কর্নেলের মনে পড়ল। কাল রাতে হাসপাতালের মর্গে অনুরাধার বাবা-মায়ের সঙ্গে ওকে দেখেছিলেন। ভীষণ ভেঙে পড়েছিল। অনুরাধর মা ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ওই মেয়েটিই তাহলে অনুরাধার বন্ধু ভাবনা।
কর্নেল বললেন, বসুন। আশা করি, আপনি অনুরাধার বন্ধু ভাবনা। আমাকে আপনি বলবেন না প্লিজ। মুখোমুখি বসে বলল। কাল রাতে অফিসারদের সঙ্গে আপনাকে দেখেছিলুম। একটু আগে ইন্সপেক্টর মিঃ শর্মার কাছে গিয়েছিলুম কিছু কথা বলতে। কিন্তু উনি আমার কথার গুরুত্ব দিলেন না। হাসতে হাসতে বললেন, সিয়াসেটিয়াসে আমি বুঝি না। এ কেসের সঙ্গে ওসবের কী সম্পর্ক? বরং আপনি সেচবাংলোয় কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে দেখা করুন। উনি ওইসব ব্যাপার বুঝবেন।
কর্নেল হাসছিলেন। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, সিয়াসে?
ভাবনা বলল, তার আগে প্লিজ বলুন, আপনি কি সেই বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর কর্নেলসায়েব? কমাস আগে টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় আপনার একটা হিস্ট্রি পড়েছিলুম। শৰ্মাজী আপনার নাম বলার পর তা মনে পড়েছে। সেজন্য ছুটে আসছি।
ভাবনা, সিয়াসের ব্যাপারটা কি?
আমার গুড লাক, কর্নেল! ভাবনা একটু হাসবার চেষ্টা করল। আপনাকে মুখোমুখি দেখব এবং কথা বলব, স্বপ্নেও ভাবিনি! এখন আমার মনে হচ্ছে, সুদীপ্ত আর অনুরাধার খুনী শীগগির ধরা পড়বেই পড়বে। সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।
কিন্তু…..কর্নেল হাসলেন। তুমি রহস্যের জট আরও পাকিয়ে তুলছ, ভাবনা!
ভাবনা চারপাশ দেখে নিল। বাংলো নির্জন। কিচেনের দিকে চৌকিদারের বউ কাজে ব্যস্ত। তার এদিকে চোখ নেই। ভাবনা চাপা গলায় বলল, আজ সাতাশে অক্টোবর, চব্বিশে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমি আর অনুরাধা সুদীপ্তের দিদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। সুদীপ্তের ওই বিধবা দিদি ছাড়া এক কেউ নেই। মাঝে মাঝে ওঁকে সাহায্য করতে যাই। সুদীপ্ত ওমাসে হঠাৎ মার্ডার হওয়ার
কে সুদীপ্ত?
ধাতু গবেষণা কেন্দ্রে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। একুশে সেপ্টেম্বর সকালে ওর ডেডবডি পাওয়া যায় পোডড়া খনি এলাকয়। পুলিশ এ পর্যন্ত কোনও কিনারা করতে পারেনি সে-কেসের।
তোমাদের সঙ্গে আলাপ ছিল তাঁর।
হ্যাঁ, অনুরাধার সঙ্গে সুদীপ্তের গোপন সম্পর্ক ছিল। সেটা শুধু আমিই জানতুম। অনুরাধার সঙ্গে ওর বিয়েও হয়ে যেত এতদিনে।
হুঁ, তারপর?
সুদীপ্তের দিদি বিশাখাদির সঙ্গে দেখা করে সাইকেলরিকশোয় ফিরে এসেছিলুম। পার্বতীতলার মোড়ে রিকশো ছেড়ে ভাবলুম, বাকি রাস্তা হেঁটে যাব। হাঁটতে, আমার ভাল লাগে। তখন অবশ্য রাত দশটা বেজে গেছে। অনুরাধা আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে। পার্বতীতলা থেকে একটুখানি পথ মাত্র। কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। তখন দৌড়ে মঞ্জুশ্রীদের বাড়ি ঢুকলাম। মঞ্জুশ্রী মানে–
বুঝতে পেরেছি। বলো।
মঞ্জুশ্রীর পিসতুতো দাদা অরুণেন্দুর সঙ্গে আলাপ হল ওদের বাড়িতে। সে সিয়াসের আসর করতে চাইল। ব্যাপারটা আমার জানার আগ্রহ ছিল। ওদের ডাইনিং টেবিলে আসর বসানো হল। অরুণেন্দু কেন জানি অনুরাধাকেই মিডিয়াম হতে রাজি করাল। আমাকে অবাক করে অনুরাধা রাজি হয়ে গেল। সিয়াসের আসর কীভাবে হয় জানতুম না। অরুণেন্দু বুঝিয়ে দিল।
ভাবনা সে রাতের ব্যাপারটা বর্ণনা করলে কর্নেল বললেন, অনুরাধা সুদীপ্তের নাম লিখেছিল?
লিখেছিল–মানে সুদীপ্তের আত্মা ভর করেছিল ওর মধ্যে। সেই লিখেছিল।
আর কী লিখেছিল?
অরুণেন্দু প্রশ্ন লিখছিল আর সুদীপ্তের আত্মা তার জবাব লিখছিল। একটু পরে হঠাৎ অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেল। আসর ভেঙে গেল। কী লিখেছিল ওরা, আর দেখিনি। কাগজটা অরুণেন্দুর হাতেই ছিল। সে একটু পরে ওটা ওর মামা ডঃ রায়কে দিল। উনি রেখে দিলেন কাগজটা।
কাগজটা তাহলে তুমি দেখনি?
না।
বাড়ি ফেরার পর কোনও সময় অনুরাধাকে জিগ্যাসা করোনি কিছু?
করেছিলুম। ও বলেছিল, কিছু জানে না। কী লিখেছিল ওর মনে নেই।
সুদীপ্তের মৃত্যুর পর অনুরাধা ওর সম্পর্কে এমন কিছু কি বলেছিল তোমাকে, যাতে তোমার ধারণা হয়েছিল যে সে কিছু জানত?
ভাবনা একটু ভেবে বলল, না তো। এমন কী কাকে ওর সন্দেহ হয় তাও বলেনি। কিন্তু ….
কিন্তু?
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, অনুরাধা হয়তো কিছু জানত। আমাকে বলেনি।
কেন মনে হচ্ছে?
কাল দুপুরে অনুরাধা আমাকে ফোন করে বলেছিল, বিকেলে ফুলঝরিয়া লেকে বেড়াতে যাবে। আমি ওর সঙ্গে যাব কি না। আমি বললুম– গাড়ি ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাবাকে গাড়ির কথা বললে জিগ্যেস করবেন কোথায় যাচ্ছি। ফুলঝরিয়ার নাম শুনলে কিছুতেই যেতে দেবেন না। ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার সময় ট্যাক্সি পাব না। রিকশোও পাব না। হাঁটতে হবে। তাই ওকে বারণ করলুম। অনুরাধা ঠিক আছে বলে ফোন ছেড়ে দিল। তো ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। কিছুক্ষণ পরে ওদের বাড়ি গিয়ে শুনলুম ও এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। আমি ভাবতেই ও একা ফুলঝরিয়া চলে গেছে। কিন্তু এখন অবাক লাগছে, কেন ফুলঝরিয়া যেতে চেয়েছিল অনুরাধা?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে হেলান দিলেন। তারপর বললেন, সিয়াসের আসরের ব্যাপারটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, বুঝতে পারছি। কেন তা তুমি ওই ব্যাপারটাই বলতে গিয়েছিলে শৰ্মাজীর কাছে। অথচ তুমি বলছ, সুদীপ্তের আত্মাই অনুরাধার শরীরে ভর করেছিল।