সর্বেশ্বরী। একশো বার দেব। সাধুবাবা স্বয়ং আমাকে বলে গেলেন। ফাইলটা তুমিই হাতিয়েছ।
ইন্দ্র। (বিকৃত হেসে) সাধুবাবা! আপনার ওসব গাঁজাখুরি ব্যাপারে আমার কোনওদিন বিশ্বাস ছিল না–এখনও নেই।
সর্বেশ্বরী। (ক্ষেপে গিয়ে) আমি এ ঘর থেকে তোমার পায়ের শব্দ পেয়েছিলুম কাল বিকেলে। উঠে এসে দেখি, তুমি ঝোপের মধ্যে চলে যাচ্ছ।
ইন্দ্র। আপনি পায়ের শব্দ বুঝতে পারেন?
সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় পারি!
ইন্দ্র। তাহলে শুনুন, যাকে দেখেছিলেন সে সৌম্য। আমি তাকে ফলো করে এসেছিলুম। ঝোপের আড়াল থেকে দেখলুম–সে এঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার হাতে কী একটা ছিল দূর থেকে বুঝতে পারলুম না।
সর্বেশ্বরী। আমি বিশ্বাস করি না।
ইন্দ্র। আপনার পা ছুঁয়ে বলব?
সর্বেশ্বরী। না–আমার পায়ে হাত দেবে না। নিজের ছোট ভাইকে খুন করেছে যে, তাকে ……. ।
ইন্দ্র। (আর্তস্বরে) কাকিমা! ওকে আমি খুন করিনি।
সর্বেশ্বরী। নিশ্চয় করেছ! যদি তোমার ওই কথাটা সত্যি হয় যে ফাইলটা সৌম্য নিয়ে যাচ্ছিল, তাহলে ওটা হাতাতে তুমিই খুন করেছ।
ইন্দ্র। (ভাঙা স্বরে) না না! ফাইলে কী ছিল আমি এখনও জানি না!
সর্বেশ্বরী। তুমি ন্যাকা!
এইসময় দূরে কোথাও গুলির শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠলাম। ফের। কয়েকবার শব্দ হতেই একটা হুলুস্থুল পড়ে গেল। সিপাইরা দৌড়ে ঘাটের দিকে গেল। ইন্দ্রনাথও বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই জিগ্যেস করলেন কী হলো জয়ন্তবাবু?
মাথা নেড়ে দৌড়ে গেলুম ঘাটের দিকে। গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলুম। লেকের জলে অনন্তরাম শর্মা গলাঅব্দি ডুবে রয়েছেন-দুহাত ওপরে তোলা। সবাই হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিঃ আচারিয়া চিৎকার করছেন–উঠে আসুন। বলছি। এক মিনিটের মধ্যে উঠে না এলে আবার গুলি ছুঁড়ব।
শর্মা আর্তনাদ করে বললেন–উঠছি। দোহাই! গুলি ছুড়বেন না। উনি এবার দুহাত তুলে ঘাটের দিকে আসতে থাকলেন। কর্নেল একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। কাছে গিয়ে বললুম–এই নাটকের অর্থ কী কর্নেল?
কর্নেল বললেন–তুমি এখনও নাবালক, জয়ন্ত! বুঝতে পারছ না কিছু?
কী সর্বনাশ! শৰ্মাই কি সৌম্যেন্দুকে খুন করেছেন?
–হ্যাঁ।
–সে কী! কেন?
–হিগিনসের একটা ফাইল হাতাতে। চলো, বাংলোয় গিয়ে সব বলছি।
তবে শেষপর্যন্ত লেকের জলে সত্যিই মাছ ধরা হলো। তাই না? বলে কর্নেল সহাস্যে সেই ছড়াটা আওড়ালেন; ‘খোকন গেছে মাছ ধরতে…..’
.
ফাইলটার কথা একটু আগে সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথের ঝগড়ার মধ্যে শুনেছি। বাংলোয় ফিরে বাকিটা শুনলুম বিশদ ব্যাখ্যা সহ। সর্বেশ্বরীও সব ফাঁস করে দিলেন।
হিগিনসই সর্বেশ্বরীর সাধুবাবা। কদিন আগে কলকাতা গিয়ে সর্বেশ্বরীকে একটা ছোট ফাইল দিয়ে আসেন। ইন্দ্রনাথ ব্যাপারটা টের পান। কিন্তু এর রহস্যটা কী জানতেন না। তাই কর্নেলের শরণাপন্ন হন। আশ্চর্য, কর্নেল আমাকেও কিছু খুলে বলেননি। যাই হোক, হিগিনস দেশে ফিরে গেছেন। গুপ্তধনের মায়া ত্যাগ করেই গেছেন। ওঁর ফাইলে উপত্যকার একটা ম্যাপ ছিল–১৯৪৩ সালের ম্যাপ। ম্যাপে গুপ্তধনের অবস্থান চিহ্নিত ছিল। কিন্তু ১৯৪৬-এর ভূমিকম্পে সব ওলটপালট হয়ে যায়। তাই হিগিনস বছরের পর বছরখোঁজাখুঁজি করেও পাত্তা পাননি। তাছাড়া বোঝাই যায়, ওঁর ক্রমশ মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল। তা না হলে হয়তো বের করা। অসম্ভবও হত না। জগদীপ তখন ফাইলটা পেলে নিশ্চয় হদিশ করতে পারতেন। এখন সর্বেশ্বরীর ভুল হলো–ফাইলের কথাটা শর্মাকে জানানো। শর্মা তক্কেতক্কে ছিলেন। সর্বেশ্বরী এখানে আসার পর ফাইলটা সতর্কতা হিসাবে সৌম্যেন্দুর বিছানার তলায় রেখে দেন। কারণ, শর্মার মতিগতির ওপর ক্রমশ তার সন্দেহ জাগছিল।
কর্নেল ও শর্মা চলে যাবার পর সর্বেশ্বরী রঘুবীরকে দিয়ে সৌম্যেন্দুকে ডাকতে পাঠান। সৌম্যেন্দু আসতে দেরি করে। সম্ভবত মাছে টোপ খাচ্ছিল তখন। সে একটু পরে এলে সর্বেশ্বরী তাকে বলেন, বিছানার তলায় যেটা আছে–সেটা সে যেন সাবধানে লুকিয়ে রাখে। কারণ, ওটা একটা দামী দলিল।
সৌম্যেন্দু দলিলের ফাইলটা নিয়ে চলে যায়, সে ঘাটে বসে পড়ে দেখার কথা ভেবেছিল। ওদিকে কর্নেল ও শর্মা গর্তগুলোর অন্যমুখ খুঁজছেন। ওই সময় এক ফকে কর্নেলের অজানতে শর্মা ফাইল চুরি করতে চলে আসেন। অভাবিত সুযোগ। সর্বেশ্বরী তখন একা আছেন। দরকার হলে তাকেও খুন করে ওটা হাতাবে। কিন্তু সৌম্যেন্দুর দুর্ভাগ্য, ঘাটে তখন ফাইলটা পড়ছে। শর্মা আগেই কিচেনের ছুরিটা হাতিয়েছিলেন। তাই দিয়ে সৌম্যেন্দুকে খুন করেন। ফাইলটা কেড়ে নেন। জঙ্গলে পাথর চাপা দিয়ে রেখে ভালমানুষের মতো কর্নেলের সামনে আবির্ভূত হন।
ইন্দ্রনাথ তার একটু আগে সৌম্যেন্দুকে বাংলোয় যেতে দেখে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ফাইলটা যে সৌম্যেন্দু নিয়ে আসছে, বুঝতে পারেননি। নিজের ঘরে ঢুকে দেখে আসেন সৌম্যেন্দু বরাবরকার মতো তার জিনিসপত্র হাতড়াচ্ছে কি না। তার শ্যাওলাভরা জুতোর দাগ আমরা ঘরের মেঝেয় দেখেছি। কালো দাগগুলো শর্মার। শৰ্মা সৌম্যেন্দুকে খুন করার পর ওঘরে একবার ঢোকেন। কারণ, সর্বেশ্বরীর মোড়ক বদলানোটা তারই পরামর্শে। ইন্দ্রনাথের রি-অ্যাকশন জানা। যখন দেখলেন, ইন্দ্রনাথের নজরে মোড়কটা এসেছে এবং সযত্নে রাখা আছে উনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ওটা দলা পাকিয়ে ফেলে দেন। তখন খুন করার পর ওঁর বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ফাইলটাও লুকোতে হবে। কিন্তু নিজের ঘরে গেলে সর্বেশ্বরীর চোখে পড়বে। তাই তক্ষুনি বেরিয়ে উপত্যকার দিকে চলে যান। ওদিকে কর্নেলও তার দেরিতে সন্দিগ্ধ হতে পারেন।