতে পারি, যদি বলেন। তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলাম।

কুম্ভকোণমের ম্যাপটা দেখে রেখেছিলাম। কিন্তু সতর্কতার জন্য সংকীর্ণ রাস্তার ধারে যত্নে সাজানো গাছপালার ছায়ায় হাঁটছিলাম। সরকারি কোয়ার্টার এলাকার পর পাথর, বালি এবং কাশবনে ঢাকা অসমতল জমিটা পেরিয়ে কাটাতারের বেড়া। দূরে-দূরে আলো। গুঁড়ি মেরে এগিয়ে নিচের বিদ্যুৎবাহী তারটা খুঁজে বের করলাম। তারপর রবারের দস্তানা পরে প্রথমে বাঁদিকের লোহার খুঁটির গায়ে আটকানো বিদ্যুতের তারটা কেটে সাবধানে একটুকরো পাথরে রাখলাম। ঈষৎ ঝিলিক দিয়েছিল। প্রায় দশ ফুট দূরে ডাইনের খুঁটিতে আটকানো সেই তারের অন্য অংশটা কেটে ফেললাম। এখানেও ঈষৎ ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ। কিন্তু বিদ্যুত্বহী তারের দুটো দিক নন-কন্ডাক্টিভ রবারের মুখে থেকে গেল। কাঁটাতারটা কাশবনে ছুঁড়ে ফেললাম। দ্বিতীয় বিদ্যুত্বহী তারটা প্রায় তিন ফুট উঁচুতে। ওটা কাটার দরকার ছিল না। এবার নিচের দিক থেকে দুসারি কাটাতার একবার কেটে দেওয়াই যথেষ্ট। এবারে সরীসৃপের মতো ঢোকা সহজ হবে।

প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। কাঁটাতার দুটো টেনে মুচড়ে সরালাম। পেরিয়ে যেতে একটুও অসুবিধে হল না। সামরিক জীবনে এ কাজ অজস্রবার করতে হয়েছে।

বালিয়াড়িতে গুঁড়ি মেরে এগোতে হচ্ছিল। কারণ কৃষ্ণপক্ষের একফালি পাণ্ডুর চাঁদ আমার গতিপথের ওপর ঝুলে আছে। খুঁজে একটা গর্ত মতো পাওয়া গেল। এই সব সামুদ্রিক বালিয়াড়িতে সাপ থাকে। খুদে টর্চের আলোয় দেখে নিলাম জায়গাটা। ওপরে ঢেউ খেলানো উঁচু বালির ঢিবি। কোথাও লম্বাটে, কোথাও ক্রুপের মতো। পৌনে পাঁচটা বাজে।

এখান থেকে জেলেবসতির টিলা এবং গির্জাঘরটা দেখা যাচ্ছিল। ক্রমে ভোরের আলো ছড়িয়ে আসছিল। এবার বাইনোকুলারে যতটা দেখতে পাওয়া সম্ভব, দেখতে থাকলাম।

অন্তত দুটো ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। জগদীশ নায়েক জঙ্গি কমান্ডো বাহিনী সঙ্গে আনবে না। কারণ আমার নামের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আছে। দ্বিতীয়টা পরে বলছি।

পাঁচটায় গির্জার ঘণ্টা বাজল। জার্মান মনোবিজ্ঞানী জুংয়ের একটা কথা মনে পড়ছিল। তাঁর এক আত্মীয় তাঁকে একদিন হঠাৎ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলেন, শয়তান নরকে আত্মাদের কীভাবে পীড়ন করে জানো? তাদের সে অপেক্ষা করিয়ে রাখে। হি কি দেম অ্যাওয়েটিং! আহ, এই অপেক্ষা করে থাকার মতো অত্যাচার সত্যি আর নেই। প্রতিটি সেকেন্ড একেকটি ঘণ্টার মতো দীর্ঘ।

সওয়া পাঁচটায় হঠাৎ চোখে পড়ল, টিলার ঢালে একটা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে আমার মতোই বাইনোকুলারে জগদীশ নায়েক বালিয়াড়ি দেখছে। পরনে শর্টস। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ। হুঁ, এক লাখ টাকা!

সে নিশ্চিত হওয়ার পর উঠে দাঁড়াল। আমিও উঠে সামনের বালির ক্রুপের ওপর গেলাম। দেখতে পেয়ে সে জগিংয়ের ভঙ্গিতে নেমে এল। তারপর প্রায় পাঁচ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে বলল, ফাইলটা দেখতে চাই।

তার দিকে সাবধানে লক্ষ্য রেখে জিপ টেনে ফাঁক করে জ্যাকেটের ভেতর। থেকে ফাইলটা বের করলাম। ফিতে খুলে ভেতরটা দেখিয়ে দিলাম। সে কয়েক পা এগিয়ে এল।

আগেই আভাস দিয়েছি, এবার সে কী করবে সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তাই মুহূর্তে রিভলবার বের করে বললাম, ডুয়েলে হেরে যাবে নায়েক! পকেট থেকে খালি হাত বের কর। হাতের সঙ্গে পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের রিভলবারের বাঁট দেখামাত্র হাত গুঁড়ো করে দেব। আর তোমার ওই খালি ব্যাগটা ফেলে দাও। এক লাখ টাকা বলা মাত্র তুমি রাজি হওয়ায় আমি জানতাম তুমি কী করবে। হাত ওঠাও! তোমার মতো জঘন্য খুনীকে এখানে কুকুরের মতো মেরে ফেলে রেখে যেতে আমার হাত কাঁপবে না। ওঠাও হাত!

সে দুহাত তুলল। তার চোখে অসহায় ক্রুরতা ঝিলিক দিচ্ছিল। তবে আমি খালি হাতেও ওকে ধরাশায়ী করতে পারি। কয়েক ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান করে ফেলে রাখতে পারি। কিন্তু ওই যে বলেছি, অপেক্ষা করতে হবে।

তাই বললাম, আমার এটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের। কাজেই তুমি ডঃ রেড্ডির ক্ষেত্রে যা করেছ, আমার ক্ষেত্রে তা করে লাভ হত না। তুমি ওঁর ডানপাশে জগিং করতে করতে হঠাৎ তোমার ফায়ারআর্মস থেকে গুলি করেছিলে। তারপর ওঁর শর্টসের পকেট থেকে ওঁর অস্ত্রটা বের করে এক রাউন্ড ফায়ার করে ডান হাতের কাছে ফেলে রেখেছিলে। ওঁর রিভলবার কত ক্যালিবারের তুমি জানতে পেরেছিলে। কিন্তু হঠাৎ হত্যার চমৎকার মওকা পেয়ে একটা মত ভুল করে ফেলেছিলে। এই ধরনের ভুল সব অপেশাদার খুনীই করে। আকস্মিকতার ধাক্কায় বুদ্ধি গুলিয়ে যায়। তুমি জানতে, ডঃ রেড্ডি লেফট্যান্ডার। কিন্তু সে মুহূর্তে কথাটা তোমার মনে পড়েনি। পরে সময় মতো পুলিশকে চুপ করিয়ে দিয়েছ। একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এবং শিল্পপতি বলে কথা! কিন্তু আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি অন্য ধাতুতে গড়া।

আহ! এতক্ষণে জিপের শব্দ কানে এল। সামরিকবাহিনীর এই বিশেষ জিপের চাকা চওড়া এবং ভীষণ রুক্ষ। বালিতেও ছুটতে পারে। কোলমের আর্মি কামান্ডার রাজেন্দ্র সিং দলবল নিয়ে ঘিরে ফেললেন। রাজেন্দ্র, সহাস্যে বললেন, আমার ভয় হচ্ছিল নায়েক তার জঙ্গি কমান্ডো নিয়ে না হাজির হয়। দূর থেকে দেখলাম, দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যাগে। রক্তপাত হল না।

রাজেন্দ্রকে ফাইলটা দিয়ে বললাম, এটা জেরক্স কপি। আসলটা ডঃ রেড্ডি পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। টাকার লোভও ছিল। আবার ভয়ও ছিল। এনি ওয়ে, এতে অনেক বে-আইনি অস্ত্র মজুতের ঘাঁটি চিহ্নিত করা আছে। আরও অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। আমি চলি।

ছোট্ট বাহিনীটি এই অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ কর্নেলকে সামরিক রীতিতে অভিবাদন জানাল। আমিও প্রত্যুত্তর দিলাম। তারপর বালিয়াড়ি পেরিয়ে পিচরাস্তার দিকে হাঁটতে থাকলাম। হ্যাঁ, জেলেবসতি দিয়ে ওই বালিয়াড়িতে এলে আমার অবস্থা রেড্ডি সায়েবের মতো হত।

সোনার ডমরু

 

০১.

ডমরুনাথ নেপাল সীমান্তে একটি প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু জনসমাগম বছরে সেই একবার-বৈশাখ মাসে বাবা ডমরুনাথের পুজো উপলক্ষে। বাকি এগারো মাস খাঁ খাঁ নিঃঝুম অবস্থা। আড়াইহাজার ফুট পাহাড়ের মাথায় বাবার মন্দির। ঘোরালো একফালি রাস্তা পাহাড় ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে ওপরে। মোটরগাড়ি নিয়েও অনায়াসে ওঠা যায়।

ছোট্ট একটা বাজার এবং বস্তী রয়েছে ডমরু পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান দিয়েই গেছে নেপালগামী একটা পিচের সড়ক।

অক্টোবরের এক বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় আমি আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ভাড়া করা জিপ থেকে নামলুম। যে বাংলোয় আমরা উঠব, সেটা খুব কাছেই একটা টিলার ওপর। জিপের ড্রাইভার বুষ্টু সিং এবং তার ছোকরা অ্যাসিস্টান্ট হরিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি মতো আমাদের অল্পস্বল্প মালপত্তর সেখানে পৌঁছে দিল। ওরা যত ভিজল, আমরা তত ভিজলুম না। কারণ আমাদের গায়ে বর্ষাতি চাপানো। কিন্তু বাংলোর বারান্দায় উঠেই আমার বন্ধুটি ভীষণ কাশতে শুরু করলেন।

চৌকিদার বদ্রীনাথ বয়সে প্রৌঢ়। পেটাই শরীর। বেঁটে, এবং মুখের গড়ন কিঞ্চিৎ বর্তুলাকার। তাকে অমায়িক ও আমুদে লোক বলে মনে হলো। সে আমার সঙ্গী ভদ্রলোকের কাশি দেখে কেন কে জানে হাসি চাপছিল। একটু পরে অনুমান করলুম সম্ভবত কাশির শব্দটাই তার হাসির কারণ।

হাসি আমারও পাচ্ছিল। কারণ, এযাবৎকাল এই খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং প্রকৃতিবিদ বৃদ্ধলোকটির এমন দুরবস্থা কখনও প্রত্যক্ষ করিনি। কাশতে কাশতে উনি যেভাবে ঝুঁকে পড়ছিলেন ভয় হচ্ছিল, দম আটকে বেঘোরে মারা না পড়েন। কিন্তু কাশি থামার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর দুচোখে সেই সুপরিচিত উজ্জ্বল হাসি ছলছল করে উঠছিল। এ হাসি প্রতিফলনের দরুণ দ্বিগুণ উজ্জ্বল-জলে আলোর ছটা পড়লে যা হয়। ওঁর চোখে কাশি জনিত জল ছিল।

অক্টোবরেই উচ্চতার দরুন এ তল্লাটে আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। তার ওপর এই বৃষ্টি। শূন্য ফায়ারপ্লেসের দিকে চেয়ে আমি একটা মতলব ভঁজছি টের পেয়ে উনি বললেন, দরকার হবে না ডার্লিং! বরং তুমি বদ্রীকে বলল, ঝটপট কফিটা নিয়ে আসুক। আর শোনো, আমার কিটব্যাগ খুলে ডানদিকে খোপ থেকে ক্ষুদে শিশিটা বের করো।

বদ্রীর উদ্দেশ্যে হাঁক মেরে জলদি কফি করতে বলার পর কিটব্যাগ খুলে। শিশিটা এনে দিলুম। টেবিলের পাশে পা ছড়িয়ে আরাম কেদারায় বসে উনি শিশি থেকে লালরঙের কয়েকটা গুলি বের করলেন। মুখে ফেলে চুষতে থাকলেন।

জিজ্ঞেস করলুম, হাই ওল্ড ম্যান! বস্তুটি কি তানসেন গুলি?

টাকওলা প্রকাণ্ড মাথাটি দোলালেন মাত্র। তারপর অভ্যাসমতো সাদা দাড়িগুলোতে আঙুল বোলাতে থাকলেন। আমি বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকলুম।

বৃষ্টিঝরা অন্ধকার রাতে ডমরুনাথকে রহস্যময় দেখাচ্ছিল। একটু নীচে ওই বস্তী ও বাজারে সামান্য কয়েকটা আলো আবছা ঝিকমিক করছে। শুনেছি, তিনমাইল দূরের হাইড্রো-ইলেকট্রিক সেন্টার থেকে এখানে বিদ্যুৎ আসে। আসার কারণ বাবা ডমরু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সেই সুবাদে এই বাংলোও বিদ্যুৎ লাভে বঞ্চিত হয়নি।

এই সময় হঠাৎ কানে এল পাশের বদ্ধ ঘর থেকে কাদের কথাবার্তা চলেছে। আড়িপাতা স্বভাব আমার নয়। কিন্তু ওই কথাবার্তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। তার চেয়ে বড় কথা, একটি কণ্ঠ মহিলার।

অনেক সময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও অন্যদের আলোচ্য কানে এসে ঢোকে এবং কিছু করার থাকে না–নেহাত শুনে যাওয়া ছাড়া। বদ্রীর কফি করতে মিনিট সাতেক লাগল। তার মধ্যে আমি অনেকগুলো কথা শুনে ফেললুম।

কিছুক্ষণ পরে কফি খাচ্ছি, গোয়েন্দাপ্রবর মাঝেমাঝে অদ্ভুত শব্দে কেশে উঠছেন–বদ্রী এসে জিজ্ঞেস করল, সায়েবরা সঙ্গে রাতের খাবারদাবার এনেছেন, নাকি তাকে খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?

আমরা কিছু আনিনি এবং তাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে, শুনে সে চলে যাচ্ছিল। আমি ডাকলুম, বদ্রী, শোনো।

বদ্রী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

বললুম– পাশের ঘরে কারা এসেছেন মনে হলো?

হ্যাঁ স্যার। ওনারাভি বাঙালী আছেন। কলকাতা থেকে আজ সকালে এসেছেন।

স্বামী স্ত্রী?

বদ্রী কেমন হাসল শুধু।

স্বামী-স্ত্রী নয়?

বদ্রী ফের হেসে বলল, নয়–তা তো বলিনি স্যার!

বেড়াতে এসেছেন বুঝি?

তাছাড়া আর কেন এখন ডমরুনাথে লোকে আসবে? আপনারাও তো এসেছেন। বলে বদ্রী রহস্যময় হেসে চলে গেল।

বৃদ্ধ গোয়েন্দা এবার আরেক দফা কেসে আস্তে বললেন, তোমায় রীতিমতো উত্তেজিত মনে হচ্ছে ডার্লিং। তবে একটা কথা বলি শোনো। নরনারীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো অভদ্রতা। সুতরাং আশা করি আজ রাতে যদি তেমন কিছু ঘটেও–তুমি যেন ব্যস্ত হয়ো না!

আমি একটু অবাক হয়ে বললুম– এর অর্থ?

অতি সরল। বলে উনি কফির সঙ্গে সেই লাল গুলিও ফের মুখে চালান করলেন।

সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– আপনি কি গণক, না অন্তর্যামী? কারা ও-ঘরে এসেছে, আমরা এখনও তাদের চাক্ষুষ পর্যন্ত করিনি। অথচ আপনি দৈববাণী করছেন যে, আজ রাতে কিছু ঘটতে পারে।

বৃদ্ধ চোখ বুজে গুলি চুষতে থাকলেন। হাঁটুর ওপর কফির পেয়ালা। পেয়ালার ভাপ নিচ্ছেন হাতে এবং সেই হাত মাঝে মাঝে গালে ও কম্ফোর্টার সরিয়ে গলায় বুলোচ্ছেন।

ডাকলুম, কর্নেল!

বলো জয়ন্ত! ঐ দৈববাণীর কারণ কী?

কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। বললেন, তোমার উত্তেজিত চেহারা দেখে যা মনে এল, বলেছি ডার্লিং!

ভ্যাট! আমার চেহারায় কিছু নেই।

গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, যখন তুমি বারান্দায় গেলে, তখন তোমার চেহারায় প্রশান্তি ছিল। যখন তুমি ঘরে ঢুকলে, তখন তোমার চেহারায় রীতিমতো উত্তেজনা ছিল। তারপর তুমি বদ্রীকে জেরা করতে শুরু করলে। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি ও-ঘরে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আড়ি পেতেছিলে! নিশ্চয় তেমন কিছু কানে এসেছিল তোমার–যাতে…

বাধা দিয়ে হাসতে হাসতে বললুম– হার মানছি। কিন্তু হে বৃদ্ধ ঘুঘুমশাই। ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি বড্ড গোলমেলে। আমি অকারণে উত্তেজিত হইনি!

কর্নেল চোখ বুজে বললনে, বলে যাও ডার্লিং! আমি সবকিছুতেই আগ্রহী।

চাপা গলায় বললুম– ওঁরা ভীষণ ঝগড়াঝাটি করছিলেন। কারণটা বোঝা গেল না। ভদ্রলোক বলছিলেন, তুমি নিজেই এ জন্যে দায়ী, এ সব কথা আগে জানলে কিছুতেই আমি আসতুম না এখানে। ভদ্রমহিলা বলছিলেন, ন্যাকামি কোরো না! তুমি জেনেশুনেই এসেছ। তুমি কী তা এতদিনে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি। তারপর শুনি, ভদ্রলোক ক্ষেপে গেছেন যেন। বললেন এখনই আমি চলে যাচ্ছি। থাকো তুমি একা! বিশ্বাসঘাতিনী মেয়ে কোথাকার! তারপর ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

হুঁ। ইন্টারেস্টিং। তারপর?

তারপর আর কোনও সাড়াশব্দ ছিল না। চলে এলুম।

কর্নেল কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন, বদ্রীও কী যেন আঁচ করেছে মনে হলো। কেমন হাসছিল।

এই সময় কড় কড় কড়াৎ করে মেঘ ডাকল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শোনা গেল। জানলাগুলো বন্ধই ছিল। দরজার পর্দা দুলে উঠল। তখন দরজা বন্ধ করে দিলুম।

কর্নেল বললেন, সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ করে ঝরছিল। তখনই বুঝেছিলুম, রাতের দিকে অবস্থা যোরালো হবে। জয়ন্ত তরাই অঞ্চলের পাহাড়ে ঝড়বৃষ্টির রাত বড় রোমাঞ্চকর। ওই শোনন, বাবা ডমরুনাথ ডমরু বাজিয়ে এবার বেজায় রকমের একটা নাচ জুড়বেন। খাসা!

বাইরে বাতাসটা বাড়তে থাকল। তার সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জন শুরু হলে বাংলো কাঁপতে থাকল। বললুম– সর্বনাশ! সেবার এ তল্লাটে এসে সাতদিন আটকে গিয়েছিলুম মনে পড়ছে কর্নেল? ধস ছেড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবারও তাই হবে নাকি?

হলেও অবাক হব না। কর্নেল নিরাসক্তভাবে বললেন।

তবে স্বস্তির কারণ, ওঁর কাশিটা কমেছে। আমি পা ছড়িয়ে আরাম পাওয়ার চেষ্টায় সিগারেট ধরালুম। কিন্তু মনের ভেতর পাশের ঘরের সেই তর্কাতর্কি সারাক্ষণ প্রতিধ্বনি করে চলেছে। একটা যুক্তিসঙ্গত ঘটনা দাঁড় করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দাঁড়াচ্ছে না। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে কিসের জন্য দায়ী করেছে? কী জানতে পারলে এখানে আসতেন না? আর ভদ্রমহিলাই বা কেন বলছেন,  জেনেশুনেই এসেছ তুমি! ব্যাপারটা কী হতে পারে?

এতকাল ধরে গোয়েন্দার সঙ্গগুণে সবতাতে কৌতূহলী হওয়ার স্বভাব আমাকে পেয়ে বসেছে। ঝোঁকের মাথায় উঠে দাঁড়ালুম। কর্নেল চোখ বুজে শরীর এলিয়ে বসে আছেন। বর্ষাতিটা গায়ে চড়িয়ে দরজার দিকে এগোলে বললেন, বেরিয়ো না জয়ন্ত। ঝড়ে উড়ে যাবে। তাছাড়া কৌতূহল জিনিসটা অনেক সময় অকারণ বিপদে ফেলে। চুপ করে বসো।

কথা কানে নিলুম না। দরজা খুলতেই ভেজা পর্দা গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। কর্নেল বিরক্ত হয়ে ফের বললেন, তুমি দেখছি কেলেংকারি না বাধিয়ে ছাড়বে না জয়ন্ত! লক্ষ্য করেছ কি, আমার স্বরভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ? যে ঠাণ্ডা বাতাসটা এইমাত্র ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে, আজ রাতে সে আমার গলার বারোটা বাজাবে। দরজা বন্ধ করো শীগগির!

দরজা বন্ধ করার মুখে আবছা একটা চিৎকার কানে এল যেন। ভুল হতেও পারে। কিন্তু গা শিউরে উঠেছিল। দরজা বন্ধ করে বললুম– কে চেঁচাল, শুনতে পেলেন?

কর্নেল ওভারকোটের কলার আরও তুলে মাথার দুপাশটা ঢেকে বললেন, না।

আমার ধারণা পাশের ঘরে একটা কিছু..।

কথা কেড়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা বললেন, শুনেছি ডমরু পাহাড়ে ঝড়ের রাতে অনেক বিদঘুটে চিৎকার শোনা যায়। ভূতপ্রেত থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাবা। ডমরুনাথ স্বয়ং মহাদেব কি না!

ক্ষুব্ধমুখে চুপচাপ বসে রইলুম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি তুমুল চলতে থাকল। বজ্রপাত এবং মেঘের গর্জনে পৃথিবী কাঁপতে থাকল।

কতক্ষণ পরে বদ্রীর সাড়া এল দরজার বাইরে। দরজা খুললে সে ট্রে ভর্তি চাপাটি আর আলুর দম নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঝড়টা কমেছে। কিন্তু ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সমানে ঝরছে। বদ্রী বলল, তাহলে আপনারা খেয়ে নিন স্যার। দরকার হলে ঘণ্টার বোতাম টিপবেন।

বললুম– পাশের ঘরের ওঁদের খাওয়া-দাওয়ার কী হচ্ছে বদ্রী?

বদ্রী চোখ নাচিয়ে বলল, ক্যা মালুম! ওনারা রাতে কিছু খাবেন না বলেছেন।

দরজা বন্ধ আছে দেখলে?

জী হাঁ।

বদ্রী চলে যাচ্ছিল, ডাকলুম–শোনো।

বলুন স্যার!

কিছুক্ষণ আগে কে চেঁচিয়ে উঠল মনে হলো। শুনছ?

বদ্রী হাসল।…..ও কিছু না স্যার। ঝড়ের রাতে এমন আজব শব্দ হয়। শুনতে নেই।

সে চলে গেলে কর্নেল উঠলেন। বললেন, জয়ন্ত! তুমি কি ভাবছ, ডমরুনাথে এসে তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কিছু লোভনীয় রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে?

হাসতে হাসতে বললুম– আপনার গলা বেশ ভেঙে গেছে কর্নেল!

আরও ভাঙবে। সকালে হয়তো আর কথাও বলতে পারব না। কর্নেল টেবিলে ট্রের দিকে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে বললেন। হুম! তাই আগে থেকে বলে রাখি, অকারণ পাশের ঘরে নাক গলিও না। বিপদে পড়বে। এবং সে বিপদে বৃদ্ধের সাহায্য পাবার আশা বৃথা। কারণ তার প্রচণ্ড কাশিজনিত স্বরভঙ্গ আসন্ন। গলার স্বর না। থাকলে গোয়েন্দাগিরিতে কোনও সুফল ফলে না।

কোনও কথা বললুম– না। কিন্তু বিপদে পড়ার কথা কেন বলছে কর্নেল, একথা ভেবেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। তাছাড়া স্বরভঙ্গের সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির বৈরীভাবের কারণ কী, তাও বুঝলুম না।

.

০২.

রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটল না, কর্নেলের কাশিও বিশেষ শুনলুম না। তবে একবার মনে হয়েছিল, বাইরে বারান্দায় কার বা কাদের চলাফেরার শব্দ শুনছি। ভাল করে শোনার আগেই সেটা থেমে গেল।

আমার ঘুম ভাঙে দেরিতে। অভ্যাস মতো লক্ষ্য করলুম, প্রকৃতিবিদ নিত্য নৈমিত্তিক প্রাতঃভ্রমণে গেছেন। দরজা ভেজানো রয়েছে।

থাক গে, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ভেবেছিলুম, কাশিটা রাতারাতি বেড়ে যাবে। বাড়েনি এবং জ্বরজ্বালা এসে কাহিল করেনি বুড়োকে। করলে এ বিদেশ বিভুয়ে কেলেংকারি হতো। ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেত।

প্রকৃতি আজ হাসিখুশি ও পরিচ্ছন্ন। আকাশ পরিষ্কার নীল। রোদে ভেসে যাচ্ছে পাহাড় ও সবুজ বনস্থলী। হিমালয় জঙ্গলের তাবৎ পক্ষিকুল যেন এক সঙ্গে গলা ছেড়ে গান ধরেছে।

একটু পরে বদ্রী দিনের প্রথম সেলামসহ চা দিতে এলে বললুম– খবর বলল বদ্রী!

বদ্রী হাসল। সে টের পেয়েছে, আমি কী জানতে চাইছি। বলল, খবর ভাল স্যার! পাশের ঘরের বাবুসাবকে দেখতে পাচ্ছি না। মেমসাব একা আছেন। উনিও ভি চলে যাবেন বললেন। বেলা সওয়া ন’টায় বাস আসবে। বাসে তুলে দিতে হবে ওনাকে।

বদ্রী চলে গেলে একটু নিরাশই হলুম। নাটকটা জমল না।

চা খেয়ে সিগারেট টানতে টানতে বেরোলুম। বারান্দা থেকে লনে নামতেই পেছনে আস্তে কেউ ডাকল-শুনুন!

ঘুরেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলুম–প্রণতি! তুমি এখানে!

প্রণতিও ভীষণ অবাক হয়ে গেল। দরজা থেকে পর্দা তুলে আমাকে ডেকেছিল– এখন ছিটকে বারান্দায় বেরিয়ে এল। বলল, জয়ন্ত! তুমি এখানে?

প্রণতির গলার স্বর কাল রাতে কেন চিনতে পারিনি, তার কারণ নিয়ে মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ বাহুল্য। আসলে এমন একটা দুর্গম জায়গায় তার অস্তিত্ব স্বপ্নেও ভাবা যায় না।

কো-এডুকেশনের কলেজে প্রণতি আমার সহপাঠিনী ছিল। তার সঙ্গে প্রেম করার কথা ভুলেও ভাবিনি কোনওদিন। তবে তার প্রতি মোহ ছিল না এমন নয়। সে-মোহ ওর সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বের প্রতি। তাছাড়া আমাকে সে পাত্তা দেবেই বা কেন? এম. এ. পড়তে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলুম, প্রণতি পিছিয়ে পড়েছে। আমার মতো সেও ইংরেজি নিয়ে পড়ত। তার পিছিয়ে পড়ার কারণ শুনেছিলুম বিয়ে। যতদুর জানতুম, সে ছিল একটা সওদাগরী আপিসের সাধারণ কেরানীর মেয়ে। এক্ষেত্রে মেয়ের সৌন্দর্য থাকলে নিম্নবিত্ত অভিভাবকরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন না।

প্রণতির বিয়ের নেমন্তন্ন আমি পাইনি। তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা বছর দেখা হয়নি। গত বছর রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। কিন্তু তার সেই উজ্জ্বল লাবণ্য আর তত ছিল না। গায়ে মেদও জমেনি। বরং আরও রোগা হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে সে অসুখ বিসুখের কথাই বলেছিল। স্বামী সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলেনি। তখনই আমার মনে হয়েছিল, দাম্পত্য জীবনে প্রণতি সুখী নয় হয়তো।

ডমরুনাথে এসে তার সঙ্গে এ-ভাবে দেখা হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রণতির চেহারা গতবছর যেমন দেখেছিলুম, প্রায় তেমনি রয়েছে। প্রথম বিস্ময় কেটে যাবার পর আমরা বারান্দার চেয়ারে বসলুম। তারপর প্রণতি ডমরুনাথে আসার কারণ যা বলল, তা এই: তার স্বামী নীতিশ ইঞ্জিনিয়ার। এখান থেকে তিন মাইল দূরে সারাঙ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সে সম্প্রতি বদলি হয়ে এসেছে। সারাঙে যেতে হলে ডমরুনাথে নামতে হয়। এখান থেকে দুর্গম পাহাড়ি পথ। তাই বিকেলে পৌঁছে এই বাংলোয় আশ্রয় নিয়েছে। খবর না দিয়ে আসার জন্য এই গণ্ডগোল। ভোরে খবর পাঠিয়েছে। নীতিশ জিপ নিয়ে এসে যাবে–সেই প্রতীক্ষা এখন।

হ্যাঁ, এক আত্মীয়ের সঙ্গেই এসেছে প্রণতি। তিনি ভোরে সারাঙ চলে গেছেন খবর দিতে।…

প্রণতির এই বিবরণ শোনার পর বলা বাহুল্য মনে মনে আমি হাসলুম। প্রণতি কতটা সত্য বলছে, তা জানি না। কিন্তু কতটা মিথ্যা বলছে, তা ধরতে পারছি, প্রথমত, ‘আত্মীয়’ ভদ্রলোকের সঙ্গে রাতে সেইসব রহস্যময় ঝগড়াঝাটি ও কান্নাকাটি–দ্বিতীয়ত, বদ্রীকে বলেছে, সওয়া ন’টার বাসে তুলে দিতে।

আমি ধূর্ত প্রশ্ন ছাড়লুম-খবর না দিয়ে এভাবে আসা কি ঠিক হয়েছে? ধরো, যদি নীতিশবাবু দৈবাৎ কোথাও গিয়ে থাকেন, তোমার আত্মীয় ভদ্রলোক কী করবেন? খামোক হয়রান হয়ে ফিরে আসবেন।

প্রণতি জবাব দিতে দেরি করল না। ভুরু কুঁচকে বলল, আমি ফিরে যাব।

সে কী?

প্রণতি জবাব দিল না। একটু চুপ করে থাকার পর বললুম– তোমার এখানে অপেক্ষা করার অসুবিধে নেই অবশ্য। নীতিশবাবু যদি সারাঙে নাই থাকেন এবেলা, তুমি অপেক্ষা করবে। আর যদি বলল, আমি এখানেই জিপের ব্যবস্থা করে তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসব’খন।

প্রণতি গুম হয়ে শুধু মাথাটা দোলাল।

বললুম– ব্যাপারটা কী বলো তো প্রণতি?

কী ব্যাপার?

হাসলুম। …অনেক খটকা লাগছে। মানে হঠাৎ তোমার এভাবে আসা…

প্রণতি কথা কেড়ে বলল, কী করব? একটা চরমহেস্তনেস্ত করা তো দরকার। কলকাতা থেকে সেজন্যে ছুটে এসেছি।

আপত্তি না থাকলে ব্যাকগ্রাউণ্ডটা জানাতে পারো। আস্তে এবং সহানুভূতি মিশিয়ে কথাটা বললুম–।

প্রণতি একটু চুপ থাকার পর বলল, তুমি তো আগে ভীষণ ইনটেলিজেন্ট ছিলে। টের পাচ্ছ না?

অতি সামান্য।

সেই যথেষ্ট। বলে প্রণতি উঠে দাঁড়াল।

তাকে হঠাৎ ব্যস্ত মনে হলো। ঘড়ি দেখল সে। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে ওপাশে নিচে রাস্তার দিকে তাকাল। হাসতে হাসতে বললুম– কিছু যদি মনে না করো, আমার কথা শোনো। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি তোমার দূত হয়ে বরং বেরিয়ে পড়ি। আমার হাতে অঢেল সময়। তাছাড়া করার মতো একটা কাজও জুটে গেল বরাতে।

প্রণতি গম্ভীরমুখে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, শমীক তো গেছে।

শমীক কে?

আমার পিসতুতো দাদা–যার সঙ্গে এসেছি।

উনি সারাঙের রাস্তা চেনেন তো? বড্ড গোলমেলে এ এলাকার রাস্তাঘাট।

চেনে।

প্রণতির হাবভাব আমার বরদাস্ত হচ্ছিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বললুম– ঠিক আছে। আমি একটু ঘুরতে বেরুব। যদি অসুবিধে হয় জানিও।

প্রণতি কোনও কথা বলল না। আমি হনহন করে গেট পেরিয়ে টিলা থেকে নামতে থাকলুম। নিচের রাস্তায় গিয়ে এদিক ওদিক তাকালুম। এমন উজ্জ্বল সকালে প্রণতির ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। মোড়ে এগিয়ে বাঁদিকে একটা সঙ্কীর্ণ পিচের পথ দেখতে পেলুম। সেখানে একটা ফলকে লেখা আছে সারাঙ চার কি. মি.। একটা তীরচিহ্নও আছে। সেই পথ ধরে আনমনে হাঁটতে থাকলুম। পথটা আঁকাবাঁকা। একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, অন্যপাশে অতল খাদ। তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে। কিছুদূর চলার পর আবছা জলের শব্দ কানে এল। খুঁজতে খুঁজেত আবিষ্কার করলুম, বাঁকের ওধারে একটা ঝর্ণা রয়েছে।

ঢালু ধাপবন্দী পাথর বেয়ে নেমে ঝর্ণার নিচে গেলুম। হাত পঁচিশেক চওড়া একটা নদীর ধারা সৃষ্টি করেছে ঝর্ণাটা। তার ওধারে বালি ও পাথরে ভর্তি অনেকটা চওড়া জায়গায় ছোট ছোট ঝোপ গজিয়েছে। ঝোপে অজস্র নীল ফুল ফুটেছে। পাথরে পা রেখে ডিঙিয়ে সেই ঝোপগুলোর কাছে গেলুম। জলের শব্দে কান ঝালাপালা হচ্ছিল।

একটা উঁচু পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে হাত বাড়িয়ে একটা নীল ফুল ছিঁড়তে গিয়েই চমকে উঠলুম।

ওপাশে বালির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে কেউ। পরনে প্যান্ট, শার্ট, পায়ে জুতো রক্তে মাখামাখি অবস্থা। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে এবং রঙটা কালচে হয়ে। গেছে।

তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে যে আতঙ্ক ও বিস্ময় চেপে ধরেছিল, তার মধ্যেই দুটো জিনিস মাথায় এল। এটা একটা হত্যাকাণ্ড এবং হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছে বৃষ্টি ছেড়ে যাবার অনেক পরে। সম্ভবত ভোরের দিকে।

অনেক বছর ধরে প্রখ্যাত এক গোয়েন্দার সহবাসে এসব জিনিস দেখার সাধারণ আতঙ্ক আমি অনেকটা এড়াতে শিখে গেছি। সেই সঙ্গে গোয়েন্দাসুলভ তদন্তবৃত্তিও অবলম্বন করতে শিখেছি।

আতঙ্ক ও বিস্ময় জোর করে তাড়িয়ে প্রথমে আশেপাশে বালির দিকে তাকালুম। জুতোর ছাপ আছে অনেকগুলো। ধস্তাধস্তির চিহ্ন প্রকট।

সেই ছাপের মধ্যে নিজের জুতোর ছাপ জুড়ে দেওয়া সঙ্গত মনে করলুম না। পাথরের ওপর পা রেখে হামাগুড়ি দিয়ে ঝুঁকে লোকটার মুখ দেখার চেষ্টা করলুম। মুখটা কাত হয়ে আছে। চোখ দুটো একটু ফাঁক। মনে হলো, আক্রমণ ঘটেছিল আচম্বিতে। লোকটা এখানে বসে কারুর জন্য অপেক্ষা করছিল কি?

আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল। পাথরে লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে ঝুঁকে দেখি, এইখানে অনেকটা বালি সরানো। গর্ত হয়ে রয়েছে। কেউ বা কারা বালির তলা থেকে কিছু উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

আবার লোকটার দিকে তাকালুম। আমারই বয়সী। প্রণতির পিসতুতো দাদা শমীক নয় তো? শিউরে উঠলুম। তারপর পাথর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ফের তার কাছে চলে এলুম। ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে তার বুকপকেটে ঢোকানোর চেষ্টা করলুম। যদি কোনো কাগজপত্র পেয়ে যাই!

কিন্তু সেই সময় আচমকা আমার পাশেই ঠকাস করে একটা ঢিল পড়ল। লাফিয়ে উঠলুম। মুখ তুলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, ঠকাস করে আরেকটা ঢিল পড়ল পাথরে।

এবার দেখতে পেলুম, ঝর্ণার ওপর বাঁদিকের প্রকাণ্ড পাথরে দাঁড়িয়ে আছেন আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। টাক ঢাকা সাদা টুপি রোদে ঝলমল করছে। গলায় কম্ফোর্টার জড়ানো। এক হাতে প্রজাপতি ধরা জাল, অন্যহাতে একগুচ্ছের ঢিল।

বুঝলুম, স্বরভঙ্গ যথার্থ ঘটেছে। তাই এই ঢিল। কিন্তু হাসবার মতো মনের অবস্থা নয়। ওঁকে দেখামাত্র সাহস ও উৎসাহ বেড়ে গেল। কীভাবে হাঁচড়-পাঁচড় করে ওই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু জায়গায় উঠে গেলুম বলতে পারব না।

পৌঁছেই হাঁফাতে হাঁফাতে বললুম– ওখানে একটা ডেডবডি পড়ে আছে কর্নেল। রীতিমত মার্ডার। রক্তে ভেসে গেছে।

কর্নেলের মুখটা গম্ভীর। হাতের ঢিল ফেলে নিজের মুখ হাঁ করে আঙুল দিয়ে বোঝালেন, স্বরভঙ্গ ঘটেছে। তারপর বোবার ভঙ্গিতে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, কিছুক্ষণ আগে তিনিও লাশটা আবিষ্কার করেছেন এবং একজন পথিককে দিয়ে ডমরুনাথ পুলিশ ফাঁড়িতে খবরও পাঠিয়েছেন। তারপর এখানে বসে শকুনের মতো অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় আমি হাজির হয়েছি। আমি কতটা কী করি, আমুদে বুড়ো তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে। শেষে আমি বাড়াবাড়ি করছি দেখে ঢিল ছুঁড়ে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

আমি প্রণতির ব্যাপারটা বলার পর প্রশ্ন করলুম, এ দুইয়ে কি কোনও সম্পর্ক আছে?

কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো সাদা চকপাথর বের করলেন। বুঝলুম, কোথাও কুড়িয়েছেন স্বরভঙ্গের দরুন ও পাহাড় পর্বতে জিনিসটা কাজে লাগবে বলে।

খড়ি দিয়ে পাথরের ওপর লিখলেন : যদি নিহত ব্যক্তিটি সেই শমীক হয়, তাহলে তো সম্পর্ক থাকছেই। যদি না হয়, তাহলে কিসের সম্পর্ক?

বললুম– যাই বলুন। প্রণতির ব্যাপার-স্যাপার বড় গোলমেলে। খুব রহস্যময়।

কর্নেল লিখলেন : রহস্যময় কি না, সেটা বোঝা যাবে সারাঙ বিদ্যুৎকেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে। যদি সত্যি ওখানে নীতিশবাবু নামে কোনও ইঞ্জিনীয়ার থাকেন, তাহলে গোলমাল কিসের?

বললুম– রাতে ওই যে সব কথাবার্তা শুনলুম শমীক ও প্রণতির–তার মানেটা কী?

কর্নেল লিখলেন : মানেটার সঙ্গে কোনও ক্রাইম জড়িত না থাকতেও পারে। যাই হোক, আর কথা নয়। চুপচাপ বসে পুলিশের অপেক্ষা করা যাক। এ আমাদের নাগরিক কর্তব্য।

বললুম– ফাঁড়িতে তো শুধু সেপাইরা থাকবে। দেখবেন, গণ্ডগোলে না যেন পড়তে হয়। বিহারের পুলিশ সম্পর্কে আমার আতঙ্ক আছে।

কর্নেল চুপচাপ চুরুট ধরিয়ে টানতে থাকলেন। আমার কথাও গ্রাহ্য করলেন না।

কিছুক্ষণ পরে ওপাশে রাস্তায় জনা দুই সেপাইকে আস্তে-সুস্থে আসতে দেখলুম। তাদের পেছনে একজন দেহাতি মজুর গোছর লোক। বুঝলুম, ওকে দিয়েই কর্নেল খবর পাঠিয়েছিলেন।

দেহাতি লোকটা ক্রমে আঙুল দিয়ে নিচে লাশটার দিকে সেপাই দুটোর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে কিছু বলল।

আমরা নেমে গেলুম লাশের কাছে। সেপাই দুজন হোমরা-চোমরা ভঙ্গিতে জেরা শুরু করল। সব জবাব আমিই দিলুম। সেইসঙ্গে কর্নেলের স্বরভঙ্গের কথাও জানালুম। তখন দেহাতি লোকটা ফিক করে হেসে হিন্দিতে বলল, আমি ভেবেছিলুম বুড়োসায়েব বোবা-কালা!

সেপাইরা থানায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঁচমাইল দূরের থানা থেকে অফিসাররা এসে পড়বেন। ততক্ষণ আমাদেরও থাকতে হবে।..

.

০৩.

প্রণতি এতে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়ল। কারণ লাশটা তার স্বামী নীতিশের। পকেটে আইডেন্টটি কার্ড ছিল। জনান্তিকে আমি কর্নেলকে বললুম– যা বলেছিলুম, হলো তো? রাত থেকেই আঁচ করেছিলুম, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে।

কর্নেলের স্বরভঙ্গ। মুখে অসহায় মানুষের ভঙ্গি। করুণ হাসলেন মাত্র।

আমরা এখন বাংলোয় ফিরেছি। লাশ মর্গে চলে গেছে পুলিশের জিপে। সারা থেকে খবর পেয়ে একদল বিদ্যুৎকর্মী ও অফিসার এসেছিলেন। পুলিশের জেরায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেছেন সবাই। বিহারের পুলিশ গা করে না তো করে না করলে বেজায় রকমের করে।

প্রণতি জেরার চোটে জেরবার। কোণঠাসা হয়ে নীরবে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওর অবস্থা দেখে। চক্রান্ত করে স্বামী হত্যার দায়ে গ্রেফতার করা হবে বলে শাসাচ্ছিলেন পুলিশের দারোগা ভদ্রলোক।

রাতের সেইসব ঘটনার কথা পুলিশকে আমি বলিনি। কর্নেল চোখ টিপে নিষেধ করেছিলেন।

কিন্তু বালির গর্তটা সম্পর্কে তীব্র কৌতূহল ছিল আমার। দারোগাবাবুকে জিগ্যেস করলে দ্রুত জবাব দিলেন, গর্ত করে লাশটা পুঁততে চেষ্টা করছিল খুনী। সম্ভবত কেউ এখানে গিয়ে পড়ায় সেটা পারেনি।

দুপুর বারোটার মধ্যে প্রণতিকে সত্যি সত্যি গ্রেফতার করে নিয়ে দারোগাবাবু সদলবলে প্রস্থান করলেন।

কিন্তু আশ্চর্য, প্রণতি আমাকে একবারও বলল না তাকে সাহায্য করতে। সে চুপচাপ চলে গেল।

বাংলো আবার নির্জন ও শান্ত হয়ে গেল। কর্নেল স্নান করলেন না আরও ঠাণ্ডা লাগবার ভয়ে। আমি স্নান করবার পর খাবার টেবিলে বসে বললুম– দারোগা ভদ্রলোক যেভাবে কেস দাঁড় করালেন, আমার খটকা থেকে গেল কর্নেল।

কর্নেল তাকালেন।

বললুম– প্রণয়ী শমীককে নিয়ে এসে স্বামীকে ডেকে এনে খুন করাল প্রণতি এই হলো দারোগাবাবুর বক্তব্য। কিন্তু রাতে শমীকের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির অর্থ কী? তাছাড়া শমীক বলছিল, এ জন্যে তুমিই দায়ি…

কর্নেল পকেট থেকে সেই চক পাথরটা বের করেছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল টেবিলে লিখলেন, খাওয়ার সময় মুখ বুজে থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তৃপ্তির সঙ্গে খেতে হলে কথা বলা উচিত নয়। বদ্রীর রান্নাও অতি উপাদেয়।

ক্ষুব্ধভাবে খাওয়াটা সেরে নিলুম। ঠিক করলুম, বুড়ো গোল্লায় যাক–আমি একা ব্যাপারটাতে নাক গলাব এবং রহস্যের ফদাই করে ফেলব ওঁর নাকের ডগায়!

খাওয়ার পর আমার একটু দিবানিদ্রার অভ্যাস আছে। সেই ঘুম ভাঙল বিকেল চারটেয়। উঠে দেখি কর্নেল নেই। বদ্রী চা দিতে এসে বলল, কর্নেল সাহাব একঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছেন।

আনমনে বললুম– আচ্ছা বদ্রী, তোমার কী মনে হয় বলো তো?

বদ্রী বলল, কী কথা বলছেন স্যার, বুঝতে পারছি না।

মানে–ওই খুনের ব্যাপারটার?

বদ্রী একটু হাসল। আমি ছোটা আদমি স্যার। আমার কী মনে হবে?

আমি তাকে জেরার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে চিৎকার শুনেছিলুম, তুমি বললে এখানে নাকি এমন চিৎকার রাতবিরেতে শোনা যায়। এটা বিশ্বাস হচ্ছে না বদ্রী।

বদ্রী চোখ বড় করে বলল, হ্যাঁ স্যার। আমি প্রায়ই শুনতে পাই। বাবা ডমরুনাথের চেলারা অমন করে চেঁচায়। তাই রাতবিরেতে আমি দায়ে না ঠেকলে। বেরুই নে।

আচ্ছা বদ্রী, শমীকবাবু ভোরে কখন বেরিয়েছিলেন, তুমি দেখেছ?

বদ্রী ঘাড় নাড়ল।

এইসময় বাইরে কেউ ভারি গলায় ডাকল-বদ্রী দাস! বদ্রী দাস।

বদ্রী যেন চমকে উঠল। ঝটপট বেরিয়ে গেল। দরজার পর্দা তুলে উঁকি মেরে দেখলুম একজন লম্বা-চওড়া গড়নের ভদ্রলোক লনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা স্যুটকেস! বদ্রী তাকে সেলাম দিয়ে স্যুটকেসটা নিল।

তারপর আমাকে অবাক করে প্রণতিরা যে ঘরে ছিল, সেই ঘরের দরজা খুলে দিল। চাপা গলায় বলল, খুব সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে রাণাসাহেব!

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ টিপে বললেন, শুনেছি। চেপে যাও এখন।

ওই ঘরে প্রণতির কিছু জিনিসপত্র তখনও রয়ে গেছে। বদ্রীর জিম্মায় আছে। পুলিশের অনুমতি না নিয়ে ওঘরে বদ্রী এই রাণাসাহেবকে ঢোকাল, এটাই অবাক লেগেছে। পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইলুম। বদ্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর বারান্দায় গেলুম। রাণাসাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। বদ্রী হনহন করে নেমে যাচ্ছে টিলা থেকে। একটু পরে সে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমার মনে রীতিমতো উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে গেল যে!

আমি পা টিপেটিপে ওই দরজার কাছে গেলুম এবং কান পেতে রইলুম। ভেতরে চাপা কী একটা শব্দ হচ্ছে। বাক্স গোছানোর মতো। শব্দটা থামলে মনে হলো রাণাসাহেব দরজা খুলতে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে সরে এলুম। লনে গিয়ে সিগারেট ধরালুম।

কিছুক্ষণ পরে রাণাসাহেব বেরিয়ে গটগট করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন। আমাকে গ্রাহ্যও করলেন না। টিলা থেকে নেমে রাস্তায় উঠলেন ভদ্রলোক। তারপর ডমরু পাহাড়ের দিকে যেতে দেখলুম তাঁকে। পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির। নিচে থেকে স্বাস্থ্যবান তীর্থযাত্রীদের জন্য নাক বরাবর সোজা একটা সিঁড়িও উঠে গেছে মন্দিরের দিকে। রাণাসাহেব সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পুজো দিতে যাচ্ছেন নাকি?

বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। পশ্চিমের পাহাড়ের পেছনে সূর্য নেমে গেছে। কুয়াশা ঘনিয়েছে। রাণাসাহেবের মূর্তি অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এদিকে বদ্রীও ফিরছে না! গেল কোথায় সে?

এইসময় আচমকা আমার কাঁধে টুপ করে একটা ঢিল পড়ল। পেছন ফিরে দেখি ওপাশে বদ্রীর ঘরের পেছনে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন গোয়েন্দা প্রবর কর্নেল সায়েব। হাসতে গিয়ে সংযত হলুম। কর্নেল ইশারায় ডাকছেন। মুখে ব্যস্ততা, ধূর্ততা ও ভীষণ গাম্ভীর্যের ছাপ।

কাছে যেতেই ইশারায় বদ্রীর ঘরের জানালার দিকে কিছু দেখালেন। চাপা গলায় বললুম– কী ব্যাপার? আপনি এখানে কী করছেন?

কর্নেল আমাকে হিড়হিড় করে টেনে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। টালির চাল চাপানো এই লম্বাটে ঘরের একদিকে কিচেন, অন্যদিকে বদ্রীর থাকার ব্যবস্থা। পেছনের জানালাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। সম্ভবত এ বুড়োরই কারচুপি খড়খড়ির ফাঁকে লাঠি ঢুকিয়ে ছিটকিনি তুলে জানালাটা খুলে কিছু দেখছিলেন।

উঁকি মেরে কিছু নজরে পড়ল না। ভেতরে আবছা অন্ধকার। জিজ্ঞেস করলুম, কী?

কর্নেল অসহায়তার ভঙ্গিতে মাথাটা দোলালেন। তারপর জানালাটা বাইরে থেকে টেনে আটকে দিয়ে আমার হাত ধরে টানলেন।

ভীষণ টান। পরক্ষণে আমাকে দৌড় করিয়ে ছাড়লেন। নিজেদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে টের পেলুম, বদ্রী ফিরে আসছে। তখন এভাবে পালিয়ে আসার কারণ বুঝতে পারলুম। বুড়োর কি সারা শরীরে অজস্র চোখ আছে?

ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন কর্নেল। তারপর পকেটের সেই চকপাথর বের করে টেবিলে খস খস করে যা লিখলেন, পড়ে দেখে আমি শিউরে উঠলুম। শরীর হিম হয়ে গেল।

কর্নেল লিখেছেন : বদ্রীর ঘরে একটা লাশ আছে।

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ওঁর মুখের দিকে। এ কি সাংঘাতিক ব্যাপার! তাহলে কি আমরা এখানে এসে এক রক্তপাগল খুনীর পাল্লায় পড়ে গেছি? আর এ লাশটাই বা কার হতে পারে? কর্নেল গুম হয়ে বসে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন।

একটু পরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলুম, কার লাস? শমীকবাবুর নাকি?

কর্নেল মাথাটা দোলালেন।

আরও ঘাবড়ে গিয়ে বললুম– সর্বনাশ! কিন্তু আপনি টের পেলেন কীভাবে?

কর্নেল লিখলেন : প্রশ্ন নয়। চুপচাপ থাকো। বদ্রীকে কফি দিতে বলল।

আমার আর সাহস হচ্ছিল না বেরুতে এবং বদ্রীর মুখোমুখি দাঁড়াতে। ভোজালির কোপ ঝাড়লেই হলো। ব্যাটা যে এমন সাংঘাতিক খুনী কে জানত! অমন অমায়িক হাসিখুশি চেহারা। আর পেটে এই সাংঘাতিক হননেচ্ছা!

ইতস্তত করছি দেখে কর্নেল থামলেন। স্বরভঙ্গ না হলে দারুণরকমের রসিকতা করতেন, সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা গেল।

দরজায় উঁকি মেরে ডাকলুম, বদ্রী! বদ্রী!

ওপাশ থেকে সাড়া এল, যাই স্যার!

কফি চাই বদ্রী! জলদি।

আচ্ছা! বদ্রী জবাব দিল।

বাইরে আলো জ্বলে উঠল একটু পরে। ইতিমধ্যে আমি চাপা গলায় জনৈক রাণাসাহেবের আগমন ও বদ্রীর সঙ্গে তার কথোপকথন জানিয়ে দিলুম কর্নেলকে। কর্ণেল নিরুত্তর এবং নির্বিকার।

আবার লাশটার কথা ভাবতে থাকলুম। আশ্চর্য, দুপুরঅব্দি এ বাংলোয় পুলিশের সমাগম ছিল। কত জেরা, কত খোঁজখবর হলো। অথচ কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, ওপাশে বদ্রীর ঘরের ভেতর আরেকটা লাশ লুকোনো রয়েছে!

বদ্রী কফি নিয়ে এল। কিন্তু মুখটা ভারি গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, রাতে কি খানার বন্দোবস্ত করতে হবে?

ওর হাতে খেতে আমার বাধছিল। ভাগ্যিস কর্নেল ইশারায় জানিয়ে দিলেন, তবিয়ত ঠিক নেই। কিছু খাবেন না। আমিও বলে দিলুম, শরীর খারাপ। খাব না।

বদ্রী দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু আঁচ করতে চাইল। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

ফিসফিস করে বললুম– কর্নেল! পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল না কি?

কর্নেল ঘড়ি দেখে মাথাটা রহস্যজনক ভঙ্গিতে দোলালেন শুধু।…

.

০৪.

তারপর ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে। রাতের অন্ধকার পরিবেশকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কর্নেল চুপচাপ শুয়ে একটা বই পড়ছে। আমি চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে আকাশপাতাল হাতড়ে এই যুগল হত্যাকাণ্ডের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। দরজা বন্ধ করা আছে। হঠাৎ বাইরে পরপর দুবার গুলির শব্দ এবং চিৎকার ও তর্জনগর্জন শোনা গেল।

কর্নেল বই ফেলে উঠে পড়লেন এবং ঝটপট দরজা খুলে বেরুলেন। আমিও বেরুলুম।

রেরুতেই চোখে টর্চের আলো পড়ল।

আলো সরে যাওয়ার পর পুলিশের মূর্তি দেখে আচ্ছন্নতাটা মুহূর্তে কেটে গেল। একদঙ্গল সশস্ত্র পুলিশ বাংলোকে হুলস্থূল করে ফেলেছে। বদ্রীর ঘরের দিকে দৌড়ে গেলেন কর্নেল। পেছন-পেছন আমিও গেলুম। গিয়ে দেখি, তেরপলে জড়ানো একটা লাশের সামনে পুলিশ অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছেন এবং বদ্রী হাঁটু চেপে ধরে বসে আছে। মুখটা বিকৃত। তার পায়ে রক্ত এবং আঙুলেও সেই রক্তের ছোপ। গুলি লেগেছে পায়ে, সেটা বোঝা গেল।

তার কাঁধ ধরে, একজন পুলিশ অফিসার তাকে ওঠাল। তারপর ওই আহত অবস্থায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল গেটের দিকে। বুঝলুম, খুনে শয়তানটাকে শ্রীঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তেরপল সরিয়ে লাশটা বের করা হলো। নীতিশবাবুর বয়সী এক যুবকের লাষ। তেমনি রক্তাক্ত। একেবারে জবাই করা অবস্থা।

তাহলে কাল রাতে যে চিৎকার শুনেছিলুম, তা কিসের এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে।

কিন্তু কেন বদ্রী এভাবে পরপর দুটো খুন করেছে? মাথা মুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যিনি বোঝেন, অর্থাৎ বুড়ো ঘুঘুমশাই স্বরভঙ্গ ধরিয়ে বসে আছেন। এককথায় যে আভাস দেবেন, আপাতত সে আশা নেই। কাগজকলম করে তাকে সবটা জানাতে হবে। কিন্তু সে তো সবকিছু চুকেবুকে গেলে, তবে।

এই হট্টগোলের মধ্যে রাণাসাহেবের কথা মনে পড়ে গেল।

ঘুরে প্রণতিদের ঘরের দিকে তাকালুম। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, সদ্য পুলিশের ঝাঁক তাকে ঘিরে ফেলল। রাণাসাহেব বেজায় হম্বিতম্বি জুড়ে দিলেন ইংরেজি ভাষায়। কোনও কাজ হলো না। পুলিশ তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল গেটের দিকে। ওধারে পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে।

লাশটা তেরপল জড়ানো অবস্থায় নিয়ে গেল ভ্যানের দিকে। তারপর জনাতিনেক অফিসার এবং কর্নেল বারান্দায় উঠলেন। অনুসরণ করলুম তাদের।

আমাদের ঘরে রীতিমতো বৈঠক বসল। এক্ষেত্রে কর্নেলের একটা লম্বাচওড়া ভাষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু তার স্বরভঙ্গ।

পকেট থেকে একটা মোড়ক বের করে টেবিলে রাখলেন কর্নেল। একজন অফিসার মোড়কটা খুলে সবিস্ময়ে বললেন, এই সেই সোনার ডমরু! এরই জন্যে এত খুনোখুনি!

হা, প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা এবং আন্দাজ ইঞ্চি তিনেক চওড়া অর্থাৎ ব্যাসের একটা ডমরু। ডমরুটা সোনার। একটু ময়লা দেখাচ্ছে। আনাড়ি চোখে ওটা পেতলের বলে ভুল হওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু এর সঙ্গে প্রণতির যোগাযোগ হলো কীভাবে?

অগত্যা জিজ্ঞেস করলুম পুলিশ অফিসারটিকে, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন মশাই?

অফিসার তাঁর সঙ্গীদের দিকে এবং পরে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নিয়ে বললেন, আপনি তো সাংবাদিক?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

জব্বর স্টোরি পেয়ে গেলেন মশাই! খাইয়ে দেবেন কিন্তু।

দেব। কিন্তু স্টোরিটা কী?

এতদিনে এই প্রথম কর্নেলের বদলে রহস্য ফাঁসের ব্যাপারটা পুলিশের কাছ থেকে নোট করতে হলো আমাকে। কিন্তু পুলিশ যে স্টোরি দেয়, তা আইন বাঁচিয়েই দেয় এবং তাতে সব জট খোলা থাকে না, অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা আছে। কিন্তু আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আমার বন্ধুর স্বরভঙ্গ থেকে আরোগ্য লাভ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সম্প্রতি কিছুদিন আগে বাবা ডমরুনাথের মন্দির থেকে এই সোনার ডমরু চুরি যায়। ডমরুটা খুব প্রাচীন। নেপালের রাজাদের অর্ঘ্য বাবা ডমরুনাথের শ্রীচরণে।

রাণাসাহেবের একটা চোরাচালানী গ্যাং আছে এ তল্লাটে। প্রবাবশালী লোক বলে তার গায়ে হাত দেওয়া যায়নি। অথচ পুলিশের সন্দেহ ছিল একাজ ওঁর গ্যাঙেরই।

বদ্রী ওঁর গ্যাঙের লোক। বদ্রীই চুরি করেছিল ডমরু। প্রণতির স্বামী নীতিশ আসলে সারাঙড্যামের ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার। ওই ঝর্ণাটা নিয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের একটা প্রকল্প আছে। তার সার্ভে করতে গিয়ে ঝর্ণার ওখানে বালির তলায় সে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করে। স্ত্রীকে ব্যাপারটা লিখে জানায়। প্রণতি এসে গেলে দুজনে মিলে ওটা বাবা ডমরুনাথকে প্রত্যর্পণ করার কথাও লেখে।

শমীক প্রণতির পিসতুতো দাদা-টাদা নয়, পুরনো প্রেমিক। নীতিশ ব্যাপারটা একটু আধটু আঁচ করেছিল। কিন্তু বিশেষ গা করত না। ডমরুনাথে পৌঁছে দিতে এসেছিল শমীক, প্রণতির অনুরোধেই। প্রণতি তাকে কথায় কথায় সোনার ডমরুর। কথাও বলেছিল।

এখানে পৌঁছনোর পর প্রেমিক শমীক তার পুরনো প্রেমিকাকে স্বামীর কাছে যাবার আগে এই একটা রাত প্রচণ্ডভাবে কাছে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রণতি বেঁকে বসে। শমীকের সঙ্গে একঘরে রাত কাটাতে রাজি নয়। অথচ উপায় ছিল না। বৃষ্টি পড়ছিল। অমন দুর্যোগে সারাঙ যাবে কীভাবে? তাই এই বাংলোয় আশ্রয় নিতেই হয়েছিল শেষপর্যন্ত। তারপর শমীক প্রেমনিবেদন শুরু করে। প্রণতি বাধা দেয়। ঝগড়াঝাটি শুরু হয়। তখন শমীক ক্ষেপে গিয়ে বলে, তোমার স্বামী চোর। বাবা ডমরুনাথের সোনার ডমরু চুরি করেছে। ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেব।

সম্ভবত বদ্রী আড়ি পেতে ব্যাপারটা শুনেছিল। এই হলো প্রণতির জবানবন্দী।

ঝগড়াঝাঁটি চরমে উঠলে শমীক রাগ করে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে যায়। তারপর একটা কিছু ঘটেছিল। ওই সময় বদ্রী তাকে নিজের ঘরে স্বচ্ছন্দে খুন করে। কেনই বা খুন করল, কেন শমীক তার ঘরে গেল–এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বদ্রীর জবানবন্দী আদায় করলে বোঝা যাবে।

ওদিকে নীতিশই বা ঝর্ণার ধারে খুন হলো কেন, তাও বোঝা যাচ্ছে না।

কর্নেল প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে তার লাশ দেখতে পান। লাশটা খুনী পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তার প্রমাণ ওই অসমাপ্ত গর্ত। কর্নেল গিয়ে পড়ায় সে পালিয়ে যায়। কর্নেল ঘুরতে ঘুরতে একটু তফাতে স্বচ্ছ জলের মধ্যে সোনার ডমরুটা আবিষ্কার করেন। বোঝা যায়, নীতিশের হাতে ওটা ছিল এবং খুনী তার ওপর হামলা করার সময় ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। খুনী আর ওটা খুঁজে পায়নি–অথবা খোঁজার সময়ও পায়নি।

কেন নীতিশ ডমরুটা নিয়ে এত ভোরে ওখানে এসেছিল?

আমার প্রশ্ন শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, বদ্রীর জবানবন্দী না আদায় করলে অনুমান করা যাচ্ছে না কিছু। তাছাড়া সারাঙে এখনও তদন্ত করছেন আমাদের অফিসার।

বললুম– আমি প্রণতি ও শমীকের ঝগড়া শুনেছিলুম। শমীক বলছিল, তুমি নিজেই এজন্যে দায়ী…

কর্নেল পকেট থেকে চকপাথর বের করছেন দেখে থেমে গেলুম। কর্নেল লিখলেন টেবিলে : ওটা পুরনো কথা তুলে প্রেমিক-প্রেমিকার কলহ। অর্থাৎ প্রণতি নিজেই নীতিশের সঙ্গে বিয়ের জন্যে দায়ি। ওসব কথার সঙ্গে এ ঘটনার সম্পর্ক নেই।

পুলিশ অফিসাররা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেল ও আমাকে বিদায় সম্ভাষণ করে চলে গেলেন।

বললুম– আপনার স্বরভঙ্গের আর সময় ছিল না? কেলেংকারি বটে!

কর্নেল করুণমুখে হাসলেন শুধু।…

.

০৫.

ঘুম ভেঙে গেল অতি পরিচিত কণ্ঠস্বরে-সুপ্রভাত ডার্লিং। আশা করি, সুনিদ্রা হয়েছে? শুনে লাফিয়ে উঠে বসলুম। বাইরে সোনালী রোদ ঝলমল করছে। আমার বৃদ্ধ বন্ধু খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।

চেঁচিয়ে উঠলুম, স্বরভঙ্গ সেরে গেছে আপনার?

কর্নেল মধুর হেসে বললে, প্রাচীন আয়ুর্বেদকে অবহেলা কোরো না বস? যষ্ঠীমধু এবং নানাপ্রকার শেকড়বাকড় সহযোগে প্রস্তুত ওই রক্তবর্ণ বটিকাগুলি আমাকে এক কবিরাজ উপহার দিয়েছিলেন। এতকাল ব্যবহারের সুযোগ পাইনি। পেয়ে ব্যবহার করে দেখলুম, অতি অব্যর্থ। কাশি তো তখনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বরভঙ্গও সেরে গেল। যাই হোক, ওঠো। চলো, আমরা নিচে রাস্তার ধারে খাবারের দোকানে গিয়ে গরম গরম কচুরি এবং চা সেবন করি গে! বদ্রী নেই–অতএব একটু কষ্ট করতেই হবে।

ঝটপট বাথরুম সেরে এসে দেখি, ঘুঘুমশাই তাঁর প্রজাপতি ধরা জাল, অত্যদ্ভুত ক্যামেরা, বাইনোকুলার ইত্যাদি কাঁধে ঝুলিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

দরজায় তালা এঁটে বেরিয়ে গেলুম দুজনে। টিলা থেকে ঢালু পিচের রাস্তায় নামতে নামতে বললুম– থানায় যাবেন না?

না ডার্লিং। আমার খাওয়াটা সেরে নিয়ে জঙ্গলের দিকে যাব।

বদ্রীর জবানবন্দীটা শোনার ইচ্ছে ছিল যে!

কর্নেল আমার একটা হাত ধরে বললেন, কী দরকার? সেটা তুমি আমার মুখেই শুনতে পারো।

আপনি জানেন সব?

আঁচ করেছিলুম কী ঘটতে পারে। কিন্তু স্বরভঙ্গ হয়ে গিয়ে অনিবার্য বিপদকে ঠেকাতে পারিনি।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম। বলেন কী!

কর্নেল আমাকে টানতে টানতে বললেন, আভাস পেয়েছিলুম। এ আমার এক সহজাত বোধ বলতে পারো। বদ্রীর হাবভাবে খুনীর আদর্শ ক্রমশ ফুটে উঠছিল। সেটাই প্রথমে আমার চোখে পড়ে। তাছাড়া সোনার ডমরু চুরির ঘটনা আগেই কলকাতায় থাকতে কাগজে পড়েছিলুম। খবরের কাগজের লোক হয়েও তুমি ব্যাপারটা জানো না, এতে আমার বিস্ময় নেই। কারণ ময়রার সন্দেশে রুচি থাকে না।

হাসতে হাসতে বললুম– ঠিক বলেছেন। তারপর?

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, বদ্রীর মধ্যে আমার চির পরিচিত খুনীর আদর্শ আবিষ্কার করার পর তার দিকে নজর রাখা উচিত মনে হয়েছিল। তবে রাতে বদ্রী যখন খানা আনল, তখন তুমি একটা চিৎকার শুনেছিলে। ওটা শমীকের আর্তনাদ হতে পারে না। হিমালয়ের ভালুকের চিৎকার। বৃষ্টির রাতে বিরক্ত হয়ে ওরা চেঁচামেচি করে। যাই হোক, শমীক প্রণতির সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে গিয়ে বদ্রীর ঘরে গিয়েছিল রাত কাটাতে। বৃষ্টির মধ্যে যাবে কোথায় বেচারা? বদ্রী তাকে নিজের বিছানায় শুতে দেয়। খুব ভোরে আমি যখন বেরুচ্ছি, তখন বদ্রীর ওপর নজর রাখতে গিয়ে উঁকি মেরে তার ঘরে শমীককে দেখি। গেটের কাছে গিয়ে বদ্রীকে খুঁজছি, চোখ পড়ল সে হনহন করে সারাঙয়ের রাস্তায় চলেছে। তখন কিছু বুঝিনি। আমার ইচ্ছে ছিল ঝর্ণার ধারে জঙ্গলে গিয়ে প্রজাপতি ধরব গোটাকতক।

কর্নেল দম ছেড়ে ফের বললেন, তখন সূর্য উঠেছে। কিন্তু কুয়াশা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় এই এক জ্বালা। সূর্য নেপালের পাহাড়ের আড়ালে থাকায় রোদ পৌঁছতে পারছে না। আমি অপেক্ষা করছি। রোদ না ফুটলে প্রজাপতির দেখা মিলবে না। ঘণ্টাখানেক পরে দেখি, এক ভদ্রলোক আর বদ্রী হনহন করে আসছে সারাঙ থেকে। ঝর্ণার কাছে এসে দুজনে দাঁড়াল। তারপর বদ্রী নিচে জলের দিকে আঙুল তুলে তার খোট্টাই বুলিতে বলল, বাবা ডমরুনাথ আমাকে স্বপ্নে ওই জায়গাটা দেখিয়ে দিয়েছেন স্যার। ওখানেই চোর ওনার ডমরু পুঁতে রেখেছিল। সেই ডমরু আপনার কাছে আছে বাবুসাব। স্বপ্নে বাবা আমাকে বলেছেন।

বললুম– আপনি ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। আমি তো মাত্র হাত বিশেক তফাতে একটা পাথরে বসে আছি। সামনে, ঝোপ থাকায় ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। …

তারপর?

ভদ্রলোক অর্থাৎ নীতিশবাবু কেমন যেন ভয় পেয়ে গেছে মনে হল। : বললেন, তোমার স্বপ্নটা হয়তো ঠিক আছে। বাবা তার ডমরু ফিরে পাবেন। ওটা আমার কাছেই রয়েছে। চলো, আমার স্ত্রীকে সঙ্গে করে বাবার মন্দিরে উঠব। তার জিনিস তাকেই ফিরিয়ে দেব। তুমি ঠিকই বলেছ, ওটা আমার লুকিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।

কর্নেল চুপ করলেন। আমরা নিচের রাস্তায় একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ওঁকে চুপ করতে দেখে বললুম– তারপর কী হলো?

হঠাৎ দেখলুম, বদ্রী কোমরের কাছ থেকে একটা ভোজালি বের করে ওঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার স্বরভঙ্গ। চেঁচিয়ে উঠতে পারলুম না। সঙ্গে রিভলভারটাও আনিনি। তাছাড়া আমাকে ওদের কাছে পৌঁছতে হলে অন্তত আড়াইশো গজ দূরত্ব ঘুরে যেতে হয়। ঝর্ণার অন্য পারে মাথার দিকটায় আছি। আমি যেতে যেতে খুন হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বদ্রী ওঁর জামাপ্যান্ট হাতড়াচ্ছে পাগল হয়ে। পেল না ডমরুটা। তখন বালি সরিয়ে লাশ পোঁতার চেষ্টা করল। আমার পক্ষে ওই দুর্গম আড়াইশো গজ পেরুতে যতটা সময় লাগে, তার আগেই এ পর্যন্ত ঘটে গেল। তখন মরিয়া হয়ে একটা পাথর ছুঁড়লুম। অমনি বদ্রী আমাকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে গেল। যাই হোক, ডমরুটা আমি কুড়িয়ে পেলুম জলের ধারে।…কর্নেল পা বাড়ালেন।

বললুম– তারপরও বদ্রীকে কিছু বলেনি? পুলিশকেও কিছু জানাননি।

কর্নেল হাসলেন।…আমার যা স্বভাব। খুনীর সঙ্গে কিঞ্চিৎ খেলা করা। তবে বদ্রীর মতো লোকের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ভুল করেছি। শমীককেও বাঁচাতে পারিনি। এদিকটা ভাবিইনি।

শমীককে কেন খুন করল বদ্রী?

শুধু শমীককে নয়। প্রণতিকেও খুন করত। প্রণতি দরজা আটকে ঘুমোচ্ছিল বলে।

কিন্তু কেন?

রাগ এবং আতঙ্ক ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে? সম্ভবত খুন করে বাংলোয় ফিরে তার ঘরে শমীককে দেখামাত্র তার হননবৃত্তি ফের চাগিয়ে উঠেছিল। তবে একটা কারণ অনুমান করা যায়। সোনার ডমরুর ব্যাপারটা ওই তিনজনেই জানত। নীতিশ খুন হওয়ার পেছনে সোনার ডমরু চুরির ব্যাপার থাকতে পারে, প্রণতি ও শমীকের এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তারা পুলিশকে বলত। ওদিকে আমি বদ্রীকে খুন করতে দেখেছি। বদ্রীর মাথার ঠিক ছিল না তাই। পারলে আমাকেও শেষ করে ফেলত। ….

বলে কর্নেল মুখ তুলে চারদিকটা দেখে নিলেন। ফের বললেন, আমি এমন ভাব দেখাচ্ছিলুম, যেন বদ্রীকে ভোরের কুয়াশার মধ্যে চিনতেই পারিনি! বদ্রীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে এটাই অনুমান করেছে। নইলে আমার এবং তারপর  তোমার ওপরও ভোজালি চালাতে দ্বিধা করত না। বাংলোয় এ কাজ নির্বিঘ্নে সেরে ফেলতে পারত।

আঁতকে উঠে বললুম– ছেড়ে দিন। চলুন চা-ফা-খাওয়া যাক।

কর্নেলের অনুমান যাই হোক, শমীককে খুন করার ব্যাপারটা রহস্যময় থেকে গেল আমার কাছে। কিন্তু আপাতত ও নিয়ে আর মাথা ঘামালুম না। ডমরুনাথের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি জাদুকর। ক্রমশ আমাকে সে আবিষ্ট করেছিল।…

.

বিকেলে রহস্যটা ফাঁস হলো শেষ পর্যন্ত। পুলিশ অফিসার মদনলাল এলেন বাংলোয়। তার কাছেই শুনলুম, বদ্রী কবুল করেছে সব। শমীককে সে খুন করত না। কিন্তু ঝর্ণাতলায় খুন করে এসে সে শমীকের মুখোমুখি পড়ে যায়। তখনও তার হাতে ভোজালি, কাপড়-চোপড়ে রক্ত। শমীক বিছানা ছেড়ে সবে উঠেছে তখন। জিজ্ঞেস করামাত্র মরীয়া হয়ে বদ্রী ওর গলায় কোপ বসায়। শমীক চিৎকার করে ওঠার সুযোগও পায়নি। তবে সাহস আছে বদ্রীর। এই বাংলোয় পুলিশ ধুন্ধুমার করছে, তার মধ্যে সে দিব্যি আরেকটা লাশ খাটিয়ার তলায় লুকিয়ে ভালমানুষ সেজে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর রাতে পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে হাতে নাতে।

 হাঙর

০১.

দ্য শার্কে একটি হামলা

বিকেলটা বেশ চমৎকার ছিল। সমুদ্রের লম্বা বিচে অজস্র লোক ভিড় করেছিল আজ। কদিন থেকে যা বৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে কোনও ভ্রমণবিলাসী ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। হঠাৎ আজ কিছুক্ষণের জন্য একটা বিকেল প্রচুল গোলাপি রোদ্দুর ছড়িয়ে খুশি করতে চাইল লোকগুলোকে। যারা বাইরে থেকে এসেছিল, প্রায় সকলেই চলে যাবার জন্যে তৈরি ছিল। কারণ বর্ষার মরসুম সত্যি সত্যি এসে গেছে এতদিনে। ভ্রমণ আর জমবার কথা নয়। কিন্তু যাবার আগের হঠাৎ পাওয়া এই সুন্দর উপহার–একটা শান্ত রোদ্দুরের বিকেল সবাই নিবিড়ভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল। আর সমুদ্রকেও দেখাচ্ছিল প্রাচীন ব্রাহ্মণের মতো, ঢেউ-এর ফেনায় যার সাদা উত্তরীয় এবং উপবীত ঝকমক করে উঠছে ঐশ্বরিক পবিত্রতায়।

ধর্মভীরু মানুষেরা রোদ মিলিয়ে যেতে যেতে শেষবার সমুদ্র-প্রণাম সেরে নিল। দুর্বলেরা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নুলিয়ার সাহায্যে স্নান থেকে স্বাস্থ্য নিয়ে এল। আর যারা চেয়েছিল শুধুমাত্র সৌন্দর্য, তারা বালির ওপর চেয়ারগুলোতে বসে সমুদ্রকে গিলে ফেলার ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে ফিরে গেল। কিছু লোক এসেছিল শিশুসুলভ বিস্ময় নিয়ে, তারাও ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ। ডেরায় ফিরল।

সংখ্যায় ওইসব লোকই ছিল বেশি, কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া যারা কোনওখানে পা বাড়াতে রাজি নয়। বাদবাকি সব নিষ্কমা ও বৈহিসেবীর দল–তাদের কাছে সমুদ্র বা পাহাড় অরণ্য, অথবা কোনও প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনের বস্তুত আলাদা মূল্য নেই, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তারা উদ্দেশ্যহীন। তারা জানে, বছরের কোন কোন সময় কোথাও যেতে হয়। তাই তারা যায় এবং ঘুরে আসে। হয়তো ঘর তাদের সময় বিশেষে চার দেয়াল থেকে চারটে, সিলিং ও মেঝে থেকে দুটো–মোটা ছটা দাঁত বের করে বলেই দরজা গলিয়ে পালায় কোথাও। তারা এই সমুদ্রতীরে এসে ঘুরতে হয় বলেই ঘুরেছে। হল্লা করা উচিত বলেই হল্লা করেছে। এবং কেউ কেউ শুনেছিল, বিচে বসে প্রকাশ্যে মদ্যপান করায় প্রচুর স্যাডিজম আছে, তারা তাই করল বটে কিন্তু সুখ কী টের পেল, বলা কঠিন। যেমন, শেষ মরসুমের সেরা আকর্ষণ তিনটি মেয়ে আর দুটি ছেলের দলটা। তাদের কেউ কেউ তো হড়হড় করে বমি করেই ফেলল। তারপর তারা বিধ্বস্ত ফুসফুস আর অস্পষ্ট চোখে সমুদ্রকে দেখেছে প্রচণ্ড ক্লান্তির প্রতীক–একঘেয়েমির যান্ত্রিক বিক্ষোভ।

দ্বিতীয় নমুনা, আর একটি পঞ্চরত্নের দল। তারা সঙ্গিনীছাড়া তরুণ। বেলেল্লামি করা তাদের পক্ষে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল–যেহেতু তাদের সঙ্গে কোনও মেয়ে নেই। তারা সমুদ্রকে আলাদা করে দেখেনি, বিচের নরমতা থেকে হাঁটার আনন্দ পায়নি, হঠাৎ এই খোলা বিকেলটার ভালবাসা টের পায়নি তারা কেবল বিশাল জালার গায়ে কয়েকটি পিঁপড়ের মতো ঘুরঘুর করছে এবং কুট কুট করে কামড়াতে চেয়েছে। বিস্তর মানুষকে তারা বিরক্ত করেছে। তারপর তিনটি মেয়ে ও দুটি ছেলের দলটাকে দেখতে পেয়ে শেষঅব্দি খানিকটা ঘুমো-ঘুষিও করেছে। পুলিশ দৌড়ে না এলে সে একটা দৃশ্য হত বটে! যেন বর্তমান সভ্যতাজোড়া স্যাডিজমের ঢেউ বিকেলের সমুদ্রতীরে বারবার হানা দিচ্ছিল।

তৃতীয় নমুনা, স্ন্যাকস-গারারা ইত্যাদি পোশাকপরা চারটি মেয়ে। সম্ভবত তারা এখানে এসেই প্রথম সিগারেট খেতে চেয়েছিল। চারজনের হালকা আঙুলে চারটে সিগারেট, বিচের চেয়ারে বসা সৌন্দর্যলিঙ্গু বুড়োমানুষটিকে বলেছে, দাদু, দেশলাই দিতে পারেন? বিস্ময়ের কথা, তিনি মৃদু হেসে এবং সপ্রতিভ আধুনিকতায় লাইটার এগিয়ে দিয়েছেন। তখন তারা দেখেছে, লোকটার হাতে জ্বলন্ত চুরুট রয়েছে এবং তাঁর পোশাক দস্তুরমতো বিলিতি। অমনি ধন্যবাদ বলে হাসতে হাসতে সরে গেছে তারা। কিন্তু দ্বিতীয় জায়গায় আরেক নিঃসঙ্গ বুড়োকে বেছে দেশলাই চাইলে তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। ভদ্রলোক মুখটা গম্ভীর করে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, নেই।তারা হেসে উঠল। এ বুড়োকে শায়েস্তা করা হয়েছে ভেবে অনেক খুঁজে আরেক বুড়োকে বের করল। ইনি কিন্তু মুচকি হেসে বললেন–দেশলাই কী হবে লক্ষ্মীমায়েরা?

সিগারেট খাবো।

মেয়েরা সিগারেট খায় নাকি? বলে পরক্ষণে মাথা দুলিয়েছেন।…হা ভুল। হচ্ছে। খায় বটে। আমাদের শহরে মনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারনীরা খায় বটে। তা লক্ষ্মীমায়েরা, তোমরা কোন মুনিসিপ্যালিটিতে কাজকম্মো করো, শুনি?

পাল্টা চোট খেয়ে ওরা চটে গেল।..বুড়ো হয়েছে, ভদ্রতা করে কথা বলতে জানেন না? যত সব সেকেলে ভূত! গেঁয়ো রাবিশ! কবে যে এগুলো যাবে সব!

এবং পরে কয়েক মিনিট শিক্ষাসভ্যতা নারীধর্ম ইত্যাদি নিয়ে একতরফা বিতর্ক–তারপর হঠাৎ চারটি ফ্যাশানভূতগ্রস্ত মেয়ের পক্ষে সেই পাঁচটি সঙ্গিনীলিঙ্গু ছেলের যোগদান, দেশলাই জ্বেলে প্রত্যেকের ঠোঁটের সিগারেট ধরিয়ে দেওয়া–তারপর বুড়ো অভিমানী কম্পিত চোখে দেখলেন, নজনের দলটা নটা সিগারেটের ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে চলতে শুরু করেছে। বুড়ো সখেদে বললেন, একেই কি বলে সভ্যতা? এবং বুড়ো শালিকের মতো ঘাড়ে রোঁ নিয়ে এক দত্তকুলোদ্ভব কবির কথা ভাবতে লাগলেন।

হ্যাঁ, অভাবিত বিকেলের সমুদ্রতটে হয়তো এসব ঘটনা ও দৃশ্যও সমুদ্রচাঞ্চল্যের অন্তর্গত। তারপর কিন্তু প্রকৃতি তেমনি বিস্ময়কর তৎপরতার সঙ্গে গুটিয়ে ফেলল ঝিলমিল গোলাপি রঙের পটচিত্র! সূর্য ডুবে যেতে-না-যেতে হু হু করে সমুদ্র থেকে উঠে এল চমরী গাইয়ের মতো মেঘ। এবং তারপর আবার শুরু হলো তুলকালাম বৃষ্টি। দেখতে দেখতে ফাঁকা হয়ে গেল বিচ। নুলিয়ারা ডাঙ্গার নৌকোর তলায় গুটিসুটি ঢুকে গেল। ফেরিওয়ালারা জিনিসপত্র গুটিয়ে শস্যকণাবাহী পোকাদের মতো দৌড়ে পালাতে লাগল। বেলুনওয়ালাদের হলো সমস্যা। চারজন কাবুলিওয়ালাও গুলিখাওয়া বাঘের মতো সি-বিচের একটা হোটেলে ডিগবাজি খেয়ে ঢুকল। বুড়ো, কাচ্চাবাচ্চা আর মেয়েরা ভিজে জবুথবু হয়ে যে-যার আখড়ায় ঢুকতে বেশ দেরি করে ফেলল। কেবল মাস্তানটাইপ কিছু ছেলেমেয়েকে দফায় দফায় দেখা গেল কাকের মতো দিব্যি ভিজতে ভিজতে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক চলেছে। নজনের দলটা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে গেছে ইতিমধ্যে। পাঁচজনের দলটা হোটেলে ফিরেছে সবার আগে। বিলিতি পোশাকপরা বুড়ো রেনকোট চাপিয়ে দিব্যি ধীরে-সুস্থে সবার শেষে গেল। তারপর সমুদ্রের ধারে শুধু বৃষ্টি আর ধূসরতা ছাড়া কিছু নেই।

একটু পরেই খুব তাড়াতাড়ি রাত এসে গেল। বৃষ্টির মধ্যে কুয়াশার মতো অপরিচ্ছন্নতায় বিচের বাতিগুলো জ্বলে উঠল। দ্য শার্ক বা হাঙর নামে একটেরে ঝাউবনের ধারে যে নির্জন ছোট্ট বার কাম-রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে ভিড় কম ছিল। মদ্যপিপাসুরা আজ বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে সুখ চেয়েছিল। তাছাড়া, কেন যেন আজ জমেইনি এখানকার আসর। কাউন্টারের ভদ্রলোক এক মাদ্রাজী। তিনিই মালিক। বিকেলে ভালো আবহাওয়া পেয়ে মোহনপুর চলে গেছেন– বউয়ের অসুখ নাকি। তিনজন ওয়েটার, কিচেনে দুজন রাঁধুনি, দুটো কিশোর বয় এবং কাউন্টারে রোগা হাড়জিরজিরে একজন বাঙালী কর্মচারী।

এ রেস্তোরাঁয় যারা দৌড়ে ঢুকেছিল, সাতটা অব্দি কেউ কেউ বিয়ার খেয়ে ভিজতে ভিজতে কেটে পড়ল। একজন অবশ্য হুইস্কি খেয়েছে পেগ তিনেক। সেও দুলতে দুলতে চলে গেল। এক মধ্যবয়সী দম্পতি ছিলেন। তারা লাইম দিয়ে জিন খেলেন এক পেগ করে তারপর রেনকোট চড়িয়ে বেরোলেন। রাত আটটাতেও বৃষ্টি চলেছে সমানে। এবং ঘরে তখন কোণার টেবিলে কেবল দুটি মেয়ে বসে রয়েছে। একজন স্ন্যাকসপরা, অন্যজন বেলবটম। বাইশ থেকে চব্বিশের মধ্যে বয়স। একজন মোটাসোটা, একটু বেঁটে, খুব পাতলা ঠোঁট আর একবার ভাজা বেগনীর মতো সরু নাক, ছোট্ট কপাল–উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যায় এবং তার মাথায় ববছাঁট চুল–সে স্ন্যাকস পরেছে ক্রিমরঙা। গায়ে তাঁতের ফিকে হলুদ হাফ পাঞ্জাবি–তাতে বাটিকের কালো ছাপ, কবিজিতে চওড়া কালো বেল্টের মোটা ঘড়ি। তার পায়ে সরু দু ফিতের হালকা স্লিপার।

বেলবটপরা মেয়েটির গায়ে শুধু ধবধবে সাদা গলা-আঁটো হাফ স্পোর্টিং গেঞ্জি, তার বুকে ব্রেসিয়ার নেই, তা স্পষ্ট। তার মুখটা একটু লম্বাটে–গালের দিকটা ডিমালো, চিবুক তিনকোণা কিন্তু প্রশস্ত, বেমক্কা পুরু ঠোঁট ঠোঁটের কোণায় উদ্দেশ্যহীন হাসির আভাস আছে। তার ভোলা বলিষ্ঠ বাহু দুটো টর্চের নতুন ব্যাটারি থেকে উৎসারিত জোরাল দুটি আলোর মতো। তারও কবজিতে মোটা ঘড়ি এবং একই ব্যাণ্ড। তার পায়ে পেতলের চওড়া বকলেস দেওয়া চটি। তার গায়ের রঙ বেশ ফরসা। হঠাৎ দেখলে অবাঙালী মনে হতে পারে। তার কপাল অশোভন ভাবে চওড়া এবং ঘন কালো ভুরু পাপড়ি, ডাগর চোখ, কালো একরাশ চুল কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি নেমে গেছে। কীরকম পুরুষালি চেহারা যেন। হঠাৎ দেখলে কিম্পুরুষ মনে হয়।

হাফ-পেগ জিন নিয়ে তারা রাত আটটা অব্দি হাঙর-এর মধ্যে বসে রয়েছে। তার জন্য অবশ্য এই দুঃসময়ে হাঙরওয়ালাদের কোনও বিরক্তি নেই বরং উপভোগ্য দ্রব্য, এই ক্লান্তিকর বৃষ্টির রাতে দুটি উঁচুদরের যুবতী! তাদের শরীরে বিবিধ আয়োজন এবং ধনী গৃহস্থের বিয়েবাড়ির দরজার সামনে দিয়ে যাবার সময় নিম্নবিত্ত যেমন একবার তাকিয়ে দেখে যায়, তেমনি করে ঘুরঘুর করে যাচ্ছে। রাঁধুনি, ওয়েটারদ্বয়–এমন কি বয় দুজনও।

মেয়ে দুটি কি বৃষ্টির দরুন উদ্বিগ্ন? তা কিন্তু কারো মনে হচ্ছিল না। ডেরায় ফিরে যাবার কোনও তাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না তাদের মধ্যে। বরং যেন কী নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় সময় কাটানো আলস্যে বৃষ্টিকে উপভোগ করছিল। চাপা গলায় কথা বলছিল পরস্পর। এদিকে ক্রমশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবার নির্দিষ্ট সময় এগিয়ে আসছিল। আজ মালিক নেই, তুমুল বৃষ্টি আর নির্জনতা, তাই কাউন্টারের রোগা কর্মচারীটি হাই তুলে বারবার ঘড়ি দেখছিল। তার ইচ্ছে, নটার বেশি অপেক্ষা করা আজ অসম্ভব। মালিক আসবেন না। তাঁর স্কুটার না থেকে পুরোপুরি গাড়ি থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল। তাই হঠাৎ দেখা গেল সে চাপা গলায় ওয়েটারদের কী সব বলে সাড়ে আটটাতেই অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে গেল–দরজার কাছে ছাতা খুলল, তারপর বৃষ্টি ও কালো রাতের মধ্যে ডুব দিল।

তার পনের মিনিট পরে বেরোল দুজন ওয়েটার–আর তাদের ছাতার তলায় একজন করে ক্ষুদে বয়। আরও পাঁচটা মিনিট লম্বা পায়ে চলে গেল রাঁধুনি দুজনও একইভাবে বেরোল। তারা মেয়ে দুটোর দিকে একবার যথারীতি তাকিয়েও গেল।

এখন রইল শুধু সবচেয়ে শক্তিমান, লম্বাচওড়া গড়নের লোক তার নাম নব। নব হাঙরে রাতে একমাত্র পাহারাদার। বোঝা যায়, সেই মালিকের একমাত্র বিশ্বস্ত ও প্রশ্রয় পাওয়া কর্মী। কারণ ক্যাশবাক্সটা সে লম্বা মোটা হাতে অবহেলায় তুলে লোহার আলমারিতে ঢোকাল। চাবির গোছাটা উর্দির তলায় গাপ করল। তারপর ক্যাশ কাউন্টারে বসে মেয়ে দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার তাকানোর মধ্যে বিস্ময় বিরক্তি কিংবা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বোঝা যায়, এই ধরনের জীবনে সে কোনও আকস্মিকতা আশা করে নাবস্তুত সব আকস্মিকতাই তার কাছে নিয়ম। এবং সেজন্যেই সে ফাঁক পেলেই বলে, এই হচ্ছে হাঙরের কানুন।

হ্যাঁ, যে-কোনও সময় কোনও আবেগবান, ভাবপ্রবণ কিংবা খামখেয়ালী খদ্দের এসে হানা দিতে পারে। দেয়ও। রাত বারোটা অব্দি তাই খুলে রাখার নিয়ম আছে দ্য শার্কের দরজা। অনেক সময় এসে পড়তে পারেন পুলিশ অফিসারদেরও কেউ। বঙ্গোপসাগরের উত্তর পশ্চিম তীরবর্তী এই উপনগরীটিতে প্রচুর রহস্যময় ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকে জানে, নব পুলিশের একজন টাউট। এবং পুলিশ সচরাচর গভীর রাতেই আসে এখানে।

রাত নটা বাজলে এতক্ষণে মেয়ে দুটি আরও দুট হাফ-জিনের অর্ডার দিল। নব অর্ডার সার্ভ করে ফের কাউন্টারে মাছের চোখ নিয়ে বসল। বাইরে বৃষ্টির শব্দ তখনও শোনা যাচ্ছে। সমুদ্রের গর্জন কাঁপয়ে দিচ্ছে মানুষের সচেতন ইন্দ্রিয়গুলোকে। এই উপকুলে এমনিতেই সমুদ্র খুব রাফ যাকে বলে–তাতে এই দুর্যোগে তার ভয়ঙ্কর আওয়াজ অনভিজ্ঞদের অস্বস্তিতে অস্থির করে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ঠিক দরজার সামনে ঢেউ এসে ভেঙে গেল। তিনজনের কেউ তাকিয়ে দেখে না।…

.

একটু পরেই দরজার বাইরে একটা ভিজে মানুষের মূর্তি দেখা গেল। দরজায় এসে দুটো হাত দুদিকে রেখে মাথা গলিয়ে দিল সে। মেয়ে দুটি অমনি অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল। বড়বড় চোখে তাকাল তার দিকে। দুজোড়া চোখে প্রচণ্ড আতঙ্ক ম্লান আলোয় ঝলমল করে উঠল।

নবও নড়ে উঠেছিল। সে সিংহের মতো গ্রীবা ঘুরিয়ে দেখছিল আগন্তুককে।

কারণ, আগন্তুকের মুখে একটা কালো মুখোশ।..

সে এক লাফে ভিতরে এসে গেল। পরক্ষণে তার হাতে ঝলসে উঠল একটা ছোরা। অমনি স্ন্যাকসপরা মেয়েটি জন্তুর মতো অব্যক্ত একটা আর্তনাদ করে কোণের দিকে ছিটকে গেল। অসমাপ্ত গ্লাসগুলো উল্টে ঝনঝন শব্দে নিচে পড়ে ভাঙল। বেলবটমপরা মেয়েটি যেন হতবুদ্ধি হয়ে বসেছিল। আততায়ী ছোরাটা নিয়ে এক পা এগোতেই সে মুখে আঙুল পুরে গোঁ গোঁ করে উঠলতারপর কাউন্টারের দিকে দৌড়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার সামনে আততায়ী-তাই কিচেনের দরজার দিকে এগোল।

তাও পারল না। আততায়ী এক লাফে সেদিকে এগোলে মেয়েটি কোণে তার সঙ্গিনীর কাছে চলে গেল। দুজনেই ভীষণ কাঁপছিল।

বড়জোর কয়েকটা সেকেণ্ডের মধ্যে এগুলো ঘটল।

তখন দেখা গেল নব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার মুখে সংশয়। প্রস্তুতির অভাব তখনও স্পষ্ট। আগন্তুকের হাতে ছোরা রয়েছে।

দ্য শার্কের সাত বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। মারামারি বিস্তর হয়েছে কিন্তু হঠাৎ এমন দুর্যোগের রাতে নির্জন পরিবেশে মুখোশপরা কোনও লোক ছোরা হাতে ঢোকেনি। নব তাই হয়তো হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল।

আট-দশ সেকেণ্ডের মধ্যে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। আততায়ী ছোরাটা তুলে জড়সড় বোবায়ধরা মেয়ে দুটির দিকে এগোতেই বেলবটমপরা ফরসা মেয়েটি ছিটকে সদর দরজার কাছে চলে গেছে এবং তারপর তাকে বাইরে অদৃশ্য হতে দেখা গেল।

তারপর ভয়ঙ্কর কানামাছি খেলা চলল স্ন্যাকসপরা বেঁটে মেয়েটি ও আততায়ীর মধ্যে। মেয়েটি বোবায়ধরা গলায় গোঁ গোঁ করতে করতে এদিক-ওদিক লাফ দিচ্ছে। টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি লণ্ডভণ্ড হচ্ছে। নব সেইসময় একহাতে চেয়ার তুলে অন্যহাতে একটা বড় বোতল তাক করল। সে খুব অবহেলায় ব্যাপারটা দেখছিল।

আর সেই মুহূর্তেই দ্বিতীয় মেয়েটিও ছিটকে সদর দরজা গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং অদৃশ্য হলো। নবর বোতলটা লাগল দরজার পাশে। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে গেল। আততায়ী তখন দরজায়। পরক্ষণে নব দ্রুত একটা সোডার বোতল তুলে। মারল। বোতলটা বাইরে বৃষ্টির মধ্যে মোটাসোটা বাচ্চার মত ধপ্ করে পড়ল মাত্ৰ-ফাটল না। লন মতো আছে ওখানটায়-ঘাস আর ফুলের গাছ রয়েছে। ঘাস আর ফুলের গাছের মধ্যে বেহেড মাতালের মতো ঘাড় গুঁজে পড়ে রইল বোতলটা।

তখন নব দুহাতে চোখ মুছল। মঞ্চে কেউ নেই।

দুঃস্বপ্ন দেখছিল না তো?

.

মোটেও না। রেস্তোরাঁর ভিতর জলজ্যান্ত ওল্টানো টেবিল-চেয়ার, ভাঙা কাচের গ্লাসগুলো, ছত্রাকার ছাইদানি ইত্যাদি-মেঝের কারপেট ভিজে গেছে ইতস্তত, একটা বোতল থেকে তখনও বগবগ করে জল পড়ছে। দরজার কাছে অজস্র কাচের .. টুকরো। একদিকের পর্দা ছিঁড়ে বেমক্কা ঝুলছে।

নব প্রথমে এক লাফে দরজায় এসে বাইরে তাকাল। কেউ কোথাও নেই। বাতিগুলি বৃষ্টির ঝাপটায় ম্লান-বিচের দিকে যেন কুয়াশার পর্দা ঝুলছে। ডাইনে বাঁয়ে উপকূলের সমান্তরাল অপ্রশস্ত রাস্তা নির্জন। ফুলগাছ কিংবা অন্যান্য সব বড় গাছগুলো বৃষ্টির মধ্যে ছটফট করছে, যেন পায়ে বাঁধা সব জন্তু-জানোয়ার।

সে দরজা ভাল করে এঁটে দিল। ডানপাশের কোনও বাড়ি বলতে বালিয়াড়িটার পিছনে কোস্টের সবচেয়ে কস্টলি হোটেল সী ভিউ। অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ হেঁটে যেতে হয় এখান থেকে। বাঁ পাশে একটা লম্বা ঝাউবন পেরিয়ে অন্তত একশো গজ দূরত্বে এক ধনী মানুষের বাংলোবাড়ি। পিছনে দেড়শো গজ পোভড়া জায়গায় কাটাতারের বেড়া এবং সরকারের লোহালক্কড়ের পাহাড়, তার পিছনে ত্রিশ গজ দূরে অবজারভেটরি। তারপর বড় রাস্তা এবং ছড়ানো-ছিটানো বসতি এলাকা, বাজার এবং সরকারী কোয়ার্টার। তারও পিছনে সরকার-লালিত অরণ্য অঞ্চল এবং কয়েকটি টিলা বা হিলক-শ্রেণীর ক্ষুদে পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় কোথাও বাংলো, কোথাও আশ্রম আর মন্দির রয়েছে।

এই ভূগোল ও প্রকৃতি-পরিবেশ ঝটপট মনে ভাসল নবর। সে খুব ক্লান্ত বোধ করল। বৃষ্টি ছাড়বার কোনও লক্ষণ নেই। সমুদ্র গর্জাচ্ছে। কোনও পুলিশ অফিসারও তো আজ আসছে না এমন রাতে! হাঙরে কোনও ফোন নেই। বড়ো হোটেলগুলোয় আছে। কিন্তু বাইরে বেরোনো অসম্ভব।

মেয়ে দুটি গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল হাঙরে। হাফ-পেগ জিন নিয়ে দুঘন্টা কাটিয়ে গিয়েছিল। কেমন গম্ভীর টাইপ মেয়ে যেন কম কথা বলে। কলকাতা থেকে এসেছে, সেটা বোঝাই যায়। কোথায় উঠেছে ওরা? আর, আচমকা ওই মূর্তির উদয় হলো, তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল…কোনও মানে হয় না। এ একটা স্বপ্নই!

একটু পরে সে সিগারেট ধরাল। তারপর ধীরে সুস্থে ঘরটা সামলাতে ব্যস্ত হলো। কাচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে টেবিলে রাখল। তারপর মেয়ে দুটি যেখানে বসেছিল, সেখানে গেল। চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করার সময় হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে কুচিকুচি এবং দলা পাকানো। দলা পাকানো কাগজটা সে অকারণ অন্যমনস্কতায় খুলল। একটা বড় কাগজের অংশ–কিন্তু ছাপানো নয়, হাতের লেখা। সে আদৌ লেখপড়া জানে না।

নবর মনে পড়ল, এই কাগজটা বেঁটে মেয়েটির হাত থেকে নিয়ে ফরসা মেয়েটি পড়ছিল বটে। দ্বিতীয়বার সার্ভ করার সময় নব দেখেছিল, বেঁটে মেয়েটি কোলে হাত দুটো রেখেছে এবং আনমনে একটা কাগজ কুটিকুটি করেছে।

কাগজগুলো সে ফেলল না। পকেটে রাখল। নব পুলিশের ইনফরমার। তার কী করা উচিত, সে জানে।…

.

০২.

ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে

এ অঞ্চলের মাটির জলশোষণ ক্ষমতা বেশি বলে যত বৃষ্টি হোক কাদা খুব কমই হয়। মাটিতে বালির ভাগ স্বভাবত বেশি। একসময় ফসল ফলানোর কথা ভাবাই যেত না। গত দশ বারো বছরে সরকারী যোজর কল্যাণে কোথাও-কোথাও চাষবাস লক্ষ করা যাচ্ছে। দুতিনটে আধুনিক ধাঁচের মেকানাইজড কৃষি-খামারও গড়ে উঠেছে। চন্দনপুর-অন-সীর বুকের কাছে পানিগ্রাহী এগ্রিকালচারাল ফার্ম। একটা টিলার নিচে ঊনিশ একর বেড়াঘেরা অসমতল জমি নিয়ে ফার্ম। ভুট্টা, বজরা আর মরশুমে অল্পস্বল্প বিদেশী ধান ফলে। তবে বেশিটাই গোলাপ ফুলের চাষ।  এইটাই মুখ্য।

পানিগ্রাহীরা একসময় বড় জমিদার ছিলেন। এখন বংশের একমাত্র পিদীম মদনমোহন সব জোতজমা খুইয়ে ওই ফার্মে এসে ঠেকেছেন। তবে ফার্মটা নিছক সৌখিনতা বলেই মনে হয়। ফুলের রানী গোলাপসুন্দরী। কাজেই লোকে পয়সা বা লাভালাভ দেখে না, দেখে সৌখিনতা। ফার্মের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কিছুক্ষণের জন্য জীবনের কদর্যতা বলে কিছু আছে, তা মনে পড়ে না। তবে কেউ বিশ্বাস করে না যে ওই ফুল থেকে মদনমোহনের একেকটা ইলেকশানের সব খরচ ওঠে। হ্যাঁ, মদমমোহন পাণিগ্রাহী রাজনীতি করেন। হেরে ভুট হন, তবু ভোটে দাঁড়ান।

খামারে অবশ্য তিনি খুবই কম থাকেন। দিন পনের আগে মদনমোহন যথারীতি ফার্মে এসেছিলেন, চলেও যান এবং বলে যান, জনৈক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে সুইডেন যাবেন। ফিরবেন ঊনিশে জুলাই। ফার্মে যদি আসেন, তো বাইশ-চব্বিশ তারিখ। আজ তেইশে জুলাই। এখন ভোর পাঁচটা। গত রাতের তুমুল বৃষ্টির বিশেষ কোনও চিহ্ন কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু খানাখন্দে কোথাও কিছু ঘঘালাটে জল আর মসৃণ কাদা থকথক করছে। তবে সমুদ্রের গর্জন বেড়েছে। বাতাস বইছে খরতর– পুবের বাতাস। টিলা ও দুরের বালিয়াড়ির ঝাউবন একটানা শনশন শব্দ করছে। সমুদ্ৰশকুনের ডানার মতো ধূসর আলোয় ক্রমশ জেগে উঠছে ভাটার চরের মতো চন্দনপুর-অন-সী। গোপালকিশোর পানিগ্রাহী ফার্মের গেটের পাশে তার ছোট্ট ঘরে জেগে বসে হাই তুলছিল।

টিনের মাঝারি সাইজের গুদামের লাগোয়া তার ঘর। পাশে একটা চালাতে কিছু কৃষি-যন্ত্রপাতি রয়েছে। সে ট্রাকটার চালায়। হার্ভেস্টার কম্বাইন তার জিম্মায়। গত একটি দিন পাণিগ্রাহীসায়েবের আশায় সে কাটিয়েছে। গোলাপক্ষেতে কী দুয়ে মড়ক লেগেছে। কিছু করা যাচ্ছে না। কর্তা ছাড়া এ কর্ম হবার নয়। মিঃ পাণিগ্রাহী এসব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। সে উদ্বিগ্ন হয়ে তার পথ চেয়ে বসে রয়েছে।

গোপালকিশোর সিগারেট ধরাল। তারপর চটিটা পায়ে গলিয়ে বাইরে এল। আকাশ দেখল। সমুদ্রের দিকে দিগন্তে কিছু খয়েরি রঙের চাপ চাপ মেঘ রয়েছে। বাকি আকাশ পরিষ্কার। সামনে ক্ষেতের দিকে তাকাল সে। যে নএকর সমতল জমিটার চারদিকে আল রয়েছে, সেখানে ধানের চাষ হয়। ইতিমধ্যে দুবার হাল্কা ডিস্ক হ্যাঁরো বা তিন নম্বর লাঙলে চাষ পড়েছে। কিন্তু গত রাতের বৃষ্টিতে একটুও জল দাঁড়ায়নি। অজস্র ঘাস আর আগাছায় জঙ্গল হয়ে উঠেছে। বর্ষার রস পেয়ে উদ্ভিদজগত এখন বেপরোয়া। গোপালকিশোর একটু ভাবনায় পড়ল। কর্তা আসবার আগেই ওই আগাছা চাবড়াসুদ্ধ উল্টে ফেলা উচিত। পরের বৃষ্টিতে সেগুলো পচে স্বাভাবিক সারের কাজ করবে এবং জলও দাঁড়াবে।

খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল সে। ঘড়ি দেখল। এখন সওয়া পাঁচটা। মিঃ পাণিগ্রাহী আসবেনই কথামতো। কিন্তু তিনি ঘুম থেকে দেরিতে ওঠেন বরাবর। ভুবনেশ্বর থেকে রওনা দিলে সে বেলা নটার আগে নয়। অতএব গোপালকিশোর দৌড়ে গিয়ে চালাটায় ঢুকল। গেটের তালা খুলে কাঠের ফ্রেমটা সরাল। ট্রাকটারের পিছনে দুনম্বর হ্যাঁরো জুড়ল। তারপর স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এল। সেই নিঃঝুম ধূসর, ভোরকে ট্রা-রা রা রা আওয়াজে উচ্চকিত করে তুলল সে।

উঁচু জায়গা থেকে নিচের ক্ষেতে ট্রাকটারটা পৌঁছলে গোপালকিশোর হাতলে চাপ দিয়ে পিছনের হ্যাঁরোর সার নামিয়ে দিল। চ্যাপ্টা এক সার দাঁত নরম বেলেমাটিতে বসে গেল। ঘাসগুলো কোথাও প্রায় এক ফুট থেকে দেড় ফুট উঁচু হয়ে উঠেছে। কোথাও ধনচে গাছ (ভালো সার হয়) ঝোপের মতো জাঁকিয়ে উঠেছে। গোপালকিশোর দেখল, একটা সাপ পড়ি কী-মরি করে পালাচ্ছে। তার একটা বদ্ধমূল সংস্কার আছে ছেলেবেলা থেকে। সাতসকালে প্রাতঃকৃত্যের আগে সাপ দেখে ফেললে প্রচণ্ড অমঙ্গল হয়।

মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে প্রণাম করল সে। সামনে ধনচে ঝাড়ের মধ্যে সাপটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সাপটাকে খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যেই সে তাকাল আরও সামনের দিকে। সেই সময় তার চোখে পড়ল, জমির শেষপ্রান্তে আলের কাছে কী একটা বড়সড় পড়ে রয়েছে। প্রথমে ভাবল কাঠের গুঁড়ি, পরে মনে হলো রঙিন কিছু একটা কাপড়চোপড়ের মতো, এবং খানিকটা কালো। ঘাস ও আগাছার মধ্যে ডুবে থাকায় ত্রিশ-বত্রিশ মিটার দূর থেকে ঠিক বোঝা কঠিন। নাকি কোনও শেয়াল? উঁহু-শেয়াল অতটা জায়গা জুড়ে থাকতে পারে না। তাছাড়া শেয়াল হলে এতক্ষণ লেজ গুটিয়ে পালাত। তাহলে কি কারও গরু রাতে বেড়া গলিয়ে এসে পড়েছিল–উঁচু আল থেকে পড়ে ঠ্যাঙ ভেঙেছে?

দেখতে দেখতে ট্রাকটারটা আরও দশ মিটার এগিয়ে গেল। তখনও জিনিসটা কী বুঝতে পারছে না গোপালকিশোর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। আরও পাঁচ মিটার..আরও দুই…আরও দুই…ফের দুই…একেবারে জিনিসটার সামনে সজোরে ব্রেক কষল সে। তার মুখ সাদা হয়ে গেল। কয়েকমুহূর্ত পাথরের মূর্তির মতো স্টিয়ারিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল গোপালকিশোর।

তারপর সংবিত ফিরে পেল। চকিত চোখে চারদিক দেখে নিল। কেউ কোথাও নেই।

সে লাফ দিয়ে নামল ট্রাকটার থেকে।

তার উল্টোদিকে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ে। ববছাট চুলগুলো ঘাস ও কাদায় মাখামাখি, হলুদ ঢিলে পাঞ্জাবির ওপর কালচে জংলা নকশা আর চাপ চাপ রক্ত। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো স্ন্যাকস। এক পায়ে দুফিতের স্লিপার রয়েছে, অন্য পা খালি–স্লিপারটা ছিটকে একপাশে পড়ে রয়েছে। ঠিক ঘুমোবার ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে মেয়েটি।

যাই হোক, পিঠে রক্ত ও ক্ষতচিহ্ন দিয়ে জংলা ক্ষেতে কোনও মেয়ের ঘুমোতে আসা খুব সহজ ব্যাপার নয়। গোপালকিশোরের শরীর থরথর করে কাঁপছিল। মেয়েটির মুখ ঘাসের মধ্যে কাত হয়ে ডুবে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভেজার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে আপাতদৃষ্টে। গোপালকিশোর বিভ্রান্ত হয়ে দৌড়তে থাকল হঠাৎ।

সেই ভোরে চন্দনপুর-অনসীর নির্জন রাস্তায় বোবায় ধরা মানুষের মতো গো গোঁ করে তাকে দৌড়তে দেখলে পাগল বলেই মনে হতো। অবশ্য এখানে পাগল কদাচিৎ দেখা যায়।

গোপালকিশোর ড্রাইভার মানুষ। কিন্তু জীবনে একবারও অ্যাকসিডেন্ট না করার রেকর্ড তার আছে। কোনও খুনখারাবিও তার বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে চাক্ষুষ করেনি। সরল, অমায়িক, সাবধানী আর হিসেবী বলে তার সুনাম আছে। আজ সকালে এই প্রথম তারই ট্রাকটারের তিন মিটার দূরে একটি রক্তাক্ত লাশ সে আচমকা আবিষ্কার করেছে এবং তার জন্যে সেই বদমাশ সাপটাই নির্ঘাৎ দায়ী।

সে উদভ্রান্তভাবে বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি! আমার কোনও দোষ নেই, স্যার!

কোথায় যাচ্ছিল, তার খেয়াল নেই। পীচঢালা সরু পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে সে দৌড়চ্ছিল। বিড়বিড় করছিল, আমি চাপা দিইনি…আমি চাপা দিইনি…

.

০৩.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

সামরিক দফতরের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চন্দনপুর-অন সী-তে প্রতি বর্ষায় কিছুদিন এসে কাটিয়ে যান। এখানে তার বন্ধু ডাক্তার সীতানাথ পট্টনায়কের একটি বাড়ি রয়েছে। সেখানেই তিনি উঠেছেন। ডাঃ পট্টনায়ক ভুবনেশ্বরের লোক। মাঝেমাঝে তিনি সস্ত্রীক এ বাড়িতে এসে থাকেন। তার হালকা সবুজ একটি ল্যাণ্ডমাস্টার গাড়ি রয়েছে। এবার তার স্ত্রী মালবিকা আর মেয়ে কল্যাণীও এসেছে সঙ্গে। কর্নেল এসেছেন পরে।

খুব ভোরে উঠে একবার সমুদ্রতীরে বেড়িয়ে আসা কর্নেল সরকারের অভ্যাস। ষাট পেরিয়েছে বয়স। চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু ভিতরে যৌবনের প্রাণপ্রাচুর্য উদ্দাম।

আজ ভোরে কী খেয়াল হলো, কর্নেল সমুদ্রের দিকে গেলেন না। অবজারভেটরির কাছে এসে ডাইনে উত্তরের পথে চললেন। একপাশে বালিয়াড়ি, অন্যপাশে ছড়ানো-ছিটানো কিছু সুন্দর বাড়ি। চন্দনপুর-অনসী বড়লোকের জায়গা। তাই সাধারণ মানুষের কোনও জমজমাট বসতি গড়ে ওঠেনি। চারদিক ফাঁকা, খোলামেলা। কর্নেলের ইচ্ছে হলো, আজ আকাশ যখন পরিষ্কার–তখন টিলায় উঠে সূর্যোদয় দেখবেন। তিনি টিলার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। সূর্য উঠতে এখনও আধঘন্টা দেরি আছে। টিলায় পৌঁছতে দশ মিনিট লাগবে মাত্র।

কাল রাত্রে পট্টনায়ক পরিবারের সঙ্গে খেতে বসে সভ্যতা ও সরলতার প্রসঙ্গ উঠেছিল। সেই কথাগুলো এখন মাথায় এল কর্নেলের। সরলতা! এখনও ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় অনেক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এটা টিকে রয়েছে। ঈশ্বর সরলতাকে রক্ষা করুন সভ্যতার থাবা থেকে। আরবস্তুত এই চমৎকার নির্মেঘ ভোরে আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে সরলতা বিরাজ করছিল।

মাথার ওপর কী একটা পাখি উড়ে গেলে কর্নেল তাকে দেখার চেষ্টা করলেন। বোঝা গেল না। বার্ডওয়াচিং তার অন্যতম হবি। ভুল হয়েছে, বাইনোকুলারটা আনেননি। পাখিটার ডাক শুনে মনে হলো, দুর্লভ জাতের সেই উড-ডাক। এ অঞ্চলে উড-ডাক নাকি মাঝে মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। কর্নেল মুখ তুলে পাখিটার মিলিয়ে যাওয়া লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ তার কানে এল ধুপ-ধুপ শব্দ। তিনি দেখলেন, একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জিপরা লোক ধুকুর-ধুকুর দৌড়ে আসছে। তার কানে এল : আমি চাপা দিইনি..আমি চাপা দিইনি! পাগল নাকি? কর্নেল কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

চন্দনপুর-অন-সী-তে এই ভোরবেলায় পাগল দেখতে পাওয়া এক দুর্লভ ঘটনা বটে! কর্নেল ভাবলেন। কাছাকাছি অনেককালের পুরনো একটা উন্মাদ আশ্রম বা লুনাটিক অ্যাসাইলাম আছে। সেকারণে এখানে প্রবাদ রটে আসছে যে চন্দনপুর অন-সীতে পাগল দেখতে পাওয়া নাকি দুর্লভ ও পরমাশ্চর্য ঘটনা এবং পাগলরা ভাল হতে অর্থাৎ পাগলামি সারাতে চায় না। তাই প্রাণ গেলেও এ তল্লাটে পা বাড়ায় না। অবশ্য এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা মুশকিল। অন্তত কর্নেল বহুবার এখানে এসেছেন, কোনও পাগল দেখেননি।

লোকটা সামনা সামনি আসামাত্র কর্নেল চমকে উঠলেন। আরে! এই লোকটাকে তো পানিগ্রাহী ফার্মে ট্রাকটার চালাতে দেখেছেন!

গোপালকিশোর কর্নেলকে যেন এতক্ষণে দেখল। দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাউ-মাউ করে উঠল–স্যার, স্যার! আমার কোনও দোষ নেই–ঠাকুরের দিব্যি, আমি সবে, ক্ষেতে নেমেছি–অমনি স্যার…

কর্নেল মুহূর্তে টের পেলেন লোকটা একটা মারাত্মক কিছু দেখে ভীষণ শক্ খেয়েছে। তিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে শক্ থেরাপি প্রয়োগ করার মতলবে ধমক দিলেন, আলবত তোমার দোষ। তুমিই তো চাপা দিয়েছ! স্বচক্ষে দেখেছি?

অমনি গোপালকিশোর কর্নেলের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।…দোহাই স্যার, বাঁচান আমাকে! আমি খুন করিনি, আমি খুন করিনি!

কর্নেলের গায়ে পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল। খুন! মার্ডার! কী বলছে ও? দুহাতে ওর কাধ ধরে দাঁড় করালেন। তারপর এক মুহূর্ত ওর মুখটা দেখে নিয়ে সজোরে গালে এক চড় মারলেন। এই শক্ থেরাপি প্রয়োগ ছাড়া উপায় ছিল না।

চড় খেয়ে গোপালকিশোর কাঠ হয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে তার মুখে স্বাভাবিকতা ফুটে উঠল। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে মাথাটা দুপাশে দোলাল হতাশভাবে। তারপর বলল, স্যার কি পুলিশ অফিসার?…

.

কিছু পরে অবজারভেটরিতে গিয়ে থানায় ফোন করে কর্নেল গোপালকিশোরের সঙ্গে পানিগ্রাহী ফার্মের দিকে যেতে যেতে ভাবছিলেন, এই তাঁর বিধিলিপি বলা যায়। শয়তানের সঙ্গে পাঞ্জা কষতে কষতেই তাঁর অবসরভোগী জীবনটা কেটে যাবে মনে হচ্ছে। একদণ্ড ফুরসত পাবেন না। এক চিরকালের খুনী সবসময় সব জায়গায় এমনি করে তার সামনে ফেলে দিচ্ছে একটা করে লাশ, তাকে লেলিয়ে দিচ্ছে নিজের পিছনে–এ এক বিচিত্র লুকোচুরি খেলা! রহস্যময় অন্ধকারে সেই খুনীকে খুঁজে বের না করা অব্দি তার রেহাই নেই। মাথায় জেদ চড়ে যায়। যৌবনে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে শত্রুর সঙ্গে এমনি মরণপণ হারজিতের লড়াই করতে হয়েছে। তাকে। সেই থেকে ওই জেদের জন্ম। কর্নেল মনে মনে বলছিলেন, না ঈশ্বরনা। তুমি আমাকে পাদরি ভেবো না। আমি তোমার প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত প্রফেটও নই তাদের পায়ের নখের যোগ্যও নই। তবু কী জানি, জীবনে এ এক দুর্মর প্যাসনের পাল্লায় আমি পড়েছি যা আমাকে অনবরত একটি শক্তির বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছে, যে শক্তি জীবনবিরোধী। সে মৃত্যুর চেলা। এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের মধ্যে সহজাত শক্তি হিসেবে সে জন্মায়–তার নাম হননেচ্ছা, হিংসার বিষাক্ত পিণ্ডের মতো তার অবচেতনায় উপস্থিতি। সুযোগ পেলে অনুকূল অবস্থা ও আবহাওয়ায় সেই পিণ্ড ডিনামাইটের মতো ফাটে ও ধ্বংস করে। সে হিসেবে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই হত্যাকারী রয়েছে। অস্তিত্বের অন্ধকার চোরকুঠুরি থেকে সে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে। তাই ডাঃ পট্টনায়কের মতো সজ্জন ভদ্র সুসভ্য মানুষকে। যদি দেখি–প্রিয়তমা স্ত্রী অথবা কন্যাকে হত্যা করে বসেছেন, বিস্মিত হবার– কিছু নেই।…

পরক্ষণে চমকে উঠলেন।…মাই গুডনেস! এ কী ভাবছি! হঠাৎ পট্টনায়কের কথাটা মাথায় এল কেন? এই আমি নীলাদ্রি সরকারও কি হননেচ্ছা থেকে মুক্ত? কে জানে! আমরা কোন মুহূর্তে কে কী করে ফেলব, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। সত্যি নেই। এমন কি, যে বিচারক ভারতীয় দণ্ডবিধির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, যিনি খুনীকে ফাঁসি দেন–তিনিও কি সেই সনাতন প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত? উত্তরবঙ্গের সেই বিচারক ভদ্রলোকের কাহিনী সবাই জানে, যিনি স্ত্রী ও তিন মেয়েকে খুন করে বসলেন। ….

টিলার কাছাকাছি এসে বাঁদিকে পথ ঘুরল। সামনে পানিগ্রাহী ফার্ম দেখা গেল। টিলার পশ্চিমের ঢালু গা থেকে নেমে কিছু অসমতল এবং কিছু সমতল জমি বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে। টিলার গায়ের অংশে ইউক্যালিপটাস গাছের মধ্যে একটা কাঠের বাংলোমতো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। জমিটার দক্ষিণপ্রান্তে–সেই বাংলোর সরাসরি উল্টোদিকে ফার্মের গেট আর গুদাম। একটা চালাঘরও রয়েছে।

কর্নেল ভীষণ দুঃখিত। এই সরলতাময় ভোরবেলাটি পৃথিবীর জন্যে বয়ে। আনল এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ। যে চিরকালের খুনী তার এই সুন্দর দিনটি এভাবে মাটি করল, তার প্রতি ঘৃণায় ও রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তার অন্যমনস্ক একটা হাত পকেটে ঢুকতেই একটি শক্ত বাঁকানো জিনিসের অস্তিত্ব টের পেলেন। রিভলভার! কী আশ্চর্য, আসবার সময় তাহলে কখন এটা পকেটে ঢুকিয়েছিলেন যথারীতি!

দুঃখে হাসলেন কর্নেল। বরাবর এটা হয়ে আসছে। অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বলা যায়। বেরোলেই এটা সঙ্গে নিয়ে ফেলেন, জেনে বা না জেনেও। কেন নেন? আত্মরক্ষা! তাহলে মাই ডিয়ার ওল্ড ম্যান, তুমি সতত সতর্ক, কারণ তুমি সেই ইটারনাল মার্ডারারকে ভয় করো। তুমি ক্রমাগত দিনের পর দিন তার একটার পর একটা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে তাকে বেআব্রু করে চলেছ–তাই তোমার এত অবচেতন ত্ৰাসনা জানি কখন সে তোমাকেই আক্রমণ করে বসে!

গোপালকিশোর ধরা গলায় রুদ্ধশ্বাসে বলল, এই যে স্যার, এই যে! আহা হা, এমন কমবয়সী মেয়ে স্যার! এত নিষ্ঠুর মানুষ থাকতে আছে–আহা হা!

দেখতে পাচ্ছি। বলে কর্নেল উঁচু আল থেকে যুবকের মতো লাফ দিয়ে নামলেন এতক্ষণে। পরক্ষণে তার নার্ভগুলো বর্তমান অবস্থার দিকে সক্রিয়তায় তৎপর হলো। অনেক হত্যাকাণ্ডের মতোই এও একটি নিছক হত্যাকাণ্ড। সূর্যের আভাস দেখা দিয়েছে দিগন্তে। একটু ঝুঁকে মেয়েটির মুখ লক্ষ্য করলেন। কোথায় যেন দেখেছেন! সম্ভবত সমুদ্রতীরেই। না, কাল বিকেলে যে চারটি মেয়ে তার কাছে সিগারেটের জন্যে আগুন চেয়েছিল, এ তাদের দলের নয়। কারণ, সেই স্ন্যাকস ও গারারাধারিনী তরুণীদের কারও গায়ে পাঞ্জাবি ছিল না।

পিঠে ছুরি মারা হয়েছে। কিন্তু ছুরিটা নেই। পিঠে মারা হয়েছে, তার একটা কারণ হতে পারে, দৌড়ে পালানোর সময় আঘাত করেছিল হত্যাকারী। কর্নেল সতর্ক চোখে আশেপাশে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। কোথাও একবিন্দু রক্ত নেই। মাটিটা বেলে। জল শুষে নিয়েছে। কাদা হয়নি বিশেষ। ঘাসে বা আগাছার পাতায় কোথাও এক ফোঁটা রক্ত লেগে নেই। লাশটা মনে হয় বাইরে থেকে এনে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও পায়ের দাগ নেই দেখা যাচ্ছে। নরম মাটিতে দাগ পড়া অনিবার্য ছিল। দেখা যাক, পুলিশ অফিসাররা কেউ আসুক। থানায় বলা হয়েছে ডাঃ পট্টনায়ককে সঙ্গে আনতে। পট্টনায়ক শুধু ডাক্তার নন, ফোরেনসিক-এক্সপার্টও। একসময় কলকাতায় ফেরেনসিক ইন্সটিটিউটে ইন্সট্রাক্টারও ছিলেন। সেই সূত্রে কর্নেলের সঙ্গে আলাপ হয়। শেয়ালদা স্টেশনে ট্রাকবন্দী একটা লাশের ব্যাপারে চমৎকার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন ভদ্রলোক।

গোপালকিপোর, তাহলে মেয়েটিকে তুমি চেনো না বলছ? কর্নেল এবার চুরুট ধরালেন।

আজ্ঞে না স্যার। এই প্রথম দেখছি।

কর্নেল মুখ ঘুরিয়ে জমির উত্তর-পূর্ব দিকে টিলার গায়ে সেই বাংলোটা দেখতে দেখতে বললেন, ওখানে কে থাকে?

গোপালকিশোর বলল, সায়েব যখন আসেন, থাকেন। বাকি সময় তালাবন্ধ থাকে।

কেউ থাকে না? কোনও মালী, কিংবা দাবোয়ান?

না স্যার। বাংলোটার বদনাম আছে। বলে গোপালকিশোর করুণ হাসল।

বদনাম! ভূতের নাকি? কর্নেল হেসে উঠলেন।

আজ্ঞে সেরকমই। রাতবিরেতে মানুষের আওয়াজ পাওয়া যায় কখনো। কখনো আবছা লোক দেখা যায়। আমরা আলো নিয়ে গিয়ে দেখেছি, কেউ নেই দরজা তালাবন্ধ রয়েছে ঠিকঠাক।

তুমি নিজে কখনো দেখেছ কি?

না স্যার আমার চোখে পড়েনি। ভোমরলালরা দেখেছে।

কে ভোমরলাল?

দারোয়ান স্যার। সে বেটা অবিশ্যি গাঁজা খায়। তবে হাসিরাম মালীও নাকি দেখেছে।

মিঃ পানিগ্রাহী এসব কথা জানেন?

না স্যার। ওনাকে এসব ফালতু কথা বলা যায় নাকি? তবে একবার…।

একবার?

সায়েব খুব বকেছিলেন এসে–শেবার ঘরের মেঝেয় কে বমি করে রেখেছিল।

বমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অথচ আশ্চর্য, দরজায় তালা আটকানো ছিল দিব্যি।

তুমি বমিটা দেখেছিলে নিশ্চয়?

না স্যার, হাসিরাম দেখেছিল। ওকেই সব ধুতে হয়েছিল কি না। তাহলে তোমাদের বাংলোর ভূতে বমি করে দেখছি!

এইসময় একে একে গেটের পাশের গুদাম আর ঘরগুলো থেকে কিছু লোককে এদিকে আসতে দেখা গেল। কেউ কেউ দৌড়ে আসছিল। সবার আগে যে এল, তার গোঁফগালপাট্টা ইত্যাদি দেখেই বুঝলেন, এই ভোমরলাল। সে একলাফে কাছে এসে অস্ফুট আর্তনাদ করল, হা রামজী! এ কী ব্যাপার?

অন্যেরাও এসে ভিড় করল। বিস্মিত গুঞ্জন শুরু হলো। কর্নেল গম্ভীর স্বরে বললেন, ভোমরলাল, এটা খুনখারাবির ব্যাপার। তুমি সবাইকে বলো, সরে তফাতে গিয়ে দাঁড়াক। এক্ষুণি পুলিশ এসে যাবে।

গোপালকিশোর আদেশটা ঝট করে লুফে নিল। হাঁকডাক শুরু করল সে।…তফাতে যাও, তফাতে যাও! ভোমরলালও দারোয়ানী দেখাতে ছাড়ল না। সূর্য উঠছে। লাল একটা চাকা বেরিয়ে পড়েছে। সূর্যটা দেখতে দেখতে মন বিষণ্ণ হয়ে গেল কর্নেলের। হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা দিনের শুরু, কোথায় পৌঁছবেন কে জানে! অবাক ভয় পাওয়া লোকগুলোর মুখে সুর্যের লালচে রঙ পড়েছে। একটা মুখে গিয়ে তার দৃষ্টি আটকে গেল। কী যেন রয়েছে মুখটায়। ঠোঁট দুটো কাঁপছে। কিছু জোর করে চেপে রাখলে মানুষের মুখে একটা দম আটকানো ছাপ। পড়ে, কর্নেল দেখেছেন। সরলতা! ডাঃ পট্টনায়ক সরলতা নিয়ে তর্ক করছিলেন মেয়ের সঙ্গে। এই সেই সরলতার দ্বিতীয় নমুনা বটে! কর্নেল লোকটার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন, তোমার নাম কী ভাই? কিছু বলবে তুমি? বলো–কোনও ভয় নেই!

লোকটি অমনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।…আমি হাসিরাম স্যার। আপনি পুলিশের অফিসার স্যার? কাল রাতে স্যার, আমি ঠিক দেখেছিলাম-সায়েবের বাংলোর মধ্যে যেন আলো জ্বলছে। এরা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেবে বলে কিছু বলিনি স্যার। তখন বিষ্টি হচ্ছিল জোর। তারপর আলোটা যেমন জ্বলে উঠেছিল, আচমকা নিভে গেল স্যার।.।

ডিটেকশন করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার মূল্য আছে। কর্নেল সরকার চুরুট টানতে থাকলেন।..অনেক সময় ফ্যাক্টস বা বাস্তব তথ্যের চেয়েও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া বেশি কাজ দেয়।

.

০৪.

 প্রাথমিক তদন্ত

জিপ থেকে চারজন ব্যক্তভাবে তোক নামল। পুলিশ অফিসার শ্রী সেনাপতি, ডাঃ পট্টনায়ক আর দুজন বন্দুকধারী সেপাই। তারা দৌড়ে লাশটার কাছে চলে এল। পট্টনায়কের কাঁধে একটা বড়সড় এয়ারব্যাগ আর অদ্ভুত গড়নের ক্যামেরা ঝুলছে। হাতে সেকেলে গড়নের হাতলওয়ালা আয়নার মতো কী একটা রয়েছে–গোলাকার ঢাকনা দেওয়া কাঁচ।

সেপাই দুজন তাদের কর্তব্য সেরে নিল আগে। অর্থাৎ ফার্মে লোকজনকে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে খেদিয়ে দিল। পট্টনায়ক সশব্যস্তে বললেন, এক মিনিট মিঃ সেনাপতি। তারপর সাবধানে এগিয়ে লাশের ডানকবজিতে নাড়ি পরীক্ষা করে নিলেন। তারপর এগিয়ে পিছিয়ে নানা ভঙ্গিতে পটাপট সুইচ টিপলেন ক্যামেরার। লাশটার চারদিক থেকে কয়েকটা ছবি তুললেন। শেষে ক্লোজশটও নিলেন গোটা তিনেক। তারপর মৃদু হেসে হাত ইশারা করলেন, হ্যাঁ, মিঃ সেনাপতি–আপনি এগোতে পারেন এবার। শী ইজ কোয়াইট ডেড।

সেনাপতি হেসে বললেন, আমার এগোনো মানে তো স্যার, লাশটা উঠিয়ে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্য কিছু পেপারওয়ার্ক রয়েছে। ছকবাঁধা ভাষায় একটা বিবরণ লেখা।

বলে তিনি নোটবইতে ৬বি মার্কা পেন্সিল লড়িয়ে দিলেন। রুটিন ওয়ার্কস, পুলিশের ভাষায়। আইটেমগুলো ধরাবাঁধা। তবে ফিতে বের করতে হলো। যে কোনও দুদিকের মোটামুটি স্থায়ী সীমানাচিহ্ন হিসেবে কোনও গাছ দেয়াল কিংবা এ ধরনের কিছু বেছে নিয়ে লাশ থেকে তাদের দুরত্ব মাপার কাজ রয়েছে। একটা চিহ্ন হিসেবে উঁচু আলটা পাওয়া গেল উত্তরে, পুবে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। সেনাপতি মাপজোকের ফিতে বের করলেন। একজন সেপাই সেটার একপ্রান্ত ধরল। শেষে ট্রাকটারটা থেকে দূরত্বও মাপা হলো।

সেই সময় ডাক্তার পট্টনায়ক সতর্ক করলেন। দেখবেন, পায়ের ছাপটাপ নষ্ট হয়।

সেনাপতি এক সময় ওঁর ছাত্র ছিলেন। অনুগত প্রাক্তন ছাত্রের বিনয়ে তিনি বললেন, না স্যার–আমি জানি। তেওয়ারী, এগোও তুমি।

কর্নেল অন্যমনস্কভাবে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চুরুট টানছিলেন। যেন এঁদের উপস্থিতি তার চেতনার বাইরে। পট্টনায়ক তার কাছে গেলেন।…এই যে কর্নেল! এ– কেসের নাম কী দেবেন, ভাবছেন বুঝি? এ মার্ডার ইন দা ফার্ম নাকি…

কর্নেল হাসলেন অভ্যাস মতো।…না। এ মার্ডার ইন দা বিগিনিং অফ এ লং ডে। দীর্ঘ দিনের শুরুতে একটি হত্যাকাণ্ড।

পট্টনায়ক বললেন, ঠিক বলেছেন। দিন লম্বাই বটে। ইস্, চন্দনপুর-অন সীর দিনগুলো যা লম্বা লাগছে, ভাবা যায় না! কী হয়েছে বলুন তো?

আপনি ব্যস্তবাগীশ মানুষ কি না। তাই অবসর কাটানো আপনার পক্ষে রীতিমতো ড্যাম বিজনেস! কর্নেল বন্ধুকে যেন সস্নেহে আদর দিলেন। তবে যাই হোক, এখন আপনি লম্বা দিন জবাই করার মতো কিছু পেয়ে গেলেন, বলব।

তাচ্ছিল্যে ভুরু কুঁচকে পট্টনায়ক জবাব দিলেন, এ একটা বাজে কেস বলে মনে হচ্ছে–যা দেখছি। মর্গ থেকে রিপোর্ট এলে দেখবেন, নিছক ধর্ষণের পর খুন। আজকাল আধুনিকতার নামে মেয়েরা যতটা সাহস দেখাচ্ছে, প্রকৃতি তাদের শরীরে তো সে-মতো শক্তি দেননি। এ একটা মারাত্মক অবিবেচনা–তাই না? বলুন!

কর্নেল চাপা হেসে বললেন, শ্রীমতা পট্টনায়ক ও তার মেয়ের সামনে এ মন্তব্য করার সাহস আশা করি আপনার আছে, মাই ডিয়ার ডক্টর পট্টনায়ক!

পট্টনায়ক একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, রিয়্যালি কর্নেল, চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে অনেকে কিছু দেখতে পায় না। আশা করি আমার স্ত্রী কন্যার স্বাধীনতাবোধ এই ঘটনায় কিছু চোট খাবে। কল্যাণীকে সঙ্গে আনলে ভালই করতুম। যখন তখন সে একা পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গত সন্ধ্যায় বৃষ্টি না হলে ওকে আমরা দেখতে পেতুম ভাবছেন? আমার তো সব সময় ভয়, কখন কী ঘটে যায় নাকি। আজকাল সুশিক্ষিত বদমাশদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আমরা যাকে ক্রাইম বলি, তাই তাদের নাকি আর্ট অফ মর্ডান লিভিং! যতঃ সব!

কর্নেল বললেন, পায়ের ছাপটাপ কিছু লক্ষ করলেন?

না। সেনাপতির মাপজোক চুকে যাক। তারপর দেখব। ডাঃ পট্টনায়ক কিটব্যাগ থেকে প্লাস্টার ছাঁচ তৈরির উপকরণগুলি বের করতে ব্যস্ত হলেন। তারপর ক্যামেরার মুখে একটা বাড়তি লেন্স পরালেন। ফের বললেন, বাজে কেস। রাজ্যের মেয়ে একাদোকা ঘুরে বেড়ায় সন্ধ্যার দিকে। রাতঅব্দিও কেউ কেউ সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে থাকে। তার ওপর মদ্যপান..ওঃ, হেল অফ ইট! আপনি দেখবেন, এই মেয়েটির পাকস্থলীতে একগাদা অ্যালকোহল বজবজ করছে।

মর্গে আমি যাচ্ছি না। বলে কর্নেল লাসটার দিকে এগোলেন।

তখন মাপজোক সেরে জিপের ইঞ্জিনের বনেটে একটা খাতা ফেলে সেনাপতি ৬বি পেন্সিলটা জোর লড়িয়ে দিয়েছেন। ডাঃ পট্টনায়ককে পাশে দেখে বললেন, আমার কাজ শেষ স্যার। আপনি এখন যেতে পারেন। ছাপটাপ কিছু তো দেখলুম না–যা ঘাস!

সেনাপতি লিখছিলেন : আজ বাইশ জুলাই ভোর ছটা তের মিনিটে কলকাতার প্রখ্যাত অপরাধ-বিজ্ঞানী কর্নেল এন সরকারের ফোন পাই। তিনি জানান, স্থানীয় অবজারভেটরি থেকে ফোন করছেন। পানিগ্রাহী ফার্মে একটা মেয়ের লাশ পড়ে আছে নাকি। তিনি ওই ফার্মের ট্রাকটার চালক শ্ৰীগোপালকিশোর দাসের কাছে খবরটা জেনেছেন বলেন। তিনি আরও বলেন, বিশিষ্ট ফোরেনসিক-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সীতানাথ পট্টনায়ক এখন চন্দনপুর-অন-সী-তে নিজের বাড়িতে রয়েছেন–তাঁকে যেন সঙ্গে নিই। তাই তাঁকে এবং থানায় বেশি কনস্টেবল না থাকায় রামদুলাল তেওয়ারী আর অজিত মহাপাত্রকে নিয়ে অকুস্থলে চলে আসি। ফার্মের ধানী জমিতে লাশটা দেখতে পাই। লাশটার ত্রিশ মিটার দূরে দক্ষিণে একটা ট্রাকটার জমি চষতে চষতে এসে থমকে দাঁড়ায়, তার প্রমাণ পিছনে টাটকা চাষের চিহ্ন। জমিতে ধান নেই–ঘাস ও আগাছা রয়েছে। চারদিকে উঁচু আল আছে। জমিটার পরিমাণ, গোপালকিশোর বলেছে, নয় একর। জমিটার সীমানা : উত্তরে গোলাপ বাগিচা, পুবে সাত মিটার চওড়া প্রাইভেট রাস্তা, দক্ষিণে কর্মচারীদের বসবাসের ঘর, গোডাউন, যন্ত্রপাতি রাখার জায়গা, পশ্চিমে ভুট্টাক্ষেত। লাশটা রয়েছে জমির উত্তর পূর্ব কোণার দিকে। স্থায়ী সীমানাচিহ্ন উঁচু আল থেকে আনুমানিক দুমিটার এবং স্থায়ী সীমানা-চিহ্ন পূর্বে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে আনুঃ পাঁচ মিটার দূরে। লাশটার মাথা পশ্চিমে, পা পূর্বে রয়েছে। এবং লাশটা উত্তর দিকে কাত হয়ে আছে। বাঁ হাত শরীরের নিচে চাপা পড়েছে, ডান হাত ৯০ ডিগ্রী কোণ করে কোমর থেকে হাফ মিটার দক্ষিণে লম্বালম্বি ছড়ানো–তালু চিৎ। লাশটার নিচে ঘন ঘাস আছে। লাশের সেক্স স্ত্রী। বয়স আনুমানিক কুড়ি থেকে বাইশ। রঙ-আনুঃ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। পরনে ক্রিমরঙা আঁটো নাইলন স্ন্যাকস, গায়ে হলদে খদ্দরের হাফপাঞ্জাবি কালো বাটিকের কাজ করা। চুল ববছাট। কোনও গয়না নেই। প্রকাশ্য হাত অর্থাৎ ডান হাতের কবজিতে চওড়া বাদামী ব্যাণ্ডে মোটা ঘড়ি রয়েছে(কোম্পানীর নাম : এভালান্স, অ্যামেরিকার তৈরি নং ২২৮৭৯৪ এ)। সিঁথিতে সিন্দুর-চিহ্ন নেই। ডান পায়ে স্লিপার দুফিতের–পরা অবস্থায় রয়েছে। ফিতের রঙ লাল, আনুঃ তিন সে.মি. চওড়া। বাঁ পা খালি। বাঁ পা থেকে পঞ্চাশ সে.মি. দূরে সরাসরি উত্তর দিকে এবং স্থায়ী উত্তর সীমানাচিহ্নের এক মিটার দূরে আরেকটি অবিকল একই গড়নের একটি স্লিপার পড়ে রয়েছে। চিৎ হয়ে আছে সেটা। লাশটার মাথা পা অব্দি আনুঃ মাপ দেড় মিটার। ক্ষত চিহ্ন : পিঠে-হার্টের উল্টোদিকে। জমাট থলথলে রক্ত রয়েছে। কিছু নিচেই ঘাসে পড়েছে। তাছাড়া আশেপাশে কোথাও রক্তের চিহ্ন দেখি না। ফার্মের কেউ মৃত তরুণীকে চেনে না বা দেখেনি। আশে-পাশে খুঁজে মার্ডার উইপন বলা যেতে পারে এমন কিছু পাওয়া গেল না। প্রাথমিক বিবরণ মোটামুটি এই। তদন্ত সাপেক্ষ।…

মাঝে মাঝে মুখ তুলে ও পেন্সিল কামড়ে ভাবছিলেন আর লিখছিলেন সেনাপতি। এই যথেষ্ট আপাতত। এবার কয়েকজনের সাক্ষ্য লিখতে হবে। তাদের সই করাতে হবে। লিখলেন : গোপালকিশোরের বিবরণ। তারপর তাকে ডাকলেন… এই যে গোপাল, এবার বলো। কীভাবে লাশটা তোমার চোখে পড়ল?

গোপালকিশোরের বলা শেষ হলে সেনাপতি তার সই নিলেন। তারপর কর্নেলের কাছে গিয়ে সবিনয়ে জানালেন, আপনার স্টোরিটা স্যার…

কর্নেল বললেন, অবশ্যই।…

তখন ডাঃ পট্টনায়ক লাশের ডানহাতের আঙুলের ছাপ নিতে ব্যস্ত। পরে সতর্কভাবে চারপাশের ঘাস আর আগাছায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ঘোরাঘুরি করলেন। না–কোনও রক্তচিহ্ন নেই, কোনও পায়ের ছাপও নেই। সূত্র বলা যায়, এমন কোনও জিনিসও চোখে পড়ল না তার। কোনও সিগারেটের টুকরো বা পোড়া দেশলাই কিংবা কোনও রুমাল। অবশেষে অস্ফুট মন্তব্য করলেন, সাধারণ খুন! সম্ভবত রেপের পর মার্ডার–আগেই অনুমান করেছি।

সেনাপতি ফার্মের অন্যান্য লোকজনের প্রাথমিক সাক্ষ্য নিচ্ছেন। কর্নেল ডাক্তারের কাছে এসে বললেন, মিঃ পট্টনায়ক, দেখাশোনা শেষ হলো?

যথেষ্ট। বলে পট্টনায়ক হাঁফ ফেলার ভঙ্গিতে কাঁধে ঝোলানো জিনিসপত্রসুদ্ধ একটি আড়মোড়া দিলেন।

কতক্ষণ আগে মারা গেছে, মনে হলো আপনার?

পট্টনায়ক হাসলেন।…দ্যাটস এ ডিফিকাল্ট কোয়েশ্চেন কর্নেল। ঠিকমতো মড়া না ঘেঁটে..।

আপনার অনুমানের ক্ষমতা অসাধারণ বলেই জানতুম।..কর্নেল সপ্রশংস স্বরে বললেন।…রাইগর মরটিস শুরু হয়েছে নিশ্চয়?

আমার অনুমানের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব–অন্তত দশ থেকে এগারো ঘন্টা আগে মেয়েটি মারা গেছে। আপাতদৃষ্টে ইনস্ট্যান্ট ডেথ–আঘাতের সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয়েছে বলতে পারি। অবশ্য, দেয়ার আর আদার ফ্যাক্টরস।

তাহলে আপনার অনুমান অনুসারে রাত নটা থেকে দশটার মাঝামাঝি খুনের, সময়টা দাঁড়ায়। কী বলেন?

সঠিক সময় বলা কঠিন। তবে ওই সময়ের মাঝামাঝি অথবা কিছু পরেও হতে পারে।

বৃষ্টি শুরু হয় বিকেল সাড়ে ছটায়। থামে–আমার হিসেব মতে, রাত দুটোর কাছাকাছি। আমি একটা বই পড়ছিলুম। বৃষ্টি ছাড়ার পর ঘুমিয়ে পড়ি। তাহলে লাশের অবস্থা দেখে আপনার কি মনে হয় যে রাত নটা-দশটা বা তারপর থেকে বাকি বৃষ্টিটা লাশের ওপর পড়েছে?

বাধা দিয়ে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, দ্যাট ডিপেণ্ডস। প্রথমত, যা বুঝলুম– খুনটা এখানে করা হয়নি। অন্য কোথাও খুন করার পর লাশটা এখানে এনে ফেলা হয়েছে। কারণ ঘাসে বা জমিতে কোথাও ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। লাশের নিচে নরম মাটি চাপে বসে গেছে কিছুটা। তার মানে-ভারি কিছু পড়লে যা হয়। অর্থাৎ লাসটা বয়ে এনে ফেলেছে খুনী। কখন ফেলেছে প্রশ্ন হলে অবশ্য চোখ বুজে বলতে পারব যে আপনার কথামতো রাতে বৃষ্টি থামবার আগেই সেটা ঘটেছে। লাশের ওপর বৃষ্টি পড়ার লক্ষণ খুব স্পষ্ট।

কর্নেল বললেন, তা যদি হয়-তাহলে লাশ বয়ে আনার পথে রক্ত ধুয়ে পড়বেই। কোথাও-না-কোথাও দু-একফোঁটাও আমরা দেখতে পাব। কারণ বৃষ্টির জল গড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এ মাটিতে ওঠে না।

ঠিক বলেছেন। ডাঃ পট্টনায়ক লাফিয়ে উঠলেন।…চলুন, আরও ভালভাবে দেখতে দেখতে কিছু দূরের মাটি পরীক্ষা করা যাক।

করেছি। কিন্তু চারদিকে ফার্মের এলাকায় অন্তত কোথাও তেমন রক্তচিহ্ন আমি দেখিনি।

সে কী! তাহলে লাশটা শূন্য থেকে এখানে গজালো নাকি? অদ্ভুত তো!

রিপিট করি। এখানেই খুন হলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকতই-দৌড়ানোর চিহ্ন থাকত?

নিশ্চয়ই।

বৃষ্টির মধ্যেই কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে?

অবশ্য, অবশ্য।

বৃষ্টির মধ্যেই লাশটা এনে ফেলা হয়েছে?

দ্যাটস রাইট।

কিন্তু কোথাও বৃষ্টি-ধোওয়া রক্তের চিহ্ন নেই মাটিতে। কোনও পায়ের দাগ নেই।

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, যদি লাশটাকে ছাতার আড়ালে বয়ে আনা হয়– তাহলে…

কর্নেল হেসে বললেন, সম্ভব। তাহলে বলতে হয়, ছাতা ধরে একা লাশ বয়ে আনার মতো হারকিউলিসই এর হত্যাকারী!

কেন? একাধিক লোক থাকতে পারে বয়ে আনার সময়।

কিন্তু তাদের পায়ের চিহ্ন কোথায় গেল?

মাটিতে বেশি বালি থাকায় ধুয়ে গেছে।

লাশটা ভারি স্বাস্থ্যবতী মোটাসোটা মেয়ের লাশ। নরম বালিমেশানো মাটিতে পা বসে যাবেই।

ব্যাপারটা তাই বটে। ডাঃ পট্টনায়কের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।

কর্নেল একটু কেশে বললেন, আশা করি, ডাঃ পট্টনায়ক জমিতে মানুষের পায়ের দাগ না দেখলেও বিজন্তুর পায়ের দাগ লক্ষ করেছেন?

হ্যাঁ–তা করেছি। ক্ষেতে গরু চরার চিহ্ন স্পষ্ট। ঘাস পরীক্ষা করেও সেটা বোঝা গেছে।

খুরের দাগগুলো এখানে আসার পর আমি দেখতে পাই। গোপাল বলেছে, প্রায়ই বেড়া গলিয়ে বাইরের গরু ঢুকে পড়ে। কাজেই, বৃষ্টির মধ্যে কোনও গরু অবশ্য মোষও হতে পারে, এই ক্ষেতে ঢুকেছিল। লাশের কাছেও ওই রকম চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু আমরা কেউ তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিনে কারণ, ক্ষেতে বা মাটিতে ওটা খুবই স্বাভাবিক চিহ্ন। ডাঃ পট্টনায়ক, একবার ফের লাশটার কাছে যাই, চলুন।

একটু পরিহাসের ভঙ্গিতে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, গরু-মোষ ইত্যাদি শৃঙ্গধারী জীবের পক্ষে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড অবশ্য অসম্ভব নয়। তাড়া করার সময় পিঠে শিঙ বিঁধিয়ে মাটিতে আছাড় দিলেও দিতে পারে।

কর্নেল পরিহাসে সাড়া দিলেন না। বললেন, বিয়্যালি। অন্তত একটি কেসের বেলায় তাই সাব্যস্ত করা হয়েছিল মনে পড়ছে। বর্ধমানে এক ডেয়ারিতে পর-পর দুজন মারা পড়ে–দুজনেই একই রাতে। একটা নতুন ভাল জাতের ষাঁড় কেনা হয়েছিল সদ্য। ষাঁড়ের শিঙে রক্তের দাগ ছিল। ভারি অদ্ভুত কেস বলব।

পট্টনায়ক উৎসাহী হয়ে বললেন, অদ্ভুত কেন? যাঁড়ের গুঁতোয় বিস্তর মানুষ মরতে দেখেছি।

বলছি। আগে ব্যাপারটা ভাবুন। মাঠের মধ্যে নির্জন একটা ডেয়ারি। অবশ্য পাসেই একটা হাইওয়ে রয়েছে। ষাঁড়টা একটা বেড়াদেওয়া ফাঁকা জায়গায় বাঁধা ছিল। তার পাশেই নাগালের মধ্যে ছিল একটা খড়ের গাদা। সে দড়ি ছিঁড়ে প্রথম নম্বর শিকারের ওপর চড়াও হয়। খড়ের গাদায় ঠেসে ধরে। লোকটার হার্টে শিঙ ঢুকে যায়। দ্বিতীয় নম্বরের বেলাতেও একই পরিণতি ঘটে। মর্গের রিপোর্টে বলা হয়, তিন ইঞ্চি মোটা কোনও সূচলো কিছুর আঘাতে মৃত্যু ঘটেছে। মার্ডার উইপন হিসেবে ষাঁড়ের রক্তমাথা শিঙটাকে সাব্যস্ত করা হয়। দ্বিতীয় মত্যুর কারণও একই। যাঁড়ের ডান শিঙে রক্ত ছিল। এমন সময় দৈবাৎ ওখানেই আমার গাড়ি বিগড়ে আটকা পড়লুম। তারপর, বুঝতেই পারছেন, চেঁকির পক্ষে ধানভাবনা ছাড়া রেহাই নেই। আমার প্রশ্ন অফিসারদের চমকে দিল। ষাঁড় দুবার দুজন মানুষকে মারবার জন্য আলাদা-আলাদা শিঙ ব্যবহার করে কি না।

ডাঃ পট্টনায়ক হাসতে হাসতে বললেন, ওয়াণ্ডারফুল!

খড়ের গাদার তলা থেকে সত্যিকার মাৰ্ডর উইপন বেরোল। একটা লোহার গোঁজ সেটা। দুষ্ট প্রকৃতির গরু-মোষ বাঁধা হয় তা দিয়ে।

তারপর?

কর্নেল জবাব না দিয়ে জমিতে গিয়ে নামলেন। পট্টনায়ক তার পিছোনে এগোলেন। তারপর হাতের সেই অদ্ভুত কাঁচটা মাটির কাছাকাছি ধরে জানোয়ারের পায়ের দাগগুলো পরীক্ষা করতে থাকলেন। কর্নেল বললেন, অনেকক্ষণ থেকে আপনার হাতে ওই জিনিসটা লক্ষ করছি। নতুন কোনও ফোরেনসিক যন্ত্র বেরিয়েছে বুঝি?

ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমারই উদ্ভাবনী ক্ষমতার নমুনা এটা। আতশ কাঁচই বলতে পারেন। তবে এর আণুবীক্ষণিক বৈশিষ্ট্য অসাধারণ। নিজে তৈরি করে নিয়েছি।

কর্নেল হাত বাড়িয়ে বললেন, একবার দেখি আপনার যন্ত্রটা।

যন্ত্র বলতে যা বোঝায়, এটা তা নয়। জাস্ট এ মালটিরিফ্লেকটর গ্ল্যাস। বলে পট্টনায়ক হাতলওয়ালা জিনিসটা কর্নেলকে দিলেন।

কর্নেল লাশের পিঠের দিকে একটু তফাতে প্রথমে ঘাসের পাতা, তারপর একহাতে ঘাস সরিয়ে ক্ষেতের তলা উদোম করলেন। দেখতে দেখতে বললেন, বেলে ধরনের মাটির একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। দেখে যান মিঃ পট্টনায়ক! এইসব মাটিতে অজস্র লালচে ছিটে দেখতে পাওয়া যায়। আপনার রিফ্লেকটরে ছিটেগুলো এক সেন্টিমিটার চওড়া দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করছেন?

পট্টনায়ক দেখে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ–অনেক আগেই লক্ষ্য করেছি। গুচ্ছ গুচ্ছ লাল দানা রাখা বেলেমাটির স্বভাব। ওই দেখুন, কোথাও কত বেশি চওড়া দেখা যাচ্ছে দানাগুলো। জাস্ট অ্যান ইচ্ছ।

কর্নেল লাল মোটা গুচ্ছটার ওপর রিফ্লেকটর স্থির রেখে বললেন, শুধু বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতে এমন থাকে না, এঁটেল মাটিতেও বিস্তর লাল ছিটে দেখা যায়। একবার এক গ্রামের বিলের ধারে নাবাল জমিতে লাশ পোঁতা ছিল একটা। বিজ্ঞ অফিসারটির কোনও তুলনা হয় না–তিনি কাছাকাছি জায়গার মাটি থেকে…বাই জোভ! বলে হঠাৎ মুখ তুলে একটু হাসলেন।…ডাঃ পট্টনায়ক, আমরাও অনায়াসে সেই আদিম ও শ্রমসাপেক্ষ পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারি।

পট্টনায়ক কপালের ঘাম মুছে বললেন, তাহলে তো পুরো ন একর জমি ( খুঁটে-খুঁটে লাল দানাগুলো তুলে নিতে হয়। দ্যাটস এ বিগ জব–খাটুনি ভীমস্য!

কর্নেল বললেন, আপাতত একটা ইঁদুরের খাটুনি খাটা যেতে পারে। আপনার কাছে প্ল্যাস্টিক পেপার আছে?

অবশ্যই।

তাহলে এই সবচেয়ে মোটা দানাগুলো–অন্তত ট্রাকটারের চাকা অব্দি জায়গায় যতগুলো সম্ভব তুলে নিই।

তারপর?

তারপর আপনি আপনার টেবিলের সামনে গিয়ে বসবেন। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করবেন।

নিশ্চয়–তাতে আমি পিছপা নই।

ছুরি পেলে ভাল হতো একটা।

নিন–সবই আছে। বলে কিটব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করলেন ডাক্তার। এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখলেন কর্নেল রিফ্লেকটারটা একখানে ধরে কী দেখছেন।…কী? সত্যিকার রক্ত নাকি?

না–একটা গর্ত।

খুরের দাগ ছাড়া আর কী হবে?

এটা আরও গভীর মনে হচ্ছে, মিঃ পট্টনায়ক। বলে কর্নেল লাশটার পিঠের দিকে রিফ্লেকটারটা নিয়ে গেলেন। তারপর একেবারে পা বরাবর থামলেন। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল হঠাৎ। চোখে বিস্ময় ফুটল।–কী কাণ্ড! এদিকেও একই সাইজের একটা গর্ত। একটা মাত্র খুর দেবে বসবে–এবং দু জায়গায়? বলে তিনি আগের গর্তটা থেকে ছুরি দিয়ে দ্বিতীয় গর্ত অব্দি একটা সরলরেখা টানলেন।

ডাঃ পট্টনায়ক অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলেন। বললেন, কী হলো?

এই সরলরেখাটা লাশের সমান্তরাল?

তাতে কী প্রমাণ হয়?

কিছু প্রমাণ হওয়া নির্ভর করছে আপনার বিশেষজ্ঞ কার্যকলাপের ওপর। ডাঃ পট্টনায়ক, এই গর্ত দুটোর ছাপ নেওয়ার ব্যবস্থা করুন। আর নিন দু একটা সাধারণ খুরের যে ছাপগুলো দেখছি, তার থেকে। আমি ততক্ষণ লাল দাগগুলো তুলে ফেলি।

কর্নেল তাই করতে ব্যস্ত হলেন। পট্টনায়ক ক্যামেরার লেন্স খুলে আরেকটা অদ্ভুত গড়নের লেন্স পরালেন। তারপর গর্ত দুটর ছবি তুললেন।

কয়েক মিনিট পরে দুজনে উঠে গেলেন সেনাপতির কাছে। সেনাপতি তখনও জাবেদা খাতায় কী সব টুকছেন। কর্নেল বললেন, জিগ্যেসপত্তর শেষ হলো মিঃ সেনাপতি?

হ্যাঁ স্যার।

তেমন কোনও বিশেষ ইয়ে পেলেন-টেলেন নাকি?

মালী হাসিরাম বলছিল, রাতে বৃষ্টির মধ্যে ওই বাংলোতে আলো দেখেছে, তারপর….

হ্যাঁ। আমাকেও বলেছে।

এখানে ওই বাংলো-ভূতের গল্প বেশ চালু আছে। বলে সেনাপতি হেসে উঠলেন।

আর কেউ ভূত দেখেছে বলেনি?

ভোমরলাল বলছিল, বৃষ্টির সময় ধুপ ধুপ শব্দ শুনেছে! বোঝা যায়–এ উদ্ভট ব্যাপার। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়া দিচ্ছিল রাত্রে। তাছাড়া লোকটা প্রচণ্ড গাঁজা টানে।

আর কিছু?

বুধন সিং বলল যে রাতে তার ঘুম হয়নি, টাট্টি পেয়েছিল। তখন অন্ধকারে কাছাকাছি কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সে হরিধ্বনি শুনেছে।

অত রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে?

সেটাই পিকিউলিয়ার। তবে ও স্বীকার করেছে, তার কানের ভুল হতে পারে।

এবার কী করবেন মিঃ সেনাপতি?

সেনাপতি উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, রুটিন ওয়ার্কস ছাড়া আপাতত কী করা যাবে বুঝতে পারছিনে। মড়াটা তুলে মোহনপুর মর্গে পাঠাতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স আনবার জন্য ট্রাঙ্ককল করতে পাঠিয়েছি অজিতকে। তার আগে লাশটা সনাক্ত করতে হবে। সেটাই জরুরী এখন। লোকালিটিতে খবর পাঠানো হয়েছে। সব হোটেলেও খবর গেছে। তেওয়ারীকে দায়িত্ব দিয়েছি। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। তবে সবচেয়ে মুসকিল কী জানেন? পানিগ্রাহী সায়েবের ফার্মে লাশটা ফেলে খুনী আমাদের খাটুনি বাড়িয়েছে। তিনি পলিটিসিয়ান ভীষণ প্রভাবশালী লোক। এ খুনের হেস্তনেস্ত না করলে বিধানসভা থেকে লোকসভাঅব্দি হইচই লাগিয়ে দেবেন।

ডাক্তার পট্টনায়ক একটু হেসে বললেন, ঠিকই। বিশেষ করে ভদ্রলোকের মহিলাদের প্রতি আগ্রহ প্রচুর। তরুণী ও সুন্দরী হলে তো কথাই নেই। এই হচ্ছে ওঁর চরম ভাইটাল পয়েন্ট।

সেনাপতি বললেন, দুর্বল পয়েন্ট বলুন, স্যার।

রোদ বেড়েছে ইতিমধ্যে। আকাশের আজ সাজগোজ করার ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না। কৌপিনপরা সন্ন্যাসীর মতো ছাইমাখা গায়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। ইউক্যালিপটাস গাছের পাতাগুলো বাতাসের টানে মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে চমকে ওঠা গরুর পালের মতো কান খাড়া করছে আর নামাচ্ছে। একজন-দুজন করে। লোক আসতে দেখা যাচ্ছিল। ভিড়ের অবস্থা কী হবে আঁচ করা যায়। ছোট্ট টাউনশিপ ইতিমধ্যে ছটফট করতে শুরু করেছে।

লোকজনের আসা লক্ষ করে ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো সেনাপতি, লাশ এক্ষুণি সনাক্ত হয়ে যাবে। হোটেলের লোকগুলো আসবার অপেক্ষা শুধু।

সেনাপতি সাহস পেয়ে বললেন, তাই আশা করছি। সনাক্ত হলেই খুনের মোটিভ বের করতে আমার দেরি হবে না। আর মোটিভ বেরোলেই খুনীর পাত্তা পাব।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, রাইট! রোগ কী জানতে পারলেই আরোগ্যের বাড়া সেটা। কী বলেন মিঃ পট্টনায়ক? আপনারা ডাক্তাররা তো তাই বলেন? ডায়গোনেসিস ইজ বেটার দ্যান কিওর কী না?

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, অবশ্যই। কর্নেল, এবার কিন্তু আমি কেটে পড়তে চাই। ভিড় দেখলে আমার হাঁফ ধরে যায়। চলুন, এগোই।

কর্নেল বললেন, আমারও। ইয়ে–মিঃ সেনাপতি, আমরা যদি এখন ফার্মের কাউকে নিয়ে ওই বাংলোটা দেখতে যাই, আপনার কোনও আপত্তি আছে– মানে, আইদার অফিসিয়াল অর পারসোনাল?

নেভার। যান না স্যার, দেখে আসুন। বরং আপনাদের মতো দুজন জায়ান্ট হ্যাঁণ্ড পাশে পেয়ে আমি কী বোধ করছি, বোঝাতে পারব না। এই ভোমরলাল! ইধার আও। সায়েবদের বাংলো দেখিয়ে আনে। চাবি কোথায়?

— ভোমরলাল জানাল, চাবি হাসিরামের কাছে। তখন হাসিরামকে হুকুম করা হলো। হাসিরাম কর্নেল ও ডাক্তারের আগে আগে ধুকুর ধুকুর দৌড়ল।

.

বাঁদিকে গোলাপক্ষেত। একটু বিবর্ণ দেখাচ্ছে। পোকা লেগেছে সম্ভবত। কর্নেল বললেন, দিল্লীর কুতুবমিনারের পাশে যে গ্রামটা আছে–মেহেরৌলি। একবার এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে সেই গ্রামের মাঠে-মাঠে এলোমেলো ঘুরেছিলুম। ওখানেই শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কিছু জমি আছে। তাই নিয়ে সেবার খুব বিতর্ক উঠেছিল। যাই হোক, সেই বিতর্কিত জমি দেখবার আগ্রহ আমার ছিল না। আমি অজস্র গোলাপক্ষেত দেখে আনন্দ কুড়োচ্ছিলুম। এক জায়গায় গোলাপক্ষেতে ময়ূর হেঁটে গেল। ভাবতে পারেন, সে কী হৃদয়গ্রাহী ঘটনা!

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, কর্নেল! ভাববেন না–এখানেও ময়ূর বাস করে। ওই সরকারী অরণ্যে।

হঠাৎ কর্নেল হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে হাসিরামের কাধ ধরে ফেললেন। ডাক্তার অবাক। হাসিরাম ঘাবড়ে গিয়ে শ্লেটে বাচ্চাদের আঁকা মূর্তির মতো সর্বাঙ্গে করুণ হয়ে পড়েছে। পট্টনায়ক দৌড়ে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, কী ব্যাপার?

কর্নেল হাসছিলেন।…কিছু না। হাসিরাম এবার আমাদের পিছনে থাকবে। কারণ কোনও বিশেষ চিহ্ন তার পায়ের তলায় ধ্বংস হোক, এটা বাঞ্ছনীয় নয়। এর পায়ের পাতা হাঁসের মতো চওড়া–লক্ষ করছেন? হাসিরাম, তুমি খুশি হবে কি না জানিনে, তুমি নির্ঘাৎ এই সমুদ্রে ছিলে পূর্বজন্মে।

হাসিরাম আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ছিলুম বই কি স্যার। সেজন্যেই তো ভয়ে ঘুমোতে পারিনে। যেই তন্দ্রামতো আসে, মনে হয় সমুদ্রের তলায় চলে গেছি–দম বন্ধ হয়ে যায় স্যার।

কর্নেল ওর হাত থেকে চাবির গোছাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, পেছন পেছন এস।

সে ঠিক তাই করতে লাগল। পথটা একটা গেট পেরিয়ে আরেকটা পথে এসে মিশেছে, গেট খুলে বেরতে হলো। টিলার ঢালু গায়ে তেমাথা সৃষ্টি হয়েছে একটা। একটু চড়াই ভাঙতে হলো। পিচ-চটা রাস্তাটা সংকীর্ণ। একটু পরেই রাস্তার পিচ হঠাৎ শেষ হলো। কাঁচা রাস্তা–দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছ আর ঝোপঝাড়। বাঁদিকে ঘুরে আন্দাজ বিশ মিটার দূরে বাংলোর গেটে শেষ হয়েছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, ডানহাতি রাস্তাটা কোত্থেকে এসেছে হাসিরাম?

হাসিরাম জবাব দিল, ওটা ফার্মের বাইরের রাস্তা স্যার। সরকারী জায়গা। ফরেস্ট বাংলোর নিচে দিয়ে চলে গেছে। একেবারে জঙ্গলে ঢুকেছে–তারপর চন্দনপুর বালেশ্বর রোডে মিশেছে।

কর্নেল কাঁচা রাস্তাটা তীক্ষ্ণদৃষ্টে লক্ষ্য করে বললেন, হুম! ডাঃ পট্টনায়ক!

বলুন কর্নেল।

এই টিলাটাও বেলে মাটিতে ভরতি। আবার জায়গায় জায়গায় বালিও যথেষ্ট দেখছি–ঘাস গজাতে পারেনি। কিন্তু..কী কাণ্ড!

কী, কী?

মোটর গাড়ির চাকার দাগ।

তাই তো বটে!

দুজনে হেঁটমুণ্ডে গেট অব্দি ঘুরে-ঘুরে দাগগুলো পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন। হাসিরাম একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।

কর্নেল বললেন, গাড়িটা গেট অব্দি এসে ফিরে গেছে বোঝা যাচ্ছে। হুম, এখানে ঘোরানো হয়েছে। তাহলে…তাহলে এটা হচ্ছে সামনের ডান চাকা। কী বলেন?

হ্যাঁ–তাই মনে হচ্ছে।

কিন্তু দেখুন, বা চাকার দাগ একরকম–ডান চাকার আরেকরকম?

অ্যাঁ? সে কী? ডাঃ পট্টনায়ক চমকে উঠলেন।

হ্যাঁ। আর সব দাগই একরকম। একটা করে সোজা রেখা, আর দুদিকে টানা দুসার ত্রিকোণ, মধ্যের ত্রিকোণটা বড়। কিন্তু সামনের ডান চাকার মধ্যের নকশাটা চারকোণা, টানা রেখার বদলে ফুটকি রয়েছে। আর খাজগুলো বেশ চওড়া। হুম! ডাক্তার পট্টনায়ক! এই চাকাটা নতুন কেনা হয়েছে বাকি তিনটে পুরনো। আপনি কি ছবি নেবেন অনুগ্রহ করে?

পট্টনায়ক ক্যামেরা নিয়ে বললেন, নিচ্ছি। কিন্তু কেসের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন কি? মিছেমিছি ছবি নেওয়ার চেয়ে সিওর হওয়া ভাল– তাই না?

সেই সময় হাসিরাম বলল, ফরেস্টে বেড়াতে অনেকে গাড়ি নিয়েই আসে স্যার। পাহাড়ের এদিকটা বেশ ঢালু কি না–আর রাস্তাও রয়েছে।

পট্টনায়ক বললেন, ঠিক তাই। সেজন্যেই এ অব্দি এসে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছে কেউ। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে অত রাত্রে গাড়ি কে আনল?

কর্নেল বললেন, ছেড়ে দিন। টায়ারের নকশা আমার মনে থাকবে। ছবি নেবার দরকার নেই।

ক্লান্ত পট্টনায়ক একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।…হ্যাঁ, ফিল্মও ফুরিয়ে গেছে দেখছি।

গেট খুলে ছোট্ট ফুলবাগিচা পেরিয়ে বারান্দায় উঠলেন ওঁরা। তারপর কর্নেল তালাটা পরীক্ষা করে খুললেন। একটা জানালার খড়খড়ি ভোলা রয়েছে দেখা গেল। কর্নেল বললেন, খড়খড়ি কি বরাবর তোলা ছিল হাসিরাম?

হ্যাঁ স্যার। সায়েবের আজকালের মধ্যেই আসার কথা। তাই সাফ করে গেছি কাল বিকেলে। ঘরে দেখছেন ভেন্দিলেটার নেই। তাই সায়েবের হুকুম আছে…

মি? পট্টনায়ক, একরকম গন্ধ পাচ্ছেন কি?

পাচ্ছি।

কিসের বলুন তো?

কসমেটিকসের মনে হচ্ছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক মিঃ পানিগ্রাহীর বাংলোয়? বলে একটু হাসলেন পট্টনায়ক।

জানালাগুলো খুলে দাও তো হাসিরাম।

হাসিরাম জানালাগুলো সব খুলে দিলে ঘরটা আলোয় ভরে গেল। এককোণে একটা চমৎকার সোফাসেট রয়েছে। দেয়ালে-দেয়ালে সুন্দর পেন্টিংস টাঙানো রয়েছে। একটা শোকেস ভরতি সুদৃশ্য দেশী-বিদেশী পুতুল। বুকশেলফে কিছু বই ও ম্যাগাজিন। কোণের সোফাসেটের দিকে এগোতে গিয়ে কর্নেল হাঁটু দুমড়ে বসলেন হঠাৎ….ডাঃ পট্টনায়ক, এ-ঘরে গতরাত্রে লোক ছিল! বলে তিনি আঙুল দিয়ে একটা কী দেখালেন।

পট্টনায়ক সেটা দেখতে পেয়ে বললেন, সিগারেটের টুকরো?

কর্নেল বললেন, তিনটে পোড়া সিগারেটের টুকরো। মিঃ পট্টনায়ক। আমি একটা পোড়া দেশলাই কাঠি পেয়েছি। আসুন, ভাল করে খুঁজি। তিনটে সিগারেট যখনতখন আরও দেশলাই কাঠি পাবার আশা আছে। ইয়ে-হাসিরাম, তোমার সায়েব সিগারেট খান না নিশ্চয়?

না স্যার।

তাই অ্যাশট্রে দেখছিনে কোথাও?

পট্টনায়ক বললেন, কী মুসকিল! তা বলে অতিথিদের জন্য অ্যাশট্রে রাখবেন না-কি?

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, এ বাংলোয় কোনও অতিথিকে আপ্যায়িত করেন মিঃ পানিগ্রাহী-তাই না হাসিরাম? অবশ্য তার প্রেমিকারা সিগারেট খান কি না জানিনে।

হাসিরাম সায় দিয়ে বলল, এ তার প্রাইভেট বাংলো স্যার। আমি ছাড়া এখানে কারো আসার হুকুম নেই। কেউ দেখা করতে এলে ওধারে ফার্মের গেটের কাছে আপিসে গিয়ে দেখা করেন।

পট্টনায়ক দেশলাই কাঠি খুঁজছিলেন। পেলেন না। বললেন, আশ্চর্য তো! আর কোথাও একটা কাঠির টুকরো নেই!

কর্নেল কাঠির টুকরো ও সিগারেটের নিটে পাফ পকেটে রেখে সোফার দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হলেন। বললেন, হাঁটুর নিচে সোফার গায়ে সিগারেট ঘষে নেভাবার চিহ্ন দেখছি। মিঃ পট্টনায়ক! আরেকটা সিগারেট পেলুম। এটা সবে ধরানো হয়েছিল কিন্তু ঘষটে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনও কারণে?

পট্টনায়ক বললেন, সিগারেটটায় ও কিসের দাগ।

লিপস্টিকের।

মাই গড! স্ত্রীলোক সিগারেট খাচ্ছিল?

এ থেকে ঠোঁটের ছাপ নিতে উৎসাহী হবেন নিশ্চয়?..কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কিছু ফ্যাক্টস এখানে তাহলে পাওয়া গেল। তার থেকে দাঁড়াচ্ছে : একটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রীলোক এখানে সিগারেট খাচ্ছিল এবং…

হাসিরাম বলে উঠল, স্যার এই দেখুন–মোমবাতি জ্বালিয়েছিল কেউ।

ডাঃ পট্টনায়ক, পুরুষটি চেইন-স্মোকার যাকে বলে। সে সিগারেটের আগুনে সিগারেট ধরাতে অভ্যস্ত। তাই আমরা একটামাত্র পোড়া দেশলাই কাঠি পেলুম। মহিলাটিকেও সে নিজের সিগারেট থেকে আগুন দেয়। মহিলাটি কয়েকটি টান দিতে সবে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ এমন কিছু ঘটে যে সে তক্ষুনি হাঁটুর কাছে বুঝতে পারছেন? টেবিল নয়–হাঁটুর কাছে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। তার একটাই অর্থ হয়। তার সিগারেট লুকোতে চেয়েছিল। তার থেকেও অর্থ খোঁজা যেতে পারে– এমন কেউ অভাবিতভাবে এসে পড়েছিল, যার সামনে সে সিগারেট খায় না। আপনি কী বলেন?

পট্টনায়ক বললেন, ওয়াণ্ডারফুল! কিন্তু খুনের সঙ্গে এসবের কি কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে?

হয়তো পারে–আবার নাও পারে। বলে কর্নেল অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা কিছু জানি না–অন্ধকারে ঘুরছি। কিন্তু আমার ধারণা যদি কারেক্ট হয়–অর্থাৎ খুনের অতীত গোপনে এখনও কাজ করে চলেছে, তাহলে..মাই গুডনেস! একটা সিগারেট-কেস! বলে টেবিলের তলা থেকে রুপোলি রঙের একটা সিগারেট-কেস দু আঙুলের কোণায় ধরে তুললেন।…কে টু এস!

.

০৫.

নীলরঙের বাসায় অসম্ভবের ছানা

কে টু এস! ডাঃ পট্টনায়কের মুখে প্রতিধ্বনিত হলো কর্নেলের বাক্যটি। তিনি যেন হতভম্ব হয়ে পড়লেন কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে। তারপর বললেন, কই দেখি, দেখি!

কর্নেল জানালার কাছে বেশি আলোয় সাবধানে সিগারেট-কেসের একটা কোণা ধরে বললেন, হ্যাঁকে টু এস খোদাই করা আছে। আঙুলের ছাপ নিশ্চয় পাওয়া যাবে এতে। থাক, এটা বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভাল।

পট্টনায়ক তার ব্যাগ থেকে মোড়ক বের করলেন।… কর্নেল, এখানেই আমি কাজটা সেরে ফেলতে চাই। এই টেবিলে ওটা রাখুন।

কর্নেল হাসলেন।…সব ব্যবস্থা নিখুঁত আপনার। বাঃ! তারপর কোণের টেবিলে সিগারেট-কেসটা রাখলেন।

পট্টনায়ক মোড়ক থেকে একটা সাদা পাউডার তুলে ছড়িয়ে দিলেন ওটার গায়ে। তারপর একটা সূচের মতো সরু জিনিস দিয়ে পাউডার ঝেড়ে ফেলতেই আবছা কিছু ছাপ ফুটে উঠল আঙুলের। ক্যামেরার লেন্স পাল্টে ও একটার পর একটা নতুন ফ্লাশবা জুড়ে চারটে ছবি তুললেন। তারপর বললেন, এবার ভেতরটা দেখা যাক!

কেস খুলে দেখা গেল পাঁচটা সিগারেট রয়েছে। কর্নেল দেখে বললেন, বিলিতী সিগারেট। খুব দামী ব্র্যাণ্ড। এখানে পাওয়া যায় নাকি?

পট্টনায়ক জবাব দিলেন, বলতে পারছিনে। আমি তো ও রসের রসিক নই। খোঁজ নিলেই জানা যাবে। তারপর ভিতরের দিকে একইভাবে পাউডার ছড়িয়ে ও মুছে আরও কিছু ছবি নিলেন। তখন কর্নেল মেঝেয় হাঁটু ভাঁজ করে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছেন।

কর্নেল বললেন, কাল রাতে বৃষ্টির সময় এ ঘরে আনাগোনার চিহ্ন প্রচুর। বালি আর কাদার টুকরো দেখতে পাচ্ছি। কার্পেটেও তা লক্ষ্য করেছি।

হাসিরাম মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার বলল, সায়েব এসে নির্ঘাৎ আমার চাকরি খাবেন, স্যার! দেখুন দিকি, কী সব করেছে ঘরের মধ্যে। আমি শুধু ভাবছি, ঢুকল কেমন করে? তালা তো ঠিকঠাক রয়েছে!

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বাইরে যাওয়ার আর দরজা নেই?

আছে। বেডরুমের দিকে। বলে হাসিরাম সেদিকে এগোল।

দুজনে ওকে অনুসরণ করলেন। বেডরুমের দরজাটা খোলা, ভারি পর্দা ঝুলছে। হলদে জমিনে বড়োবড়ো লাল ফুলের নকশা। কর্নেল বললেন, ঐ দরজাটা কি ভোলা থাকে?

হাসিরাম পর্দা তুলতে গিয়ে থেমে জবাব দিল, হ্যাঁ স্যার। তারপর ভিতরে ঢুকেই সে পিছিয়ে এল। তার মুখে প্রচণ্ড অতঙ্কের চিহ্ন। সে অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল, রক্ত স্যার, রক্ত!

কর্নেল প্রথমে ঢুকলেন, তারপর পট্টনায়ক। এ ঘরের জানালা বন্ধ। কিন্তু যেটুকু আলো আছে, তাতেই সব দেখা যাচ্ছিল। সারা মেঝে হলদে কার্পেটে মোড়া। এক পাশে বিছানার খাট রয়েছে। দরজার সামনা-সামনি কঁকা–অন্য পাশে সোফাসেট ও বই ভরতি সেলফ। ফাঁকা জায়গায় কার্পেটের ওপর চাপচাপ রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। বিছানার ওপর, দেয়ালে সবখানে রক্তের দাগ।

পট্টনায়ক বললেন, সর্বনাশ! এখানেই তাহলে খুন করা হয়েছে মেয়েটিকে!

হাসিরাম, জানালাগুলো খুলে দাও। কর্নেল শান্তভাবে বললেন।

হাসিরাম জানালা খুলে পর্দাগুলো সরাল। প্রচুর আলো এল ঘরে। দেখা গেল, বিছানাটায় রাত্রে কেউ শুয়েছিল।

কর্নেল দরজা খুলে বেরোলেন ওদিকে। চওড়া বারান্দা রয়েছে। টবে অজস্র গাছ রয়েছে। বারান্দায় কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ দেখা গেল। নিচে ছোট লনে নুড়ি বিছানো, দুধারে কেয়ারি করা লতার বেড়া আন্ধু ফুলগাছ। নুড়ি বিছানো পথটা ঘুরে বাংলোর পূর্বদিক হয়ে গেটে পৌঁছেছে। নুড়ির ওপর কোথাও রক্ত দেখা গেল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে নিশ্চয়। কর্নেল অস্ফুটস্বরে বললেন, রক্তের ছিটেলাগা বিছানায় শুয়ে রাত কাটায়, সে কে? এত নির্বিকার সে?

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, তাহলে মোটামুটি বোঝা গেল, খুনটা ওঘরে হয়েছে। তারপর এদিক দিয়ে লাশ বের করেছে খুনী। গেট পেরিয়ে আমরা যে-পথে এসেছি, সেই পথে নিয়ে গিয়ে ওই ধানের জমিতে ফেলেছে।

কর্নেল গেট ঘুরে ফের সেই সদর দরজায় গেলেন। তালাটা পরীক্ষা করে বললেন, মোমের দাগ দেখছি না। ছাপ নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানানোর চিহ্ন নেই।

হাসিরাম করুণ মুখে বলল, আমি কী করব স্যার? ঘরদোরের এ অবস্থা দেখে সায়েব ক্ষেপে যাবেন যে!

কর্নেল বললেন, হাসিরাম, কাল তুমি শেষবার কখন এখানে এসেছিলে?

বিকেলে, স্যার। বৃষ্টির আগে। সায়েব আসব আসব হয়ে আছেন। পথের দিকে চোখ রেখে আমরা কাটাচ্ছি। তাই সব ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে এসেছিলুম।

সব ঠিকঠাক দেখেছিলে?

হ্যাঁ স্যার।

তোমাদের সায়েব নিজের গাড়িতে না ট্রেনে আসেন বরাবর?

নিজের গাড়িতে।

বাংলোর ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় সায়েবের কাছে আছে?

আছে, স্যার।

তুমি এক কাজ করো। দরজার এ তালা-চাবি আমরা নেব। তুমি আর একটা মজবুত তালা এনে দরজা আটকাও।.বলেই কর্নেল একটু ভেবে নিলেন। ফের বললেন, …থাক। মিঃ সেনাপতি বরং সে-ব্যবস্থা করবেন। বাংলোটা আপাতত পুলিশের জিম্মায় থাকাই ভাল। ডাঃ পট্টনায়ক, আপনি প্লীজ–যদি কিছু মনে না করেন, সেনাপতিকে খবর দিন। আমি আর হাসিরাম ততক্ষণ এখানে রইলুম। এস হাসিরাম, আমরা বেডরুমের দিকের খিড়কির দরজাটা এঁটে দিই। তারপর গল্পগুজব করা যাক।

ডাঃ পট্টনায়ক চলে গেলেন। কর্নেল বাংলোর সদর দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাসিরাম মনমরা হয়ে বলল, আমার মাথা ঘুরছে স্যার, বমি বমি লাগছে। হাওয়ায় দুদণ্ড না বসলে আর পারব না।

কর্নেল ভাবলেন, হাসিরাম চাকরি যাবার ভয়ে ঘাবড়ে গেছে, বেচারা! সে বারান্দায় বসে পড়ল। কর্নেল ভিতরে ঢুকে ফের খুঁটিয়ে সবকিছু দেখতে থাকলেন। কিছু চোখ এড়িয়ে গেছে নাকি?

তারপর বেডরুমে ঢুকলেন। ওদিকের দরজাটা ভিতর থেকে এঁটে দিলেন। দরজার কপাটে খুনীর ছাপ থাকা সম্ভব। যাকগে, সে পরের ব্যাপার। বুকশেলফ দটোর কাছে গিয়ে দেখলেন, তালা বন্ধ রয়েছে। রাজনীতি, ফার্মিং, খেলাধুলো সংক্রান্ত নীরস বই সব। কোণের দিকে একটা টুলে একগাদা ইংরেজি পত্রিকা আছে। কর্নেল পত্রিকাগুলো উল্টে চললেন। একটু পরেই তার অবাক লাগল নিজের আচরণ। পত্রিকাগুলো এভাবে নিজের অজান্তে কেন হাতড়াচ্ছেন? কী সূত্র পাবেন বলে আশা করছেন? সেই মুহূর্তে অনুভব করলেন, তিনি যেন এই হত্যাকাণ্ডরূপী রক্তফুলে ভরা গাছটার শিকড় এই বাংলোর তলায় আবিষ্কার করতে চাইছেন। বাংলোর সঙ্গে তার যোগসূত্র আছে বলে কীভাবে যেন বিশ্বাস হয়ে গেছে অবচেতন মনে। বাংলোটা শ্ৰীমদনমোদন পানিগ্রাহীর। অতএব পরোক্ষে তাই কি এই ভদ্রলোকেরই জীবনযাত্রা হাতড়াতে ব্যস্ত হলেন? কেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? পানিগ্রাহীর নারীঘটিত দুর্বলতা, এই বাংলোয় স্ত্রীলোক নিয়ে নির্জনে একান্তে এসে, থাকা…এইগুলো হচ্ছে বাস্তব তথ্য বা ফ্যাক্টস। এই ফ্যাক্ট তাকে অবচেতনায় প্ররোচিত করেছে নিঃসন্দেহে। অমনি একটু অস্বস্তি হলো। পানিগ্রাহী তো এখনও আসেননি। সুইডেন থেকে পৌঁছেছে কি না তাও জানা নেই। সেটা খবরের কাগজ থেকে আগে জেনে নেওয়া উচিত ছিল। খামোকা বেচারাকে সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না।

অথচ একটা কিন্তু ভাব থেকেই যাচ্ছে।…

কী একটা খচখচ করে বিধছে মনে।…

হঠাৎ একটা দৃশ্য মাথায় ভেসে এল। ডাঃ.পট্টনায়ক সিগারেট কৌটোটা : দেখামাত্র কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। তার মুখের সেই বিস্ময় ও শিহরণ কর্নেলের দৃষ্টি এড়ায়নি।

বারবার মনে হলো, এটা তারই চোখের ভুল। কিন্তু…

ঠিক সেই সময় পত্রিকাটি অন্যমনস্কতার দরুন হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর তার পাতার ফাঁকে একটা নীলরঙের খামের কোণা উঁকি মারল। খামটা বের করে নিলেন। নীল খাম। ভিতরে চিঠি রয়েছে। কোনও ডাকটিকিট নেই, পোস্টাপিসের ছাপ নেই। তার মানে হাতে-হাতে পাঠানো হয়েছে। ওপরে পানিগ্রাহীর নাম লেখা।

সাবধানে এক কোণা ধরে চিঠিটা বের করে খুললেন। পরক্ষণে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। নানা, এ অসম্ভব। এ কী দেখছেন! আর তারিখ তো গত কালকের! ২২ জুলাই!

চিঠিটা পকেটে ভরে ফেললেন। তাঁর দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে রইল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। পৃথিবীতে বিস্ময়কর অনেক কিছু আছে কিন্তু অসম্ভব বলে সত্যি কিছু নেই। এ যেন নীলরঙা একটা বাসায় অসম্ভবের ফুটফুটে একটি ছানা। কর্নেল চুরুট। ধরিয়ে বেরিয়ে এলেন।…

.

০৬.

মুখোশ, ছুরি ও নব-র কাণ্ড

কর্নেল একজন সেপাইয়ের জিম্মায় বাংলোর ভার দিয়ে ফার্মের জমিতে গেলেন। ডাঃ পট্টনায়ককে দেখতে পেলেন না। সেনাপতি জানালেন, ডাক্তার তার বাড়িতে গেছেন–ফোরেনসিক ল্যাবের টেবিলে বসবেন গিয়ে। তার সঙ্গে বরাবর পোর্টেবল একটা ল্যাররেটরী থাকে, কর্নেল জানেন।

আরও সব সেপাই ও অফিসার এসে গেছে ততক্ষণে। সেপাইরা ভিড় হটাচ্ছে। ইউক্যালিপটাস গাছের লম্বাটে ছায়ায় একটা টেবিল ও কিছু চেয়ার পাতা হয়েছে। সেগুলো ফার্মের আপিস থেকে আনা হয়েছে।

সেনাপতি দুজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওঁরা দৈবাৎ এসে পড়েছিলেন চন্দনপুর-অন-সী-তে। ইন্সপেক্টর শ্রী আচার্য আর কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর শ্রী শর্মা। শর্মা একটা গোপনীয় কেসের ব্যাপারে এসেছেন। কর্নেলের নাম শুনে দুজনেই লাফিয়ে উঠলেন। কারণ গর্ত শীতে কাশ্মীরে স্কি-ট্রেনিং সেন্টারের সেই জোড়া হত্যাকাণ্ড আর কর্নেলের খবর সারা ভারতবর্ষে বড়বড় কাগজগুলো ছড়িয়ে ছিল। দিল্লী রাজধানী জায়গা। সেখান থেকে কিছু প্রচারিত হলেই তা জাতীয় হয়ে ওঠে।

একটি ময়লা প্যান্ট-শার্ট পরা লোক কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকেই জিগ্যেসপত্তর করা হচ্ছিল এতক্ষণ। সেনাপতি বললেন, কর্নেল, মেয়েটির কিছু খবর এর কাছে পাওয়া গেল। এর নাম নবসুন্দর–দ্য শার্ক রেস্তোরাঁর কর্মী। আমাদের ইনফরমার। নব, কর্নেলসায়েবকে ব্যাপারটা ফের বলো তো। সে একটা রীতিমতো নাটক কর্নেল। নব, তুমি বলো।

নব গত রাত্রে ‘দ্য শার্কে’ যা-যা ঘটেছিল, সব আওড়ে গেল। এমন কি সেই কাগজের টুকরোগুলোর কথাও বলল। সেনাপতি কাগজের টুকরোগুলো একটা খাম বের করছিলেন, কর্নেল হাত তুলে তাকে থামালেন। তারপর বললেন, আচ্ছা নব, তোমার পুরো নাম কী?

শ্রীনবসুন্দর দাশ, স্যার।

বাড়ি কোথায়?

গ্রাম কাঠাপাড়া, পোঃ সুন্দরী, থানা..

থাক। শার্কে কদ্দিন এসেছ?

তা বছর তিনেক হলো, স্যার। একেবারে গোড়া থেকেই, বলতে পারেন।

শার্ক রাত্রে কতক্ষণ অব্দি খোলা থাকে?

রাত বারোটা অব্দি। তবে কোনও কোনও রাতে একটু দেরিও হয়।

কিন্তু তোমাদের ক্যাশবাবু গতরাতে নটায় চলে গেলেন বলেছ?

হ্যাঁ স্যার। উনি তাই যান। তারপর সব আমার জিম্মায় থাকে।

মালিক থাকেন না কোনও সময়?

থাকেন। কিন্তু তার কোন ঠিক নেই। ওঁর আরও সব ব্যবসাপত্তর আছে।

আর সব লোকেরা বারোটা অব্দি থাকে কি?

থাকে স্যার। কাল বৃষ্টি হচ্ছিল–লোক হবে না ভেবে তাদের যেতে বলেছিলুম।

কাল রাতে যে মেয়ে দুটি ছিল, তারা কটায় তোমাদের রেস্তোরাঁয় এসে ঢোকে?

বৃষ্টি শুরু হবার একটু আগে।

আন্দাজ কতক্ষণ আগে?

তা মিনিট পনের হবে–ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারব না স্যার।

তাদের একজন খুন হয়ে ওখানে পড়ে রয়েছে বলছ। তোমার চিনতে ভুল হচ্ছে না তো?

না স্যার, কী বলছেন! অতক্ষণ অব্দি বসেছিল শার্কে–আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল চেহারা।

তুমি একেবারে, নিশ্চিত হয়ে বলছ?

একেবারে, স্যার। ভুল হয়নি।

তাদের হাতে কোনও ব্যাগ-ফ্যাগ ছিল না?

না।

তোমরা কি খাওয়ার পর দাম নাও?

মদের দামটা আগে নিই, অন্য কিছু খেলে পরে নিই।

প্রথমবার হাফ-পেগ করে জিন নিয়েছিল বলেছ, তার দাম কে দিল?

ফরসা লম্বা মেয়েটি। সে বেলবটম প্যান্টের পিছনের পকেট থেকে টাকা বের করেছিল।

তার ঠোঁটে লিপস্টিক ছিল?

নব একটু ভেবে বলল, বোধ হয়, না স্যার।..না, ছিল না। কারণ, ওর ঠোঁট দুট কীরকম মোটা-সেটা চোখে না পড়ে পারে না।

কীরকম সেটা, মানে?

মানে ইয়ে…স্যার, ওরকম ঠোঁট মেয়েদের মুখে মানায় না। কেমন যেন পুরুষালি।

তার গায়ে গেঞ্জি ছিল বলেছ। চুল লম্বা ছিল, তাও বলেছ। কতটা লম্বা?

নব তার ঘাড়ের অনেকটা নিচে হাত দিয়ে দেখাল।…এতটা লম্বা হবে।

ঘাড় থেকে ছসাত ইঞ্চি?

হ্যাঁ স্যার।

চুল খোলা ঝুলছিল?

হ্যাঁ স্যার।

নব, তুমি হিপি দেখেছ?

অনেক দেখেছি, স্যার। বিস্তর।

তার বুকে ব্রেসিয়ার ছিল না কিভাবে বুঝলে?

নব সলজ্জ স্বরে বলল, বুকটা উঁচু ছিল স্যার।

নব, এতে লজ্জা পাবার কিছু নেই। মেয়েরা, ব্রেসিয়ার না পরে থাকলে নড়াচড়ার সময় স্তনদুটো দোলে। তুমি তেমন কিছু নিশ্চয় লক্ষ করে থাকবে?

অতটা লক্ষ করিনি। তবে বুক উঁচু ছিল, তাতে কোনও ভুল নেই।

এই সময় পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্য হাসতে হাসতে মন্তব্য করলেন, আজকাল ছেলেরাও মেয়ে সেজে থাকতে পছন্দ করে। মোহনপুরে একদল ইভ-টিজার ধরলুম গতকাল, দুজনকে দেখে তো বুঝতেও পারিনি যে আসলে ওরা ছেলে।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, ঠিকই। আচ্ছা নব, ওদের মধ্যে কথাবার্তা নিশ্চয় হচ্ছিল?

হচ্ছিল। তবে এত চাপা গলায় যে কিছু শুনতে পাইনি।

অর্ডার দিচ্ছিল কে?

ফরসা মেয়েটিই। তবে স্যার, টেবিল ঠুকে ইশারায় অর্ডার দিচ্ছিল। আরও একদিন–না, আগের দিন তারও আগের দিন ওরা এসেছিল। রাত নটা অব্দি ছিল দুজনে। হাফ করে খেয়ে আসছিল প্রতিদিনই। শুধু গত রাতে আরেকটা হাফ পেগের অর্ডার দেয়।

দুজনকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল, না হাসি-খুশি?

দুজনেই গম্ভীর। আগের দিনও তাই দেখেছি।

ফরসা মেয়েটির আর তেমন কোনও বিশেষ চিহ্ন বা কোনও ভঙ্গি তোমার মনে পড়ছে?

নব একটু ভেবে ঈষৎ উদ্দীপ্ত হয়ে বলল, স্যার, ফরসা মেয়েটির হাতে উল্কি ছিল।

আর কিছু?

আর কিছু…মনে পড়ে না স্যার।

কোন হাতে উল্কি ছিল?

সেটা…হ্যাঁ, হ্যাঁ–বাঁ হাতে গেলাস ধরছিল। বাঁহাতে উল্কি ছিল এখানটায়। বলে নব তার বাঁহাতের তালু চিৎ করে কবজি থেকে ছইঞ্চি দূরে একটা জায়গা দেখাল। তারপর ফের উদ্দীপ্ত মুখে বলে উঠল, স্যার! মেয়েটি বেঁয়ে। বাঁহাতে সিগারেট খাচ্ছিল, বাঁহাতে দাম দিচ্ছিল.

তার মানে লেফট হ্যাণ্ডার?

কী বলো?

হ্যাঁ।

দুজনেই সিগারেট খাচ্ছিল?

হ্যাঁ।

সিগ্রেটের টুকরোগুলো কোথায় ফেলছিল?

অ্যাশট্রেতে।

অ্যাশট্রে কি সাফ করে ফেলেছ?

হ্যাঁ, স্যার। ভোরে সুইপার এসে সাফ করে প্রতিদিন।

আচ্ছা নব, দেশলাই জ্বালছিল কে?

খুন হওয়া বেঁটে মেয়েটি, স্যার। সে ধরিয়ে দিচ্ছিল–একবার লক্ষ করেছি।

ফরসা মেয়েটি বেশি সিগারেট খাচ্ছিল, না বেঁটে মেয়েটি? নাকি দুজনেই একসঙ্গে সমান খাচ্ছিল?

নব একটু ভেবে বলল, বেঁটে মেয়েটি দুএকবার–তবে ফরসা মেয়েটি বেশি।

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, সে নিশ্চয় নিজের সিগারেটের পোড়া টুকরো থেকে সিগারেট ধরাচ্ছিল?

হ্যাঁ, স্যার। ঠিক বলেছেন।

সেনাপতি বললেন, তাহলে সে চেইন-স্মোকার দেখছি!.

কর্নেল বললেন, নব, এবার সেই ছোরা হাতে লোকটির কথা বলল। সে মাথায় তোমার চেয়ে ছোট, না উঁচু?

না স্যার, ছোট। রোগামতো টিঙটিঙে লোক। ময়লা রঙ। হাতে লোম ছিল।

চুল?

চুল…তখন খুঁটিয়ে দেখার মতো অবস্থা তো ছিল না স্যার। তার ওপর মুখে মুখোশ পড়া।

কোনও বিশেষ চিহ্ন বা ভঙ্গির কথা মনে পড়ছে?

না স্যার। সে আধ মিনিটেরও কম লম্ফঝম্ফ করে পালাল। তখন কিছু লক্ষ করার কথা মাথায় কারও আসা সম্ভব, স্যার?

পায়ে জুতো ছিল দেখেছ?

মনে পড়ছে না। বলছি তো–তখন যা অবস্থা চলেছে…

কিন্তু তুমি তো শক্ত-সমর্থ প্রায় পালোয়ান মানুষ, নব। বারে মাতালদের হাঙ্গামা নিশ্চয় হয়। তোমাকেও তা থামাতে হয়। কী বলো?

হয়, স্যার। আমাকে মাতাল বলে কথা নেই, আপনাদের আশীর্বাদে, ভদ্রলোক ছোটলোক সবাই বেশ ডরায়। আমি নিজেও কম মারামারি করিনি এ জীবনে। থানার স্যাররা সে-হিসট্রি সব জানেন।

অথচ নব, তুমি তখন ছোরা হাতে একটা লোককে দেখে হতভম্ভ হয়ে রইলে। কোনওরকম বাধাও দিলে না! ইচ্ছে করলে তো তুমি ওকে ছোরা কেড়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিতে পারতে!

নব মাথা নিচু করে কাঁচুমাচু মুখে বলল, আপনার আশীর্বাদে তা পারতুম, স্যার!

কিন্তু তা করোনি।

আমার…আমার কী যেন হয়েছিল! এখন আফসোস হচ্ছে, স্যার।

কর্নেল তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, নাকি তুমি মোটেও বাঁধা দিতে চাওনি?

নব লাফিয়ে উঠল। তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলল, ছি ছি! এ কী বলছেন স্যার! চোখের সামনে একটা খুনখারাপি দাঁড়িয়ে দেখার ছেলে নব নয়। আমার পরম শত্রুকেও যদি কেউ খুন করতে চেষ্টা করে আমি সামনে থাকলে তা প্রাণ গেলেও হতে দেব না। কত বড়বড় গুণ্ডা আর বদমাশ পিটিয়ে আমি ঠাণ্ডা করেছি। বালেশ্বরের ওদিকে গিয়ে নবর নাম বললে এখনও সাপ রাস্তা ছেড়ে সরে যায়!

কর্নেল তার কথার ওপর কথা ফেললেন।…সাপও রাস্তা ছেড়ে যায়। অথচ মুখোশপরা লোকটা দিব্যি ছোরা হাতে দুটি মেয়েকে খুন করতে ঢুকেছে–আর ঢুকেছেও তোমার ঘরে বলা যায়–তুমি অমনি বোবা বনে গেলে নব?

নব ফ্যালফ্যাল করে তাকাল… আমার বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল যেন।

তোমার বুদ্ধি সামান্য একটা–তোমারই ভাষায় রোগা টিঙটিঙে লোককে ছোরা হাতে লম্ফঝম্ফ করতে দেখে গুলিয়ে গেল? দুঃখিত নব, এটা বিশ্বাস করতে পারছিনে।

নব বিব্রত মুখে হাত কচলাতে থাকল। এইসময় সেনাপতি যেন নবর। হয়েই সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, কর্নেল স্যার! নব আমাদের বিশ্বাসী। ও ভীষণ সাহায্য করেছে নানা ব্যাপারে। তাছাড়া ইনফরমারের গতিবিধি জানবার জন্যেও আমাদের ইনফরমার রয়েছে। নব ইজ কোয়াইট ক্লিন ইন অল রেসপেক্ট।

কর্নেল বললেন, একটা কথা মিঃ সেনাপতি। নবর ধরনের লোকেরা সচরাচর কীরকম হয়ে থাকে আমরা জানি। অতীতে সে বদমাইশি খুনোখুনি করেছে। তারপর সম্ভবত নানা ঘটনার চাপে ওর চরিত্র বা জীবনযাত্রার ধাঁচ বদলাতে বাধ্য হয়েছে সে নিজে, কিংবা হয়তো শুধু বাইরের চাপেই বদলে গেছে। সাধারণত এই ধরনের লোকই পুলিশের ইনফরমার হবার উপযুক্ত। পুলিশের কার্যকলাপের আওতায় এসে এরা কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটা পাল্টা ভূমিকা নিতে শুরু করে। তাদের অহংবোধ উদ্দীপ্ত হয় এবং আইনের পথে প্রকাশ্যে, নিজের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে দেখে তাদের পক্ষে অনেক সময়। সমাজের একটি উপকারী মানুষ হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়। ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়। এবার আসছি, এ ধরনের লোকেদের দ্বিতীয় একটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের কথায়। যেহেতু তাদের তীব্র অহংবোধ এখন আইনের প্রশ্রয় পাচ্ছে এমনকি সামাজিক দিকে থেকে নৈতিক প্ররোচনা ও পিঠচাপড়ানি দুই-ই পাচ্ছে এরা বেপরোয়া হয়ে গুণ্ডা বদমাশ ঠ্যাঙাতে তৎপর হয়। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিদ্বন্বিতার মনোভাব। তার কাছে এখন পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম খনী বা গুণ্ডা-বদমাশ যে নস্যি, এটা দেখানোর জেদ মাথায় উগ্র হয়ে ওঠে। ভাবটা এই : আরে যা ব্যাটা পুঁচকে! অমন কত মাল পকেটে ভরেছি অ্যাদ্দিন! …আমার মনে হচ্ছে, নবর মধ্যে এইসব ভাব থাকা স্বাভাবিক।

সেনাপতি মাথা দোলালেন।…হ্যাঁ, আছে। আই এগ্রি। নিশ্চয় আছে।

আছে। অথচ সে গতরাতে হাঙরের মুখোশপরা ছোরাধারী একটা রোগা টিঙটিঙে লোককে দেখে ঘাবড়ে গেল!…

নব বাধা দিয়ে বলল, না স্যার, না স্যার। ঘাবড়াইনি। হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। এ যে এক আজব ঘটনা স্যার!

এমন ঘটনার মুখোমুখি তাহলে কখনও হওনি বলছ! ভেবে বললো, নব।

হইনি বললে মিথ্যে বলা হবে। একবার আচমকা একটা লোক আমাকে ছোরা নিয়ে হামলা করেছিল… বলে নব সেনাপতির দিকে সায় নেবার ভঙ্গিতে তাকাল।…ঠিক না, স্যার? তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ছুরিসুদ্ধ থানায় নিয়ে গেলুম না, স্যার?

সেনাপতি বললেন, দ্যাটস রাইট।

কর্নেল প্রশ্ন করলেন, তাহলে, নব?

নব ঘামছিল। ভারি গলায় বলল, কী বলব–কী যেন হয়েছিল তখন! খুব হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আপসোস হচ্ছে–ইস্! আর একবার যদি ওরকমটি হতো!

কর্নেল একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যাক্ গে, ছেড়ে দাও। যা হবার হয়েছে। এখন বলল, মুখোশটা কেমন ছিল?

এমনি একটা মুখোশ-বাচ্চারা যা পরে। বিচে বিকেলে বেচতে আসে ফেরিওয়ালারা। ভূতের মুখোশ, রাক্ষসের মুখোশকত রকম। কানে গাটার দিয়ে আটকাতে হয়। নাক ও চোখের ফুটো থাকে।

তাহলে বলছ খেলনার মুখোশ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আর ছোরাটা সেই রকম খেলনার নয়, আশা করি!

নব কেন যেন একটু অবাক হলো, খেলনার ছোরা?

সী-বিচে খেলনার মুখোশ আর রাঙতামোড়া ছুরি তলোয়ার তীর ধনুক বিক্রি হতে আমি দেখেছি। কর্নেল সকৌতুকে বললেন, ফের, নব, আমাদের বেশ অদ্ভুত গল্প শোনালে তাহলে!

অমনি নব এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে আচমকা দৌড়ে পালিয়ে গেল।

ঘটনাটা এমন আচমকা ঘটল যে সবাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। নব যখন ফার্মের সদর গেট পেরিয়েছে, তখন দুজন সেপাই উপস্থিতবুদ্ধি মতে পাকড়ো, পাকড়ো শালা বদমাশকো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ল। সেনাপতি, শৰ্মা, আচার্য এবার স্প্রিঙের পুতুলের মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন একসঙ্গে। আচার্য বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ দিলেন, পাকড়ো শালা খুনী কো! সেনাপতি চেয়ার সরিয়ে রিভলভার খুলে বেরোবার চেষ্টা করতেই কর্নেল তার হাতটা ধরলেন। কোথায় যাবেন? বসুন। কর্নেল এতক্ষণ একটুও নড়েননি।

ওদিকে ফার্মের কিছু লোক আর ভিড় থেকে কয়েকজন মিলে দৌড়ে যাচ্ছে দেখা গেল।

সেনাপতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কর্নেল, কর্নেল! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে জেরার চোটে নবর মুখোশটা খুলে দিয়েছেন! ব্যাটা সেটা টের পেয়েই পালাল। উঃ! একটুও ভাবিনি–ও ব্যাটারই কাজ! শয়তান কখনও মানুষ হয়– না হয়েছে? চোখে ধুলো দিয়ে দিব্যি ইনফরমার সেজে কাটাচ্ছিল, একটুও টের পাইনি।

আচার্য হাঁসফাঁস করে বললেন, আমি বারবার বলেছি, ও ব্যাটা খুনে গুণ্ডা সম্পর্কে সাবধানে থাকা উচিত আপনাদের। অতটা বিশ্বাস করবেন না!

আচার্য স্থূলোদর মানুষ। তার লাল মুখ ঘেমে কালো দেখাচ্ছে। ভুড়িটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে। সেনাপতির একটা হাত ধরে কর্নেল আটকানোর চেষ্টা করছেন।

কিন্তু কর্নেলের মুখে শান্ত হাসি। সবার মনে হচ্ছিল যে এই হাসি নবকে চরম পয়েন্টে জেরা করে ফেলার জন্যে তৃপ্তির হাসি। শর্মা বসলেন অবশ্য। বসে সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আগাগোড়া একটা বানানো গল্প বলে ব্যাটা কেমন ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করছিল। হুঁ! মুখোশপরা একটা লোক। নাও, এখন পৃথিবী হাতড়ে বেড়াও তার জন্যে! এই ফন্দিটা একটুও টের পাইনি আমরা।

আচার্য বললেন, আসলে ও ইনফরমার, তাই বিশ্বাস করতে হচ্ছিল।

কর্নেল বললেন, ওকে বিশ্বাস করে কোনওবার কখনও ঠকেছেন, এমন ঘটনা আছে?

না–ঠকিনি। এবার অ্যাদ্দিনে ঠকলুম। অবশ্য আমি ঠকিনি আমার বরাবর সন্দেহ ছিল গু-খাওয়া গরু। খোলভুষি খাবে কেন?

কর্নেল বললেন, বাই দা বাই, মিঃ আচার্য–আপনি কি মুর্শিদাবাদের লোক?

আচার্য অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

নিশ্চয় গ্রামাঞ্চলে বাড়ি ছিল?

হ্যাঁ। কেন, কেন? কিসে বুঝলেন?

ওই গ্রাম্য প্রবাদবচনে। বলে কর্নেল হেসে উঠলেন।…! একজ্যাক্টলি! বিষ্ঠাভক্ষণকারী প্রাণীরা এমনি হয়।

.

০৭.

তামাশাবাজি ও একটা মড়া

একটু পরে দেখা গেল, থানার এ. এস. আই. বরকত আলি এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ফার্মের গেট পেরোচ্ছেন। এঁরা সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। আচার্য বললেন, মিঃ সেনাপতি, বসুন! সেপাইরা গেছে, নবও গেছে–এতক্ষণ ব্যাটাকে ধরে ফেলেছে। যাবে কোথায়? নবর হাত থেকে এখন ওকে বাঁচাতে হিমশিম খাবে সেপাইরা। আপনি ব্যস্ত হবেন না–দিস ইজ নট ইওর ফল্ট। ওই দেখুন আপনারা, আলিসায়েব আসছেন কাকে নিয়ে। মনে হচ্ছে, ঘটনার জালটা বেশ ছড়ানো। নব খুন করেছে কারো টাকা খেয়ে–তা বই তো নয়! অতএব পিছনে লোক রয়েছে আই অ্যাম সিওর, মশাই। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল বললেন, ফ্যাক্টস। ফ্যাক্টস থেকেই তো সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব।

আলির সঙ্গের ভদ্রলোক রীতিমতো ভদ্রলোক। ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গিলেকরা হাতা, গলায় সরু সোনার চেন, বয়সে অবশ্য প্রৌঢ়, পায়ে পাম্প-শু রয়েছে। তার হাতে মস্ত একটা বাঁধানো রেজিস্টার মতো রয়েছে। এই সব লোক দেখেই বলা যায়, ছায়ায় সারাক্ষণ থাকেন, তাই কীরকম চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেন। পান খান। আঙুলে অনেক আংটিও রয়েছে। আলিসায়েব এসে একটি সেলাম ঠুকে কিছু বলতে মুখ খুলছেন সবে, কর্নেল হাসিমুখে বললেন, আশা করি, ইনি কোনও হোটেলের মালিক। আসুন, আসুন! ওটা নিশ্চয় হোটেল রেজিস্টার। সী-ভিউ নিশ্চয়। খ্রিস্টার হোটেল এখানে তো ওই একটিই। বলুন স্যার, নিশ্চয় সিঙ্গল স্যুট বুক করেছিল হতভাগ্য মেয়েটি?

সবাই হাঁ করে কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভদ্রলোকের মুখও হাঁ–ভিতরে একটা খয়েরি রঙের মাংসখণ্ড–অবশ্যই সেটি রসনা–প্রকাণ্ড বিলিতী কুকুরের মতো বসে থাকতে দেখা যাচ্ছিল–এবং গলার গর্ত ও আলজিভটাও, নজরে পড়ছিল। ভীষণ ঘাবড়ে যাওয়া মূর্তি।

আলি বললেন, হ্যাঁ স্যার। মেয়েটির নামধাম সব পাওয়া গেছে। এই যে– রেজিস্টারটা দেখুন। কই ভারতবাবু, দিন।

ভারতবাবু টেবিলে ওটা রেখে একপাশে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে মুখে সামান্য হাসি ফুটল। কথাও।…হাঁ স্যার। যা বর্ণনা পেলুম, আর আমার লোকেরাও এসে দেখে গেছে–উনিই তিনি। কাল রাত্তির থেকে নিখোঁজ। বৃষ্টি ছাড়ল না। তাছাড়া…

কর্নেল বললেন, এক মিনিট। তারপর একফালি কাগজে চিহ্ন দেওয়া পাতাটা খুললেন। অফিসার তিনজন মুণ্ডু বাড়িয়ে দিলেন।

তন্দ্রা ভাদুড়ী। স্থায়ী ঠিকানা : ১২৩/১৭ হরি মুদী লেন, কলকাতা-১৩। এসেছে ২১ জুলাই দুপুর বারোটায়। সুইট নম্বর সি, সিঙ্গল। স্পেশাল রেফারেন্স শ্রী-মদনমোহন পানিগ্রাহী, পানিগ্রাহী ফার্ম, ..

হোয়াট! লাফিয়ে উঠলেন সেনাপতি।

কর্নেল বললেন, তার মানে কোনও বিপদ-আপদের ক্ষেত্রে শ্রীপানিগ্রাহীর সঙ্গে হোটেল কর্তৃপক্ষকে যোগাযোগ করতে হবে। তন্দ্রা তাহলে কলকাতার কোনও রেফারেন্স দেয়নি–যা স্বাভাবিক ছিল। তাহলে দাঁড়াচ্ছে : পানিগ্রাহী মেয়েটিকে ভালই চেনেন। আর…।

আলি তার পকেট থেকে দুটো চিঠি বের করে বললেন, চেনেন স্যার? এই দেখুন, ওঁর সুইট তল্লাসী করে এই চিঠিদুট খুব ইমপরট্যান্ট মনে হলো বলে সঙ্গে এনেছি। সুইটে আমাদের তালা আটকানো হয়েছে এখন।

দুটই ইনল্যাণ্ড লেটার। দুটতেই তন্দ্রা ভাদুড়ীর নাম ঠিকানা ইংরজিতে টাইপ করা। এবং দুট চিঠিরই ভাষা ইংরেজি, টাইপ করা। প্রথমটার শুরু, ডিয়ার মিস ভাদুড়ী। দ্বিতীয়টার শুরু, মাই ডিয়ার মিস তন্দ্রা। দুটোর তলায় শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহীর সই। চিঠি দুট পড়ে জানা গেল, শ্ৰীপানিগ্রাহী তন্দ্রাকে পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি দিচ্ছেন।

প্রথম চিঠিটা :

বিজ্ঞাপনটি আপনার নজরে পড়েছে দেখে আমি আনন্দিত। আপনি দরখাস্ত পাঠিয়েছেন, কিন্তু কোনও ফোটো পাঠাননি। শিগগির ফোটো পাঠান। পি.এ.র পক্ষে দরকারী যোগ্যতা আপনার আছে। এবার কিন্তু বক্স নম্বরে পাঠাবেন না। আমার ঠিকানা দেওয়া হলো। বাই দা বাই, মাইনের কথা লিখেছেন। সর্বসাকুল্যে হাজার টাকা প্রায়।

এর তারিখ ২ জুলাই।

দ্বিতীয় চিঠিটা :

ফোটো পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। এই চিঠিটা নিয়োগপত্র বলে জানবেন। পরে ফর্মাল নিয়োগপত্র পেয়ে যাবেন এখানে এসে। আকস্মিক কারণে আমি পনের দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। চন্দনপুরে ফিরব বাইশ-তেইশ তারিখ নাগাদ। আপনি একুশ তারিখ রওনা হোন। এই সঙ্গে পৃথক ইনসিওর করা খামে তিনশো টাকা পাঠালাম। এটা অগ্রিম। আপনার রাহাখরচ এবং চন্দনপুরে এসে যদি আমার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, সেজন্য হাতখরচ বাবদ। আপনার অসুবিধে হবে না। আমার লোক হোটেল বুক করে রাখবে। সী-ভিউ-তে একটা সিঙ্গল সুইট পাবেন। মনে রাখবেন নামটাসী-ভিউ। আমার প্রেসটিজের জন্যেই আপনাকে কিছু প্রেসটিজ মেনে চলতে হবে। আমার ফার্মে গিয়ে নিজে খোঁজ নেবেন না। এখানে রাস্তার লোককে জিগ্যেস করলেও জানতে পারবেন, আমি ফিরেছি কি না। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি ফিরলেই নিজে হোটেল থেকে আপনাকে নিয়ে আসব। দিস ইজ ভেরি ইমপরট্যান্ট।…তারপর পুনশ্চ আরও কিছু নির্দেশ আপনি শীঘ্রই পাবেন। নির্দেশগুলি খুব গোপনীয়। তাই চিঠিতে জানাব কি না ভাবছি। যাই হোক, অপেক্ষা করুন।

এটার তারিখ ৭জুলাই।

আচার্য মন্তব্য করলেন, বিজ্ঞাপনটা তাহলে জুনের কাগজে বেরিয়ে থাকবে। সেনাপতি, সব বড় দৈনিকগুলোর বিজ্ঞাপন কলমে খোঁজ নিতে হবে। পেয়ে যাবেন। কলকাতায় লালবাজারে ট্রাঙ্ক করে ওঁদের বলুন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বের হয়ে যাবে।

সেনাপতি মাথা দোলালেন।

শর্মা বললেন, কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে আমার। কর্নেল কী বলেন?

কর্নেল তাঁর চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন। ভারতবাবুকে এবার কিছু জিগ্যেস করব।

ভারতবাবু বিনয়ে নত হয়ে জবাব দিলেন, একশোবার, স্যার। অবশ্যই।

মেয়েটি মানে তন্দ্রা ২১ তারিখে একা এসেছিল বলছেন তাহলে?

হ্যাঁ, স্যার। একা। দুপুর বারোটার বাসে নেমেছিলেন।

লাগেজ ছিল সঙ্গে?

হ্যাঁ–একটা বেডিং আর বড়ো একটা স্যুটকেস।

লেডিজ ব্যাগ–মানে, যাকে ভ্যানিটি ব্যাগ বলা হয়–তেমন কিছু..

ছিল স্যার। কাঁধে ঝুলছিল। তার থেকে একটা পার্স বের করে টাকা মেটালেন। ওনার চোখে গোগো চশমা ছিল। পরনে…

থাক। আচ্ছা ভারতবাবু, তন্দ্রা ওদিন হোটেল থেকে প্রথম কখন বেরোয় মনে। আছে?

তিনটেয় একটি ঢ্যাঙা মতো মেয়ে এসে ওঁর খোঁজ করলেন। সব ঘরে ফোনের ব্যবস্থা আছে। আমি ওনাকে রিং করে ভিজিটারের কথা বললুম–। উনি বললেন, কী নাম? ভিজিটারকে জিগ্যেস করলে জানালেনবলুন, মিস এস রায়। ফ্রম ক্যালকাটা। তন্দ্রাদেবী তক্ষুনি ওনাকে পাঠিয়ে দিতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পরে দুজনে দোতালা থেকে নেমে বেরিয়ে গেলেন।

ঢ্যাঙা মেয়েটির চেহারা মনে আছে?

আছে বই কি স্যার। তারপর তো সকাল দুপুর রাত্রি সব সময় দুজনকে একসঙ্গে দেখেছি। রাত্রেও থেকেছেন ওঁর সুইটে। গেস্ট হিসেবে খাওয়া-দাওয়াও করেছেন।

এবার চেহারা বলুন।

ঢ্যাঙা, হাত দুটো বেশ ছড়ানো লম্বা, মোটা হাড়ের গড়ন বলা যায়। বাঁ হাতে উল্কি ছিল। সবসময় সাজপোষাক বদলানো অভ্যাস। পাঞ্জাবি, বেলবটম প্যান্ট, নয়তো গেঞ্জি। কেমন যেন পুরুষালি চালচলন। গলার স্বরও মোটা। ঘাড়ের কিছু নিচে অব্দি খোলামেলা চুল।

সে মেয়ে, তা কিসে বুঝলেন?

সবাই হেসে উঠলেন এ প্রশ্নে। ভারতবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না স্যার-তা কি হয়? ছেলে না মেয়ে, তা বুঝব না আবার?

আজকাল ছেলেরাও লম্বা চুল আর মেয়েদের ঢঙে পোশাক পরছে। আশা করি, বিচ-এ লক্ষ্য করেছেন।

তা ঠিক, স্যার। তবে ওনার বুক–বুক ছিল যে।

ব্রেসিয়ার ছিল? বলে কর্নেল হাসি চাপলেন–ফের বললেন, না–মানে, কেউ কারও জামা তুলে পরীক্ষা করার কথা ওঠে না। আমি বলছি, বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল কি না?

ভারতবাবু লাফিয়ে উঠলেন।..স্যার, স্যার! বুক আঁটো ছিল না ওনার। আজকাল যে বিদিশী মেম-সায়েবদের দেখাদেখি অনেকে ব্রেসিয়ার পরা ছেড়েছেন! বিচে কত সব ঘুরে বেড়ান–আমার হোটেলেও ওঠেন।

তার মানে ব্রেসিয়ার ছিল না?

ঠিক স্যার।

গতকাল–মানে ২২ তারিখ কখন ওরা হোটেল ছেড়ে বের হন, মনে আছে?

আছে, স্যার। আমার নজর কড়া রাখতে হয়। বুঝতেই পারছেন, আজকাল হোটেলের আইন-কানুন সরকার কড়া করেছেন। গতকাল ওনারা বের হন, বিকেল। সাড়ে চারটে নাগাদ। সময়টা মনে আছে। কারণ, এক মন্ত্রীমশায় ওসময় চেক আউট করলেন। আপনাদের আশীর্বাদে মন্ত্রীরাও সী ভিউ-এ এসে থাকেন অনেক সময়। সরকারী অতিথিভবনে যখন আরও বড় কোনও মন্ত্রী থাকলে…

রাইট। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অতিথিভবনে থাকলে রাজ্যের মন্ত্রীদের পক্ষে হোটেল ছাড়া উপায় কী? কর্নেল মন্তব্য করলেন।…আচ্ছা ভারতবাবু, ভিজিটরদের নাম বা সই নেবার জন্যে নিশ্চয় আপনার রেজিস্টার রয়েছে?

আছে স্যার। মিস এস রায়ের প্রথমদিনকার সই আছে। পরে আর নিইনি। কারণ উনি তো দেখলুম, মিস তন্দ্রার সঙ্গেই থাকছেন-টাকছেন।

একুশ তারিখে ওরা রাতে কটায় হোটেলে ফিরেছিল?

রাত দশটা নাগাদ।

কোনও বোর্ডার রাতে না ফিরলে আপনারা কী করেন?

থানায় জানিয়ে দিই, স্যার।

কখন জানান?

সেটা স্যার অবস্থার ওপর নির্ভর করে। তবে–ভভারের দিকে থানায় খবর দেওয়া আমাদের রীতি। আসলে হয় কি জানেন? আকাশের অবস্থা ভাল থাকলে অনেকে সী বিচেই রাত কাটান। স্যার, বুঝতেই পারছেন, যা যুগ পড়েছে। সারারাত ড্রিঙ্ক করে তখন যে যেখানে পায়, শুয়ে পড়ে। ভোরবেলা বিচে গেলে আপনি দেখবেন–

তা দেখেছি বটে।

এমনকি মেয়েরাও স্যার–মেয়েরাও! রাত্রিবেলা আবহাওয়া ভাল থাকলে সী বিচে খুব অশ্লীল সব ব্যাপার ঘটতে থাকে আজকাল। ক্রমশ বাড়ছে এটা।

সেনাপতি বললেন, নানা, অতটা বাড়িয়ে বলবেন না মশাই। আমাদের লোক রোঁদে ঘোরে। গত বছরকার সেই রেপ কেসটার পর রাত্রে সী বিচে কড়া নজর রাখা হয়। তাছাড়া, আলো রয়েছে। কী সব যা-তা বলছেন?

ভারতবাবু ধমক খেয়ে ঘাবড়ে গেলেন–তা হয় স্যার–তবে কি না আজকাল যা যুগ পড়েছে। আজকাল ছেলে-মেয়ে বুড়োবুড়ি আইন-টাইন মানলে তো? সরকার তো নিজের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত।

কর্নেল বললেন, তাহলে সেরকম কিছু ভেবেই তন্দ্রার ব্যাপারে থানায় জানাননি, বলতে চান?

হ্যাঁ, স্যার। এসব আকছার ঘটে কি না।

মিঃ আলি, তন্দ্রার জিনিসপত্র সার্চ করেছে?

আলি বললেন, করেছি স্যার। তেমন সন্দেহজনক কিছু পাইনি। মানে–এই কেসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমন কিছু। শুধু এই চিঠি দুটোই যা পেয়েছি।

তন্দ্রার শিক্ষা-দীক্ষার সার্টিফিকেট?

আছে স্যার। বি এ সারটি…।

আর কোনও চিঠিপত্র?

কয়েকটা আছে ওর স্যুটকেসে। খুব পুরনো। মনে হলো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের লেখা সব।

একটু পরে আমাকে একবার তার ঘরে নিয়ে যাবেন, মিঃ আলি।

নিশ্চয়, স্যার?

ভারতবাবুকে নিয়ে গিয়ে আপাতত লাশটা দেখান। দ্যাটস ইওর রুটিন জব।বলে কর্নেল সেনাপতির দিকে মৃদু হেসে কটাক্ষ করলেন।

সেনাপতি বললেন, ইয়েস মিঃ আলি। ভারতবাবু, যান দেখে আসুন।

ওঁরা চলে গেলেন লাশটার দিকে। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন, নটা পনের। তারপর আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ পরিষ্কার। শুধু পাখিদের আনাগোনা আছে। সাত মাইল দূরে একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি রয়েছে, তাই এত পাখির আনাগোনা। বাঁহনোকুলারটা আনলে ভাল হতো। কর্নেল আকাশ দেখতে থাকলেন।…

একটু পরে ভারতবাবুরা ফিরলেন জমি থেকে। ভারতবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেছে এবার। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। হাঁ, স্যার, তন্দ্রা ভাদুড়ী। উঃ ভগবান! অমন জলজ্যান্ত মেয়েটা–এ এক অসম্ভব দৃশ্য স্যার! এর বিহিত হওয়া দরকার। দেশে আইন-কানুন থাকতে এসব আর চলতে দেওয়া যায় না।

সেই সময় গেটের দিকে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল। তারপর দেখা গেল নব ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। আর তার পিছনে একদল লোক তাড়া করেছে। তাদের মধ্যে লালটুপিও দেখা যাচ্ছিল। এখানে কর্নেল বাদে সবাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেছেন আগের মতো। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছেন।

নব প্রায় হুমড়ি খেয়ে টেবিলের কাছে পড়ল। সে প্রচণ্ড হাঁফাচ্ছিল। কর্নেল উঠে তার হাত ধরে টেনে তুললেন। ভিড়টাও এসে পড়ল সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। কর্নেল সামরিক আওয়াজ দিলেন-বজ্রকণ্ঠ বলা যায়–স্টপ ইট! থামুন আপনারা।

ভিড়টাও হাঁফাতে থাকল খানিক তফাতে। নব শ্বাস-প্রশ্বাসের ফাঁকে বলে উঠল–পেয়েছি স্যার, পেয়ে গেছি! আজ সকালেই এটা পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল। ঝোপের ধারে দেখেছিলুম স্যার!

কর্নেল তার হাত থেকে দোমড়ানো চকচকে কী একটা নিলেন। তারপর হাসিমুখে অফিসারদের সামনে সেটা ধরে বললেন, এই সেই মুখোশধারীর ছোরা!

হ্যাঁ–রাঙতামোড়া খেলনার ছোরা। আচার্য বললেন, স্ট্রেঞ্জ! সেনাপতি হাঁ করে চেয়ে থাকলেন। কেবল শর্মা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বসে পড়লেন।

কর্নেল বললেন, গত রাতে শার্কে একটা মজার নাটক অভিনীত হয়েছিল। স্রেফ নাটক বা ফার্সই বলব। খেলনার মুখোশ আর খেলনার ছোরা নিয়ে একটা রোগা টিঙটিঙে লোক ঢুকে পড়ে লম্ফঝম্ফ করেছিল। অন্য সময় এই ব্যাপারটার কী প্রতিক্রিয়া ঘটত বলা যায় না। কিন্তু কল্পনা করুন, বাইরে অশান্ত সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। বিচের একপ্রান্তে নির্জন একটা বার-কাম-রেস্তোরাঁ হাঙরে ওইরকম রাত্রিবেলার বিশেষ একটা পরিবেশে কাকেও ভয় দেখিয়ে কাবু করতে এই খেলনার মুখোশ আর রাঙতার ছুরিটা যথেষ্টই। হলফ করে বলতে পারি, আমি থাকলেও একইভাবে ভয় পেতুম এবং ভুল করে বসতুম। নবও প্রথম মুহূর্তে ভুল করে বসবে–সত্যি কিছু ঘটছে ভেবে। কিন্তু নবর মত একজন অভিজ্ঞ সুদক্ষ সাহসী লোক প্রথম মুহূর্তে ভুল করে ধোঁকাবাজিতে পড়লেও পরক্ষণে তার সহজাত ক্ষমতা আর অভিজ্ঞ ইন্দ্রিয়সমূহের অনুভূতিবলে টের পেয়েছিল যে এই ঘটনার কোথাও একটা গুরুতর অস্বাভাবিকতা আছে। তার কিছুক্ষণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ ওই অবচেতন মানসিক দ্বন্দ্ব। হ্যামবর মতো লোকের পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক। ভুলে যাবেন না, সে একজন নিরক্ষর মানুষ। এখনও প্রচুর সরলতা কোনও-না-কোনওভাবে প্রকৃতি তার মধ্যে টিকিয়ে রেখেছে। নবর মতো একজন খুনখারাপি মারামারিতে সিদ্ধহস্ত অভিজ্ঞ মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা-সংস্কৃতির ফলে যুক্তিজ্ঞান আয়ত্ব করলে হয়তো সে হো-হো করে হেসে উঠত। নয়তো তক্ষুনি এগিয়ে দুথাপ্পড় কষে দিত। কিন্তু তার যুক্তিজ্ঞান কিছুটা সহজাত আর প্রকৃতি অবিশ্রান্ত ঘা মেরে মেরে যেটুকু তাকে দিতে পেরেছেন, তার যোগফল মাত্র। ভুলে যাবেন না, এদিক থেকে প্রতিটি নিরক্ষর মানুষের মধ্যে যে মৃদুতম আদিম ব্যাপারগুলি রয়েছে, তা আমরা প্রাণীদের মধ্যে পুরোপুরি দেখব। হাতে ঢিল না নিয়েও কিছু ছোঁড়ার ভঙ্গি করলে কাকটা যতই দেখতে পাক যে হাত খালি, তবু ভয় পেয়ে একটু সরে যাবে। কিন্তু নব প্রাণী নয়, মানুষ। তাই সে অবচেতন দোটানায় পড়েছিল। যাক্, এত বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। আশা করি, তার তত্ত্বালীন মানসিক অবস্থা বোঝাতে পেরেছি। ছোরাটার দিকেই তার বেশিমাত্রায় চোখ পড়া স্বাভাবিক। এবং পড়েছিলও। তার নিশ্চয় কোনও সন্দেহ জেগেছিল–হয়তো সেটা অবচেতন বিহ্বলতার মধ্যে।…

নব বলল, কেমন সন্দেহ লাগছিল–ছোরাটা কেমন যেন…

হ্যাঁ। তাই শেষ অব্দি নব আর ও ব্যাপারে উৎসাহী হয়নি। আমি মার্ডার কেসে দুটো দিকে সচরাচর লক্ষ রাখি। তাই থেকে সিদ্ধান্তে আসি। প্রথমটা হচ্ছে খুবই ইমপরট্যান্ট : ব্যক্তিগত মানসিক প্রতিক্রিয়া। দ্বিতীয়টা হচ্ছে : ফ্যাক্টস। তথ্য বা বাস্তব ঘটনা। নবকে আমরা তার ওই নিষ্ক্রিয়তার জন্য আইনত কিংবা বিবেকের দিক থেকে খুব একটা দায়ী করতে পারিনে। এই সমুদ্রতীরে আজকাল যুবক-যুবতীরা প্রচুর ফার্সের অবতারণা করেন। প্রায়ই বিকেলে আমি দেখেছি, আবহাওয়া ভাল থাকলে অনেকে ছদ্মবেশের খেলা–যাকে বলে অ্যাজ ইউ লাইক গেম, খেলে থাকেন।

নব বলল, অনেকটা রাতে শুতে যাবার সময় আমি একবার ভেবেছিলুম স্যার, ওটা হয়তো ওনাদের সেই তামাশাবাজি। প্রায় দেখি, খেলনার পিস্তল নিয়ে ওনারা…।

ঠিক বলেছ, নব। তামাশাবাজি! কিন্তু আমাদের পক্ষে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, সেই তামাশাবাজির পরবর্তী ঘটনা–যা এই জমিতে দেখা গেল। এখন আমাদের ভাবতে হবে, সেই নিছক তামাশাবাজির সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কোনও যোগসূত্র আছে কি না।

আচার্য বললেন, আমার ধারণা, খুবই আছে। মেয়ে দুটিকে ওইভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল খুনীর। নিয়ে গিয়ে খুন করেছে।

শর্মা বললেন, আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা তা নয়। ওটা যে তামাশাবাজি, তা আমরা এখন জানলুম। প্রমাণ পেলুম। কিন্তু আসলে খুনীর ওটা একটা শো। খুন যে মুখোশধারীই করেছে, এটা দেখানো। পুলিশকে ভুল পথে চালানো তার উদ্দেশ্য ছিল।

কর্নেল বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ শর্মা। ওই তামাশাবাজি ঘটে যাবার পরে–আমি প্রমাণ যা পেয়েছি, তন্দ্রা আর তার সঙ্গী পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় যায়। নিশ্চিন্তে সিগারেট খায় দুজনে। ওখানেই বেডরুমে তাকে খুন করা হয়। তারপর এই জমিতে তার লাশ ফেলে যায় খুনী। কোন পথে লাশ এনেছিল, এখনও প্রমাণ পাইনি–যদিও সোজা বাংলো থেকে এই প্রাইভেট রাস্তা দিয়ে কিংবা গোলাপক্ষেত পেরিয়ে আসা তার পক্ষে সহজ ও স্বাভাবিক ছিল।

সেনাপতি বললেন, গোলাপক্ষেতে কোনও পায়ের দাগ পাইনি স্যার।

রাস্তাতেও পাইনি।

গোলাপক্ষেতে রক্তের কোনও চিহ্নও পাওয়া যায়নি।

রাস্তাতেও না। তাহলে লাশ কোন পথে এল?

সদর গেট দিয়ে আসতে পারে। কিন্তু গেট তো বন্ধ ছিল। ভোমরলাল!

ভোমরলাল এগিয়ে এল..বলুন স্যার!

সেনাপতি বললেন, সকালে আজ কখন গেট খুলেছ?

আপনাদের আসার একটু আগে।

তালা বন্ধ ছিল রাত্রে?

হ্যাঁ, স্যার।

অমনি গোপালকিশোর লাফিয়ে এল। ভোমরলাল, মিথ্যে বলো না। আমি লাশটা দেখে সদর গেট খুলেই দৌড়ে গেছি। তখন গেটের তালা খোলা ছিল ঝুলছিল কড়ায়। তুমি এখন ঢাকছ। চাকরি যাবার ভয়ে তো? ও আমি বুঝেছি।

ভোমরলাল ঘাবড়ে গেল। ঘাড় চুলকোতে লাগল।

গোপালকিশোর বলল, ভোমরলালের এ অভ্যাস আছে স্যার। ও সন্ধ্যে থেকে নেশা চড়ায়। তারপর নেশার ঘোরে রাত্রে গেটে তালা দিতে ভুলে যায়। এজন্যে সায়েব কতবার ওকে বকেছেন। গাঁজার কল্কেয় টান দিয়ে ও খাটিয়ায় গিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকে। তার ওপর কাল বৃষ্টি হচ্ছিল প্রচণ্ড। বেড়াল স্যারও একটা বেড়াল! জলকে বেজায় ডরায়।

সবাই হেসে উঠল। ভোমরলাল কঁচুমাচু মুখে বসে পড়ল একপাশে।;

সেই সময় কর্নেল এগিয়ে গেলেন ভিড়ের দিকে। তারপর তার অভ্যাস মতো একটু কেশে বললেন, আপনারা আশা করি সবাই স্থানীয় বাসিন্দা?

ভিড় থেকে একবাক্যে সাড়া এল।

আপনারা কেউ বলতে পারেন, গত রাত্রেধরুন, রাত নটার পরে, আগে নয় কিন্তু কেউ হরিধ্বনি শুনেছেন? ফার্মের মালী হাসিরাম আমাকে বলেছে, কাল অনেকটা রাত্রে সে কোথাও মড়া নিয়ে যাওয়ার হরিধ্বনি শুনেছে। কেউ আপনাদের মধ্যে

একজন মধ্যবয়সী সাধারণ মানুষ এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। বলল, হ্যাঁ– স্যার। বৃষ্টি তখনও হচ্ছিল। আমার স্টেশনারী দোকানের ঝপ বন্ধ করতে গিয়ে দেখলুম, ভিজতে ভিজতে কারা মড়া নিয়ে যাচ্ছে। হরিধ্বনিও দিচ্ছে। তখন রাত এগারোটা প্রায়। কলকাতায় মাল আনতে তোক পাঠাবার কথা ছিল আজ সকালে। তাই স্টক মিলিয়ে লিস্ট করছিলুম।

আপনার নাম?

আজ্ঞে, হরিহর মহাপাত্র। সোনালি স্টোর্স দেখেননি স্যার? অবজারভেটরির পাশেই। বাজারে জায়গা পাইনি–তাই একটেরে দোকান করেছি।

মড়া যারা বইছিল, তাদের চেহারা কীরকম?

অতটা লক্ষ করিনি। আবছা দেখেছিলুম। সঠিক বর্ণনা দিতে পারব না স্যার।

চারজন ছিল?

চারজন? হুঁ–তাই তো থাকে স্যার। না–না, পাঁচজন–পাঁচজন ছিল।

খাটিয়া ছিল নিশ্চয়?

খাটিয়া–মানে খাট-ফাট ছিল না–সেটা দেখেছি। দুটো বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা মাচা মতো ছিল যেন।

ভেবে বলুন।

হ্যাঁ-স্যার। ভেবেই বলছি। বৃষ্টির মধ্যে তো–আবছা হলেও রাস্তার আলো ছিল। এক পলক দেখেই নিজের কাজে ব্যস্ত হলুম স্যার। রাত্রিদিন তো কত মরছে নিয়ে যাচ্ছে। দূরের সব গ্রাম থেকেও লোকেরা এপথে মড়া নিয়ে সমুদ্রের ধারে শ্মশানে আসে। কত দেখছি অ্যাদ্দিন ধরে! হরিহরবাবু নিরাসক্ত দার্শনিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন।

মিঃ সেনাপতি, এই ব্যাপারটা আপনি একটু খোঁজ নিন। গত রাত্রে যে মড়াটা এসেছিল, তা কোথা থেকে। শ্মশানেও লোক পাঠান। কারা বয়েছিল, তাও জানুন।

সেনাপতি অবাক হয়ে বললেন–মড়া! আচার্য আর শর্মা হেসে উঠলেন।

কর্নেল বললেন, হ্যামড়া। কাল রাত নটার পর মনে রাখবেন রাত নটার পর থেকে বৃষ্টি না থামা অব্দি অর্থাৎ রাত দুটো পর্যন্ত কোনও মড়া কারা রয়েছে, কার মড়া ইত্যাদি ডিটেলস খবর খুব জরুরী।…তিনি এবার শান্তভাবে চুরুট ধরালেন। ফের বললেন, এবার আমাকে সেই ছেঁড়া কাগজগুলো দিন।

.

০৮.

পানিগ্রাহী ও সুমন্তের বৃত্তান্ত

এখন বেলা এগারোটা। কর্নেল, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর ডঃ শর্মা এবং এ.এস. আই. বরকত আলি একসঙ্গে সী-ভিউ হোটেলের লাউঞ্জে পৌঁছেই ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেয়ালে একটা বিরাট গোল ঘড়ি টকটক আওয়াজ দিচ্ছিল। আওয়াজটা আকৃষ্ট না করে পারে না।

ভারতবাবু কথামতো আগেই চলে এসেছিলেন। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ঘড়িটার বয়স স্যার তিন পুরুষ। আমার কর্তাবাবার আমলের বিলিতী জিনিস। আজকালকার পরিবেশে মানায় না।

তিন জনে সপ্রশংসদৃষ্টে ঘড়িটা দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। চারতলা বিরাট হোটেল। দোতলায় তিনটে সিঙ্গল, তিনটে ডবল সুইট রয়েছে। প্রত্যেকটাই এয়ার কণ্ডিশনড। চমৎকার আধুনিক ব্যবস্থা। অনেকটা করে কাচের দেয়াল বিশাল দামী সব পর্দা ঝুলছে। চওড়া লাউঞ্জ রয়েছে ওপরে। সামনেও কাচের গোল দেয়াল। সেখানে বসলে মনে হয়, সমুদ্রে ভেসে আছে বাড়িটা। গাছের টব আছে অগুনতি। ভারতবাবু দেখতে সেকেলে টাইপ, কিন্তু একেলে রুচি তার হোটেলের আষ্টেপৃষ্ঠে ছাপ ফেলেছে।

ওপর-নিচে দুজন করে পুলিশ প্রহরী রয়েছে। আলির ইশারায় সুইট নম্বর সি খুলে দিল একজন সেপাই। এয়ার কণ্ডিশনড চালু করলেন ভারতবাবু। বন্ধ ছিল আজ সকাল থেকে। মিছিমিছি পয়সা খরচ করার পক্ষপাতী তিনি নন। তারপর বললেন, আমার থাকার কি দরকার হবে স্যার?

কর্নেল বললেন, না–আপনি আপনার জায়গার গিয়ে বসুন ভারতবাবু। তেমন দরকার পড়লে খবর দেব।

ভারতবাবু চলে গেলেন। সিঙ্গল সুইট হলেও দুজনের শোবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা খাট ছাড়াও সোফা-কাম-বেড রয়েছে একপাশের দেয়ালে। খাটের বিছানা খুব সুন্দরভাবে গোছানো। কর্নেল বিছানাটা সাবধানে পরীক্ষা করলেন। বালিশের নিচে একটা লেডিজ রুমাল পাওয়া গেল, কোণে একটা গিট। অকারণ গিট–ভিতরে কিছু নেই। আর একটা কোণা পরীক্ষা করে কর্নেল বললেন, তার একটা অভ্যাসের পরিচয় পাচ্ছি। রুমালে গিট দেওয়া আর কোণা চিবুনোর অভ্যেস। সচরাচর এই অভ্যাস সরলতার প্রতীক। গোবেচারা ধরনের, ভীতু, লাজুক মেয়েদের এ অভ্যেস লক্ষ্য করা যায়।

শর্মা বললেন, ঠিক, ঠিক।

শার্কের টেবিলে বসে সে কাগজ ছিঁড়ছিল–এও ওই অভ্যাসের অন্তর্গত কিন্তু। অনেক সময় এই স্বভাবের লোকেরা নিজের অজান্তে দামী কাগজপত্র, এমনকি নোটও ছিঁড়ে ফেলে। আমি মনস্তত্ত্ব নিয়ে সামান্য নাড়াঘাটা করেছি। বলতে পারি, এই টাইপের লোকেদের জীবনে একটা চাপা কোনও দুঃখবোধ থাকে–যা নানা কারণের জন্যে হতে পারে। বাল্যে অবহেলা, কিংবা মানসিক প্রচণ্ড আঘাত পাওয়া–কোনও তীব্র সাধ না মেটা ইত্যাদি। আমার ধারণা তন্দ্রার এরকম কিছু ছিল।

বিছানায় আর কিছু পাওয়া গেল না। ওয়াড্রোব খুলে কিছু কাপড় চোপড় পাওয়া গেল। কর্নেল বাথে ঢুকলেন। বাথ টয়লেট প্রিভি একত্রে। তোয়ালে সাবান টুথব্রাশ যা যা লাগে, সবই রয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলেন না কর্নেল।

ফিরে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ালগুলো তন্নতন্ন খুঁজলেন। একটা চকলেটের প্যাকেট পাওয়া গেল। কিছু প্রসাধনী। আর কিছু না।

এবার স্যুটকেস ও গোটানো বেডিংটা পরীক্ষার পালা। বেডিংটা এককোণে হোল্ডলে গোটানো রয়েছে। ভোলা হলো। তন্দ্রা একটু বিলাসী মেয়ে, তার পরিচয় সবখানে রয়েছে। কিন্তু সূত্র বলতে যা বোঝায়, মিলল না।

স্যুটকেসটা আগেই আলি তালা ভেঙে দেখেছিলেন। এখনও দেখা হলো খুলে। একটা ছোট্ট ফাইলে তার শিক্ষাদীক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। কলকাতার একটা কলেজের ছাত্রী ছিল সে-দুবছর আগে বি.এ. পাশ করেছে। কর্নেল বললেন, এই দুটো বছর তন্দ্রা চাকরি করে থাকলে অন্তত এসব ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট থাকত–সে সঙ্গে আনত নিশ্চয়। তা যখন নেই, তখন.. বলে হঠাৎ থামলেন তিনি। স্যুটকেসে কয়েকটা ভাঁজকরা জামা কাপড়ের নিচে তলার দিকে হাত চালিয়ে একটা নীল ইনল্যাণ্ড লেটার বের করলেন।

আলি শশব্যস্তে বললেন, আমি খুব খুঁটিয়ে কিছু দেখিনি স্যার। চোখ এড়িয়ে গেছল, দেখছি। কী ওটা?

কর্নেল বললেন, তাকে লেখা পানিগ্রাহীর তৃতীয় চিঠি। এটাই আমি এতক্ষণ খুঁজছিলুম।

তিনি চিঠিটা একান্তে নিয়ে গিয়ে খুললেন–কিছু মনে করবেন না আপনারা আগে আমি দেখে নিই।

আলির মুখটা গম্ভীর দেখাল। শর্মা মুচকি হাসলেন মাত্র।

চিঠিটা পড়া হলে কর্নেল বললেন, মিঃ শর্মা, সকাল থেকে আমি মূল যে জিনিসটা হাতড়াচ্ছিলুম-খুনের মোটিভ সম্ভবত পেয়ে গেছি। মোটিভটাই ভাইটাল ব্যাপার যে-কোনও খুনের কেসে। ডাক্তাররা যেমন বলেন, রোগ ধরা পড়াটাই চিকিৎসার অর্ধেক তেমনি মোটিভ ধরা পড়লেই খুনীকে ধরা সহজ হয়ে ওঠে। যাই হোক, মিঃ শর্মা বরাবর মুখ বুজে থাকলেও চন্দরপুর-অন-সীতে যে অকারণে আসেননি–তা আমার মাথায় ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে–মোটামুটি জানতে পেরেছি।

আলি চাপা গলায় সরল মুখে শর্মাকে প্রশ্ন করলেন ব্ল্যাকমানি কেস, স্যার?

শর্মা হাসলেন।–না, মিঃ আলি। অন্য ব্যাপার। পরে জানতে পারবেন।

কর্নেল শর্মার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, মিঃ শর্মা, এবার প্লীজ– আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিলে অনেক জটিলতা সেরে যায়।

শর্মা হেসে বললেন, অবশ্যই। বলুন, কী জানতে চান?

প্রথম প্রশ্ন : মিঃ মদনমোহন পানিগ্রাহী এখন কোথায়?

গভমেন্ট গেস্ট হাউসে।

উনি কবে এসেছেন?

একুশে জুলাই রাত্রে।

আপনি কবে এসেছে?

আজ সকালে।

আপনাকে উনি ডেকেছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ। গতকাল দুপুরে ট্রাঙ্ক করেন দিল্লিতে। প্লেনে কলকাতা চলে আসি। আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্লেন দমদম পৌঁছতে তিনঘণ্টা দেরি করে। তারপর রাত বারোটায় একটা সরকারী জীপ নিয়ে একা রওনা হই। পৌঁছেছি আজ ঠিক সাতটায়। পৌঁছে পুলিশ ইন্সপেক্টর আচার্যকে ফোন করেছিলুম। তাকে গেস্ট হাউসে তক্ষুনি চলে আসতে বলেছিলুম।

পাণিগ্রাহী আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন?

হ্যাঁ। দুঃখের সঙ্গে জানালেন–সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। এমনকি উনিই উল্টে বিপদে পড়েছেন।

ওয়েট। কর্নেল হাত তুললেন।পানিগ্রাহী প্রকাশ্যে আসছেন না কেন?

শর্মা বললেন, আসলে হয়েছে কী জানেন? বিরোধী রাজনৈতিক দল তো ওঁর বিরুদ্ধে নানা স্ক্যাণ্ডাল বরাবর রটাচ্ছে। ওঁর ভয় হচ্ছে, এটা নিয়ে আবার কাগজে হই-চই শুরু হলে ওঁর কেরিয়ারটি খতম হয়ে যাবে। তাই উনি বলছিলেন, খুনের মীমাংসা হয়ে গেলেই বরং ফার্মে আসবেন। তার মানে প্রকাশ্য হবেন।

আমি এখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, মিঃ শর্মা। খুবই জরুরী।

চলুন–আপত্তি নেই। তবে

বুঝেছি। আমরা গোপনেই যাব। ধরুন, গেস্ট হাউসে আপনার ঘরেই চলেছি।

দ্যাটস রাইট। মিঃ আলি, প্লীজ ইট ইজ টপ সিক্রেট।

আলি বললেন, ইয়েস স্যার।

দুজনে বেরিয়ে এসে নিচে নামলেন। ভারতবাবু সবিনয়ে এগিয়ে দিলেন লন অব্দি। হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, মিঃ শৰ্মা, যাবার পথে একবার শার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে যাব।

তাই চলুন। বরং ফার্মের ওখানে খবর পাঠালে পুলিশ ড্রাইভার দিয়ে আমার জীপটা পাঠিয়ে দিত।

থাক। আমরা পায়ে হেঁটেই যাই। মেঘ করেছে–বোদ কমে যাচ্ছে। বলে কর্নেল একবার আকাশ দেখে নিলেন। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে।

দ্য শার্ক-এর সামনে এসে কর্নেল দাঁড়ালেন। ভিতরে ঢুকলেন না। সামনের লন ও জমিটা খুঁটিয়ে দেখে পা বাড়াচ্ছেন, সেই সময় নব বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। কর্নেল বললেন, কতক্ষণ এসেছ নব?

এইমাত্র, স্যার। আসুন, ভেতরে আসুন।

না। পরে আসবখন। শোনো নব, এসেছ ভালই হলো। তুমি তো খুব কড়া নজরের মানুষ, এস–আমরা আশপাশটা খুঁজে দেখি।

কী খুঁজতে হবে স্যার? নব হাসল।…আবার কোনও খেলনা-টেলনা নাকি?

কর্ণেল গম্ভীর হয়ে বললেন, একজ্যাক্টলি। ঠিক তাই।

মুখোশটা স্যার?

হ্যাঁ–মুখোশ তো বটেই। আর–আর ইয়ে–ইয়ে-ধরো বেলুন।

বেলুন!

হ্যাঁ। একরকম বেলুন নিয়ে বাচ্চারা খেলে না? জল ভরা থাকে!

ওই তো স্যার, একটা পড়ে আছে।..বলে নব দৌড়ে গিয়ে রেস্তোরাঁর পিছন দিক থেকে একটা জলভরা বেলুন কুড়িয়ে আনল।

কর্নেল সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, জলটা পড়ে যায়নি। তবে সুতোটা ছিঁড়ে গেছে। নব, আরেকটা ঠিক এমনি বেলুন আমাদের দরকার।

নব লাফিয়ে উঠল।…স্যার, স্যার! ওইরকম একটা বেলুন পড়ে থাকতে দেখেছি। দাঁড়ান, এক মিনিট! আনছি। তখন দৌড়ে যেতে গিয়ে পায়ের চাপে পট করে ফেটে গিয়েছিল–ওই যে রাস্তার ওপর।

শর্মা অবাক হয়ে বললেন, বেলুনে কী আছে কর্নেল?

মিঃ পাণিগ্রাহী আপনাকে তাহলে সবটা বলেননি?

না তো–বেলুন সংক্রান্ত কোনও কথা নাঃ! ষ্ট্রেঞ্জ!

পানিগ্রাহীর সঙ্গে আজ সকালের দিকে কেউ দেখা করতে যায়নি?

না, না। তিনি তো গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এক্কেবারে আউট অফ সারকুলেশন যাকে বলে। কেউ জানেও না, তিনি এখানে আছে–শুধু ম্যানেজার ছাড়া।

ম্যানেজার বিশ্বাসী?

নিশ্চয়। সে আমাদের ব্যুরোর লোক। ডেপুটেড স্টাফ।

তাহলে অনেকদিন যাবৎ আপনারা চন্দনপুর অন-সীর ওপর নজর রেখেছেন?

নিশ্চয়?

সেই সময় ফাটা চুপসে যাওয়া ধূসররঙের আর একটা বেলুন নিয়ে নব দৌড়ে এল।…ফেটে গেছে বলে অসুবিধা হবে না তো স্যার?

কর্নেল সেটা নিয়ে বললেন, না। পেয়েছি, এই যথেষ্ট। আচ্ছা, চলি নব। মুখোশটা না পেলেও আমার চলবে–ওজন্যে তুমি মিছে পরিশ্রম করো না। চলুন, মিঃ শর্মা।

দুজনে প্রায় আধ মাইল হেঁটে সরকারী অতিথিভবনে পৌঁছলেন। সারা পথ। দুজনে যা কথা হলো, তা এই কেস সংক্রান্ত নয়। আবহাওয়া, পঞ্চবার্ষিক যোজনা, আয়কর আদায় সমস্যা–এইসব। কর্নেল টের পাচ্ছিলেন–যাই করুন, তিনি আসলে একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের ভূমিকা নিয়েছেন কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর সরকারী অফিসার শ্রী শর্মা খুব সহজে তাকে কোনও সরকারী গোপনতথ্য জানাবেন না এবং সেটা বিধিবহির্ভূতও বটে।

নীচের লাউঞ্জে ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে শর্মাকে স্বাগত জানালেন। শর্মা চাপা গলায় বললেন, কোনও ভিজিটার এসেছিল আমার নাম করে?

না, স্যার।

মিঃ সত্যচরণ দত্তের কাছে?

একটি ছেলে এসেছিল স্যার। ফোনে জানাতেই মিঃ দত্ত. পাঠিয়ে দিতে বললেন।

সে কী! কীরকম ছেলে?

বছর একুশ-বাইশ বয়স হবে–ফরসা।

কর্নেল বললেন, মাথায় লম্বা চুল ছিল?

ম্যানেজার অবাক হয়ে বলল, না তো! ছোট-ছোট চুল।

কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। শর্মা বললেন, যাক্ গে–সে মিঃ দত্তের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ছেলেটি কখন গেল? কতক্ষণ ছিল?

ম্যানেজার একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মধ্যে কিছুক্ষণ ছিলুম না–স্যার। কখন গেছে, জানিনে। এসেছিল সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিশ্চয় চলে গেছে।

ভিজিটরস বুকে রেকর্ড রাখা হয়েছে?

হ্যাঁ স্যার, দেখাচ্ছি।

থাক। চলে যাওয়ার সময়ের রেকর্ড নিশ্চয় রাখেননি?

রাখিনি স্যার–পরে মিঃ দত্তের কাছে জেনে নিয়ে রাখব ভেবেছিলুম।

ভেবেছিলেন কিন্তু … ঘড়ি দেখে শর্মা বললেন–এখন পৌনে বারো। এখনও তা জেনে নেননি। এটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় কিন্তু। অমনভাবে আপনাকে বলা হল তখন!

বলে তিনি ম্যানেজারের কৈফিয়ত শোনার গরজ না দেখিয়ে হনহন করে গিয়ে সিঁড়িতে উঠলেন। কর্নেল তাকে অনুসরণ করলেন।

দরজায় কার্ড আটকানো ছিল : মিঃ সত্যচরণ দত্ত। দরজা খুলে দিলেন এক ভদ্রলোক–উজ্জ্বল গৌর রঙ। মাথায় টাক। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। শক্ত সমর্থ গড়ন। মুখে যুবকের দীপ্তি রয়েছে। শর্মা পরিচয় করিয়ে দিলেন।… মিঃ পানিগ্রাহী।… প্রখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

কর্নেল ঘরের কোণের দিকের সোফায় তরুণটিকে লক্ষ্য করে বললেন, আশা করি–উনিই শ্ৰীমতী এস রায়?

তরুণটি কাঁচুমাচু মুখে হাসল। পাণিগ্রাহী অবাক হয়ে হাঁ করে তাকালেন কর্নেলের দিকে। বুদ্ধিমান শ্ৰী শৰ্মা হো-হো করে হেসে উঠলেন।

কর্নেল তরুণটির পাশে গিয়ে বসে বললেন, সকালেই চুল কাটা হয়েছে দেখছি! মাই ইয়ং ফ্রেণ্ড, অনেক কথা আছে। আপাতত আমি মিঃ পাণিগ্রাহীর সঙ্গে আলাপটা সেরে নিই। বাই দা বাই, এই বেলুন দুট নিশ্চয় আমার তরুণ বন্ধুটির সুপরিচিত?

ঘরে হাসির শব্দ হলো দ্বিগুণ। পানিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত, কর্নেল সরকারের নাম তুমি জানো না সম্ভবত। তার কাছে কিছু চাপা থাকে না। যাক গে, কর্নেল আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে এমন সময়ে আপনাকে আমরা পেয়ে গেছি। বেচারা তন্দ্রার জন্যে কিছু করতে পারার সাহস এবার এসেছে আমার মধ্যে।

কর্নেল পানিগ্রাহীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি পি. এর জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? কোন কোন কাগজে?

কলকাতার তিনটে ইংরেজি কাগজে।

দেখুন তো তন্দ্রাকে লেখা এই তিনটে ইনল্যাণ্ড চিঠি আপনার নাকি? বলে কর্নেল চিঠি তিনটে পানিগ্রাহীর হাতে দিলেন।

পানিগ্রাহী দ্রুত চোখ বুলিয়েই বললেন, হ্যাঁ–আমারই।

এই তিন নম্বর চিঠিটার তারিখ হচ্ছে ৮ জুলাই। যে নির্দেশ তাকে দিতে চেয়েছিলেন, তা এতে রয়েছে। আপনি সী ভিউ হোটলের মালিক ভারতবাবুর গতিবিধির ওপর চোখ রাখতে বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন, ভারতবাবুর মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা আছে। কোন স্ত্রীলোকের সঙ্গে কীভাবে মিশনে জানাতে হবে। আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, তন্দ্রা যে এ ধরনের কাজে রাজী হবে এবং অছাড়াও ভারতবাবুর মতো ব্যবসায়ী মানুষকে পটানোর ব্যাপারে তার ক্ষমতা আছে তা আপনি কীভাবে জানলেন?

পাণিগ্রাহী একটু অপ্রস্তুত হলেন যেন।…না–মানে ওর ফোটোই ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে দিয়েছিল। আমার মহিলাদের সম্পর্কে… একটু হাসলেন পানিগ্রাহী— আধুনিক মহিলাদের ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে, কর্নেল!

ফটো দেখে কী বৈশিষ্ট্য টের পেয়েছিলেন?

সেক্সি গড়ন। বিশেষ করে চোখ দুটো। ওই চোখ আমি চিনি।

আরও অনেক ছবি আর দরখাস্ত আপনি পেয়েছিলেন কি?

নিশ্চয়। প্রচুর প্রচুর! আপনি দেখতে চাইলে…

থাক। তাদের মধ্যে তাকেই আপনি বেছে নিলেন?

দ্যাটস রাইট।…বলে পানিগ্রাহী একটু ইতস্তত করে ফের বললেন, থাক,

লুকোব না। এই সুমন্তর সুপারিশেই ওকে আমি নিই।

কর্নেল তার দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু মিঃ পানিগ্রাহী, ভারতবাবুর কালো টাকা, নিষিদ্ধ ড্রাগের কারবার ইত্যাদি কুকর্মের ব্যাপারে নজর রাখার জন্য উপযুক্ত সরকারী কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। আপনি তাদের জানালেই তো সেকাজ তারা সরকারী খরচ আর উৎসাহ-উদ্যমে চালাতে পারতেন। বরং আরও ভাল পারতেন তাদের সব বিশেষজ্ঞ আছেন। তা না করে আপনি নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ব্যক্তিগত উদ্যমে সেকাজে কেন নামতে গেলেন?

পানিগ্রাহী ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। হন্তদন্ত বললেন, নামব না কী বলছেন কর্নেল? আপনি জানেন না, এর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক কেরিয়ার আর অ্যামবিশান জড়িয়ে আছে! গত ইলেকশানে ভারতবাবু আমার বিরোধীদলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেতাবার জন্যে লাখ টাকা খরচ করেছিল। সে ওদের সমর্থক। ওদের পার্টির ফাণ্ডে সে নিয়মিত মোটা টাকা দেয়। ওদের একটা জীপও দান করেছে সে। এ এলাকায় আমার নামে যত কুৎসা রটানো হয়েছে, তার মূল ওই লোকটাই–তা জানেন?

তাই বুঝি?

নিশ্চয়। আর দেখুন, মিঃ শর্মার সামনেই বলছি স্থানীয় পুলিশ বলুন, এনফোর্সমেন্ট বলুন, কাস্টমস বলুন–আমার জানা হয়ে গেছে! সব ওই ভারতের কাছে টিকি বাঁধা রেখেছে। আপনার তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা কী করবে, আমার ভালই জানা আছে। আর সেজন্যেই তো খোদ দিল্লি থেকে একেবারে সি. বি. আই. এর বড়কর্তাকে আসার জন্যে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম। আপনার সামনেই উনি বসে আছেন। জিগ্যেস করুন ওঁকে। এর জন্যে হোম মিনিস্টারকে ধরতে হয়েছিল পর্যন্ত।..বলে উত্তেজিত পানিগ্রাহী একটু দম নিলেন। ফের বললেন, এর আগে বিস্তর চেষ্টা করেছি সরকারের লোকজনকে দিয়ে। তাদের এই এক কথা–ভারতবাবুর ব্যাপারে সন্দেহজনক কিছু নেই। বুঝুন তাহলে। অথচ আমি জানি–ভালভাবেই জানি যে লোকটা নিয়মিত ড্রাগের চোরা কারবার চালায়। হোটেল থাকায় সুবিধে হয়েছে। বিদেশী গলার হোটেলে এসে ওঠে। কোনও সন্দেহ করার উপায় নেই। লেনদেন দিব্যি চলে। আসে বিদেশী ড্রাগ এল. এস. ডি. যায় গাঁজা আর কোকেন। আসে ভেনডিটা ক্যাপসুল, যায়। আফিং। আসে…

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, বুঝলুম। তাছাড়া এটা নিশ্চয় রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতা হিসেবে আপনার নৈতিক কর্তব্যও বটে।

পানিগ্রাহী সোৎসাহে বললেন, একজ্যাক্টলি, একজ্যাক্টলি!

তাহলে ভারতবাবুর ওপর চোখ রাখবার জন্যে আপনি মিস তন্দ্রা ভাদুড়ী নামে একটি সেক্সি চেহারার মেয়েকে চাকরি দিলেন এবং ভারতবাবুর হোটেলে সুইট ভাড়া করে থাকতে নির্দেশ দিলেন। মিঃ পানিগ্রাহী, ২১ জুলাই তারিখটি তন্দ্রা আসার এবং সেইসঙ্গে আপনারও আসার জন্যে কেন বেছে নিলেন? কেন ২০, ১৯, ১৮, ১৭ কিংবা অন্য কোনও তারিখ নয়?

ঠিকই ধরেছেন কর্নেল সরকার! ওই তারিখে আসতে বলার উদ্দেশ্য ছিল। আমি কোনও সুত্রে জানতে পেরেছিলুম যে ২২ তারিখ রাত্রেই ভারতবাবু একটা মোটারকমের লেনদেন করবে। কিন্তু কীভাবে শয়তানটা আমার সব প্ল্যান টের পেয়ে ভাড়াকরা খুনী লাগাল তন্দ্রার পিছনে। মুখোশ পরে খুনী ফলো করল তন্দ্রা আর সুমন্তকে। তারপর…।

কিন্তু ওটা স্রেফ ফার্স মিঃ পানিগ্রাহী!

ফার্স? তার মানে?

কর্নেল রাঙতার ছুরির তথ্য জানালেন। পানিগ্রাহী হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, তাহলে তো ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, তাকে ওইরকম ভয় দেখিয়ে ভারতবাবু তাড়াতে চেয়েছিল এখান থেকে?

এও হতে পারে। আই এগ্রি। কিন্তু তন্দ্রা খুন হলো সত্যি সত্যি।

হ্যাঁ–খুন হলো?

মিঃ পানিগ্রাহী, এবার আমি ফের কিছু প্রশ্ন করি।

বলুন কর্নেল?

এই ছেলেটি–সুমন্ত, একে কোথায় পেলেন?

সুমন্ত আমার অনেকদিনের চেনা ছেলে। আমি ওকে আসতে বলে এসেছিলুম কলকাতা গিয়ে। তখনই ও বিজ্ঞাপন দেবার পরামর্শ দেয়। যাই হোক, আফটার অল তন্দ্রা মেয়ে, তার একটা রিস্কের ব্যাপার ছিল। তাই ভাবলুম, তার বয়ফ্রেণ্ড হিসেবে ও যদি নিছক বেড়াতে এসে তার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে গেছে–এভাবে তার কাছাকাছি থাকে, তাহলে সুবিধে হয়। তন্দ্রা আর আমার মধ্যে গোপন যোগাযোগের মাধ্যম হবে সুমন্ত। আজকাল তরুণ-তরুণীদের মেলামেশার রীতি ভারতবাবু তো চোখের ওপর দেখছে। তাই সন্দেহ হবে না!

আপনার তৃতীয় চিঠিতে তারই উল্লেখ আছে বটে। কলকাতা থেকে জনৈক এস. রায় দেখা করবে তাকে। তন্দ্রা যেন তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। তন্দ্রা সেই নির্দেশ পালন করেছিল জানতে পেরেছি। কিন্তু কেন সুমন্ত মেয়ে সাজল? বুকে এই বেলুনদুটো আটকে একেবারে মডগার্ল সেজে…

বাধা দিয়ে পানিগ্রাহী বললেন, পরে ভেবে দেখেছিলুম, সুমন্ত সঙ্গে থাকলে ভারতবাবুকে করতলগত করতে পারবে না তন্দ্রা। বয়ফ্রেণ্ডওয়ালা মেয়ের সঙ্গে সে। মিশতে সাবধানী হয়ে উঠবে। তার চেয়ে তার মেয়েবন্ধু হয়ে থাকাটা খুব সুবিধাজনক। সুমন্ত চৌকস ছেলে। রাজনৈতিক দলে কালচারাল সুখ্যাতি আছে কর্মী। হিসেবে। সে দরকার হলে মারামারি খুনোখুনিতেও সিদ্ধহস্ত।… বলে সস্নেহে সুমন্তর দিকে তাকালেন পাণিগ্রাহী। তারপর বললেন, যাই হোক–তখন আর হাতে সময় নেই। সুমন্তকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলুম, আমি কী নামে কোথায় থাকব…

তন্দ্রাকেও কি জানিয়েছিলেন পরে–মানে, সুমন্তর মারফত?

হ্যাঁ। তা–এই গেস্ট হাউসের বেয়ারাকে দিয়ে চিঠি পাঠালুম। আপনি সেই বেয়ারাকে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবেন।

থাক্, বলুন। সুমন্ত তখন কোথায় ছিল?

আমার বাংলোয়?

হুঁ–তাকে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়েছিলুম।

কিন্তু হাসিরাম তো একুশ তারিখ বিকেলে বাংলো সাফ করতে গিয়েছিল। সে তো কিছু বলল না।

হাসিরাম সুমন্তকে চেনে। সুমন্ত গত ইলেকশানে–এ বছর মার্চে আমার সঙ্গে বাংলোয় ছিল কয়েকদিন। তখন অবশ্য মাথায় লম্বা চুল ছিল না ওর। কিছুকাল আগে কলকাতায় ওর সঙ্গে দেখা হয়–তখন ওর মাথায় লম্বা চুল দেখেছিলুম। তাই আমার শেষ মুহূর্তে মতলব এসেছিল যে ওর যা মেয়েলি চেহারা, আনায়াসে মডগার্ল বলে চালানো যায়। অবশ্য বেয়ারার চিঠিতে আমি ওকে বুকে জলভরা বেলুন বাঁধতে লিখিনি।..হো-হো করে হাসলেন পাণিগ্রাহী। সুমও হাসল।

তাহলে হাসিরাম সুমন্তকে দেখেছিল বাংলোয়। সে আমার কাছে তাহলে কথাটা চেপে গেছে। আচ্ছা, মিঃ পানিগ্রাহী, এবার বলুন–২২ জুলাই রাত্রে আপনি কী কী করেছেন?

কথা ছিল–আমার সেই সোর্সের খবর সতি হলে সুমন্ত তক্ষুনি সোজা এখানে এসে আমাকে খবর দেবে। তাই ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে ছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি রেনকোট পরে বেরোলুম। তখন রাত সাড়ে দশটা। এই গেস্ট হাউসের পিছনেই একটা জংলা পথ আছে–টিলার গা ঘেঁষে আমার বাংলোয় পৌঁছেছে। আমি বেরিয়ে দোটানায় পড়লুম। সী ভিউতে যাব না, আমার বাংলোয়। সুমন্ত যদি আমাকে জানাত যে সে একুশ তারিখ রাত্রে বাংলোয় না থেকে হোটেলে তার কাছেই ছিল এবং পরের রাতেও থাকবে–তাহলে আমি বাংলোয় যেতুম না। অন্য প্ল্যান করতুম। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের আমি সত্যি বুঝতে পারিনে। সুমন্ত তন্দ্রার সঙ্গে রাত কাটাবে আর তন্দ্রা সব জেনেও তাতে আপত্তি করবে না–আমি ভাবিনি।

সুমন্ত চাপা স্বরে বলল, তন্দ্রা বরাবর আমার গার্লফ্রেণ্ড ছিল।

পানিগ্রাহীর স্বরে রাগ ও ভর্ৎসনা প্রকাশ পাচ্ছিল। বললেন, দা হেল অফ ইট! যা গে–আমি তখন উদ্বিগ্ন। ভাবলুম, বৃষ্টির জন্যে নির্ঘাৎ ভারতবাবুর প্ল্যান ভেস্তে গেছে-তাই তখনও কোনও খবর পাচ্ছিনে সুমন্তদের কাছ থেকে। তাই

এবার শর্মা মন্তব্য করলেন, না মিঃ পাণিগ্রাহী। এইসব রাত্রেই তাদের চমৎকার মওকা। আপনি কেন যে লোকাল থানায় মিঃ সেনাপতিকে কিছু বলে রাখেননি, সেটাই অবাক লাগছে আমার!

পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন, সেনাপতি! ও তো ভারতের লোক, মশাই! আমার সোর্স জানিয়েছিল…সেনাপতি-টেনাপতি সবাই সব জেনেও চুপ করে থাকবে।

শর্মা বললেন, কিন্তু আপনি এলাকার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা মিঃ পানিগ্রাহী।

পানিগ্রাহী চটে উঠলেন।…ওঁদের ওই ল্যাক অফ ভিসনের জন্যেই তো আমরা আমলাতন্দ্রের বিরুদ্ধে চেঁচাই। আপনারা মশাই বাস্তব অবস্থা কিছুমাত্র টের পান না। স্বয়ং মিনিস্টার না লাগলে আপনাদের টনক নড়ে না। আমি কোন ছার! আমি কী করতে পারি লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের! যখন এম এল এ ছিলুম, তখন পারতুম। এখন এম এল এ নই স্রেফ নেতা। মিনিস্টাররাও একশোটা কথা বললে তবে একটা কথায় কান পাতেন। আমি তো মশাই যাত্রাদলের রাজা–ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন, ফ্যাক্ট। তারপর কী হলো বলুন।

পানিগ্রাহী শান্ত হয়ে বললেন, আমি প্রথমে বাংলোয় যাওয়ার সিদ্ধান্ত করলুম। মাত্র গজ দশেক গেছি, দেখি, কে দৌড়ে আসছে। অন্ধকার ছিল–কিন্তু বিজলী চমকাচ্ছিল। সুমন্তকে চিনতে আমার ভুল হলো না। সুমন্তও আমাকে দেখতে পেয়েছিল। যাই হোক–ও আমাকে সাংঘাতিক খবর দিল। শার্কে বসে থাকার সময় কে ওদের মুখোশ পরে ছুরি নিয়ে তাড়া করে। দুজনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমার ফার্মে ঢুকে পড়ে। বাংলোতে যায়। সেখানে তাকে একা রেখে সে আমাকে খবর দিতে আসছিল।

একা রেখে! এই কাণ্ডের পরও? শর্মা এই প্রশ্ন করলেন।

সুমন্ত বললে, হ্যাঁ–ওকে সঙ্গে আনিনি। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে আর এইভাবে তাড়া খেয়ে তন্দ্রা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। তাছাড়া ওর দিকেই যেন ছোরাধারী লোকটার লক্ষ দেখেছিলুম বেশি। তন্দ্রা মেয়ে। আমার পক্ষে যা সম্ভব ওর পক্ষে তা নয়। তাই ওকে রেখে এসেছিলুম। বাংলোয় সে নিরাপদে থাকবে। ভিতর থেকে ভালোভাবে দরজা আটকাতে বলে আমি তবে বেরিয়ে এসেছিলুম।

পাণিগ্রাহী বললেন, সুমন্ত আমাকে খবর দিতেই আমি আরও উদ্বিগ্ন বোধ করলুম। আমার কাছে একটা লাইসেন্সড রিভলভার আছে। আমি আর সুমন্ত তক্ষুনি ফিরে গেলুম বাংলোয়।

কর্নেল বললেন, গিয়ে দেখলেন দরজা খোলা। আর বেডরুমে তন্দ্রা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে।

পানিগ্রাহী ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ–গিয়ে সেই ভয়ানক দৃশ্য দেখলুম। সুমন্তর এ ব্যাপারে মাথা খোলে সবসময়। সে আমাকে একটা চমৎকার পরামর্শ দিল। তা না করলে এই মার্ডারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ুক বা না পড়ুক–পড়ার চান্স তো থাকেই, প্রচণ্ড স্ক্যাণ্ডাল রটে যাবে। আমার পলিটিক্যাল কেরিয়ার নষ্ট হবে। তখন ওর কথা মতো

মড়াবওয়া লোক আর একটা খাটিয়া যোগাড় করলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি, কর্নেল।

সুমন্ত বলল, আমি বেরিয়ে প্রথমে গেলুম সমুদ্রের কাছে শ্মশানে। শ্মশান থেকে একটা মাচান নিয়ে এলুম। অনেক খাটিয়া বা মাচান ওখানে পড়ে থাকে দেখেছিলুম। এই মাচানটা টাটকা ছিল। সেটা বয়ে সোজা নাক বরাবর ফার্মের খোলা গেটে ঢুকে বাংলোয় আনলুম। আগে গেটটা খোলা রেখেছিলুম। তারপর মাচানে তন্দ্রার লাসটা চাপিয়ে ওপাশের বারান্দায় নিয়ে গেলুমতলায় পুরনো একটা ষেক দেওয়া হয়েছিল। রক্তগুলো ধুয়ে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু মোমবাতির আলোয় সেটা সহজ মনে হলো না। ভাবলুম, সকালে ধুয়ে ফেলব খন। হাসিরামকে সব জানাতে হবে। যাই হোক, লাশটা দুজনে বয়ে এনে বড়ো রাস্তার ধারে একটা বটতলায় রাখলুম। তখনও বৃষ্টি থামেনি। পানিগ্রাহীদাকে এখনে সবাই চেনে। উনি চলে গেলেন। আমি গেলুম ডোমপাড়ায়। গিয়ে বললুম– পাশের গ্রামের মড়া আমারই এক আত্মীয়া। বটতলায় বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়েছিলুম। মড়াবওয়া লোকগুলো সব মদদ খেয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে মড়া ফেলে পালিয়েছে। আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি। ওদের সাহায্য দরকার।…ওরা প্রথমে রাজি হলো না। সব তখন ঘুমের ঘোরে আর নেশায় টলছে তো! ওদের অনেক টাকা আর মদ খাওয়ানোর প্রস্তাবে রাজি হলো। চারজন লোক নিজেরা ঠিক করে দিল। তাদের নিয়ে পাশের খুঁড়িখানায় গেলুম। দেখি, তখনও সব মক্কেল রয়েছে। তিনটে বোতল কেনা হলো দিশী। ওরা সেখানে বসে খেল। তারপর আমার সঙ্গে বটতলায় এসে মড়া তুলল। অন্ধকার। বৃষ্টি পড়ছে। মাতাল হয়ে উঠেছে লোকগুলো। আমরা হরিধ্বনি দিতে দিতে এগোলুম।

কর্নেল বললেন, কিন্তু মড়া শেষ অব্দি শ্মশানে না নিয়ে মিঃ পানিগ্রাহীর ফার্মের জমিতে ফেললে কেন?

পানিগ্রাহী বললেন, ওটাই তো সুমন্তর অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি!

সুমন্ত বলল, শ্মশান থেকে মাচান লুকিয়ে আনা সোজা। কিন্তু মড়া নিয়ে যে যাব, শ্মশানের রেজিস্টারের চোখ এড়াবে না। ডেথ সার্টিফিকেট চাইবে। রক্তক্ত দেখতে পাবে, তাই

কর্নেল বললেন, একথা আগে ভাবোনি তোমরা।

না স্যার। তখন দুজনেরই মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। অতটা তলিয়ে ভাবিইনি। অন্ধকার রাতে বৃষ্টির মধ্যে ঝোঁকের বশে চলেছিলুম।

তারপর?

ফার্মের গেটের কাছে গিয়ে ঠিক করলুম–অন্য উপায় ঠিক করা যাক। আফটার অল, তা আমার গার্লফ্রেণ্ড–গভীর ভালবাসা কিছু ছিল না, কিন্তু তাহলেও স্যার–আমার মরালিটি যেটুকু আছে, তাতে বাধল। পাণিগ্রাহীদার সামনেই বলছি–আমার সন্দেহ হলো, বা রে! একটি অসহায় মেয়ে ওঁর কাজে এসেই খুন হলো। আর উনি পুলিশকে জানাবার বা খুনীকে ধরিয়ে দেবার যেন নামই করলেন না! উপরন্তু লাশটা সামলাতে বলছে! আমার বিবেকে বাধল, স্যার! আমি ঠিক করলুম–এমন কিছু করা দরকার যাতে পানিগ্রাহীদা বাধ্য হয়ে তার মার্ডারের কথা পুলিশকে জানাবেন কিংবা নিজের সম্মানরক্ষার জন্য খুনীকে ধরতে নিজের প্রভাব খাটাবেন। কিন্তু কিছুই করছেন না। তাই রাগ হলো। ওঁকে তন্দ্রার মার্ডারের সঙ্গে আমি জড়াবো ঠিক করলুম। তাই লোকগুলোকে দাঁড় করালুম। বললুম– দেখ–এখন বৃষ্টির মধ্যে লাশ চিতেয় ওঠানো অসম্ভব। রেজিস্ট্রারবাবুও হয়তো আফিং খেয়ে ঘুমোচ্ছন। সেই ভোরবেলা ছাড়া কিছু করা যাবে না। বরং এক কাজ করা যাক। লাসটা কোথাও ফেলে দিই। এত বৃষ্টির মধ্যে কী করা যাবে তোমরাই বলো? এখানটায় ফেললে মিউনিসিপ্যালিটির মেথররা তুলে কোথায় ফেলে দেবে-সঙ্কার হবে না। তার চেয়ে এই ফার্মের জমিতে ফেললে কাজ হবে। এক হোমরা-চোমরা নেতার জমি। ভোটের জন্যে ওনারা সব করেন-কী বলো? মাতাল লোকগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক, ঠিক। পানিগ্রাহীবাবুর জমিতেই ফেলে যাই। নির্ঘাৎ সদগতি হবে লাসটার। না করে উপায় আছে? লোকে বলবে– ওই দেখ, সামান্য খরচা করে উনি মড়াটা পোড়াতে পারলেন না! উনি আবার গরীবের হয়ে কাজ করবেন?.বুঝতেই পারছেন স্যার, মাতাল সাদাসিধে মানুষ সব। তখন ওদের দিয়ে যা খুশি করানো যায়। আমরা গেট দিয়ে ঢুকে লাশটা কোণার দিকে ফেললুম।

তোমাদের পায়ের দাগ নরম জমিতে নিশ্চয় থাকত। কিন্তু গোপালকিপোর ট্রাকটার চালিয়ে তা নষ্ট করে দিয়েছে। তবে মাচানের দুটো বাঁশের চাপে গর্ত থেকে গেছে। তোমরা মাচানের একদিক মাটিতে ঠেকিয়ে লাশটা ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে। তাই লাশের মাথা ও পায়ের কাছে দুটো গর্ত দেখলুম। দুটো বাঁশের মাথায় চাপা পড়ে গর্ত দুটো হয়েছিল।

তাই হবে।

তারপর?

তারপর চুপিচুপি লোক চারটে চলে গেল। নিষেধ করে দিলুম ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তা না হলে তারাও তো বিপদে পড়ে যাবে।

তুমি কী করলে।

প্রথমে আমি খাটিয়াটা নিয়ে গিয়ে শ্মশানে ফেলে দিলুম। তোষকটা আর দড়িগুলোসুষ্ঠু। তারপর ভিজতে ভিজতে ফিরলুম। তখন রাত একটা বেজে গেছে। আমি বাংলোয় গিয়ে রইলুম। আর কোন চুলোয় যাব, বলুন?… পানিগ্রাহীদার ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল। তাছাড়া কেমন সন্দেহও জাগতে শুরু করেছিল। ভারতবাবুর ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছিল… ।

পানিগ্রাহী ফুঁসে উঠলেন–যা-তা কী বলছ সুমন্ত?

কর্নেল বাঁধা দিলেন।..প্লীজ। সুমন্ত, তুমি বলো।

সুমন্ত বলল, ওই বাংলোয় রাত কাটানো কী দুঃসাধ্য তখন। যে-ঘরে যে বিছানায় শুয়েছি, তার একহাত দূরে তাকে কেউ স্ট্যাব করেছেউঃ! হরিবল। ঘুম তো হলোই না। বৃষ্টি ছাড়ল শেষরাত্রে। ভোরে উঠে বেরিয়ে চলে গেলুম পাহাড়ের ওপর আশ্রমে। অনেকক্ষণ কাটালুম। মাথা ঘুরছিল। তারপর সটান গেলুম সেলুনে। কারণ, বুঝতে পারছিলুম, আমার লম্বা চুল শক্ত হয়ে উঠেছে। তারপর সব জানতে পারলুম লোকের মুখে। সমুদ্রের ধারে-ধারে ঘুরে ঠিক করলুম, পানিগ্রাহীদার কাছে কৈফিয়ত নিতেই হবে। আগাগোড়া একটা ভাওতার মধ্যে কেন উনি আমাকে আর তাকে ঘোরালেন?..

পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন কিন্তু কর্নেল তার হাত ধরে নিবৃত্ত করে বললেন, অধৈর্য হবেন না মিঃ পানিগ্রাহী। সুমন্ত ইজ রাইট। ভারতবাবুর গতিবিধির উপর নজর রাখতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ আপনার এই তৃতীয় চিঠিটি। এবং…

সুমন্ত বলে উঠল, পানিগ্রাহীদার হুকুমে অনেক কাজ করেছি। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমাকে বুকে বেলুন বেঁধে মডগার্লও সাজতে হলো! এখন আমার সবটাই এত অপমানজনক মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ওঁর কোনও পলিটিক্যাল মোটিভ নেই! সবটাই ব্যক্তিগত। নিশ্চয় ভারতবাবুর ওপর অন্য কোনও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা আছে ওঁর।

আবার দুপক্ষকে সামলাতে হলো। কর্নেল বললেন, উত্তেজিত হবেন না কেউ–প্লীজ। আমরা কেসের খুব ভাইটাল পয়েন্টে এসে গেছি।

পানিগ্রাহী বললেন, ব্যক্তিগত ব্যাপার হবে যদি, সি.বি.আই. থেকে মিঃ শর্মাকে কি ছেলেখেলা করতে ডেকেছিলুম?

সুমন্ত বলল, দ্যাটন দা শো বিজনেস; ওটা আপনার চালাকি!

কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! আচ্ছা মিঃ পানিগ্রাহী, এই গেস্টহাউস থেকে বেরোতে হলে নিচের লাউঞ্জ পেরোতেই হবে–আমি লক্ষ করে এসেছি। তাহলে আপনার এখানে চেক ইন করা অব্দি কবার বাইরে বেরিয়েছেন, তার রেকর্ড আমরা ম্যানেজারের কাছে পেয়ে যাব। কী বলেন?

পানিগ্রাহী বললেন, একশোবার পাবেন। নিচে চব্বিশ ঘণ্টা কেউ না কেউ কাউন্টারে থাকে। হয় ম্যানেজার, নয় কোনও ক্লার্ক। নাইট ডিউটির ব্যবস্থা রয়েছে। চেক করুন, তাহলে বুঝবেন। মাত্র একবারই আমি বেরিয়েছিলুম–গতরাত্রে। জাস্ট সাড়ে দশটায়।

কর্নেল পকেট থেকে এবার আরেকটা নীলখামের চিঠি বের করে বললেন, এই চিঠিটা আমি বাংলোয় পেয়েছি। ওপরে লেখা রয়েছে প্রাপক শ্রী মদনমোহন পাণিগ্রাহী। কিন্তু চিঠিটার লেখকও শ্রী মদনমোহন পানিগ্রাহী। তারিখ ২১ জুলাই।

হ্যাঁ–আমি ওই চিঠিতেই সুমন্তকে মেয়ে সাজবার নির্দেশ দিয়েছিলুম। প্রাপকের নাম…।

বুঝেছি। ওটা আপনার সর্তকতা। চিঠিটা দেখেই আমার অবাক লাগে। তখনই জানতে পারি, আপনি কোথাও আছেন, এই চন্দনপুর-অন-সী-তেই। সম্ভাষণ করেছেন প্রিয় এস বলে। যাই হোক, এই চিঠিটা আপনার তন্দ্রাকে লেখা তৃতীয় চিঠির পরিপূরক। বাই দা বাই, সুমন্ত একটা সবে ধরানো সিগারেট নিবিয়ে ফেলে এসেছ কি তুমি?

সুমন্ত বলল, তাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়েই আমি বেরিয়েছিলুম পানিগ্রাহীদার কাছে।

সবে ধরিয়ে দিয়েই বেরিয়েছিলে?

হ্যাঁ! ও সিগারেট খুব কম খেত। এই মানসিক অবস্থায় খেতে চাচ্ছিল না। আমি চলে আসার সময় ওকে বললুম–সিগারেট খাও, তাহলে ভয় করবে না। সিগারেটটা শেষ হবার আগেই আমি ফিরব। মোমবাতির আলো আছে–ভয় নেই। আর…বেডরুমে বিছানায় একটা ছোরা রেখেছিলুম। ছোরাটা সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর অসুবিধে ছিল–বেশ বড় ছোরা। তাছাড়া ছোরা নিয়ে বেড়ানোর কী দরকার, বুঝতে পারিনি। যাই হোক, ছোরাটা ওকে দিয়ে এসেছিলুম।

ছোরাটা বাংলোয় দেখতে পাইনি আমি।

আমরাও পাইনি স্যার। যখন তাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখলুম, ছোরাটা খুঁজছিলুম তন্ন তন্ন করে। আমি তো জানতেই পারছিলুম, খুনী ওই ছোরাটাই মেরেছে তাকে।

রাইট। তুমি চলে যাওয়ার পর জঙ্গলের পথে কিংবা কোথাও গাড়ি দেখেছিলে কি?

না স্যার।.. বলে একটু ভেবে নিয়ে সুমন্ত ফের বলল, তবে পানিগ্রাহীদাকে নিয়ে যখন বাংলোয় যাই, তখন জঙ্গলের দিকে পাহাড়ের পশ্চিম পিঠে একটা আওয়াজ আমার কানে এসেছিল। গাড়ির আওয়াজ বলে মনে হচ্ছিল। পানিগ্রাহীদাকে বললুম– কথাটা কিন্তু উনি বললেন–মেঘ ডাকার শব্দ।

পাহাড়ের দক্ষিণ গা দিয়ে যে-পথ, সে-পথে তোমরা এসেছ বা গেছ। কিন্তু পশ্চিম গা দিয়ে গাড়ি চলার কোনও পথ আছে কি?

আছে স্যার। তবে কোনও তৈরি রাস্তা নয়। ঝোপঝাড় বিশেষ নেই। বালিয়াড়ি মতো আছে। ইচ্ছে করলে কেউ পাহাড় ঘুরে পশ্চিম থেকে উত্তর হয়ে পুবদিকে এসে আশ্রমের পথে উঠতে পারে। তারপর এইগেস্টহাউসের পিছনের সদর রাস্তায় আসা যায়।

মিঃ পানিগ্রাহী, পিছনটা তো আপনার ঘর থেকে দিব্যি দেখা যায়। কোনও গাড়ি দেখেছিলেন রাত্রে?

পানিগ্রাহী বললেন, অসম্ভব! রাত্রের বৃষ্টি ছিল অকল্পনীয়। ওই অবস্থায় কেউ গাড়ি বের করতে সাহস পাবে না।

কিন্তু আমি বাংলোর পূর্ব গেটে গাড়ির চাকার দাগ দেখেছি। হিলের দক্ষিণ দিককার জঙ্গলের রাস্তা–মানে আপনাদের যাওয়া-আসার রাস্তা অবশ্য পাথুরে। কোনও দাগ পাইনি। যদিও ভেবেছিলুম, এই পথেই রাত্রে বৃষ্টির মধ্যে একটা গাড়ি এসেছিল এবং চলে গেছে। ভেবেছিলুম নয়–গাড়ি যাওয়া-আসা ফ্যাক্ট। কিন্তু উত্তর অংশটা খুঁজিনি। এখন মনে হচ্ছে ওদিক দিয়েই গাড়িটা এসেছিল এবং চলে গিয়েছিল।

অ্যাবসার্ড! কে অত রাত্রে গাড়ি নিয়ে যাবে–আমার বাংলোয়?

খুনী যাবে–উঁহু, গিয়েছিল। সুমন্ত চলে আসার পরেই সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়িটা গিয়েছিল ওখানে।

তাহলে তো আলো নজরে পড়ত!

ঠিক। আলো জ্বালেনি খুনী। অন্ধকারেই গিয়েছিল।

অসম্ভব! ওই বিপথে ঝোপঝাড় বালিয়াড়িতে

মিঃ পানিগ্রাহী, ধরুন, ওই জায়গা–তার মানে পুরো এলাকা খুনীর এত মুখস্থ যে সে বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ করেনি। সে এমন লোক যে বাংলোর চারপাশের নাড়িনক্ষত্র তার জানা। তাই আলো জ্বালাতে হয়নি। আলো জ্বাললে অনেকের চোখে পড়ত। তাছাড়া চুপি চুপি আসতে চেয়েছিল সে।

কে হতে পারে সেভারতবাবু ছাড়া? নির্ঘাৎ ওই শয়তানটা। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী এবার আমার ধারণার কথা বলি। খুনী চুপি চুপি এসে বাংলোর দরজায় নক করেছিল। উঁহু, সে সোজা তন্দ্রার নাম ধরে ডেকেছিল। বোঝা যায়, তন্দ্রা তার সুপরিচিত। তাই সে তাকে তক্ষুনি দরজা খুলে দেয়। এবং তাকে সে রীতিমতো শ্রদ্ধাভক্তি করত বলেই তক্ষুনি সিগারেটটা হাঁটুর পাশে সোফার গায়ে ঘষে নিভিয়ে ফেলে। বলতে বলতে নিজের যুক্তির শক্তিমত্তা নিজেই টের পেয়ে পানিগ্রাহী লাফিয়ে উঠলেন।…মিলে যাচ্ছে, একেবারে দুয়ে দুয়ে চার মিলে যাচ্ছে। এখানে হোটেলওয়ালা ভারতবাবু ছাড়া তার তো আর কারও সঙ্গে আলাপ ছিল না। আর ওকে সে বয়সের খাতিরে হোকনজর রাখার সুবিধে হবে বলে অন্তরঙ্গ হয়ে শ্রদ্ধাভক্তি দেখাতে চেয়েছিল নিশ্চয়। বলে যান–আমার কাছে খুনীর চেহারা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। এতক্ষণ ধারণা ছিল, তার লোক তাকে খুন করেছে। এবার বোঝা যাচ্ছে না, সে নিজেই ওকাজ করেছে। মিঃ শর্মা, তাহলে বুঝতে পারছেন তো? নিশ্চয় তন্দ্রা কিছু জেনে ফেলেছিল আঁটঘাটের খবর। তাই ভারত মরীয়া হয়ে উঠেছিল।

শর্মা বললেন, তাই দাঁড়াচ্ছে বটে। প্রথমে মুখোশপরা লোক লাগিয়ে রাংতার ছোরা দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দেওয়া যথেষ্ট মনে হয়নি। কারণ, সেই মুখোশধারী সম্ভবত ফিরে গিয়ে বলে থাকবে যে আসামিরা ফার্মে ঢুকে পড়েছে। তার মানেই প্রতিদ্বন্দ্বী পানিগ্রাহীসায়েবের লোকের কানে যাওয়া! আরও বিপদের সম্ভাবনা এবার। কাজেই একেবারে খতম করাই ভাল। ভারতবাবুকে চেনে তন্দ্রা। কাজেই তাকে দেখল…

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, প্লীজ প্লীজ! আমাদের এখন আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ বাকি আছে। সুমন্ত, এবার আমার আরও কিছু প্রশ্নের জবাব দাও।

— পানিগ্রাহী কটমট করে তাকালেন সুমন্তের দিকে। সুমন্ত গ্রাহ্য করল না। কর্নেলের দিকে তাকিয়ে সপ্রতিভ মুখে বলল, বলুন স্যার?

কর্নেল বললেন, একটা কাগজ তুমি আর তন্দ্রা পড়ছিলে শার্কে বসে থাকার সময়। তারপর তন্দ্রা কাগজটা কুচিকুচি করে ফেলে দেয়। কী সেটা?

একটা উড়ো চিঠি, স্যার। দুপুরে ডাইনিং হলে খেয়ে আমি আর তন্দ্রা ওপরে স্যুটে ঢুকলুম, দেখি–চিঠি পড়ে রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে :

ডাইনি মেয়ে দুটোকে–

তোরা যদি আজই হোটেল ছেড়ে না যাস, ভীষণ বিপদ হবে। তোদের যে পাঠিয়েছে, তাকে বলিস–পাখি উড়ে গেছে চিরকালের মতো …

এই সময় পানিগ্রাহী প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, অ্যাঁ! উড়ো চিঠির কথা তো বলোনি!

কর্নেল পকেট থেকে লম্বা সরকারী খাম বের করলেন। তারপর ভিতর থেকে কয়েকটা কুচি কাগজ বের করে বললেন, এগুলো চিনতে পারছ?

সুমন্ত সোৎসাহে বলল, হ্যাঁ স্যার। ওইটাই। বড়বড় আঁকাবাঁকা হাতের লেখা। ইংরেজিতে লেখা–হ্যাঁ, ওটাই বটে।

কর্নেল পানিগ্রাহীকে প্রশ্ন করলেন, আপনি চিনতে পারছেন, এ হাতের লেখা কার?

পানিগ্রাহী একবার দেখে নিয়ে বললেন, না। তাছাড়া অমন টুকরো কাগজের লেখা চেনা অসম্ভব আমার পক্ষে। তবে বাজী রেখে বলব, ও ভারতের লেখা। এক্সপার্টের কাছে পাঠান।…তারপর সুমন্তের দিকে কটমট করে চেয়ে বললেন, তুমি একটা ওয়ার্থলেস!

কর্নেল কুচিগুলো খামে ভরে সুমন্তকে বললেন, তাহলে চিঠিটা তোমরা। গতকাল দুপুরে খাওয়ার পর পেলে। তারপর কী করলে?

সুমন্ত বলল, টের পেলুম, পানিগ্রাহীদা ঠিক জায়গায় তাক করেছে। তাকে বললুম– ভয়ের কারণ নেই। পানিগ্রাহীদা নিশ্চয় পুলিস আর নিজের লোকজন নিয়ে তৈরি হচ্ছেন। উনি বলে দিয়েছিলেন, ২২ তারিখ রাত্রেই কিছু ঘটবে। কাজেই রাত্রি আসুক আগে। আমরা কড়া নজর রাখি। কিন্তু তন্দ্রা আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল।

কী কথা?

বলল–পানিগ্রাহীসায়েব ভারতবাবুর ওপর লক্ষ রাখতে বলেছেন, তার পিছনে কোকেন, এল এস ডি বা নিষিদ্ধ ড্রাগের চোরাকারবার ধরা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্যটা সে এবার টের পেয়ে গেছে।… সুমন্ত থামল।

পাণিগ্রাহী তেড়ে এলেন।…কী উদ্দেশ্য বলল তন্দ্রা?

কর্নেল বললেন, প্লীজ, প্লীজ! সুমন্ত তুমি বলো।

সুমন্ত বলল, ভারতবাবুর সঙ্গে এক ভদ্রমহিলার কী সম্পর্ক–তন্দ্রা বলল মিঃ পানিগ্রাহী যেন সেটাই জানতে চান আসলে। তন্দ্রা আরও বলল, তিন নম্বর চিঠিতে তাকে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে..

কর্নেল কথা কেড়ে বললেন, হ্যাঁ–বিশেষ করে কোনও মহিলার সঙ্গে ভারতবাবুর যোগাযোগ ঘটেছে কি না।

ঠিক তাই স্যার। তা তাকে বললুম– তুমি কীভাবে জানলে যে ওটাই আসল কারণ। তন্দ্রা বলল–চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী আমি নজর রেখে দেখলুম এ স্যুটে এক ভদ্রমহিলা আছেন। ভারতবাবু প্রায়ই তার ঘরে গিয়ে কাটাচ্ছেন। ২১ তারিখ রাত্রে আকাশ পরিষ্কার ছিল। দুজনকে বাইরে থেকে আসতে দেখেছিল নাকি তন্দ্রা–আমি ঘুমোছিলুম। তন্দ্রা বলল, সে উঁকি দিয়ে দেখল– নির্জন করিডরে ভারতবাবু আর মহিলা ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছেন। হঠাৎ সেই সময় মহিলাটির চোখে পড়ে তার সুইটের দরজায়। অমনি ওরা সরে আলাদা হয়ে যায়। আর তন্দ্রাও দরজা বন্ধ করে। কাজেই তন্দ্রা বলল–তার ফেমিনিন ইনস্টিংক্ট অনুযায়ী নাকি মিঃ পানিগ্রাহীর আসল লক্ষ ওটাই। আমরা দুজনে সারা বিকেল ওই নিয়ে আলোচনা করলুম। ভদ্রমহিলাকে আমি দেখিইনি। যাই হোক, আমরা দুজনে সিদ্ধান্তে এলুম যে ২২ তারিখ-টারিখ কোনও ব্যাপারই নয়। আসলে ওই সময়ের মধ্যে ওই ভদ্রমহিলার আসার কথা ছিল এখানে–এটা পানিগ্রাহীদা জানতে পেরেছিলেন। তাই আমাদের গোয়েন্দা হিসেবে লাগিয়েছিলেন। আমরা দুজনেই চন্দনপুরে অচেনা বললেই হয়। গত মার্চে আমি এদিকে ইলেকসানে খেটে গেছি কিন্তু তখন তো মাথায় লম্বা চুল ছিল না আমার। আর অত মনেই বা কে রাখে! অমন কয়েকডজন কর্মী খেটেছিল।

কর্নেল বললেন, এক মিনিট! মিঃ পানিগ্রাহী, আপনার ফোনটা একবার নেব?

পানিগ্রাহী ক্লান্তভাবে বললেন, হ্যাঁনিন না। হোটেলে রিং করবেন?

না। সেনাপতিকে। বলে কর্নেল ফোন তুললেন।…একবার প্লীজ থানায় দিন।…হ্যাঁ, হ্যালো! কে বলছেন? মিঃ সেনাপতি ফিরেছেন?…কেউ ফেরেননি? ডাঃ পট্টনায়কের ওখানে গেছেন? আমি কর্নেল সরকার বলছি। ঠিক আছে। ছাড়ছি?

কর্নেল ফোন ছেড়ে সরে এলেন। হ্যাঁ, সুমন্ত, তারপর বলল।

সুমন্ত বলল, আমরা সমুদ্রের ধারে ঘুরছি, বৃষ্টি এসে গেল। তখন সামনে শার্কে ঢুকলুম। আগের দিনও ঢুকেছিলুম। বেশ সুন্দর বার-কাম রেস্তোরাঁ। তন্দ্রার ওই অভ্যাস। একবার কিছু মাথায় এলে তা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যাবে। আমরা হোটেলে গিয়ে সোজা পানিগ্রাহীদার কাছে গিয়ে রিপোর্টটা দেব আর সোজা জেনে নেব রহস্য–এই হলো আমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বৃষ্টি দেরি করিয়ে দিল। তারপর হঠাৎ ছোরা হাতে মুখোশপরা মূর্তি এসে…

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। সুইট নাম্বার এতে মহিলাটিকে দেখেছিল তন্দ্রা?

হ্যাঁ, স্যার।

মিঃ পানিগ্রাহী, মহিলাটি কে?

পানিগ্রাহী ভুরু কুঁচকে বললেন, ওসব সুমন্ত আর তন্দ্রার অলীক ধারণা। অবশ্য ভারতের লাম্পট্য চিরাচরিত। সবাই জানে। ওরা দুজনেই ভুল করেছিল। আসলে আমার খবর ছিল–মহিলাদের মারফতও ড্রাগ পাচার হয়। তাই ওদের মহিলাদের দিকেও লক্ষ রাখতে বলেছিলুম। তাছাড়া–কোন মহিলার সঙ্গে ভারতের কী হচ্ছে না হচ্ছে জানবার জন্যে আমি মিঃ শর্মাকেই বা কেন কষ্ট করে দিল্লি থেকে আসতে বলব? আর কেনই বা অত গাঁটের পয়সা খরচ করে দু-দুটো লোক লাগাব? বলুন–কোনও যুক্তি আছে।

কর্নেল বললেন, –আছে। যদি মহিলাটি… বলেই চুপ করে গেলেন হঠাৎ। পানিগ্রাহী ঝুঁকে এলেন।…বলুন বলুন।

থাক। আমি আগে নিশ্চিত হতে চাই–তারপর সিদ্ধান্তে আসব। আচ্ছা মিঃ শর্মা, উঠি তাহলে। আপনি বিশ্রাম করুন। মিঃ পানিগ্রাহী, চলি। সুমন্ত তুমি তুমি বরং এস আমার সঙ্গে।

পানিগ্রাহী গম্ভীর হয়ে বললেন, ও থাকবে কর্নেল। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

কর্নেল হাসিমুখে সুমন্তর দিকে তাকালেন।…সুমন্ত, আমার মনে হয় পুলিস তোমার এজাহারটা দাবি করবে। সেটা শীগগির হলেই তোমার পক্ষে নিরাপদ।

সুমন্ত উঠে বলল, নিশ্চয়। চলুন কর্নেল। পানিগ্রাহীদা, পরে দেখা হবে।

সুমন্ত কর্নেলের আগেই বেরিয়ে এল। শর্মা করিডর অব্দি এসে চাপা গলায় বললেন, সবটাই ধাঁধা, কর্নেল। যাক গে, খুব ক্লান্তি লাগছে। যা জার্নির ধকল গেছে। আমি একটু জিরিয়ে নিই। ওবেলা দেখা হবে।

পানিগ্রাহী গুম হয়ে ঘরে একা বসে রইলেন।

রাস্তায় নেমে কর্নেল বললেন, বাংলোয় পাওয়া সিগারেট কেসটা…

সুমন্ত কথা কেড়ে বলল, ওটা আমাকে ডঃ পট্টনায়কের মেয়ে কল্যাণী প্রেজেন্ট করেছিল। গত ইলেকশানে এসে কল্যাণীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। একটু হৃদ্যতাও হয়েছিল।

তাহলে পট্টনায়ক-ফ্যামিলি তোমাকে ভালই চেনেন। অথচ তুমি বললে, এখানে তুমি অচেনা।

ফ্যামিলিতে বিশেষ চেনে না। চেনে শুধু কল্যাণী। সে তো কলকাতায় আছে এখন।

উঁহু, কল্যাণী এসেছে।

কল্যাণী এসেছে নাকি? বাঃ, জানতুম না। ভালই হলো। উঃ, দুটোদিন যা লুকোচুরি খেলা গেছে, কোনওকিছু ভাববার ফুরসতই পাইনি। আমি বরং তাহলে ওদের বাড়িতেই থাকব আজ রাত্তিরটা। কাল সকালে কেটে পড়বখন।

কল্যাণীর সঙ্গে তোমার আলাপ কীভাবে হয়েছিল?

বললুম– তো–এখানে এসে–মার্চ মাসে। একটা ফাংশান মতো হয়েছিল। আমি গীটার বাজিয়েছিলুম। গীটার সঙ্গে ছিল না। তাই গীটারের খোঁজ করছিলুম। তখন বউদি–মানে পানিগ্রাহীদার স্ত্রী কল্যাণীদের বাড়ি থেকে আনিয়ে দিলেন। ওই সূত্রে কল্যাণীর সঙ্গে চেনাজানা হলো। বউদির সঙ্গে কল্যাণীদের ভীষণ ভাবটাব ছিল, দেখেছিলুম।

কর্নেল অন্য কথা ভাবছিলেন। এ-যুগের ইয়ংম্যানরা ভারি আশ্চর্য। বেচারা তন্দ্রা!

.

০৯.

পথিমধ্যে বিস্ফোরণ

কর্নেল ভাবছিলেন, পাখি উড়ে গেছে–এই উড়ো চিঠির খবর পানিগ্রাহীকে সুমন্ত দেয়নি বলে তিনি যেন বিচলিত বোধ করলেন। কেন? দ্বিতীয়ত পানিগ্রাহীর নির্দেশ ছিল–ভারতবাবু সংক্রান্ত (এবং কোনও মহিলা সংক্রান্তও বটে) যা কিছু ঘটবে, সব তাকে দুজনে যেন জানায়। এই দুটো ব্যাপার কেবলই মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সুমন্ত তেমন কোনও ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করেনি হোটেলে। এর কারণ বোঝা যায় দুটো। এক : সুমন্ত মেয়ে সেজে থাকায় সে স্বভাবত খুব বেশি ঘোরাফেরা করেনি প্রকাশ্যে। দুই : সুমন্ত তার গার্লফ্রেণ্ড তাকে পেয়ে মেতে উঠেছিল। অন্যদিকে চোখ রাখবার স্পৃহা ছিল না। একজন তথাকথিত মড-এর পক্ষে এগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু সুমন্তের মতো ছেলের পক্ষে কতটা স্বাভাবিক?

এ সুইটের মহিলাটি কি এখনও আছেন হোটেলেঃ কর্নেল খুব জোরে পা চালিয়ে হাঁটছিলেন। কোথাও রিকশো দেখা যাচ্ছে না। রোদ নেই অবশ্য–মেঘলা দিনের বিষণ্ণতা আছে। হোটেলে যাওয়া খুবই জরুরী। কর্নেল যত এগোলেন, তত তার ধারণা দৃঢ় হলো যে, এ সুইটের মহিলাটি ভোরেই কেটে পড়েছেন সম্ভবত। নির্বোধ না হলে নিশ্চয় থেকে যাবেন।

সুমন্ত শিস দিতে দিতে হাঁটছিল। সত্যি, তার অবাক লাগে কর্নেল ভাবলেন– একালের ইয়ংম্যানদের তিনি বুঝতে পারেন না। এরা এত নির্বিকার আর তাৎক্ষণিকতাবাদী! সব ওমর খৈয়ামের চেলা একেকটি।…জীবনসুরা শূন্য হবার। আগে/পাত্রখানি নাও ভরে নাও, নিবিড় অনুরাগে।… এরা কেমন যেন নিঃসাড়, বোধশূন্য, জড়ভরত! যন্ত্রের মতো রোবোটই বলা যায়। পূর্বপুরুষদের সূক্ষ্মতম ইন্দ্রিয়গুলি এরা জন্মের সঙ্গে বয়ে আনেনি। গভীর যা কিছু তা এদের স্পর্শ করে না। বাংলায় একে বলে–গোলেমালে হরিবোল দিয়ে কাটানো।

কর্নেল! সুমন্ত ডাকল।

হ্যাঁ সুমন্ত, বলো।

পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করবে নাকি?

কর্নেল হাসলেন।… তুমি যদি অসত্য কিছু না বলো, পুলিশ তোমাকে গ্রেফতার করবে বলে মনে হয় না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি কোথাও কিছু মিথ্যা জুড়েছি।

দ্যাট ডিপেণ্ডস, মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেণ্ড।

ডিপেণ্ডস অন হোয়াট? কিসের ওপর?

পানিগ্রাহীর সঙ্গে তোমার সম্পর্কের ওপর।

ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধু টাকার। স্রেফ মানি অ্যাণ্ড নাথিং এক্স।

শার্ক থেকে তাড়া খেয়ে তুমি আর তন্দ্রা যখন বাংলোয় ঢোকো, তখন সময় কত ছিল? আমি তখন জিগ্যেস করিনি। মোটমাট ঘটনাটি জানতে চেয়েছিলুম শুধু। কিন্তু পুলিশ চায় অবজেকটিভ ফ্যাক্টস অ্যাণ্ড ফ্যাক্টরস। মাইণ্ড দ্যাট, সুমন্ত। আজকাল পুলিশের কাজকর্ম মোর সায়েন্টেফিক প্রসেসে চলে। অন্ধকারে তারা কিছু হাতড়ায় না। কটার সময় তোমরা বাংলোয় ঢুকেছিলে?

ঘড়ি দেখিনি তখন। তবে আন্দাজ সাড়ে নটা হবে।

কতক্ষণ পরে তুমি তাকে রেখে বেরিয়েছিলে?

আধঘণ্টা প্রায়–হা, ওইরকমই হবে।

ঢুকেই কি সিগারেট ধরিয়েছিলে?

কেন স্যার?

প্লীজ সুমন্ত– নেভার স্যার! তুমি আমাকে কর্নেল বলেই ডেকো। দ্যাট আই লাইক মাচ।

সিগারেট… ।

হ্যাঁ-সিগারেট। খুব ভেবে জবাব দাও।

ঢুকে ভিজে কাপড়-জামা বদলে নিইধরুন, পাঁচ মিনিট। তন্দ্রার বদলানোর উপায় ছিল না। হা–ঢোকার মিনিট পাঁচ পরে সিগারেট ধরালুম।

কর্নেল মনে মনে হিসেব করে বললেন, ধরা যাক্ কুড়ি মিনিট। তুমি ওঠার সময় তাকে নিজের সিগারেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিলে?

হ্যাঁ। কিন্তু কুড়ি মিনিট কী বলছেন?

তুমি চেইনস্মোকার–কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে।…এটা তুমি জানো?

সুমন্ত অবাক হলো।…না তো!

তুমি সবসময় সিগারেট খাও না, তাই না?

হ্যাঁ। তা খাইনে বটে। খুব ভাবনা-টাবনা থাকলে খাই।

তখন চেইনস্মোক করো। অর্থাৎ নিজের সিগারেট থেকে ধরিয়ে ঘন-ঘন টানো।

সুমন্ত মাথা নাড়ল।…ঠিক বলেছেন কর্নেল।

ধরলুম–প্রতি সিগারেট পুড়তে ম্যাক্সিম্যাম সময় লাগুক পাঁচ মিনিট তোমার ক্ষেত্রে। কেমন? তাহলে বাংলোয় তুমি তিনটে সিগারেট খেয়েছিলে মোট। তার মানে বেশিপক্ষে পনের মিনিট। পাঁচ মিনিট জামা কাপড় বদলেছ। তাহলে কুড়ি হলো। তুমি বড়জোর কুড়ি মিনিট পরে বেরিয়েছিলে সুমন্ত, আধঘণ্টা নয়।

তা হতে পারে।

বাংলো থেকে গেস্ট হাউস যেতে যেখানটায় পানিগ্রাহীসায়েবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, দূরত্ব কতটা বলতে পারো?

তা-তিন-চারশো মিটার হবে।

তিন-চারশো? উঁহু–থাক। দূরত্ব মাপা তোমার কর্ম নয়। বলো–আন্দাজ কতটা সময় হেঁটে ওঁর দেখা পেয়েছিলে?

দৌড়ে যাচ্ছিলুম তো। মিনিট ছ সাত–উঁহু, মিনিট চারেরনাঃ, কর্নেল, মিনিট হিসেব করা মুশকিল। উত্তেজনার ঝেকে দৌড়োনো বৃষ্টি পড়ছিল।

ওই পথটার যা অবস্থা দেখেছি তাতে আমার ধারণা, খুব সহজে তুমি দৌড়তে পারছিলে না। পাথুরে পথ–তাছাড়া পিচ্ছিল হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। সমতলও নয়। অতএব আমার ধারণা, .. কর্নেল একটু থেমে ফের বললেন, পানিগ্রাহী বলছিলেন, ঠিক সাড়ে দশটায় উনি তোমার খোঁজে বেরোন। তাহলে সুমন্ত, বেশিপক্ষে আমি দশ-পনের মিনিট পরেই ধরে নিচ্ছি তোমারে সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল পৌনে এগারোটা নাগাদ। শার্কের নব বলেছে, সাড়ে নটায় মুখোশধারী ঢোকে। অতএব শার্ক থেকে বাংলো পাঁচ মিনিট যথেষ্ট, তারপর কুড়ি মিনিট, হলো পঁচিশ। তার মানে বাংলো থেকে বেরিয়েছিলে রাত নটা পঞ্চান্ন বা ধরো দশটা। কেমন? এবার সুমন্ত, টাইম ফ্যাক্টর গোলমেলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্দাজ কমপক্ষে আধঘণ্টা, বেশিপক্ষে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় হাতে রইল। এতটা সময় তুমি নিশ্চয় ওই রাস্তায় দৌড়োওনি! দ্যাটস অ্যাবসার্ড। তোমার কথাতেই বলি–তিন-চারশো গজ রাস্তা দৌড়োতে অতটা সময় কোনও অবস্থাতেই লাগতে পারে না। দ্বিতীয়ত তোমার পোশাক বদলানো–এটাও গোলমালে ফেলছে। বলেই কর্নেল একলাফে সুমন্তর একটা হাত ধরে ফেললেন, পালানোর চেষ্টা করো না সুমন্ত। আমি দেখতে বুড়ো হলেও পেশীগুলো বুড়ো হয়নি।

সুমন্ত ধস্তাধস্তি শুরু করল রাস্তার মধ্যে। কিন্তু কর্নেলের গায়ে অসুরের শক্তি। তারপর তিনি পকেট থেকে একহাতে রিভলভারটা বের করে ওর কাঁধে নল ঠেকালেন।…সুমন্ত, চুপচাপ আমার সঙ্গে চলল। আমি এ জীবনে কারও বেয়াদপি বরদাস্ত করিনি। হ্যাঁ–পা বাড়াও।…

.

১০.

কল্যাণীর কীর্তি

কর্নেল ওইভাবে সুমন্তকে নিয়ে ডাঃ পট্টনায়কের ঘরে ঢুকতেই সবাই চমকে উঠেছিল। ডাঃ পট্টনায়ক, মিঃ সেনাপতি, মিঃ আচার্য, পট্টনায়কের স্ত্রী মালবিকা, তার মেয়ে কল্যাণী আর একটি অচেনা যুবক বসে ছিল। কর্নেল ঢুকেই বললেন, মিঃ সেনাপতি, এই শ্রীমানটিকে এবার আপনার জিম্মায় তুলে দিতে চাই। বিহিত ব্যবস্থা করুন। এই যুবকটি অবশ্য ডাঃ পট্টনায়ক-ফ্যামিলির সুপরিচিত।

সেনাপতি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, কে ও? মার্ডারার নাকি?

ঘরসুদ্ধ নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। পট্টনায়করা স্বামী-স্ত্রী অস্ফুটে বললেন সুমন্ত! আশ্চর্য তো!

অচেনা যুবকটি লাফিয়ে উঠে বলল, এই সেই মুখ–বলেই অবাক হয়ে চুপ করে গেল।

কর্নেল হেসে বললেন, হ্যাঁ–ইনিই তিনি। মিস তন্দ্রা ভাদুড়ীর সঙ্গী বা সঙ্গিনী যাই বলুন। এবং তার হত্যাকারীও বটে।

যুবকটি বলল, সর্বনাশ! এ তো দেখছি আমাদের মতোই পুরুষমানুষ। চুল কেটে ফেলেছে দেখছি। তাহলেও চিনতে ভুল হচ্ছে না। কাল বিকেলে এই আমাকে টাকা দিয়েছিল জোক করার জন্যে। হা-এই। ওই তো বাঁ-হাতে উল্কি রয়েছে।

সেনাপতি তক্ষুনি দুজন সেপাই ডেকে সুমন্তকে তাদের জিম্মায় থানায় পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, এই ভদ্রলোকের নাম প্রবীর দাশ, একজন হরবোলা–আবার মডার্ন বহুরূপীও বলতে পারেন। সী বিচে নানারকম ফান দেখিয়ে রোজগার করা এঁর পেশা। কাল বিকেলে তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী যাই বলুন প্রবীরবাবুকে বলেছিল, শার্কে গিয়ে রাত নটার পর মুখোশ পরে ছোরা হাতে জোক করতে হবে। পেশা–তার ওপর টাকা পাচ্ছেন। তাই কিছু তলিয়ে না দেখেই প্রবীরবাবু রাজি হয়ে যান। কথা হয়–ওরা দুজন শার্কে সাড়ে নটা অব্দি থাকবে। ঝড়বৃষ্টি হোক, আর যাই হোক–প্রবীরবাবুকে এই জোক করতেই হবে।…।

প্ৰবীর বলল, হ্যাঁ স্যার। সেটা পইপই করে বলে দিলেন উনি।

কর্নেল বললেন, গল্প শুনেও কিছু সন্দেহ হয়নি আপনার?

না স্যার। ইশারায় ডেকে ফিস ফিস করে কথা বলছিলেন। মেয়েদের দিকে আপন গড বলছি স্যার…চোখ তুলে কথা বলার অভ্যাস আমার নেই। তাই অতটা লক্ষ করিনি। তাছাড়াজলজ্যান্ত বুক রয়েছে, সেটাও দেখতে পাচ্ছি।

কর্নেল পকেট থেকে বেলুন দুটো বের করে দেখালেন। সবাই অবাক হলো, তারপর হেসে উঠল। কর্নেল বললেন, বুঝে গেছি। তারপর?

একটুখানি তাড়া করে গিয়ে আমি চলে গেলুম। বৃষ্টির মধ্যে আর কতক্ষণ থাকা যায়? তার ওপর ভয় ছিল নবকে। ভাগ্যিস, নব ঝাঁপিয়ে পড়েনি কিংবা দৌড়ে পিছু নেয়নি। খুব রিস্কের কাজ স্যারনবর মতো সাংঘাতিক লোকের সামনে ছুরি হাতে লম্ফঝম্প করা চাট্টিখানি কথা নয়। শুধু কুড়িটা টাকার জন্যে রাজি হয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, নব ধরে ফেললে না হয় পরিচয় দেব, বলব-জোক করছি। নব আমাকে চেনে, স্যার। কেন যেন তখন চিনতে পারেনি, বুঝতে পারছিনে। যাই হোক, সকালে ওই খুনের খবর শুনে দেখতে গেলুম। গিয়ে তো আমার চোখ ছানাবড়া। সর্বনাশ, এতো সেই মেয়ে দুটির একটি। অমনি ভয় পেয়ে সরে গেলুম। কিন্তু আমি গরীব হই, বা লেখাপড়া ভাল শিখিনি বটে–বিবেক হারাইনি, স্যার। মনে খুব কষ্ট হতে লাগল। অবশেষে যা আছে রাতে, বলে বড়দারোগাবাবুর সামনে গিয়ে সব জানালুম। ওনারা আমাকে আটকে রাখলেন।

সেনাপতি বললেন, আপনাকে আটকে রাখিনি প্রবীরবাবু। তবে কোর্টের সমন পেলে যেন কেটে পড়বেন না। আপনি এখন আসতে পারেন।

না স্যার, সে কী কথা! তাহলে যেচে পড়ে বলতে আসব কেন? বলে প্রবীর চলে গেল।

কর্নেল বললেন, যাক্ গে। ডাঃ পট্টনায়ক, আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

পট্টনায়ককে গম্ভীর দেখাল। বললেন, আমি ধাঁধায় পড়ে গেছি, কর্নেল। যে গাড়ির চাকার দাগ আমরা সকালে বাংলোর বাইরে দেখে এসেছি–আপনাকে তখন সন্দেহ হলেও বলিনি–ওটা আমারই গাড়ির। এই হলো প্রথম ধাঁধা। দ্বিতীয় ধাঁধা-ঘন্টা দুই আগে ছাপ নেওয়ার কাজ শেষ করে বেরোব ভাবলুম, গাড়ি বের করে স্টার্ট দিলুম-নিল না। ইঞ্জিনের ঢাকনা তুলে দেখি কারবুরেটারে একটা রক্তমাখা ছোরা আটকানো রয়েছে।

মার্ডার উইপন!

হ্যাঁ–তাই। কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব হলো? তাছাড়া সবচেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, ছোরার বাঁটে যার হাতের ছাপ পাচ্ছি, সেই সিগারেট কেসে তারই হাতের ছাপ রয়েছে।

ডাঃ পট্টনায়ক, আপনি সিগারেট কেসটা দেখে চমকে উঠেছিলেন কেন?

কর্নেল, ওটা আমার মেয়ে গত মার্চ মাসে উপহার দিয়েছিল সুমন্তকে। সুমন্ত তখন আমার বাড়ি প্রায়ই আসত। কল্যাণীর সঙ্গে হৃদ্যতা ছিল। ও ভাল গীটার বাজায় কল্যাণীরও এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে। তাই আমি সিগারেট কেসটা ওখানে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলুম। তবে গেটের কাছে গাড়ির চাকা সম্পর্কে আপনার সিদ্ধান্ত প্রথমে চমকে দিয়েছিল। কারণ ও-গাড়ি তো আমারই।

কর্নেল কল্যাণীর দিকে তাকাতেই সে চোখ নামাল। কর্নেল বললেন, কল্যাণী, তুমি গত রাত্রে হ্যাঁ, জাস্ট ডিনারের পর আমরা যখন শুতে গেলুম, তখন দশটা কোথায় বেরিয়েছিলে গাড়ি নিয়ে? তারপর কোত্থেকে খানিক বাদে ফিরে এলে!

মালবিকা বললেন, কল্যাণী বেরিয়েছিল? সে কী!

হ্যাঁ। আপনাদের গ্যারাজটা বাগানের কোণে একটু দূরে কিন্তু আমি যে ঘরে ছিলুম, তার জানালা থেকে দেখা যায়। দেখলুম, কেউ বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে। ডাঃ পট্টনায়ক গেলেন–ভাবলুম। কিন্তু তার গলার আওয়াজ পেলুম শোবার ঘরে। আপনার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাহলে কল্যাণী ছাড়া আর কে হবে!

পট্টনায়ক ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আশ্চর্য! ও কী যে করে–আমরা কিছু জানতে পারিনা।

কর্নেল বললেন, কল্যাণী, দিস ইজ ভেরি ভেরি ইমপরট্যান্ট। জবাব দাও, প্লীজ।

কল্যাণী আস্তে বলল, সুমন্ত আমাকে চিঠিতে সব জানিয়েছিল কলকাতা থেকে। জানিয়েছিল, ২২ জুলাই রাত্রে সে পানিগ্রাহীসায়েবের বাংলোয় থাকবে। আমাকে যেতে বলেছিল। কোন পথে কীভাবে যাব, তাও লিখেছিল। ২১ তারিখে চিঠিটা পাই। তারপর হঠাৎ শার্কের সামনে কাল বিকেলে ওকে মেয়ে সেজে বেড়াতে দেখি। সে ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে। আর বলে যে রাত দশটার পর যেন ফার্মের বাংলোয় কথামতো যাই।

তাই কথামতো তুমি গেলে। কিন্তু কোন পথে গেলে?

হিলের উত্তর দিকটা ঘুরে। দক্ষিণ ঘুরে গেলে পথ ভাল ছিল কিন্তু ওদিকে যেতে বারণ করেছিল সুমন্ত। বলেছিল, আমাকে কিছু দামী জিনিসপত্র রাখতে দেবে–তার দাম নাকি, পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা। সোজা গেলে অত রাতে ও রাস্তায় গাড়ি দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারে–তাই উত্তর দিকের বালিয়াড়ি হয়ে যেতে হবে।

সুমন্তর ভয় ছিল পানিগ্রাহীর জন্যে। উনি ওই রাস্তাটা ব্যবহার করবেন, সে অনুমান করেছিল। তারপর?

আমি গিয়ে বাইরে গাড়ি রেখে ঢুলুম। অল্প আলো জ্বলছিল ঘরে। সুমন্ত দরজা খুলে দিল। সে আমাকে ঘরে ঢুকতেও দিল না। দরজার সামনে একটা মস্ত প্যাকেট গুঁজে দিয়ে বলল, শীগগির এটা নিয়ে যে-পথে এসেছ, চলে যাও। প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখবে। আমি সকালে দেখা করব।

তুমি বেডরুমে তাহলে ঢোকোনি?

না। বাইরের ঘরের ভিতরই ঢুকিনি। ঢুকতে দিলে তো!

ঘরে কোনও মেয়ে ছিল, লক্ষ করেছিলে?

পর্দা থাকায় ভিতরটা দেখতে পাইনি। তবে–তবে আমার মনে হচ্ছিল, ঘরে আরও কেউ যেন আছে। কারণ, প্যাকেট নিয়ে চলে আসবার সময় ফিসফিস কথা কানে এসেছিল যেন। বৃষ্টির মধ্যে কানের ভুল ভেবেছিলুম।

সুমন্তকে তাহলে অন্ধকারে দেখেছিলে?

হ্যাঁ। আলো ভিতরে ছিল। প্যাকেটটা দিয়ে দরজা বন্ধ করেছিল তক্ষুনি।

সুমন্তের পোশাক কি ভিজে মনে হচ্ছিল তখন? ভাল করে ভেবে বলল।

অতটা লক্ষ…না, ভিজে ছিল। কারণ, প্যাকেট নেবার সময় টের পাচ্ছিলুম, ওর হাত ভিজে। হ্যাঁ সম্পূর্ণ ভিজে অবস্থায় ও ছিল। একটু কাঁপছিল মনে হলো।

তারপর তুমি কী করলে?

বাড়ি ফিরে এলুম। গ্যারাজে গাড়ি ঢুকিয়ে প্যাকেটটা ডিকিতে রাখলুম।

সকালে এল সুমন্ত?

হ্যাঁ। তখন আটটা প্রায়। মা পাশের একটা বাড়িতে গেলেন। আমি একা ছিলুম। এসে বলল, চুল কাটতে দেরি হলো। প্যাকেটটা এবার চাই। আমার শরীরে কোল থেকে জ্বর জ্বর ভাব ছিল–এখনও একটু টেম্পারেচার। রাতে ভিজেছিলুম একটুখানি। তা, সুমন্তকে চাবি দিলুম গ্যারাজ আর গাড়ির। সে চলে গেল। খানিক পরে জানালা দিয়ে চাবির রিঙটা গলিয়ে ফেলে বলল, পরে দেখা হবে। কাকেও কিছু বলল না। ওর কাঁধে একটা কিটব্যাগ দেখলুম।

সেনাপতি বললেন, কিটব্যাগে তাহলে প্যাকেটটা ভরেছিল। আর ছোরাটা ইঞ্জিনের মধ্যে রেখে কল্যাণী বা ডাঃ পট্টনায়ককে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কর্নেল, প্যাকেটটায় কী থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?

কর্নেল বললেন, নিষিদ্ধ ড্রাগ।

সে কী! কোথায় পেল সে?

পানিগ্রাহী ভারতকে ঢিট করতে চেয়েছিলেন। তাই নিজের ট্যাকের কড়ি দিয়ে যোগাড় যন্ত্র করে সী ভিউ হোটেলে পাচার করার মতলব ছিল। ওঁর সুইডেন যাওয়াটা আকস্মিক ব্যাপার নয়। বিদেশে চেষ্টা-চরিত্র করে ওই জন্যেই গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। মন্ত্রীর দলে গেলে কাস্টমস বেশি কড়াকড়ি করবে না, ভেবেছিলেন। এদিকে ভারতবাবু ওঁর বিরোধীদলের বিরাট ঘাঁটি বলতে পারেন!

হ্যাঁ–সে তো সবাই জানে এখানে।

পানিগ্রাহী জনৈক মহিলাকে প্যাকেটটা ভারতবাবুর হোটেলে সুবিধেমতো জায়গায় পাচার করতে নিযুক্ত করেছিলেন সম্ভবত। হা–এখনও সবই অনুমান। তাই সুইট নম্বর এতে কোনও মহিলা ছিলেন বা এখনও আছেন কি না এখনই জানা দরকার।

সুইট নম্বর এ? আলিকে বলা আছে আমাদের তদন্ত শেষ না হওয়া অব্দি কাকেও চেক আউট করতে দেবে না। যদি সকাল সাতটার মধ্যে কেউ গিয়ে থাকে–উপায় নেই।

সব আমার অনুমান। তাকে নিযুক্ত করার কারণ, পানিগ্রাহী মহিলাটিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার মানে মহিলাটি নিশ্চয় তাহলে তথাকথিত সোসাইটি গার্ল। পানিগ্রাহীর নির্বুদ্ধিতার মাত্রা দেখে তাক লেগে যায়। ভদ্রলোক গত ইলেকশানে হেরে গিয়েছেন তাই জেদ। অফকোর্স–দিস ইজ এ সাইকলজিকাল প্রসেস। বাজি ধরে ক্রমাগত নির্বুদ্ধিতা বাড়িয়ে চলা একটা জীবন-মরণ প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত ওঁর মতো লোকের পক্ষে। ক্রমশ জেদ বাড়ছে, ক্রমশ নির্বোধ হয়ে পড়ছেন, ক্রমশ পাগলের মতো সম্ভব-অসম্ভব পথে টাকা খরচ করে দেউলিয়া হবার পথে পা বাড়াচ্ছেন। হ্যাঁ–এই হচ্ছে পানিগ্রাহীর বর্তমান জীবন। ওইভাবে মিঃ শর্মাকে আনিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রলোক কখন তন্দ্রা বা সুমন্ত খবর দেবে যে পাখি ফাঁদে পড়েছে। তখন উনি শর্মাকে লেলিয়ে দেবেন। মিঃ সেনাপতি, পানিগ্রাহী প্রচণ্ড সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মানুষ–তা আমি টের পেয়েছি। যেমন–আপনাদের অর্থাৎ লোকাল পুলিশকে উনি বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই আগেভাগে কিছু জানাননি। ভেবেছিলেন, শর্মার মাধ্যমে সে ব্যাপারটা সেটলড হবে।

আচার্য ও সেনাপতি হাসলেন।

কর্নেল বললেন, আমার ধারণা–উনি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। মহিলাটি মাল নিয়ে কেটে পড়েন কি না ওঁর সে সন্দেহও ছিল। তাই সুমন্তর পরামর্শে তাকে লাগালেন ওয়াচডগ হিসেবে। কিন্তু তন্দ্রাও যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে! হা-হেরে যাওয়া মানুষ এইরকমই হয়ে থাকে। ভাবে, সবাই তাকে ঠকাবে। এবং সে কারণে তন্দ্রার ওপর ওয়াচডগ রাখলেন সুমন্তকে। আর সুমন্ত ওঁকে ঠকাল–সত্যি সত্যি ঠকাল। আসলে সুমন্ত তো তাই চেয়েছিল। নির্বোধ পানিগ্রাহী ওকে বিশ্বাস করে ঠকলেন। এর ফলে হলো কী জানেন? এরপর পানিগ্রাহীর অবশিষ্ট বিশ্বাসটুকুও চলে গেল মানুষের ওপর। এটা ভালই হলো।

পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু তাকে খুন করল কেন সুমন্ত?

খুব সঙ্গত ও স্বাভাবিক মোটিভ। কল্যাণীর সাক্ষে প্রমাণ পাচ্ছি, মালটা শেষ অব্দি যে-কোনওভাবে হোক–হয়তো মহিলাটির সঙ্গে যোগসাজস করে কিংবা তার ঘর থেকে চুরি করে সুমন্ত হাতিয়েছিল। তা টের পেয়ে ওকে কিছু বলে থাকবে। তা হয়তো পানিগ্রাহীর কানে তোলার জন্যে শাসিয়েছিল। তাই ওকে সরানোর দরকার হলো সুমন্তর। কিংবা কল্যাণীর হাতে মালটা তুলে দেওয়ার পর দুজনের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে থাকবে–যার পরিণামে আকস্মিক রাগেও ছুরি মারতে পারে সুমন্ত। ওর মতো ছেলের পক্ষে এটা খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। এখন সবটা নির্ভর করছে সেই মহিলাটি আর সুমন্তের কনফেশনের ওপর। পানিগ্রাহীর মুখ থেকে কথা বের করা কঠিন। ওঁর রাজনৈতিক অ্যামবিশান ওঁকে মরিয়া করেছে। সত্যি বলতে কী, আমাদের আজকের জীবনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই ট্র্যাজেডি এত ব্যাপক আর গভীর, কহতব্য নয়। তার প্রমাণ আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে পাচ্ছি।

সেনাপতি বললেন, কর্নেল, ডোমপাড়ার চারজন লোক এসেছিল

কর্নেল বললেন, জানি। তারা তার লাশ বয়েছিল সুমন্তর কথায়।

লাশটা মর্গে চলে গেছে। সেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন।…তার ঠিকানায় খবর গেছে। লালবাজারেও ওর ব্যাকগ্রাউণ্ড জানতে চেয়েছি। আজ রাতের মধ্যেই সব, পেয়ে যাব আশা আছে। তাহলে আপনি স্নানাহার সেরে নিন, আমরা সী ভিউতে গিয়ে সুইট এতে হানা দিই।

ওরা চলে গেলে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ডাঃ পট্টনায়ক, কল্যাণীকে বলুন–তার বন্ধু বিচ্ছেদের জন্যে যে বৃদ্ধটি দায়ী, তাকে যেন সে ক্ষমা করে।

কল্যাণী ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, বন্ধু না হাতি! ভাল হাত আছে গিটারে–তাই! ও গোল্লায় যাক! খুনী গুণ্ডা কোথাকার! বলে সে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

ডাঃ পট্টনায়ক বললেন, সত্যি, একালের ছেলেমেয়েদের আমরা বুঝতে পারিনে।

.

১১.

 স্বীকারোক্তি

সমুদ্রতীরে আবার একটা বিকেল নেমেছে আজ। কিন্তু এ বিকেল বৃষ্টিধূসর। বিচ নির্জন। আকাশভরা ঘন মেঘ। মেঘ আর সমুদ্র সমানে গর্জন করছে।

থানার বড় ঘরটিতে বসে সুমন্ত তার জবানবন্দি দিচ্ছিল। কফেশন বা স্বীকারোক্তি বলাই ভাল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার এক পাশে। অন্যপাশে ডাঃ পট্টনায়ক।

…পানিগ্রাহীদার ভাড়াটে মেয়ে মিস শান্তার ঘর থেকে গতকাল দুপুরে আমি ড্রাগের প্যাকেটটা হাতাই। তারপর..

কর্নেল বললেন, কিন্তু কীভাবে?

সুমন্ত চোখ তুলে নামাল। আস্তে বলল, তাহলে গোড়া থেকে ভ্যানর-ভ্যানর করতে হয়।

এটা ইমপরট্যান্ট, সুমন্ত। অবশ্য বলা না বলা তোমার খুশি। আমরা আইনত তোমাকে চাপ দিতে পারিনে, ইউ নো দ্যাট।

পানিগ্রাহীদার প্ল্যান ছিল, ২২ জুলাই রাতে কোনও একসময় প্যাকেটটা মিস শান্তা ভারতবাবুকে রাখতে দেবে। তারপর সে সুযোগ মতো শেষরাতে কেটে পড়বে। পানিগ্রাহীদাকে আমরা গিয়ে খবর দিলে উনি ব্যবস্থামতো অফিসারদের নিয়ে হানা দেবেন হোটেলে। আমি আর তন্দ্রা–দরকার হলে সাক্ষীও দেব। এদিকে তখন মিস শান্তা উধাও হয়ে যাবে ইত্যাদি সব প্ল্যান। এ হচ্ছে পানিগ্রাহীদার বরাবরকার রীতি। সব ব্যাপারে বিরাট প্ল্যান করেন। ভেস্তে যায় শেষ অব্দি। এমন অজাযুদ্ধ ঋষিশ্রাদ্ধ গোছের জবড়জং প্ল্যান করলে তাই হয়। ইলেকশানে তো ও জন্যেই হেরেছেন। নির্বোধ বহু দেখেছি, এমন আর নেই। জলের মতো টাকা খরচ করে…

তুমি নিজের কথা বলো, সুমন্ত।

এই নির্বোধ বড়লোকটার ওপর আমার বরাবর ঘৃণা ছিল। তাই ওকে ঠকিয়ে টাকা নিয়েছি সবসময়। এটা পাপ মনে করিনে।

প্লীজ, প্লীজ!

মিস শান্তা দুপুরবেলা খাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। গিয়ে ঘণ্টা টিপলুম। দরজা খুলল। অমনি বের করলুম ড্যাগারটা। ড্যাগারের সামনে সে চুপ করে গেল। প্যাকেটটা তক্ষুনি বের করে দিল। তাকে বললুম– যদি এক্ষুণি না কেটে পড়ো, তো বিপদ হবে। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে সামনেই সি সুইটে তন্দ্রার ঘরে ঢুকে গেলুম। দরজা খোলা ছিল–কারণ, আমি একটু আগে বেরিয়েছি। তন্দ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠল। ওর প্রশ্নে উত্যক্ত হয়ে সংক্ষেপে সব জানালুম। তারপর…

একটা কথা। শান্তা তোমাকে চিনতে পারেনি?

না। ঘরে থাকার সময় ফিতে দিয়ে আটকানো বেলুন দুটো খুলে রাখতুম। শার্ট-প্যান্ট আর মুখোশ পরে ঢুকেছিলুম শান্তার ঘরে।

সুইটের দরজায় আইহোল আছে, সুমন্ত?

হ্যাঁ–সেতো ছিল। কিন্তু আমি সুইচ টিপে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিলুম। শান্তা ঝটপট দরজা খুলেছিল। বয় কিংবা ভারতবাবু ভেবে থাকবে ও। ভারতবাবুর সঙ্গে খুব খাতির জমিয়েছিল তো।

রাইট। বলো।

তন্দ্রা প্যাকেটটা দেখে যেন লোভে পড়ে গেল। সে আমাকে শাসাতে থাকলটাকার ভাগ না দিলে পানিগ্রাহীর কানে তুলবে। তখন ওকথা ঠাট্টা ভেবেছিলুম। পরে ও্যখন সমানে ঘ্যানর-ঘ্যানর চালিয়ে গেল বুঝলুম ও সিরিয়াস। এক ফাঁকে একটা শাসানি চিঠি লিখে ফেলে রাখলুম দরজার পাশে।

সেই চিঠিটা–ডাইনী মেয়েরা!

হ্যাঁ। তাতেও বিশেষ ভয় পেল না তন্দ্রা। তখন সেই বহুরূপীটাকে ঠিক করলুম গোপনে।

আর মিস শান্তা কী করল?

খুব ভয় পেয়েছিল তো। একটু পরেই কেটে পড়েছিল প্রাণ বাঁচাতে। তাছাড়া পুলিসের খাতায় ওর দাগী নামও রয়েছে। দেখলুম, ভারতবাবুর মুখটা গম্ভীর। সব শালা খচ্চর! ভারতবাবু শান্তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল–ভাবা যায়?

তারপর?

সারা বিকেল তন্দ্রা আমাকে টাকা দাবি করতে থাকল। রীতিমতো ব্ল্যাকমেইল। রাত সাড়ে নটায় শার্কের ওই কাণ্ডের পর বাংলোয় নিয়ে গেলুম ওকে–পালানোর ছলে। বললুম– ঠিক আছে–ভাগ দেব টাকার। কিন্তু তন্দ্রা প্যাকেটের অর্ধেক ভাগ দাবি করে বসল তখন। তন্দ্রার হিসট্রি আছে–সে ইচ্ছে করলে পুলিস বের করতে পারে। ও নানা ঘাটের জল খাওয়া মেয়ে। খুব সহজ নয়। জেদী। কুচুটে। খানকি তো বটেই। সেই সময় কথামতো কল্যাণী হাজির হলো। আমার প্ল্যান তো ওই গাড়োল পানিগ্রাহীদাটার মতো নয়। সিম্পল অ্যাণ্ড স্ট্রেইট। গাড়ির শব্দ হতেই পানিগ্রাহী এলেন তাহলে, এই বলে তন্দ্রা সিগারেটটা নিবিয়ে ফেলল। তক্ষুনি সবে ধরিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণে সব টের পেয়ে গেল। ওর চোখের সামনে প্যাকেটটা নিয়ে গিয়ে দরজা খুললুম। কল্যাণীকে ওটা দিয়ে দরজা থেকেই বিদায় করলুম। তারপর দরজা বন্ধ করে দেখি ও রাগে ফুঁসছে। লাফিয়ে এসে আমার চুল ধরল– কাকে দিলে, কে ওই মেয়েটি?…রিয়েলি কর্নেল, ওই ঢ্যামনামি দেখে তখন  মাথায় আগুন ধরে গেল। এমন ভাব দেখাচ্ছে, যেন আমার সাতপাকে বাঁধা বউ। ক্রমশ ও ক্ষেপে গেল। অকথ্য গালিগালাজ শুরু করল। আমার প্রেমও চায়, টাকাও চায়–সেক্সের ব্যাপারেও হিংসে, আবার টাকার ব্যাপারেও লোভ। তন্দ্রা– এই তন্দ্রাটা কী, আমি বুঝে উঠতে পারছিনে এখনও। শেষে ও করল কী জানেন?…বিশ্বাস করুন, ওকে স্রেফ মারধোর করে বেঁধে রেখেই সোজা কল্যাণীদের বাড়ি চলে যেতুম–কিন্তু হঠাৎ ও হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা আমার ছোরাটা তুলে নিল। আমার আর সহ্য হলো না। ছোরাটা কেড়ে নিয়ে ওর চুল ধরে বেডরুমে ঢোকালুম। তারপর… সুমন্ত দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। … কিন্তু আমি সত্যি ভালবাসতুম ওকে। ও যে আমাকে স্রেফ টাকার লোভে ব্ল্যাকমেইল করে বসবে, আমি কল্পনাও করিনি।

সুমন্ত, প্লীজ!

বলুন।

তাহলে তুমি পোশাক বদলেছিলে–

রক্ত লেগে গিয়েছিল, তাই। ওভাবে পানিগ্রাহীদার কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

ছোরাটা টেবিলে কোত্থেকে এল?

বেডরুম থেকে এনে রেখেছিলুম। বিছানায় রাখা ছিল বালিশের নিচে।

কেন এনেছিলে?

সুমন্ত জবাব দিল না।

সুমন্ত, কখন ছোরাটা বেডরুম থেকে এনেছিলে?

ঘরে ঢোকার পরই।

তখন মোমবাতি জ্বেলেছিলে?

না। একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে জ্বেলেছিলুম।

তাহলে তোমার মাথায় খুনের মতলব ছিলই, সুমন্ত অস্বীকার করো না।

জানি না। যখন ওটা আনি, খুন করব বলে আনিনি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।

বিশ্বাস করলুম না–দুঃখিত, সুমন্ত। কারণ আমি যুক্তিবাদী।…কর্নেলের, কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলো। তার চোখদুট জ্বলজ্বল করতে থাকল।…তুমি তন্দ্রার প্রথম রিঅ্যাকশন হোটেলে লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে খুনের সিদ্ধান্তে এসেছিলে। প্রবীর বহুরূপীকে তুমি যা করতে বলেছিলে, তার পিছনে তোমার ওই সিদ্ধান্তের চাপ ছিল। ওই শো-বিজনেস! নিছক ভয় দেখিয়ে তাকে চুপ করানোর জন্য নয়। তন্দ্রা যে অত সহজে চুপ করবে না–কিংবা তখনকার মতো করলেও পরে সুযোগ মতো মিঃ পানিগ্রাহীর কাছে সব ফাঁস করে দেবে, এই ছিল তোমার ধারণা। তাকে তো তুমি ভালই চিনতে। তাই যখনই লক্ষ্য করলে যে তন্দ্রা তোমার অসহযোগী, তুমি তোমার অভিজ্ঞতা অনুসারে ধরে নিলে, তন্দ্রা বরাবর অসহযোগী থেকে যাবে–

ডাঃ পট্টনায়ক বলে উঠলেন, যতক্ষণ না সুমন্ত ওকে ক্যাশ অর কাইণ্ডস কোনও ভাগ দিচ্ছে।

ঠিক। সেটাই হচ্ছে তন্দ্রার রিঅ্যাকশন বা অসহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রেমিস। তুমি একা সব হাতাতে চেয়েছিলে সুমন্ত। আধুনিক সমাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লোভটাকার প্রতি লোভ, যে লোভ হাঙরের মতো প্রতিটি মানুষকে গ্রাস করে চলেছে, তার খপ্পরে তুমি আর তন্দ্রা অনেক আগেই পড়েছ। তাই যে মুহূর্তে এক ভাগীদারকে আচমকা মাথা তুলতে দেখলে, তুমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে। এই ভাগীদারটি কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে, তাও জানা ছিল তোমার। সুতরাং তুমি একটি নাটকীয় মোডস অপারেণ্ডির পথ ধরলে। হাঙরের রাতের ঘটনা সকালে রটতে দেরি হবে না, সবাই জানবে কোনও মুখোশপরা খুনী দুজনকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে একজনকে খুন করেছে। তোমার অ্যালিবাই (অজুহাত) ভীষণ শক্ত–যেহেতু নিজেও তার সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছ, দৌড়ে পালিয়েছ। চমৎকার। পরিকল্পনা! তোমার পরিকল্পনার আরও চমকপ্রদ এবং যুক্তিসিদ্ধ অংশ হচ্ছে, তোমার পরবর্তী কার্যকলাপ। পরে তুমি টের পেলে যে প্রবীর হরবোলা হচ্ছে পরিকল্পনার একটা মারাত্মক দুর্বল গ্রন্থি। তাহলে কি প্রবীরকে সরাতে হবে? কিন্তু প্রবীরের পাত্তা কখন আবার কোথায় পাওয়া যাবে, ঠিক ছিল না। সে কাজ সময়সাপেক্ষ। সেই সময় তোমার মাথায় খেলে গেল আরেক প্রকল্প। মিঃ পানিগ্রাহীর ভারতকে ঢিট করার পরিকল্পনার মতো বিশাল আশ্রয়কক্ষ থাকতে কেন ফের খুনের ঝুঁকি নিতে যাওয়া? তাই তুমি মাল নিয়ে কেটে পড়লে না তক্ষুনি। পানিগ্রাহীর সহায়তায় খুনের দায় ভারতের ঘাড়ে চাপাবে ঠিক করলে। এতে পানিগ্রাহীর লাভ আছে–ভারতবাবু ঢিট হবেন। তুমি পানিগ্রাহীর সহযোগিতায় নামলে কোমর বেঁধে। তুমি থেকে গেলে।

পট্টনায়ক বললেন, কিন্তু ছোরাটা আমার গাড়িতে রাখল কেন ও?

সুমন্ত আস্তে বলল, আপনার বাড়ি এসে থাকব ভেবেছিলুম। কর্নেলের সঙ্গে তাই আসছিলুমও। ইচ্ছে ছিল, কল্যাণীর সাহায্যে ওটা সুযোগ মতো ভারতবাবুর হোটেলে পাচার করব।

কর্নেল মৃদু হাসলেন, অ্যামবিশাস প্ল্যান! সুমন্ত পানিগ্রাহীর কাছে আজ চুলটুল কেটে খুব আশা নিয়ে গিয়েছিল, প্রথম উদ্দেশ্য : ভারতবাবুর দিকে পানিগ্রাহীকে যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতিতে লেলিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য : পানিগ্রাহী যদি পিছিয়ে যান, কিংবা উল্টে ওকেই সন্দেহ করে বসেন তাহলে ব্ল্যাকমেইল।–

সবাই চমকে উঠল–ব্ল্যাকমেইল!

হ্যাঁ, তাই। পানিগ্রাহীর নার্কোটিকস পাচারের প্ল্যান ফাঁস করে দেবার শাসানি মাথায় ছিল সুমন্তর। এবং দরকার হলে খুনের সম্পূর্ণ দায় তার ঘাড়ে চাপানো হতো। সুমন্ত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হবে বলে ভয় দেখাতে পারত। সুমন্তর তখন তো তুঙ্গে বৃহস্পতি। নির্বোধ পানিগ্রাহীকে দিয়ে যা খুশি করার মওকা মিলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রকৃতির সবকিছুতে, কী বস্তু কী প্রাণীজগতে একটা অদ্ভুত পদ্ধতি কাজ করছে। আমরা নিজের দাঁতেই নিজেদের কবর খুঁড়ি।

মিঃ আলি এবং একটি ছোটোখাটো পুলিসদল রেনকোট পরে ঘরে ঢুকল। আলির হাতে একটা বড় কিটব্যাগ। বললেন, ড্রাগের প্যাকেট, তন্দ্রার ব্যাগ, পার্স। সবকিছু এর মধ্যে রয়েছে। বাংলোর উত্তরে বটতলায় পাথরচাপা ছিল কিটব্যাগটা খুঁজতে অসুবিধে হয়নি। রক্তমাখা গেঞ্জি আর বেলবটম প্যান্টটাও ওখানে লুকানো ছিল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, সুমন্তকে ধন্যবাদ।

সুমন্ত লাফিয়ে উঠল–গেট আউট, গেট আউট, ইউ ওল্ড ফুল! সেপাইরা তক্ষুনি ওকে ধরে ফেলল। কর্নেল আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলেন। পিছনে সুমন্তর কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন।

বারান্দায় রেনকোট আর টুপিটা পরে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নামলেন কর্নেল।

এখন তিনি অন্য মানুষ। বিচে এসে ভয়ঙ্কর গর্জনকারী প্রাকৃতিক শক্তিটিকে বাঁয়ে রেখে জীবনমৃত্যুময় অস্তিত্বের কোলসের তলায় নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ এক বৃদ্ধ চলেছেন উদ্দেশ্যহীনভাবে। তিনি ভাবছেন, মানুষ প্রবৃত্তির কাছে এত অসহায়! অথচ সুমন্ত কাঁদছে। সব হত্যাকারীই কাঁদে–কেউ মনের তলায় অবচেতনায়, কেউ প্রকাশ্যে। কিন্তু তাকে কাঁদতে হয়। এটাই তার অস্তিত্বের মানুষী ভাব।…

Exit mobile version