ইন্দ্রনাথ কিন্তু বারবার ঘাট থেকে উঠে বাংলোর দিকটা দেখছিলেন। অর্থাৎ লক্ষ্য রেখেছিলেন। হঠাৎ তার চোখে পড়ে, শৰ্মা চলে যাচ্ছেন। যদি ইন্দ্রনাথ সৌম্যেন্দুর ঘাট হয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো পাশের ঝোপে লাশ পড়ত। কিন্তু সৌম্যেন্দুর চোখে পড়ার ভয়ে তিনি আরও ওপর দিয়ে শর্মাকে অনুসরণ করেন। উঁচু থেকে দেখতে পান, শর্মা কী একটা পাথরের তলায় পুঁতে রাখছেন। গতরাতে সেটা খুঁজতেই গিয়েছিলেন। পান নি।
আজ সকালে অবশ্য ফাইলটা কর্নেলরা উদ্ধার করেছেন। কিন্তু ম্যাপটা নেই। ওটা শর্মার পকেটস্থ হয়েছিল। কাজেই লেকের জলে ভিজে দুমড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। কালি ধেবড়ে গেছে। অতএব গুপ্তধন মানুষের চোখের আড়ালেই থেকে গেল।…..
জানালার নীচে একটা লোক
০১.
ধীরে বও, ধীরে
সুবচনী হে বাতাস, এ সন্ধ্যায় আজ
বিষাদের সুর বাজে, মৃত্যু অনুগামী।
উজ্জ্বলতাগুলি নিল কঠিন শামুক
গোরস্থানে সংহত কফিনে…
শ্রীদিগন্ত সেন থামল। এবং তখন সন্ধ্যা ও সবরকম শব্দ খুব বিষাদগ্রস্ত নরমতায় গলে পড়ছে, এমনকি আকাশে কিছু জলহাঁসকেও ‘আঁক আঁক’ ধ্বনিপুঞ্জ নখের আঁচড় দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে দেখছি আমরা–ঠিক ওইভাবেই গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে যায়, হয়তো চারজনের মধ্যে আমিই একা বুকে ও মস্তিষ্কে হিমবাহ চলনশীল টের পাচ্ছি, এ একটা অদ্ভুত সন্ধ্যা চিকনডিহির বাংলোয়।
শুধু শ্ৰীঅমর্ত্য (৩৪), আমাদের দ্বান্দ্বিক তত্ত্ববাদী বন্ধু এবং হার্বার্ট মারকুইসের ভক্ত অমর্ত্য রায় বলে উঠল, বড় সেকেলে–কিন্তু আমরা কেউ-ই বাক্যটা নিলুম না।
কবি দিগন্তের (৩৬) খুনীদের মতো চৌকো চোয়াল, একরাশ চুল পেঁয়াজের শেকড়ের মতো, তামাটে রঙ, ক্ষুদে কুতকুতে চোখে পুরু কাচের চশমা। টকটকে লাল শার্টের নিচে ডোরাকাটা ঢিলে পাতলুন, পায়ে বেঢপ পেতলের বকলেসলাগা চটি। সেই পেতলটা থেকে আলো, চিকনডিহির মাঠে বালির পাহাড়ের চূড়া থেকে যে আলো আসছিল, মুছে যেতে দেখলুম। এবং আমার মনে হল, সত্যি কি ও ত্রিশদশকী বিষাদবায়ুগ্রস্ত প্রেমিক? রাত্রি আমাদের হোস্টও মাননীয় বন্ধু জেলাশাসক শ্রীবিহ্বল মজুমদারের (৪২) বউ শ্ৰীমতী রাত্রি (২৬) দরজার ধারে দাঁড়িয়ে কী দেখতে দেখতে হঠাৎ ঘুম পাচ্ছে বলে চলে গেলেন পর্দার আড়ালে।
মনে হল, কারো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কিছুক্ষণ। এটা কি দিগুর ওই ত্রিশদশকী কবিতা আবৃত্তির দরুণ, নাকি নির্জন চিকনডিহির মাঠের এই প্রাকৃতিক ঘটনাবলী? ঠিক বোঝা গেল না।
এই সময় চাপা স্বরে অমু বলল বিহ্বলকে (ডি এমকে বিহুটিহু বলতে পারা যায় না), লুম্বিনীতে কিছু হল না তো এক কাজ করলে পারতেন–ডক্টর বাগচীর কাছে, মানে এস কে বাগচী, নার্ভ স্পেশালিস্ট যিনি… ।
বিহ্বল একটু হেসে বললেন, সেও হয়ে গেছে। ও কিছু হবার নয়।
আমরা ফের দুতিন মিনিট চুপ করে থাকলুম। হুঁ, কবিতায় কিংবা চিকনডিহির মাঠে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় কী ছিল বা কী থাকে, সব সুবচনীকে ধীরে বইতে হয়। আর কী হিম মস্তিষ্কে! কিছু ভাবতে ভালো লাগে না, কিছু ভালো লাগে না! ঘুলিয়ে যায় যুক্তি ও বিবেক, মরিয়া হতে ইচ্ছা করে অনিবার্যের বিরুদ্ধে। আমি হতভাগিনী রাত্রির কথা ভাবতে চেষ্টা করলুম। রাত্রি আমার নতুনতম আবিষ্কার–এখানে চিকনডিহির বাংলোয় জেলা শাসকের ঘরণী! মুখ তুলে ঘাড় উঁচু করে কষ্টে তাকাতে হচ্ছে তার দিকে। আর ওই রাত্রিকে একদা মাথা নিচু করলেই দেখতে পেতুম–এবং বুকের নিচে। হায়, সে এখন মাথার ওপর কতদূরে! চেনা যায় না, চেনা যায় না!
সেই রহস্যময় রুদ্ধবাক যেন জড়ভরত, ভারত বেয়ারা (আমার নাম-অ ভারত অ-অছি) দুটো সাদা জীনের বোতল রেখে গেল আর পাঁচটা গ্লাস। তিনজনে তাকাতাকি করলুম। রাত্রিও বসবে নাকি? কিন্তু লনে চেয়ার রয়েছে ছটা–একটায় রাত্রি এসে একবার বসেছিল তিন-চার মিনিট। তারপর জানালার ধারে যাই বাবা, এসব পোষায় না, বলে উঠে গিয়েছিল। ডি এম বেচারা সত্যি বড্ড বিব্রত বোধ করছেন স্ত্রীকে নিয়ে। পাগল হলে বেঁধে রাখা যায়, কিংবা রাঁচিটাচিতে রাত্রির অসুখ দুর্বোধ্য। কতকটা হ্যালুসিনেশান আর সিজোফ্রেনিয়ার মাঝামাঝি। তা এতক্ষণে আমাদের যেন চমক লাগল। চেয়ার ছ’টা কেন? গ্লাসই বা পাঁচটা কেন?
বিহ্বল মৃদু উচ্চারণ করলেন, ভারত, বরফ। ভারত-অ চলে গেল শূন্য ট্রে নিয়ে। তখন উনি ঘড়ি দেখলেন কবজির, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সম্ভবত চাঁদ উঠছে– কি না দেখলেন, তারপর রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ গাড়ির শব্দ পাচ্ছেন?
আমরা ব্যস্ত হয়ে কানগুলোতে মন রাখলুম এবং চোখগুলো দিলুম ঢালু হয়ে যাওয়া ধূসর রহস্যময় রাস্তায়। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। হরেক জাতের ক্যাকটাস আর কেয়াঝাড়। আর সরকারী প্রযত্নে খচিত ঝাউবন। বিশ সাল আগে দশ মাইল দূরের সমুদ্রে এসে এতখানি ভূগোল বদলে দিয়েছিল নাকি। সব মাটি ঢেকে বালিয়াড়ি আর টিলা গড়ে উঠেছিল। সরকারী যোজনা তাদের আরও শোভন করেছে। কখনও কখনোও রাষ্ট্রীয় এবং প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সৌন্দর্য প্রয়োজনকে খুন করে। কারণ আমরা তিনজন আসবার সময় পথের গ্রামে প্রচুর পাঁজরের হাড় গুণে এসেছি মানুষ ও জন্তুদের!
কিন্তু তেমন কোনও শব্দ কি শুনলুম? শুধু মৃদুগামী সান্ধ্য বাতাস, দূরের ঝাউবনে, অস্পষ্ট কী স্বর, উড়ন্ত জলহাঁস, ধূসরতা, বালিয়াড়ি জুড়ে বিষাদের নরম শিশির–সেই কবিতাটি ফিরে এল।