কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন–ছিল! এখন সেটা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। মিঃ রায়। কিন্তু একটা কথা–আপনার কাকিমা আপনাকে বাধা দেবেন না?
ইন্দ্রনাথ বললেন–নিশ্চয় দেবেন। কিন্তু আমি এবার যেভাবে হোক, যাবই কর্নেল। জায়গাটা এত সুন্দর, এত নির্জন, ভাবা যায় না। আমার স্মৃতি আমাকে উত্যক্ত করে মারছে। কাকিমাকে গোপন করেই যাব।
কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–জয়ন্ত! আশা করি, ইতিমধ্যে তুমি ঞ্চল হয়ে উঠেছ! মনশ্চক্ষে চিরিমিরি হ্রদের অপূর্ব সৌন্দর্য এবং রুপোলি মৎস্য অবলোকন করছ!
ইন্দ্রনাথ বললেন–তাহলে দুজন নয় কর্নেল, তিনজন মিলে যাব। জয়ম্বাবুকেও আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
কর্নেল হেসে বললেন রাইট, রাইট। তারপর অস্ফুটস্বরে বাচ্চা ছেলের মতো সেই ছড়াটা আওড়াতে থাকলেন :
খোকন গেছে মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কুলে…
.
চিরিমিরি পাহাড়ের বাংলোটির নাম ‘দা সোয়ান’। দূর থেকে ধূসর এই পুরনো বাংলোটিকে সত্যি একটা রাজহাঁসের মতো দেখায়–যেন মাঝে মাঝে রাজহাঁসটা জ্যোৎস্নারাতে হ্রদে সাঁতার কেটেও যায়। বাংলোর গেট থেকে একফালি সরু পথ ঘুরে ঘুরে হ্রদে নেমেছে। যেখানে নেমেছে, সেখানে কয়েক ধাপ পাথর বাঁধানো আছে ঘাটের মতো। পথের দুধারে গাছপালা ঝোপঝাড় আছে। পথটাও এবড়োখেবড়ো অব্যবহৃত হয়ে রয়েছে অনেক বছর। ফাটলে ঘাস বা আগাছা গজিয়েছে। আমরা দুপুর নাগাদ তিনজনে পৌঁছুলে কেয়ারটেকার রঘুবীর সিং তক্ষুনি কয়েকজন আদিবাসী লাগিয়ে সব সাফ করার ব্যবস্থা করল। ঘাটের পাথরগুলোয় শ্যাওলা জমে ছিল। তাও সাফ করা হলো। লাঞ্চের আগে কর্নেল স্বভাবমতো চারপাশটা দেখতে বেরিয়ে গেলেন–সঙ্গে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা নিতেও ভুললেন না। আমাকে ডাকলেন না দেখে অভিমান হলো–অবশ্য ডাকলেও যেতুম না, সারাদিন সারারাত ট্রেনজার্নির পর তখন খুব ক্লান্ত আমি। বিছানায় গড়াচ্ছি। কর্নেলকে ইন্দ্রনাথ সাবধান করে দিলেন এলাকার জঙ্গলে বুনো হাতি আছে অজস্র। বাঘ ভালুকও কম নেই। কর্নেল ঘাড় নাড়লেন মাত্র।
বাংলোর ঘরগুলো এসেই দেখা হয়েছে। পাঁচঘানা ঘর আছে। একটা কিচেন কাম-ডাইনিং-প্লাস ড্রয়িং রুম, একটা বাথরুম-প্রিভি, বাকি তিনটে শোবার ঘর। থাকার ব্যবস্থায় কোনও ত্রুটি নেই। ইন্দ্রনাথ খবর পাঠিয়ে সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দান সিং নামে ওঁদের পুরনো রাঁধুনিও অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। এবার সে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে কাজে লেগে গেল। আমাদের সঙ্গে তিনখানা হাল্কা মজবুত বিলিতি ছিপ, চার এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রয়েছে। ইন্দ্রনাথ আমাকে ছিপ ফেলার ঘাট দেখতে ডাকলেন একবার। কিন্তু আমার ক্লান্তি লক্ষ্য করে শেষে একজন লোক সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন।
একটু পরে বারান্দায় গিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে থাকলুম। হ্রদটা বিশাল। সামনে উত্তরে রয়েছে সেটা। পশ্চিমে মোটামুটি সমতল জায়গায় ওঁদের পোড়ো খনি–এখন জঙ্গল গজিয়ে গেছে। পুবে এবং উত্তরে যতদূর চোখ যায়, শুধু জল। দিগন্তরেখায় কিছু নীল পাহাড়। উত্তরেও পাহাড়–সেগুলো কাছে বলে মনে হলো। বাংলোটা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে–এটা হ্রদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ-ঘেঁষা। রঘুবীর এসে সব দেখাল। বাংলোর পিছনে আরেকটা রাস্তা আছে–সেটা চলে গেছে খনিতে। বাংলা থেকে সিকি কিলোমিটার দূরে রাস্তাটা দুভাগ হয়েছে ডাইনে চলে গেছে খনির দিকে। বাঁয়ে গিয়ে মিলেছে একটা ঢালু বড় সড়কে মাইল পাঁচেক দূরে। ওই পথেই আমরা টাঙ্গায় চেপে এসেছি। সড়কটা নদী পেরিয়ে পুবে বরটুঙ্গা স্টেশন হয়ে জব্বলপুরের দিকে চলে গেছে।
রঘুবীর বলল কী ছিল জায়গাটা, কী হয়ে গেল! কত লোকজন– কত আওয়াজ–সবসময় গমগম করত। আমি স্যার, সেই এসেছিলুম রায়সায়েবের সঙ্গে পাঁচ সাল আগে। উনি তো মারা গেলেন। তারপর আমিও চলে গেলুম। আমার মনে বড় কষ্ট হত স্যার। কিন্তু ওনারা ছাড়বেন না। বাংলোর জিম্মাদারি করতে হবে। তো আমার ছেলেই এখানে এসে মাঝে মাঝে দেখাশোনা করে যেত। খুব সাসহী ছেলে স্যার! আমার তো এ বয়সে এই ভূতের আড্ডায় থাকার সাহসই ছিল না। লেকিন দেখুন, আমার ছেলের একচুল ক্ষতি হয়নি। ভূতও নাকি দেখা দেয়নি। তবে…
ও থামলে জিগ্যেস করলুম–তবে?
–ছেলে বলত, খনির ওদিকে আলো জ্বলতে দেখেছে। ওর ধারণা ওসব আলো জেলেদের। রাতে মাছ ধরতে আসে জেলেরা।
–আচ্ছা রঘুবীর, রায়সাহেব মারা যাবার সময় তো তুমি এখানে ছিলে?
জী হুজুর।
–তুমি কি মনে করো উনি হার্টফেল করেই মারা যান?
রঘু গম্ভীর হয়ে বলল–জী হাঁ। আচানক কিছু আজগুবি দেখলে তো হার্টফেল করবেই! আমার মালুম, রায়সাহেব সেই সাধুকে দেখতে পেয়েছিলেন। সাধুর রাগ হয়েছিল। কেন? না–খনির গর্ত বন্ধ করে দেবেন রায়সাহেব। সাধুর ভয়ঙ্কর চেহারা দেখেই মারা যান উনি।
–তাহলে বলছ, খনির মধ্যে কৈানও সাধু ছিলেন? তাকে কেউ দেখেছিল নাকি?
–জী হ্যাঁ। মাইজি দেখেছিলেন।
–তুমি?
রঘুবীর একটু চুপ করে থেকে বলল–স্যার, বিশ্বাস করেন তো বলি। আমি একদিন সন্ধ্যাবেলায় এক পলকের জন্যে দেখেছিলুম। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। তারপর–আর নেই! বিলকুল হাওয়া।
বল কী রঘুবীর!
হ্যাঁ স্যার। দেখামাত্র গর্তে সেঁধিয়ে গেলেন। মনে মনে হেসে সিগারেট ধরালুম। রঘুবীর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। একটু পরে শুনি বাংলোর পিছন দিকে গাড়ির আওয়াজ হচ্ছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য লন ঘুরে পিছনে যেতেই দেখলুম, একটা জিপ থেকে আমার বয়সী একজন যুবক নামল–চোখে সানগ্লাস, পিঠে বন্দুক। তারপর নামলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। কর্নেলের বয়সী। তবে কর্নেলের মতো টাক বা দাড়ি নেই। শেষে নামলেন এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। পোশাক দেখেই চমকে উঠলুম। বাঙালী বিধবা। তাহলে কি হঠাৎ ইন্দ্রনাথের সেই কাকিমা এসে পড়লেন? সর্বনাশ!