কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–আপনি ভুল করছেন মিঃ লাল। আমি আপনাকে ফেলে দিইনি। বরং আপনিই আমাকে….
শাট আপ! গর্জালেন মিঃ লাল।
সর্বেশ্বরীকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখলুম। মিঃ শর্মা এগিয়ে এসে বললেন–ড্রয়ার থেকে উনি কী বের করেছেন, সেটা এবার সার্চ করা উচিত মিঃ লাল। জয়দীপ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তার ড্রয়ারে উনি কেন রাতদুপুরে হাত ভরতে গেলেন জানা দরকার।
মিঃ লাল এগিয়ে কর্নেলের রাতের পাজামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো বাঁধানো নোটবই কিংবা ডায়রি বের করে নিলেন। মিঃ শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ দুজনে একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললেন–দেখি, দেখি ওটা কী?
মিঃ লাল হয়তো ওঁদের একজনের হাতে দিয়েই ফেলতেন বইটা। কিন্তু : কর্নেল এক লাফে সরে এসে বাধা দিলেন।খবরদার মিঃ লাল! এই ডায়রি ওঁদের হাতে দেবেন না। এটা একটা ভেরি ইমপরট্যান্ট ডকুমেন্ট!
মিঃ লাল রিভলভার তুলে বললেন হ্যাঁণ্ডস্ আপ। নয়তো গুলি ছুঁড়ব!
অমনি কর্নেল দুহাত তুলে দাঁড়ালেন। আমি হাসব না কাদব ভেবে পেলুম না। ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কর্নেল ফের বললেন–মিঃ লাল, প্লীজ! ওই ডায়রি সরকারের সম্পত্তি। কারো হাতে দিলে আপনিই বিপদে পড়বেন। আর দু-এক ঘণ্টার মধ্যে ডিটেকটিভ ডিপার্টের অফিসাররা এসে পড়বেন জব্বলপুর থেকে। ততক্ষণ আপনার অপেক্ষা করা কর্তব্য।
মিঃ লাল অমনি ভড়কে গিয়ে বললেন–ডিটেকটিভ ডিপার্টের লোক আসবে? তার মানে?
ইন্দ্রনাথ বললেন–হ্যাঁ। আমি টেলিফোন করে এসেছি কর্নেলের কথায়।
মুখ বিকৃত করে মিঃ লাল বললেন–ভাল করেছেন! এবার দেখুন মশা মারতে কামান দেগে কী অবস্থা হয়। সব জড়িয়ে পড়বেন মাইণ্ড দ্যাট! একজন জোচ্চোরের কথায় আপনি……
বাধা দিয়ে বললুম–মিঃ লাল, আবার আপনি অন্যায় করছেন। ওঁকে এসব কদর্য কথা বলার জন্যে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।
এবার মিঃ লাল আর গর্জালেন না। গম্ভীর মুখে বললেন–আপনিও ভাববেন যে জার্নালিস্ট বলে আপনি বেঁচে যাবেন। ইয়েস–লেট দেম কাম। কিন্তু ততক্ষণ এই লোকটা আর আপনি দুজনেই এই ঘরে বসে থাকুন। ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।
কর্নেল আমাকে চোখ টিপলেন। হাসি টিপে বললুম–বেশ। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, উনি বুড়োমানুষ ওভাবে হাত তুলে কতক্ষণ থাকবেন?
মিঃ লাল ধমক দিয়ে বললেন–হ্যাণ্ডস ডাউন।
ঘরের ভেতর বসে নিঃশব্দে আমরা ভোরের প্রতীক্ষা করতে থাকলুম। তখন রাত চারটে বেয়াল্লিশ। বৃষ্টি সমানে পড়ছে।……
.
ভোরেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। মিঃ লাল টেবিলের বাতির সামনে সেই কালো নোটবই পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে আমাদের দিকে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন। দুজন সেপাই দরজায় বন্দুক বাগিয়ে পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু অবাক লাগল, শর্মা এবং ইন্দ্রনাথ ও ঘর ছেড়ে শুতে যাননি। দুটি লুব্ধ জন্তুর মতো মিঃ লালের নোটবইটার দিকে তাকিয়ে ঠায় বসে থাকলেন। আমরা দুজন তো মিঃ লালের বন্দী, তাই ঘর ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। বেচারা কর্নেলের জন্য দুঃখ হচ্ছিল। ওঁর হাতির বরাত, এমন মশা বনে যেতে কখনও দেখিনি! চালে ভুল করেই এই দুর্দশায় পড়েছেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ মিঃ লালের খপ্পরে এভাবে পড়ে যাবেন, ভাবেননি। ভাবছিলুম, কর্নেলকে যথেষ্ট বকে দেব। নির্ঘাৎ এবার ওঁকে বাহাওরে ভীমরতি ধরেছে! এভাবে সেখানে যা খুশি করে ফেলে নিজেও বিপদে পড়বেন– আমাকেও ফেলবেন। কোনও মানে হয় না!
কিন্তু ওঁর মুখটা নির্বিকার। মিটিমিটি হাসছেন আর হাসছেন। কী লোক রে বাবা!
সবে পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, মিঃ লালের পড়া শেষ হলো। নোট বইটা বুজিয়ে কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। বললেন, বোঝা গেল শ্রীমান চারশো বিশের আগমনের উদ্দেশ্য। ইন্দ্রনাথবাবু, মিঃ শর্মা! আপনাদের সাক্ষ্যের ওপর সব নির্ভর করছে–মাইণ্ড দ্যাট।
ইন্দ্রনাথ বললেন–মিঃ লাল, কী লেখা আছে ওতে বলবেন কি?
মিঃ লাল কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল বাধা দিলেন। মিঃ লাল, আবার। আপনাকে, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি। ওই ডায়রি বইটা সৌম্যেন্দুর হত্যকাণ্ডের ব্যাপারে একটা মূল্যবান দলিল।
মিঃ লালের ঠোঁট ফাঁক হলো, কিন্তু কথা বেরুবার আগেই দরজা খুলে ফের সর্বেশ্বরী বেরুলেন। মনে হলো, বৃদ্ধা এতক্ষণ ঘুমোননি। জেগেই ছিলেন। বললেন– মিঃ লাল, ওই ডায়রিটার কথা আমি জানতুম। ওটা আমার স্বামীর ডায়রি। ওতে কী আছে, তা আমার স্বামী অবশ্য কখনও জানাননি–জানতেও চাইনি। এখন মনে হচ্ছে, ওর মধ্যে এমন কিছু আছে–যার জন্য সৌম্যেন্দুর প্রাণ দিতে হলো। ওটা কি আমাকে একবার দেখতে দেবেন?
মিঃ লাল কর্নেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধাজড়িত স্বরে বললেন কিন্তু এটা এখন আদালতের একজিবিট হবার যোগ্য। তাই আপনাকে দেখানো যাবে কি?
কর্নেল বললেন–ওঁকে একবার পড়তে দিতে আমার আপত্তি নেই। কারণ উনিই এই হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রধান সাক্ষী হবেন।
–আপনি থামুন! বলে মিঃ লাল সর্বেশ্বরীর দিকে ঘুরলেন। মিসেস রায়, এটা আমার হাতেই থাকবে। আপনি এখানে এসে পড়ে দেখুন।
সর্বেশ্বরী এগিয়ে গিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। মিঃ লাল ডায়রিটা খুলে ধরলেন। কয়েক পাতা পড়ার পর সর্বেশ্বরীর মুখে অদ্ভুত ভাবান্তর লক্ষ্য করলুম। মনে হলো, উনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। আমরা সবাই চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছি।