মৎস্যশিকারী বৃদ্ধ এদিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। তার পা ফেলার ভঙ্গিতে সুমন বুঝতে পারছিল ভদ্রলোককে যতটা বৃদ্ধ মনে করেছিল, ততটা হয়তো নন। যুবকের মতো শক্তসমর্থ যেন। কাছে এসে বললেন, সামথিং হ্যাড ইয়ং ম্যান?
সুমন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অনুরাধাকে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক চমকে উঠে দ্রুত এগিয়ে গেলেন গর্তটার দিকে। তারপরে অস্ফুটস্বরে বললেন, মাই গুডনেস! আমার মাত্র একশো মিটার পেছনে।
তারপর ঘুরে সুমনকে বললেন, এরই খোঁজেই আসছিলেন কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সুমন আড়ষ্টভাবে জবাব দিল। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।
আপনার কি নাম! কোথায় থাকেন? এই মেয়েটি কে?
সুমন ব্যানার্জি। থাকি বারাহিয়ার নিউ কলোনিতে। সুমন ঢোক গিলে বলল, এ অনুরাধা।
কুইক। এখনই বারাহিয়া থানায় গিয়ে খবর দিন। আমি থাকছি এখানে। ইন্সপেক্টর মিঃ মোহন শর্মা থাকলে তাকে বলবেন, কর্নেল আছে ডেডবডির কাছে।
সুমন একটু অবাক হল। কর্নেল? কর্নেল কী…মানে আপনার পুরো নামটা…
বৃদ্ধ একটু হাসলেন। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। এবার টিলার দিকে নয়, উত্তরদিকটা ঘুরে সহজ পথে।…
.
০৩.
এই শরৎকালে বারাহিয়া এলাকায় বেড়াতে এসে হত্যারহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের এতটুকু ছিল না। কিন্তু চেঁকি স্বর্গে গেলেও তাকে ধান ভানতে হয় এটাই চেঁকির নিয়তি। ফুলঝরিয়া লেকের আশেপাশে সকালে একজাতের প্রজাপতি দেখেছিলেন। তাছাড়া লেকের পূর্বপ্রান্তে ঝর্ণার মোহানায় ছোট্ট জলাশয়ে ছিপ ফেলে বিকেলটা কাটানো লোভনীয় মনে হয়েছিল। কল্পনাও করেননি, তাঁর মাত্র একশো মিটার পেছনে এইভাবে একটা সাংঘাতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবে–নিয়তি যেন তার সঙ্গে একটা কদর্য পরিহাস করে বসল।
নিহত মেয়েটির নাম অনুরাধা সান্যাল। তার বাবা পরিতোষ সান্যাল স্থানীয় সরকারি শিল্পসংস্থার কর্মিদফতরের অফিস সুপারিন্টেন্টে। আর এক বছর পরে রিটায়ার করবেন। তার কাছে পুলিশ এমন কোনও সূত্র পায়নি, যাতে অনুরাধার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রণয়-প্রতিহিংসা বা এধরনের কোনও ব্যাপার আছে বলে মনে হবে। অনুরাধা নাকি সাদাসিধে আর মুখচোরা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে ডঃ কুসুমবিহারী রায়ের মেয়ে মঞ্জুশ্রী আর শান্তপ্রসাদজীর মেয়ে ভাবনা। তারাও পুলিশকে কোনও সূত্র দিতে পারেনি। মঞ্জুশ্রী যা বলেছে, তাতে সুমন ব্যানার্জীর অ্যালিবাই সঠিক সাব্যস্ত হয়েছে। তারা দুজনেই দেখেছিল, অনুরাধা দৌড়ে টিলা বেয়ে ওপাশে নেমে যাচ্ছে। শুধু এটুকু বোঝা যায়, কেউ তাকে তাড়া করে গিয়ে ছুরি মেরেছে। সুমনের বক্তব্য হল অনুরাধার ওভাবে দৌড়ানোটা তার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তাই সে খোঁজ নিতে গিয়েছিল হন্তদন্ত হয়ে।
যে গর্তে অনুরাধার বডি পড়ে ছিল, তার চারপাশে মাটিতে ঘন ঘাস। তাই তাদের ছাপ পাওয়া অসম্ভব। টিলাটার ঢালু অংশে মাটি পাথুরে। আগের রাতে বৃষ্টি হলেও পায়ের বা জুতোর ছাপ পড়ার মতো নরম হয়নি মাটিটা। অন্তত পুলিসের চোখে পড়েনি কোনো ছাপ।
ইন্সপেক্টর শর্মাজী সকালে সেচ দপ্তরের বাংলোয় এসে কর্নেলকে এইসব কথা জানিয়ে গেছেন। তার সিদ্ধান্ত হল ফুলঝরিয়া লেকের ওদিকে খুনোখুনি না হলেও মেয়েদের প্রতি মস্তানদের দৌরাত্মের অভিযোগ ইতিপূর্বে পাওয়া গেছে। অনুরাধাকে সম্ভবত কোনো মস্তানই রেপ করার জন্য তাড়া করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে রাগের চোটে ছুরি মেরে পালিয়ে গেছে। ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার দুবৃত্তরা খুব সহজেই ছুরি চালাতে ওস্তাদ।
সিদ্ধান্তটা তত টেকসই অবশ্য নয়। তবু পুলিশের নিজস্ব কিছু প্রবণতা ও পদ্ধতি আছে এসব কেসে। তাছাড়া আজকাল যথেষ্ট খুনোখুনির দরুন পুলিশ আগের মতো মাথা ঘামাতে চায় না। রুটিন ডিউটি সেরে নেয় মাত্র।
কর্নেলেরও মাথা ঘামাবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু তার মাত্র একশো মিটার দূরত্বে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে, ওটাই তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সারারাত ভাল ঘুমোত পারেননি। বারবার মনে হয়েছে, এ যেন একটা সাংঘাতিক ধৃষ্টতার সামিল। সামরিক জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর হিসেবে তার অভিজ্ঞতাটি বিরাট। ইদানিং তিনি হত্যারহস্য ছেড়ে প্রকৃতি রহস্যে মন দিয়েছিলেন। অথচ নিয়তি প্রতি পদক্ষেপে তার সামনে একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলে তার সঙ্গে কুৎসিৎ রসিকতা করে চলেছে।
কর্নেল বাংলোর বারান্দায় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলেন, কোন পথ ধরে এগিয়ে যাবেন, অনুরাধার জীবনের ব্যাকগ্রাউণ্ড জানার জন্য কি তাদের বাড়িতে যাবেন, নাকি সেই টিলার কাছে গিয়ে আততায়ীর কোনও চিহ্ন খুঁজে বের করবেন। আজ সকালে ছুরিটা অবশ্য গর্তের জলের খুঁজে পেয়েছে পুলিস। কিন্তু জলে ধুয়ে গৈছে ছুরির বাঁটে আততায়ীর হাতের ছাপ এবং গন্ধ। তবে অন্য কোনও চিহ্ন কি মিলবে না যা আততায়ী সম্পর্কে একটু অন্তত আভাস দেয়!
বাংলোর গেট দিয়ে এক যুবতীকে আসতে দেখে কর্নেল তাকিয়ে রইলেন। যুবতীর মুখে অবাঙালী আদল। কোথায় দেখেছেন যেন। খুব সম্প্রতি দেখেছেন যুবতীটি বারান্দায় উঠে নমস্কার করে চমৎকার বাংলায় বলে উঠল, আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?