ঢুকে দেখি সুদৃশ্য হারিকেন ল্যাম্প জ্বলছে এবং এটা বসার ঘর। আমরা দুজনে দুদিকে দৌড়ে গেলুম। সৌভাগ্যবশত, আমি আরেকটা পর্দা ছিঁড়ে (পরে দেখেছি এত ভয় পেয়েছিলুম, কিংবা রাত্রির অসুখের বিরুদ্ধে এত বেশি অবচেতন হিংসা ছিল যে দুটো পর্দা ফেড়ে ফেলেছি) আরেক ঘরে ঢুকে আরেকটা ছোট্ট আলোর গম্বুজ হাতে নিয়ে জেলাশাসককে দেখলুম, অচেতন স্ত্রীর মুখের দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। আমার শব্দ পেয়ে বললেন, অজ্ঞান হয়ে গেছে!
সামনে বিছানার ওধারে খোলা পর্দা ওঠানো জানালা। তার নিচে অমু ভারতকে দেখতে পেলুম। অমু বলল, কই, কেউ তো নেই! এখানটায় ঘাস বড্ড, বালি থাকলে পায়ের দাগ পাওয়া যেত!
বিহ্বল বললেন, ও কিছু না চলে আসুন! ওর হ্যাঁলুসিনেশা!
অমু জানালায় নাক ঠেকিয়ে বাইরে থেকে নিস্তব্ধ রাত্রিকে দেখছিল। চমকে উঠলুম ওর চোখ দেখে। কী নীল, কী জান্তব! অমু বলেছিল, রাত্রি তার চেনা মেয়ে। আমি কাকেও বলিনি কিছু। তবে দিগুও ইশারা দিয়েছিল, রাত্রিকে সে চিনত। এই চেনাচেনির ব্যাপারটা এইসময় মাথায় এসে মনে হল, আমরা সবাই আজ এক ভয়ঙ্কর নাটকের পাত্রপাত্রী যেন।
হ্যালুসিনেশান! ভুল ঘরে ধাক্কা খেয়ে দিও চলে এসেছিল। এখন সবিস্ময়ে বলল।
হ্যাঁ আজ দুপুর থেকেই এই হচ্ছে। এ নিয়ে চারবার হল। জেলাশাসক বললেন।
আমি বললুম– সেন্ট্রি গার্ড রাখলে ভাল হতো মিঃ মজুমদার।
জেলাশাসক হাসলেন। নাঃ। স্রেফ হ্যালুসিনেশান! এক্ষুণি ঠিক হয়ে যাবে। তারপর সম্ভবত স্মেলিং সল্টের শিশি নিয়ে এলেন হোয়াটনটের মাথা থেকে।…
.
০২.
কিছুক্ষণ পরে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে ফের লনে পৌঁছলুম। ভারত চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করে দিল। এখনও চাঁদ খুব ঝকমক করছে না। রাত্রি এখন আমাদের সঙ্গে। সে হাসিখুশি। পায়ের ওপর পা তুলে দোলাচ্ছে এবং দিগুকে কবিতা শোনাতে বলছে। সেই কবিতাটাই শুনতে চায় সে বারান্দা থেকে নাকি শুনছিল কিছুক্ষণ আগে। দিগু একটু কেসে রেকর্ড বাজানোর ভঙ্গিতে চাপা আবৃত্তি করে গেল
ধীরে বৃও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক–
গোরস্থানে সংহত কফিনে…
হঠাৎ রাত্রি বাধা দিল, দিগম্বাবু! এ কিন্তু আচমকা রসভঙ্গ হলো–যাই বলুন। রাত্রি হেসে উঠল।
দিগু বলল, কেন বলুন তো? (আশ্চর্য, দিগুর চোখদুটও অত নীল কেন? জান্তব কেন?)
বেশ চলছিল। হঠাৎ শামুক গোরস্থান কফিন…এসব কী। যেন পূরবী-তে আচমকা ঝাঁপতালে মালকৌষের আক্রমণ!..রাত্রি মাঝে মাঝে কী চমৎকার সুস্থ ও স্বাভাবিক কথা বলছে! তার স্বামী দুঃখিত মুখে তাকালেন কি তার দিকে? মৃদু চাঁদের গোলাপী আভা ছাড়া আলো নেই–তাই সব দুঃখময় মনে হচ্ছিল।
দিগু বলল, একটা গোরস্থান দেখলুম ওখানে। তাই।
জেলাশাসক জানালেন, হ্যাঁ। দ্যাটস এ ট্রাজিক স্টোরি। ১৯৪২-এ এদিকে অগাস্ট আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ সরকার একদল সোলজার পাঠায়। তারা সেই ভয়ঙ্কর সমুদ্রবন্যায় মারা যায়। তারপর…..বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে কী দেখতে দেখতে ফের বললেন, আশ্চর্য! কর্নেলের গাড়ির শব্দ শুনলুম কতক্ষণ আগে, মনে হলো আলোও দেখেছি–অথচ এখনও আসছেন না তো!
রাত্রি সুস্থ। ও বলল, ওঁর যা অভ্যাস। কোনও বালিয়াড়ির চুড়োয় বসে চাঁদ দেখছেন।
এই সময় ফাঁক পেয়ে তাকে জিগ্যেস করলুম, মিসেস মজুমদার, ইয়ে–আপনি জানালার নিচে যে লোকটা দেখেছিলেন, তার পোশাক কী রকম?
নিশ্চয় ভুল করলুম। কারণ, অমনি রাত্রি ফের সুস্থতা হারাল। সে হি-হি-হি-হি করে এত জোরে হাসল যে চুল খুলে গেল। তার চশমা পড়ে গেল। সে দিগুর দিকে আঙুল তুলে অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল–এর মতো–ঠিক এই ভদ্রলোকের মতো! ওই পোশাক! ওইরকম চেহারা! আমি ওকে আর তাবলে ভয় পাচ্ছিনে। উ–আমি কি কচি মেয়ে? এবং তাতেও ক্ষান্ত হলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে আরও বলল–কী ভেবে এসেছ তোমরা? কী মতলব? এই ডি এম বাহাদুর! এদের অ্যারেস্ট করছ না কেন? এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স কী জন্যে এসেছে জানো?
বিহ্বল বিব্রতমুখে টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর কাধ ধরে বললেন, প্লীজ, প্লীজ! রাত্রি, আর নয়। ছি ছি, এ কী করছ তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে ওকে ধরলেন। নিয়ে গেলেন বাংলোর দিকে। আমি প্রচণ্ড অপ্রস্তুত-মুখ নিচু করে বসে রয়েছি। দিগন্ত চাঁদ দেখছে। অমু রাগী-চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে।
তারপর বিহ্বল এলেন। এসে বললেন, নেভার মাইণ্ড! হ্যালুসিনেশান তো সজ্ঞানে হয় না। তবে আশ্চর্য, ও প্রতিবারই জানালার নীচেকার লোকটার যা বর্ণনা দিচ্ছে, তার সঙ্গে দিগন্তবাবুর পোশাক বা চেহারার আশ্চর্য মিল!
দিগন্ত নার্ভাস হেসে বলল, কিন্তু আমি তো বরাবর এখানে আছি। পিছনে যাই-ই নি।
ডি এম বললেন, সেই হচ্ছে মজা। এক মিনিট–দেখাচ্ছি। ডাক্তারদের হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই ভাবছিলুম কিছু করা যায় নাকি। আফটার অল, এ তো মানসিক ব্যাপার। দেন–হুঁ ইজ হার অলটাইম কম্পানিয়ান, তার পক্ষে অনেককিছু করা সম্ভব। আমি তাই হ্যাঁলুসিনেশানের ব্যাপারে পড়াশুনা আরম্ভ করলুম। আশ্চর্য লাগছে–এই একটু আগে মনে পড়ল, আমার কাছে একটা ভালো বই রয়েছে তার এক জায়গায় অবিকল জানলার নিচে একটা লোকের হ্যালুসিনেশান বর্ণনা করা হয়েছে। ভারত! আমার টেবিল থেকে সবচেয়ে মোটা বইটা নিয়ে এস তো।