ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে–মৃত্যু অনুগামী….
শিউরে উঠলুম। এই কি মৃত্যুর স্বাদ? অনুগামী মৃত্যু কি পা টিপে টিপে সত্যি সত্যি আসছে–ধীর অনুসরণে, বালিয়াড়িতে দীর্ঘ ছায়া ফেলে, তার পায়ের শব্দ ফুটে উঠছে ক্রমশঃ, এই নির্জন সন্ধ্যার বাংলোয়? অথচ মস্তিষ্কে এ কীরকম হিমবাহ স্বপ্নের মধ্যে বিপদ আসার মতো অসহয়তা, এবং যখন শরীর জড়বস্তু ছাড়া কিছু নয়।
কিছুতেই এই ভাবটা ঘুচল না। জিনের গ্লাসটা হোস্টের আগেই তুলে নিলুম অভদ্রতা নিশ্চয় হল কিন্তু যুদ্ধের গোলাগুলির মধ্যেও আত্মরক্ষার উপায় বালায় যে সনাতন বোধ, সে যেন খুঁচিয়ে দিল–তৈরি থাকো, তৈরি হয়ে পড়ো, ঝটপট! আসন্ন যা-যা অনিবার্য, তার জন্যে।
আর কেউ আসবেন নাকি? অমু প্রশ্ন করল।
হোস্ট জেলাশাসকটি বললেন, হু। কর্নেল।
দিগন্ত চেয়ার ছেড়ে সোজা হল।…..কর্নেল! কে তিনি?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এলে দেখবেন, এক অসাধারণ পারসোনালিটি! যে কোনও বয়সের লেডি অর জেন্টলম্যান হোক না, অ্যাটওয়ান্স সে টের পাবে, কর্নেল ইজ এ ভেরি ভেরি গুড কমপানিয়ান! সো চারমিং, সো ইনটেলিজেন্ট, সো মাইটি সেন্স অফ ডিডাকশান ফ্রম দা ফ্যাকটস, সো এলাবোরেট নলেজ অফ ডিটেকশন…..,
মলোচ্ছাই! বাংরেজি ঝাড়ছে দেখি! এ যে মাল না টানতেই গন্ধে বেহেড হয়ে গেল! বিকেলে লোকটা তার মানসিক রুগী বউ (আহা, আমার রাত্রি! আমার রহস্যময়ী রাত্রি!) আর তার এই চাকরি প্রসঙ্গে একটা শব্দ বারবার ব্যবহার করছিল : হামড্রাম একজিস্টেন্স। লালচে চুলওয়ালা লম্বা নাকবিশিষ্ট এই লম্বু ফর্সাগুলো বরাবর ব… নির্বোধ হয় দেখেছি। রাত্রি, হায়, রাত্রির মতো আত্মসচেতন সহস্রচক্ষু সেনসেটিভ মেয়ে তো কম দুঃখে পাগল হয়নি!
কিসের ডিডাকশন-ডিটেকশন বুঝলুম না। অমু স্পষ্টভাষী স্বভাবে আস্তে বলল।
হি ইজ অ্যাকচুয়ালি এ প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।
অফ?
ক্রাইম। বলে খুক খুক করে হেসে বিহ্বল গেলাস তুলে বললেন–চিয়ার্স!
আবার আমার মাথার ভিতর একটুকরো বরফ ধসল। ক্রাইম! স্বপ্নের মতো চেঁচানোর চেষ্টা করে বললুম–কী ক্রাইম?
জেলাশাসক ঠোঁটে হাসি রেখে জবাব দিলেন–মার্ডার! অমনি আরর এই দন্ত জিহ্বা কম্পনকারী ধ্বনিটি বিস্তৃত হতে হতে কোথাও দূরে আরও ভয়ঙ্কর হতে থাকল এবং বালিয়াড়ির মাথায় ঝাউবনে যেন আগুন লাগল। তখন বিহ্বল মজুমদার খিকখিক করে হেসে বললেন, আসছেন। কর্নেল ইজ কামিং!
যেন মহানন্দে পরপর দুটানে গেলাস শেষ করে এবং ফের ভরে ও শেষ করে জ্বলজ্বলে চোখে সেইদিকে তাকালেন। চাউনি দেখে ভয় লাগল। কী নীল, কী জাম্ব!
মার্ডার! বাবার শিউরে উঠলুম। অথচ সবই স্বপ্নের মধ্যে এত অসহায়, কিছু করা যায় না, কারণ উজ্জ্বলতাগুলি বুকে নিল কঠিন শামুক গোরস্থানে সংহত কফিনে।…..
এবং ঠিক সেই সময় ঘর থেকে রাত্রির আর্ত চিৎকার শোনা গেল–তোমরা এস, তোমরা এস! জানালার নিচে সেই লোকটা এসেছে। জানালার নিচে সেই লোকটা?
মুহূর্তে একটা হতচকিত হুলুস্থুল ঘটে গেল এবং তাই স্বাভাবিক ছিল।
আমার ডাইনে, যেখানে দিগু ছিল–তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাউবনের কালো বাসায় তখন লাল চাঁদটা পাখির ডিম ভেঙে যাওয়া ব্যাপার, হলফ করে বলছি ঠিক তাই এবং না হলে সেই লাল থলথলে গোটাটার মধ্যে প্রথমে আমার চোখদুটো তারপর মগজসমেত আমি নিজে আঠালো চ্যাটচ্যাটে বস্তুতে আটকে পড়তুম না অন্তত আধমিনিটের জন্যে! দুদ্দাড় ধুপধাপ অস্পষ্ট শব্দগুলো পরিস্থিতিকে মুচড়ে ভয়ের বস্তায় ভরে ফেলছিল। দিগুর চেয়ারটা পড়ে যেতে দেখলুম, কিংবা আমারটাই–(পরে দেখেছিলুম সবকটা চেয়ারই পড়ে গিয়েছিল টেবিলটা বাদে) অমুর কথা শুনলুম–কী ব্যাপার এবং লম্বা নির্বোধ ভদ্রলোকটি, আমাদের মাননীয় বন্ধু ও হোস্ট, কুসুমগলা লালচে, ব্যাপারটার মধ্যে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পিছলে যেতে যেতে চেঁচিয়ে উঠলেন–রাত্রি! রাত্রি! ভয় নেই–ভয় নেই! আর আমার তখনও স্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়া মাকড়সার মতো হয়েছে। কিন্তু তাহলে তো চলবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। রাত্রি–আমার রাত্রির ডাক! দ্বিতীয়বার রাত্রি বুক ফেটে চেঁচাল–সেই লোকটা এসেছে। জানালার নিচে সেই লোকটা! বাঁচাও, বাঁচাও! একটু পরে দেখলুম, আমি দিগু আর অমুকে ঠেলে বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে ভারি পর্দাটা ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলেছি। কখন লনের ছইঞ্চি খাপি দলদলে ঘাসে সেই আঠালো রঙীন ব্যাপারটা মুছে ফেলে এসেছি, হুঁশ নেই। মুছে ফেলেছি বলার কারণ, এখন আমার শরীর ভীষণ খসখসে শুকনো লাগছিল। আর ডাইনে দুতিন মিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিলুম ব্যাটাছেলে ভারত-অমুকে-খাকি হাফপ্যান্ট হাফশার্ট থাকায় দুর থেকে বিষাদময় আজকের সন্ধ্যা ও লাল আঠাটার মধ্যে তাকে সনাক্ত করা। কঠিন যে সে একটি সজীব পদার্থ।
ভিতরে কিছু ঘটছিল। নির্বোধ ভদ্রলোকের রাত্রি রাত্রি চিৎকার, দুমদাম শব্দ, রাত্রির চেরাগলায়–বাঁচাও বাঁচাওকরুণ কান্না। দিগু বিকট গৰ্জাল–অ্যাই ভারত, জানালার নিচেটা দেখে এস শীগগির!
অমু বলল, টর্চ! টর্চ নিয়ে যাও!
আমি বললুম– লাঠি! লাঠি!
ভারত করুণ কেঁদে বলল, মুই একা পারিবু না সার! আপুনি আসুন।
তখন অমু, দ্বান্দ্বিক জড়বাদী ও অমর্তে অবিশ্বাসী অমর্ত্য তার বলিষ্ঠ বেঁটে দেহ নিয়ে তার হাত ধরে বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিল পূর্বদিক। ঘুরে পেছনে চলে গেল বাংলোটার। তার যাওয়ার মধ্যে খুনে স্বভাবের লক্ষণ ছিল। যেন বিপ্লব এলে এরকম মরণাপ সে দেবে পরিখায় এবং জানালার নীচের লোকটার মতো শ্রেণীশত্রুর চুল খামচে ধরবে। ফের শিউরে উঠলুম।