অনুরাধা তাকিয়ে রইল নিষ্পলক চোখে। মোমের আলোয় তাকে যেন দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল অন্যদের। সুমনের ঠোঁটের কোণায় সুক্ষ্ম হাসি ছিল এতক্ষণ। সেটা মিলিয়ে গেল। ভাবনাও গম্ভীর হয়ে পড়ল। মঞ্জুশ্রীর মুখে ভয় ও বিস্ময় ছিল। তাকেও এবার শান্ত দেখাল।
— অরুণেন্দু বলল, রেডি। আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতীক্ষা করছি। বলে সে টেবিলে আঙুলের শব্দ করল।
বাইরে মেঘ ডাকল সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটা কেঁপে উঠল। মোমের শিখা স্থির জ্বলছে। ঘরে স্তব্ধতা ও ভ্যাপসা গরম। আবছা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ক্রমশ শোনা যেতে থাকল। দুমিনিট পরে দেখা গেল অনুরাধার হাতের পেন্সিল কঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে কাগজের ওপর কিছু লেখা হল।
পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু আস্তে কাগজ আর পেন্সিলটা অনুরাধাকে না ছুঁয়ে তুলে নিল। কিছু লেখা নেই। আঁকাবাঁকা একটা রেখা মাত্র।
অরুণেন্দু লিখল : আপনি কে? তারপর কাগজটা আস্তে এগিয়ে পেন্সিলটা অনুরাধার হাতে গুঁজে দিল। অনুরাধার হাত তেমনি পেন্সিল ধরার ভঙ্গিতে টেবিলে রাখা আছে।
আবার পেন্সিলটা কাঁপল। তারপর লেখা হতে থাকল। পেন্সিল থামলে অরুণেন্দু কাগজ ও পেন্সিলটা তেমনি আস্তে তুলে নিল। লেখা হয়েছে : আমি সুদীপ্ত।
অরুণেন্দু লেখাটা নিঃশব্দে দেখাল অন্যদের। অনুরাধা ছাড়া সবারই মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের কথা ভেবেছিল সবাই। সুদীপ্ত এসে গেল!
এর পর অরুণেন্দুর প্রশ্ন এবং অনুরাধার জবাব লেখা হতে থাকল পালাক্রমে।
তা হল এই :
আপনাকে আমরা ডাকিনি।
আমার কথা আছে।
বলুন।
থাক। আমি যাই।
কেন?
পিট নং ৩৪৭ ..
তার মানে?
কালো পাথর।
কিছু বুঝলাম না।
মোহান্তজী।
এসব কী বলছেন?
যাচ্ছি।
অনুরাধার আঙুল থেকে কাগজ-কলম টেনে নিতে হাত বাড়াল অরুণেন্দু, সেই সময় হঠাৎ টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অনুরাধা। ভাবনা আতঙ্কে অস্ফুট চীৎকার করে উঠল। অরুণেন্দু ডাকল, অনুরাধা! অনুরাধা!
অনুরাধা অজ্ঞান হয়ে গেছে। সবাই উঠে দাঁড়াল। সুমন ঝটপট সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল। মঞ্জুশ্রী কিচেন থেকে জল নিয়ে এল গ্লাসে। অরুণেন্দু অনুরাধার মুখে জল ছিটিয়ে দিল। ভাবনা তাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে।
তারপর অনুরাধা চোখ খুলল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
গণ্ডগোল শুনে ডঃ রায় এবং মীনাক্ষীদেবী পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন। অরুণেন্দুকে একটু বকাবকি করলেন। ভাবনা বলল, অনু, তোমরা কি হয়েছিল?
অনুরাধা আস্তে বলল, জানি না। হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল।
সুমন জানালাগুলো খুলে দিলে ঘরের ভেতরকার গুমোটভাবটা চলে গেল। বাইরে ঝড়ের প্রকোপ লেগেছে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে সমানে। অরুণেন্দু কাগজটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে অদ্ভুত হাসি। সে বলল, সিয়াসের আসরে অনেক সময় এমন হয়েই থাকে অবশ্য। মিডিয়াম নিজেও ভয় পেয়ে যায়। তার একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আমি দিতে পারি। তবে
ডঃ রায় কপট ধমক দিয়ে বললেন, থাক। তারপর হো হো করে হাসলেন। কবে অশরীরী এসে তোমারই ঘাড় মটকাবে দেখবে।
মীনাক্ষী বললেন, মনু, সুস্থবোধ করছ তো?
অনুরাধা একটু হাসল। আমি ঠিক আছি, মাসিমা।
বাইরের বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখে এসে ডঃ রায় বললেন, এখন বেরুনো যায়। অনু ভাবনা, এস–গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করি।
ভাবনা বলল, এক মিনিট। মেসোমশাই, সিয়াসের আসরে কে এসেছিল জানেন? সুদীপ্ত।
ডঃ রায় চমকে উঠলেন। সুদীপ্ত!
ধাতু গবেষণা কেন্দ্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ অফিসার ছিল সুদীপ্ত। কিছুদিন আগে সে খুন হয়ে গেছে। তাই সকলের অবাক হবারই কথা।
ডঃ রায় অরুণেন্দুর হাত থেকে কাগজটা নিলেন। অরুণেন্দু কাগজটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কাগজটা নিয়ে চোখ বুলোতে ডঃ রায়ের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। পড়া শেষ হলে গম্ভীর মুখে বললেন, এটা আমার কাছে থাক, অরু! ভাবনা এস। অনু তোমাদের পৌঁছে দিয়ে আসি।
সুমন বলল, আমি ওদের পৌঁছে দিতে পারতাম। বৃষ্টির মধ্যে আপনি কষ্ট করে–
ডঃ রায় বললেন, তুমি তো উল্টোদিকে যাবে। তাছাড়া রাত হয়ে গেছে। অতখানি পথ তোমাকে ফিরতে হবে।
ডঃ রায় বেরিয়ে গেলেন। তাদের বিদায় দিতে গেল মঞ্জুশ্রী আর তার মা। মা ও মেয়ের মুখে আতঙ্ক ও উদ্বেগের ছাপ লেগে রয়েছে।
অরুণেন্দু গুম হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন একটু হেসে বলল, কী অরুদা? কী ভাবছ?
অরুণেন্দু হাসল। চাপা গলায় বলল, ব্যাপারটা আমার নিজেরই খটকা লাগছে।
কেন বলো তো?
আমার অভিজ্ঞতায় কখনও সিয়াসের আসরে সদ্যমৃত কেউ আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা অপঘাতে মৃত কোনো মানুষের আত্মা আসে বলেও জানি না। প্রেততত্ত্বের বহু বই পড়েছি। কোথাও পড়িনি, অপঘাতে মৃতরা আসে। কারণ কী জানো? অরুণেন্দু চাপা গলায় বলতে লাগল। তার মুখে উত্তেজনা থমথম করছে।..কারণ যারা অপঘাতে মারা পড়ে, তারা ভীষণ যন্ত্রণায় ভোগে অনন্ত কাল। মৃতদের জগতে কয়েকটা স্তর আছে। অপঘাতে মৃতরা সেই সব স্তরের বাইরে কোথাও স্থান পায়। সেখান থেকে যদি বা কেউ বস্তুজগতে এসে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। তাই ভগবান বা প্রকৃতি, যিনিই হোন, তাদের স্বাভাবিক পারলৌকিক স্তরগুলোতে রাখার ব্যবস্থা করেননি। ..
সুমন বলল, বাপস্। মাথাটা আর বিগড়ে দিও না অরুদা! তাছাড়া এসব শুনলে এ রাতে আর বাড়ি ফেরা কঠিন হবে। মাইণ্ড দ্যাট, পাঁচ কিলোমিটার দূরে থাকি।