কর্নেল ফের মাথা দুলিয়ে বললেন রাইট, রাইট!
শর্মা একটু ঝুঁকে বললেন–কিছু যদি মনে করেন কর্নেল, তাহলে আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন। সার্ভে এবং ডিনামাইট রাখার ব্যাপারে আপনার মতো অভিজ্ঞ একজন সমরকুশলী থাকা খুবই সঙ্গত। এ ধরনের কাজকর্ম সমর বিভাগের লোকেরা নিশ্চয় করে থাকেন।
কর্নেল তক্ষুণি আমন্ত্রণটা নিলেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন জয়ন্ত, তাহলে তুমি ছিপ ফেলতে যাও। আমি মিঃ শর্মার সঙ্গে যাই।…
সর্বেশ্বরী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আপনারা ঘুরে আসুন। ততক্ষণ আমি বিশ্রাম করে নিই।
সবেশ্বরী ঘরে ঢুকলেন। কর্নেল ও মিঃ শর্মা বেরিয়ে গেলেন। আমি লেকের দিকে পা বাড়ালুম। লন পেরিয়ে যাবার সময় সৌম্যেন্দু হঠাৎ আমাকে ডাকলেন– জয়ন্তবাবু, শুনুন!
কাছে গেলুম। বললুম–আপনি গেলেন না যে?
সৌম্যেন্দু সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন–আপনারা কি সত্যি নিছক মাছ ধরতেই এসেছেন?
চমকে উঠে বললুম–নিশ্চয়ই। আপনার অবিশ্বাসের কারণ বুঝলুম না সৌমেন্দুবাবু। দুঃখিত।
সৌম্যেন্দু আমার অনুযোগ গ্রাহ্য না করে প্রশ্ন করলেন–আপনি কি সত্যি রিপোর্টার?
অপমানিত বোধ করলুম। পকেট থেকে আমার আইডেন্টিটি কার্ড (ফটো সমেত) বের করে ওঁর সামনে ধরে বললুম–আপনার কি এটা জাল মনে হচ্ছে?
সৌম্যেন্দু, আশ্চর্য, আইডেন্টিটি কার্ডটা আমার হাত থেকে নিলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টে পরীক্ষা করার পর ফিরিয়ে দিয়ে একটু হাসলেন–জয়ন্তবাবু, আমার এই সংশয়কে ক্ষমা করবেন। আপনাকে খোলাখুলিই বলছি, দাদার প্রতি আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই।
–কেন সৌমেন্দুবাবু?
ওঁর এখানে আসার মধ্যে অবশ্যই কোনও মতলব আছে। কিন্তু শুধু বুঝতে পারছি না–আপনাদের কেন উনি আনলেন? বিশেষ করে ওই কর্নেল ভদ্রলোকের নাম আমার শোনা আছে–উনি একজন শখের গোয়েন্দা–তাই না?
–ঠিক তা নয়। তবে ওঁর রহস্যসম্পর্কে আগ্রহ আছে। তবে একটা পোড়ো খনির মুখ বন্ধ করার মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে, সত্যি আমি বুঝতে পারছি না সৌম্যেন্দুবাবু।
–পারে বইকি।…বলে সৌম্যেন্দু কেমন হাসলেন। তারপর চাপা গলায় ফের বললেন–আমার বরাবর ধারণা, ওই খনির সুড়ঙ্গে কোথাও গুপ্তধন লুকোনো আছে।
বলেন কী মশাই!
-হ্যাঁ জয়ন্তবাবু। এই আমার বরাবরকার অনুমান। কিন্তু কিছুতেই মাথায় ঢোকে না, ওখানে কে গুপ্তধন পুঁতে রাখতে গেল? কখন পুঁতল?
আমি হতভম্ভ হয়ে গেছি কথাটা শুনে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ সৌম্যেন্দু বললেন–চলুন, আপনার ওই কর্নেল সায়েব তো ছিপ নিয়ে বসবেন না। অতএব আমি ওঁর ছিপটা নিয়ে মাছ ধরতে বসব। কিন্তু একটা কথা–আমি ছিপটা দাদার কাছে গিয়ে আনতে পারব না। আমি দূরে দাঁড়াব। আপনি এনে দেবেন। দাদার কাছে জেনে নেবেন কিন্তু, কোন ঘাটে কর্নেলের বসার কথা ছিল। সে ঘটেই আমি বসব।…
.
লেকের এই দক্ষিণ ধারটা পাহাড় থেকে ঢালু বা গড়ানে অবস্থায় জলে নেমে গেছে। অজস্র ঝোপঝাড় ও পাথর আছে এখানে। বাঁদিকে অর্থাৎ পশ্চিমে সেই পাথর বাঁধানো ঘাটে কর্নেলের বসার কথা। সেখানেই সৌম্যেন্দু বসলেন। আমি বসলুম তার আন্দাজ তিরিশ গজ দূরে ঝোপের মধ্যে থেকে একটা পাথর জলঅব্দি নেমে গেছে, তার ওপর। আমি সৌম্যেন্দুর ছিপের ডগাটা শুধু দেখতে পাচ্ছিলুম। আর, ইন্দ্রনাথ বসেছেন আমার ডাইনে আন্দাজ চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে। সেখানেও এমনি পাথর আছে। কিন্তু আমি ইন্দ্রনাথের ছিপটা দেখতে পাচ্ছিলুম না। ওই ঘাটটা সম্পূর্ণ আড়ালে পড়ে গেছে।…
হ্রদের জল এখন মোটামুটি শান্ত। আমার পিছন থেকে বাতাস বইছে বলে আমার ঘাটের জলটা কাচের মতো নিভাজ আর স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল। পশ্চিমের উপত্যকায় সেই ভুতুড়ে খনি অঞ্চল–বেশ কঁকা খানিকটা জায়গা। ঝোপঝাড় অবশ্য আছে। কিন্তু কোনও পাহাড় না থাকায় সূর্যের আলো এসে হ্রদের জলকে গোলাপি আলোয় রাঙিয়ে তুলছিল। ছিপে বসতে যে একাগ্রতার দরকার, এখন তা আর আমার নেই। মাথায় সৌম্যেন্দুর গুপ্তধন কথাটা ভেসে আসছে। বারবার পশ্চিমের ওই উপত্যকার দিকেই তাকাচ্ছি। ফাতনা স্থির হয়ে ভেসে আছে। হ্রদে প্রচুর মাছ আছে শুনেছিলাম, কিন্তু একবারও ফানা নড়তে দেখলুম না। চারে মাছ এলে বুজকুড়ি ফুটবে জলে। তারও কোনও লক্ষণ নেই। বসে থেকে বিরক্তি ধরে গেল। অনেকগুলো সিগারেট খেয়ে ফেললুম। বারকতক ছিপ তুলে টোপও দেখলুম। মাছে ঠোকর দেয়নি। ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। হ্রদের জলের গোলাপি রঙ ঘিরে ধূসর কুয়াশা জেগে উঠছে। দূরের পাহাড়গুলো কালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। যে সব পাখি হ্রদের আকাশে ওড়াউড়ি করছিল, এতক্ষণে তারা পাহাড়-জঙ্গল লক্ষ্য করে ডানা মেলছে। হঠাৎ আমার ছিপের সুতোয় টান পড়ল এবং হুইলের ঘরঘর শব্দ শোনা গেল। ছিপটা চেপে ধরে, দেখি সুতো প্রচণ্ড বেগে জলের তলায় ছুটছে। নির্ঘাৎ কোনও প্রকাণ্ড মাছ বঁড়শি গিলেই গেঁথে গেছে, আমাকে খ্যাচ মারার সুযোগও দেয়নি।
ছিপের ডগা বেঁকে যাচ্ছিল। সামলাতে না পেরে উঠে দাঁড়ালুম। একটু পরেই মাছটা স্থির হলো। তখন সুতো গুটোতে শুরু করলুম। মাছটা অন্তত কিলো দশকের কম হবে না। কাছাকাছি আসার পর মাছটা এক লাফ দিয়ে ডাইনে ঘুরল। তারপর পাড়ের সমান্তরালে জল ভেঙে দৌড় দিল। পাড়ের কাছাকাছি বলে এসব জায়গায় অজস্র পাথর জলের ভিতরে এবং উপরে ঘাপটি পেতে রয়েছে। ভয় হলো, নির্ঘাৎ এবার মাছটা কোনও পাথরের খাঁজে ঢুকে যাবে এবং আমার সুতোটা ছিঁড়ে ফেলবে।