পড়া শেষ হলে সর্বেশ্বরী কর্নেলের দিকে ঘুরে বললেন-কর্নেল সরকার! আপনি কীভাবে এটার খোঁজ পেলেন বলবেন কি?
কর্নেল বললেন-বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। এই সংকেতটি কি আপনার পরিচিত?
সর্বেশ্বরী ভুরু কুঁচকে বললেন—হ্যাঁ। কেন?
–এর অর্থ কি আপনি জানতেন?
না। কারণ, আমার স্বামী এর অর্থ আমাকে জানাননি। তিনি বেশ কয়েকদিন আমাকে বলেছিলেন–যদি আমি হঠাৎ মারা পড়ি, তুমি C? এই কথাটা মনে রাখবে এবং সৌম্যেন্দুকে জানাবে। ওর সব কথাই ওই রকম হেঁয়ালিতে ভরা থাকত। ভাবতুম ড্রিঙ্কস-এর ঘোরে আবোল তাবোল বকছেন।
–সৌম্যেন্দুকে আপনি জানিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ। ওর মৃত্যুর পর জানিয়েছিলুম। সৌম্যেন্দু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল-কাকামশাইয়ের পাগলামি!
কর্নেল ইন্দ্রনাথকে জিগ্যেস করলেন–আপনি এর আগে C? কথাটা শুনেছিলেন?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীরমুখে বললেন না। এখানে আসার পর বঁড়শির মোড়কে লেখা দেখেছিলুম।
কর্নেল সর্বেশ্বরীকে বললেন–মিসেস রায়, লুকোবার কারণ নেই। এবার বলুন তো, আপনিই ইন্দ্রনাথ বাবুর বড়শির মোড়ক বদলে C? লেখা ডায়রির একটা পাতা ও ঘরে রেখেছিলেন কি না?
সর্বেশ্বরী মুখ নামিয়ে জবাব দিলেন–হ্যাঁ। আমার স্বামী যেদিন মারা যান, সেদিনই আনমনে কথাটা অন্য একটা ডায়রির পাতায় আমি লিখেছিলুম। ইন্দ্রনাথ এবার এখানে আসার পর আমার সন্দেহ হলো যে নিশ্চয় একটা কিছু ঘটতে চলেছে–যার কোনও কিছু আমি জানি না। তাই ওই পাতাটা ওর নজরে এনে দেখতে চেয়েছিলুম, ও কী করে।
ইন্দ্ৰনাথ শুকনো হেসে বললেন–অবাক হয়েছিলুম তারিখটা দেখে। কিন্তু ওই কথাটার মানে কী, আমি তো জানতুম না। এখনও জানি না।
কর্নেল মিঃ শর্মার দিকে ঘুরে বললেন–আপনি কিছু জানতেন?
শর্মা অন্যমনস্ক ছিলেন যেন। চমকে উঠে মাথা দোলালেন। ওদিকে মিঃ লাল এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। এবার হাত নেড়ে বললেন–খুব হয়েছে। এটা আদালত নয় এবং ওই লোকটা সরকারী কৌসুলী নয়। সে অধিকার আমি ওকে দিইনি।
সেই সময় বাইরে জিপের গর্জন শোনা গেল। তখন সূর্যের হাল্কা আলো এসে লন পেরিয়ে বারান্দা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকছে। দুটো জিপ দেখা গেল লনে। তারপর ক’জন পুলিশ অফিসার এবং দুজন সিভিলিয়ানের পোশাক পরা ভদ্রলোক জিপ থেকে নেমে বারান্দায় উঠলেন। একজন ঢুকতে ঢুকতে বললেন কই? কোথায় আমাদের মাননীয় কর্নেল সাহেব?…ও হ্যাল্লো! হ্যাল্লো! হ্যাল্লো!
আমি অবাক হলুম না। মিঃ লাল ভীষণ অবাক হলেন নিশ্চয়। কর্নেলের হাত ধরে সেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন–একি কর্নেল সরকার! আপনার এ অবস্থা কেন?
কর্নেল স্মিত হেসে বললেন–ও কিছু না মিঃ আচারিয়া! ও কিছু না! আপনি কেমন আছেন? ইস! দীর্ঘ ছ-সাত মাস পরে দেখা। তাই না?
মিঃ আচারিয়া তখনও অবাক। আমি এবার মিঃ লালের কীর্তি ফাঁস করতে যাচ্ছি, টের পেয়েই কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–মিঃ আচারিয়া, আগে আলাপ করিয়ে দিই আমার এই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে। জয়ন্ত চৌধুরী কলকাতার প্রখ্যাত সংবাদপত্র দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার। জয়ন্ত, ইনি আমার এক বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ চন্দ্রমোহন আচারিয়া।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মিঃ লাল ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছেন এবং সূর্যোদয়ই দেখছেন হয়তো।
হঠাৎ সর্বেশ্বরী বলে উঠলেন–আপনারা বসুন, প্লীজ। আমি আপনাদের কফির ব্যবস্থা করি। কেউ কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা কিচেনের দিকে চলে গেলেন।…
.
ডায়রিতে কী লেখা ছিল, পরে জেনেছিলুম। কিন্তু ঘটনা আগাগোড়া সাজানোর খাতিরে সেটা এখানেই দেওয়া হলো। সংক্ষিপ্তভাবেই বলছি :
জগদীপ রায় একবার বোম্বাইয়ের এক পানশালায় হিগিনস নামে একজন প্রাক্তন ব্রিটিশ যোদ্ধার সঙ্গে পরিচিত হন। হিগিনস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেফটন্যান্ট মেজর ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার পরও তিনি এদেশে থেকে যান। এবং অবসর নেন। হিগিনস বেজায় মদ খেতেন। সেই পানশালায় জগদীপের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় তখন ওঁর প্রচণ্ড মাতাল অবস্থা। তখন জগদীপ ওঁকে ওঁর বাসায় পৌঁছে দিতে যান। হিগিনস ব্যাচেলার ছিলেন। যাইহোক, গাড়িতে নিয়ে যাবার সময় এবং বাসায় গিয়ে নেশার ঘোরে এমন কিছু কথা বলেন, জগদীপের তাক লেগে যায়।
হিগিনস যুদ্ধের সময় মধ্যপ্রদেশের এই এলাকার এক রাজপ্রাসাদে ছিলেন। বলাবাহুল্য বাড়িটি এক দেশীয় রাজার এবং তা ব্রিটিশ সরকার সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দখল করে নেন। সেই বাড়িতে যেভাবেই হোক, হিগিনস এবং তিনজন সহযোদ্ধা মিলে একটি বাক্স পেয়ে যান। বাক্সে সোনাদানা হীরে জহরত ছিল বোঝাই হয়ে। এই গুপ্তধন পাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। সবার চোখ এড়িয়ে এগুলো ভাগাভাগি করা কঠিন। কারণ সেনানিবাসে সব সময় ভিড়। তাছাড়া কাকে কোন মুহূর্তে কোথায় পাঠানো হবে, ঠিক নেই। ধনসম্পদের ভাগ নিয়ে রাখবেন কোথায়? চার বন্ধু মিলে এই চিরিমিরি জঙ্গলে এসে লেকের পশ্চিম উপত্যকায়–যেখানে পরে সীসের খনি খোঁড়া হয়, সেখানে। পুঁতে রাখেন। কথা রইল–যুদ্ধ শেষ হলে ওটা ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে। ঘটনাচক্রে বর্মা ফ্রন্টে হিগিনস বাদে সবাই মারা পড়েন। হিগিনস ফিরে এসে গুপ্তধনের খোঁজ করেন। কিন্তু তিনবছরের মধ্যে এক ভূমিকম্পে উপত্যকার মাটি ওলটপালট হয়ে গেছে। ফলে হিগিনস খুঁজে বাক্সটা বের করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসকরা চলে গেলেন। কিন্তু বাধ্য হয়ে হিগিনসকে থাকতে হলো। এখন তাঁর একমাত্র কাজ, বারবার চিরিমিরি উপত্যকায় যাওয়া এবং অনুসন্ধান।