কিন্তু এই অভিশপ্ত মাটিতে হঠাৎ উনি নিজেই এসে পড়লেন এবং সদলবলে– কেন?
ততক্ষণে রঘুবীর দৌড়ে হাজির হয়েছে। তার হাবভাব দেখে স্পষ্ট জানা গেল, যা ভেবেছি, তাই। বৃদ্ধা বেশ শক্ত সমর্থ মনে হলো। আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন–আপনাকে তো চিনলুম না বাবা?
রঘুবীর বলল-মাইজী, ওনারা এসেছেন কলকাতা থেকে। ইন্দর সাহেবের সঙ্গে। লেকে মাছ ধরবেন।
ইন্দ্র! ইন্দ্র এসেছে? বৃদ্ধার মুখে খুবই বিস্ময় ফুটে উঠল।
–জী হাঁ। এই তো দো-তিনঘণ্টা আগে এসেছেন। ঔর এক কর্নেল সাহেব এসেছেন।
বৃদ্ধা গম্ভীর মুখে দলবল সহ বাংলোয় উঠলেন। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগল। ভুতুড়ে বাংলোর সব রোমান্স মাঠে মারা যাবে। বেশি হইচই করা যাবে না। মেপে জুপে চলাফেরা করতে হবে। ইন্দ্রনাথের মুখে ওঁদের গার্জেন এই ভদ্রমহিলার যে ব্যক্তিত্বের আঁচ পেয়েছিলুম, বাস্তবে মনে হচ্ছে তার চেয়েও কড়া কিছু। আশঙ্কাও হলো, ইন্দ্রনাথ ওঁর বিনা অনুমতিতে এবং অজ্ঞাতসারে আমাদের নিয়ে এখানে এসেছেন–এই নিয়ে কোনও মনান্তর দেখা দেবে না তো?
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় গেলুম। তারপর আরও কিছু এগিয়ে যেতেই আচমকা পাশের একটা ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। টুপিতে মাকড়সার জাল, জামায় কাঁটা আটকে আছে এবং শুকনো পাতা লেগে রয়েছে। আমাকে দেখে যেন একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন–এই যে জয়ন্ত!
বললুম–বন্য জন্তুর মতো ঝোপ জঙ্গলে ঢুঁ মেরে বেড়াচ্ছেন। ওদিকে দেখুন গে, ধুন্ধুমার শুরু হয়েছে এতক্ষণ। ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা ভদ্রমহিলা দলবল নিয়ে। এসে পড়েছেন!
কর্নেল হাত তুলে বললেন–দেখেছি। এত নার্ভাস হয়ে পড়ার কিছু নেই। এবার চুপচাপ একটা জমাট নাটক দেখতে থাকো। আনন্দ পাবে–আই অ্যাসিওর ইউ, ডার্লিং!
নাটক মানে?
কর্নেল টুপি খুলে টাক চুলকে বললেন–হ্যাঁ জয়ন্ত। সম্ভবত একটা রোমাঞ্চকর নাটকের শেষ অঙ্কের পর্দা উঠল এবং আমরা কিছু না জেনে তার মধ্যে এসে। পড়েছি।
বিস্মিত হয়ে বললুম–কর্নেল! প্লীজ-অন্ধকারে রাখবেন না!
কর্নেল সস্নেহে আমার একটা হাত ধরে বললেন–ধৈর্য ধরো, জয়ন্ত। সম্ভবত আমাদের দুজনেই এখন একটা সুবিশাল ধৈর্যের মধ্যে সময় কাটাতে হবে। আই জাস্ট স্মেল ইট।
লাঞ্চ খেতে তিনটে বেজে গেল। আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, ইন্দ্রনাথের ঠাণ্ডা ধরনের নির্লিপ্ত আচরণ সত্ত্বেও তার কাকিমা সর্বেশ্বরীদেবী আমাদের বিশেষ করে কর্নেলের প্রতি খুব ভদ্রতা দেখালেন। কিন্তু একটু বিসদৃশ মনে হলো দুই ভায়ের পরস্পর আচরণ। ইন্দ্রনাথ ও সৌমেন্দু পরস্পর বাক্যালাপ পর্যন্ত করলেন না। সর্বেশ্বরীর সঙ্গের ভদ্রলোক সেই ইঞ্জিনিয়ার এবং খনি-বিশারদ, যিনি জগদীপের মৃত্যুর সময় এখানে ছিলেন এবং খনিমুখ বন্ধ করার উপায় বাতলাতে এসেছিলেন। সেই বৃদ্ধের নাম অনন্তরাম শর্মা। মহীশূরের লোক। জগদীপের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন।
কর্নেলের যা স্বভাব, এই তিনজন নবাগতের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তুলতে দেরি হলো না। লাঞ্চের টেবিলে কর্নেলের অনুরোধে সর্বেশ্বরীও বসলেন। কিন্তু তিনি নিরামিষ খান। আলাদা ব্যবস্থাও ছিল। নিঃসঙ্কোচে খেলেন এবং তাঁর স্বামীর কার্যকলাপ সম্পর্কে গল্পও করলেন। মনে হলো, ভদ্রমহিলার প্রভুত্ব করার ক্ষমতা অসাধারণ এবং রীতিমতো শিক্ষাদীক্ষা আছে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ইন্দ্রনাথ তিনটে ছিপ নিয়ে চলে গেলেন হ্রদের দিকে। আমাদের দুজনকে ডেকেও গেলেন। কর্নেল বললেন–খাওয়ার পর আধঘণ্টা জিরিয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস, মিস্টার রায়। আপনি চলুন। আমরা দুজনে যাচ্ছি।
বুঝলাম, আমাকেও কর্নেলের সঙ্গে জিরিয়ে নিতে হবে।
সৌমেন্দুকে দেখলুম লনে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। বারান্দার চেয়ারে আমরা চারজন বসে আছি-কর্নেল, সর্বেশ্বরী, মিঃ শর্মা আর আমি। সর্বেশ্বরী বলছিলেন–তা বুঝলেন কর্নেল? স্বপ্ন দেখার পর তো আমি অস্থির হয়ে উঠলুম। তখনই টেলি করে দিলুম মিঃ শর্মাকে। সৌমেন্দুকেও খবর দিলুম মিঃ শর্মাকে নিয়ে সে যেন অপেক্ষা করে। তারপর…
কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন–একটা ছোট্ট প্রশ্ন মিসেস রায়। জাস্ট একটা কৌতূহল। ইন্দ্রনাথকে আপনি কথাটা নিশ্চয় জানাননি?
সর্বেশ্বরী গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেন–দেখুন কর্নেল সরকার, ব্যাপারটা অবশ্য পারিবারিক এবং প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। কিন্তু আপনাকে বলতে সংকোচের কারণ দেখি না। ইন্দ্রনাথকেই প্রথমে কথাটা বললুম–। কিন্তু ও বরাবর অবিশ্বাসী-নাস্তিক। ও উড়িয়ে দিল। বলল–একটা পোডড়া খনির গর্ত বুজিয়ে ফেলতে একগাদা টাকা খরচা হবে। এর কোনও জাস্টিফিকেশন নেই। ইন্দ্রনাথ গোঁ ধরে বসে রইল। তখন আর কী করি বলুন! প্রত্যক্ষ স্বপ্নে দেখলুম, উনি বলছেন পিট তিনটে শীগগির বন্ধ করে দাও। সাধুবাবা চলে গেছেন!
কর্নেল মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন-রাইট, রাইট মিসেস রায়। মিঃ শর্মাকে জিজ্ঞেস করছি। মিঃ শর্মা কীভবে পিট বন্ধ করবেন, নিশ্চয় প্ল্যান করেই এসেছেন?
শর্মা বললেন–অবশ্যই। সঙ্গে ডিনামাইট নিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধে হবে না। এখন আগে একবার গিয়ে জায়গাটা দেখতে হবে কী অবস্থায় আছে। পাঁচ বছর আগে যেমন দেখেছি, তেমন না থাকতেও পারে। কারণ, বুঝতেই পারছেন–প্রকৃতি সবসময় নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ওলট-পালট ঘটাচ্ছে।…বলে শর্মা হাসতে থাকলেন।