সুড়ঙ্গে ঢোকা যায় না?
–যায়। কিন্তু তখন যথেষ্ট আলো নেই। তাছাড়া ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস থাকতে পারে। না পরীক্ষা করে ঢোকা যায় না। অবশ্য, আমরা দুজনে সুড়ঙ্গের অন্য মুখ আছে কি না খুব তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। পাইনি। শর্মার তো পরিচিত জায়গা। উনি কোনও মুখ দেখেননি। এবারও দেখতে পাননি।
অন্যমুখ ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না কর্নেল।
কর্নেল ব্যাখ্যা করে বললেন–পোড়ো খনির সুড়ঙ্গে জীবজন্তুরা বাসা বাঁধে। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও কোনও জায়গায় ফাটল দেখা যায়। জীবজন্তুদের স্বভাব হচ্ছে, ঢোকার মুখ পেলেই সহজাত প্রবৃত্তি অনুসারে বেরিয়ে যাবার একটা মুখ খোঁজে। না থাকলে নখের আঁচড়ে গর্ত করে সেটা বানিয়ে নেয়। সজারু ইত্যাদি কয়েক রকম গর্তবাসী প্রাণীর এ অভ্যেস আছে। আমরা ওখানে অজস্র সজারুর কাটা পড়ে থাকতে দেখেছি বলেই অন্যমুখ খুঁজছিলুম। কিন্তু তেমন কিছু দেখলুম না। হয়তো ছোট্ট ফোকর থাকতে পারে–তা দিয়ে মানুষ ঢোকা বা বেরুনো অসম্ভব।
বাইরে লাশটা এসেছে। আমরা বেরিয়ে গেলুম। চাদরে ঢাকা লাশটা বারান্দায় খাটিয়াতে রাখা হচ্ছিল। সর্বেশ্বরী তখনও ঘরের ভেতরে আছেন। ভেতরে অন্ধকার। শর্মা দারোগাবাবুর সামনে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। সম্ভবত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন এতক্ষণ।
কর্নেল গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ইন্দ্রনাথ এদিকের ঘরে এসে ঢুকলেন। আমি একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর ইন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলতে ফিরে এলুম। ঘরে ঢুকে দেখি, ইন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে বিছানা হাতড়াচ্ছেন। বললুম–কী খুঁজছেন?
ইন্দ্রনাথ কোনও জবাব না দিয়ে স্যুটকেসটা টানলেন। তারপর বলে উঠলেন—হুঁ। যা ভেবেছিলুম, তাই!
কী মিঃ রায়?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর মুখে উঠে তার খাটে বসলেন। বললেন–নিশ্চয় সৌম্যের কাজ। আমি যখন ঘাটে ছিলুম, ও এসে স্যুটকেসের তলা ভেঙেছিল। এ ছাড়া আর কে ভাঙবে?
-কেন বলুন তো ইন্দ্রনাথবাবু!
ইন্দ্রনাথের মুখটা লাল হয়ে উঠল। নিজেকে সংযত করে আস্তে আস্তে বললেন–ওর মাথায় একটা অদ্ভুত বোকামি ঢুকে পড়েছিল। ও ভাবত, খনিতে কোনও গুপ্তধন আছে এবং তার সন্ধান আমার হাতে আছে। বরাবর সুযোগ পেলেই আমার জিনিসপত্র হাতড়ানো অভ্যাস ছিল ওর।
ওঁকে সেই কাগজের কথাটা বলার জন্যে খুব ইচ্ছে সত্ত্বেও চেপে গেলুম। কিন্তু আমার মাথায় টিকটিকির উৎপাত। তাই কৌশলে প্রশ্ন করলুম-কিছু খোওয়া গেছে দেখলেন, মিঃ রায়?
ইন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়েই জবাব দিলেন–হ্যাঁ। কলকাতায় বড়শি কেনার সময় দোকানদার আমাকে একটুকরো কাগজের মোড়কে সেটা জড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে এসে মোড়কটা খুলে দেখি, ওটা একটা ডাইরি বইয়ের ছেঁড়াপাতা। লেখা ছিল C? ইংরেজি হরফে। কিন্তু তারিখটা দেখে অবাক হয়েছিলুম। ১৯৬৮ সালের ১৭ আগস্ট, রবিবার। ওইদিনই কাকা মারা যান। এটা নিছক দৈবাৎ যোগাযোগ ছাড়া কিছু নয়। তবু মনটা একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ওটা বালিশের তলায় এমনি-এমনি রেখে দিয়েছিলুম। সেটা এখন আর পাচ্ছি না।
এবার আর না বলে পারলুম না যে ওটা দলাপাকানো অবস্থায় আমিই পেয়েছি এবং কর্নেলকে দিয়েছি। শুনে ইন্দ্রনাথ হতাশভাবে মাথাটা দোলালেন। বললেন– বেশ বুঝতে পারছি। সৌম্যই ওটা হাতড়ে বের করেছিল। তারপর মাথামুণ্ডু বুঝতে পেরে ফেলে দিয়েছিল দলা পাকিয়ে। হয়তো ভেবেছিল, Cকথাটা মুখস্থ রাখা যখন সোজা, তখন কেন চুরি করি দাদার কাছ থেকে?
কিন্তু যেভাবে ছিল, সেভাবেই রাখতে পারত?
সৌম্যের স্বভাব এই। সহজে রেগে যেত। অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা নিয়ে থাকত। খুব খেয়ালী ছেলে ও। ভেবে কোনও কাজ করা ওর স্বভাবে ছিল না।
হঠাৎ কর্নেল ঢুকে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু, রঘুবীর আর রাঁধুনী লোকটাকেই মিঃ লাল আসামী হিসেবে চালান দিচ্ছেন। আমার কোনও কথা কানে তুললেন না।
ইন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বললেন–সে কী! কেন?
রাঁধুনীই বিপদটা ডেকে আনল। সৌম্যেন্দুকে যে ছুরিটা মারা হয়েছে, সেটা নাকি কিচেনেরই ছুরি। বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া একবার নাকি রঘুবীর বিকেলে কিচেনে ঢুকে ছুরিটার খোঁজ করেছিল।
ইন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল আমার পাশে বসে বললেন–তোমাদের আলোচনার শেষাংশ আমি শুনে নিয়েছি, জয়ন্ত। না–এ জন্যে লজ্জা পাবার কিছু নেই। তুমি মুখটা অমন হাঁড়ি করো না। এবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার শোনো। বঁড়শি একটা মোড়কে ছিল, তা সত্যি। কিন্তু সেই ওরিজিন্যাল মোড়ক বদলে এখানে আসার পর কেউ দ্বিতীয় মোড়কটা পাচার করে। ওরিজিন্যালটা আমি এইমাত্র কুড়িয়ে পেয়েছি বারান্দার নিচে। এই দেখ।
মোড়কটা দাদহাজার বিজ্ঞাপনের কাগজ। দেখে নিয়ে বললুম–মোড়ক বদলানোর উদ্দেশ্য কী?
ইন্দ্রনাথকে সম্ভবত উত্যক্ত করা।
বুঝলুম না।
–সি স্কোয়ার কথাটা এবং ওই তারিখ সম্ভবত ইন্দ্রনাথের ওপর কেমন প্রভাব সৃষ্টি করে কেউ দেখতে চেয়েছিল। বলা বাহুল্য, ইন্দ্রনাথ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন বই কি।
-কিন্তু কে সে?
–যে ছুরি চুরি করেছে এবং সৌম্যেন্দুকে হত্যা করেছে। সে ছাড়া নিশ্চয় আর কউ নয়। এবং যে দু-ধরনের দাগ মেঝেয় আছে, তার মধ্যে সবুজ দাগ যদি ৗম্যেন্দুর জুতোর হয়, কালো দাগ নিশ্চয় সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতো থেকে য়েছে।