গুপ্তধনের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড নেশাধরানো লোভ আছে। জগদীপ সেই লোভে পড়ে গেলেন এবং গোপনে একা তল্লাস শুরু করলেন। কিন্তু বারবার ওখানে শিকার কিংবা ছিপে মাছধরার অজুহাত কাঁহাতক দেখানো যায়। বিশেষ করে ক্রমাগত সপ্তাহ কিংবা মাসও লেগে যেতে পারে। অতএব উনি ফন্দি আঁটলেন। অনন্তরাম শর্মা ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খনি ইঞ্জিনিয়ার। ওই উপত্যকায় কোনও খনিজ সম্পদ থাকা সম্ভব বলে মনে হয়েছিল জগদীপের। ওঁর ভাগ্য ভাল শর্মা মাটি পরীক্ষা করে জানালেন, তলায় সীসের খনি আছে। জগদীপ ভূপালের নবাবের কাছে বন্দোবস্ত নিলেন জায়গাটার। খনির কাজ শুরু হলো। কিন্তু সেই গুপ্তধনের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।…….
এরপর জগদীপের নিজের ভাষায় ডায়রির শেষাংশ তুলে দিচ্ছি। তারিখ ১৬ আগস্ট। অর্থাৎ ওঁর মৃত্যুর আগের দিন।
..আজ আমি জীবনের এক ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলুম। শেষ তিনটি পিট সাবধানতার জন্য বুজিয়ে দেওয়া দরকার। তাই শর্মাকে নিয়ে বেরিয়েছিলুম। শর্মা কিছুক্ষণ পরীক্ষার পর মাছ ধরতে গেল লেকে। আমি বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এতগুলো বছর আমার বৃথা চলে গেল। এবার ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে এই উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
….আনমনে বড় সুড়ঙ্গের কাছে যেই গেছি, হঠাৎ দেখি এক আজব মূর্তি। প্রথমে চিনতে পারিনি–পরক্ষণে চিনলুম। হিগিনস! কিন্তু এ কী মূর্তি তার! মাথায় একরাশ চুল, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, পরনে মাত্র একটা ঘেঁড়া হাফপ্যান্ট হাতে বড়বড় নখ, সারা গা নোংরা–খালি পা–সে আমাকে দেখামাত্র অমানুষিকভাবে হেসে উঠল। ও নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে! শিউরে উঠলুম ওর পরিণতি দেখে। তাহলে কি একদিন আমারও ওই পরিণতি ঘটবে?
….হঠাৎ হিগিনস জন্তুর মতো গর্জন করে আমাকে তেড়ে এল। পকেট থেকে। পিস্তল বের করে ছুঁড়লুম। গুলি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো। হিগিনস অমনি ঘুরে সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকল। আমার মধ্যে তখন খুনের নেশা জেগেছে। সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লুম। আন্দাজে গুলি ছুঁড়লুম পাগলের মতো। মনে হলো হিগিনস হাসছে কোথায়। কানের ভুল হতেও পারে।…
….ঠিক করেছি, হিগিনসকে শেষ করতেই হবে। আগামীকাল টর্চ নিয়ে ওই সুড়ঙ্গে ঢুকব। ওকে খুঁজে বের করে হত্যা করব। ও আমার লোভের জন্য দায়ী। ও আমার জীবনের সুখশান্তি নষ্ট করার মূলে। আজ আমার চোখে শুধু হীরেপান্না জহরতের ঝলমলানি। এ কী অদ্ভুত অভিশাপ! খেতে ঘুমোতে সবসময় ওই গুপ্তধন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঘুমোতে পারিনে–খাওয়া ফেলে উঠে পড়ি। আমার জীবনীশক্তি দিনে দিনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শয়তান হিগিনসই এর জন্যে দায়ী….
বেশ বোঝা যায়, ১৭ আগস্ট হিগনসকে হত্যার উদ্দেশ্যে জগদীপ সুড়ঙ্গে ঢোকেন এবং সম্ভবত হার্টফেল করে মারা পড়েন। ওই মানসিক অবস্থায় এটা স্বাভাবিক ছিল।
সেই সঙ্গে বোঝা গেল সর্বেশ্বরী যে সাধুর কথা বলেন, সে কে। কিন্তু হিগিনস কি এখনও বেঁচে আছেন এবং সুড়ঙ্গে থেকে অভিশপ্ত গুপ্তধন খুঁজে বেড়াচ্ছেন?
আর C2 কথার অর্থ কি, কর্নেল আমাকে জানিয়েছে। ওটা দুর্বোধ্য কিছু নয়। ক্যাবিনেট নম্বর টু। ডাইনিংয়ের দেয়াল আলমারির দুনম্বর খোপ। কর্নেল নিছক অনুমানের ভিত্তিতে কাজে নেমেছিলেন এবং অনুমানটা মিথ্যে হয়নি।
আচারিয়া কর্নেলের দুর্দশার কথা শুনে হেসে খুন। ততক্ষণে মিঃ লাল পুরোপুরি বদলে গেছে এবং কর্নেলের উদ্দেশ্যে বারবার বলছেন–খুব দুঃখিত। কিন্তু স্যার, আমার কর্তব্যজ্ঞানই এ জন্যে দায়ী। কর্নেল মিঃ লালের একটা হাত সস্নেহে টেনে নিয়ে তার উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস এবং দক্ষতার প্রশংসা করার পর দেখা গেল, দুজনে পাশাপাশি হাঁটছেন, বসছেন। কর্নেলের এ সব ব্যাপারে জুড়ি নেই। সব অপ্রীতিকর স্মৃতি ঘুচিয়ে দিতে তিনি পটু। অতএব, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছি।
কর্নেল এবং পুলিশ অফিসাররা সবাই ঘাট ঘুরে খনি উপত্যকায় চলে গেলেন। রাতে ভাল ঘুম হয়নি–তাই আমার ক্লান্তি লাগছিল। ভাবলুম ওঁরা তদন্ত করুন– আমি একটু গড়িয়ে নিই।
গড়াচ্ছি, হঠাৎ কানে এল সর্বেশ্বরী ও ইন্দ্রনাথ পাশের ডাইনিংয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন। উঠে বারান্দায় গেলুম। তখন অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। একটু পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। সেপাইরা এবং অ্যাম্বুলেন্সকর্মীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিঃ শর্মাকে দেখতে পেলুম না কোথাও। অথচ উনি কর্নেলদের সঙ্গেও যাননি। শরীর খারাপ বলে নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন। সেই ঘরের দরজা খোলা এবং বিছানা শূন্য দেখা যাচ্ছে। বারান্দা থেকে ডাইনিংয়ের দরজা দিয়ে সেটা আমার চোখে পড়ছিল।
সর্বেশ্বরী তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্দ্রনাথ একটু তফাতে। আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকলুম।
সর্বেশ্বরী। তুমি দেব-দেবতা ভগবান–যার নামই নাও, আমি ও কথা বিশ্বাস করি না।
ইন্দ্রনাথ। আপনার বিশ্বাস করা না করায় আমার কিছু যায় আসে না।
সর্বেশ্বরী। হ্যাঁ, তা তো বটেই। এখন ওকথা বলবে বইকি! মানুষ হয়ে গেছ এখন তো আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু জেনে রেখো, আমার একটি পয়সাও তুমি আশা কোরো না।
ইন্দ্র। নিশ্চয় করি না। আপনার সম্পত্তি যা খুশি করুন, আমি কিছু বলতে চাইনে। কিন্তু দোহাই আপনার, ওই মিথ্যে বদনাম দেবেন না।