লাল জটা, দাড়ি, গোঁফ। চোখ নীল। টকটকে ফর্সা রং। মনে মনে হাসলুম। অলৌকিক পুরুষ যখন, তখন ভারতবাসীর আদর্শ চেহারা যা, অর্থাৎ একেবারে সায়েবদের মতোই হবেন বই কি। প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনে থেকে আমাদের চোখে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা সায়েবদের ওপর আরোপ করার অভ্যাস হয়েছে।
দুজনেই চুপ করে আছি। এক সময় সর্বেশ্বরী হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চাপা গলায় বললেন ইন্দ্র আমার কথা শুনছে না। তুমি দেখে নিও, ওরও কী ঘটে। আমার কী?
বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর যেমন এসেছিলেন, বেরিয়ে গেলেন। ওপাশে ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। হয়তো অন্ধকারেই শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আমি ওঁর কথাগুলো ভাবতে থাকলুম। তারপর মনে পড়ল কাগজটার কথা। C লেখা আছে। কোনও সংকেত বাক্য কি? কাগজটা কার? কে অমন করে ফেলে দিয়েছে?
এই সময় কর্নেলদের সাড়া পাওয়া গেল। ওঁরা সবাই বারান্দায় এলে বেরিয়ে গেলুম। মিঃ লাল চেয়ারে বসে বললেন–লাশটা আর ওভাবে ফেলে রাখার মানে হয় না। কী বলেন কর্নেল সরকার? আমাদের যা দেখাশোনার ছিল, হয়ে গেছে। এবার একটা খাটিয়া নিয়ে গিয়ে ওটা আনা যাক্।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মিঃ লাল।
–তাহলে ইন্দ্রনাথবাবু, আপনি প্লীজ সেই ব্যবস্থাই করুন। কাল সকালের আগে অ্যাম্বুলেন্স আসার কোনও চান্স নেই। তারপর বডি মর্গে যাক্। এবার আমরা আরও কিছু জরুরী কাজকর্ম সেরে নিই।
ইন্দ্রনাথ রঘুবীর ও রাঁধুনীকে ডেকে বাংলো থেকে একটা ক্যাম্প খাট বের করলেন। লাশের কাছে দুজন সেপাই রেখে এসেছেন মিঃ লাল। বয়ে আনতে কোনও অসুবিধা হবে না। দারোগাবাবু একটা ফাইল খুলে পেন্সিল চালনা শুরু করলেন। কর্নেল আমার হাত ধরে বললেন–চলো জয়ন্ত, আমরা একটু জিরিয়ে নিই। আজ আর ডিনার খাবার বিন্দুমাত্র আশা রেখ না। কেমন?
ঘরে ঢুকে আমাদের খাটে বসলুম দুজনে। তারপর সেই কাগজ দিলুম ওঁকে এবং সংক্ষেপে সর্বেশ্বরীর কথাগুলোও জানালুম। কাগজটা পরীক্ষা করার পর কর্নেল পকেটে ঢোকালেন। চাপা গলায় বললেন–জয়ন্ত, আমি যা অনুমান করেছিলুম, তা যে ভুল নয়–তার প্রমাণ পেলুম।
বললুম–কী অনুমান করেছিলেন, কর্নেল?
কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে হাতের টর্চটা জ্বেলে মেঝেয় আলো ফেললেন। তারপর ইন্দ্রনাথের খাটের কাছে গিয়ে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন জয়ন্ত, দেখে যাও।
কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখি, পাথরের মেঝেয় কয়েকটা দুইঞ্চি-দেড়ইঞ্চি এবং একইঞ্চি দাগ। দাগটা কালো। বললুম–ও কিসের দাগ?
মনে হচ্ছে জুতোর গোড়ালির, কিম্বা ডগার। দেখ জয়ন্ত, আমরা বিকেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেউ এ ঘরে ঢুকেছিল। সে বাইরে থেকেই এসেছিল।…বলেই কর্নেল আরেক জায়গায় আলো ফেলে অস্ফুট স্বরে বললেন–মাই গুডনেস!
দেখি ওখানেও একই রকম দাগ। কিন্তু এই দাগগুলো সবুজ রঙের। বললুম– কর্নেল, নিশ্চয় তাহলে এসব জুতোর দাগ নয়। অন্য কিছু।
না জয়ন্ত! এবার বুঝলুম, দুজন এসেছিল এই ঘরে। একজন এসেছিল ঘাট থেকে। ঘাটের ধাপে শ্যাওলা আছে। সবুজ দাগ তারই। কিন্তু কালো দাগ কার জুতোর? এখানে কালো মাটি আছে একমাত্র খনির ওখানে। খনিতে তো আমি আর মিঃ শর্মা এই দুজনে গিয়েছিলুম। কিন্তু, আমরা কেউ এ ঘরে আসিনি। অতএব অন্য কেউ এসেছিল। সে কে?
কর্নেল, তখন বাংলোয় রঘুবীর, রাঁধুনী আর সর্বেশ্বরী ছিলেন। তাদের জিগ্যেস করা যায়।
করব। তবে এটা ঠিক, ওরা কেউ এ ঘরে এলেও এই দাগগুলোর জন্য ওরা দায়ী নয়। কারণ, দাগগুলো পুরুষ মানুষের জুতোর। এবং ওই তিনজনের মধ্যে রঘুবীর আর রাঁধুনী জুতো পরে না। সর্বেশ্বরী স্লিপার পরেন। এ দাগ স্লিপারেরও নয়। স্লিপারের দাগ আরও ছোট হওয়া উচিত।
–তাই মনে হচ্ছে।
কর্নেল চিন্তিতমুখে উঠে এসে ফের খাটে বসলেন। তারপর বললেন– ইন্দ্রনাথবাবুকে বলেছিলুম-জব্বলপুরে একটা টেলি পাঠাতে। ওখানে সি. আই. ডি. ইন্সপেক্টরকে আমার নামে টেলি করা হয়েছে। সম্ভবত ওঁরা কেউ এসে পড়বেন আজ রাত্রে, অথবা সকালে। বলাবাহুল্য মিঃ লাল চটে যাবেন। কিন্তু উপায় কী? এই হত্যাকাণ্ড খুব সহজ ঘটনা বলে মনে হচ্ছে না জয়ন্ত। এর পিছনে একটা জটিল রহস্য আছে যেন।
হঠাৎ সৌমেন্দুর কথাটা মনে পড়ে গেল। কর্নেলকে সেটা জানালুম। শুনে উনি ঘন ঘন মাথা নাড়তে থাকলেন। তারপর বললেন–গুপ্তধন সত্যি করে থাক, বা নাই থাক–একটা গুজবের ব্যাপার নিশ্চয় আছে, তা প্রথমেই অনুমান করেছিলুম। জয়ন্ত, গুপ্তধনের গুজবের মতো ভয়ঙ্কর সর্বনেশে আর কিছু নেই।
কর্নেল! কাগজের ওই সংকেতটা গুপ্তধনের ঠিকানা নয় তো?
কর্নেল হেসে ফেললেন।–তোমার অনুমানে যুক্তি থাকতেও পারে। কিন্তু ডার্লিং, তাহলে ওটা অমন তাচ্ছিল্য করে কেউ ফেলে দেবে কেন?
ফেলে দিয়েছে। কারণ, সে ভেবেছে একটা বাজে কাগজ।
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার যুক্তিতে সারবত্তা উঁকি দিচ্ছে। খুব খুশি হলুম, জয়ন্ত।
উনি চুরুট ধরিয়ে কী ভাবতে থাকলেন। একটু পরে বললুম–থাগে। আপনি আর ডঃ শর্মা খনিতে কী করছিলেন অতক্ষণ? হঠাৎ ঘাটের দিকেই বা গেলেন কেন? কোন পথে গেলেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–খনিটা দেখে মনে হলো, সত্যি ভূতের আড্ডা। খানাখন্দ প্রচুর। তত ঝোপঝাড়। বারোটা পিট ছিল। তিনটে বাদে সব বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনটের মধ্যে একটা ধস নেমে প্রায় বুজে গেছে। দুটো পিট এখনও খোলা। কিন্তু জঙ্গল গজিয়েছে। ভেতরে ঢোকার কথা ভাবা যায় না। শর্মা তো ভেবেই পেলেন না কোথায় ডিনামাইট বসাবেন। ও দুটোর কাছে কোনও পাথর নেই–তাছাড়া মুখগুলোর চারপাশে গভীর খাদ, জলে ভর্তি। মুখের কাছে যথেষ্ট মাটিও নেই যে ডিনামাইট চার্জ করলে ধস ছাড়বে। এক হতে পারে, সুড়ঙ্গের ওপর গর্ত খুঁড়ে ডিনামাইট বসানো। কিন্তু সুড়ঙ্গ কোন পথে কী ভাবে মাটির তলায় গেছে, না জানলে তো কিছুই করা সম্ভব নয়। ওপর থেকে বুঝবে কী করে?