অরুণেন্দু বলল, সুদীপ্তকে তুমি চিনতে, সুমন?
সুমন উঠে দাঁড়াল। অল্পস্বল্প। তবে ওর কথা আর নয়। দেখি বৃষ্টি কমল নাকি।…
.
০২.
বারাহিয়া টাউনশিপে জল সরবরাহ করা হয় ফুলঝরিয়া লেক থেকে। লেকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। চারিদিকে টিলাপাহাড় আর জঙ্গল। এক দিকটায় সুন্দর পার্ক করা হয়েছে সমতল জমির ওপর। পার্কে বিকালের দিকে অনেকে বেড়াতে আসে। ছাব্বিশে অক্টোবর বিকেলে পার্কের দক্ষিণপূর্ব কোণে বিশাল ম্যাকটামের মেঝের পাশে একটা বেঞ্চে বসে কথা বলছিল সুমন আর মঞ্জুশ্রী। সুমনের গাড়ি পার্কের উত্তরে ওয়াটার পাম্পিং সেন্টারের পেছনে রাখা ছিল। পার্কটা লেকের দক্ষিণে। ওরা সেখানে বসে ছিল, সেখান থেকে বাঁদিকে একটা ন্যাড়া টিলা লেকের কিনারা থেকে উঠে গেছে। টিলাটার গায়ে বড় বড় পাথর। কথা বলতে বলতে মঞ্জুশ্রী হঠাৎ সেদিকে তাকাল। তারপর বলল, আরে! অনু ওখানে কী করছে?
সুমন ঘুরে দেখে বলল, বেড়াতে এসেছে কারুর সঙ্গে! ছেড়ে দাও।
না, না একা।
সুমন হাসল। একা নয়। বাজি রাখছি, ওর প্রেমিক আড়ালে বসে আছে।
অনু ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?
প্রেমিকের কাছে।
মঞ্জুশ্রী বলল, ভ্যাট! খালি প্রেমিক আর প্রেমিক!
তাছাড়া আর কে থাকবে মঞ্জু, এই সুন্দর দিন শেষে নিরিবিলি ফুলঝরিয়া লেকের ধারে- সুমন খুব আবেগে হবু স্ত্রীকে চুম খাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
মঞ্জুশ্রী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তুমি বড়বেশি সাহসী হয়ে উঠেছ অশকারা পেয়ে।
সুমন মুখ এগিয়ে দিয়ে বলল, প্লিজ মঞ্জু! ফুলঝরিয়া একটা চুমুর প্রত্যাশা করে! তার খাতিরে।
মঞ্জুশ্রী হেসে ফেলল তার কথাবলার ভঙ্গি দেখে। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে সুমন অথবা এই সুন্দর লেকের প্রত্যাশা পূর্ণ করতে গিয়ে হঠাৎ চমক খাওয়া গলায় সে বলল, এই, এই, অনু দৌড়ে যাচ্ছে কে-দেখ, দেখ!
আঃ! বলে সুমন ঘুরল ওদিকে। তারপর সেও অবাক হল।
অনুরাধাকে খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। টিলাটার ওপর শেষ বেলার রোদ ঝকমক করছে। সে টিলার ওদিকে নেমে গেল। মিনিট দুয়ের মধ্যে তার দৌড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে অস্বাভারিকতা ছিল।
সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু বসবে তুমি? আমি দেখে আসি কী ব্যাপার।
চলো আমিও যাই।
পারবে না। দেখছ না ভীষণ চড়াই, আর পাথরে ভর্তি?
শীগগির ফিরে আসবে কিন্তু। আমার একা থাকতে ভয় করবে।
তুমি বরং গাড়িতে গিয়ে বসো, এই নাও চাবি।
গাড়ির চাবি দিয়ে সুমন হন্তদন্ত এগিয়ে গেল। মঞ্জুশ্রী পার্কের গেটের দিকে হাঁটতে থাকল। পার্কে আজ তত লোক নেই তাদের মতো জোড়ায়-জোড়ায় কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা, প্রবীণ দম্পতি, আর কিছু নিঃসঙ্গ লোক চুপচাপ বসে আছে। ছড়িয়ে-ছাটিয়ে।
সুমন টিলার পাথর বেয়ে সোজা উঠে যাচ্ছিল। তার মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং নেওয়া আছে। আগের অক্টোবরে সে কামেট শৃঙ্গ অভিযানে গিয়েছিল। দুর্যোগের জন্য দলটাকে ফিরে আসতে হয়। এবার আবার গেছে। কিন্তু সুমনকে যেতে দেননি ওর মা। মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু প্রচুর পয়সা রেখে গেছেন ছেলের জন্য। গোটা তিনেক অভ্র খনির মালিক ছিলেন সুমনের বাবা। এখন খনিগুলো পরিত্যক্ত। তবে সুমন নিষ্কর্মা নয়। সে চাটার্ড অ্যাকাউন্টাষ্ট। বারাহিয়ার্স ইস্পাত কারখানার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের অ্যাকাউন্টস অফিসার।
সুমন অনুরাধাকে ডেকে সাড়া পাচ্ছিল না। টিলার দক্ষিণপূর্বে দিকে নেমে যেতে দেখেছে তাকে। নিচে ওদিকেও প্রকাণ্ড সব পাথর পড়ে রয়েছে। তার ফাঁকে ঝোপ ঝাড় সাজিয়েছে। একটা জলের ধারা মোটামুটি সমতল উপত্যকার মতো মাঠ ঘিরে ঝর্ণার আকারে লেকের পূর্ব দিকে মিশেছে। তার বুক জুড়ে পাথর। সড় সড় শব্দে জল ঝরে পড়ছে নিচের ডোবামতো একটা জায়গায় এবং ডোবাটা লেকেরই একটা অংশ হয়েছে।
একজন অচেনা লোক ডোবাটায় ছিপ ফেলে বসে আছে। মাথায় টুপি। পরনে। ধূসর জ্যাকেট, আর প্যান্ট। সুমন আবার অনুরাধা বলে ডাকতেই সে মুখ ফেরাল। মাথার টুপিটা পড়ে গিয়ে টাক চকচক করে উঠল। টুপিটা কুড়িয়ে নিল সে।
এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মুখে সাদা ঋষিসুলভ দাড়ি। টকটকে ফর্সা রঙ। যেন আশু সান্তাক্লজ। গলায় একটা বাইনোকুলার ঝুলছে। পাশে পাথরের ওপর পড়ে আছে। একটা ক্যামেরা কিটব্যাগ, আর ছড়ির মতো দেখতে একটা সবুজ রঙের মাথায় পরানো ছোট্ট জাল।
সুমন বলল, এদিকে একটা মেয়েকে আসতে দেখেছে।
শান্তা ক্লজ বললেন, কৈ, না তো!
সুমন এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনুরাধাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ গেল খানিকটা দূরে পাথরের আড়ালে কী একটা রঙীন জিনিস যেন। সে সেদিকে দৌড়ে গেল।
ঝর্ণার ডোবা থেকে আন্দাজ একশো মিটার দুরে কয়েকটা পাথর আর ঝোপের ভিত্র একটা বড় গর্ত। গর্তে জল জমে আছে। আগের রাতের বৃষ্টিটাই এই জল জমার কারণ। সুমন যে রঙিন জিনিসটা দেখতে পেয়েছিল, সেটা অনুরাধার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ। গর্তে জলের ভেতর মুখ গুঁজে পড়ে আছে অনুরাধা। তার পিঠের ডানদিকে চাপচাপ টাটকা রক্ত। রক্তে গর্তের জল লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
সুমন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বোধ বুদ্ধি ফিরে আসতে লাগল। তারপর সে পিছিয়ে এল কয়েক পা। তার শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল–সে আর ওদিকে তাকাতে পারছিল না।