ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলুম ইন্দ্রনাথবাবু! ইন্দ্রনাথবাবু!
চেঁচানোর উদ্দেশ্য, মাছটা ওঁর ঘাটের দিকেই যাচ্ছে। উনি যদি এখন কোনওভাবে ওঁর বঁড়শিতে বা সুতোয় ওটাকে আটকাতে পারেন, মাছটা হাতছাড়া হবার সুযোগ পাবে না।
আমার ডাকের পর মনে হলো উনি সাড়া দিলেন–সেটা আমার শোনারও ভুল হতে পারে। কারণ, ঠিক তখনই যা ভয় করেছিলুম–তাই হলো। সুতোটা ঢিলে হয়ে নেতিয়ে গেল। গুটিয়ে আনার পর দেখি, ফাতনাসুদ্ধ ছিঁড়ে মাছটা সম্ভবত পাথরের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফাতনাটা খুঁজলুম। আলো কমে গেছে। এখান থেকে দেখা গেল না। তখন আরও ভাল করে দেখার জন্য ইন্দ্রনাথের ঘাটের। কাছে গেলুম।
ঝোপ ঠেলে গিয়ে দেখি, ইন্দ্রনাথ পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে দোলাচ্ছেন। ছিপটা তুলে পাশে রেখেছেন। জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। ব্যাপার কী?
আমার পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। আসুন, আসুন জয়ন্তবাবু। আপনারও দেখছি আমার অবস্থা হয়েছে। লেকের মাছগুলো খুব শক্তিমান। বরাবর এই কাণ্ডটি ঘটে বলে এবার বিলিতি কোম্পানির সুতো আনলুমতাও টিকল না।
বললুম–ডাকছিলুম, শোনেননি?
ইন্দ্রনাথ বললেন—হুঁ শুনেছি। কিন্তু তখন সাড়া দেবার ফুরসত কোথায়? চলুন–আলো কমে গেছে। আজ আর আশা নেই। কাল সকাল থেকে ফের বসা যাবে।
দুজনে পাশাপাশি ঢালু বেয়ে ওঠা শুরু করলুম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ বললেন-সৌম্য অবশ্য আমাদের মতো আনাড়ি নয়। আমি জানি জব্বলপুর থেকে গাড়ি করে এসে ও মাছ ধরে। বিলক্ষণ অভ্যাস আছে। এজন্যেই সম্ভবত জব্বলপুর ছেড়ে যেতে চায় না।
বললুম–দেখে আসব নাকি?
–থাক। ও একটু গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে। ডিসটার্ব করলে খুশি হবে না। আসুন, আমরা বাংলোয় গিয়ে আরামে কফি খাব।…..
.
বাংলোয় গিয়ে দেখি, সর্বেশ্বরী বারান্দায় বসে রয়েছেন। রঘুবীরের সঙ্গে কথা বলছেন। ভাসুরপোকে একবার দেখে বললেন–মাছ হলো না? ইন্দ্রনাথ জবাবে একটু হাসলেন মাত্র। তারপর আমরা বারান্দার উত্তরদিকে একটু তফাতে বসলুম। ইন্দ্রনাথ রঘুবীরকে বলে দিলেনকফি খাব।
একটু পরে কফি খেতে খেতে কর্নেল ও শর্মার গলার আওয়াজ পেলুম। তখনও অন্ধকার ঘন হয়নি। গোধূলিকাল বলা যায়। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম কর্নেল ও শর্মা ঘাটের দিক থেকেই আসছেন। কিন্তু তাঁদের আসার মধ্যে কেমন ব্যস্ততা ছিল। খোলা বারান্দায় আমাদের দেখতে পেয়েই কর্নেল চেঁচিয়ে বললেন ইন্দ্রনাথবাবু! সৌমেন্দুবাবু ফিরেছেন?
ইন্দ্ৰনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললেনা। ও এখনও ঘাটে আছে।
কর্নেল অমনি ঘুরলেন এবং হাস্যকর ভঙ্গিতে দৌড়ে, যেদিক থেকে আসছিলেন–অর্থাৎ সেই পাথরের ধাপবন্দী ঘাটটার দিকেই চলে গেলেন। শর্মা দাঁড়িয়ে ওঁর চলে যাওয়া দেখছিলেন। ইন্দ্রনাথ ও আমি বারান্দা থেকে তক্ষুনি ওঁর কাছে চলে গেলুম।
ইন্দ্রনাথ বললেন ব্যাপার কি মিঃ শর্মা?
শর্মার যেন এতক্ষণে সংবিত ফিরল। ইন্দ্রনাথ! ঘাটে সৌমেন্দু নেই– ছিপটা জলে পড়ে আছে। আর…আশ্চর্য ঘাটের পাথরে একটুখানি রক্ত। আমরা ভাবলুম, মাছের রক্ত। কিন্তু… ।
কথা শেষ করার আগেই কর্নেলের ডাক এল ইন্দ্রনাথ! মিঃ শর্মা! চলে আসুন।
সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি ঘাটের ওপর দিকে ঝোপে কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। ঝোপে ঢুকে আমার মাথা ঘুরে গেল। শরীর অবশ হয়ে উঠল। ইন্দ্রনাথ ভাঙা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন-সৌম্য!
সৌমেনের বুকে একটা ছোরা বিধে রয়েছে। বিঁধে আছে বলেই বিশেষ রক্ত পড়েনি। চিত হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে আছেন উনি। চোখদুটো খোলা। মুখে বিকৃত ভাব। মুহূর্তে আমার মনে পড়ে গেল, কর্নেলের মুখে শোনা সেই ছড়াটা :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেছে কোলাব্যাং
মাছ নিয়ে গেছে চিলে।…
.
বিন্দিয়া নামে পাঁচ মাইল দূরে একটা ছোট শহর আছে। সেখানেই থানা। ইন্দ্রনাথ সেই গাড়িটা চালিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। ফিরলেন সাতটা নাগাদ। সঙ্গে একদল পুলিশ। অফিসার-ইন-চার্জের নাম মিঃ লাল। ভদ্রলোক খুব রাগী মানুষ। এসেই প্রথমে চোখ পড়ল রঘুবীর আর রাঁধুনী বেচারার দিকে। ধমক দিয়ে বললেন এই ব্যাটারাই খুন করেছে! শুনে ওরা ঠকঠক করে কাঁপতে ঈশ্বর-রামজী-হনুমান গণেশ তাবত দেব-দেবতার কিরিয়া খেতে থাকল। বেগতিক দেখে কর্নেল তার পরিচয়পত্রটি বের করলেন। সম্প্রতি এটি তিনি ভারত সরকারের কাছে লাভ করেছেন। এটি এতদিন ছিল না বলে তাকে নানান অসুবিধায় পড়তে হচ্ছিল। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার পরামর্শে যোগাড় করতে হয়েছে।
পরিচয়পত্র দেখে মিঃ লাল একটু সংযত হলেন। কিন্তু ঠোঁটে বাঁকা হাসিটা থেকে গেল। বললেন–আপনার সাহায্য পেলে খুশি হব নিশ্চয়। কিন্তু কর্নেল সরকার এ হলো মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল। যত সব খুনে ডাকাতের আড্ডা। কথায় কথায় ওরা খুন খারাবি করে। আশা করি, খবরের কাগজ পড়ে তা আপনি বিলক্ষণ অবগত আছে। এই লোকদুটোর চেহারা দেখেই বুঝেছি এরা ঘোড়েল ক্রিমিনাল। রেকর্ড খুঁজলে নিশ্চয় সব বেরোবে। যাক্ গে, এখন আমাদের রুটিনওয়ার্কে নামতে হবে।
টর্চের আলোয় সরজমিন তদন্ত শুরু হলো। লাশটা সেখানেই পড়ে ছিল। লাশের কাছে একটা হেরিকেন রেখে সর্বেশ্বরী, মিঃ শৰ্মা, এবং আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলুম। কর্নেল বাংলোয় (লাশটা থেকে পঞ্চাশ গজ ওপরে) রঘুবীর ও রাঁধুনীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারপর লাশের কাছে এলেন।