মিঃ লাল টর্চের আলো পেলে লাশ পরীক্ষা করতে করতে বললেন–মনে হচ্ছে ঘাটে মাছ ধরার সময় খুনী ছুরি মেরেছে। তারপর লাশটা টেনে এখানে এনেছে। আপনি কী বলেন কর্নেল সরকার?
কর্নেল একটু কেসে বললেন–ঠিক তাই বটে। কিছু রক্ত পড়ে আছে।
অমনি মিঃ লাল ও দুজন কনস্টেবল রক্ত খুঁজতে ব্যস্ত হলেন। কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-জয়ন্ত, যদি অসুস্থ বোধ করো, বাংলোয় গিয়ে বিশ্রাম করো।
অসুস্থ বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে হলো, কর্নেল আমাকে কোনও গূঢ় আদেশ দিচ্ছেন। অতএব ভালছেলের মতো আমি বাংলোয় চলে গেলুম।
বাংলোর বারান্দায় একটা কাঁচটকা ল্যাম্প রয়েছে। ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দায় দুজন রাইফেলধারী সেপাই বসে রয়েছে। তারা আমার দিকে তাকাল মাত্র। তারপর চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। আমি ঘরে ঢুকলাম। মোমবাতি দেখেছিলুম দিনে। দেশলাই জ্বেলে একটা ধরালাম। তারপর খাটে বসে পড়লুম।
এ ঘরে একটা বড় বিলাতি খাট আছে তাতে কর্নেল ও আমার শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যপাশে একটা ক্যাম্পখাট পাতা হয়েছে ইন্দ্রনাথের জন্যে। হঠাৎ চোখে পড়ল ওই খাটটার তলায় দলাপাকানো একটা কাগজ পড়ে রয়েছে। অন্যসময় হলে কিছুই ভাবতুম না। কিন্তু সদ্য খুন হয়েছে এবং কর্নেলের মতো রহস্যভেদী আছেন। সঙ্গগুণে এসব ক্ষেত্রে আমার মধ্যে গোয়েন্দা পোকা অর্থাৎ টিকটিকিটা খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অতএব তক্ষুনি কাগজটা কুড়িয়ে এনে খুলে ফেললুম। খুব পুরনো কাগজ। কোণায় ছাপানো সনতারিখ দেখেই বুঝলুম, এটা কারো ডায়েরির ছেঁড়া পাতা। তারিখটা হচ্ছে ১৭ আগস্ট ১৯৬৮ রবিবার। পাতার নিচের দিকটা ছেঁড়া। তাতে শুধু লেখা রয়েছে ইংরেজিতে: ‘C2’। খুব বড় হরফে কালো কালিতে কেউ লিখেছে। কালি পরীক্ষা করে মনে হলো খুব পুরনো।
ধুরন্ধর গোয়েন্দার শিষ্য আমি। তাই কাগজটা পকেটে রেখে দিলুম। গুরুদেবকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেব। এবং এরপর স্বভাবত আমার মাথায় তদন্তের পোকাটা আরও চঞ্চল হয়ে উঠল। তখন ইন্দ্রনাথের বিছানা হাতড়াতে ব্যস্ত হলুম। আমার তদন্ত ব্যর্থ হলো। তেমন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। তলায় ওঁর একটা স্যুটকেস রয়েছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম, সেটা ভোলা। তখন সাবধানে খুলে ফেললুম। কয়েকটা প্যান্টশার্ট আর দুটো হুইস্কির বোতল ছাড়া আর কিছু নেই। এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ হতেই ঝটপট সরে এলুম।
দরজায় দেখা দিলেন সর্বেশ্বরী। ব্যস্ত হয়ে বললুম–আসুন, আসুন মা।
সর্বেশ্বরী ঢুকে ইন্দ্রনাথের খাটে বসে পড়লেন। সন্ধ্যা থেকেই দেখছি, উনি স্তব্ধ এবং যেন নির্বিকার কিংবা যেন ভীষণ-বিমূঢ়। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছেন শুধু, এক ফোঁটা চোখের জল পড়তে দেখিনি। এখন চুপচাপ বসে সেই শক খাওয়া নির্বিকার চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয় হলো, উনি পাগল হয়ে। যাননি তো এই আকস্মিক আঘাতে? একটু অস্বস্তি হলো। বললুম–কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল বলুন তো! কী বলে যে আপনাকে সান্ত্বনা দেব, ভেবে পাচ্ছি না! সৌমেন্দুবাবু…
বাধা দিয়ে সর্বেশ্বরী মুখ খুললেন এবার।–এ আমি জানতুম, বাবা জয়ন্ত।
অবাক হয়ে বললুম–জানতেন?
–হ্যাঁ। ওই অভিশপ্ত খনি কাকেও রেহাই দেবে না। কোনও-না-কোনও ভাবে রায়বংশের সবাইকে শেষ করবে। বলবে, কেউ ছুরি মেরেছে সৌমেন্দুকে। হ্যাঁ– মেরেছে। কিন্তু যে মেরেছে, সে নিজেও জানে না কেন ওকে ছুরি মারল।…দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের শোকমবেগ যেন:দমন করলেন সর্বেশ্বরী। ফের বললেন–আমি যা জানি তোমরা কেউ তো, তা জানো না, বাবা জয়ন্ত। বললে বিশ্বাস করবে না।:ওই অভিশপ্ত জায়গাটা কেনার কথাবার্তা চলতে চলতেই আমার ভাসুর আর বড় জা হঠাৎ মারা গেলেন–একমাস আগে-পরে। আমি বাধা দিলুম। তাই কেনা হয়নি। কিন্তু আমার স্বামী না জানিয়ে উনিশ বছর পরে কখন কিনে বসলেন। শর্মা ওর বন্ধু। শর্মাই নাকি কবে সার্ভে করে দেখেছিলেন, ওখানে মাটির তলায় অনেক সীসে আছে। তারপর তো খনির কাজ শুরু হলো। আমার কপাল ভাঙল।…
উনি চুপ করলে বললুম–আপনারা খনি শুরু করার আগে জায়গাটা তাহলে এমনি পড়ে ছিল?
মাথা দোলালেন সর্বেশ্বরী। তারপর বললেন–পড়ে ছিল ঠিকই। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই গুজব রটেছিল যে ওখানে সীসের খনি আছে।
কিন্তু তাহলে ওই উনিশ বছর ধরে কেউ খনির কাজ করেনি কেন?
–ওখানে এক সাধু থাকতেন। তিনিই বরাবর ভূপালের নবাবকে ধরে কাকেও ইজারা নিতে দিতেন না। উনিশ বছর পরে হঠাৎ সাধু অদৃশ্য হলেন। তখন আর আমার স্বামীর পক্ষে কেনার বাধা রইল না। নবাবের এক উত্তরাধিকারীর কাছে সস্তায় কিনে ফেললেন। তখন দেশীয় রাজাদের সম্পত্তি সরকার দখল করতে শুরু করেছেন। তাই বেগতিক দেখে ওরা বেচে দিলেন। কিন্তু বাবা, তোমরা তো একালের ছেলে কিছু বিশ্বাস করো না। সাধু কিন্তু বরাবর অদৃশ্য হয়ে ওখানে বাস করতেন। এতদিনও করেছিলেন। কদিন আগে এক রাতে আমাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন–বেটি, চলে যাচ্ছি। খনির মুখ বন্ধ করে দে এবার।
–সাধুকে আপনি কি দেখেছেন কখনও? মানে–স্বপ্নের কথা বলছি না।
–হ্যাঁ। একবার প্রত্যক্ষ দেখেছিলুম। খানিকটা দূর থেকে। টকটকে ফর্সা রঙ-লাল জটা, দাড়ি গোঁফও লাল। একেবারে উলঙ্গ বলা যায়। চোখ দুটো নীল–হৃঙ্খল্ করছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র একটু হেসে অদৃশ্য হলেন।