কর্নেলের এই কথায় রহস্যের জট আরও পাকিয়ে গেল। আমি গুম হয়ে রইলুম। এমন অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের পাল্লায় কখনও পড়িনি।..
.
ডিনার খাওয়া হবে না জানতুন। বিস্কুট আপেল আর কফি খেয়ে শুয়ে পরলুম। আমরা। মিঃ লালের সবুর সইছিল না। আসামী দুজনকে নিজের জীপে তিনজন কনস্টেবলের সঙ্গে চালান দিলেন সেই রাত্রেই। দুজন কনস্টেবল লাশের কাছে। পাহারায় রাখলেন এবং ডাইনিং টেবিলে বিছানা করে আরামে নাক ডাকাতে থাকলেন। ডাইনিংয়ের ওপাশে দুটো রুমের একটায় সর্বেশ্বরী, অন্যটায় শর্মা শুতে গেলেন। এ পাশের রুমে আমি, কর্নেল ও ইন্দ্ৰনাথ শুয়ে পড়লুম। বারান্দায় সেই ল্যাম্পটা জ্বলতে থাকল। বেচারা কনস্টেবল দুজনের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু মিঃ লালের কাছে ডিউটি ইজ ডিউটি।
শুয়ে জঙ্গলে রাতচরা জানোয়ারের ডাক শুনতে পাচ্ছিলুম মাঝে মাঝে। ঘুম আসছিল না। পাশে কর্নেলের কিন্তু দিব্যি নাক ডাকছে। জানালার পর্দার ফাঁকে তারা দেখা যাচ্ছে। তারপর একসময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে গেছি, কে জানে!
হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। জেগে ওঠার পর টের পেলুম বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু গাছপালা থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আমার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে। সিগারেট ধরিয়ে দেশলাইয়ের আলোয় কোণার দিকে ইন্দ্রনাথকে দেখার চেষ্টা করলুম। দেখতে পেলুম না। ওঁর বিছানা খালি। তখন মাথার কাছ থেকে টর্চটা নিয়ে সাবধানে জ্বাললুম। ইন্দ্রনাথ নেই। বাথরুমে ঢুকেছে কি? কিন্তু বাথরুমের দরজা বাইরে থেকেই বন্ধ। তখন ঘরের দরজায় আলো ফেললুম। দরজার ছিটকিনি খোলা কপাট দুটো ঠেস দেওয়া রয়েছে। তার মানে ইন্দ্রনাথ বেরিয়েছেন।
আলো নিভিয়ে কর্নেলের গায়ে হাত রাখলুম। অমনি আমার হাতটা চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন–চুপচাপ শুয়ে থাকো।
তাহলে কর্নেল জেগে আছেন! নিশ্চয় সব লক্ষ্য করছেন কখন থেকে। উত্তেজনায় অধীর হয়ে শুয়ে রইলুম।
প্রায় দুঘণ্টা কেটে গেল। সময় যে আসলে এত দীর্ঘ, তা এই প্রথম জানলুম। তারপর দরজাটা নিঃশব্দে ফাঁক হলো, বাইরের আলো এল একটুখানি। দেখলুম ইন্দ্রনাথ ঢুকছে। খালি গা, পরনে শুধু আণ্ডারওয়্যার, পায়ে কেডস। ওঁর হাতে যা দেখলুম, তাতে গা শিউরে উঠল। একটা রিভলভার।
ইন্দ্রনাথ নিঃশব্দে দরজাটা এঁটে দিলেন। তারপর অন্ধকারে কীভাবে জুতো খুলে শুলেন, টের পেলুম না। একটু পরেই শুনি ওঁর নাক ডাকছে। তখন খুব হাসি পেল। কর্নেলকে খুঁচিয়ে দিলুম। কর্নেলও শুনি এবার নাক ডাকাচ্ছেন। অদ্ভুত লোক তো!
এইসময় আবার বৃষ্টি এল। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে আমার ঘুমের সম্পর্ক নিশ্চয় নিবিড়। ফলে আবার চোখের পাতা খুঁজে এল।
কী একটা স্বপ্ন দেখছিলুম, হঠাৎ স্বপ্নটা ছিঁড়ে এবং ঘুমটাকে বরবাদ করে কোথাও কোনও জন্তু গর্জে উঠল যেন। জাগার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলুম ইন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং আলো জ্বেলেছেন। আমাকে জাগতে দেখে বললেন–আসুন তো জয়ন্তবাবু, পাশের ঘরে কী গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হলো।
কিছু একটা হচ্ছে তা ঠিকই। ধস্তাধস্তির এবং চাপা গর্জনের আওয়াজ। ঘুরে দেখি কর্নেল নেই বিছানায়। বেরিয়ে গেছেন। আমিও বেরোলুম। বারান্দায় যেতেই ডাইনিং থেকে মিঃ লালের চিৎকার শুনলুম–হ্যাণ্ডস আপ!
বারান্দায় যে সেপাই লাশের পাশে ঘাড় গুঁজে একটা কম্বলে পড়ে ছিল, তারা আচমকা জেগে রাইফেল বাগিয়ে ধরল। মিঃ লাল ফের চেঁচালেন বুধন সিং! সূরযলাল! মেরা টারচ খো গ্যয়া। জলদি বাত্তি লে আও!
কয়েক সেকেণ্ডে এসব ঘটে গেল। বারান্দা থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে সেপাইরা ডাইনিংয়ে ঢুকল। আমরাও ঢুকলুম। ঢুকে হাঁ করে তাকালুম। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য।
কর্নেল দেয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন–দুহাত মাথার ওপরে তোলা। রাতের জামা ছিঁড়ে ফর্দাফাই। ঝুলছে কোমরের নিচে অব্দি। মুখে অপ্রস্তুত হাসি।
তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে মিঃ লাল রিভলভার তুলে শাসাচ্ছেন। আর কোনও কথা শুনব না। দেখেই আঁচ করেছিলুম, এ ব্যাটা নিশ্চয় একজন এক নম্বর চারশো বিশ। আমার চোখ এড়িয়ে যাবে? কত খুনী জোচ্চোর দেখলুম অ্যাদ্দিন!
খুব রাগ হলো আমার। বললুম–দেখুন মিঃ লাল, আপনি ভুল করছেন। উনি বিখ্যাত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ওঁর পরিচয়পত্র আপনি দেখেছেন। ওঁকে এভাবে অপমান করাটা আপনার মোটেও উচিত হচ্ছে না। এর জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে কিন্তু!
মিঃ লাল তুমুল গর্জন করে বললেন–ইউ শাট আপ! আপনাকেও আমি ও ব্যাটার সহযোগী বলে গ্রেপ্তার করব।
ইতিমধ্যে দুপাশের দুটো দরজা খুলে সর্বেশ্বরী এবং মিঃ শর্মা বেরিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাচ্ছেন। ইন্দ্রনাথ বললেন মিঃ লাল, ব্যাপারটা কী হয়েছে বলুন তো?
মিঃ লাল হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন–মশাই, আমার এক চোখ ঘুমোয়, অন্য চোখ জাগে। কপাট ফাঁক করে ও ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়েছি কী মাল! : ভাবলুম কী করে দেখা যাক। ও করল কী, একটা ক্ষুদে টর্চের সাহায্যে দেয়াল হাতড়ানো শুরু করল। তারপর দেখি, ওই দেয়াল আলমারিটার একটা ড্রয়ার টানাটানি করছে। তারপর ড্রয়ার খুলে ফেলল দেখলুম। কী একটা বের করল। তখন আমি নেমে পা টিপে টিপে টেবিলের পিছনে গেলুম। যেই বাছাধন আসা, অমনি জাপটে ধরলুম। ভুল করে টর্চটা হাতে নিইনি। যাই হোক, ব্যাটার গায়ে অসুরের বল। জুডোর প্যাঁচে আমাকে ছিটকে ফেলে দিলে। আমি ওর জামা খামচে ধরেছিলুম। ওই দেখুন না। তারপর উঠে এক লাফে বিছানায় গিয়ে রিভলভার হাতে নিলুম।….