আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কর্নেল! একবার মনে হচ্ছে, অনুরাধা ইচ্ছে করেই দুষ্টুমি করেছিল। আবার মনে হচ্ছে, তাহলে ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল কেন? অথচ খালি সন্দেহ হচ্ছে, ওর খুন হয়ে যাওয়ার পেছনে যেন সিয়াসের ব্যিাপারটার কোনও যোগাযোগ আছে।
কী যোগাযোগ থাকতে পারে ভাবছো?
এক হতে পারে, অনুরাধার হাত দিয়ে সুদীপ্তের আত্মা এমন কিছু লিখেছিল, যা তার খুনীকে ধরিয়ে দেবে। আর এক হতে পারে, অনুরাধা দুষ্টুমি করে–তার মানে, অভিনয় করে আসরের কাউকে কোনও হিন্ট দিতে চাইছিল।
অর্থাৎ সে জানত কে খুন করেছে সুদীপ্তকে?
ধরুন, তাই।
তাহলে তো বলতে হয়, খুনী ওই আসরেই উপস্থিত ছিল?
ভাবনা চমকে উঠল। আসরে তো ছিল সুমন ব্যানার্জি, অরুণেন্দু, মঞ্জুশ্রী আর আমি। অরুণেন্দু কলকাতায় থাকে। বেড়াতে এসেছে। আমি সুদীপ্তকে খুন করি নি। আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। মঞ্জুশ্রীও তাই। বাকি রইল সুমন। কিন্তু সুমন কেন সুদীপ্তকে খুন করবে? তাছাড়া সুমন অত্যন্ত নিরীহ ছেলে। খুব ভদ্র।
কাগজটা ডঃ রায় নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। ভাবনা জোরের সঙ্গে বলল। কিন্তু উনিই বা কেন সুদীপ্তকে খুন করবেন? সুদীপ্ত তো ওঁরই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। মঞ্জুর সঙ্গে প্রথমে সুদীপ্তেরই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সুদীপ্ত রাজি হয়নি। কিন্তু তাই বলে তাকে মেরে ফেলবেন? এ একেবারে অসম্ভব।
তাহলে স্বীকার করতে হয়, সত্যি সুদীপ্তের আত্মা এসেছিল। কিন্তু খুনীকে ধরিয়ে দেবে এমন কোনও সূত্র লিখেছিল সেই কাগজটাতে–এর প্রমাণ কী? তুমি তো দেখনি ওটা। কাজেই ওতে কী ছিল না দেখা পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় কি?
ভাবনা আস্তে বলল, আমার সন্দেহ যাচ্ছে না। আপনি একবার যাবেন আমার সঙ্গে ডঃ রায়ের কাছে?
কর্নেল, বললেন, চলো, যাই।…
ডঃ কুসুমবিহারী রায় কর্নেলের পরিচয় পেয়ে খুব আগ্রহের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চাইলেন। কাগজটা তক্ষুনি এনে দিলেন কর্নেলকে। বললেন, ভাবনা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওর সঙ্গে আমি একমত। আমিও ঠিক একই সন্দেহে ভুগছি। কিন্তু পুলিশকে আগ বাড়িয়ে এ ব্যাপারটা জানাতে যাইনি। কারণ আশা করি, বুঝতেই পারছেন। পুলিশ বড় আনপ্রেডিক্টেবল! উল্টে আমাদের কাউকে জড়িয়ে বসবে হয়তো। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব চিন্তাভাবনা করেছি। এর একটা আশকারা হওয়া দরকার। দীপ্তেন্দু আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল–অনুরাধাও।
কর্নেল কাগজটা দেখছিলেন। পেন্সিলে লেখা। ৩৪৭ নং পিট, কালো পাথর, মোহান্তজী। বললেন, এই কথাগুলো অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন কি!
ডঃ রায় চিন্তিতমুখে বললেন, খনি এরিয়ার ম্যাপ দেখে বুঝতে পেরেছি, ওটা একটা ডেড মাইন। জায়গাটা আট কিলোমিটার দূরে ফুলঝরিয়া লেকের পশ্চিম দিক দিয়ে যে হাইওয়ে গেছে, সেই রাস্তায় ডেড মাইন এলাকায় যাওয়া যায়। সবই অ্যাবাণ্ডাণ্ড মাইন। মুখ সিল করা আছে। দেখাচ্ছি আপনাকে।
বলে উনি ভেতরের ঘর থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে এলেন। সেটা টেবিলে ছড়িয়ে এলাকাটা দেখিয়ে দিলেন। এই হল পিট নং ৩৪৭। এই দেখুন, লেখাই আছে। মুখটা পাথর আর কংক্রিটের চামড়া দিয়ে সিল করা আছে। এটা ছিল অভ্রের খনি।
কর্নেল বললেন, আর কালো পাথর?
কালোপাথর তো বারাহিয়া ব্লকের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এর অর্থ কী বুঝতে পারিনি।
মোহান্তজী?
ডঃ রায় বলার আগেই ভাবনা বলে উঠল, কেন? পার্বতীমন্দিরের মোহান্তজী!
ডঃ রায় বললেন, হ্যামন্দিরের সেবায়েত উনি। উনি ছাড়া আর এ এরিয়ার তো কোনো মোহান্তজী নেই। কিন্তু মোহান্তজী তো বুড়ো মানুষ। মন্দিরেই থাকেন প্রায় সারাক্ষণ। ওঁর নাম কেন লিখল–অনুরাধা লিখুক অথবা দীপ্তরে আত্মাই লিখুক–কিছুতেই মাথায় আসছে না।
আপনার ভাগ্নে অরুণেন্দু আছেন কি?
মঞ্জুশ্রী বলল, অরুদা একটু আগে বেরিয়েছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি।
ডঃ রায় একটু হাসলেন। ওঁর ওই অভ্যাস! টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো। এখানে এসে একদণ্ড ঘরে বসে থাকতে চায় না। ভূতপ্রেতের খোঁজেই হয়তো ঘুরে বেড়ায়।
মীনাক্ষী বললেন, নিশ্চয় মোহান্তজীর কাছে গিয়ে বসে আছে। মোহান্তজীও যে ওর দোসরা ভূতের ওঝা!
ডঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ–মোহান্তজী বস্ত এরিয়ার সব ভূতপ্রেতের একচেটিয়া মালিক। বস্তর মেয়েদের নাকি প্রায়ই ভূতে ধতে। ওঁর পোষা প্রেত কিংবা পিশাচ ভূতটাকে তাড়িয়ে দেয়।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কাগজটা আর এই ম্যাপটা আমি একদিনের জন্য রাখতে চাই, ডঃ রায়। আপত্তি আছে কি?
না, না। রাখুন। ডঃ রায় ঘড়ি দেখে বললেন, আমাকেও এখনই অফিসে যেতে হবে। আবার দেখা হবে। এ বাড়িতে আপনার অবারিত দ্বার। তাছাড়া আমি চাই, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী ধরা পড়ুক। পুলিস হোপলেস! আপনি আমার কাছে সর্বপ্রকার সহযোগিতা পাবেন–আই অ্যাসিওর ইউ।…
রাস্তায় গিয়ে ভাবনা বলল, কর্নেল মোহান্তজীর কাছে যাবেন একবার?
চলো, যাই।
ভাবনা পা বাড়িয়ে বলল, ওই দেখা যাচ্ছে বটগাছের ভেতর মন্দিরের চুড়ো। কাছেই।
মন্দির এলাকা বেশ বড়। পাঁচিল ঘেরা প্রাঙ্গণ। একটা আটচালা আছে প্রাঙ্গণে। ওপাশে কয়েকটা একতলা ঘর। জরাজীর্ণ অবস্থা। মন্দিরটার চেহারা বেশ পরিচ্ছন্ন। পেছনে বিশাল বটগাছ আছে। মন্দিরের ভেতর একাদশ শতাব্দীর পার্বতীমূর্তি। পাশের একতলা ঘরের বারান্দায় খাটিয়া পেতে দাড়িজটাজুটধারী এক বৃদ্ধ বসে আছেন। তিনিই মোহান্তজী। ভাবনাকে দেখে বললেন, আয় বেটি আয়।