এখান থেকেই অনুরাধার গতিপথ খুঁজে পেলেন। দৌড়ে এলে ঘাস ছিঁড়ে ও উপড়ে যাবার কথা। ওর জুতো দুটো এখানেই কোথাও কুড়িয়ে পেয়েছে পুলিশ। শৰ্মাজী বলছিলেন, গর্তটার কাছাকাছি পাওয়া গেছে।
তার মানে অনুরাধা জুতো খুলে দৌড়ত শুরু করেছিল। কিংবা তার মতলব টের পেয়ে প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছিল।
ঘাস ছাড়িয়ে পশ্চিমে টিলার দিকে এগোতেই অনুরাধার দৌড়ে আসার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল। মাটিটা পাথুরে এবং টিলার ঢাল থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে এসে একখানে নালা মতো হয়েছে। তাতে জল নেই। বালি জমে রয়েছে। বালির ওপর ডেবে যাওয়া জুতোর ছাপ অনেকগুলো। ছাপগুলো পরিষ্কার নয়। তবে কিছু ছাপ বেশি গভীর। কিছু কম। কম গভীরগুলো অনুরাধার, তাতে ভুল নেই। বেশি গভীরগুলো নিশ্চয় আততায়ীর।
কর্নেল বালির ওপর দিয়ে এলেন একবার। তারপর নিজের জুতোর ছাপ পরীক্ষা করলেন। আততায়ীর দেহের ওজন তার চেয়ে কিছু কম। লোকটা তার চেয়ে বেঁটে। জুতোর দৈর্ঘ্য দেখে মনে হয় তার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি হতে পারে না। কর্নেলের উচ্চতা সওয়া ছফুট।
কোথাও-কোথাও টিলার ঢালের ওপর অনুরাধার জুতোর ছাপের ওপর আততায়ীর জুতোর ছাপ পড়েছে। সেই ছাপগুলো কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট। একটা প্রকাণ্ড পাথর ঘুরে ছাপগুলো ওপরে উঠেছে। পাথরটার কাছে গিয়ে কর্নেল থমকে দাঁড়লেন। পাথরটার কোণার দিকে টাটকা গর্ত খোঁড়ার চিহ্ন। এমন কী, একটা ছোট্ট খুরপিও পড়ে আছে।
দেখামাত্র মনে হল, এইমাত্র কেউ গর্তটা খুঁড়ছিল। তাকে আসতে দেখে পালিয়ে গেছে।
কর্নেল ব্যস্তভাবে ওপরে উঠতে থাকলেন। ফুট দশেক ওঠার পর চ্যাটালোত একটা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে ওধারের ঢাল ও নিচের লেকের দিকে তাকালেন। কাছাকাছি কাউকে দেখতে পেলেন না। দূরে পার্কে এবং ওয়াটার পাম্পিং স্টেশনের ওখানে কিছু লোক আছে। যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে সম্ভবত নিচের বড় বড় পাথরের আড়ালে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। মিনিট দশেক চোখে বাইনোকুলার রেখে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন। তারপর গর্তটার কাছে নেমে এলেন।
আবার থমকে দাঁড়ালেন। গর্তের ওপর এবং এই ঢালে আরও নানা সাইজের কালোপাথর পড়ে আছে। কিন্তু কোনটাই এত কালো নয়।
তাহলে কি এটাই সেই কালোপাথর?
গর্তের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসলেন কর্নেল। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে এতক্ষণে চোখে পড়ল, যে গর্ত খুঁড়ছিল, সে তাকে দেখে পালিয়ে যেতেও পারে বটে, কিন্তু যে জন্য খুঁড়ছিল, তা পেয়ে গেছে। কারণ গর্তটার তলায় আন্দাজ আট ইঞ্চি লম্বা এবং ইঞ্চি ছয়েক চওড়া কী একটা জিনিস ছিল। তার তলার ছাপটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। মাটিটা বৃষ্টিতে যথেষ্ট নরম। কারণ সে রাতের বৃষ্টির জল টিলার ওপর দিকে থেকে গড়িয়ে এসে এই কালো পাথরে বাধা পেয়ে মাটিটাকে গভীর ভাবে ভিজিয়ে দিতে পেরেছিল।
কোনও চৌকো জিনিস এখানে পোঁতা ছিল। ছোট্ট বাক্সের মতো কোনও জিনিস।
খুরপিটার বাঁটে হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। সেটা সাবধানে মাথার দিকে ধরে তুলে নিলেন কর্নেল। তারপর ঢাল বেয়ে নেমে ঝর্ণার ডোবাটার ধারে ফিরলেন।
কিন্তু ছিপ ফেলার চেয়ে যা দেখে এলেন, সেটাই জরুরী হয়ে উঠেছে। কর্নেল সব গুটিয়ে নিয়ে ফিরে চললেন বাংলোয়। ইন্সপেক্টর শর্মার সঙ্গে শীগগির আলোচনা করা দরকার।
আধঘণ্টার মধ্যে বাংলোয় ফিরে গেটের মুখে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। তিনি তাকে দেখে নমস্কার করে বললেন, আপনিই কি কর্নেলসায়েব? ভাবনা আমাকে আপনার কাছে আসতে বলল। আমি অনুরাধার বাবা।
.
০৫.
পরিতোষবাবু বললেন, আপনি বেরিয়েছেন শুনে চলে যাচ্ছিলুম। পরম সৌভাগ্য যে দেখা হল। সকালে অনুর বডি মর্গ থেকে ডেলিভারি দিয়েছিল। দাহক্রিয়া করে বাড়ি ফিরে ওর জিনিসপত্র ঘাঁটতে বসেছিলুম। আমার ছেলে মনীশ বছর দুই আগে বাস অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। তারপর অনুও এভাবে গেল। কী পাপে ভগবান এমন শাস্তি দিলেন জানি না। তো যে জন্য এসেছি বলি–
পরিতোষবাবু পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণ আগে অনুর ড্রয়ারে এটা পেয়েছি। এ চিঠি কে তাকে লিখেছে, জানি না। পুলিসের কাছে যাব ভাবছিলুম, হঠাৎ অনুর বন্ধু এল। তাকে তো আপনি চেনেন। সে বলল আগে আপনার কাছে যেতে। কারণ ভাবনার সন্দেহ, এর পেছনে প্রভাবশালী লোক আছে। তাই পুলিশ সুদীপ্তের কেসের মতো এই কেসটাও চেপে দেবে।
কর্নেল চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে চমকে উঠলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা ছোট্ট চিঠি। সরলার্থ করলে দাঁড়ায় :
২৬ অক্টোবর বিকেল পাঁচটায় ফুলঝরিয়া লেকের পূর্বদিকে টিলায় গোর্পনে : গিয়ে অপেক্ষা করবে। সুদীপ্তের হারানো জিনিসটার খোঁজ দেব। ইতি, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
কর্নেল বললেন, খুনী ওকে ফাঁদে ফেলেছিল। কিন্তু সুদীপ্তের হারানো জিনিস কী, সে সম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন?
পরিতোষবাবু বললেন, অনুর কাছে শুনেছিলুম মনে পড়ছে। সুদীপ্ত কী একটা নতুন মিশ্ৰধাতু আবিষ্কার করেছিল নাকি। একটা ফর্মুলার আকারে সেটা লিখে ব্রিফ কেসে রেখেছিল। ওর ল্যাবরেটরি থেকেই সেটা চুরি যায়।
এটা কতদিন আগের ঘটনা, জানেন?
এই তো গতমাসের। সুদীপ্ত যেদিন খুন হল, তার পরদিন অনু ওর মাকে বলছিল। আমার কানে এসেছিল কথাটা। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলুম। অনু বলল, যে মিশ্ৰধাতু সুদীপ্ত আবিষ্কার করেছিল, তা নাকি যুগান্তকারী। অসম্ভব হালকা, অথচ ভীষণ শক্তিশালী। ওই দিয়ে মহাকাশযান তৈরি করা যাবে ভবিষ্যতে। সুদীপ্ত ওকে কথাটা গোপন রাখতে বলেছিল।